Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন || Syed Shamsul Haque

কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন || Syed Shamsul Haque

বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন রজনী

বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন রজনী। গায়ের রং ছিল ভোরের কেবল সূর্য উঠতে থাকা অন্ধকারের মতো, ওরই মধ্যে যেন একটুখানি দীপ্তির আভাস। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই রং তার সারাটা মুখে এমন এক সারল্য এনে দিয়েছিলো, যেন অখণ্ড এক মমতার ছবি চোখে দেখা যাচ্ছে। সেই মেয়ে, সেই রজনী, একুশ বছরের বিপজ্জনক বয়সে ঘর পালাবে কেউ ভাবেনি।

কেউ না। রজনী নিজেও না। মানুষ তো তার নিজের সব কথা নিজে জানতে পারে না। রজনীই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?

একদিন দুপুরে গেল কলেজে। তিনবার আই, এ, ফেল করবার পর চতুর্থ বারের মতো পড়া চলছিল। আর আই, এ পাশ না করলে যে আজকাল ভাল বর পাওয়া যায় না এ সত্যটা বাড়ি থেকে পাঁচনের মতো দুবেলা তাকে গেলানো হচ্ছিল। আজকাল বাবা যখন ডাকেন রজনী বলে সে ডাকে আদরের আভাস মাত্র থাকে না। সে যে ভাগ্যহীনা, সংসারের গলায় মশলা পেষা পাথরের মতো দুর্বহ-ভার, সেই তিক্ততাটুকু ফুটে বেরোয়।

সেদিন রজনী গেল কলেজে। কলেজ থেকে সন্ধ্যের প্লেনে সোজা করাচি।

একা নয়। সঙ্গে একজন। রজনীদের দুবাসা পরের পুরোনো দোতলার মেজ ছেলে মহসিন। লেখাপড়া প্রায় কিছুই না করে ডা ডা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সুদর্শন চেহারাটাকে মূলধন করে। একদিন মায়ের কাছ থেকে হাজার দুয়েক টাকা পাওয়া গেল। মা বললেন, ব্যবসা কর, কিছু একটা কর, নইলে আমি আত্মঘাতী হবো। সে টাকাই হলো কাল। দুহাজার টাকা মহসিনের কাছে মনে হলো কুড়ি হাজার টাকার মতো। রজনীকে সে ভালবাসত। আর তিনবার আই, এ, ফেল করা, সংসারে সবার কাছে সংকুচিতা রজনী মহসিনের মতো সুদর্শন একজনের কাছ থেকে হৃদয়ের পরম প্রশ্রয় পেয়ে মনে মনে হৃদয়টাকেই তার পায়ের তলায় সমর্পণ করেছিল। সেই তাকে নিয়ে মহসিন ঝাঁপিয়ে পড়ল সংকেতহীন ভবিষ্যতের খাদে।

কিছুদিন থেকে রজনী তার বুকের মধ্যে শুনতে পেত দুয়ার ভাঙ্গার আহ্বান।

শুনতো, শুনে শিউরে উঠতো। মহসিন বলত, আমি একদিন আসবো, ঝড়ের মতো তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবো।

ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়া পৃথ্বি-রাজ সংযুক্তার গল্প আর সেই সঙ্গে আঁকা একখানা ছবি চমক দিত রজনীর মনে। সে দেখতে পেত, ঠিক ছবিতে যেমন আঁকা, মহসিন ঘোড়ায় চড়ে কোলসাপটা করে তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তখন তার ভয় করত, কিন্তু ভাল লাগত। ফুলের গন্ধ পেত রজনী। চোখে আলো দেখত। মানুষের কোলাহল শুনতে পেত। মহসিনের সঙ্গে তার বিয়ের রাতটা খণ্ড খণ্ড ছবিতে জীবন্ত হয়ে উঠতো। আনন্দে, উদ্বেগে, অন্ধকার ঘরে বালিশ বুকে চেপে নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকত রজনী।

রজনীর পিঠে একদিন মার পড়েছিল। মহসিনের একটা চিঠি পড়েছিল বাবার হাতে। বাসার চাকর ছোঁকরাটি ফিরছিল বাজার করে। তার থলের মধ্যে চিঠিখানা পুরে দিয়েছিল মহসিন। বলেছিল, বুবুর হাতে বাজারের থলে দিবি।

কিন্তু তা আর হলো না। রজনীর বাবা ছিলেন বারান্দায়। বাজার দেখবার জন্যে চাকরটার হাত থেকে থলে নিয়ে উপুড় করতেই দিব্যি ভাঁজ করা চিঠি বেরুলো। পড়লেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে টুবুলের আঁক কষা স্কেল দিয়ে মারলেন রজনীকে।

রজনীর পিঠ লাল হয়ে উঠেছিল। ব্যথা করছিল। খানিকক্ষণ পর ব্লাউজটা শরীরের সঙ্গে টেনে ধরেছিল কাঁচা রক্ত শুকিয়ে গিয়ে। তিন দিন গেল না কলেজে। সেই তিনটে দিন মহসিন বাসার চারপাশে ঘুরঘুর করল। এবং অবশেষে সেই চাকর ছোঁকরার মুখ থেকেই শুনলো আদ্যোপান্ত ঘটনা। শুনে প্রথমে সরে গেল রজনীদের বাসার ত্রিসীমা থেকে। রজনীর বাপের চোখে পড়াটা বোধহয় মধুর হবে না, আর এ তিনদিনে যে তাঁর চোখে আদৌ পড়েনি সেজন্যে ভাগ্যতারাকে ধন্যবাদ দিল। পালিয়ে পালিয়ে কী ভাবল কে জানে, প্রায় দিন দশেক পর রজনীকে যখন গলির মোড়ে কলেজ ফেরত পাওয়া গেল তখন মহসিন বলল, বাপ না ডাকাত। বোলো তোমার বাপকে, আমার মতো জামাই পেলে ধন্য হয়ে যাবে।

রজনী বলল, বাবা তোমার কাছে বিয়ে দিলে তো।

কেন? না দিক তো বয়েই গেল। তুমি চলে আসবে, বাইরে বিয়ে হবে। আজকাল কত হচ্ছে। তাছাড়া খরচাপাতিও নেই। বরং আজকাল বাপ মা তাই চাচ্ছে, তুমি খোঁজ নিয়ে দেখ।

অসম্ভব!

কী অসম্ভব?

সে পারবো না।

কেন? বাহ।

কক্ষনো না। ততক্ষণে বাসা প্রায় দেখা যাচ্ছে। মহসিন দাঁড়িয়ে রইল। রজনী মাথা নিচু করে বই খাতা কোলের পরে অদল বদল করতে করতে বাসায় গিয়ে ঢুকলো। তারপর সোজা বাথরুমে। সেখানে বসে বসে ভাবলো মহসিনের কথা। রজনী খানিকক্ষণ কাঁদলো। আবছা করে তার মনে পড়ল দুএকজন বান্ধবীর কথা, একটা ভালো মোটর গাড়ি কবে দেখেছিল সেটা, কবে একদিন রজনী কলেজ থেকে এসে দেখে ঢাকা তার তরকারি বেড়ালে খেয়েছিল সেই কথা। এইসব বিচ্ছিন্ন ছবিগুলো কারণহীন এসে ভিড় করলো এবং তাকে কাঁদালো!

বাড়ি পালানোটাও অদ্ভুত। কলেজে ঢুকতে যাবে, দেখে গেটের সামনে মহসিন দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তাকে দেখেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, চল, তোমার সাথে কথা আছে। এবং ভালো করে কিছু বোঝা বা বলার আগেই রজনী দেখে কখন মহসিনের সঙ্গে এক রিকশায় উঠে বসেছে সে। রিকশা চলছে মেডিক্যাল কলেজের সমুখ দিয়ে। অত বড় দালানে কয়েকশ লোক একসঙ্গে শুয়ে রোগেব যন্ত্রণায় কাত্রাচ্ছে, কী মারা যাচ্ছে এই উপলব্ধিটা রজনীর সেদিন হয়েছিল আর জীবনের প্রতি একটা আচমকা বৈরাগ্য এসে গিয়েছিল।

তাকে নিয়ে মহসিন সেদিন সারাদিন ঘুরলো। যে কথাটা বারবার জিগ্যেস করল তা হচ্ছে, তুমি আমাকে বিয়ে করবে কিনা বল।

প্রথমবার যখন জিগ্যেস করেছিল তখন রজনীর মনে হয়েছিল ঠাট্টা। দ্বিতীয় বার মনে হয়েছে, একটা খেয়াল। পরে যখন আবারো জিগ্যেস করেছে, তখন সে বুঝতে পেরেছে। ঠাট্টাও নয়, খেয়ালও নয়, মহসিন তাকে সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চায়।

গায়ে তার কাঁপন লাগল, সংযুক্তার মতো তারও বুঝি তবে পালা এসেছে লুট হয়ে যাওয়ার। রজনীর কাছে এটা একটা অভিনব ব্যাপার যে কেউ তাকে এত কাছে থেকে, একেবারে চোখ মুখ হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যায় এত নিকট থেকে, বিয়ের প্রস্তাব করে বসবে। নিজেকে তার অমিত ভাগ্যবতী বলে মনে হলো। মনে হলো, এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের কোটি কুমারীদের ওপর জিৎ হয়ে গেছে তার। সে হাসলো। রজনী মাথা কাৎ করে জানাল, তার এতে অমত নেই।

তখন মহসিন বেরিয়ে গেল। বলে গেল, আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরছে। রেস্তোরাঁর কেবিনে একা বসে রইলো রজনী। বসে বসে তার অস্বস্তি করতে লাগল। ছটফট করতে লাগল। এই মুহূর্তে যদি বাইরে গিয়ে খানিকটা ছুটোছুটি করতে পারতো, নাচতে পারতো, ছোট ভাইটার গলা জড়িয়ে ধরতে পারতো কী বাসার ছাদে খুব করে হাঁটতে পারতো রজনী, তো ভালো লাগতো। তার বদলে খাতায় পাখি আঁকলো, নাম লিখলো, অনেকগুলো পাতা নষ্ট করলো। এমনি করে। অবশেষে মহসিন ফিরে এলো। তখন শেষ বিকেল। চোখের পাতার মতো ফিকে লাল হয়ে যাচ্ছে আকাশটা। মানুষ বাড়ি ঘর মোটরের ছায়াগুলো লম্বা লম্বা দেখাচ্ছে। বেরিয়ে এসে রজনী জিগ্যেস করল, কোথায়?

এসো আমার সঙ্গে। এয়ারপোর্টে এসে সে বলল, রজনী আমরা করাচি যাচ্ছি।

না, না। কেন?

তুমি বুঝতে পারছ না, রজনী, আমি তোমায় বিয়ে করব। আমার সঙ্গে অনেক টাকা আছে। আমি একটা কাজ নেব। বাঙালিদের কত কাজ সেধে দিচ্ছে করাচিতে। তোমার নিজের সংসার হবে, যেখানে কেউ তোমাকে বকবে না। আমরা, আমরা মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসবো দেশে।

না, না।

কী না–না? তোমার বাবা আমাকে দুচোখ দেখতে পারেন বলছ?

তা নয়।

তাহলে, আমার সঙ্গে টাকা নেই মনে করছ?

না।

তবে, তবে কী?

না, না।

আমি কিসসু বুঝতে পারছি না কেন তুমি না–না করছ।

মহসিন অত্যন্ত চটে গিয়েছে। সেটা লক্ষ্য করে মনটা ভারী ছোট হয়ে গেল রজনীর। অথচ এইটে স্পষ্ট করে বোঝাতে পারলো না যে, আপত্তিটা তার গোড়াতেই। বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে না কয়ে কী করে চলে যায়। আর বিয়েই বা করে কী করে? তার বাবার মুখ মনে পড়ল। রজনী যেন দেখতে পেল, অফিস থেকে ফিরে এলে তার যেমন হয়, তেমনি খুব উদ্বিগ্ন বিব্রত দেখাচ্ছে বাবাকে।

অথচ এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে পারছে না মহসিন তা ভেবে অবাক লাগল তার। একবার কী বলতে চেষ্টাও করল, কিন্তু থেমে গেল। মহসিন এমন একটা প্রত্যয় নিয়ে কথাগুলো বলছে যে, রজনীর খানিকটা বিশ্বাস হচ্ছে জীবনে এ রকমটি হতেও পারে। হয়ত এটাই স্বাভাবিক। এবং সে যদি প্রতিবাদ করে তো ওই মহসিনের কাছে নিছক একটা ভীরু বলে লজ্জা পেতে হবে তাকে।

এই রকম যখন সংকট তখন মহসিনই যেন দেবতা হয়ে দাঁড়াল। বলল, অবশ্যি তোমার ভয় করলে আলাদা কথা। তুমি ফিরে যাও। আমি জোর করব না। আমি যাব।

কোথায়?

যেখানে তোমাকে যেতে বলেছিলাম। আমাকে আজ যেতেই হবে। আমি আর একটা দিনও থাকছিনে। পোড়ার দেশে থেকে কী হবে?

রজনীর খুব ভয় করলো! মহসিন একা কোথায় কোন বিদেশে গিয়ে মুখ থুবড়ে মরে থাকবে, কী দেখা শোনার কেউ থাকবে না—-এই ভাবনাটা কষ্ট এনে দিল রজনীর মনে। তার জিদ দেখে আরো মনে হলো লোকটার কপালে দুঃখ নিশ্চিত লেখা আছে, ভাগ্য তাকে টানছে। শিউরে ওঠে মেয়েটা। বড় বড় চোখ মেলে সে তাকিয়ে রইলো মহসিনের দিকে। এই লোকটা যাবে চলে, আর সে থাকবে এখানে, হয়ত এবারও ফেল করবে, বাবা আর পড়াবেন না বলে দিয়েছেন, ছোট ভাইটা পর্যন্ত ইতিমধ্যে তাকে তুই বলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে, কেননা সে অবধি বুঝে গেছে তার বোনের আর আদর নেই—- রজনী আর ভাবতে পারলো না। ভীরু গলায় একবার শুধোলো, এখানে থেকে কিছু হয় না?

এখানে থেকে আমি কিছু করতে চাই না।

আর প্রতিবাদ করল না রজনী।

রাত একটার সময় তাদের প্লেন পৌঁছুলো করাচি। তারা উঠলো হোটেল কোলামবাসে। তেতলার ঘরে।

.

পীরজাদা হচ্ছে সেই জাতের মানুষ যে রাজার ঘরে জন্মালে মুকুট হারাতে, কোটালের ছেলে বসতো তার সিংহাসনে। নেহাৎ একালে জন্ম বলে রাজ্যও তার হারায়নি, একবস্ত্রে দেশত্যাগও করতে হয়নি, কিন্তু যা হারিয়েছে তার বেদনা সাত রাজাতেও সারিয়ে দিতে পারবে না।

দেশত্যাগের বদলে বৃহত্যাগ কবেছে পীরজাদা। আজ আড়াই বছর ধরে হোটেল কোলামবাসের তেতলার শেষ দক্ষিণ ঘরখানা তার আশ্রয়। একদিকে জানালা খুললে দূরে আরব সাগরের ইশারা, আর এক দিকের জানালায় শাহরাহ ইরান পেরিয়ে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, প্রান্তরের শেষ প্রান্তে মালার মতো মেলারাশি প্রাসাদের বীথি। রাতে ঐ দূর দালানগুলো থেকে অসংখ্য আলোর ডট অন্ধকারকে চন্দনফোঁটার মতো সাজিয়ে রাখে। পীরজাদা যেদিন অত্যধিক মদ্যপান করে চোখের তীব্রতা হারিয়ে ফেলে, সেদিন তার মনে হয় এক সুন্দরী, যার মুখ নিকষ কালো সে প্রসাধন করে অধীর অপেক্ষা করছে। তাকে স্পর্শ করা যাবে না, তার আর কোন অঙ্গ দেখা যাবে না, তার আসন দেখা যাবে না—- সে শুধু তার বিশাল মুখ সজ্জিত করে রাতের পর রাত অপেক্ষা করবে। তার মাথার চুলে চক্রের মতো ঘুরবে তারকাপুষ্প।

যে পীরজাদা সুন্দরী তরুণী দেখলে শিউরে উঠত, মনে মনে এবং কখনো কখনো সরবে তাদের গাল দিত বাস্টার্ড, হাসি, বেশ্যা বলে সেই পীরজাদা যখন এই সব রাতে বারান্দায় বেরিয়ে এসে ঐ আলোর মধ্যে নিকষ কালো কল্পনার মহিলাকে দেখতে পেত তখন তার মনে হতো ভেতর থেকে বুক খালি করে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাথার মধ্যে তখন সুরার সেতার বাজছে। সে রেলিং–এ ঝুঁকে পড়ে প্রলাপ বকতো আর কাঁদতো।

বন্ধুদের রীতিমত শক্তি প্রয়োগ করতে হতো পীরজাদাকে তখন বারান্দা থেকে ঘরে আনতে। এটা একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল, সুরা পানের আসর থেকে পীরজাদাকে কেউ একা বারান্দায়। বেরুতে দিত না। তাকে চোখে চোখে রাখা হতো।

কিন্তু যারা পাহারা দেবে তারাও তো মদ খেতেই বসেছে। তাদের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেলে। কে আর কাকে রাখবে চোখে? তখন পীরজাদা বেরুতো বারান্দায়। আর ঘটতো এই কান্ড। নিচে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ে তার শরীর হিম হয়ে যেত। কারণ তার মনে হতো, পীরজাদা বুঝি রেলিং থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করছে।

অবশ্যি সে ইচ্ছে থাকলে আজ থেকে আড়াই বছর আগেই সব শেষ হয়ে যেত। তার কবরের পরে ঘাসের শীষ ঘন হয়ে উঠত এতদিনে। তবে সুদর্শন অগ্নিসম্ভব গায়ের রং, কয়লা রং স্যুট পরা, নীল চোখ, দীর্ঘ এই মানুষটাকে জীবিত বলাও ভুল। কারণ, পীরজাদা মনে মনে জানে তার বেঁচে থাকার এখন একটি মাত্রই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে এই ছফুট দেড় ইঞ্চি দীর্ঘ লাশটা যদ্দিন না মাটির তলায় যাচ্ছে তদ্দিন মাটির ওপরে তাকে বাঁচিয়ে রাখা। আর সম্ভবত তাই নিয়ম বা অনিয়মের ভেদাভেদ নেই তার কাছে। রাত চারটেয় তার শোবার সময়, দুপুর এগারোটায় ব্রেকফাস্ট, তিনটেয় লাঞ্চ, ডিনারের কথা কোনদিন মনে থাকে কোনদিন থাকে না। সাতদিন অফিসে ভূতের মতো কাজ করতে পারে এক লহমার বিশ্রাম না নিয়ে, আবার তিনদিন একটানা ঘুম থেকে বুঝি আজরাইলও টেনে তুলতে পারবে না। মদ স্পর্শ করবে না মাসের পর মাস, আবার বসলে বড় একটা বোতল বিরতিহীন পান করে কারো সাহায্য না নিয়ে নিচ তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় উঠে অন্ধকারে চাবি দিয়ে ঘরের তালা খুলে পোশাক বদলে ঘুমোতে যেতে পারে একটুও না টলে, ভুল না করে।

এর শুরু সেই আড়াই বছর আগে।

তারো তিন বছর আগের কথা। পীরজাদা তখন সদ্য বিলেত ফেরত, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সীতে সাফল্যের সঙ্গে ওত্রানো ছেলে। দেশে ফিরে চাকরি নিল না। বাবা বললেন, আমি টাকা দিচ্ছি, তুমি ফার্ম করো। বাবাকে একালের ছেলেদের চেয়ে একটু বেশি শ্রদ্ধা করতে পীরজাদা। চাকরির অফারটা ছিল ভালো। কিন্তু সেটা তক্ষুনি ফেরৎ পাঠিয়ে ফার্ম করার জন্যে উঠে পড়ে লাগল সে।

কয়েক মাস পর সুদূর গুজরানওয়ালা থেকে বাবা লিখলেন, আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ। আশঙ্কা হচ্ছে বাচবো না। তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছ এবং ইতিমধ্যে অনেকখানি। প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছ এটা পিতা হিসেবে আমার পরম আনন্দের কারণ। কিন্তু তবু বলবো, এ আনন্দ সম্পূর্ণ নয়। তুমি সংসারী হও। পুত্রবধূর মুখ না দেখে মরলে বেহেস্তে গিয়েও শান্তি পাবো না। তোমার ওপর আমার অসীম আস্থা আছে। আমি একটি সুলক্ষণা, সর্বগুণসম্পন্না, সুন্দরী পাত্রীর সঙ্গে তোমার বিবাহ স্থির করেছি। পত্র পাওয়া মাত্র বাড়ি চলে এসো। আগামী বৃহস্পতিবার রাত্রে শুভদিন ধার্য হয়েছে।

পীরজাদা এলো গুজরানওয়ালায় সেই রাতেই ট্রেন ধরে। এবং যথানিয়মে বৃহস্পতিবারও এলো। পরিবারের বড় ছেলের বিয়েতে তিনদিন তিনরাত রোশনাই হয়ে থাকল সারা মহল্লা। চতুর্থদিনে পীরজাদা বউ নিয়ে ফিরলো করাচি। সুন্দরী সন্দেহ নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য জগতের মেয়ে।

পীরজাদার বাবা সন্ধান রাখতেন না, তার ছেলের জীবনে পরিবেশের কতখানি পরিবর্তন হয়েছে ছবছর বিলেত বাসের ফলে। যে সুলক্ষণা মেয়েটিকে তিনি ছেলের জীবনসঙ্গিনী করে দিলেন, সে সলাজ, সন্ত্রস্ত এক গেঁয়ো বালিকা। পীরজাদা যে সমস্ত বান্ধবীদের সঙ্গ পেয়ে অভ্যস্ত তাদের কলরব মুখরিত বিদ্যুৎ চমকিত উপস্থিতির পাশে এ মেয়ে যেন মাটির প্রদীপ। প্রথম কদিন স্তব্ধ হয়ে রইলো লোকটা। এমন কী একে আত্মনির্বাসনও বলা যেতে পারে। প্রায় এক পক্ষকাল করাচিতে থেকেও পীরজাদার সাক্ষাৎ তো দূরে থাক তার সিগারেটের ছাইটুকু পর্যন্ত কেউ দেখতে পেল না। একদিন বিকেলে তার কয়েকজন বন্ধু, বন্ধুপত্নী আর একজোট অবিবাহিত বান্ধবী এসে অতর্কিতে বাসায় চড়াও হলো। সমস্বরে তারা বলল, কী এমন বউ পেয়েছ যে বাসা থেকে বেরুতেও চাও না? আমরা দেবী দর্শনে এসেছি।

লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেল পীরজাদা। এদের সামনে ঐ স্বল্পশিক্ষিতা, এক শতাব্দী পেছনে পড়ে থাকা, প্রচুর পোশাকে প্রায় সম্পূর্ণ আবৃতা তার স্ত্রীকে কী করে সে বার করবে? তার বান্ধবীদের চোখে যে দীপ্তি জ্বলছে, পীরজাদার মনে হলো, তা প্রস্তুত হয়ে আছে। উপহাসের জন্যে। পীরজাদাকে সেদিন গলদঘর্ম হতে হয়েছিল উদগ্রীব মানুষগুলোকে নিরস্ত করতে। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে তাদের তো পাঠানো গেল। এবং প্রতিজ্ঞা করতে হলো অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই স্ত্রীকে সে হাজির করবে তাদের দরবারে।

বলতে গেলে সে রাত থেকেই স্ত্রীকে আধুনিকা করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেল লোকটা। পীরজাদার একটা স্বভাব যখন যে কাজ করবে নিঃশ্বাস না নিয়ে করা চাই, আর যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই। স্ত্রীর কোন ওজর আপত্তি টিকলো না, ঘরের কাজ মাথায় উঠলো রান্নাবান্না পড়ে রইলো, বসে বসে সে মুখস্ত করতে লাগলো সামাজিক কেতা–কানুনেব বুলি, নতুন ধরনের কাটা কামিজ পরে অস্বস্তির সঙ্গে শুরু হলো তার চলাফেরা, এক ফালি দোপাট্টায় শরীর বিব্রত হয়ে রইল, মুখে নানা রঙের সমাবেশ মুখোশের মতো যন্ত্রণার সৃষ্টি করলো, নাক জ্বালা করতে থাকল সুরার গন্ধে, বাথ সলটে বমি। কিন্তু মাত্র দিন সাতেকের জন্যে।

এক পক্ষকাল যেতে না যেতে দেখা গেল পীরজাদার শাদা রেসিংকার, যেটা সে শখ করে আসবার পথে ইটালিতে কিনেছিল, সেটা সন্ধ্যায় কোনদিন সেজানে এসে দাঁড়াচ্ছে, কোনদিন বীচ লাকসারির কার পার্কে পাওয়া যাচ্ছে, কিংবা শাহরাহ ইরান ধরে উধ্বশ্বাসে ছুটে চলছে পুরনো ক্লিফটনের দিকে। রোববারে তো কথাই নেই, নিশ্চয়ই হস বেতে দেখা যাবে। এতকাল পীরজাদার পাশে একেক দিন একেক রূপসীর দেখা মিলত—-সিংহাসন কারো স্থির ছিল না কোন কোনদিন একাধিক আরোহিণীও চোখে পড়ত, মনে হতো হারেম লুট করে। রাজধানীতে ফিরছে যুবরাজ। কিন্তু এবারের আরোহিণী একজন, আর তাকেই দেখা গেল দিনের পর দিন, সন্ধ্যের পর সন্ধ্যে। দামেশকের তলোয়ারের মতো ঋজু ছিপছিপে এক তন্বী। চলনে সভা স্তব্ধ হয়, হৃদয় স্পন্দিত হয়ে ওঠে। উদ্যত ফণিনীর মতো তার বঙ্কিম গ্রীবা, রক্তিম ঠোঁটে এক বিজয়িনীর স্মিত দম্ভ, শরীরের রং–এ সুরার জ্যোছনা, স্তনাগ্রে তীরমুখের তীক্ষ্ণতা আর চোখে সর্বনাশের ইঙ্গিত।

বন্ধুরা ছেঁকে ধরলো, কে এই নারী?

বান্ধবীরা ঘনঘন টেলিফোন করতে লাগল, শেষে কি স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করছে পীরজাদা?

পীরজাদা বাড়িতে একদিন বিরাট পার্টি দিয়ে লম্বা এক বাও করে বিনীত কণ্ঠে জানালো ইনিই আমার ধর্মমতে পরিণীতা স্ত্রী। সে রাতে তার স্বাস্থ্য পান করলো সকলে। বেগম পীরজাদার হাতে হাইবল কলিন্স যে নিখুঁত ভঙ্গিতে উত্তোলিত ছিল তা দেখে তাক লেগে গেল সবার। পুরুষেরা কয়েক জীগার পানীয় একসঙ্গে মাছের মতো পান করলেন। রমণীকুল নিঃশ্বাস এবং বিষ বাতাসে ছড়িয়ে রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই ঘরে ফেরবার জন্যে হাই তুললেন। গর্বে বুক ফুলে উঠলো পীরজাদার। ভাবলো কিশতি মাৎ করেছি।

পার্টি শেষে শোবার ঘরে এসে স্ত্রীকে এক সশব্দ চুম্বন করে সেই বিজয়ের উল্লাস জ্ঞাপন। করলো সে।

পরদিন থেকে বান্ধবীর সংখ্যা কমলো পীরজাদার, কিন্তু বন্ধুর সংখ্যা বাড়লো। অনেক দূরের বন্ধু নিকট হলো, নিকটের বন্ধু নিয়মিত অতিথি হয়ে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে পীরজাদার ফার্ম জমে উঠেছে। এখন আর অবসরের দিন নেই তার। কিন্তু অফিসে যেদিন পীরজাদাকে অধিক রাত অবধি কাজ করতে হতো, সেদিনও তার স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার জন্যে বন্ধুর অভাব হতো না।

সারাদিনের কাজ ক্লান্ত করে রাখতে পীরজাদাকে। কিন্তু নেশায় পেয়ে বসেছে তার স্ত্রীকে। হয়ত কোন রোববারে তাকে থাকতে হলো শহরে, তাতে কী? তার স্ত্রী বেরিয়ে পড়ল। ছুটিবার করতে ম্যানোরা দ্বীপে কী হল্স বে–তে। দীর্ঘদিন একরম চলবার পর, আতঙ্কিত হয়ে পীরজাদা লক্ষ্য করল তার হাতের তৈরি পুতুল প্রাণ পেয়েছে এবং তাকে থামানোর কৌশল তার জানা নেই। যে বিশেষ বন্ধুটি তার স্ত্রীর জন্যে সহানুভূতি এবং সঙ্গদানে উদার তাকেও সে কিছু বলতে পারল না।

একদিন রাতে পীরজাদা ঘরে ফিরে বন্ধুটিকে দেখতে পেল বসে আছে, তার পোশাক থেকে রনিয়ে রনিয়ে উঠছে তার স্ত্রীর প্রিয় সুবাস। বন্ধু অল্পক্ষণ পরেই চলে গেল। পীরজাদার চোখে পড়ল স্ত্রীর শুভ্রকণ্ঠে সদ্য চুম্বনের চিহ্ন। বেয়ারার কাছে শোনা গেল, ভদ্রলোক বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে মেমসাহেবের সঙ্গে গল্প করছিলেন।

সে রাতে কঠোর হওয়ার প্রথম ও শেষ চেষ্টা করেছিল পীরজাদা। তার ফল হলো এই, স্ত্রী খানিকক্ষণ কাঁদলো, বলল, আমাকে তবে মুক্তি দাও; বলল, আমাকে কেউ অবিশ্বাস করুক এ আমি চাইনে। পাঁচ দিন স্বামী স্ত্রীতে কথা বন্ধ হয়ে রইল। ষষ্ঠ দিনে পীরজাদা নতি স্বীকার করল। বলল, তুমি বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। সে রাতে আসলেই আমার মনটা ভালো ছিল না।

কিন্তু পীরজাদাও জানত, কোথায় যেন ভাঙ্গন ধরেছে, স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না, রক্তের মধ্যে কেবল আঁচ করা যাচ্ছে। তার অবস্থা তখন গভীর রাতে ঘুম ভাঙা এক বেড়ালের মতো যে একটা শত্রুর পদশব্দের জন্যে অপেক্ষা করছে।

গোড়ার দিকে বাবা পুত্রবধূর রূপান্তর দেখে শংকিত হয়ে চিঠি লিখেছিলেন। পীরজাদা সেদিন তার উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করেনি। চিঠিতে যখন সাবধান বাণীর আয়তন দিনে দিনে বাড়ছিল তখন সে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিল, এ বিয়ে আমার মতানুসারে হয়নি। পছন্দটা ছিল আপনার, কিন্তু ঘর করতে হচ্ছে আমাকে। অতএব আমার পছন্দের সমান তাকে হতে হবে। তাই হচ্ছে।

এখন, এই মুহূর্তে তার মনে পড়ল বাবার কথা। মনে হলো, তার কাছে সান্তনা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যাবার মতো মুখ নেই, মনোবলও নেই। একদিন তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিয়ে তিনি ইন্তেকাল করলেন। আজ তাকে বলবার আর কেউ রইলো না, কিন্তু আজকেই তার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল অমন একটা মানুষের। স্ত্রীর সামনে পিতার শোকে কাঁদার সাহসও পেল না লোকটা।

ওর একটা বহুদিনের পুরনো অভ্যেস ছিল, অফিস থেকে ফিরে এসে পোশাক বদলাতে বদলাতে হাফ পেগ হুইস্কি অনেকটা পানির সঙ্গে মিশিয়ে পান করা। একে বিলাসিতাও বলা যেতে পারে। প্রথমে লম্বা হয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকত চেয়ারে—-তখন কয়েক চুমুক। যে। পোশাক বদলাতে পাঁচ মিনিট লাগার কথা নয় সেইটে সে বিরতি দিয়ে দিয়ে পনের থেকে বিশ মিনিটে বিস্তৃত করতো তখন গ্লাস নিঃশেষ। সুরার আসল স্বাদ পীরজাদা এই বিশেষ সময়টিতে যতখানি পেত আর কোন সময় তার সিকিও পেয়েছে কিনা সন্দেহ।

এ ড্রিংক সে নিজে বানাতো, চিরকাল এটা ছিল উপভোগের আরেকটি অংগ। একদিন ঘরে ফিরে দেখল তার স্ত্রী বানাচ্ছে। দেখে অবাক হলো, খুশিও হলো। পাঁচদিন কথা না বলার সেই সময়টার স্মৃতি তখনো তাজা। তাই স্ত্রীর এই ব্যবহারে পীরজাদা অভূতপূর্ব এক অন্তরঙ্গতার স্বাদ পেল। এবং এটা যখন তার স্ত্রীর একটা নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়াল তখন তার হৃদয় থেকে সমস্ত মালিন্য সন্দেহ মুছে গিয়ে বইলো অনুরাগের নির্মল ঝর্ণা। সুখ বলতে পীরজাদার চোখের সমুখে তখন ভেসে উঠতো তার স্ত্রীর ছবি, যে হাসছে, যে এগিয়ে দিচ্ছে তাকে সারাদিনের ক্লান্তির পর বিকেলের পানীয়।

কিন্তু সুখের কপাল নিয়ে পীরজাদা পৃথিবীতে জন্মায়নি। জন্ম মুহূর্তে মা–র মৃত্যু থেকে তার শুরু। এমন কিছু লোক আছে যারা নিজের দুর্ভাগ্য নিজে বানায়, তাদের বানাতে হয়, স্বেচ্ছায় নয়, অনিচ্ছায়। পীরজাদা সেই দলের মানুষ।

সেদিন বিকেলে এসে স্ত্রীর হাত থেকে পানীয় নিয়ে চুমুক দিতেই মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল তার। স্ত্রী হেসে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? খাও।

পীরজাদা অপ্রস্তুত হয়ে আরেক চুমুক পান করে টাই খুলল। খুলতে খুলতে ভাবল, আজ কি এমন কিছু ঘটেছিল যার জন্যে তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, ফলে বিস্বাদ লাগছে এই পানীয়? না, তেমন কিছু তো হয়নি। বরং আজ একটা ভালো দিন বলা যেতে পারে। কাজে ছিল স্বাচ্ছন্দ্য, মনোযোগ; বাইরে বাতাস ছিল সুন্দর, পথে ছিল না তিলমাত্র ভিড়। তবে? পীরজাদা আবার গ্লাসটা হাতে নিল। এক চুমুকে বাকিটুকু নিঃশেষ করবার জন্যে হাঁ করল সে। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখতে পেল স্ত্রীর ঠোঁট কাঁপছে। চোখ এক পলকের জন্য বিস্ফারিত হল; আতঙ্কে বরফ হয়ে গেল মেয়েটা হাত থেকে গ্লাস নামালো পীরজাদা—-হয়ত চোখের ভুল, হয়ত গ্লাসের মধ্য দিয়ে দেখেছে বলে অমন মনে হয়েছে। ভালো করে দেখবার জন্যে হাত থেকে গ্লাস নামালো পীরজাদা।

সঙ্গে সঙ্গে আরেক বিস্ময়। তার স্ত্রী প্রায় দৌড়ে, অস্পষ্ট একটা কাতরোক্তি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে হাতের গ্লাস হাতে রইল পীরজাদার যেন চলমান ছবি স্থির হয়ে গেছে।

পাশের ঘরে এসে দেখে স্ত্রী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে । সমস্ত মুখ তার শাদা হয়ে গেছে, দরদর করে ঘাম পড়ছে। পীরজাদা তাকে বুকের মধ্যে নেবার চেষ্টা করল। সে এলো না। জিগ্যেস করল, কী হয়েছে ? উত্তর পাওয়া গেল না। পীরজাদার মনে হলো। হঠাৎ তার বড় মাথা ধরল। সে আবার জিগ্যেস করল, কী হয়েছে ? এবারে তার কণ্ঠস্বরে ছিল কিছুটা উত্তাপ। সচকিত হয়ে স্ত্রী তখন তাকে একবার দেখল। বলল, ও গ্লাস তুমি ফেলে দাও। খেও না।

কেন? কী আছে গ্লাসে?

কোনো জবাব পাওয়া গেল না। তখন সেও মরে গিয়ে গ্লাসটা আবার হাতে নিল। ভাবলো, তবে কি তার স্ত্রী চায় না সে সুরা পান করে? তা যদি হয়, তাহলে মেয়েটার চোখে আতঙ্ক কেন?

জগতে তেত্রিশ বছর বাস করছে পীরজাদা। আবার সে টাই বাধলো গলায়, জুতো পরল, জ্যাকেট চাপালো এবং গ্লাস থেকে সম্পূর্ণ পানীয় একটা শিশিতে ঢেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

রাত সাড়ে দশটায় অবসন্ন হৃদয় নিয়ে ফিরলো পীরজাদা। হুইস্কিতে বিষ মেশানো ছিল। তার বন্ধু এক ডাক্তার ছিল। ল্যাবরেটরীতে বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল। খবরটা পেয়ে পীরজাদার মনে হয়েছিল, এখন আবার সে সম্পূর্ণ গ্লাসটা পেলে পান করে ফেলতে পারত। যেন অনুতাপও হলো তখন তা করেনি বলে। তাকে হত্যা করতে চেয়েছে তার স্ত্রী এ সত্য না স্বপ্ন? কেন তাকে সে হত্যা করতে চাইবে? কেন? টলতে টলতে বাড়ি ফিরল সে।

ফিরে দেখল ঘর শূন্য, স্ত্রী নেই। এটাও যেন আশা করা গিয়েছিল। বিস্ময় তাকে আলোড়িত করতে পারল না। সে রাতে সারা রাত সুরা পান করল পীরজাদা।

দুদিন পরে সন্ধ্যার সংবাদপত্রে এক খবর ছাপা হলো যার সারমর্ম জনৈক ভদ্রমহিলা করাচি থেকে রাতের ট্রেনে পেশোয়ার যাচ্ছিলেন জনৈক পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে। পথিমধ্যে ভদ্রমহিলা দারুণ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ব্যাধির প্রকোপ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তার পুরুষ সঙ্গীটির কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। ভদ্রমহিলা এক স্টেশনের বারান্দায় প্রাণত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তার নাম বলেন বেগম পীরজাদা।

খবরটা বিদ্যুতের মতো স্পর্শ করলো পীরজাদার বন্ধুমহলকে। তারা টেলিফোন করল, দেখা করতে এলো, খুঁজে বেড়াল পীরজাদাকে। কিন্তু এত কাণ্ড যাকে নিয়ে তাকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। একমাস পর পীরজাদাকে আবার হঠাৎ দেখা গেল করাচিতে। তখন সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। এই একটা মাস সে কোথায় ছিল তা জানা গেল না। বন্ধুদের সে বর্জন করলো, বান্ধবীদের সতেরো হাত দূরে রাখল। বাসা তুলে দিলো। উঠে এলো হোটেল কোলামবাসে। প্রথমে তার মনে হয়েছিল বুঝি খুব কষ্ট হবে, কিন্তু কই তাতো হলো না। বরং যেন তার মনে লেগেছে অস্বাভাবিক এক মুক্তির রঙ। এ এমন এক মুক্তি যেন জীবন চলছিল এতক্ষণ সিনেমা হলে শাদা কালো ছোট পর্দার ছবির মাপে, হঠাৎ পর্দা প্রশস্ত হয়ে গেল—-শাদা কালোর বদলে রং দেখা দিল।

আসলে এটাই হচ্ছে পীরজাদার কষ্টের রূপ। একেকটা মানুষের কষ্টের ছবি একেক রকম। এ লোকটা নিজে সচেতন নয় তার কষ্ট এসেছে এই ভাবে। ওটাতো মুক্তি নয়, ও হচ্ছে মৃত্যু। হোটেল কোলামবাসের তেতলায় সর্বদক্ষিণের ঘরে আজ আড়াই বছর ধরে যে মানুষটা থাকে, তাকে দেখে এখন আর এসব কল্পনাও করা যাবে না। এখন, আগেই বলা হয়েছে, সে যদ্দিন না মাটির তলায় যাচ্ছে তদ্দিন নিজেকে মাটির ওপর বাঁচিয়ে রেখে চলেছে।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *