গেটুস দ্যা গ্রেট – 1
বেলা প্রায় দশটা বাজে। মামার স্করপিও থামল একটা অট্টালিকা সমান বাড়ির সামনে । নেমে দাঁড়ালাম আমরা গাড়ি থেকে। মামা বাজখেয়ী গলায় ডাকলেন।
–গেটুস, গেটুস।
বলডুইন কেঁপে উঠলেও আমি কাঁপিনি। আমি ক্লাস টেন এ পড়ি। তা ছাড়া এই প্রথম মামা বাড়ি এলাম। মা অবশ্য আমাদের নিয়ে মামার বাড়ি আসা টা চায় নি। মায়ের কথায়, মামা নাকি আমাদের দেখভাল করতে অপারগ। কিন্তু বলডুইন নাছোড়। বায়নাক্কা শুরু করলো বলডুইন। আমিও যোগ দিলাম বলডুইন এর সাথে।
মাকে বললাম- কি আশ্চর্য! আমাদের বন্ধুরা সবাই হাসাহাসি করে। বলে, সে কি রে তোরা মামা বাড়ি কোন দিন যাসনি?
মা রাগ করে বলেন—মন্টু, তোমাকে আগে ও বলেছি, মামার বাড়ি যাওয়া হবে না । কোথায় ছোট ভাই কে সামলাবে তা না, ওর তালে তাল দিচ্ছ ?
মায়ের মন্টু, মানে আমি ,মায়ের দিকে হাবা গোবার মতো চেয়ে রইলাম। আমি জানি আমার এই দৃষ্টিতে মায়ের মনটা কাদা হয়ে যায়। আর মায়ের ভালোবাসাটা উথলে ওঠে । আর তখুনই সব বাধা পার হয়ে যায়। এবার কিন্তু মায়ের মনটা কাদা হলেও মা রাজি হলেন না।
মা বাবাকে বলেন।
–দেখেছ, কেমন বায়না করছে!
বাবা বলেন –ভালই তো, চলো না আমরা ও বেড়িয়ে আসি। বহুদিন শালা বাবুর বাড়ি যাওয়া হয়নি।
শেষ অবধি মাকে রাজি হতেই হল। আমরা সবাই রওনা হলাম ভাইজ্যাগ এ মামার বাড়ি। ছোট থেকেই শুনেছি মা অন্ধ্রে মানুষ হয়েছে। দাদুর ব্যবসা ছিল ওখানে । এখন দাদু দিদা কেউ নেই। শুধুই মামা ওখানে থাকে।
স্টেশনে পৌঁছেই আমরা মালপত্র নিয়ে ছুটলাম মাদ্রাজ মেল-এর দিকে। ট্রেন দাঁড়িয়েই ছিল। ট্রেন এ চড়ে বসলাম আমরা ।
বলডুইন বলল —এই দাদা, শেষ অবধি আমরা মামা বাড়ি যাচ্ছি ! তোর মনে আছে মামার বাড়িটা?
আমি মাথা নাড়লাম। সত্যিই আমার মনে নেই। সেই কবেকার কথা দাদু-দিদা মারা যাবার পর একবার ই মামা বাড়ি গিয়েছিলাম । তখন আমার পাঁচ কি ছয়। আমরা ট্রেন এ ওঠার কিছুক্ষণ পরই ট্রেন ছেড়ে দিল। আমরা জানালার ধারে বসে উচ্ছ্বসিত। বলডুইন চিৎকার করে স্টেশনের নাম পড়ছে।
বললাম—চল বলডুইন আমরা ওপরে উঠে যাই।
বলডুইন এককথায় রাজি। ওপরে উঠেই বলল।
–দাদা, ক্যারিয়ার এ কি কি আছে বলতো?
বললাম–তোর খালি খাবার গল্প।
বাবা বললেন–কাল সকালে আমরা বিশাখাপত্তনম এ পৌঁছে যাব।
আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম। বাবাকে বললাম।
— বাবা ,মামার বাড়ি কি সমুদ্রের ধারে?
বাবা বললেন–হ্যাঁ।
আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। বন্ধুরা সব ভাইজ্যাগ ঘুরে এসেছে । বিকাশ বলেছিল ,দারুণ জায়গা ঐ ভাইজ্যাগ মানে বিশাখাপত্তনম। না গেলে বুঝবি না।
বলডুইন কে বললাম–জানিস বলডুইন,বিশাখাপত্তনম এর পাশ দিয়েই পূর্ব ঘাট পর্বত মালা। বিকাশ বলেছে দারুণ জায়গা ।
বলডুইন বলল–মামার বাড়ি এত সুন্দর জায়গায় অথচ মা যে কেন যেতে চায় না সেখানে ! কেন বল তো দাদা?
বললাম–ঠিক বলেছিস । মনে হয় মামীটা ভাল না ।
বলডুইন—না না ,মামাই খারাপ। মামা খারাপ না হলে কি মামী খারাপ হতে পারেন?
আমাদের ভালো খারাপের যুদ্ধ থেমে গেল মায়ের ধমকে।
আবার কিছুক্ষণ পর বলডুইন শুরু করলো ।
–বুঝলি দাদা, মামা খারাপ বলেই মা যেতে চান না মামার বাড়ি । এই দেখ না বাবা যদি ভাল না হতো তাহলে মামার বাড়ি আমাদের যাওয়া হতো না। মায়ের সাথে মামার সম্পর্ক ও থাকতো না।
আমি বলডুইনের যুক্তি মানতে নারাজ। তাই আমার গলাটা চড়ে যাচ্ছিল। তখনই মায়ের গলা কানে এলো।
–মন্টু, বলডুইন এটা বাড়ি না। খেতে এসো।
অর্থাৎ রাস্তাঘাটে ঝগড়া চলবে না। বলডুইন খাবারের নামে কসরত করে নিচে লাফ দিল ।আমিও নামলাম। খাওয়া হতেই আমরা শুয়ে পড়লাম।
সকালে জেগে মনে হল, সত্যিই আমরা মামার বাড়ি চলেছি ! বলডুইনের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম চোখ পিট পিট করছে। আর ঠোঁট নড়ছে। বলডুইন বলছে—বলছি তো ঐ মামীই খারাপ।
বুঝলাম ও স্বপ্ন দেখছে। রাতে ঘুমানোর আগে বলছিল মামা খারাপ। আর এখন বলছে—মামীই খারাপ।
আমি বললাম—কি রে কাল বললি মামা খারাপ। আর এখন বলছিস মামী খারাপ।
এবার বলডুইন জেগে গেল।
বলল–রাতেও তাই বলেছি মামী খারাপ।
বলডুইন এবার সত্যিই জেগে গেল । বলল– রাতেও তাই বলেছি, মামী খারাপ । আমি বললাম–রাতে তা বলিস নি । বলেছিলি, মামা খারাপ না হলে কি মামী খারাপ হয় !
মা ধমক দিলেন। –বলি হচ্ছেটা কি?আবার শুরু করেছ। ওঠো এবার খাবার দেবো।
আমি জানি বলডুইনের মনে পড়ে গেছে ক্যারিয়ারের লুচি-আলুর দম আর মায়ের হাতের বানানো কড়া পাকের সন্দেশের কথা। মনে পড়েছে বলেই ওর এই ব্যস্ততা । আমিও নেমে পড়লাম। বেশ খিদেও পেয়েছে।
আমি কোন দিন বলডুইন এর সাথে নিজের তুলনা করিনি। তবে আমার মনে হল বলডুইন এর শরীরটা ভারী বলেই নামতে কষ্ট হচ্ছিল। আর আমিতো টপাৎ করে লাফ দিলাম। এতদিন রোগা বলে কষ্ট পেয়েছি। বিশেষ করে মা যখন বলতো।
—ভাল করে খা বাবা যা টিং টিং এ শরীর, আমার তো দেখে ভয় ই করে!
আজ মনে হল, এই ভাল।
বিজয়নগরম পার হতেই মা বললেন ।
–এরপর ই বিশাখাপত্তনম। আমাদের বাড়ি ওয়ালটেয়র।
বলডুইন আর মা কথা বলছে। আমি প্রকৃতিতে ডুবে আছি । দু পাশে পাহাড়ের ঢেউ ঘুরে ঘুরে চলেছে আমাদের সাথে।
বলডুইন বলল–ওয়ালটেয়র কি ছোট জায়গা? বিশাখাপত্তনম কি আলাদা জায়গা?
মা বললেন– অনেক বড় জায়গা । স্টেশন এর নাম বিশাখাপত্তনম। ইতিহাস বলে এই জায়গা টা ছিল কয়েক শো মেছোয়ালি দের গাঁ । স্যার ওয়ালটেয়র নামে একজন ইংরেজ এই জায়গার পত্তন করেন ।
বলডুইন বলল—তাহলে ওঁর নামেই ওয়ালটেয়র নাম হল ?
মা বললেন— হ্যাঁ । এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুমতি নিয়ে ক্যাপ্টেন থমাস ব্ল্যাক মোর তার রেজিমেন্ট গড়লেন ইয়ারাদা হিল রেঞ্জ এর ওপরে । তাঁর নামেই সেই পাহাড়ের নাম হল “ক্যাপ্টেন থমাস ব্ল্যাক মোর ‘স হিল ” । সমুদ্রের তলদেশ থেকে তিনশো ফুট উঁচুতে এক বিশাল অন্তরীপের ওপরে দশ ক্যাননের ব্যাটারি আর সেখানেই তাঁর বাংলো তৈরি করেন ।
বলডুইন বলল—মা আমরা ব্ল্যাক মোর এর হিল দেখব।
মা বললেন—দেখো। এখন তার নাম বদলে “ডলফিন নোজ ” হয়ে গেছে । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে চুয়াল্লিশ একর জমি নিয়ে যে রেজিমেন্ট গঠন করেছিলেন তিনি । তার আকার ছিল ভলফিন এর আকারের।
আমি বললাম—বিকাশ বলেছিল পাহাড়ের আকার ডলফিন এর মতো তাই ডলফিন নোজ । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি !! সেই কবেকার কথা । তাই না মা ?
দেখতে দেখতেই ভাইজ্যাগ স্টেশন এসে গেল । আমরা নেমে মামার অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। তখনই একজন টিংটিং এ গড়ণের ছেলে এগিয়ে এল আমাদের দিকে । ছেলে না বলে লোক বললেই চলে। তার লিং পিং এ চেহারার সাথে আমার চেহারার যেন একটু মিল খুঁজে পেলাম । আর তখনই সে এসে বাবাকে আর মা কে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তখনই বুঝলাম যে এই লিং পিং এ চেহারার মামার মতোই আমি । মা বললেন—মন্টু, বলডুইন মামা কে প্রণাম করো।
মায়ের কথা মতোই আমরা মামা কে প্রণাম করলাম । কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল মামার জামা কাপড়ের দশা দেখে । এমন কি পায়ের চটি টা ও বহু কালের।
বাবা বললেন—-যাক, বহুদিন পর শালা বাবুর দেখা পেলাম । না এলে তো শালাবাবুর দেখা হতো না ।
মামা লজ্জা পেয়ে বলল— কি করে যাই ! এ দিক টা কে দেখবে? আপনারা এলেন তাই ভাগ্নে দুটো কে দেখতে পেলাম ।
আমার মনটা গলে গেল মামার কথায় । সত্যিই তো মামী কে ফেলে যাবেই বা কি করে ? মামার কষ্টে আমার মুখ টা বুঝি হাবাগোবা র মত হয়ে গিয়েছিল মামার কথা শুনে তাই মনে হল । আমার মাথায় একটা গাট্টা মেরে মামা বলল—কি রে মন্টু এমন ক্যাবলার মত মুখ করে আছিস কেন?
মামার কথায় রাগ হলেও কিছুই বললাম না । কিন্তু বলডুইনের চিমটি কাটায় রাগ হয়ে গেল । ওর দিকে ফিরলাম। ওর চোখ বলছে —-কি রে দাদা, বলিনি মামাটাই খারাপ । নমুনা দেখলি! এবার আমায় ছেড়ে মামা বলডুইন কে নিয়ে পড়ল ।
—–দিদি, তোমার ছোট টির গেঁটে গেঁটে বুদ্ধি ।
প্রশংসায় বলডুইনের দাঁত বেড়িয়ে গেছে । এরপর ই মামা বলডুইনের পিঠে ধাঁই করে একটা ঘা দিয়ে দিল। ঘা’টা বলডুইন এর হোঁত্কা শরীর ও নিতে পারল না । ভয় পেলাম আমি কি জানি বলডুইন বুঝি বেফাঁস কিছু বলে না ফেলে । কিন্তু বলডুইন কিছুই বলল না । শোধ নিতে মামা কে ই ঠুকলো ।
—বাব্বা! তোমার এই লিং পিং এ প্যাংলা চেহারায় তো ভাল জোর আছে !!
মামা এতক্ষণে দিল খোলা হাসি হাসতে লাগল । মামা হাসলে ও মা শাণিত দৃষ্টিতে বলডুইন এর চোখে ছুরি চালালো তা মায়ের দিকে না তাকিয়ে ও বুঝল বলডুইন। তাই হালকা করতেই বলল—মামা, তুমি কি রোজ সকালে ডন বৈঠক কর ? মামা বড় বড় চোখ করে বলডুইন এর কথাগুলো উপভোগ করছিল ।
কুলি ঠিক হতে আমরা এগুলাম স্টেশন এর বাইরের দিকে । এক ফাঁকে মা নিষেধের বাণী শুনিয়েছে—মামা তোমার ইয়ার এর পাত্র ? আর যেন এমন না শুনি ।
প্রথমে তাজ্জব হলেও পরে মনে হল মামা বুঝি এই স্করপিও গাড়ির ড্রাইভার । আমাদের জন্য ই মালিকের থেকে চেয়ে এনেছে । কারণ মামার যা হতদরিদ্র অবস্থা তাতে কি এমন একখানা জাঁদরেল গাড়ি থাকতে পারে ? তবে যাই হোক মামার কষ্টে আমার মনটা গলে আছে । কাল ঠিক ই ভেবেছিলাম মামী টাই মামার দেখভাল করেনা । মামার জন্য কষ্ট পাওয়া যাবে না ,তবে আবার ক্যাবলা বলবে । তাই গম্ভীর হয়েই রইলাম । কারণ মামার সাথেই আমাকে সামনের সীট এ বসতে হল । স্টেশন থেকে সোজা চলল গাড়ি । একটু পরেই উপরে উঠতে শুরু করল । এতক্ষণে মায়ের উচ্ছাস কানে এল । মা বললেন—-বিকু, কিছুই তো চিনতে পারছি না । একেবারেই পাল্টে গেছে ওয়ালটেয়র । মনে ভাবলাম মায়ের ভাইয়ের নাম বিকু না হয়ে ‘ ভিক্ষু ‘ হলে ঠিক মানাতো। মামা বলল—ডান এ আর টি সি কমপ্লেক্স । বাঁয়ে বিমলিপত্তনম চলে গেছে । অনেক কিছু নতুন হয়েছে। বিচ রোড এর পাহাড় কে কেটে সোজা রাস্তা বিমলিপত্তনম এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে । মা বললেন—-ও দিক টা তো দুর্গম পাহাড় ছিল । পূর্ব ঘাট রেঞ্জ ছিল । মামা—পাহাড় কেটে সমুদ্রের পাশ দিয়ে রাস্তা করেছে। তার পাশ দিয়েই কৈলাশ গিরি তে ওঠার যায় । এখন রোপ ওয়ে করেছে । আবার সার্কুলার রেল চলছে। একটু এগুলে ই ঋষি কোন্ডা পড়বে আর বাঁয়ে উঠে গেছে সোজা কৈলাশ গিরি । বাবা বললেন—তাই নাকি ? মামা বলল–দিদি, তোমার ইউনিভার্সিটি বাঁয়ে ।
মায়ের দিকে ফিরলাম । মা যেন একটা বাচ্চা মেয়ে । বাবা ও খুশি হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে আছে । গাড়ি ঢালের দিকে চলেছে । সমুদ্রের কাছে এসে গেছি আমরা । বলডুইন বলল—-এই দাদা দেখ সমুদ্র !