অতিশয়োক্তি হবে না, যদি বলি সময়টা ছিল
মাতাল, অন্তত আমার জন্য। সদর স্ট্রিটের
ল্যাম্পপোস্টে বসে-থাকা পাখি, পথের ধারে
ধুলোর ঘর-বানানো বালকের ঠোঁটের ভঙ্গি, মাটি
আর মামুলি তারের তৈরি ছোট্র বেহালায়
ফিল্মি গানের সুর-বাজানো পথিক শিল্পীর হাঁটার ছন্দ
আমাকে মুগ্ধ করতে খুবই। চা-খানায় ইয়ার-বন্ধুদের
আড্ডায় রোজানা শরিক হওয়া, নানা স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো,
দূরের আসমানে মেঘে মেঘে সাঁতার কাটা
ছিল আমার নিত্যকার কাজ। আধুনিক কবিতায় নিয়ত
বুঁদ হয়ে থাকতে পেরেছি বলেই
পেয়েছি স্বর্গসুখ এবং প্রায়শ বেদনাবোধ দখল করেছে
আমাকে। সেই উদ্দামকালে যৌবনের দুপুরে
একজন তরুণী আমার দু’চোখে, হৃদয়ে ছড়িয়েছিল সাতরঙা স্বপ্নাভা।
প্রণয়-নিকুঞ্জে মিলিত হয়েও তরুণী সৃষ্টি করল উপেক্ষার মুদ্রা,
আমার অনাবিল স্বপ্ন ভেঙে-পড়া কাচের পাত্রের মতো
আর্তনাদ করে উঠলো। আজ এতকাল পরে হঠাৎ
কখনও মনে হয়, আমার জীবনের অতি সংক্ষিপ্ত সেই অধ্যায়
কত বছর আগেকার সমুদ্রতলে নিমজ্জিত নৌযানের মতোই
অতিশয় ক্ষয়া, বাতিল। হয়তো কালেভদ্রে
ভাবনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে উঠবে আর নিজের
প্রাচীন আহাম্মকির কথা মনে করে হাসিতে ফেটে পড়বে হৃদয়।
তারপর জীবনের নানা বাঁকে কত না মোহিনী-মুখ চকিতে
চন্দ্রিমা হয়ে মিশেছে অমাবস্যায়; শুধু গৌরীর
নিরুপম সত্তার আভা আজও বসন্তবাহার হয়ে প্রহরে
প্রহরে সুর বিস্তার করে। সত্যি-সত্যি জীবন
দেখিয়েছে কত না খেল, নেচেছি বানর কিংবা
ভালুকের মতো পাকা খিলাড়ির হাতে। মাঝে মাঝে
হঠাৎ বেঁকে বসেছি বটে। ফলত কিছু ব্যর্থতা কিছু সাফল্য
হেঁটে গেছে পরস্পর হাত ধরাধরি করে। এখন
আমার জীবন ঝুঁকেছে অস্তাচলে না, কোনো
হাহাকারকেই দেব না আমল, মাথা রাখব উঁচু সারাক্ষণ।
হিসেব নিকেশে দড় নই কোনওকালেই। কী খরায়,
কী স্নিগ্ধ বর্ষণে রয়েছি অবিচল জীবনের এই গোধূলি-লগ্নে
গৃহিণীর দিকে তাকিয়ে লক্ষ করি, একদা রূপকোমল মুখ
এখন কেমন এবড়ো-খেবড়ো জমির মতো। হঠাৎ কখনো
ইচ্ছে হয় হাত বুলিয়ে মসৃণ করে দিই। ঝড়-ঝাপটা তো
কম হয়নি ওর ওপর। ভাবি, যদি এই মুখ কোনো ইন্দ্রাজালে
সেই কবেকার বিকেল-ছোঁয়া বারান্দায় অথবা
বাসর-রাতের প্রস্ফুটিত চেহারায় রূপান্তরিত করতে পারতাম।
আজো কোনও কোনও রাতে আলো আঁধারিতে ওর গালে,
ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিই ব্যর্থ শিল্পীর ধরনে।
ঘুমে ভাসমান শরীরী যুগ্মতায় তুষার ঝরে, পাতাহারা
রুক্ষ গাছে কোকিল ডেকে উঠতে চেয়েও মূক হয়ে থাকে।