জমিদারী
নিবারণবাবু তার বিশাল সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তিন পুত্রের উপর অর্পণ করে গেলেও প্রকৃতপক্ষে গ্রামের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ভার কনিষ্ঠপুত্র রমেশবাবুর উপর ন্যস্ত ছিল। সরকারী চাকুরী সূত্রে বড় দুই পুত্র দীর্ঘদিন থেকেই জেলা সদরে নিজ নিজ বাসভবনে আছেন। গ্রামের বাড়ীতে তাদের একপ্রকার যাতায়াত নেই বললেই চলে।
নিবারণ বাবু জীবিত অবস্থায় বহু জমি গরীব চাষীদের মধ্যে বিতরণ করায় রমেশবাবু ব্যাপারটা খুব সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। পিতার এই দানশীলতার বিরুদ্ধে বারংবার প্রতিবাদ জানানো সত্যেও বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারেননি। একদিকে যেমন তার বিশাল জমির উপর আধিপত্য, তেমনি সুবৃহৎ বাড়ীর পিছন দিকে নিজ হাতে লাগিয়েছেন উন্নত জাতের নানান ফলের গাছ। বাড়ীর অন্যদিকে এক বিশালকায় পুকুর খনন করিয়ে গ্রামবাসীদের নানানভাবে উপকার করেছেন। গ্রামবাসীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে খুব সুখ্যাতিও অর্জন করে গেছেন তিনি।
পিতা স্বর্গবাসী হবার পর গ্রামবাসীদের আশার কীরণ ক্ষীণ হতে লাগল। রমেশবাবুর মধ্যে পিতার কোন মহৎ গুণ দেখা দিল না। ছোট ছোট নানান কারণে চাষীদের প্রতি নির্দয় আচরণ করতে লাগলেন। তার অত্যাচারের শীকার হতে চললেন সরলাদেবী ও তার পরিবার। এই দুঃস্থ পরিবারের কষ্টের দুমুঠো অন্নও কি রমেশবাবুর সহ্য হল না ?
রমেশবাবুর পিতা জীবিত অবস্থায় সরলাদেবীর পরিবারকে তার বাড়ীর সন্নিকটে একখন্ড ভূভাগে থাকতে দিয়ে তার কিয়দংশ জমি চাষ করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন রকম উইল করে দিয়ে যেতে পারেননি। এই দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে রমেশবাবু এক মর্মান্তিক চক্রান্তের সৃষ্টি করতে লাগলেন। তিনি নানান কৌশলে গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে আনার জন্য সচেষ্ট হলেন। সম্পদশালী ব্যক্তির বিপক্ষে এসে দাঁড়ায় এমন লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। আর যারাও দুঃস্থ পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখানো উচিত মনে করলেন তারা জনসমক্ষে মুখ ফুটে বলার সাহস করলেন না।
একদা রমেশবাবু গোপনীয় ভাবে জেলা সদরে এসে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আদালতের মাধ্যমে সরলাদেবী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ ভাবে জমি কব্জা করে আছেন বলে নোটিশ পাঠালেন। সেই সঙ্গে অতি সত্ত্বর জমি ছেড়ে চলে যেতে বলা হল। স্বামীহীন, অশিক্ষিতা, দুঃস্থ সরলাদেবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল। বুদ্ধিশূন্য ভাবে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর দেহ ও মনের খানিকটা হৃতশক্তি সঞ্চয় করে গ্রামের প্রতিভাবান ব্যক্তিদের নিকট এসে জমি সংক্রান্ত সমস্যার কথা অবগত করান। কিন্তু দুঃখির কথায় কেহ সংবেদনা প্রকাশ করলেন না। কেহ কেহ বললেন: “আদালতের নোটিশের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করতে পারব না। আপনি বরং জেলা আদালতে গিয়ে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করুন।”
এই পরামর্শের ভিত্তিতে সরলাদেবীর মাথায় নতুন বুদ্ধির উদয় হল। তিনি একদিন জেলা সদরে রমেশবাবুর দুই দাদার সঙ্গে আলোচনা করায় মনের ভাব কিছুটা হলেও হাল্কা হল। উনাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারলেন যে আদালতের উক্ত নোটিশে অযথা ভয় পাবার কোন কারণ নেই। উনাদের সাক্ষ্য ছাড়া পৈতৃক সম্পত্তির একাংশও রমেশবাবু নিজের বলে দাবী করতে পারবেন না। সরলাদেবীকে আশ্বাস দিলেন যে পিতা কর্তৃক প্রদত্ত জমি থেকে তার পরিবারকে বেদখল করার সাহস ছোট ভাইয়ের হবে না। বললেন: “আদালতে যাবার কষ্ট আর আপনাকে করতে হবে না। আপনি বাড়ী ফিরে যান। আপনার কষ্ট লাঘব করার জন্য ছোট ভাইকে একখানা পত্র লিখে পাঠাচ্ছি।”
সেই পত্রপাঠ মাত্রই রমেশবাবু অতিশয় ক্ষুব্ধ হলেন। প্রথম বারের মত নিজের গড়া চক্রান্তে সফলতা না পেয়ে তিনি পূর্বাপেক্ষা অধিক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন।
এ যাত্রায় রমেশবাবু কিছুটা পিছু পা হটলেন বটে কিন্তু চক্রান্তের অবশিষ্ট মনের মধ্যে পুশে রাখলেন। সাময়িকভাবে কলহের যবনিকা পতন হলেও তিনি জমিদারী কৌশলে অসহায় পরিবারের ব্যাপক ক্ষতি সাধনের ইন্ধন যোগাতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি একদিন গ্রামবাসীদের ডেকে আলোচনা করে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্রামবাসীরা ভেবে নিলেন তার হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে। সকলে স্কুলের জায়গার কথা জানতে চাইলে তিনি স্থিরভাবে উত্তর করলেন : ” সরলাদেবীর পরিবারকে সরিয়ে সেখানেই স্কুল খুলব।”
এই কথা শোনা মাত্রই অনেকে হাততালি দিয়ে সমর্থন জানালেন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে ন্যায় অন্যায় বুঝার মানসিকতা সবার থাকে না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ বয়োজ্যেষ্ঠ এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন:
“এই অসহায় পরিবারই বা যাবে কোথায়?”
প্রতি উত্তরে রমেশবাবু বলে উঠলেন: “সে ভাবনা সেই পরিবারের। এতদিন আমাদের এই জমিতে থাকতে পেয়েছে এটাই কি কম নয়? তাছাড়া গ্রামবাসীর সকলের স্বার্থ এখানে জড়িয়ে আছে। শুধুমাত্র একটি পরিবারের কথা ভেবে কি হবে?”
তুলনা করে দেখা যায় যে বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে হয়। তবে কি এই দুঃস্থ পরিবারকেই ভিটেমাটি ছাড়তে হবে? না কেউ তাদের সহায়তার জন্য হাত বাড়াবে?
পরদিন সকালবেলায় রমেশবাবুর প্রেরিত একদল লোক এসে উপস্থিত হলেন সরলাদেবীর বাসস্থানে। সরলাদেবী এই সকালবেলায় গ্রামের অর্থশালী ও প্রভাবশালী লোকদের দেখে দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন। তিনি বললেন: “আপনারা কি মনে করে এসেছেন জানতে পারি কি?”
আগন্তকদের মধ্য থেকে ধীরেনমশাই বলে উঠলেন: “দেখুন সরলাদেবী, আপনার সঙ্গে আমাদের কোন মনোমালিন্য নেই। আমাদের কোন প্রকার দোষ দেবেন না। আমরা শুধু রমেশবাবুর কথা আপনাকে জানাতে এসেছি। উনি এই জমিতে স্কুল খুলবে বলে মনস্থির করেছেন। কাজেই আপনাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। একথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে আপনারা বেআইনিভাবে এখানে বসতি করে আছেন।”
এসব শুনে সরলাদেবী নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না। চরা গলায় বলে উঠলেন: “দেখুন ধীরেনবাবু, আমি লেখাপড়া না জানতে পারি ; আইনের মারপ্যাচও বুঝি না, তবে এটুকু জোর গলায় বলতে পারি যে আমরা এখানে উড়ে এসে বসিনি। আজ নিবারণবাবু বেঁচে থাকলে এসব কথা শুনতে হতো না। তিনি আমাদের বংশানুক্রমে মালিকানা হক লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই।”
দূর হতে এসব কথা শুনতে পেয়ে তার বড় ছেলে রামলাল বলল : “আমাদের আর্থিক ক্ষমতা কম হতে পারে, কিন্তু কারো সাধ্যি নেই যে আমাদেরকে এ জমি থেকে উৎখাত করে। একটু হলেও পড়াশুনা করেছি। আইন কি শুধু ঐ একমাত্র রমেশবাবুর জন্য? দেখতে পারছেন না এই আম, কাঁঠাল ও নারিকেল গাছগুলো কত বড় হয়েছে। এগুলো বাবা জীবিত অবস্থায় লাগিয়েছিলেন। না হলেও কুড়ি বছর হয়েছে। যদি এই ভিটেমাটির উপর অধিকার না থাকতো তাহলে কি আমরা এখানে আপনমনে থাকতে পারতাম? রমেশবাবুর তো বিস্তর জমি আছে, সেই জমি থেকেই কিছুটা দান করুক। তাতে কি উনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে?”
গ্রামবাসী অসহায় মা ও ছেলের কথা শুনে লজ্জিত বোধ করলেন। সবকিছুই জলের মতো বুঝতে পারলেন যে রমেশবাবুর স্কুল খোলার উদ্দেশ্যের পেছনে নিগুঢ় স্বার্থ ও প্রতিহিংসা জড়িয়ে আছে। এতদিন যারা রমেশবাবুর চাটুকারীতা করে এসেছেন, তারা সবাই পালা বদল করে রমেশবাবুর বাড়ী গিয়ে তার উপর চাপ সৃষ্টি করে বললেন:
— আপনি বরং আপনার নিজস্ব জমিতেই স্কুল খুলুন। অযথা নিপীড়িত সরলাদেবীর উপর অযৌক্তিক ভয় সৃষ্টি করে জমিদারী দেখানোর কোন মানে হয় না। আমরা সর্বসম্মতি ক্রমে স্বর্গীয় নিবারণবাবুর আশ্বাসকেই সমর্থন করি। আশাকরি আপনি আগামীকাল সেই জমির কাগজপত্র লিখে দিয়ে সরলাদেবীর পরিবারকে উদ্ধার করবেন! আমরা চললাম!