জীবন যখন ফুরিয়ে যায়
ভিসি আর-এ অমরসঙ্গীর ক্যাসেট চালিয়ে দেখছিলেন কল্যাণ চৌধুরি। সারাটা সন্ধে একঘেয়েভাবে কেটেছে। অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পর থেকেই এই একঘেয়েমির শুরু। অজন্তা বাড়ি না থাকলে এরকমটাই হয়। আজও ও বাড়ি নেই। আজ সকালেই অফিসের মিটিং-এ দিল্লি গেছে। চারদিন পর ফিরবে। মনে মনে আজকের একঘেয়েমিকে চার দিয়ে গুণ করলেন কল্যাণ। অঙ্কের তত্ত্ব ওলটপালট করে দিয়ে গুণফল বেরোল চল্লিশ। রঙিন টিভি-র পরদায় তখন একটি যুবক একটি যুবতাঁকে প্রাণপণে প্রেম নিবেদন করে চলেছে। চিরদিনই তুমি যে আমার… ইত্যাদি একটা গানও হচ্ছিল। কল্যাণ হাসলেন মনে মনে। ছাব্বিশ বছর আগে তার বয়েস ছাব্বিশ বছর ছিল। তখন এরকম গানের বয়েস থাকলেও গান করেননি ঠিকই, তবে বাকি কাজটুকু করেছেন। প্রাণপণে প্রেম করেছেন অজন্তার সঙ্গে।
এমন সময় ঘরের এককোণে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল।
সোফা ছেড়ে উঠলেন কল্যাণ। টিভি-র ভলিয়ুম কন্ট্রোলের নব ঘুরিয়ে শব্দ কমিয়ে দিলেন। তারপর তাড়াতাড়ি পা ফেলে টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলেন। টেলিফোনটা আসায় তার ভালো লাগছে। একঘেয়েমির শান্ত পুকুরের জলে কেউ যেন একটা পাথর ছুঁড়ে জল তোলপাড় করার চেষ্টা করছে।
হ্যালো
মিস্টার কল্যাণ চৌধুরি? সল্ট লেক সিটি? একটা ভারী কণ্ঠস্বর নিপ্রাণ গলায় ওপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন করল।
অচেনা গলা। সম্পূর্ণ অকারণেই কল্যাণের বুকের ভেতরটা আচমকা টিপটিপ করতে শুরু করল।
হ্যাঁ, আমি কল্যাণ চৌধুরি বলছি। কী হয়েছে? আপনি কে বলছেন? কথা বলতে গিয়ে কল্যাণের গলা কেঁপে গেল।
লালবাজার থেকে বলছি। আপনার ওয়াইফের নাম মিসেস অজন্তা চৌধুরি?
হ্যাঁ। কী হয়েছে অজন্তার?
আপনি বাড়িতে থাকুন। এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা আপনার বাড়ি যাচ্ছি।
কল্যাণ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ওপ্রান্তের রিসিভার নামিয়ে রেখেছে। ভারী কণ্ঠস্বরের মালিক।
রিসিভার জায়গামতো রেখে দিয়ে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো কোয়ার্জ ঘড়ির দিকে তাকালেন কল্যাণ। পৌনে নটা। এক ঘণ্টার মধ্যে ওঁরা আসছেন। কল্যাণের বুকের ভেতরে একটা বড় পাথর নিষ্ঠুরভাবে চুরমার করছিল কেউ। কী হয়েছে অজন্তার!
ভি সি আর-এর সুইচ অফ করে দিলেন কল্যাণ। একই সঙ্গে মনে হল তার ভেতরেও কেউ যেন একটা সুইচ অফ করে দিয়েছে।
অজন্তা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করে ক্যামাক স্ট্রিটের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কম্পিউটেক লিমিটেড-এ। আর কল্যাণ আর্কিটেক্ট হিসেবে মোটামুটি নাম করেছেন। সল্ট লেকে এ পর্যন্ত এগারোটা শৌখিন বাড়ি তৈরি করেছেন। তার অফিস কঁকুড়গাছিতে। পাঁচজন স্টাফ নিয়ে ছোট হলেও সফল ব্যবসা।
সুতরাং স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ব্যস্ত থাকেন নিজেদের কাজ নিয়ে। কিন্তু অফিসের বাইরের সময়টুকু একসঙ্গে কাটানো ওঁদের বহুদিনের অভ্যেস। অজন্তাকে প্রায়ই অফিসের মিটিং-এ বম্বে, দিল্লি, মাদ্রাজ করে বেড়াতে হয়। গত তিন বছরে এই মিটিং-এর ব্যাপারটা বেশ বেড়ে গেছে। ফলে অজন্তা না থাকলে কল্যাণ কেমন একা হয়ে যান। গত বাইশ বছরের চেষ্টাতেও ওঁদের দুজনের সংসারে তিনজন হননি। অজন্তা অনেকবার বিশদ ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য বলেছে, কিন্তু কল্যাণ রাজি হননি। বলেছেন, কী হবে ডাক্তারি পরীক্ষা করে, অজন্তা! পরীক্ষার রিপোর্টে জানা যাবে, হয় তুমি দোষী, নয় তো আমি। কিংবা দুজনেই। যদি তুমি বা আমি দোষী হই তা হলে জেনো আমাদের একজন নির্ঘাত ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্সে ভুগবে। আমাদের এতদিনের সুন্দর সম্পর্কে চিড় ধরে যাবে। বাইরে থেকে সেটা বোঝা যাবে না, তবে ভেতরে ভেতরে থাকবে। সুতরাং এই বেশ ভালো আছি, ডার্লিং।
অজন্তা রাজি হয়েছে কল্যাণের প্রস্তাবে। হেসে বলেছে আমরা দুজন ছিলাম, দুজন আছি, দুজনই থাকব। কোনও থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারের জায়গা নেই এখানে, কী বলো!
কল্যাণ ওকে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছেন। বলেছেন, অজন্তা-ইলোরাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
অজন্তাকে প্রায়ই কল্যাণ মজা করে অজন্তা-ইলোরা বলে ডেকে থাকেন। সেই অজন্তা ইলোরার কোনও বিপদ হল নাকি!
কল্যাণ দোতলার ঘরে-বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। বাড়িটা এখন ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। রাতদিনের কাজের লোক পরাশর একতলায় ওর ছোট্ট ঘরটিতে বসে নিশ্চয়ই রেডিয়ো শুনছে। ঠিক সাড়ে নটা বাজলেই ও এসে খেতে দেবে কল্যাণকে। রোজকার রাঁধুনি-বউ গীতা এসে রান্না bast করে ফ্রিজে তুলে রেখে গেছে। পরাশর শুধু গরম করে নেবে। কিন্তু কল্যাণের এতটুকু খাওয়ার ইচ্ছা নেই। বারান্দায় ছুটে আসা হালকা বাতাসে অকারণেই তার শীত করছিল।
পরাশর যখন জিগ্যেস করতে এল খাবার দেবে কি না, তখন কল্যাণ সংক্ষেপে শুধু বলে দিলেন, খিদে নেই। তুই খেয়ে শুয়ে পড়। তারপর নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু অপেক্ষা। কখন একতলার কলিংবেলের সুইচে কেউ আঙুল ছোঁয়াবে, আর মিষ্টি সুরে বেজে উঠবে ইলেকট্রনিক ঘণ্টা।
কতক্ষণ পরে কে জানে, একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল, আর তারপরই বেজে উঠল কলিংবেল।
কল্যাণের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ল ভয়ঙ্কর শব্দে। প্রায় ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নীচে। পরাশর দরজা খুলতে যাচ্ছিল। ওকে ইশারায় চলে যেতে বলে কল্যাণ নিজেই সদর দরজা খুলে দিলেন।
দরজার কাছে লাগানো শৌখিন আলোয় একজন শক্তপোক্ত মানুষকে দেখা গেল। চোয়ালের রেখা স্পষ্ট। চৌকো মুখে অভিজ্ঞতার ছাপ। চওড়া গোঁফ। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। চোখা নাক। গায়ের রং মাজা।
আমরা লালবাজার থেকে আসছি। আপনি মিস্টার কল্যাণ চৌধুরি?
টেলিফোনে শোনা ভারী গলা চিনতে পারলেন কল্যাণ। কোনওরকমে মাথা নেড়ে ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাব দিলেন। তারপর অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আসুন, ভেতরে আসুন–
প্রথম ভদ্রলোককে অনুসরণ করে ফরসা রোগা চেহারার আর একজন মানুষ বাড়ির ভেতরে ঢুকে এল। ওকে হিসেবে ধরেই আমরা শব্দটা ব্যবহার করেছেন প্রথম জন।
কল্যাণের গলা শুকিয়ে আসছিল। কেশে গলা পরিষ্কার করে তিনি ওঁদের নিয়ে এলেন বসবার ঘরে। ওঁরা সোফায় বসামাত্রই কল্যাণ গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে জিগ্যেস করলেন, কী হয়েছে। একটু বলবেন?
প্রথমজন কোনওরকম ভণিতা না করে সরাসরি বললেন, খুব খারাপ খবর। আপনি মন শক্ত করুন।
দ্বিতীয় জন তখন ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছেন। তাঁর চোখেমুখে তারিফ করার ছাপ। কল্যাণের ড্রইংরুম সত্যিই প্রশংসা করার মতো। দেওয়াল আর আসবাবে মানানসই রং। এ ছাড়া দুটো অভিনব অয়েল পেইন্টিং আর একটা পিতলের ভাস্কর্য ঘরের সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কল্যাণের বুকের ভেতরে এবার ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় তিনি বললেন, বলুন–
অজন্তার নিশ্চয়ই কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মনে মনে ভাবলেন কল্যাণ। নাকি দিল্লিতে পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে কোম্পানির গেস্ট হাউসে যাওয়ার পথে কোনও গ্যাঙের হাতে পড়েছে? কিন্তু অজন্তার বয়েস তো প্রায় তেতাল্লিশ। অবশ্য দেখতে এখনও সুন্দরী। পুরুষদের নজর কাড়তে পারে এখনও। তা হলে কি নির্জন রাস্তায় ওর গাড়ি আটকে কোনও গুন্ডার দল…
মিস্টার চৌধুরি, আপনার স্ত্রী তমলুকের কাছে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। প্রথম জনের ভারী কণ্ঠস্বরে কোনও আবেগ নেই। যেন খবরের কাগজের খবর পড়ে শোনাচ্ছেন।
কল্যাণের চোখের সামনে ওঁর শৌখিন ড্রইংরুমটা মুহূর্তের মধ্যে মর্গ হয়ে গেল। বরফের দেওয়ালে ঘেরা একটা ঘরে কল্যাণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বরফের দেওয়াল থেকে ঘন সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে কল্যাণের নাকে-মুখে ঢুকে পড়ছে। কল্যাণের শরীরের ভেতরটা হিম হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
কল্যাণ চৌধুরির মাথা টলছিল। অজন্তা-ইলোরা আর নেই! চারপাশে আর কেউ নেই। কিচ্ছু নেই।
কল্যাণের গলার কাছে অনেক প্রশ্ন এসে জড়ো হল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন, কথা বলতে গেলেই একরাশ কান্না তাঁকে ভাসিয়ে দেবে। গলায় জমাট বেঁধে ওঠা শক্ত ডেলাটাকে দম বন্ধ করে নিয়ন্ত্রণে রেখে তিনি সর্বহারার ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন।
কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে! এক সময় কল্যাণের বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। দু-হাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি। অনেকক্ষণ ধরে তার শরীর থরথর করে কাপল। অফিসার দুজন কল্যাণকে বাধা দিলেন না। পাথরেরর মুখ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
অবশেষে নিজেকে খানিকটা সামলে নিতে পারলেন কল্যাণ। মুখ তুলে প্রথম অফিসারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী করে অ্যাক্সিডেন্ট হল?
উত্তরে জানা গেল, হাইওয়ের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল অজন্তা চৌধুরির গাড়ি। হঠাৎই একটা মালবোঝাই ট্রাক বেসামাল হয়ে গাড়িটাকে মুখোমুখি ধাক্কা মারে। চোখের পলকে সব চুরমার। এবং সব শেষ। ট্রাকের ড্রাইভার এবং খালাসি দুজনেই পালিয়েছে। অজন্তার হাতব্যাগ থেকে কল্যাণের একটা কার্ড পাওয়া গেছে। তাতে ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই ছিল। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ কল্যাণের সঙ্গে যোগযোগ করতে পেরেছে।
প্রথম জন যখন দুর্ঘটনার ব্যাপারটা বিশদভাবে বলছিলেন, তখনই কল্যাণ একটা ভয়ংকর ধাক্কা খেলেন।
অজন্তা তো অফিসের মিটিং-এ দিল্লি রওনা হয়েছিল! তা হলে তমলুকের কাছে ওর অ্যাক্সিডেন্ট হল কেমন করে! কোথায় দিল্লি, কোথায় তমলুক! কল্যাণের সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। অজন্তা, গাড়ি, তমলুক!
কল্যাণদের গাঢ় নীল মারুতি এখন, এই মুহূর্তে, বাড়ির গ্যারেজেই রয়েছে। তা ছাড়া অজন্তা তো গাড়ি চালাতে জানে না!
ওইরকম একটা ভয়ংকর মানসিক অবস্থার মধ্যেও কল্যাণ বুঝতে পারছিলেন, অজন্তার দিল্লিতে মিটিং-এ যাওয়ার নাম করে রওনা হওয়ার ব্যাপারটা এঁদের বলা যায় না। কাউকে বলা যায় না।
কিন্তু দিল্লির নাম করে, কল্যাণের কাছে মিথ্যে কথা বলে, অজন্তা হঠাৎ তমলুকের দিকে গেল কেন? আর কার গাড়িতে করেই বা ও যাচ্ছিল?
কল্যাণের মনে পড়ল, তমলুকের ওপর দিয়ে তিনি দুবার গেছেন অতীতে। দুবারই অজন্তাকে নিয়ে তিনি দীঘায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। একবার শৌখিন বাসের যাত্রী হয়ে, আর একবার গাড়িতে চড়ে। কল্যাণ নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন দীঘায়, সমুদ্রের কাছাকাছি।
অজন্তা কি তাহলে দীঘা যাচ্ছিল? কী কারণে যাচ্ছিল, বেড়াতে? কে চালাচ্ছিল গাড়ি? আর কে কে ছিল ওই গাড়িতে?
কল্যাণ চৌধুরির ভেতরে নানা রকমের ভাঙচুর চলছিল। গাড়িটা কি প্রাইভেট কার, না ট্যাক্সি? ট্যাক্সি ভাড়া করে কলকাতা থেকে কেউ দীঘা যায় না! তা হলে?
অজন্তা ছাড়া আর কে কে ছিল ওই গাড়িতে? কেমন এক শূন্যতার মধ্যে থেকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন কল্যাণ।
আর এক ভদ্রলোক ছিলেন গাড়িতে। উনিই গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
কল্যাণ অবাক চোখে প্রথম অফিসারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অজন্তা আর এক ভদ্রলোক! কে সে? অজন্তার প্রেমিক? অজন্তা বলত, ওঁদের দুজনের মাঝখানে আর কেউ নেই। তা হলে কে এই লোকটা? থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার?
কল্যাণ এলোমেলোভাবে আরও সব প্রশ্ন করে গেলেন। উত্তরে যেসব কথা তার কানে ঢুকল সেগুলো কেমন বুদবুদের মতো ভেসে উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছিল মাথার ভেতরে।
লাল রঙের মারুতি গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ওরা দুজনে। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই শেষ। গাড়িটা একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেছে। না, ওই ভদ্রলোকের কোনও পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে খোঁজখবর নেওয়ার কাজ চলছে। পুলিশ হাল ছাড়েনি।
আপনাকে আমাদের সঙ্গে তমলুক যেতে হবে, মিস্টার চৌধুরি। আপনার স্ত্রীর বডি আইডেন্টিফাই করতে হবে।
অনেক দিন পর একটু বেশি মাত্রায় মদ্যপানের সাধ জেগে উঠল কল্যাণের। অন্ধকার দোতলার বারান্দায় বসে চাঁদ-তারাকে সাক্ষী রেখে গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলেন তিনি। গাঢ় গাছপালা আর ঘন নীল ছায়াময় আকাশের দিকে শুন্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন। সেখানে অত্যন্ত দ্রুতগামী চলচ্চিত্রের ছবির মতো পরপর ভেসে যাচ্ছিল গত তিন দিনের ঘটনা।
পুলিশের সঙ্গে তমলুক গিয়ে অজন্তার মৃতদেহ–অথবা, বলা যায় মৃতদেহের অবশেষ শনাক্ত করতে কোনও অসুবিধে হয়নি কল্যাণের। মৃতদেহটা বলতে গেলে একরকম তালগোল পাকিয়ে গেছে। কিন্তু মুখটা কোন এক অলীক লীলায় প্রায় অক্ষত থেকে গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল, একটু জোরে অজন্তা-ইলোরা বলে ডাকলেই বোধ হয় জেগে উঠবে। আর মুখে কোথাও অপরাধবোধের ছায়া পর্যন্ত নেই।
শুধু মুখ ছাড়াও অনেক কিছু শনাক্ত করেছেন কল্যাণ। পায়ের চটি, কানের দুল, গলার হার, লেডিজ ব্যাগের টুকিটাকি জিনিসপত্র, আরও কত কী! ভেবেছিলেন, এতটুকুও দুর্বল হবেন না, কিন্তু চোখের জলের ফোঁটাগুলো কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! সামান্যতম সুযোগেই কল্যাণের চোখ ভাসিয়ে গড়িয়ে পড়েছে গালে। ভালোবাসা বড় নিষ্ঠুর। সুযোগ পেলেই কাদায়।
শনাক্ত করার পর বেশ কয়েক ঘণ্টা যখন কেটে গেছে, তখন কল্যাণের মনের ভেতরে কৌতূহল ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিল। যে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল তার মৃতদেহটা কোথায়? সেটারও কি মুখটা অবিকৃত রয়েছে অজন্তার মতো? কল্যাণ কি মুখ দেখলে চিনতে পারবেন লোকটাকে?
অফিসারদের প্রশ্ন করে তিনি জানতে পারলেন, পুরুষ সহযাত্রীটির মৃতদেহ এতই বীভৎসভাবে গুঁড়িয়ে গেছে যে, চেনার কোনও উপায় নেই। তবুও পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, নানান কায়দায় খোঁজখবর করছে।
শূন্য হাতে শূন্য হৃদয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছেন কল্যাণ। অফিসে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন কিছুদিনের জন্য। শূন্য বাড়িতে তার ভালোবাসার অশৌচ শুরু হয়ে গেল।
অনেক রাত পর্যন্ত মদের গ্লাসে চুমুক দিলেন কল্যাণ।
অজন্তার মৃতদেহ কলকাতায় এসেছে, পোস্ট মর্টেম হয়েছে, তারপর দাহ করা হয়েছে নিমতলা শ্মশানে। উভয়পক্ষের কয়েকজন করে আত্মীয়স্বজনকে সাক্ষী রেখে অজন্তা পুড়ে ছাই হয়েছে। শেষ হয়েছে অসতীদাহ। কিন্তু কল্যাণের বুকের ভেতরটা তখনও জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল।
অজন্তা যে অফিসের মিটিং-এ দিল্লি যাচ্ছি এ কথা বলে গিয়েছিল, সে কথা কাউকে বলেননি কল্যাণ। কেউ জানে না ওঁদের জীবনে অজ্ঞাত সেই তৃতীয় ব্যক্তির কথা। অজন্তা নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছিল সেই লোকটার সঙ্গে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রেম করতেই বোধ হয় ওরা দীঘা রওনা হয়েছিল।
কল্যাণ জানেন, ভালোবাসলে অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করে–সেগুলোই শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় প্রেমপত্র। অজন্তার আলমারিতে সেরকম কি কিছু নেই? একটাও কি চিঠি লেখেনি দুর্ঘটনার মরে যাওয়া তালগোল পাকিয়ে যাওয়া ওই লোকটা।
অসহ্য এক জ্বালায় নেশা-টেশা ছেড়ে উঠে পড়লেন কল্যাণ। একটু এলোমেলো পায়ে চলে এলেন শোবার ঘরে পাশাপাশি দাঁড় করানো দুটো স্টিলের আলমারির কাছে। একটা আলমারিতে কল্যাণের জিনিসপত্র, অন্যটায় অজন্তার। গোড়ার দিকে এই ভাগাভাগিটা বজায় ছিল। কিন্তু পরে কিছু কিছু জিনিস এলোমেলোভাবে রাখা হয়ে গেছে। আর তার জন্য কল্যাণ নিজেই দায়ী। কারণ, অজন্তা যতটা গোছানো স্বভাবের, কল্যাণ ঠিক ততটাই অগোছালো।
অজন্তার আলমারির দরজায় দুটো কালো টিপ লাগানো রয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতেও এরকম দু-একটা টিপ লাগানো থাকে। ওর ফরসা কপালে কালো টিপ চমৎকার মানাত। কল্যাণ এক লহমার জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
আলমারিটা খুলতেই হালকা পারফিউমের গন্ধ নাকে এল কল্যাণের। অজন্তা ওর শাড়ি জামাকাপড়ে মাঝে-মাঝেই পারফিউম স্প্রে করে রাখত। পয়জন পারফিউমের গন্ধ খুব ভালোবাসত ও। আলমারির দু-পাল্লা খুলে অনেক সময়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। বুক ভরে সুগন্ধির ঘ্রাণ নিত। গন্ধটা কল্যাণেরও প্রিয় ছিল।
এখন আলমারি খুলতেই পয়জন-এর গন্ধ অন্যরকমভাবে কল্যাণের নাকে এসে ধাক্কা মারল। কল্যাণের গা গুলিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি অনুসন্ধানের কাজ শুরু করলেন তিনি। একটা চিঠিও কি পাওয়া যাবে না?
একটু খোঁজাখুজি করতেই চিঠির গোছাটা পাওয়া গেল। কতকগুলো দামি শাড়ির ভাজের তলায়, আলমারির পিছনের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা ছিল চিঠিগুলো। অনেকগুলো চিঠি–অন্তত কুড়ি পঁচিশটা তো হবেই। তারই একটা টেনে বের করলেন কল্যাণ। লক্ষ করলেন, এক অকারণ উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। নিজেকে সি আই এ বা কে জি বি-র গুপ্তচর বলে মনে হচ্ছিল। অথচ কারও হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। অজন্তা নেই, সে-ও নেই।
বোধহয় নিজের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন কল্যাণ। এ কদিন যা নিছক আশঙ্কা অথবা অনুমান ছিল এখন আর তা নয়। হাতে এসেছে অকাট্য প্রমাণ। চিঠিটা খামসমেতই রেখে দিয়েছে অজন্তা। খামের ওপরে সুন্দর হাতের লেখায় মিসেস অজন্তা চৌধুরী এবং ঠিকানা লেখা রয়েছে।
কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলেন কল্যাণ। আবেগজর্জর এলোমেলো লেখা। আপনি সম্বোধনে লেখা হলেও প্রেমপত্র বলে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হয় না। আর চিঠির কিছু কথা পড়লে বেশ অনুমান করা যায় ওরা পরস্পরের যথেষ্ট কাছাকাছি এসেছে। হয়তো আরও কাছে আসার জন্য ওরা দীঘা যাচ্ছিল।
চিঠিটা খুলে ধরামাত্রই কল্যাণ চৌধুরীর চোখ বিদ্যুতের মতো ছিটকে চলে গিয়েছিল একেবারে শেষের লাইনে–যেখানে লেখকের নাম লেখা আছে। নামটা পড়লেন কল্যাণ ও কাজল। না, এ নামে সেভাবে কাউকে চেনেন না তিনি।
একটা একটা করে বেশ কয়েকটা চিঠি পড়ে ফেললেন কল্যাণ। কোনওটায় তুমি আর কোনওটায় আপনি সম্বোধন। তবে চরিত্র সব চিঠিরই এক। কিন্তু কোনও চিঠি থেকেই লেখকের স্পষ্ট পরিচয়ের কোনও সূত্র বেরিয়ে এল না। শুধু এটুকু অনুমান করা গেল, ভদ্রলোক কোনও একটি কোম্পানির দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন মানে, ছিলেন। বহু চেষ্টা করেও সেই কোম্পানির নাম কিংবা ঠিকানা কল্যাণ আঁচ করতে পারলেন না।
চিঠিগুলো আবার জায়গামতো রেখে দিয়ে আলমারি বন্ধ করে দিলেন কল্যাণ। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এখন এই চিঠিগুলোর মালিক। অজন্তা দুর্ঘটনার মারা গিয়ে তাকে অনেক জ্বালা, যন্ত্রণা, লজ্জা এবং অস্বস্তির মালিক করে দিয়ে গেছে।
গতকাল দুটো খবরের কাগজে এই দুর্ঘটনার খবর ভারী অদ্ভুতভাবে ছাপা হয়েছে। কাগজের তিনের পাতায় অজন্তার নাম এবং বয়েস দিয়ে চার লাইনের একটি খবর ছাপা হয়েছে। আর তার সামান্য নীচেই ছাপা হয়েছে দ্বিতীয় একটি দুর্ঘটনার খবর। তাতে বলা হয়েছে, তমলুকের একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। ভদ্রলোক নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রাকের সঙ্গে তাঁর গাড়ির মুখোমুখি ধাক্কা লাগে।
বাঃ! চমৎকার! একটা দুর্ঘটনাকে কী অনায়াসে দু-দুটো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনায় দাঁড় করানো হয়েছে! এর পিছনে কোন কারসাজি কাজ করছে কে জানে! এর মধ্যে নিশ্চয়ই পুলিশ অথবা চতুর সাংবাদিকদের হাত রয়েছে। কিন্তু কল্যাণ কিছুতেই ভেবে পাননি, একটা দুর্ঘটনাকে দুটো আলাদা দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টার কারণ কী!
আবার অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন কল্যাণ চৌধুরী। অন্ধকার আকাশ, চাঁদ-তারা, আর কয়েকটা গাছের ভৌতিক ছায়ার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মনে হল, ওরা সবাই তার লজ্জার কথা জানে। কিছু একটা করার জন্য কল্যাণ ভেতরে ভেতরে জানোয়ারের মতো ছটফট করছিলেন কিন্তু কী করবেন! অন্তত ওই খুনি ট্রাক ড্রাইভারটিকেও যদি হাতের কাছে পেতেন।
কল্যাণ প্রায় ছুটে চলে গেলেন রান্নাঘরে। সাদা রং করা ক্যাবিনেটের পাল্লা খুলে স্টেইনলেস স্টিলের একটা চপার বের করে নিলেন। এই মাংস কাটা ছুরিটা খুব একটা ব্যবহার করা হয়নি। কালো ফাইবার গ্লাসের হাতল। ঝকঝকে চওড়া ফলা। তার একদিকে করাতের ধারালো দাঁত।
ছুরিটা ডান হাতের শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে আবার বারান্দায় চলে এলেন কল্যাণ। পশুর হিংস্রতায় ছুরিটা ক্ষিপ্রভাবে বসিয়ে দিলেন বারান্দায় শৌখিন কাঠের রেলিং-এ। তারপর এক হ্যাঁচকায় গেঁথে যাওয়া ছুরিটা তুলে নিলেন। এবং দ্বিতীয়বার বসিয়ে দিলেন।
কল্যাণ চোখের সামনে অচেনা ট্রাক ড্রাইভারের নিষ্ঠুর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলেন। লোকটার লাল চোখ থেকে আগুন আর মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। এই লোকটা কল্যাণের জীবন খতম করে দিয়েছে। এই লোকটা না থাকলে কল্যাণ অজন্তার পরকীয়ার কথা জানতে পারতেন না। হয়তো তথাকথিত সুখে কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবনের বাকি দিনগুলো। কিন্তু… ।
বারান্দায় রেলিংটাকে কল্যাণ পাগলের মতো কুপিয়ে যাচ্ছিলেন বারবার। চাঁদের আলোয় ভোতা শব্দগুলো পরপর ভেসে যাচ্ছিল। কল্যাণের মুখ থেকে গোঙানির মতো টুকরো কিছু আওয়াজও বেরিয়ে আসছিল। কিন্তু কল্যাণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রতিশোধ নেবার জন্য একজন শত্রু এই মুহূর্তে তার কাছে খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংবিৎ ফিরে পেলেন পরাশরের ডাকে।
দাদাবাবু–
কল্যাণের হাত থেমে গেল। ভাঙাচোরা মুখে তাকালেন আধো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা পরাশরের দিকে। তারপর কী যে হয়ে গেল! ছুরিটা ফেলে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত রেলিংটাকে আঁকড়ে ধরে চাঁদের আলোয় হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। জীবনটা তার শেষ হয়ে গেলেও কোথায় যেন একটু গ্লানিময় অবশেষ থেকে গেছে।
অজন্তার অকালমৃত্যুর অনুষ্ঠান একেবারে নীরবে শেষ করলেন কল্যাণ চৌধুরী। সেই সময়ে, যখন তার চোখ জলে ভেসে যাওয়ার কথা, তিনি ফুলের মালা, ধূপ আর অজন্তার ফটোর দিকে তাকিয়ে কাজল লোকটার কথা ভাবছিলেন। লোকটার পরিচয় না-জানা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। সুতরাং সেই মুহূর্তেই তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, আগামীকাল থেকেই কাজলের খোঁজ শুরু করবেন।
লালবাজার থেকে যে দুজন অফিসার তার সঙ্গে প্রথম দিন যোগাযোগ করেছিলেন তাদের নাম বিনয় তালুকদার আর অভিজিৎ দাস।
তবে তালুকদারই বরাবর কথাবার্তা চালিয়েছেন কল্যাণের সঙ্গে। তাই শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারটা মিটে যেতেই কল্যাণ দেখা করলেন বিনয় তালুকদারের সঙ্গে।
আপনারা এখনও জানতে পারেননি, ওই লোকটা কে?
তালুকদার একটা মোটা ফাইল উলটে-পালটে দেখছিলেন। পাখার হাওয়ায় ফাইলের কাগজ উড়ছিল। হাত দিয়ে সেটা ঠিক করে নিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলেন, নাঃ, এখনও পারিনি।
কল্যাণের কেন যেন মনে হল তালুকদার সত্যি কথা বলছেন না। তাই তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া গাড়িটার নম্বর থেকে কোনও খোঁজখবর করেননি আপনারা?
তালুকদার খোলা ফাইলটা শব্দ করে বন্ধ করে কল্যাণের চোখে সরাসরি তাকালেন। তার নজরে স্পষ্ট বিরক্তি। একটা জলের মতো সহজ ব্যাপার কেউ বুঝতে না পরলে যে ধরনের বিরক্তি হওয়া স্বাভাবিক।
ছোট ছোট চোখের কোণে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তুললেন বিনয় তালুকদার, বললেন, মিস্টার চৌধুরি, আপনি কি এখনও ছেলেমানুষ সেজে বসে থাকবেন! বলুন তো মশাই, ওই লোকটার নাম ধাম জেনে আপনার কী লাভ!
কল্যাণ জেদি সুরে বললেন, ওই লোকটার জন্যে আমার স্ত্রী মারা গেছে।
তালুকদার শ্বাস ফেলে চোখ বুজে মাথা নাড়লেন। তারপর খানিকটা খোঁচা দিয়ে বললেন, ওই লোকটার জন্যে আপনার বউ মারা গেছে! আপনি এখনও বোঝেননি ওরা গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিল..কেন যাচ্ছিল?
কল্যাণকে একটু সময় দিলেন তালুকদার। যখন দেখলেন কল্যাণ কোনও উত্তর দিচ্ছেন না, তখন বললেন, মিস্টার চৌধুরী, এটা সুইসাইড বা মার্ডার কেস নয়–প্লেন অ্যাকসিডেন্ট। সুতরাং এ-নিয়ে আর ফালতু মাথা ঘামাবেন না। শুধু শুধু খুঁচিয়ে স্ক্যান্ডাল করে লাভ কী! সব কিছু যখন মিটে গেছে তখন বাদ দিন। একটা হাই তুলে তালুকদার বললেন, আমরা তো ফাইল ক্লোজ করে দিয়েছি। যান, বাড়ি যান।
শেষ কথাটা রুক্ষভাবে বললেন বিনয় তালুকদার। এবং কথাটা বলেই টেবিলের বাঁদিকে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাবার্তায় মনোযোগ দিলেন। অর্থাৎ, কল্যাণ এবার যেতে পারেন।
কল্যাণ অপমানটা টের পেলেন। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন একবার। অন্তত পাঁচ ছজন লোক রয়েছে ঘরে। তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই শুনেছে ওঁদের কথাবার্তা। এখন কী করবেন কল্যাণ? তালুকদারকে বাড়তি কিছু বলতে গেলে তিনি যদি একঘর লোকের মাঝখানে অজন্তার ব্যাপারটা নোংরাভাবে খোলাখুলি বলতে শুরু করেন।
কল্যাণ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিছু বলবেন না ঠিক করেছিলেন, কিন্তু তবুও তার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল।
ওই লাল মারুতির নম্বরটা আপনারা তা হলে পাননি?
লেজে পা দেওয়া সাপের মতো চকিতে কল্যাণের দিকে মুখ ফেরালেন বিনয় তালুকদার। স্থির চোখে কল্যাণকে কিছুক্ষণ দেখলেন। মানুষটাকে দেখে বোধ হয় মায়া হল তাঁর। তাই ঠান্ডা গলায় শুধু বললেন, না। পাইনি।
ঘোর লাগা মানুষের মতো আনমনা পা ফেলে কল্যাণ চৌধুরি বেরিয়ে এলেন লালবাজার থেকে। চারপাশের যানবাহন মানুষজন কিছুই তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। একটা আগুনের গোলা তার মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যে করে তোক ওই লাল মারুতির নম্বরটা তার চাই। তারপর, গাড়ির নম্বরের সূত্র ধরে কাজলের পুরো নাম-ঠিকানা। তারপর…। তারপর যে কী সেটা কল্যাণ নিজেই ভালো করে জানেন না। কাজল আর বেঁচে নেই। অজন্তাও নেই। তা হলে শূন্য ভাগশেষ থেকে কল্যাণ নিজের জন্য নতুন করে আর কোন শূন্যতা তৈরি করবেন!
আশ্চর্য! এতসব স্পষ্ট করে বোঝা সত্ত্বেও কল্যাণের ভেতরে একরোখা একটা আক্রোশ কাজ করছিল। ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো কাজলের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য ছটফট করছিলেন তিনি–মরণাপন্ন কোনও মানুষ জীবনকে ধরে রাখার জন্য যেভাবে ছটফট করে।
দাদা কত টাইম হয়েছে?
ট্রামরাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখ তুলে তাকালেন কল্যাণ। একজন ভদ্রলোক তার কাছে সময় জানতে চাইছেন। গোলগাল ফরসা চেহারা। সরু গোঁফ। পাতলা চুল। চোখে চশমা। পরনে পরিচ্ছন্ন শার্ট-প্যান্ট। বয়েস কল্যাণের কাছাকাছি। তবে হাতে ঘড়ি নেই।
কাজলকে কি খানিকটা এইরকম দেখতে? মানে, এইরকম দেখতে ছিল. তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার আগে?
কল্যাণ অদ্ভুত চোখে ভদ্রলোককে দেখছিলেন। এই মুখের ছবিটাকে একটু-আধটু ঠিকঠাক করে নিলে কি কাজলের মুখটা পাওয়া যাবে না?
ভদ্রলোক তার প্রশ্নের কোনও উত্তর না পেয়ে ভুরু কুঁচকে কল্যাণের দিকে বিরক্তির দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। অকারণে অপেক্ষা করার সময় তার নেই। কিন্তু কল্যাণের আছে। অফুরন্ত অনন্ত সময়। সময় ছাড়া এখন তার হাতে আর কিছু নেই।
পুলিশ যখন ব্যাপারটা নিয়ে সহযোগিতা করবে না, তখন কল্যাণকে একাই কিছু একটা করতে হবে। সেই কিছু একটা কী? যেমন, অজন্তার অফিসে গিয়ে ওর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা যায়। নানান প্রশ্ন করা যায় অজন্তার আচার-আচরণ নিয়ে। কার সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল অজন্তার, এমনকী অফিসের মিটিং-এ দিল্লি যাচ্ছি বলে কার সঙ্গে দীঘার দিকে বেড়াতে যেতে পারে ও–এ-সব নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।
কিন্তু সমস্যা একটাই ও কী করে সকলের সামনে তিনি অজন্তার গোপন ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবেন! অন্তর্বাস কি চৌরাস্তায় বসে কাঁচা যায়! কাউকে কি বলা যায় কাজলের কথা!
অজন্তাকে একটা ডায়েরি উপহার দিয়েছিল কাজল। চিঠির গোছার নীচেই ছিল ডায়েরিটা। তার প্রথম পৃষ্ঠায় সুন্দর অক্ষরে লেখা আছে দুটি ছত্র ও ব্যক্তিগত বর্ণমালা লিখে যাও গোপন অক্ষরে,/মনচিহ্ন রেখে যাও প্রতিদিন নিজের স্বাক্ষরে।
কল্যাণ কখনও এ-ভাবে কাব্য করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেননি। তবে…।
অবাক হয়ে কল্যাণ খেয়াল করলেন, কখন যেন তিনি কাজলের সঙ্গে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন।
পথ চলতে চলতে চিঠিগুলোর নানান অংশ মনে পড়ছিল।
হয়তো আপনাকে সত্যিকারের ভালোবাসব বলেই আর কাউকে এতদিন সত্যিকারের ভালোবাসা হয়নি।
ভালোবাসায় যদি পরিণতি না থাকে তা হলে সে কি পূর্ণতা পায় না? সমাজ যে-ভালোবাসাকে স্বীকার করে না, তারই নাম কি ব্যভিচার? তা হলে আমাদের ইচ্ছের কোনও দাম নেই।
আমাদের সংসারী জীবনে তৃতীয়জনের আসাটা কি অন্যায়? আর যদি বা কেউ আসে, তা হলে দ্বিতীয়জনকে কি অস্বীকার করা হয়! আর তৃতীয় জনের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়াটা কি দুর্বল হৃদয়ের রোগলক্ষণ? জানো, নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে করে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে, আমি শেষ হয়ে গেছি।
আমাদের ভালোবাসা যদি নিতান্ত শরীরের আকর্ষণই হবে তা হলে কেন তুমি স্পর্শ করলেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়, কেন তোমাকে দেখামাত্রই বুকের ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলে খুশিতে তিনতলার সমান লাফিয়ে ওঠে, কেন আনন্দে আমার চোখে জল এসে যায়!
অজন্তা, চৈত্র মাসে আমাদের প্রথম দেখা হয়নি, তবে সর্বনাশ দেখেছিলাম পরস্পরের চোখে। বুঝলে, সর্বনাশ বোধ হয় মাসের তোয়াক্কা করে না।
তীব্র রোদে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল কল্যাণের, কিন্তু তিনি নিজেকে কষ্ট দিতে চাইছিলেন। তার মাথার ভেতরে ঝড় উঠেছে। সব কিছু এলোমেলো ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে। কাজলের পরিচয় না জানা পর্যন্ত এ ঝড় বোধ হয় থামবে না। তবে এটা বোঝা যায়, অজন্তা আসার পর কাজলের জীবনের মনে অনেক পালটে গেছে। কল্যাণের এই ধারণার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে কাজলের আর একটা চিঠিতে ও চরণতলে পড়ে ছিলাম সরল অভিমানে,/আদর করে কুড়িয়ে নিলে, জীবন পেল মানে,/ একথা আর কেউ জানে না, যে জানে সে জানে।
একটা মৃত মানুষের অশরীরী অস্তিত্বের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে করতে কল্যাণ ক্রমেই যেন অবসন্ন হয়ে পড়ছিলেন। এই অর্থহীন বাড়তি জীবনটাকে নিয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এরকম এক অসহায় মুহূর্তে কল্যাণ ঠিক করে ফেললেন, তিনি তমলুক যাবেন। সেখানে গিয়ে যে করে-তোক খুঁজে বের করবেন ওই মারুতি গাড়ির নম্বর। আর সেই নম্বরের সূত্র ধরে কলকাতার মোটর-ভেহিকলস-এর দফতর থেকে বের করবেন গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা। সেই নাম-ঠিকানাই যে কাজলের নাম-ঠিকানা সেটা শতকরা নিরানব্বই ভাগ হলফ করে বলা যায়। তারপর…।
তারপর কী? হা ঈশ্বর! তারপর কী করবেন কল্যাণ!
এইরকম একটা মনের অবস্থা নিয়ে পরদিন তমলুক রওনা হয়ে গেলেন কল্যাণ চৌধুরী।
.
অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ৭৪, লেক গার্ডেন্স, কলকাতা ৭০০০৪৫।
একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা অক্ষরগুলো বারবার পড়ছিলেন কল্যাণ। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের পোশাকি নাম আর ঠিকানা। গত উনিশ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।
গাড়ির নম্বর জোগাড় করতে গিয়ে দুর্ঘটনার প্রায় গোটা এলাকাটাই একরকম চষে ফেলেছেন কল্যাণ। সাধারণ মানুষের কাছে তিন দিন ধরে একটানা অনুসন্ধানের এই পরিশ্রম হয়তো অমানুষিক, তবে কল্যাণের মতো ভূতে পাওয়া মানুষের কাছে কিছুই নয়। তৃতীয় দিনের মধ্যে অন্তত তিনজনের কাছ থেকে গাড়ির নম্বরটা পেয়েছেন কল্যাণ ও ডব্লিউ. এন. সি. ১২৩। তারপর বাকি পনেরো ষোলো দিনে নম্বর থেকে মালিকের নাম-ঠিকানা।
কিন্তু কী করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়েরই ডাকনাম কাজল? এই নামটাই ওঁদের জীবনে তৃতীয় নাম?
অনেক চিন্তাভাবনার পর কল্যাণ ঠিক করলেন অজন্তার অফিসে একবার ফোন করবেন। অজন্তা গল্প করতে করতে অফিসের দু-চারজন সহকর্মীর নাম প্রায় বলত? যেমন, ঘোষদা, জিতেনবাবু, সলিলদা, সরকার সাহেব। এর মধ্যেই ঘোষদাই বোধহয় ওর খুব কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু…।
একটা লোহার ডাইসে কল্যাণের মাথাটা চোপে ধরে কেউ বোধ হয় হাতল ঘোরাচ্ছিল। মড়মড় করে শব্দ হচ্ছিল। ধীরে ধীরে শেষের খুব কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কল্যাণ। এক ঝটকায় অবসন্ন শরীরটাকে চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে কল্যাণ টেলিফোনের কাছে চলে গেলেন। টেলিফোনের পাশে রাখা ছোট্ট টেলিফোন-বই দেখে অজন্তার অফিসের ফোন নম্বরটা মুখস্থ করে নিলেন। তারপর কাঁপা হাতে পুশ বাটনগুলো টিপে দিলেন একে একে।
গুড মর্নিং, কম্পিউটেক লিমিটেড। অপারেটরের মিহি পেশাদারি গলা ভেসে এল।
একটু সময় নিয়ে কল্যাণ বললেন, একটু…একটু সফ্টওয়্যার ডিভিশনে দেবেন।
ধরুন দিচ্ছি–
সঙ্গে সঙ্গে প্রতীক্ষার ইলেকট্রনিক মিউজিক বাজতে শুরু করল টেলিফোনে। অপেক্ষা করতে করতে বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত চাপ অনুভব করছিলেন কল্যাণ। কীভাবে কথাগুলো বলবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। যদি কোনও কারণে ঘোষদা অফিসে না থাকে তা হলে জিতেনবাবু, সলিলদা, সরকার সাহেব–যাকে পাবেন তাকেই জিগ্যেস করবেন।
হঠাৎই মিউজিক থেমে গিয়ে শোনা গেল ।
হ্যালো, সফ্টওয়্যার ডিভিশন—
চমকে উঠে তাড়াতাড়ি কথা বললেন কল্যাণ, মিস্টার ঘোষ আছেন?
এক মিনিট ধরুন, দিচ্ছি।
কল্যাণের বুক ঠেলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যাক, ঘোষদা তা হলে আছেন।
হ্যালো, অজিত ঘোষ স্পিকিং ভারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তবে কেন যেন মনে হয়, এই কণ্ঠস্বরের মালিকের ওপর আস্থা রাখা যায়।
আমি..আমি কল্যাণ চৌধুরি বলছি। আপনার কোলিগ অজন্তা চৌধুরির হাজব্যান্ড। মানে, আমাকে আপনি ঠিক…বোধহয়…চিনবেন না।
বুঝেছি। অজিত ঘোষ আশ্বাসের গলায় বললেন, আর্কিটেক্ট কল্যাণ চৌধুরি, তাই তো?
হ্যাঁ…মানে, একটা বিশেষ দরকারে…।
খুব স্যাড ব্যাপার, মশাই। কী বলে যে আপনাকে সান্ত্বনা দেব জানি না। অবশ্য সান্ত্বনা দেবার কোনও মানেও হয় না। আসলে ব্যাপারটা আমাদের কাছে একেবারে আনএক্সপেক্টেড…
হ্যাঁ, কাজলের ব্যাপারটা আমার কাছেও একেবারে আনএক্সপেক্টেড।
অজিত ঘোষ কথা বলেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু কল্যাণ কখন যেন লাল মারুতি, দুজন আরোহী, দুর্ঘটনা–এ-সবের কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ওঁর সংবিৎ ফিরল মিস্টার ঘোষের প্রশ্নে : …আপনি তো একদিনও এলেন না। যাই হোক, বলুন কী দরকার, যথাসাথ্য হেল্প করব।
একটু ইতস্তত করে কল্যাণ বললেন, আচ্ছা..আপনি…অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নামে কাউকে চেনেন, মিস্টার ঘোষ?
ও-প্রান্ত থেকে কোনও কথা নেই–অন্তত দশ সেকেন্ড। তারপর ও হ্যাঁ, চিনি। অচিন্ত্য ব্যানার্জি–নিউট্রেন্ড লিমিটেড-এর জেনারেল ম্যানেজার। ওঁর কথাই কি বলছেন?
হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে ওনার কীরকম আলাপ?
কেশে গলা পরিষ্কার করলেন অজিত ঘোষ। একটু সময় নিয়ে বললেন, তা…ইয়ে…ভালোই আলাপ ছিল। মানে, উনি..মাসখানেক মাসদেড়েক আগে..মারা গেছেন। মিস্টার ব্যানার্জি আমাদের অফিসে মাঝে মাঝে আসতেন–অফিসের কাজে। ওঁদের কোম্পানির মেইনলি সফটওয়্যার এক্সপোর্টের কাজ। তাই…।
কল্যাণ একবার ভাবলেন, অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায় কীভাবে মারা গেছেন সেটা জানতে চাইবেন। তারপর মত পালটালেন। জিগ্যেস করলেন, নিউট্রেন্ড লিমিটেড-টা কোথায়?
২৩৭ উড স্ট্রিট। থার্ড অ্যান্ড ফোর্থ ফ্লোর।
ওই অফিসের ফোন নম্বরটা আমাকে দিতে পারেন?
এক মিনিট।
কিন্তু এক মিনিট শেষ হওয়ার আগেই অজিত ঘোষের গলা পাওয়া গেল আবার : লিখে নিন। টু নাইন ফোর সেভেন জিরো ওয়ান।
কল্যাণ টেলিফোনের পাশে রাখা পেন তুলে নিয়ে নম্বরটা টুকে নিলেন। নম্বরটা পড়ে শোনালেন অজিত ঘোষকে। তারপর ছোট্ট কাছে থ্যাঙ্ক য়ু বললেন।
অজিত ঘোষ ফোন ছেড়ে দেননি। কল্যাণের ধন্যবাদের উত্তরে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, মিস্টার চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ নেই, তবে..অজন্তার সঙ্গে ছিল। ওকে আমি ছোট বোনের মতোই ভালোবাসতাম ।
আমিও ওকে ভালোবাসতাম! হে ঈশ্বর, তুমি তো জানো, আমি ওকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম!
–খুব ভালো মেয়ে ছিল। আপনার জন্যেও আমি ফিল করছি। হয়তো আপনাদের বাড়িতে যেতাম… কিন্তু এরকম একটা আনফরচুনেট ব্যাপার..কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াব! তাই শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি। তবে একটা কথা আপনাকে বলি… অজিত ঘোষ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর বললেন, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। ওসব নাড়াচাড়া করে আর কী লাভ!
কল্যাণ সব শুনছিলেন, কিন্তু কোনও কথা বলেননি। অজিত ঘোষের শেষ কথাটা তিনি পাথরের মূর্তি হয়ে শুনলেন।
অস্বস্তিকর নীরব মুহূর্তগুলো ডিঙিয়ে অজিত ঘোষ আলতো গলায় বললেন, মিস্টার চৌধুরি, আশা করি এই বুড়ো মানুষটার অনুরোধ আপনি শুনবেন। অজন্তার আত্মাকে মিছিমিছি কষ্ট দিয়ে কোনও লাভ আছে! একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ও-প্রান্তে ও আচ্ছা, রাখছি। কোনও দরকার হলে উইদাউট হেজিটেশান আমাকে ফোন করবেন। অজন্তার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট কাগজপত্র সব তৈরি করছে। ওগুলো রেডি হয়ে গেলে আপনি বাড়িতে অফিসিয়াল চিঠি পাবেন।
কল্যাণ আবার ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন। পরিচয়হীন একটা মানুষ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। কল্যাণ বুকের ভেতরে অদ্ভুত ধরনের এক উত্তেজনা টের পাচ্ছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার মানুষটি ধীরে ধীরে যেন কাছে এগিয়ে আসছে।
সিগারেটের ধোঁয়ার ফিনফিনে পরদা ভেদ করে ডানদিকের দেওয়ালে নজর গেল কল্যাণের। অজন্তার বড় মাপের ফটোগ্রাফ টাঙানো রয়েছে সেখানে। কী নিষ্পাপ সুন্দর মুখ! ব্যভিচারের কণামাত্রও নেই কোথাও।
হঠাৎই মন খারাপের বাতাস কল্যাণকে ভাসিয়ে দিল। চোখে জল এসে গেল পলকে। সম্পূর্ণ অকারণে অবুঝ বাচ্চা ছেলের মতো ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করলেন কল্যাণ। এখন তিনি কী চান তা নিজেই জানেন না।
এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা অজন্তাকে থেতলে চুরমার করে দিয়েছে। একইসঙ্গে কল্যাণকেও। অজন্তার বাইরেটা, আর কল্যাণের ভেতরটা। অজিত ঘোষ অজন্তার আত্মার কথা বলছিলেন। কেন, কল্যাণের বুঝি আত্মা নেই।
সময় কখন কীভাবে গড়িয়েছে কল্যাণের স্পষ্ট খেয়াল নেই। তবে সংবিৎ ফিরে পেয়েই কল্যাণ শ্লথ পায়ে আবার চলে এসেছেন টেলিফোনের কাছে। অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ফোন নম্বরটা তার দরকার। তারপর…।
নিউট্রেন্ড লিমিটেড থেকেই অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ফোন নম্বরটা পাওয়া গেল। অচিন্ত্যর ছোটবেলার বন্ধু, বারো বছর বিদেশে ছিলেন, দেশে ফিরেই ওঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন– এইসব বলতেই আর কোনও অসুবিধে হয়নি। উপরন্তু কাজল নামটাও কল্যাণ একবার ব্যবহার করে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের পরিচয় দিলেন।
ও-প্রান্ত থেকে একজন তরুণী যখন অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন নম্বরটা উচ্চারণ করছিল আর কল্যাণ সংখ্যাগুলো লিখে নিচ্ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, তিনি যেন একটা অপার্থিব ভয়ংকর দরজার কম্বিনেশান লকের নম্বর জেনে নিচ্ছেন। সেই দরজার ওপিঠে রয়েছে একটা অন্ধকার ঘর। সেই ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে আবছায়া চেহারার একজন থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার। আর সেই ঘরের অন্ধকারে মৃত্যুর ঠান্ডা বাতাস বইছে।
অনেকক্ষণ পর কল্যাণের নিজেকে ক্লান্ত মনে হল। তৃপ্তির অবসাদ তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ঘুঘু-ডাকা দুপুরের সেই ঘুমের মধ্যে অজন্তা-ইলোরাকে তিনি স্বপ্নে দেখলেন। তবে অজন্তার মুখটা কেমন অস্পষ্ট অচেনা ঠেকছিল। আর একটা লম্বা কালো ছায়া তেরছাভাবে এসে পড়ছিল অজন্তার সুঠাম শরীরে।
*
কল্যাণ চৌধুরীর ঘুম যখন ভাঙল তখন আকাশ ভগবানের স্লেট। বিছানা ছেড়ে ওঠামাত্রই অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন নম্বরটা মাথায় ধাক্কা মারল। কিন্তু কল্যাণ সংখ্যাগুলো স্পষ্টভাবে মনে করতে পারছিলেন না।
পরাশর এসে কফি আর বিস্কুট দিয়ে গেল।
হাত-মুখ ধুয়ে কফির কাপে চুমুক দিলেন কল্যাণ। ফোন নম্বরটা দেখে নিয়ে এখুনি ফোন করতে হবে। নিশ্চয়ই মিসেস ব্যানার্জি ফোন ধরবেন। তখন কী বলবেন কল্যাণ?
কফি শেষ করে অস্থির মন নিয়ে টেলিফোনের কাছে চলে এলেন। একটা চিরকুটে লেখা অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন নম্বরটা একপলক দেখে নিয়ে রিসিভার তুলে বোতাম টিপলেন। তাঁর চোখ চলে গেল অজন্তার ফটোর দিকে। ওর চোখের দৃষ্টি যেন বলতে চাইল, এ-সব কী ছেলেমানুষি করছ!
কল্যাণ চোয়াল শক্ত করে রিসিভার কানে চেপে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ও-প্রান্তে। টেলিফোন বাজছিল। কল্যাণের হঠাৎই মনে হল, এই বুঝি অচিন্ত্য নিজেই ফোন ধরে কল্যাণের সঙ্গে কথা বলবেন। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের সঙ্গে ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের কথা হবে, বোঝাঁপড়া হবে।
ও-প্রান্তে কেউ ফোন তুলে হ্যালো বলতেই কল্যাণ জিগ্যেস করলেন, ফোর সেভেন থ্রি, এইট সেভেন থ্রি এইট?
হ্যাঁ…বলুন… একটি অল্পবয়েসি মেয়ের গলা। বয়েস বড়জোর চোদ্দো-পনেরো হবে। অচিন্ত্যর মেয়ে নয়তো! নাকি অন্য কেউ!
মিসেস ব্যানার্জির সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আমার নাম কল্যাণ চৌধুরি। গলা যাতে না কেঁপে যায় সেদিকে খেয়াল রেখেছিলেন কল্যাণ। আর একই সঙ্গে ও-প্রান্তের প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে শুনতে চাইছিলেন।
একটা চাপা ঠনঠন শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অনেকটা করতাল কিংবা খঞ্জনির শব্দের মতো। তার সঙ্গে টিভির অনুষ্ঠানের নানান টুকরো শব্দ মিশে যাচ্ছিল। সেইসব শব্দ ছাপিয়ে মেয়েটি বলল, একটু ধরুন দিচ্ছি।
তারপর মা, তোমার ফোন। কথাটা আলতোভাবে শুনতে পেলেন কল্যাণ। অচিন্ত্যর মেয়েই তা হলে ফোন ধরেছিল!
একটু পরেই মহিলাকণ্ঠ শোনা গেল টেলিফোনে ও মিসেস ব্যানার্জি বলছি–
কণ্ঠস্বর খানিকটা ভারী, একটু যেন পুরুষালি ছোঁয়া–পপ গায়িকাদের মতো। আর প্রচ্ছন্ন হলেও ব্যক্তিত্বটা টের পাওয়া যায়।
নমস্কার মিসেস ব্যানার্জি। আমার নাম কল্যাণ চৌধুরী। আমি..আমি কাজল–মানে, অচিন্ত্যর খুব ক্লোজ…ইয়ে…ছিলাম। শুনলাম ও অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে পারলে খুব ভালো হত।
শান্ত গলায় মিসেস ব্যানার্জি জিগ্যেস করলেন, কী কথা?
আমার কথা শোনার পর আপনি কি এমন শান্ত গলায় কথা বলতে পারবেন, ম্যাডাম?
কয়েকটা জরুরি কথা। এগুলো আপনাকে না বলা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মিসেস ব্যানার্জি বললেন, বলুন, কী বলবেন–
সেকথা টেলিফোনে বলা যাবে না। আপনার সঙ্গে দেখা করে বলতে হবে। ভয় নেই, বেশিক্ষণ নেব না–মাত্র দশ-পনেরো মিনিট।
ওই দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই সবকিছু পালটে যাবে। জানি, সূর্য রোজ যেমন ওঠে তেমনই উঠবে, রোজ যেমন অস্ত যায় তেমনই অস্ত যাবে। কিন্তু তবু, বিশ্বাস করুন, সব কিছু পালটে যাবে।
আপনি কবে দেখা করতে চান, বলুন–
কল্যাণ কণ্ঠস্বর শুনে মিসেস ব্যানার্জির চেহারাটা আঁচ করতে চেষ্টা করছিলেন। ফরসা, লম্বা চওড়া, চোখে রিমলেস চশমা, পরনে সাদা থান, নাকি…?
আপনি যদি আপত্তি না করেন তা হলে আজই সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ দেখা করতে পারি–
কল্যাণ মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বর বা যাহোক কাউকে ডাকছিলেন। মিসেস ব্যানার্জি যেন আপত্তি না করেন। আজ রাতেই যেন কল্যাণ ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তারপর বলতে পারেন নিজের কথা। অজন্তার মৃত্যুকে ঘিরে এতদিন ধরে জমানো তিলতিল যন্ত্রণা যেন আজ শুকনো ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে পড়ে তার বুকের ভেতর থেকে।
অজন্তাকে এ কেমন ভালোবাসা, এ কেমন ঘৃণা! এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে কল্যাণ যেন এক আশ্চর্য মানুষ হয়ে গেছেন।
ঠিক আছে–আসুন। আমাদের ফ্ল্যাটটা চেনেন তো?
কল্যাণের অনুরোধে বাড়ির ঠিকানা, কীভাবে সেখানে পৌঁছোনো যাবে, সবই বলে দিলেন মিসেস ব্যানার্জি। কল্যাণ অন্যমনস্কভাবে ওঁর কথা শুনছিলেন। ঠনঠন ধাতব শব্দটা তখনও একঘেয়েভাবে শোনা যাচ্ছিল।
কথা শেষ হলে ধন্যবাদ জানিয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন কল্যাণ চৌধুরি। অজন্তার ফটোর দিকে তাকালেন। তারপর কী ভেবে তাকালেন টেলিফোনের দিকে। এই টেলিফোন সব জানে। অচিন্ত্যর কণ্ঠস্বর কতবার তার বেয়ে এই টেলিফোনে পৌঁছে গেছে তার সব হিসেব ধরা রয়েছে এই যন্ত্রের শরীরে। যে-টেলিফোন নম্বর এত কাঠখড় পুড়িয়ে কল্যাণ হাতে পেয়েছেন সেটা অজন্তার ঠোঁটে হাজির ছিল। অজন্তার সুন্দর ঠোঁটের দিকে তাকালেন কল্যাণ। অচিন্ত্য বেঁচে থাকলে কি এই ঠোঁটজোড়াকে ওষ্ঠাধর বলতেন? অদ্ভুত এক হীনম্মন্যতা কল্যাণকে জড়িয়ে ধরছিল। কোন এক অজানা কারণে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাচ্ছিলেন। আর একটা হাউইবাজি এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বুকের ভেতরে। ভেতরটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছিল।
.
রাত আটটা নাগাদ লেক গার্ডেন্সে অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির দরজায় কল্যাণ যখন পৌঁছোলেন, বুকের ভেতরে ছুটে বেড়ানো হাউইটা তখনও নেবেনি।
পাড়াটা নির্জন হয়ে গেছে এখন। মাঝারি মাপের গলি দিয়ে পাক-পাক হর্ন বাজিয়ে দুটো সাইকেল-রিকশ চলে গেল। চোখে পড়ল দু-চারজন পথচারী। একটা স্টেশনারি দোকান ঝাঁপ বন্ধ করছিল। দোকানের ভদ্রলোককে ৭৪ নম্বরের কথা জিগ্যেস করতেই উলটোদিকের ছাই-রঙা একটা চারতলা বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। বাড়িটার সামনে একটা ল্যাম্প পোস্ট–তার টিউবলাইট বিকল হয়ে যাওয়ায় একটা উলঙ্গ বা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাড়ির চারপাশে খাটো পাঁচিল। তারই এক জায়গায় কালো রং করা গ্রিলের দরজা।
ল্যাম্প পোস্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে দরজা খুললেন কল্যাণ। সামান্য শব্দ হল। কল্যাণ ভেতরে ঢুকলেন, এগোলেন একতলার ফ্ল্যাটের দিকে। তার ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হল।
সিঁড়ির নীচে সরাসরি আলো না পড়ায় লেটার বক্স আর মেইন সুইচগুলো আবছাভাবে দেখা গেল। দু-ধাপ সিঁড়ি উঠে কল্যাণ একতলার ফ্ল্যাটের কোলাপসিবল দরজার মুখোমুখি হলেন। তার পরেই কাঠের দরজা। বন্ধ।
একটা চাপা উত্তেজনা কল্যাণকে কিছুতেই স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। তিনি কাঠের দরজায় বসানো প্লাস্টিকের নেমপ্লেট পড়লেন মিস্টার এ. ব্যানার্জি, মিসেস এস. ব্যানার্জি। অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটা এখনও মুছে যায়নি। ওঁর নাম মুছে ফেলা বোধ হয় সহজ নয়।
নেমপ্লেটের ওপরেই ম্যাজিক আই। আর তার বাঁদিকে, কাঠের দরজার ফ্রেমে, বসানো কলিংবেলের সুইচ।
দরজার ওপার থেকে কিছু শব্দের টুকরো শোনা যাচ্ছিল। টেলিফোনে যেমন শুনেছেন, প্রায় সেইরকমই।
কল্যাণ কলিংবেলের বোতাম টিপলেন। টুং-টাং করে ইলেকট্রনিক মিউজিক বেজে উঠল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল কাঠের দরজা। সুন্দর ফরসা গোলগাল চেহারার একটি মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা। পরনে সবুজ কালোয় ছাপা চুড়িদার।
ডান হাতের তর্জনির ডগা দিয়ে চশমাটাকে নাকের গোড়ায় ঠেলে দিয়ে প্রশ্নের দৃষ্টিতে কল্যাণের দিকে তাকাল মেয়েটি।
তুমি কাজলের মেয়ে?
প্রশ্নটা কেমন সহজভাবে বেরিয়ে এল কল্যাণের ঠোঁট চিরে। কল্যাণ নিজেই ভারী অবাক হয়ে গেলেন। একটু আগেই তিনি ভেবেছিলেন, কীভাবে নিজের পরিচয় দেবেন, তারপর মিসেস ব্যানার্জির সঙ্গে পরিচয়ের পালা সেরে…।
মেয়েটি সামান্য হেসে বলল, হ্যাঁ। আপনি?
আমার নাম কল্যাণ চৌধুরি। আজ সন্ধেবেলা আমি ফোন করেছিলাম…
হ্যাঁ, মা বলছিল। কোলাপসিবল দরজা খুলে গেল? আসুন, ভেতরে আসুন–
ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণ ডুবে গেলেন নতুন এক জগতে। অচিন্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেলে যাওয়া ঘর-সংসার তাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। শব্দ, গন্ধ, অনুভব–সব কিছু তাকে দ্রুত আপন করে নিচ্ছিল। কল্যাণের ভীষণ অবাক লাগছিল। এ তোমার কেমন খেলা, ঈশ্বর!
ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টিভির শব্দ আরও জোরালো হয়েছে। আর টেলিফোনে শোনা ঠনঠন ধাতব শব্দটার কারণটাও বোঝা গেছে।
ঘরের বাঁদিকের কোণে মেঝেতে প্রচুর খেলনা ছড়ানো। আর খেলনার পুকুরের মাঝে পাঁচ-ছবছরের একটা ফুটফুটে ছেলে বসে আছে। সে একমনে একটা প্লাস্টিকের স্টেনগান ফায়ার করে চলেছে, আর বকবক করে যাচ্ছে আপনমনে।
তার ছড়ানো এলোমেলো খেলনার মাঝে একটা বানর চোখে পড়ল কল্যাণের। খুব সাধারণ সস্তা খেলনা। বানরটার মাথায় টুপি আর পরনে ডোরাকাটা শার্ট ও হাফপ্যান্ট। দুটো ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। দু-হাতে দুটো পিতলের করতাল। হাত দুটো ফাঁক করে মুখে বিমূঢ় হাসি ফুটিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। চাবি ঘুরিয়ে দম দিলেই শুরু হয়ে যাবে ঠনঠন বাজনা।
বাচ্চাটার কাছাকাছি মেঝেতে বসে কুড়ি-বাইশ বছরের একটি মেয়ে কী যেন সেলাই করছিল। কল্যাণকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল।
যে-মেয়েটি দরজা খুলে দিয়েছিল সে ঘরে ঢুকে তাকিয়েছে তার মায়ের দিকে। মা টিভির। কাছ থেকে খানিকটা দূরে একটা সোফায় বসেছিলেন। কল্যাণের দিকে চোখ ফেরাতেই মেয়েটি আলতো করে বলল, কল্যাণবাবু। তুমি আসতে বলেছিলে।
উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন কল্যাণকে, বললেন, আসুন…আসুন…
অভ্যর্থনায় ত্রুটি ছিল না, তবে কোথায় যেন উষ্ণতার অভাব ছিল।
ভদ্রমহিলা মেয়েকে বললেন, অনি, দরজাটা বন্ধ করে দাও। তারপর কল্যাণের দিকে তাকিয়ে সামান্য ইতস্তত করে হেসে বললেন, আমার মেয়ে অনমিতা। আপনি বসুন–
অনি দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের ডানদিকে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটা বুক শেলফের কাছে গেল। কয়েকটা বই নিয়ে চলে গেল ভেতরের কোনও ঘরের দিকে। যাবার আগে ছোট্ট করে বলে গেল, আমি পড়তে গেলাম।
কল্যাণ আর একটা সোফায় বসলেন। দেওয়ালে টাঙানো সুদৃশ্য কোয়ার্জ ঘড়িতে আটটার সংকেত বেজে উঠল নানা সুরে। মিসেস ব্যানার্জি টিভিটা অফ করে দিলেন। তারপর খেলনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ছেলে নয়ন। খুব দুরন্ত। ওর বাবাকে একেবারে নাজেহাল করে দিত– শেষ দিকে ওঁর গলার স্বরটা সামান্য ধরে গেল।
একটু সময় নিয়ে তারপর আবার কথা বললেন মিসেস ব্যানার্জি, শীলা, তুই নয়নকে ভেতরে নিয়ে যা। এখানে আমরা কথা বলব। নয়নকে অনির কাছে দিয়ে তুই আমাদের একটু চা-টা কিছু দে…
কল্যাণ নীচু গলায় বললেন, শুধু চা, আর কিছু না…
শীলা বাচ্চাটাকে খানিকটা টানা-হাচড়া করে খানিকটা ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গেল। তবে যাবার আগে দুরন্ত ছেলেটা বন্দুক ছাড়াও বেশ কয়েকটা খেলনা বগলদাবা করে নিয়ে গেল।
বসবার ঘরে এখন শুধু ওঁরা দুজন। কোনও কথা নেই, কোনও শব্দও নেই।
কল্যাণ ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। সুদৃশ্য ছিমছাম। দুটো সোফা, একটা ডিভান, বুক সেলফ, গ্লাসটপ, ছোট টি-টেবল। দেওয়ালে টাঙানো একটা গ্রুপ ফটো, আর একটা মধুবনী ছবি কাপড়ে সুতোর কাজ করে আঁকা। টিভিটা ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে চাকাওয়ালা টেবিলে বসানো। আর তার খানিকটা দূরেই একটা বুককেসের ওপরে টেলিফোন। তার পাশে নতুন টেলিফোন ডিরেক্টরি।
অচিন্ত্যর ছবি কোথায়? কোথায় সেই থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, যাকে আমি এত কাঠখড় পুড়িয়ে দেখতে এসেছি।
অচিন্ত্যর কোনও ছবি বাঁধিয়ে রাখেননি? ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে বললেন কল্যাণ। তাঁর কথায় প্রশ্নের সুরটা খুব হালকা শোনাল।
বেডরুমে আছে। ছোট্ট করে জবাব দিলেন মিসেস ব্যানার্জি, আর ওই গ্রুপ ফটোটা– ওদের অফিসে তোলা–ওতেও আছে।
বিধবা মহিলাকে ভালো করে জরিপ করলেন কল্যাণ। লম্বাটে ফরসা মুখ। টানা ভুরু। আলতো খোঁপা করা চুল। রগের পাশে একটা কি দুটো রুপোলি সুতো। লম্বা নাক। চোয়ালের রেখা স্পষ্ট। চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা। অনেকটা যেন দিদিমণি-দিদিমণি চেহারা। কিন্তু কাছাকাছি এসে বসলেই ব্যক্তিত্বের অদৃশ্য কোমল বিকিরণ অনুভব করা যায়।
মিসেস ব্যানার্জির পরনের শাড়িটা সাদা নয়, খুব হালকা আকাশি। তার ওপরে কপালের টিপের মতো অসংখ্য গাঢ় নীল বুটি। সরু পাড়ে রুচিসম্মত নকশা। দেখে মনে হয় না প্রথাগত বিধবা-জীবনযাপন করছেন। নিরামিষ খাওয়াদাওয়া মেনে নিয়েছেন কি না কে জানে!
কল্যাণের কৌতূহল এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
আপনি কী জরুরি কথা বলবেন বলছিলেন…
বোঝা গেল, মিসেস ব্যানার্জি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে চান না। তা ছাড়া কল্যাণ চৌধুরি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত।
কল্যাণ নিজেকে মনে মনে নিষ্ঠুর করলেন। গড় দেড় মাসের যন্ত্রণা তিনি একা সয়েছেন। একটু পরেই তিনি আর একা থাকবেন না। তার মনে হল, অচিন্ত্যকে হারিয়ে মিসেস ব্যানার্জির সংসার যতটা সুখী হওয়া সম্ভব ঠিক ততটাই সুখী। কী সুন্দর! যেন স্বচ্ছ স্ফটিকের তৈরি একটা মনোহারি বল–অনেকটা প্রকাণ্ড বুদবুদের মতো। কল্যাণ মনে মনে সেই বলটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লোফালুফি শুরু করলেন।
কল্যাণ উঠে দাঁড়ালেন সোফা ছেড়ে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন গ্রুপ ফটোটার দিকে। ওটার খুব কাছে গিয়ে গভীর মনোযোগে ছবির মানুষগুলোর মুখ দেখতে দেখতে হঠাৎই ঘুরে তাকালেন মিসেস ব্যানার্জির দিকে । এর মধ্যে কে কাজল?
মিসেস ব্যানার্জির মুখে পলকে বিস্ময় ফুটে উঠল, চোয়াল শক্ত হল। একটু সময় নিয়ে তারপর কথা বললেন তিনি, আপনি এঁকে চেনেন না! ফোনে যে বললেন—
চিনি। তবে কখনও সামনা-সামনি দেখিনি। এ-ছবিতে কোন জন? কল্যাণ স্ফটিকের বলটা নিয়ে তখনও লোফালুফি করছেন। যে-কোনও মুহূর্তে শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া বলটা না লুফে হাত সরিয়ে নিলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিশ্রী শব্দে মেঝেতে আছড়ে পড়ে সুন্দর বলটা চুরমার হয়ে যাবে।
বাঁদিক থেকে ফোর্থ।
কল্যাণ আবার ফটোর দিকে তাকালেন। বাঁদিক থেকে চতুর্থ জনই সেই তৃতীয় ব্যক্তি।
অচিন্ত্যকে দেখে কল্যাণ কেমন দিশেহারা হয়ে গেলেন। ফটোতে মুখটা মাপে ছোট হলেও স্পষ্ট বোঝা যায়। খুবই সাধারণ চেহারা, কিন্তু চোখ দুটো একেবারে অন্য জগতের কেমন যেন মায়া জড়ানো। যেন বোঝা যায়, এ-চোখের আড়ালে একটা অন্যরকম মন আছে। অসুখী এই মানুষটাকে অজন্তা আদর করে কুড়িয়ে নিয়েছিল। তার অর্থহীন জীবনের একটা মানে খুঁজে পেয়েছিল মানুষটা।
হঠাত্ কল্যাণের এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল। দুজ্ঞেয় এক জ্বালা তাকে অস্থির করে তুলল। ছবির দিকে চোখ রেখেই তিনি বললেন, মিসেস ব্যানার্জি, আপনার স্বামী যেদিন তমলুকে অ্যাকসিডেন্টে মারা যান, সেদিন ওখানে আরও একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। কাগজে দুটো খবরই বেরিয়েছিল–পড়েননি?
স্ফটিকের বলটা এখন শূন্যে। কল্যাণ ওটা শেষ মুহূর্তে লুফে নেবেন, নাকি হাত সরিয়ে নেবেন?
কল্যাণ ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে আসছিলেন সোফার দিকে, মিসেস ব্যানার্জিকে দেখছিলেন, তখনই একটা খেলনার হোঁচট খেলেন।
সেই করতাল বাজানো বানরটা। কাত হয়ে পড়ে গিয়ে হঠাৎই করতাল বাজাতে শুরু করেছে। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষের শব্দ ঘরের চুপচাপ পরিবেশে এলোপাতাড়ি ছুরি চালাতে লাগল।
মিসেস ব্যানার্জি ইতস্তত করে বললেন, কাগজে বেরিয়েছিল? আমার ঠিক খেয়াল পড়ছে না।
কল্যাণ কোনও জবাব না দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বানরটা তুলে নিলেন। প্রাণহীন চোখ। ভোম্বলদাস মুখ নিয়ে বানরটা করতাল বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই। বোধ হয় ওটার ভেতরে কিছুটা দম তখনও ছিল।
করতালের শব্দটা খানিকটা ঢিমে হয়ে আসতেই কল্যাণ চাবি ঘুরিয়ে একেবারে শেষ পর্যন্ত দম দিলেন। কিন্তু বানরটা চুপচাপ রইল। কল্যাণ একটু অবাক হলেন। কী ভেবে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিলেন খেলনাটাকে। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র শব্দে শুরু হয়ে গেল বাজনা। কল্যাণের দিকে শুন্য চোখে তাকিয়ে বানরটা করতাল বাজাচ্ছে। বানরটার পুরু ঠোঁটের কাছে কি এক চিলতে হাসি? কল্যাণের কেমন অস্বস্তি হল। মনে হল, বানরটা করতাল বাজিয়ে তাকে দুয়ো দিচ্ছে।
খেলনাটা মেঝেতে বসিয়ে রেখে আবার মিসেস ব্যানার্জির কাছে এসে বসে পড়লেন কল্যাণ। বললেন, মিসেস ব্যানার্জি, আপনাকে আমি একজন থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের গল্প শোনাতে এসেছি। মিসেস ব্যানার্জির বিমূঢ় চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে কল্যাণ আবার বললেন, আপনার স্বামীর গল্প। অনমিতা আর নয়নের বাবার গল্প। না কি ওরা আবার ড্যাডি বলে ডাকত অচিন্ত্যকে?
মিসেস ব্যানার্জি তখনও ঠিক বুঝতে পারেননি কল্যাণ কী বলতে চাইছেন।
এমনসময় শীলা ট্রে-তে করে চা-বিস্কুট নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। কাচের টেবিলের ওপরে। কাপ-প্লেট সাজিয়ে দিয়ে ট্রে নিয়ে চলে গেল।
বানরটা তখনও করতাল বাজাচ্ছে, তবে তার বাজনার জোর কমে এসেছে। সেদিকে একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন কল্যাণ। স্ফটিকের বলটা ওপর থেকে নেমে আসছে। এখনও সময় আছে লুফে নেওয়ার। কিন্তু…।
চা খান।
মিসেস ব্যানার্জির অনুরোধে চায়ের কাপ তুলে নিলেন কল্যাণ। কাপে পরপর কয়েকটা চুমুক দিয়ে সরাসরি তাকালেন ওঁর চোখের দিকে।
তারপর এক ঝটকায় মনস্থির করে নিয়ে হাত সরিয়ে নিলেন। স্ফটিকের বলটা মেঝেতে আছড়ে পড়ল। ঝনঝন শব্দে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল চারদিকে। কল্যাণ সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলেন।
কল্যাণ দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে সব বলে গেলেন একে একে, কিছুই বাদ দিলেন না। অজন্তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে আজকের এই মুহূর্ত পর্যন্ত সময়টা তার কাছে যেন একটা অন্ধকার টানেল। এই টানেলের মধ্যে দিয়ে এতদিন দৌড়ে এসেছেন কল্যাণ। এখন, পুরোনো কথা বলতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, আবার সেই টানেলের মধ্যে দিয়ে তিনি দৌড় শুরু করেছেন।
কল্যাণ কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে আর চুমুক দিতে পারলেন না। তার ঠোঁট অকারণেই কাঁপছিল। গলার মধ্যে একটা রবারের বল ঢুকে পড়েছিল।
মিসেস ব্যানার্জি চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই হয়েছে প্রথম এবং শেষ চুমুক। তিনি মাথা নীচু করে কল্যাণের কথা শুনছিলেন। চোয়াল শক্ত করে কান্না চেপে রাখতে চেষ্টা করছিলেন। আর মনেপ্রাণে চাইছিলেন, অনি যেন এখন এ-ঘরে না আসে।
এক সময় কথা শেষ করলেন কল্যাণ। গলার কাছটায় কী একটা যেন বারবার আটকে যাচ্ছিল, গলা ধরে যাচ্ছিল–তাই কেশে গলা পরিষ্কার করে নিচ্ছিলেন। তবে নিজেকে কী অদ্ভুত হালকা লাগছিল, বুকের ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে।
এই…এই আপনার জরুরি কথা! ভাঙাচোরা গলায় বললেন মিসেস ব্যানার্জি।
জরুরি কি না জানি না, তবে এই কথাগুলো আপনাকে আমি জানাতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আপনার সঙ্গে আমার অবস্থার খুব একটা তফাত নেই। অবশ্য তখন তো আমি নয়ন বা অনমিতার কথা জানতাম না–
অচিন্ত্যর ব্যাপারটা আমি আঁচ করেছিলাম…খানিকটা জানতে পেরেছিলাম, তবে কোনও অশান্তি করিনি– শাড়ির আঁচল দিয়ে কান্না চাপতে চাইলেন মিসেস ব্যানার্জি, কিন্তু দু-একটা টুকরো ছিটকে বেরিয়ে এল বাইরে? আসলে আমি নয়ন আর অনির কথা ভেবেছিলাম…আমাদের কথা ভেবেছিলাম।
কল্যাণ তেতো হাসলেন, বললেন, জানেন, খুব নিশ্চিন্তে জীবন কাটাচ্ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম, আমার জীবনে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের কোনও জায়গা নেই। কিন্তু পরে বুঝেছি, এই থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বাররা সবসময় থেকে যায়…কোথাও না কোথাও থেকে যায়..হয় স্টেজের ওপরে, নয়তো উইংস-এর ফাঁকে, দর্শকদের মাঝে, অথবা গ্রিনরুমে। এরা থাকবেই।
মিস্টার চৌধুরী, এখন এ সব পুরোনো কথা তুলে কী লাভ! আমাকে আমার সংসার নিয়ে বাঁচতে হবে..আর আপনাকেও তো বাঁচতে হবে…আমাদের তো আর কিছু করার নেই কথার শেষ দিকটা কান্নায় মিশে গেল।
মিসেস ব্যানার্জির কষ্ট কল্যাণের মনে খুব একটা আচঁড় কাটতে পারছিল না। মিসেস ব্যানার্জির কথার জের টেনে তিনি বললেন, আপনার কি ধারণা আমি এখনও বেঁচে আছি! অজন্তার অ্যাকসিডেন্টের খবরটা শোনার পরই আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে…
জীবনটা তো একটা স্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই সেই স্বপ্নের ইতি–মৃত্যু। স্বপ্ন শেষ হওয়ার মুহূর্ত থেকে কল্যাণ জীবনের মৃতদেহ কাঁধে করে ক্লান্ত পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উদ্দেশ্যহীন সেই ঘুরে বেড়ানো হয়তো আজ শেষ হবে।
কাজলের লেখা চিঠিগুলো আমাকে একবার দেখাবেন? আর্ত খসখসে গলায় মহিলা অনুরোধ করলেন।
চিঠি! কল্যাণের মনে পড়ল কাজলের লেখা আন্তরিক চিঠিগুলোর কথা। কী সুন্দরভাবেই না কাজল আর অজন্তা নিজেদের আলাদা একটা ভালোবাসার জগৎ গড়ে নিয়েছিল। চোখের আড়ালে থাকা সেই জগতের কথা কেউ জানত না। সেই জগতে কল্যাণ মানে, মিস্টার চৌধুরি বা মিসেস ব্যানার্জির কোনও জায়গা ছিল না। ওঁরা ছিলেন বাইরের লোক। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার।
কল্যাণের মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গেল আচমকা। তিনি চায়ের কাপের দিকে চোখ রেখে অসহায় সুরে বললেন, ওগুলো দেখে কী করবেন? শুধু শুধু কষ্ট পাবেন। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার…আমাদের দেখা কি ঠিক হবে?
অজন্তাকে দেওয়া কাজলের ডায়েরিটার কথা মনে পড়ল কল্যাণের। ওদের ব্যক্তিগত বর্ণমালা কিছুই বোঝেননি ওঁরা। ওদের মনচিহ্নও বুঝতে পারেননি। একই চিহ্নের তো কতরকম মানে হয়। যেটা সাধারণ যোগচিহ্ন, সেটাকে সামান্য ঘুরিয়ে দিলেই হয়ে যায় গুণচিহ্ন অথবা কাটা চিহ্ন। কল্যাণ কল্পনায় নিজের মুখের ওপরে কুৎসিত এক কাটাচিহ্ন দেখতে পেলেন। মিসেস ব্যানার্জির মুখেও। অজন্তা আর কাজল যেন ওদের দুনিয়া থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে এই দুটি প্রাণীকে, তারপর মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সেই অপমান আর গ্লানি নিয়ে ওঁরা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে আছেন।
মিসেস ব্যানার্জির মুখের দিকে তাকিয়ে কল্যাণের মায়া হচ্ছিল। কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই ব্যক্তিত্ব। তার বদলে বসে আছে এক ভাঙাচোরা রমণী। অচিন্ত্য আর অজন্তাকে পাশ কাটিয়ে অনমিতা আর নয়নকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিলেন মিসেস ব্যানার্জি। কল্যাণ ওঁকে হয়তো পাশ কাটাতে দেননি, কিন্তু স্বপ্নটা কি পুরোপুরি কেড়ে নিতে পেরেছেন? অনমিতা আর নয়ন যে থেকে গেছে। ওদের চারটে চোখ দিয়ে এখন এই বিষণ্ণ দুটি চোখ স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করবে।
কল্যাণের বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করছিল। চাপা অথচ তীব্র যন্ত্রণা। তেতো হাসলেন কল্যাণ। দ্বিতীয়বার মরতে কে আর ভয় পায়! ঘরের মেঝেতে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে বসে থাকা বানরটার দিকে চোখ গেল তার। লোমশ প্রাণীটার কুতকুতে চোখে কি সামান্য হাসির ছোঁয়া?
ক্লান্ত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বানরটার কাছে গেলেন কল্যাণ। ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলেন খেলনাটা। এক অদ্ভুত জ্বালায় ওটাকে আচ্ছা করে কষে দম দিলেন। তারপর বাঁধন আলগা করতেই ঠনঠন শব্দে করতাল বাজতে শুরু করল। বাজতেই থাকল।
পায়ে পায়ে চায়ের টেবিলের কাছে চলে এলেন কল্যাণ। নিথর হয়ে বসে থাকা মিসেস ব্যানার্জির সামনে টেবিলের কাচের ওপরে বসিয়ে দিলেন খেলনাটাকে। তারপর ছোট্ট করে বললেন, আসি–
মিসেস ব্যানার্জি কোনও উত্তর দিলেন না।
কল্যাণ রবারের পা ফেলে বেরিয়ে এলেন ফ্ল্যাটের বাইরে। করতালের শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছে।
অন্ধকার নির্জন রাস্তায় করতালের শব্দটা কল্যাণকে একঘেয়েভাবে অনুসরণ করে চলল।