Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জীবজন্তুর কথা || Tarapada Roy

জীবজন্তুর কথা || Tarapada Roy

জীবজন্তুর কথা

লিখেছিলাম নাকি কাণ্ডজ্ঞানে জীবজন্তুর বিষয়ে এর আগে ? মাত্র পনেরো মাসেই কীরকম যেন স্মৃতিবিভ্রম হচ্ছে আমার। তা ছাড়া একই লোকের কাছে একই রসিকতা দু’বার করার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক এই রসিকতা একই পৃষ্ঠায় একাধিকবার করতে যাওয়া। খেয়াল করতে পারছি, বানর নিয়ে, গোরু নিয়ে লিখেছি; কিন্তু পুরোপুরি জীবজন্তু নিয়ে বোধহয় নয়।

সে যা হোক, এখন যে-গল্পটা উল্লেখ করছি সেটা নিশ্চয়ই আগে লিখিনি, তার কারণ একটা বিলিতি কার্টুনে আমি নিজেই মাত্র গতকাল এটি দেখেছি ও পড়েছি। এটা ক্যাঙারুদের গল্প। খুব ভিড়; সেই ভিড় ঠেলতে ঠেলতে বাপ-ক্যাঙারু আর মা-ক্যাঙারু একটু ফাঁকায় এসে দাঁড়াতেই বাপ-ক্যাঙারু জিজ্ঞাসা করছে, ‘খোকা, খোকা কই ?’ মা-ক্যাঙারু তার শরীরের মধ্যে শূন্য পকেটের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘সর্বনাশ, খোকা তো এই ভিড়ের মধ্যে পকেটমার হয়ে গেল।’

জীবজন্তুর খোকাদের নিয়ে এ রকম আরেকটি অনেকদিন আগে দেখা ব্যঙ্গচিত্র মনে পড়ছে; সেটি অক্টোপাসদের নিয়ে। একটি বড় অক্টোপাস, তার চারপাশে কিলবিল করছে ছোট ছোট অক্টোপাস। সেই ছোট অক্টোপাসগুলি বড়টির বাচ্চা, তারা তাদের মাকে জোর করছে, ‘মা, তুমি আমাদের বলে দাও, কোনগুলি আমাদের পা আর কোনগুলি আমাদের হাত।’

কিন্তু মা অক্টোপাস এই সাংঘাতিক প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ! মা অক্টোপাস নিজেই কি জানে কোনগুলো তার হাত, আর কোনগুলো তার পা ? আর, সবচেয়ে বড় কথা তা জানারই বা দরকার কী ?

অক্টোপাসের ব্যক্তিগত সমস্যা কিংবা তার জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। বরং একটা কাণ্ডজ্ঞান এবং বাক্‌শক্তি সম্পন্ন বেড়ালের কথা বলি।

এই বেড়ালটি একটি প্রাচীন, মাথামোটা, সাদা-কালো হুলো বেড়াল। আমি নিজে স্বচক্ষে এই বেড়ালটিকে দেখিনি কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য এক ভদ্রলোকের মুখে এর বৃত্তান্ত শুনেছি।

গরমের দিনের এক ভরদুপুর বেলায় সেই ভদ্রলোক চেতলার এক গলি দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন। সুনসান মধ্য নিশীথের মতো ফাঁকা চারদিক, হঠাৎ গলির মুখের একটু আগেই ভদ্রলোকের গাড়িটা কী করে খারাপ হয়ে, একবার হ্যা-হ্যা-হ্যা করেই বন্ধ হয়ে গেল। প্রচণ্ড গরমে রাস্তায় পিচ গলছে, চারদিকে রোদ্দুরের ঝাঁজ, আশেপাশে জনমানব চোখে পড়ছে না। অন্তত গাড়ি ঠেলবার লোক সব রাস্তাতেই পাওয়া যায় কিন্তু এই সময়ে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক নিজে গাড়ির যন্ত্রপাতি সম্পর্কে ভাল জানেন না, তবু নিরুপায় হয়ে গাড়ি থেকে নামলেন, নেমে সামনেটা খুলে ইঞ্জিনের মধ্যে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন কোনও গোলমাল ধরা যায় কিনা। ঘামতে ঘামতে ইঞ্জিন পর্যবেক্ষণ করছেন এমন সময় তাঁর কানে এল কে যেন মোটা গলায় বলছে, ‘কারবুরেটরে গোলমাল মনে হচ্ছে।’ একজন সাহায্যকারী পাওয়া গেল এই আশায় ভদ্রলোক মাথা তুলে দেখলেন মানুষজন কিছু নয়, একটা বেড়াল। ছোটবেলায় সুকুমার রায়ের হযবরল পড়ে আর দশটি শিশুর মতোই মজা লেগেছিল তাঁর; সেই মজা, সেই কল্পকাহিনী কোনওদিন যে সত্যি হতে পারে এ তিনি ঘুণাক্ষরেও কখনও ভাবেননি।

সামনের একটা শতাব্দী-প্রাচীন তিনতলা বাড়ির অর্ধভগ্ন দেয়ালের উপরে একটি প্রলম্বিত এবং তুলনামূলকভাবে বৃহৎ গন্ধরাজ ফুলগাছের ছায়ায় পূর্ব-বর্ণিত সাদা-কালো অভিজ্ঞদর্শন বেড়ালটি বসে রয়েছে এবং সে-ই কথা বলছে। ভদ্রলোক মাথা তুলতে বেড়ালটি আবার গমগমে গলায় মানুষের মতো অবিকল বলল, ‘কারবুরেটরটা সারাতে হবে।’

ভদ্রলোক স্তম্ভিত হয়ে প্রাচীরস্থ বেড়ালটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, এমন সময় ওই তিনতলা বাড়ি থেকে এক বুড়ো ভদ্রলোক বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন, ‘কালাচাঁদ, এই কালাচাঁদ’, এইরকম হাঁকতে হাঁকতে। বেড়ালটিও দেয়াল থেকে এক লাফে ভিতরের দিকে নেমে চলে গেল। বুড়ো সদর দরজায় এসে গাড়ির সামনে বিপদগ্রস্ত ভদ্রলোককে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল, গাড়ির কিছু খারাপ হয়েছে ?’

বেড়ালকে কথা বলতে দেখার ধাঁধা ভদ্রলোকের তখনও কাটেনি, তিনি বললেন, ‘একটা বেড়াল আমাকে বললে…’, অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ভদ্রলোককে বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বুড়ো বললেন, ‘বেড়াল ? কাঁলাচাদ ? ওই সাদা-কালো যেটা এই দেয়ালের উপরে বসেছিল ?’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই সাদা-কালো বেড়ালটা।’ বুড়ো জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বলেছে কালাঁচাদ ?’ ভদ্রলোক রীতিমতো বিচলিত হয়ে বললেন, ‘বেড়ালটা বলল আমার গাড়ির কারবুরেটরটা নাকি খারাপ হয়েছে।’ বুড়ো হো হো করে হেসে বললেন, ‘কালাচাঁদ বুঝি তাই বলেছে ! কালাচাঁদের যত মাতব্বরি। ও গাড়ির কী বোঝে ? আপনি ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।’

এই কাহিনীর বাকি অংশ আমাদের এই জীবজন্তুর কাণ্ডজ্ঞানে প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস করার মতো গল্প নয় এটা, শুধু যিনি বলেছিলেন তাঁর উপর আস্থা আছে বলে এই গল্পটা লেখার সাহস হল।

তবে কিছুদিন আগে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বাতির নামে যে কথা-বলা হাতির বাচ্চার সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, সেটা পড়ার পর বুঝতে পেরেছি শুধু চেতলার বেড়াল নয়, রাশিয়ার হাতিও মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। আর বাতিরের কথাবার্তা অতি চমৎকার। সে মোটেই কালাচাঁদের মতো শয়তান নয়। তার একটাই দোষ, কাণ্ডজ্ঞান লেখক তারাপদ রায়ের মতো সে অনবরতই নিজের কথা বলে। ‘বাতির খুব ভাল, বাতিরকে স্নান করার জল দাও, কই বাতিরের খাবার কোথায় ?’ ইত্যাদি নিতান্ত আত্মগত ভাষণ বাতিরের, যা টেপরেকর্ডেও ধরা পড়েছে।

অবশ্য ক্যাঙারু, অক্টোপাস, বেড়াল বা হাতির বাচ্চা নয়, কথা বলার গল্প ঘোড়াকে নিয়েই বেশি।

অনেক গল্পের মধ্য থেকে দু’রকম দুটো ঘোড়ার কথা বেছে নিচ্ছি। প্রথমটি, ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া। ধরা যাক, ঘোড়াটির নাম যেমন হয় ‘হ্যাপি বয়’। হ্যাপি বয়ের জীবন কিন্তু খুব হ্যাপি নয়। সে রেসে দৌড়ায় বটে, কিন্তু তার স্থান খুব উঁচুতে নয়, সে মোটেই বাজি জিততে পারে না। জুয়াড়িরাও সেইজন্যে তার উপরে বিশেষ বাজি ধরে না।

সেদিন একটা রেসে অন্যান্য ঘোড়ার সঙ্গে হ্যাপিও বয়ও রয়েছে এবং যথারীতি তার উপরে বিশেষ কেউই বাজি ধরেনি। রেস আরম্ভ হওয়ার কিছু আগে রেস কোর্সের বুকিং কাউন্টারে কর্মরত ভদ্রলোক হঠাৎ শুনলেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় কে একজন বলছে, ‘দাদা, হ্যাপি বয়ের উপরে দশ হাজার টাকা ধরছি’, বলে এক তাড়া নোট কাউন্টারের সামনে এগিয়ে দিয়েছে। কাউন্টারের ভদ্রলোক কী একটা হিসেব মেলাচ্ছিলেন, তিনি হঠাৎ মাথা তুলে দেখেন একটা ঘোড়া দশ হাজার টাকার নোটের বান্ডিল কাউন্টারের উপর রেখেছে। সুখের বিষয়, তিনি আঁতকে ওঠেননি, রেসকোর্সে কাজ করে করে ঘোড়া ও মানুষের প্রভেদ করতে তাঁর একটু সময় লাগে। কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়া হল ‘হ্যাপি বয়’ শুনে, তিনি চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাপি বয়ের ওপরে দশ হাজার টাকা কেন ?’ কাউন্টারের ওপার থেকে সেই ঘোড়াটি বলল, ‘কারণ আমিই হ্যাপি বয়।’

দ্বিতীয় গল্পের ঘোড়াটি অবশ্য সাধারণ চড়বার ঘোড়া। এক ঘোড়সওয়ার তাঁর ঘোড়া থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে আহত হয়েছিলেন। সেই ঘোড়াটি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে এক পশুচিকিৎসককে ডেকে নিয়ে প্রভুর কাছে অকুস্থলে ফিরে আসে। পরে ওই ঘোড়ার মালিককে তাঁর ঘোড়ার এই বুদ্ধির প্রশংসা করলেই তিনি আপত্তি জানাতেন, ‘একেই বলে ঘোড়ার বুদ্ধি ! আমি কি ওর মতো ঘোড়া নাকি যে আমার জন্য ঘোড়ার ডাক্তার ডেকে এনেছে ?’

এত সব অলীক কাহিনীর শেষে একটি সত্যিকারের ঘটনা বলি। সেটা অবশ্য ঘোড়ার কথা বলার গল্প নয়। মানুষের কথা না বলার গল্প।

ছোটবেলায় আমাদের এক প্রতিবেশীর একটি ঘোড়া ছিল। সেটি তাঁর বাড়িতেই থাকত, কালেভদ্রে কখনও চড়তেন। সকালবেলা তিনি ঘুম থেকে উঠে ঘোড়াটিকে নিঃশব্দে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে আস্তাবল থেকে বার করে দিতেন। ঘোড়ার খাওয়ার পাত্রে ভুষি-ছোলা ইত্যাদি দিয়ে সেই টিনের পাত্রটি একটি লাঠি দিয়ে বাজিয়ে ঘোড়াটি অন্যমনস্ক থাকলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন খাদ্যের প্রতি। এমনকী ওই ঘোড়ায় চড়ে কখনও কোনও মোড়ের কাছে এলে, ‘ডাইনে’ বা ‘বাঁয়ে’ ইত্যাদি না বলে ঘোড়া থেকে নেমে লাগাম টেনে নির্দিষ্টমুখী হয়ে আবার ঘোড়ায় চড়তেন। তাঁর এই ব্যবহারে অবাক হয়ে একদিন আমি জানতে চেয়েছিলাম, অন্যরা যেমন বাঁয়ে-ডাইনে বলে, খাবার দিয়ে ডাকে, আপনি তা করেন না কেন ? ঘোড়া তো এসব কথা বেশ বুঝতে পারে। তিনি গম্ভীর মুখে আমাকে বলেছিলেন, ‘এ ব্যাটা আমাকে তিন বছর আগে একবার অন্যায়ভাবে চাঁটি মেরে ফেলে দিয়েছিল, তারপর থেকে আমি ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *