জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 01
মার্চের দশ তারিখ হয়ে গেল। কিন্তু এখনও দেখছি দু এক দিন অন্তর অন্তরই ব্রুকলিনের আকাশ তুষার ঝরিয়ে চলেছে। পনেরটা শীতের মধ্যে তেরটাই আমাদের কেটেছে দক্ষিণে যেখানে কর্কটক্রান্তি নিকটবর্তী হওয়ার দরুন আবহাওয়া অনেকটা নম্র। শীতটা শুধু একটু কড়া। দিল্লির শীতের মতো। তা-ও জানুয়ারীর পরই শীত পাততাড়ি গুটোয়। এতো তুষার বা ব্লিজার্ড আমাদের অভ্যেস নেই। বৃষ্টিপাতের মতো তুষারপাতও আমার মতে কাচের আড়াল থেকে উপভোগ করবার জিনিস। বেরোতে হলেই চমৎকার! গত বছরটা শীতের মরশুমে পালিয়েছিলুম অস্ট্রেলিয়ায়। একা। সাত সপ্তাহের মতো লেকচার ট্যুর। দক্ষিণ পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার কিছুটা ওই সুবাদে ঘুরে আসাও গেল, উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের শীতের কামড়টাও এড়ানো গেল। আমি বরাবর শীতকাতুরে। আমার স্ত্রী কমলিকার আবার গরম সয় না। হিউসটনের গরমটা একেক সময় ট্রপিক্যাল হীটের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তার ওপরে আছে গাল্ফ্ অফ্ মেক্সিকো থেকে ছুটে আসা নখদন্তবিশিষ্ট হারিকেন। হিউসটন থেকে নিউ ইয়র্ক—প্রথম ঝোঁকে আবহাওয়া বদলটা তাই মন্দ লাগেনি। আমার বন্ধু জ্যোতি বরাবরই এখানে। ব্রঙ্কস্-এর হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত ব্যস্ত ডাক্তার। ও আশ্বাস দিয়েছিল স্প্রিং সেমিস্টারের মধ্য ও অন্ত্যভাগে খুব সুন্দর আবহাওয়া পাওয়া যাবে। শহরের উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত বীথিকাগুলোর মধ্য দিয়ে শুধু ড্রাইভ করতেও তখন খুব ভালো লাগে।
এবারেই কি তা হলে ব্রুকলিনের চরিত্র পাল্টে গেল? আমি তো দেখছি ছলনাময়ী এ য়িহুদি ললনা। রহস্যগুণ্ঠনে নিজেকে আবৃত রেখেছে। শীত তো বটেই। হাওয়াও এলোমেলো। সবচেয়ে মজার কথা এই শীতের মাঝখান থেকে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে এসেছে এক একটা উষ্ণ সোনালি দিন ফ্রেশ ফ্রম দি ওভ্ন্ বেক্ড্ চিংড়ির মতো। তখন খুলে ফেলতে হয়েছে গ্রেট কোট, গ্লাভ্স্, মাফলার। ছুটি আর কই? তবু ছুটির মেজাজ এসে গেছে, মনে হয়েছে ওদের সবাইকে ডাকি, বলি—‘চলো আজ স্কুল-টুল, অফিস-টফিস নয়, আজ হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলবো বাফেলোর দিকে। দুপাশে পড়বে অনবদ্য সব শহরতলি। জলরঙে আঁকা মফঃস্বল, গ্রামাঞ্চল। মোটেলে মোটেলে কয়েকটা অযান্ত্রিক লঘু প্রহর কাটিয়ে, সকালে কোনও ফাস্ট ফুড জয়েণ্ট থেকে মোটা সোটা হাম বার্গার আর সন্ধের মুখে তিন চার কোর্সের ইস্পাহানী ডিনার খেয়ে আবার ফিরে আসা যাবে গুহায়।’ কিন্তু এসব খেয়ালখুশীর কথা এখানে উইক-এণ্ড ছাড়া বলা যায় না। ও ভাষাই এ মহাদেশে অচল। নিয়ম করে এই আনুষ্ঠানিক উইক-এণ্ড পালনে আবার আমার প্রচণ্ড অনীহা। বাধ্যতামূলক হলে রিল্যাক্সেশন কি আর রিল্যাকসেশন থাকে?
উত্তরের শীত দেখছি বেশির ভাগই আমাদের ক্ষেত্ৰী বন্ধু বর্মনের বউয়ের তৈরি দহি-বড়ার মতো ভারি-ভারি, ভিজে-ভিজে। রসে টই-টম্বুর। টক আর ঝাল রস। এই রসের প্রভাবেই কি না জানি না তুমুল তর্ক করেছি সেদিন আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে। ওর বউ মেরিয়ানের চোখের নিষেধ গ্রাহ্যও করিনি। মেরিয়ান বলে আলেকজাণ্ডারের ধারণা ভারতীয়রা, বিশেষতঃ বাঙালিরা নাকি আগ্নেয় মেজাজের হয়। এতে ভারতীয়র সঙ্গে কাজ করেছে ও যে বাংলাদেশীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গীয়, গুজরাটির সঙ্গে মারাঠী তফাত করতে পারে। ওর বিষয় হওয়া উচিত ছিল অ্যানথ্রপোলজি। এমনিতে ও খুব পছন্দ করে বাঙালিদের, অনুপম দে সরকার বলে জনৈক ভদ্রলোক ওর কাছে কাজ করে গেছেন। এখনও আলেকজাণ্ডার তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কল্পনাশক্তির সঙ্গে বুদ্ধির এমন মিশ্রণ না কি চট করে আর কারো মধ্যে দেখতে পায় না। কিন্তু এই মেজাজের আভাস দেখলেই শুনেছি ওর ভেতরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মেরিয়ানের আবার আমার ওপর খুব পক্ষপাত। ‘বন্ধ হবো-হবো দরজাটার সামনে ও দেখি সতর্ক প্রহরা দেয়। কেন আমি কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি। তবে মনে হয় আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা নিয়ে বেচারি খুব মুশকিলে পড়েছে। একমাথা রুপোলি চুল, কচি মুখের এই মোটাসোটা প্রৌঢ়া আলেকজাণ্ডার রাটলেজের হাইস্কুল সুইট হার্ট। হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনের পর আর পড়াশোনা করবার সুযোগ পায়নি। এদিকে আলেকজাণ্ডার একমুঠো দামী ডিগ্রি নিয়ে এখন নিউ ইয়র্ক মেডিক্যাল সেণ্টারের বায়ো কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যান। খুব সম্ভব মেরিয়ানের যৌবনের সবটাই ব্যয়িত হয়েছে বরের উচ্চশিক্ষার মাশুল যোগাতে, ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে। সেই চার ছেলেমেয়ের একজনের সঙ্গেও এখন বৎসরান্তে দেখা হয় না। আলেকজাণ্ডার এখন সাতান্ন বছরের যুবক, আর মেরিয়ান বেচারি সাতান্ন বছরের বৃদ্ধা। আলেকজাণ্ডার অল্পবয়সী ছাত্রীদের সঙ্গে খুব রোমিওগিরি করে দেখি, আবার ওয়েডিং অ্যানিভার্সারিতে বউকে হীরের আংটিও কিনে দেয়। তুখোড় খেলোয়াড়, দু হাতে খেলে যাচ্ছে। মেরিয়ান আমাকে ওর জীবনের অনেক কথাই বলে থাকে। যত হাসি তত কান্না বলে গেছে রামশর্মা। বলে একটা প্রবাদ আছে আমাদের ভাষায়, মেরিয়ানের বোধ হয় সেই ব্যাপার। স্কুল-জীবনে চুটিয়ে প্রেম করেছে, এখন শুধু বর্ণহীন দিনযাপন। খুব সম্ভব আমি ওর কাছে পুরুষদের বিশ্বস্ততার একটা প্রতীক ট্রতীক হবো। আগে আমায় রীতিমতো জেরা করতো ‘শ্যারন গিলারির সঙ্গে তোমার কিছু নেই! মিছে কথা! তা হলে বোধহয় তুমি নিজের দেশের মেয়ে ছাড়া পছন্দ করো না, হোয়াট অ্যাবাউট দ্যাট ডক্টর্স ওয়াইফ?’ আমার মজা-পাওয়া হাসি দেখে ওর মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। সব মেয়ের স্বামীই যদি ওর স্বামীর মতো ভ্রমরস্বভাব হত তাতে ওর একটা সান্ত্বনা ছিল! যাই হোক, ও চায় আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো থাকুক। আমাদের ইনফর্ম্যাল আলাপচারিগুলোও ও খুব নিপুণ হাতে মনিটর করে। করুক। শী মে হ্যাভ হার ওন রীজনস। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই নিষিদ্ধ প্রদেশে পা ফেলি। আর কি করবে আমার? মেরিয়ানের চোখে বিপদসঙ্কেত জ্বলে ওঠবার পরও আমি বেশ মেজাজে ঝগড়া করে যাই। আলেকজাণ্ডারও কিন্তু সৌভ্রাত্র্যসহকারেই আলাপ চালিয়ে যায়। ও শীতল হলেই যে আমার অগ্ন্যুৎপাত বন্ধ হয়ে যাবে এমন কথাও আমি দিতে পারি না। যাই হোক, অবশেষে মেরিয়ানের ভাণ্ডার থেকে তো বেরিয়ে আসবেই হুইস্কি অন দা রক্স্। সব ধুয়ে মুছে সাফ। সে ফুটন্ত লাভাই হোক আর হিমশীতল হাডসনের জলই হোক।
আমাদের রাস্তাটায় মেপল বেশি। দু চারটে চেরিও আছে। মেপল্-এর বড় বড় বাহারে ডালের ওপর ফ্রস্টের একটা পাতলা মসলিন আস্তর পড়েছে দেখতে পাচ্ছি। খুবই মনোহর। কিন্তু আশপাশে তাকালে জীবনে অনীহা আসে। সুন্দর শুধু ওই প্রাকৃতিক বিন্দুগুলোই। এবং বেরোতে না হলে। প্রথম যখন এসেছিলুম নিউ ইয়র্ক এখন তার চেয়েও মলিন হয়ে গেছে। বরফ-কাদা মেখে থাকলে সর্দিমাখা বাচ্চার মতো ঘিনঘিনে লাগে। এরকম সময়ে কলকাতায় আমাদের বাল্য-কৈশোরের রিমঝিম বর্ষার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। অতীত মানেই রোমাণ্টিকতার মোড়কে মোড়া স্মৃতি। কলকাতার বর্ষার জমা জলে গো এবং মানবকৃত ময়লা কি আর ভাসত না? কিন্তু মোড়ক খুলে দেখছি রয়ে গেছে শুধু কাগজের নৌকো আর রবীন্দ্রনাথ: “জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে মাঠের পরে, আজ মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে।’ সেসব দিনের অকালসন্ধ্যায় অফিসযাত্রীরা হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে এক হাতে জুতো আর হাতে জোড়া ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আমার বাবাও তাদের মধ্যে থাকতেন। পায়ে কাদা, মুখে হাসি। রেনি-ডের ফলে আমরা স্কুল-বিচ্ছুরা অনেক আগেই বাড়ি ফিরে দাপাদাপি করছি। ঠনঠনেতে কোমর জল। বড়দা মেজদা কলেজ যেতেই পারেনি। সুতরাং দুপুর-খেলা চলছে। বড়দা-মেজদা ক্যারম, খেলতে খেলতে মাঝে মাঝেই বড়দা চড়া গলায় গেয়ে উঠছে, ‘এই কি গো শেষ দান!’ ‘না না, বিরহ দিয়ে যাইনি’—বেশ মিড় দিয়ে শেষ করছে মেজদা। অর্থাৎ নেক-টু-নেক ফাইট চলছে। এদিকে আমি, দিদি, ছুটকি আর সুমিত টোয়েণ্টিনাইন। ছুটকিটা দেদার আজেবাজে ডাক দিচ্ছে, আমি রেগে মেগে পার্টনার বদল করতে চাইলেই সরু গলায় চেঁচিয়ে উঠছে—‘প্লীজ, আরেকবারটি চান্স দে সেজদা।’ শেষ দুপুর পেরিয়ে গেছে, বিকেল মেঘের পেছনে, সন্ধে, হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ইলিশমাছ ভাজার গন্ধে মাতাল হাওয়া। পড়ে রইল ক্যারম বোর্ড, তাসের প্যাকেট। ইলশে-গন্ধ আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচে, রান্নাঘরে। বড়মার তোলা উনুন ঘিরে আমরা কজন। সুকৃতকে মনে পড়ছে না। ও কি তখন খুব ছোট ছিল? আমাদের হাতে মাতৃবাহিত প্লেটে গরম গরম ডিমভাজা মাছভাজার প্রেলিউড। বুঝতেই পারছি রাতটা জমবে ভালো।
আজকের এই ঝিরিঝিরে বরফের দিনটা ওই বার্ষাসন্ধ্যারই মার্কিনি সংস্করণ। কিন্তু ইলিশি উপহারের কোনও মার্কিন বিকল্প নেই। নেই হঠাৎ-ছুটির রোমাঞ্চ। গাড়িগুলোকে দেখলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই রকম একখানা গাড়ির অন্দরে আপাদমস্তক ঢাকা গরিলার মতো আমাকে দেখা যাবে। মোটেই সুখপ্রদ অবস্থা নয়।
আজ আরাত্রিকার জন্মদিন। প্রতি বছর এ দিনটা একবার করে আসেই, এটা পুরনো কথা। এবার কিন্তু একটু নতুনভাবে আসছে। তের পূর্ণ হয়ে চোদ্দয় পড়ল ও। এইরকম অর্থপূর্ণ সময়ে ব্লিজার্ড ট্রিজার্ডের প্রাকৃতিক আয়োজন দেখে প্রাচীন প্রাচ্য সংস্কার কেমন ঘাবড়ে যাচ্ছে। হাক্সলির কোন বইয়ে যেন পড়েছিলুম, মানুষ সব সময়ে নিজেকে জগতের কেন্দ্র ভাবে। অথচ সে কেউ নয়। তাকে ভেবে কিছু ঘটছে না। যদিও ভীষণ আত্মসচেতনভাবে অবিরাম সে তাই-ই ভেবে যাচ্ছে। এ এক রকমের অহষ্কৃত বোকামি। আবার সান্ত্বনাও। হাক্সলি কথিত ওই ধরনের অমোঘ মনস্তাত্ত্বিক ভ্রান্তিতে পড়েছি নিশ্চয়। প্রকৃতির ওপর নাটুকেপনা আমিই চাপাচ্ছি। প্রকৃতি কোনও অ্যাবসার্ড নাটক উপস্থিত করছে না। প্রকৃতির নাটক এমনিতেই অ্যাবসার্ড। তা হলে? এভাবে ভাবছি কেন? তবে কি এখনও আঁধার যায়নি? এখনও বাধা রয়েছে? এবং দ্বিধা। অথচ আমাকে তো সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে।
কমলিকা জিজ্ঞেস করেছিল—‘লোকে পাঁচের মাল্টিপ্ল্ বছরগুলোকে বিশেষ চোখে দ্যাখে, তুমি হঠাৎ এই আনলাকি থার্টিনটা নিয়ে এতো মাতামাতি করছ কেন?’ আচ্ছা, ওরই তো বেশি করে বোঝা উচিত ছিল কেন এই তের এতো জরুরি। ওর নিজের রক্তমাংসে গড়া মানুষীটির অভ্যন্তরে জীবনের প্রথম বীজটি ফাটছে। তার জন্য শরীরের মধ্যে কত আয়োজন! পুরো এণ্ডোক্রিন সিস্টেমটা ঝড়ের বেগে কাজ করে চলেছে। জীবন এবার সমুদ্রগামী নদীর মতো কলকল্লোলে ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত সত্তায়। দেহের রসায়নে বিপ্লব। ভেতর থেকে ঘুম ভেঙে উঠে বসবে একটা আনকোরা নতুন মানুষ। তার হাসি-কান্নায় নতুন মাত্রা। অনুভবে নতুন স্বাদ, খেলা কি আর শুধু খেলাই থাকবে? সযত্নে গড়ে তোলা ছেলেমানুষি পৃথিবীর গণ্ডি ফেটে বেরিয়ে যেতে থাকবে হিসেবের বাইরের অতিরিক্ত জীবন। সে অপচয়ে কি আনন্দ! কি রোমাঞ্চ! এই প্রাচুর্য ওকে কি শুধু উচ্ছ্বাসই দেবে? না প্রগাঢ়তা! কিভাবে এই যৌবনকে ও গ্রহণ করবে, ব্যবহার করবে তারই ওপর তো নির্ভর করছে সব কিছু! তা ছাড়া তেরকে শুধু শুধু আনলাকিই বা ভাবতে যাবো কেন? আমাদের ঐতিহ্যে যতদূর জানি তেরকে অপয়া ভাবার কোন নজির নেই। এখন আন্তর্জাতিকত্ব প্রাপ্ত হয়ে আমরা ক্রীসমাস আর দুর্গাপুজো, পায়েস আর পুডিং সবই চার হাতে ভোগ করছি খুব ভালো কথা। কিন্তু কুসংস্কারে কুসংস্কার যোগ করা বোধ হয় ঠিক না। আমাদের ত্রয়োদশীর চাঁদে একটি একটি করে কলা যোগ হবে। এই সময়ে ঠিকমতো পরিচালিত করতে না পারলে পরে মুশকিল আছে না?
কমলিকা ঠাট্টা করছিল—‘তোমার মতো বাবা কোটি কোটি আছে। তাদের মধ্যে শতকরা দু চারজনও তো তোমার মতো বোদ্ধা! তারা তো কেউ নিজের মেয়ের বড় হওয়া নিয়ে এতো মাথা ঘামায় না!’
‘প্রথমত তুমি জানলে কি করে যে তারা ঘামাচ্ছে না! দ্বিতীয়ত আমার পরিস্থিতি ভিন্ন। সেই পরিস্থিতিই আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে।’
—‘জ্যোতি, দীপঙ্কর এদের পরিস্থিতি তোমার চেয়ে ভিন্ন? ওদেরও তো একটা করে মেয়ে রয়েছে, না নেই? দীপঙ্করের তো একমাত্র। ওরা কেউ কোনদিন এইসব আজগুবি অবসেশনের কথা তোমাকে বলেছে? ছেলেমেয়ে নিয়ে দীপালির সঙ্গেও আমার কম আলোচনা হয় না। ওরা তো এসব ভাববারই সময় পায় না। এতো কাজের মধ্যে তুমি কী করে পাও সেটাই আশ্চর্য।
—‘দীপঙ্করের কথা আলাদা। অ্যানকে বিয়ে করে ও একেবারে অ্যামেরিকানাইজড্ হয়ে গেছে। না হয়ে উপায়ও নেই। আর জ্যোতি তো সিটিজেনশিপ নিয়েই নিয়েছে।’
—‘তুমিই বা নিচ্ছো না কেন?’
কমলিকা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে কার্পেটের ফুল খুঁটছে। অর্থাৎ এ প্রশ্নটা ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারে না।
আমি চুপ করে গেলুম। ভাবতে হবে, সত্যিই আমাকে আরও আরও ভাবতে হবে। সেদিন দীপালির সঙ্গে ও বাড়ির ব্যাপারে গিয়েছিল। নিউ জার্সিতেই বাড়ি কেনবার পরামর্শ দিচ্ছে জ্যোতি। আমি ব্রুকলিনের এই অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে আপাতত নড়বার কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছি না। আমার ইন্সটিটিউট এখান থেকে খুব কাছে, কাছে আরাত্রিকার স্কুলও। কমলিকাকেই একটু দূরে যেতে হয়। নিউ জার্সি গেলে আরও দূর হয়ে যাবে। বাড়ির ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ওকে আমি বারণ করে দিলুম। সেই থেকে অকথিত একটা প্রশ্ন অশরীরীর মতো আমাদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেন আমি এখনও লোভনীয় মার্কিন নাগরিকত্ব নিচ্ছি না। কেন এখনও সেটল করছি না। জ্যোতির মতো, দীপঙ্করের মতো, শরদ পারেখ কি বর্মনের মতো! এই একটা ব্যাপারে কমলিকার সঙ্গে আমার মতের অমিল। সারা জীবন যা বলেছি বেচারি বেদবাক্যের মতো পালন করে এসেছে। ওর এই প্রশ্নহীন বাধ্যতা ও তন্ময়তার সঠিক মূল্য আমি দিতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করেছি। ও অসুখী হয়েছে এমন কোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি করিনি কখনও। বরং অসুখ থেকে, সমস্যা থেকে বাঁচিয়েই এসেছি ওকে বরাবর।
আমি জানি, আসলে দেশে কমলিকা অসুখী ছিল। যা রোজগার করতুম তাতে যৌথ পরিবারের পাওনাগণ্ডা চুকিয়ে হাতে বিশেষ কিছু থাকত না। কমলিকা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল উপরন্তু ছোট পরিবারের মেয়ে। খুবই সুখ স্বাধীনতার মধ্যে মানুষ। ওর তাতে অসুবিধে হত। যদিও সেকথা মুখ ফুটে ও কোনদিনও আমাকে বলেনি। আমি অনেক লোভনীয় চাকরি প্রত্যাখ্যান করে গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকতুম। ব্যাপারটা বড়রা কেউই ভালো চোখে দেখতেন না। কমলিকা গান করত। ওর ওই রেডিওয় গাওয়া-টাওয়া কারো পছন্দ ছিল না। উপরন্তু ও তখন সবেমাত্র পাশ করেই ইউ. জি. সি. স্কলারশিপ পেয়েছে। আমি ওকে দুটো জিনিসই সিরিয়াসলি নিতে বলেছিলুম। মেয়েদের বিশেষতঃ বিবাহিত মেয়েদের স্কলারশিপ বড় একটা কেউ দিতে চায় না। সব গাইডেরই এক অভিযোগ। মেয়ে মানেই বিয়ে, তারপর বাচ্চা, কাজের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না। মাঝখান থেকে স্কলারশিপের টাকাটা আটকে যাবে। অভিযোগ মিথ্যে নয়। আমার দেখা বহু মেয়ে সহকর্মী ও ছাত্রী এইভাবে মাঝপথে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। মেয়েদের পক্ষে পরিবেশগত বাধা কাটিয়ে ওঠা বড় সহজ নয়। আমাদের বাড়িতেই দেখেছি। যার জন্য দিদির অমন কেরিয়ারটাই মাটি হয়ে গেল। কমলিকার ব্যাপারটা কেউ সহানুভূতির চোখে দেখত না। মার কথা বলতে পারি না। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। বড়মা বুঝতেন না। অযথা নানারকম বিরূপ মন্তব্য করতেন। মা যদি কোনও মত প্রকাশ করেও থাকেন সেটা হয়ত নিজস্ব নয়। বড়মার অপছন্দের প্রতিক্রিয়া। বউদি দুজনেরও কোথায় যেন একটু গ্রাজ ছিল। কেন, কী বৃত্তান্ত অত মেয়েলি সাইকলজির মধ্যে প্রবেশ করার সাধ্য বা সাধ কোনটাই আমার নেই। তবে কমলিকা যুগপৎ দুটো বিপরীত কমপ্লেক্সে ভুগত এটা লক্ষ্য করেছি। ও যে অন্যদের মতো নয়, একটু অন্যরকম, এতে ওর আত্মপ্রসাদ আর সঙ্কোচ দুইই ছিল। ওই তো বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম মহিলা তার ওপর শিল্পী। আমার বধূ-নির্বাচন হয়ত বড়মা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, তাইই সাত তাড়াতাড়ি নিজের মনোনীত পাত্রীর সঙ্গে সুমিতের বিয়ে দিয়েছিলেন। যদ্দুর জানি, সম্পর্ক ভালো হলেও রীণার সঙ্গে কমলিকার ঠিক জমেনি। টাকা পয়সার চূড়ান্ত অভাবও আমায় কাবু করতে পারত না যদি কমলিকা বেচারি অতটা কাবু না হত। ও সব সময়েই ভাবত। ছায়াভরা দিঘির মতো গভীর চোখগুলো ওর সবসময়ে বিষণ্ণ হয়ে থাকত। আমাদের প্রথম সন্তান বাবুকে প্রতিদিন ডিম-কলা-পরিজের ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে না পারলে ও চোখের জল ফেলত। কিছুতে বুঝত না আমাদের দেশের সত্তর পার্সেন্ট বাচ্চা পেট ভরে খেতেই পায় না। ডিম-কলার ব্রেকফাস্ট খেয়ে মানুষ হতে হবে এ এক ধরনের সংস্কার। ইন ফ্যাক্ট, আমি নিজেই হইনি। আমাদের বাড়ির বারোয়ারি জলখাবার ছিল আটা বা ময়দার হাতরুটি। কি সকালে, কি বিকেলে। তাতে কি আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু কম হয়েছে? না স্বাস্থ্য কিছু খারাপ হয়েছে? কিন্তু ও কিছুতে বুঝতে চাইত না। ও নিজে ডিম-কলা খেয়ে মানুষ হয়েছে সুতরাং ওর ছেলেকেও ঠিক তাইই খেতে হবে। ডিম হল কমপ্লিট ফুড। ওই ওর এক কথা। আমি এভাবে ভাবি না। কোনরকম স্টিরিওটাইপ্ড্ জীবনযাত্রায় আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু নিজের বিশ্বাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার সাধ্যই বা আমার কই! কমলিকার সঙ্গে আমার সম্পর্কে একটা ছাত্র-অধ্যাপক গন্ধ থেকে গেছে। ওর গাইড ডক্টর মালিক কতকগুলো বায়ো-কেমিক্যাল ডেটার জন্য ওকে বারবার আমার কাছে পাঠাতেন। আমার প্রতি এতো নির্ভরশীল, এতো বাধ্য বোধহয় ও সেইজন্যেই। কিন্তু আমিও ওর প্রতি কম নির্ভরশীল নই। সেটা সারাজীবন একটু একটু করে হয়েছি। অথচ আমার মতো স্বনির্ভর বাঙালি ছেলে কমই আছে। মেয়েলি কোন কাজই আমার আটকায় না। আমাদের বউবাজারের বাড়িতে আমি ইলেকট্রিক ওয়ারিং সারাইও করেছি আবার মা-বড়মাকে রুটি লুচি পর্যন্ত বেলে দিয়েছি। বাড়িতে মুরগী রান্না হলে রান্না এবং পরিবেশনের ভার আমাকেই নিতে হত। উঠোনে জ্বল জ্বলে রোদের মধ্যে অচ্ছুৎ উনুনে অচ্ছুৎ বাসনে কোমর বেঁধে মুরগী রান্না, তারপর কলাপাতায় করে রোয়াকে বসে ভক্ষণ এবং পরে আপাদমস্তক স্নানের কথা মনে পড়লে কি হাসিই না পায় এখন। সুমিতটার সর্দির ধাত ছিল বলে ওর স্নানটা মাপ ছিল। জামাকাপড় বদলাবার পর গঙ্গার জল ছিটিয়ে ওকে ঘরে তোলা হত।…কিন্তু কমলিকার মধ্যে কোথায় যেন একটা জোর আছে। নিজের বিশ্বাসের প্রতি ও নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে পারে বোধইয়, বাইরে থেকে যতটা নমনীয় মনে হয়, ততটা নয়। আমার ক্ষেত্রে আবার জিনিসটা ঠিক উল্টো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেও ভেতরে প্রশ্ন আমার থেকেই যায়। কারো কাছে সে দ্বিধা প্রকাশ করতে পারি না বলে ভেতরে মানসিক চাপ কখনও কখনও অসহ্য হয়ে ওঠে। আমেরিকায় আসার সিদ্ধান্ত নেবার পর, এমনকি এখানে চলে এসে পুরোপুরি বসবাস করতে আরম্ভ করার পরও আমার এ দ্বন্দ্ব যায়নি। রাত্রে প্রায় মাকে স্বপ্ন দেখতুম, ম্লান মুখে কি যেন বলবার চেষ্টা করছেন, বাবা যেন অনেক দূরে কোথায় চলে যাচ্ছেন। গায়ে ঢোলা খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে তালতলার চটি, হাতে ছাতা। আমি বাবার পেছন পেছন ছুটছি। ধরতে পারছি না, ‘বাবা, বাবা যাবেন না’ বলে চেঁচাচ্ছি, বাবা শুনতে পাচ্ছেন না। হঠাৎ একসময়ে পেছন ফিরলেন, দেখলুম ওটা আদৌ বাবা নয়, স্বর্ণেন্দু ওই রকম মেক-আপ নিয়েছে। কি অদ্ভুত ছেলেমানুষি স্বপ্ন! তবে ওর মধ্যে আমার অপরাধবোধ এবং দুর্ভাবনার ফোক্যাল পয়েন্টগুলোকে ঠিকই ধরা যায়। যাইহোক, জীবন সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তই আমি কমলিকাকে জিজ্ঞেস না করে নিতে পারি না।
শুনতে পাচ্ছি, প্রাত্যহিকের টুং-টাং আরম্ভ হয়ে গেছে। আমার দাড়ি কামানো শেষ। পনের বছর ধরে একই নিয়মে হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়ে ইনস্টিটিটিউট যাচ্ছি। আজও যাবো। আজ একটা স্নো-বুট আর রেনকোট লাগবে। এক্স-রে ক্রিস্ট্যালোগ্রাফার শ্যারনের সঙ্গে আজ খুব জরুরি কাজ আছে। কমলিকা কি একবার ডাকল?
কোটটা কাঁধে ফেলে কিচেন আর ডাইনিং রুমের মাঝখানে ছোট্ট পরিসরটুকুতে পাতা ব্রেকফাস্ট টেবিলের দিকে চলে গেলেন সুদীপ। ব্রেকফাস্ট টেবিলটা ছোট, চৌকো। চারজন বাদে পাঁচজনের জায়গা হয় না। আজ টেবিল জমজমাট।
সাদা কালোয় দাবার ছকের মতো স্কার্ট আর সাদা পোলো নেক ব্লাউস পরে আরাত্রিকা সার্ভ করতে আরম্ভ করেছে। ওর চুল কপাল থেকে উল্টে বাঁধা। একটা মাঝারি পনিটেল। বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল—‘হাই বব্স্!’
সুদীপ বললেন—‘প্লীজ মণি।’
—‘আচ্ছা, দুঃখিত। কেমুন আছো বাবা! রাতে ঘুম ভালো ছিল তো!’
হাতে সার্ভিং চামচ। মণি ঘাড় বেঁকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসছে, ওর কানের পাশের চুলগুলো একটু একটু গুটিয়ে আছে, মণির মা নীল সিল্কের ওপর ছোট ছোট সাদা জিপসি ছাপ শাড়ি পরে, নেভি ব্লু এপ্রন এঁটে রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে হাতে এগিয়ে আসছে, দার্জিলিঙ চায়ের সুগন্ধে সমস্ত ঘর বাড়ি মাতোয়ারা—এই দৃশ্য বর্ণগন্ধময়, বহুকাল পর্যন্ত অন্য অনেক জমকালো দৃশ্য, হুল্লোড়ের ছবি, এমনকি নিভৃত সুখের দৃশ্য ছাপিয়েও সুদীপের মনে ছিল। কেন কে জানে! কোন্ দৃশ্যটা মনের ঠিক চাবিতে আঘাত করে তাকে বরাবরের জন্য স্মৃতির ভাঁড়ারে পাঠিয়ে দেয়, কে বলবে?
খেতে বসে সুদীপ খুঁত খুঁত করতে লাগলেন—‘বাবুর খালি চেয়ারটা একটা পড়ে যাওয়া দাঁতের মতো বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে। তুমি ওকে ফোনে ঠিক পেয়েছিলে তো?’
কমলিকা বললেন—‘কতবার বলবো পেয়েছি। ও যেরকম বলল তাতে মনে হয়েছিল কাল রাতেই পৌঁছে যাবে। আমার মনে হয় ওয়েদারের জন্য ও কাল এলো না। ভালোই করেছে। তবে জন্মদিনের পার্টির জন্যে ওকে এতো দূরে টেনে আনা কিন্তু তোমার একটু বাড়াবাড়ি।
সুদীপ খেতে খেতে নিজের মনেই হাসলেন, তারপর বললেন, ‘ইস এইসব ভালো ভালো বাঙালি খানা বানিয়েছ। বাবুটা খেতে পেল না! খেয়ে থাকে তো শুধু টুনা স্যান্ডউইচ আর হট ডগ। এলো না?
কমলিকা হেসে ফেললেন—‘কেন? ছেলে না খেলে স্বাদ পাচ্ছো না? আদর্শ ভারতীয় পিতা দেখছি! সেই সংস্কৃত শ্লোকটা জানো না? আমরা ছোটবেলায় স্কুলে প্রেয়ারে গাইতাম…“পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ!” আপাতত তুমি খেলেই ছেলের খাওয়া হবে। বাবু এলে তাকে খাওয়াতে আজ আমি রয়েছি।
—‘তুমি আজও ছুটি নিলে?’
—‘না হলে চলবে কী করে? সপ্তাহের মাঝ মধ্যিখানে?’
আরাত্রিকা বলল—‘ইসস্ আমি তোমাদের কি বিপদেই ফেললাম না মমস্?’ বলেই হঠাৎ লম্বা করে জিভ কাটল—‘একদম ভুলে গেছি।’
—‘কী ভুলে গেছিস রে?’
কমলিকার কথা শেষ হতে না হতেই ও ঘুরে এসে প্রথমে সুদীপকে, পরে কমলিকাকে প্রণাম করল।
সুদীপ বললেন, ‘আশীর্বাদ ও প্রার্থনা তোমার আয়ুর প্রতিটি মুহূর্ত যেন জাস্টিফায়েড হয়।’
কমলিকা বললেন—‘হাতে করে খাচ্ছিলি, যা হাতটা ধুয়ে আয়। জুতোর হাত।’
—‘বাবার জুতো তো।’
—‘আরে বাস! বাবার জুতো তো আর বাবা নয়।’
সুদীপ বললেন বাবার পায়ের ধুলোও বাবা নয়, হাতটা ধুয়ে এসো মণি।’
আরাত্রিকা কাঁটা-চামচ তুলে নিল, কিছুতেই হাত ধুতে গেল না।
এইসব মুখরোচক খাদ্যাখাদ্য করা আমিই কমলিকাকে শিখিয়েছি। শুধু এগুলো কেন, সবই। বাবা-মার আদুরে মেয়ে ছিল। কিছুই প্রায় জানত না। অথচ আমি একের নম্বরের ঔদরিক। তা এখন দেখি ওর গুরুমারা বিদ্যে হয়ে গেছে। হিউসটনের বুকের ওপর নটেশাকের চচ্চড়ি খাইয়েছে শিম বরবটি মটরডালের বড়ি দিয়ে। অবিকল মায়ের হাতের চচ্চড়ির মতো স্বাদ। কোথা থেকে শিখল, কোথা থেকে যোগাড় করল বলতে চায় না, মিটি মিটি হাসে। এনিওয়ে, ডলার গ্যাজেট আর কমলিকার দৌলতে ভোজন ব্যাপারটা নিয়ে আমার আর কোনও খেদ রইল না।
বেরোবার সময় আরেকটা সারপ্রাইজ দিল ব্রুকলিন এইট্টি-ওয়ান। রেনকোটটা গলাচ্ছি, মণি চেঁচিয়ে উঠল—‘বাবা শীগগীরই দেখবে এসো।’ বেরিয়ে দেখি চোখ-ধাঁধানো রোদ উঠেছে। গাছের ডাল থেকে বরফ-গলা জল ঝরছে টুপটাপ করে। রাস্তায় বরফ কাদা। যাক, ফ্রস্টের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাবার বিশ্রী অভিজ্ঞতাটা আজ বাদ থাকল। মণি পাশে এসে বসে বলল—এটা আরাত্রিকা মুখার্জীর থার্টিন্থ্ বার্থ-ডে স্পেশ্যাল, না বাবা?’ অর্থাৎ আমি যে ভুল করেছি, আমার মেয়েও সেই ভুলই করছে। মনে করছে সমস্ত জগৎ ব্যাপারের কেন্দ্র ও নিজে। এই ভ্রান্তি আমাদের ডারউইন-পূর্ব বায়োলজির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গড ক্রিয়েটেড ম্যান ইন হিজ ওন ইমেজ। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। জানি ভুল, তবু এই রমণীয় ভ্রান্তি-জাল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি না। ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
পা দুটো মণি ছড়িয়ে দিয়েছে সামনে। এতো সুন্দর, সোজা, নরম, যেন জীবন্ত মোমের তৈরি পা এই চরণ-সচেতন দেশেও চট করে চোখে পড়ে না। মণির গলা, আঙুল, বাহু সব কিছুরই একটা ক্ল্যাসিক্যাল সৌন্দর্য আছে। হালকা বাদামি, সাটিনের মতো নিদাগ, নিখুঁত, চকচকে ত্বক। হিউজটনে থাকতে ওকে হোম-কামিং কুইন করেছিল স্কুলে। এখানে ওদের স্কুল ইয়ারবুকে শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সফোমোর বলে যার ছবি দিয়েছিল, বিশুদ্ধ আমেরিকান মেয়েটি। বলা উচিত নয় ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়ার মতো মুখ, লম্বা লম্বা দাঁত, মাড়ি বার করে হাসছে। মণি খুব নিষ্পাপ মুখে বলেছিল—‘বব্স্, ডোণ্ট য়ু থিঙ্ক শী ইজ রিয়্যাল বী!’ কে জানে হবেও বা। আসলে আমি মণিকে অনেক স্কুল ইভেন্টে যোগ দিতে দিই না। হঠাৎ দেখি, কমলিকা দৌড়ে আসছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাটিওটা পার হল। আমি গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চুপ করে বসে আছি। গাড়ির মধ্যে উঠে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ও মণিকে চুমু খেল, বলল—‘তুই যখন প্রণাম করলি তখন আমার দু হাত জোড়া ছিল মাগো।’ দেখি ওর দু চোখ টলটল করছে। আমার দিকে একবারও ফিরল না। কেন বুঝলুম না।