খোলা চিঠি
বন্ধুগণ,
বাড়ির ও “বারোয়ারি” দুর্গাপুজো শেষ হয়ে “বিজয়া” হলো। আবার একবছর পর আবার—- দিন যায়….. ভাবছি, যাবার আগে “দেনাপাওনা” সব মিটিয়ে ফেলা উচিত, কারণ “শেষ প্রশ্ন” নয়ত সকলের সবসময় থেকেই যায়। কিন্ত উপায় খুঁজে পাচ্ছি না, আসলে “শেষের পরিচয়” বা শেষ পরিণতি কিভাবে যে হবে— কিভাবে যে দেবো? তবে যা লিখছি, সব কিন্ত সত্যি কথা। একটুকুও বানানো নয়। আমার নাম পূরবী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এ নামটি পছন্দ করতেন এবং পূরবী নাম স্বাক্ষরিতও করেছেন, অথচ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কোথাও উল্লেখই করেন নি। কত নায়িকার নাম, ললনা, ছলনা , অচলা ” শুভদা” যাক্। আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের ডাকনাম ” লালু” কেউ কেউ মানে দুষ্টু বন্ধুরা তাকে খ্যাপাত, ওটা ত কুকুরের নাম বলে। কি আর করা যাবে, নিজের নাম ত নিজে পছন্দ করে রাখা যায় না, যে ” ভালমন্দ” নিয়ে মন্তব্য করবো।
আমার ছোটবেলা কেটেছে, এক আধা গ্রাম আধা শহরে, ঠিক পল্লীগ্রাম নয়, তবে তখন “পল্লীসমাজ” কাকে বলে, সেটা কিছুটা আঁচ পেয়েছিলাম। আমার বড়োমেসোমশাই নামী ডাক্তার ছিলেন,তাঁর ডিস্পেন্সারিতে দুজন কম্পাউন্ডারবাবু ছিলেন, রমাকান্তবাবু ও শ্যামাদাস বাবু , “কাশীনাথ” বলে কেউ ছিলেন না, অথচ নামগুলোর মানে ত প্রায় এক।
তেমনই “চন্দ্রনাথ” বলে কারোকে জানি না, তবে চন্দ্রকান্ত বলে একজনকে জানি, বায়োকেমিষ্ট্রি পড়াতেন, মাস দুয়েক আগে মারা গেলেন কভিড 19 তে, অত্যন্ত দুঃখের। নামের ব্যাপারে আরও একটু বলি, বিপ্র মানে ব্রাহ্মণ, দ্বিজ (অর্থাত দুবার জন্ম, পৈতে ধারণের জন্য ) মানেও ব্রাহ্মণ, তাই, ” বিপ্রদাস ” ও দ্বিজদাস মানেও এক।
আমার মা (দিদিমা) বিধবা ছিলেন, সধবা কেউ মারা গেলে, বলা হতো তাকে “সতী” । এতে আমার খুব দুঃখ হতো, আমার মা কি তাহলে অসতী? একজন বিধবা মহিলা আসতেন মাঝে মাঝে। সুন্দর সম্ভ্রান্ত চেহারা, হাতে এক থলে তাতে থাকত আতপ চিঁড়ে, মা ত আমার সেদ্ধ চিঁড়ে খেতেন না। মহিলা চলে গেলে মা বলতেন দুঃখ ভরে, আহা “বামুনের মেয়ে” অবস্থার ফেরে এখন চিঁড়ে কুটে বিক্রি করে খায়।
নানা স্মৃতির কলসে কত কিছু “বোঝা” যে বয়ে বেড়াচ্ছি , সেই ছোটবেলার ” বাল্যস্মৃতি” থেকে।
“ছেলেবেলার গল্প” করতে খুব ভাল লাগে।
সে শহরে একটা সিনেমা হলের নাম ছিল আলোছায়া— “আলো ও ছায়া” নয়। আর যেতাম দুটি “মন্দির” রে, গোপীনাথ ও যোগমায়া কালিবাড়ী। আমার মাসতুতো দিদিকে ডাকতাম, “বড়দিদি”— ভালবাসতেন খুব,ওনাকে হারিয়েছি , তবে “মেজদিদি” আছেন। “আমার কথা” আর কত বলবো। একা কোথাও মা আমাকে ছাড়তেন না, তখন খুব “ছেলেধরা” র ভয় ছিল। অনেক গল্প করতেন, ” সত্যাশ্রয়ী” ” মহাত্মাজী” “মহাত্মাজীর পদত্যাগ ” ইত্যাদি।
আমার দাদুকে আমি দেখি নি , আমার জন্মের আগেই তিনি গত হয়েছিলেন। গল্প শুনেছি মা(দিদিমা) র মুখে। তিনি উকিল ছিলেন, “মামলার ফল ” যেমনই হউক, রোজ চুটিয়ে বাজার করতেন। বাজার এনেই, চুলে তেল ঠাসতে ঠাসতে কুয়োর পাড়ে যেতেন স্নান করতে। ১৯২০ সাল, স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী চলছে, আমার গর্ভধারিণী কাঁথায় শুয়ে হাত পা নেড়ে খেলছেন, ছেলেমেয়ে শাশুড়ি পরিচারকদের নিয়ে মা’র তখন জমজমাট সংসার। তখন ত তিনি আর “ষোড়শী” নন, প্রায় পঁচিশ বছর পাড় করে এসেছেন।
একদিন আমার সৌখীন ” বিলাসী” মনের দিদিমা লাল লতাপাড় শাড়িতে মাথায় ঘোমটা টেনে দাদুকে খেতে দিয়ে বলেছিলেন , আপনি বাজার করে এসেই চান করতে যান, এতো কমসময়ে আমি কি করে, মুড়িঘন্ট, মাছ কালিয়া রান্না করে দি…..আমি বিস্ময়াভিভূত, তুমি দাদুকে আপনি করে বলতে? হ্যাঁ, উনি ত অনেক বড়ো ছিলেন। একশ বছরে কত পরিবর্তন। কলকাতার আরামবাগে মাঝে মাঝে গ্রসারি করতে যাই, সেখানে রাম বলে একজন আছেন, মাঝে মাঝে বদলি হন, আবার আসেন। এত ভাল ব্যবহার যা মনে ধরে রাখে, বহু আগে হোম ডেলিভারি দিতে এসে , মিষ্টি মিষ্টি গল্প করত অল্প স্বল্প কিছুক্ষণ, দিদি আলুভাতে খেতে ভাল লাগে না। আমি হেসে বলতাম খুউউব। ফর্সা সুন্দর চেহারা, মুখে হাসি, সবাই দোকানে এসেই ত রাম কোথায়, রাম কোথায় —খোঁজ করে , মনে হতো জন্ম থেকেই “রামের সুমতি” ঈশ্বর দিয়েছেন। আমি “অরক্ষনীয়া” ছিলাম না, তবে ” স্বামী” কেও কয়েক বছর আগে হারিয়েছি। এখন তিনি—“ছবি” কার কখন যাবার পালা যে কখন আসবে,তা কেবল উপরওয়ালাই জানেন। কবে ভবসংসার থেকে “নিষ্কৃতি” হবে , তাতো জানি না। মৃত্যুতে বোধহয় সবার “দর্পচূর্ণ” ও হয়ে যায়। থাক্ এসব কথা । সদ্গুরুর “পথনির্দেশ ” এই ” আঁধারে আলো” র জীবন — যেন এই সুন্দর পার্থিব পটভূমিতে বিচরণ, কখনোই শেষ কথা শেষ হবার নয়। শরৎচন্দ্র লেখকই কি সব শেষ করতে পেরেছিলেন, আমার মতো “নারীর লেখা” তে আর কতটুকুই বা “নারীর মূল্য ” এর বিকিরণ ঘটে। কোনদিন জানতে পারব না, “ক্ষুদ্রের গৌরব” বা কাকে বলে সত্যিকারের “জাগরণ”। পারলাম না তার ” রস সেবায়েত” হতে। শুনতাম, ” বেতার সঙ্গীত ” ও গ্রামাফোন ,আর বিনোদন বিশেষ ছিল না। কিন্ত গান ত প্রাণ, সব সঙ্গীত, ” ভারতীয় উচ্চ সঙ্গীত” থেকে সব সুরের রেশ ভালো লাগে, “শ্রীকান্ত ” আচার্যের— আমার সারাটা দিন ,মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি , তোমাকে দিলাম….. শুধু…… খুব দরদ দিয়ে গেয়েছেন।
“আগামীকাল” যেমন ছোওয়া যায় না, তেমনই “সত্য ও মিথ্যা” ও যাচাই করাও কঠিন। ধরা যায় না ছোট গল্পের ছোওয়াও— তবুও “রসচক্র” এর ” আসার আশায়” শুধু ঘুরপাক। “ভবিষ্যত বঙ্গসাহিত্য” র ধারা যে কোথায় যাবে জানা নেই। “সাহিত্য ও নীতি” র সংঘাত ক্রমশঃ বেড়েই চলছে। কিছু “ভাগ্য বিরম্বিত লেখক সম্প্রদায়” “বাংলা বইয়ের দুঃখ” ঘোচাতে “সাহিত্যের মাত্রা” র ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। “সাহিত্যের আর একটা দিক” গতি পেয়েছে ” বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা” নিয়েও।
কিন্ত সবচেয়ে এই দুই ধর্মের সৌহার্দ্য সমন্বয়ের ইঙ্গিত একটি গরুর নাম যখন গৃহকর্তা রাখেন ,” মহেশ”। আমার জীবনে অনেক গুরুর প্রভাব, তার মধ্যে কথাশিল্পী লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন। এখানে ” গুরু — শিষ্য সংবাদ” এর মাধ্যম গুরুর সৃষ্ট সাহিত্য। তাঁকে প্রণাম জানিয়ে এ চিঠি শেষ করলাম। সবাই খুব ভালো থাকুন।