Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গজাননের কৌটো || Shirshendu Mukhopadhyay

গজাননের কৌটো || Shirshendu Mukhopadhyay

মঙ্গলেশ্বরী অস্ত্রোপচার কেন্দ্র

দোকানের বাইরে মস্ত সাইনবোর্ড ‘মঙ্গলেশ্বরী অস্ত্রোপচার কেন্দ্র’, নীচে লেখা—“এখানে অতি সুলভে কাটা হাত, পা, মুণ্ডু ইত্যাদি যত্ন সহকারে নিখুঁতভাবে জুড়িয়া দেওয়া হয়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।”

দোকানের ভেতরে রমরম করছে ভিড়। লম্বা একটা হলঘরে বেঞ্চে বসে আছেন হাতকাটা নকুড়বাবু। হলঘরের অন্য প্রান্তে একটা লম্বা অপারেশন টেবিলের ওপরে বুকে কাটা হাত, পা, মুণ্ডু জুড়ে যাচ্ছে একটা দাড়িগোঁফওলা লোক। ভীষণই ব্যস্ত। তাকে ঘিরে মেলা লোক “আমারটা আগে করে দিন দাদা, আমাকে আগে ছেড়ে দিন দাদা” বলে কাকুতি মিনতি করছে। লোকটা খুব একটা ভূক্ষেপ করছে না। শুধু বলে যাচ্ছে, “হবে রে ভাই হবে, একটু সবুর করো। এক-এক করে সবাইকেই মেরামত করে দেব।”

নকুড়বাবুর পাশে একটা লোক নিজের কাটা মুণ্ডুটা দু’হাতে বুকে চেপে ধরে বসে আছে। মুণ্ডুটা পিটপিট করে চারদিকে চাইছিল। নকুড়বাবুকে বলল, “বুঝলেন মশাই, গজু কারিগরের হাতটি বড় ভাল। কিন্তু খদ্দেরের ভিড়ে লোকটা হিমসিম খাচ্ছে।”

নকুড়বাবু বললেন, “তাই দেখছি। তা আপনার মুণ্ডু কাটা গেল কীভাবে?”

“সে আর বলবেন না। রাতের খাওয়া শেষ করে সবে পায়েসের বাটিতে হাত দিয়েছি, এমন সময় বাড়িতে ডাকাত পড়ল। আমি তবে রে’ বলে যেই লাফিয়ে উঠেছি অমনি ফ্যাচাং।”

“আচ্ছা।”

“মুণ্ডু কাটা পড়লে বড় অসুবিধে মশাই। খাওয়া দাওয়াই বন্ধ।”

“তা বটে।”

“দেখি, যদি আজকেই গজু জুড়ে দেয়, তবে বিকেলে ভাল খ্যাঁট চালিয়ে দেব।”

ওদিকে একটা লোক খুব চেঁচামেচি লাগিয়েছে, “এটা তোমার কেমন আক্কেল বলল তো গজুদা! ভুল করে আমার মুণ্ডু বাঞ্ছারামের ধড়ের সঙ্গে জুড়ে দিলে! ছিঃ ছিঃ। আমি হলুম ফরসা আর বাঞ্ছারাম হাকুচ কালো। তার ওপর বাঞ্ছারামের কোমরে দাদ আছে। বলি কি, চোখের মাথা খেয়েছ নাকি?”

গজু ওস্তাদ মোলায়েম গলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “ওরে, অমন চেঁচাসনি, এক হাতে এত কাজ করলে একটু আধটু ভুলচুক কি আর হতে নেই! আজ বাড়ি যা, সামনের সপ্তাহে আসিস, ধড় বদলে দেবখন।”

“না না, সে হবে না, আমার ধড়টাই আমার চাই।”

“আহা, তোর ধড় এখন খুঁজে দেখবে কে? কোন মুণ্ডু তোর ধড়ে চেপে চলে গেছে কে জানে? সে যদি ফেরত দিতে আসে তখন দেখা যাবে। একা হাতে কাজ, সামলানো মুশকিল।”

“তোমাকে কবে থেকে বলছি টিকিট সিস্টেম করো, টিকিট সিস্টেম করো, তা কথাটা কানেই তুলছ না। ধড়ে আর মুণ্ডুতে নাম ঠিকানা লেখা টিকিট সেঁটে রাখলে তো আর ভুল হয় না।”

“হবে রে বাপু, হবে। একটু সবুর কর, সব হবে।”

হঠাৎ আর একটা লোক পিছু হেঁটে দোকানে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল, “এটা কী করলে গজুদা?”

গজু খুব স্নেহের গলায় বলল, “কেন, তোর আবার কী হল?”

লোকটা খাপ্পা হয়ে বলল, “দেখছ না, কী কাণ্ড করেছ?”

নকুড়বাবু দেখলেন লোকটার মুণ্ডু পেছনদিকে ঘোরানো। চোখ, নাক, মুখ, সব পেছনদিকে।

লোকটা বলল, “অজ্ঞান করে মুণ্ড জুড়েছ। তারপর ঢাকাঁচাপা দিয়ে আমার ছেলেরা আমাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। জ্ঞান হয়ে দেখছি এই কাণ্ড। চোখ পেছনে বলে সামনের দিকে হাঁটতে পারছি না। খেতে গেলে কাঁধের ওপর দিয়ে হাত ঘুরিয়ে মুখে গরাস দিতে হচ্ছে, তাও ঠিকমতো মুখে যাচ্ছে না। লোকের সঙ্গে পিছু ফিরে কথা কইতে হচ্ছে। ভীমরতি হল নাকি তোমার?”

নকুড়বাবুর বাঁ পাশে বসা একজন বুড়োমানুষ বলে উঠলেন, “ভীমরতি ছাড়া আর কী? এই তো আমার দুটো কাটা হাত জুড়তে গিয়ে বাঁ হাত ডান হাতের জায়গায় আর ডানটা বাঁয়ের জায়গায় জুড়েছে। কী যে কাণ্ড করে গজু মাঝে মাঝে! তবে হ্যাঁ, দু-চারটে গণ্ডগোল করলেও ওর মতো কারিগর নেই। এমন জুড়বে যে, কখনও কাটা গিয়েছিল বলে মনেই হবে না। তা মশাই, আপনার কেসটা কী?”

নকুড়বাবু করুণ গলায় বললেন, “ছেলেবেলায় সেপটিক হয়ে হাতে পচন ধরায় ডাক্তাররা নুই অবধি কেটে বাদ দিয়েছিল। তা সেই হাতের জন্যই আসা।”

“অ। তা একটা হাত কি জোগাড় করে এনেছেন?”

“না তো?”

“তা হলেই তো মুশকিল। হাত একখানা জোগাড় করে আসলে ভাল হত। গজুর কাছে অবিশ্যি হাত পাওয়া যায়। দামটা একটু বেশি পড়বে আর সব বেওয়ারিশ হাত। লাগালে অসুবিধে হতে পারে। হয়তো চোর-ছ্যাঁচড় বা খুনে-গুণ্ডার হাত, কিংবা পকেটমারেরও হতে পারে। তখন দেখবেন হাত সামলানো মুশকিল হবে। আপনি হয়তো চান না তবু আপনার হাত হয়তো কারও জিনিস চুরি করল বা কাউকে হঠাৎ খুন করেই বসল কিংবা কারও পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিল।”

“ও বাবা! তা হলে কী হবে?”

এই স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ধড়মড় করে উঠে বসেছিলেন নকুড়বাবু। তারপর তাঁর আর ঘুম হয়নি। আর কী আশ্চর্য কাণ্ড! সকালবেলাতেই একটা দাড়িগোঁফওয়ালা লোক এসে হাজির হল।

“মশাই, সদাশিব রায়ের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?”

নকুড়বাবু জবাব দেবেন কি, হাঁ করে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। এ যে স্বপ্নে দেখা গজু কারিগর! সেই মুখ, সেই দাড়িগোঁফ! এ কি ভগবানেরই লীলা! গজু কারিগর সশরীরে তাঁর বাড়িতে! তা হলে কি তাঁর ডান হাতের দুঃখ এবার ঘুচবে?

খুব খাতির করে লোকটাকে বসালেন নকুড়বাবু। বললেন, “সদাশিব রায় বলে তো এখানে কেউ নেই। তা মশাই, সদাশিবের বাড়ি না থাক, আমার বাড়ি তো আছে, এখানেই থাকুন না হয়।”

লোকটা কেমন যেন বুঝুঁস হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল। তারপর বলল, “তস্য পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রাদিও কি কেউ নেই?”

“আজ্ঞে, তা তো জানি না, দরকারটা কীসের?”

“খুবই দরকার।”

নকুড়বাবু বললেন, “রায়বাড়ি অবশ্য এখানে একটা আছে। হরিকৃষ্ণ রায়। রথতলা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই বাঁ-হাতি বিরাট বাড়ি। তারা সদাশিব রায়ের কেউ হয় কি না তা অবশ্য জানি না। তা আপনি আসছেন কোথা থেকে?”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “বিশেষ কোনও জায়গা থেকে নয়। আমি ঘুরে-ঘুরেই বেড়াই।”

“তা আপনার নামটি?”

“গজানন, জাদুকর গজানন।”

নকুড়বাবু লাফিয়ে উঠলেন, “গজানন! অ্যাঁ! আরে আপনিই তো তবে গজু কারিগর! কী সৌভাগ্য আমার! কী সৌভাগ্য! এ যে ভাঙা ঘরে চাঁদের উদয়! এ যে কাঙালের ঘরে লক্ষ্মীর আগমন! এ যে লঙ্কায় জয় বাবা হনুমান! না না, এই শেষ কথাটা দয়া করে ধরবেন যেন?”

লোকটার অবশ্য কোনও কথাতেই তেমন গা নেই। চুপচাপ বসে রইল।

নকুড়বাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই পথের ধকল গেছে খুব। আর খিদেটাও নিশ্চয়ই চাগাড় দিয়েছে। দাঁড়ান, ব্যবস্থা করে আসছি।”

কিন্তু লোকটার যেন কোনও ব্যাপারেই তেমন গা নেই। খুব অন্যমনস্ক। ভারী চিন্তান্বিত। কাছেপিঠের কিছুই যেন লক্ষ করছে না। সকালে মুড়ি-শশা-চানাচুর দেওয়া হল, সঙ্গে চা। লোকটা সেসব একটু নাড়াচাড়া করল মাত্র। দুপুরে সামান্য দু-চার গরাস ভাত মুখে দিয়ে উঠে পড়ল।

নকুড়বাবুর স্ত্রী বাসবী দেবী বললেন, “এ কোন কিম্ভূতকে

জোটালে গো! হাঁটাচলা দেখেছ? ঠিক যেন অষ্টাবক্র মুনি।”

নকুড়বাবুর দশ বছরের ছেলে বিলু বলল, “একটু আগে কী দেখলুম জানো? পুকুরে চান করতে নেমে লোকটা মোটে ডুবই দিল না। পুরো শরীরটা ভেসে রইল। যেন শোলার মানুষ। উঠোন থেকে যখন বারান্দায় উঠল তখন দেখলুম বাতাসে ভেসে উঠল।”

নকুড়বাবুও এসব দেখেও দেখেননি। বললেন, “ওঁরা সব গুণী মানুষ।”

বাসবী দেবী চোখ বড় বড় করে বললেন, “ভূতপ্রেত নয় তো গো?”

ধন্দ একটু নকুড়বাবুরও আছে। তবু মাথা নেড়ে বললেন, “ভূত নয়, তবে ভগবানের কাছাকাছি কেউ হবে। কারণ, কাল রাতেই আমি লোকটাকে স্বপ্ন দেখেছি। আমার কাটা ডান হাতটা ফের জোড়া লাগাতেই ওঁর আসা। খুব বড় কারিগর। বেশ যত্নআত্তি করো দেখি।”

“ওমা! যত্নআত্তি করব কী? উনি তো এইটুকু ভাত খান। ভাল করে বিছানা পেতে দিয়েছি, উনি তো মোটে শুলেনই না। আর যে গিয়ে দুটো খোসামুদি কথা বলব তারই বা উপায় কী? উনি তো সর্বদা যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন।”

কথাটা ঠিকই যে, জাদুকর গজাননের কোথায় যেন গণ্ডগোল আছে। হাঁটছে না ভেসে বেড়াচ্ছে তা বোঝা যায় না। রাত্রিবেলা নকুড় বাইরের ঘরের চৌকিটাতে বিছানা করে গজাননের শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজে শুলেন পাশেই মেঝেতে মাদুর পেতে। এঁরা সব ভগবানের লোক। এঁদের হাওয়া বাতাসেও মানুষের পুণ্যি হয়। কিন্তু মাঝরাতে হ্যারিকেনের সলতে কমানো আবছা আলোয় যা দেখলেন তা অবিশ্বাস্য। দেখলেন, গজাননেন শরীরটা বারবার যেন শূন্যে ভেসে উঠে পড়তে চাইছে, আর গজানন শূন্যে সাঁতার কাটার মতো করে বারবার নেমে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষ তো গ্যাস-বেলুন নয়! তবে শূন্যে ভাসছে কী করে?

ভয়ে-দুশ্চিন্তায় রাতে নকুড়বাবুর ভাল ঘুমই হল না। তাঁর স্ত্রী ভূতের কথা বলছিলেন। কে জানে বাবা, ঘরে একটা ভূতই ঢুকে পড়ল নাকি?

সকালবেলায় মুখোমুখি চা খেতে বসে নকুড়বাবু বলেই ফেললেন, “আচ্ছা, আপনি আসলে কে বলুন তো? রাত্রিবেলা দেখলুম, আপনি বিছানা থেকে বারবার ভেসে উঠছেন গ্যাস বেলুনের মতো। ভূতটুত নন তো?”

গজানন জুলজুল করে চেয়ে থেকে বলল, “কে জানে বাবা, আমি আসলে কে। তবে ওজনটা বড় কমে গেছে। ওইটেই হয়েছে মুশকিল। যখন-তখন কেন যে ভেসে উঠছি কে জানে!”

“আপনি তো জাদুকর। বলি কুম্ভক-টুম্ভক জানেন নাকি? প্রাণায়ামে নাকি ওসব হয়।”

“জানতুম তো মেলাই। এখন কিছু মনে পড়ে না।”

“আমি বড় আশা করে আছি, আপনার দয়ায় যদি আমার ভাল হাতটা হয়ে যায়।”

গজানন তার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “ডান হাত ছাড়া কি খুব অসুবিধে হচ্ছে?”

“আজ্ঞে, খুব অসুবিধে। ধরুন গামছা নিংড়ানো যায় না, তবলা বাজানো যায় না, হাততালি দেওয়া যায় না।”

“যদি এতকাল চলে গিয়ে থাকে তা হলে বাকিটাও চলে যাবে। কাজ কী ঝামেলা বাড়িয়ে?”

“ঝামেলা কেন বলছেন? হাতটা কি কাজে লাগবে না?”

গজানন মৃদু গলায় বলে, “আমাদের ফটিক ছিল জন্মান্ধ। বেশ চলে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ কে একজন কবরেজ এসে তার চোখ ভাল করে দিল। এখন ফটিকের কী মুশকিল! চোখে আলো সহ্য হয় না, রং সহ্য হয় না, যা-ই দেখে তাই তার কাছে কিম্ভুত, অসহ্য মনে হয়। শেষে কান্নাকাটি, চেঁচামেচি। তাই বলছিলুম হাত বাড়ালে হয়তো ঝামেলা বাড়বে।”

এমন সময় প্রতিবেশী গুনেন সরকার এসে হাজির। “শুনলুম তোমার বাড়িতে একজন মস্ত গুনিন এয়েছেন। তাই দেখা করতে এলুম। কতকাল ধরে একজন ভাল গুনিন খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার বেগুনখেতে প্রতি বছর পোকা লাগছে, রাঙা গাইটা দুধ দিচ্ছে না মোটে, মাজার ব্যথাটা সেই যে কচ্ছপের কামড়ের মতো লেগে আছে, আর ছাড়ছেই না। তার ওপর ছেলের বউয়ের সঙ্গে তার শাশুড়ির নিত্যি ঝগড়া লাগছে, বাড়িতে তিষ্টনো যাচ্ছে না। কদম বিশ্বেসের সঙ্গে মামলাটা এখনও ঝুলে রয়েছে…”

গজানন কথাগুলো শুনতে-শুনতে হঠাৎ একটা ঢেকুর তুলতেই তার শরীরটা পক করে খানিকটা শূন্যে উঠে পড়ল, তারপর একটু হেলেদুলে পেঁজা তুলোর মতো নেমে এল নীচে।

গুনেন সরকার কথা থামিয়ে হাঁ করে দৃশ্যটা দেখল। তারপর সোজা সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, “চর্মচক্ষে আজ এ কী দেখলাম বাবা! ইনি যে মস্ত গুনিন! সাক্ষাৎ শিবের অবতার…”

গজানন একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বিড়বিড় করে বলল, “বড্ড হালকা হয়ে গেছি। নাঃ, ডিবেটা না হলেই নয়।”

খবর পেয়ে আরও পাড়াপ্রতিবেশী জড়ো হয়ে গেল। রীতিমত ভিড়। সবাই নিজের নিজের নানা সমস্যার কথা বলতে লাগল। কে কার আগে বলবে তাই নিয়ে ঝগড়াও লেগে যেতে যাচ্ছিল।

পরদিন সকালে উঠে নকুড়বাবু দেখলেন, সদর দরজা হাট করে খোলা। গজানন নেই। নেই তো নেই-ই। নকুড়বাবু খুবই দুঃখ করতে লাগলেন, “এ হেঃ! আমার ভাল হাতটা ওঁর দয়ায় হয়ে যেত। সবাই মিলে এমন বিরক্ত করল যে, লোকটা গায়েব হয়ে গেল!”

বৃন্দাবনের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। গত সাতদিন তার কোনও রোজগার নেই। সাধুচরণ সাহার বাড়ির জানলার গরাদ ভেঙে চুরি করতে ঢুকেছিল মাঝরাতে। ভুলচুকও কিছু করেনি। আগে মন্তর পড়ে বাড়ির লোকজনের ঘুম গাঢ় করে নিয়েছে। কুকুরের মুখবন্ধন করার মন্তরও পড়ে নিয়েছে। ঠাকুর-দেবতাদের পেন্নাম করতেও ভুল হয়নি। সবই ঠিকঠাক ছিল। গরাদ সরিয়ে ঢুকে পড়েছিল অর্ধেকটা। এমন সময় তার পায়ে লেগে টুলের ওপর রাখা একটা জলভর্তি মেটে কলসি মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দে ভেঙে যাওয়ায় বিপত্তিটা ঘটল। সাধুচরণ তড়াক করে উঠে এক ঘা লাঠি বসিয়ে দিল কবজিতে। তারপর ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচানি। বৃন্দাবন হাতের চোট নিয়েও যে পালাতে পেরেছে সে ভগবানের আশীর্বাদে। আর অনেকদিনের অভিজ্ঞতা আছে বলে।

কবজি ফুলে ঢোল হয়ে থাকায় দিনসাতেক আর কাজকর্ম করতে পারেনি। আজই মাঝরাতে বেরিয়েছে, হারু মণ্ডল ধান বেচে আজই কিছু টাকা পেয়েছে, সেইটে হাতাতে পারলে কয়েকদিন ভালই চলে যাবে।

হারু মণ্ডলের বাড়িতে ঢোকা বেশ সহজ কাজ। মাটির ভিটে বলে সিঁধ দিতে অসুবিধে নেই। আর হারুর ঘুমও খুব পাকা। বৃন্দাবন মন্তর-টন্তর পড়ে নিয়ে ঠাকুর-দেবতাকে প্রণাম করে সবে দক্ষিণের ঘরে সিঁধ দেওয়ার জন্য ছোট যন্তরটা চালিয়েছে, হঠাৎ কে যেন খুব ক্ষীণ গলায় বলে উঠল, “ডিবেটা যে কোথায় গেল!”

বৃন্দাবন চমকে উঠে পেছন ফিরে যা দেখল, তাতে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। একটা লোক যেন বাতাসে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। মাটির একটু ওপরে পা। একটু ক্ষয়াটে জ্যোছনায় দেখা যাচ্ছে, লোকটা বেশ রোগাভোগা আর দাড়িগোঁফ আছে।

“ভূত!” বৃন্দাবনের হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।

লোকটা তার দিকে চেয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, “সদাশিব যে কোথায় গেল, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। জায়গাটা পালটে গেছে কত!”

বৃন্দাবন কাঁপতে কাঁপতে হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আপনি কে? দেবতা না অপদেবতা?”

লোকটা মাটির ওপর নেমে দাঁড়িয়ে তাকে একটু দেখল। তারপর বলল, “আমি জাদুকর গজানন। সদাশিবের বাড়ি কোথায় জানোনা?”

“আ-আজ্ঞে না।”

“তুমি তো চোর। সব বাড়িই তোমার চেনার কথা। আমি যে সদাশিবকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

“ও নামে যে কেউ এখানে নেই!”

“ইস! তা হলে যে ভীষণ বিপদ!”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress