Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোপাল ভাঁড় || Tarapada Roy

গোপাল ভাঁড় || Tarapada Roy

গোপাল ভাঁড়

‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় রসরাজও ছিলেন, গোপাল ভাঁড়ও ছিলেন, কিন্তু ভাঁড়ে থাকিতে থাকিতে খেজুর রস, তালের রসও যেমন তাড়ি হইয়া পড়ে, কথার রসেরও সেই দশা দাঁড়াইল।

এখন কেহ রসিকতা করিলে গম্ভীর লোকে তাহা ছ্যাবলামো বা ভাঁড়ামো বলিয়া নিন্দা করেন।’

আজ থেকে প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগে অন্য যুগের অন্য এক রসরাজ, নাট্যাচার্য শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসু এ কথা লিখেছিলেন।

গোপাল ভাঁড়ের রসিকতা শোনেননি, বলেননি বা পড়েননি এমন বঙ্গভাষীর সংখ্যা বিরল। ‘গোপাল ভাঁড়’ নামক রসিকতার বই গত এক শতাব্দী ধরে বাংলা সাহিত্যের বেস্টসেলার, পঞ্জিকা বা রামায়ণ কিংবা লক্ষ্মীর বা শনির পাঁচালির প্রতিদ্বন্দ্বী, শংকর বা বুদ্ধদেব গুহের বেস্টসেলার এর পাশে অর্বাচীন।

এখনও রেলের কামরায়, হাট-বাজারে গোপাল ভাঁড়ের শস্তা সংস্করণ নিয়মিত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। নতুন যুগের শিক্ষাব্যবস্থা ধারাপাত, বর্ণপরিচয়, শিশুশিক্ষাকে কিছু কোণঠাসা করেছে কিন্তু গোপাল ভাঁড়ের আজও সমানই রমরমা।

কিছুদিন আগে কাছাড়ে গিয়েছিলাম, সেখানে প্রত্যন্ত শহরের ছোট বইয়ের দোকানে দেখেছি গোপাল ভাঁড় কাচের শোকেসে সাজানো। তারও আগে বাংলাদেশে, ঢাকা টাঙ্গাইলের বইয়ের দোকানে গোপাল ভাঁড় পেয়েছি। সব সংস্করণ এক রকম নয়, গল্পগুলোও সব মেলে না, কিন্তু বিশাল ভুঁড়ি, টাকমাথা গোপাল ভাঁড়ের ছবি আঁকা প্রচ্ছদ নিয়ে গোপাল ভাঁড় কথামালা চমৎকার চলছে।

সরস গোপাল ভাঁড় নিয়ে নীরস আলোচনা করার আগে গোপাল ভাঁড় এতকাল ধরে কেন এত জনপ্রিয় সেটা বোঝার চেষ্টা করি।

এক ভদ্রলোক তাঁর ছেলেদের নাম রেখেছেন, পটল, আদা, সিম, বেগুন ইত্যাদি। গোপাল ভাঁড় শুনে বলছে, ‘সবাইকে আলাদা আলাদা করে না ডেকে একবারে এদের শুকতো বা লাবড়া বলে ডাকতে পারেন।’ এ নিতান্ত বাঙালির নিজস্ব রসিকতা। কিংবা সেই কাণ্ডজ্ঞানে ঘড়ির উপাখ্যানে গোপাল ভাঁড়ের একটা প্রশ্নোত্তর লিখেছিলাম। গোপাল ভাঁড়ের কাছে একটা ঘড়ি রয়েছে, একজন তার কাছে সময় জানতে চাইছে, ‘দাদা, ক’টা বাজে ?’ হাস্যমুখ গোপাল জিজ্ঞাসা করছে, ‘দাদা, ক’টা চাই ?’ এই রহস্যময় জবাবি প্রশ্নটির কিন্তু কোনও জবাব নেই।

তবু গোপাল ভাঁড়ের অধিকাংশ রসিকতা বড় মোটা দাগের, স্থূল ও অশ্লীল। মূত্রত্যাগ, মলত্যাগ, শারীরিক পঙ্গুতা, এমনকী পুত্রবধূ নিয়ে রসিকতা গোপাল ভাঁড়ের পাতায় পাতায়।

তবু গোপাল ভাঁড় এত জনপ্রিয়। বোধহয় স্থূলতা, রুচিহীনতা যা কিছু বৈঠকী বা রকের রসিকতার একটা বড় অঙ্গ সেই সঙ্গে উচিত জবাব এবং অম্লকষায় মন্তব্য গোপাল ভাঁড়কে এতকাল বাঁচিয়ে রেখেছে। গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে একাধিক বাংলা চলচ্চিত্র হয়েছে, যাত্রাও হয়েছে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র জড়িত যে কোনও ঐতিহাসিক পালায় গোপাল ভাঁড় জনপ্রিয় চরিত্র। আসলে গোপালের গুণ হল সে যতই স্হুল হোক, সহজবোধ্য।

এই শতাব্দীর প্রথম ভাগের একটা বিখ্যাত মঞ্চকাহিনী বলি। মিনার্ভা থিয়েটারে আবু হোসেন অভিনীত হচ্ছে। আবু হোসেনের ভূমিকায় অভিনয় করছেন স্বয়ং অর্ধেন্দু মুস্তফি।

নাটকের একটি দৃশ্যে আছে, আবু হোসেনকে রক্ষিবৃন্দ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে পাগলাগারদে দেওয়ার জন্য। আবু হোসেনের মা ডুকরে কাঁদছেন, ‘ও বাপরে— আমার কী হল রে !’ ইত্যাদি করুণ উক্তি করে।

সেকালে চপল এবং লঘুমতি নাট্যামোদীর অভাব ছিল না। তাদের কেউ কেউ আবু হোসেনের ক্রন্দনরতা মায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে হলের মধ্যে থেকে কাঁদতে লাগল। আবু হোসেনবেশী মুস্তফিসাহেব স্টেজ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে দর্শকদের এই ক্রন্দনধ্বনি শুনে ফিরে দাঁড়িয়ে মাকে বললেন, ‘মা, আর কাঁদিসনে। তোর কান্না শুনে শেয়াল-কুকুরে কাঁদছে।’ সঙ্গে সঙ্গে শেয়াল-কুকুরের দশায় পরিণত হওয়া দর্শকেরা থেমে গিয়েছিল।

অর্ধেন্দু মুস্তফির এই শেষের ডায়লগটি মূল নাটকে ছিল না। থাকার কথাও না। এটা গোপাল ভাঁড়ের একটা পুরনো গল্প, অর্ধেন্দুবাবু সুযোগ পেয়ে এবং বুদ্ধি করে এখানে চালিয়ে দিলেন।

গোপাল সংক্রান্ত এ রকম বহু গল্প বুদ্ধিমান ব্যক্তি সুযোগ ও সুবিধামতো সদ্ব্যবহার করতে পারেন।

গোপালের হাতের লেখা ভাল নয়। এক বৃদ্ধা এসেছেন তাকে দিয়ে একটা চিঠি লেখাতে। গোপাল বলল সে চিঠি লিখতে পারবে না, তার পায়ে ব্যথা। বৃদ্ধা অবাক, হাত দিয়ে চিঠি লিখতে পায়ের সঙ্গে কী সম্পর্ক ? গোপাল ব্যাখ্যা দিল, ‘লিখব তো হাত দিয়েই। কিন্তু আমার হাতের লেখা পড়বে কে ? সে তো পড়তে হবে আমাকেই গিয়ে। কিন্তু আমার পায়ে যে ব্যথা, পড়তে যেতে পারব না।’

অন্য এক কাহিনীতে গোপাল মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে উঠে তার স্ত্রীকে বলছে, ‘যাও তো দেখে এসো ভোর হচ্ছে কি না ? পূর্বের আকাশ লাল হয়ে এসেছে কী না ?’ বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বউ ফিরে এসে বলল, ‘ভারী আঁধার। কিছু ঠাহর করতে পারছি না।’ গোপালের আদেশ হল, ‘এমনিতে দেখতে না পাও, আলো জ্বেলে দেখ সূর্য উঠছে কি না ?’

আরেকবার এক আলুর গুদামে আগুন লেগেছিল। গোপাল সেই গুদামের পোড়া আলু নুন মাখিয়ে আনন্দের সঙ্গে খাচ্ছে, এমন সময়ে গুদামের মালিকের সঙ্গে দেখা। তিনি হাহাকার করে উঠলেন, ‘আমার দুটো আলুর গুদামের একটা পুড়ে গেল। আমার সর্বনাশ হয়ে গেল।’ গোপাল তৃপ্ত মুখে আলুপোড়া খেতে খেতে বলল, ‘জানেন, আমার আলুপোড়া খেতে খুব ভাল লাগে। আপনার পরের গুদামটায় যখন আগুন লাগবে, খবর দেবেন।’

গোপাল ভাঁড়কে বলা হয় অষ্টাদশ শতকের লোক। কিন্তু এই আলু কিংবা ঘড়ি ব্যাপারটা ওই শতকের সঙ্গে মিলছে না। ঘড়ি কিংবা আলু আমাদের সমাজে অনেক পরের ব্যাপার।

কথিত আছে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় গোপাল ভাঁড় সভাসদ ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় এবং মৃত্যু ওই শতকের শেষাশেষি। তিনি বাংলার নবাব আলিবর্দি, সিরাজদৌল্লা এঁদের সমসাময়িক ছিলেন। গোপাল তাঁরই বিদূষক: আকবরের যেমন বীরবল, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের তেমনি গোপাল ভাঁড়।

গোপাল ভাড়ের এই ঐতিহাসিকতা কিন্তু সকলে স্বীকার করেন না। স্বয়ং সুকুমার সেন বলেছেন, কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড় ছিলেন না। শঙ্করতরঙ্গ নামে একজন ছিলেন রাজার পার্শ্বচর, দেহরক্ষী; তিনি বাক্‌বিদগ্ধ ব্যক্তি ছিলেন, ভাঁড় ছিলেন না।

গোপাল ভাঁড় কে ছিলেন কে জানে ? রসরহস্যমালার এই প্রাচীন নায়ক, তাকে ঘিরে থাকুক কিছু কিংবদন্তি, কিছু অস্পষ্টতা। বটতলার গ্রন্থমালা তাকে পৌঁছে দিক গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শতক থেকে শতকান্তরে। তার উপাখ্যানে নতুন যুগের নতুন বিদূষক যোগ করে দিক আর কয়েকটি রসিকতা, খারাপ-ভাল কয়েকটি বহুজনবোধ্য গল্প।

ততক্ষণে আমরা এই কালজয়ী ভাঁড়কে আরও একটু অবলোকন করি। গোপাল ভাঁড়ের যেসব বিখ্যাত গল্প, সেই বিধবা পিসির লাউঘণ্টে ভাজা চিংড়ি মাছ মিশিয়ে পিসিকে ব্ল্যাকমেল করা কিংবা কবি ভারতচন্দ্রকে গোপালের অনুরোধ, ‘আপনার বিদ্যাসুন্দরের পাণ্ডুলিপিটি কাত করবেন না, এ যে রসে টইটম্বুর, রস গড়িয়ে পড়বে,’ এসব প্রায় সকলেরই বহুবার শোনা।

মোটা দাগের এবং বহুশ্রুত গল্পগুলি এড়িয়ে। দু’-একটি অন্য গল্প বলা যাক। এক মজুর গোপালকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবু, গর্ত তো কাটলুম, গর্তের মাটি রাখব কোথায় ?’ গোপাল জবাব দিল, ‘গর্তটা একটু বড় করে খুঁড়লেই তার মধ্যে মাটিটা রাখতে পারবে।’ গোপাল কিন্তু মাঝেমধ্যে জব্দও হয়েছে। সে তার স্ত্রীকে বলেছিল তিলের নাড়ু বানাতে। তার স্ত্রী বানাল তালের বড়া, গোপাল বিস্ময় প্রকাশ করাতে গোপালের স্ত্রী জানালে, ‘তিল থেকেই তো তাল হয় গো।’ আরেকবার গোপালের ছেলে হাটের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে বাবাকে, ‘গোপাল, গোপাল’, নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকছিল, গোপাল এতে রাগ করায় ছেলে বলেছিল, ‘হাটের মধ্যে বাবা-বাবা করলে কে না কে সাড়া দেবে। তার থেকে নাম ধরে ডাকাই নিরাপদ।’

গোপাল ভাঁড়ের শেষ গল্পটি সাদামাটা। মজার কথা এই যে, এ গল্পটি মোল্লা নাসিরুদ্দিনেরও আছে। গোপাল নাকি কবে যুদ্ধে গিয়েছিল, সেখানে বিপক্ষের বহু সৈন্যের সে পা কেটে ফেলে। ‘মাথা না কেটে পা কাটলে কেন ?’ এই প্রশ্নে গোপাল জানাল, ‘মাথাগুলো যে আগেই কাটা ছিল।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *