Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কেদার রাজা || Bibhutibhushan Bandyopadhyay

কেদার রাজা || Bibhutibhushan Bandyopadhyay

দুপুর বেলায় নীলমণি চাটুজ্জে বাড়ি ফেরবার পথে গ্রামের মুদির দোকানে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ গো ছিবাস, কেদার রাজাকে দেখেছিলে আজ সারাদিন?

ছিবাস আলকাতরার পিপে থেকে আলকাতরা বার করতে করতে জিজ্ঞেস করলে, কেন চাটুজ্জে মশায়, তেনার খবরে কি দরকার?

নীলমণি বললেন, আরে, খাজনার অংশ নিয়ে গোলমাল বেধেছে বড্ড৷ বাঁটুল নাপিতের দরুন আমার অংশে আমি চার আনা করে বছরশাল খাজনা পাই, তা গাঁয়ের শুদ্দুর ভদ্দর কে না জানে? এ বছরের খাজনা কেদার রাজা দিব্যি আদায় করে নিয়ে বসে আছে৷ দ্যাখো তো কি উৎপাত৷

ছিবাস মুদির মন তখন ছিল আলকাতরার পিপের মুখের ফাঁদলের দিকে৷ সে আপনমনে কি বললে, ভাল বোঝা গেল না৷ নীলমণি ছিবাসের সহানুভূতি না পেয়ে বোকার মত মুখখানা করে বাঁড়ুজ্জে পাড়ার দিকে অগ্রসর হলেন—উদ্দেশ্য, বৃদ্ধ বিশ্বেশ্বর বাঁড়ুজ্জের বাড়ির সান্ধ্য পাশার আড্ডায় গিয়ে একবার খোঁজ নেওয়া৷

পথেই একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে দেখা৷

নীলমণি চাটুজ্জে বললেন, আরে এই যে কেদার খুড়ো, তোমাকেই খুঁজছি৷

লোকটি বললে, কেন বলো তো হে?

নীলমণি যতটা জোরের সঙ্গে ছিবাসের দোকানে কথা বলেছিলেন, এখানে কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে অত জোরের সুর বের হল না৷

—সেই বাঁটুল নাপিতের ভিটের খাজনা বাবদ কয়েক আনা পয়সা—

—সে পয়সা তুমি কোত্থেকে পাবে খুড়ো?

নীলমণি ভ্রু কুঁচকে বললেন, নেই বললে সাপের বিষ থাকে না তো জানি কোন ছার! তবে সেটেলমেন্টের কাগজপত্রে তাই বলে বটে৷

—ভুল বলে নীলমণি খুড়ো!

—সেটেলমেন্টের পড়চা ভুল বলে?

নীলমণির বড় ছেলে হাজুকে এই সময় সাইকেলে চড়ে সতেজে যেতে দেখা গেল৷

নীলমণি হেঁকে বললেন, ও অজিত—ও অজিত—

ছেলেটি সাইকেল থেকে নেমে বললে, বাবা, তুমি এখানে?

—দরকার আছে, তুই একবার তোর দাদুর সঙ্গে যা দিকি ওর বাড়ি৷ খুড়ো, আমাদের অংশের খাজনা ক’আনা পয়সা অজিতের সঙ্গে দিয়ে দাও গিয়ে—

—কোথা থেকে দেবো এখন? আজ পাঠিও না, যদি কাগজ-পত্র দেখে মনে হয় তোমার জমি ওর মধ্যে আছে—

নীলমণি বাধা দিয়ে বললেন, আলবাত আছে, হাজার বার আছে, ওর বাবা আছে—

লোকটা বললে, চটো কেন নীলু খুড়ো, থাকে পাবে৷ তবে এখন হাতে টানাটানি—

—টানাটানি তা আমার কি? আমার তো না হলে চলে না৷ ওসব শুনলে আমার কাছারির খাজনা মাপ করবে কি জমিদার?

গ্রামের পথ৷ চেঁচামেচি শুনে দু-চারজন লোক জড়ো হয়ে পড়ল৷

—কি, কি, খুড়ো কি?

—এই দ্যাখো না ক্যাদার খুড়োর কাণ্ডটা—নিজের অংশ আমার অংশ গিলে খেয়ে বসে আছে, এখন উপুড়হাত করবার নামটি নেই৷

লোকে কিন্তু এ ঝগড়ায় উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিলে না, দু-একবার ঘাড় নেড়ে সরে পড়ল অনেকে৷ যারা দাঁড়িয়ে রইল, তারাও নীলমণি চাটুজ্জের পক্ষে কথা না বলে বরং এমন সব মতামত প্রকাশ করলে, যা কি না তাঁর বিরুদ্ধেই যায়৷

নীলমণি অগত্যা অন্য দিকে চলে গেলেন৷ দু-একজন লোকে বললে, পথের মধ্যে এ রকম চেঁচামেচি কি ভালো? ছিঃ—সামান্য কয়েক আনা পয়সার জন্যে—আর ওঁর সঙ্গে? কেউ সহানুভূতির সঙ্গে বলেন, ক্যাদার জ্যাঠা আপনি বাড়ি যান চলে—

তিনিও চলে গেলেন৷

নবাগত দু-একজন লোক জিজ্ঞেস করলে জনতাকে—কি হয়েছে, কি?

—ওই নীলু খুড়ো ক্যাদার রাজাকে পথের মধ্যে ধরেছে, আমার খাজনা শোধ করো ভারি তো খাজনা, ক’অনা পয়সা—হুঁঃ—

—ক্যাদার রাজা কি বললে?

—বলবে আর কি, সবাই জানে ওর অবস্থা কি৷ দিতে পারে যে দেবে এখুনি? পয়সা ট্যাঁকে করে এনেছে নাকি?

—কেদার রাজা এসব গোলমালের ভেতর থাকতে চান না, কখনও পছন্দ করেন না৷ নির্বিবাদী লোক৷ নীলু খুড়োর যা লোভ!

জনতা ক্রমে ভেঙে গেল৷

যাঁর নাম কেদার রাজা, তিনি নিজের বাড়ি ঢুকলেন যখন, তখন বেলা প্রায় একটা৷ কেদারের স্ত্রী লক্ষ্মীমণি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী, ইদানীং তাঁর সে চোখ-ধাঁধানো রূপের সামান্য কিছু অবশেষ যা ছিল তাতেও অপরিচিত চোখ তাঁর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত৷ তাঁর মৃত্যু হয়েছে আজ এই বছর দুই৷

বাড়িতে আছে শুধু মেয়ে শরৎসুন্দরী৷ মেয়ে মায়ের অতটা রূপ পায় নি বটে, তবুও এ গ্রামের মধ্যে তার মতো সুন্দরী মেয়ে আর নেই৷

—এত বেলা অবধি কোথা ছিলে?…তোমায় নিয়ে আর পারিনে—তেল মাখো, নেয়ে এসো৷ কেদার রাজা একটু অপ্রতিভ মুখে ঘরে ঢুকলেন৷ মেয়ে ভাত রেঁধে বসে আছে, তিনি আগে খেয়ে না নিলে সে-ও খেতে পারে না—হয়তো তার কষ্টই হচ্ছে৷ মুখ ফুটে তো কিছু বলতে পারে না৷ না, বড় অন্যায় হয়ে গিয়েছে৷

শরৎ বাবাকে তেল দিয়ে গেল৷ বললে, এত বেলায় আর নদীতে যেয়ো না৷ জল তুলে দিচ্ছি, বাড়িতেই নাও৷

এই কষ্টের ওপর আবার শরৎকে জল তুলতে হবে কুয়ো থেকে? কেদার প্রতিবাদ করে বললেন, না, আমি নদীতেই যাই৷ ডুব দিয়ে না নাইলে কি আর নাওয়া হল; চললাম, দে গামছাখানা—

শরৎ পাথরের খোরায় বাবার ভাত বাড়তে গেল৷ কাঁসার জিনিসপত্র ছিল বড় সিন্দুক বোঝাই—সব গিয়েছে একে একে—অভাবের তাড়নায় বিক্রি হয়ে, নয়তো বাঁধা দিয়ে৷ আর উদ্ধার করা যায় নি৷

শরৎ বাবার খাবার জায়গা করে অপেক্ষা করতে লাগল৷ কেউ নেই কেদার রাজার সংসারে—এই বিধবা মেয়ে শরৎ ছাড়া৷ মানে, এখন এই গ্রামের বাড়িতে নেই৷ কেদার রাজার একমাত্র পুত্র বহুদিন যাবৎ নিরুদ্দেশ৷ কোনো সন্ধানই তার পাওয়া যায় নি গত দশ বৎসরের মধ্যে৷

কেদার স্নান সেরে এসে খেতে বসলেন৷ পাথরের খোরায় বুকড়ি কালো আউশ চালের ভাত ও ডাঁটাচচ্চড়ি৷ খোরার পাশে একটা ছোট কাঁসার বাটিতে কাঁচা কলাইয়ের ডাল৷ কেদার নাক সিঁটকে বললেন, কি ছাই-রাই-ই রাঁধিস রোজ, তোর রান্না নিত্যি খাওয়া এক ঝকমারি৷

শরৎ চুপ করে রইল৷

নীরবে কয়েক গ্রাস উদরস্থ করে ক্ষুধার প্রথম দিকের জ্বালার খানিকটা মিটিয়ে কেদার মেয়ের দিকে তিরস্কারসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, আহা, কি ডাল রাঁধবার ছববা! আর এই একঘেয়ে ডাঁটাচচ্চড়ি, এ রোজ রোজ তুই পাস কোথায় বাপু!

—আমার কি দোষ আমি কি বাজারে যাই নাকি? যা পাই হাতের কাছে তাই রাঁধি৷ কে এনে দিচ্ছে বল না—

কেদার মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, তার মানে?

তার মানে কি শরৎ বাবাকে-ভালো ভাবেই বুঝিয়ে বলতে পারত, ঝগড়ায় সে-ও কম যায় না—কিন্তু বাবার মেজাজ সে উত্তমরূপে জানে, এখুনি রাগ করে ভাতের থালা ফেলে উঠে যাবেন এখন৷ সুতরাং চুপ করেই গেল সে৷

কেদার পাতের চারিদিকে ডাল-মাখা ভাত ফেলে ছড়িয়ে ছেলেমানুষের মতো অগোছালো ভাবে আহার সম্পন্ন করে অপ্রসন্ন মুখে উঠে যাবার উদ্যোগ করতে শরৎ বললে—বসো বাবা, উঠো না, কিছু তো খেলে না, একটু তেঁতুল দিয়ে খেয়ে নাও—

কেদার রেগে বললেন, তোর মুণ্ডু দিয়ে খাব অকর্মার ঢেঁকি কোথাকার—অমন ছাই না রাঁধলেই না—

শরৎও প্রত্যুত্তরে বললে, তাই খাও, আমার মুণ্ডু খাও না—আমার হাড় জুড়ুক, আর সহ্যি হয় না—

মাঝে মাঝে পিতাপুত্রীতে এমন দ্বন্দ্ব বাধা এদের সংসারে সাধারণ ব্যাপারের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছে৷ কেদার খারাপ জিনিস খেতে পারেন না, অথচ এদিকে সংসারের সচ্ছলতার যে রূপ, তাতে আউশ চালের ভাত জোটানোই দুষ্কর৷ এক পোয়া সর্ষের তেল কলুবাড়ি থেকে আসে, মাথায় মাখা সমেত সেই তেলে তিন দিন চালাতে হয়—সুতরাং তরকারিতে জল-আছড়া দিয়ে রান্না ছাড়া অন্য উপায় নেই৷ তরকারি মুখরোচক হয় কোথা থেকে?

অথচ শরৎ বাবাকে সে কথা বলতে পারে না৷ বড়ই রূঢ় শোনায় সেটা৷ বাবার অর্থ উপার্জনের অক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয় তাতে৷ এক যদি তিনি বুঝতেন, তবে সব মিটেই যেত৷ কিন্তু বাবা ছেলেমানুষের মতো অবুঝ, তিনি দেখেও কিছু দেখেন না, বুঝেও বোঝেন না—প্রৌঢ় পিতার এই বালস্বভাবের প্রতি স্নেহ ও করুণাবশতঃই শরৎ কিছু বলতে পারে না তাঁকে৷

তার পর সে বাবার পাতেই খেতে বসে গেল৷

দিবানিদ্রায় কেদার রাজার অভ্যাস নেই, দুপুরে খাওয়ার পর তিনি আটদশগাছা ছিপ নানা আকারের, পুঁটি মাছ থেকে রুই কাৎলা ধরা পর্যন্ত, সুতো—বঁড়শি বাঁধা, মাছধরা ভাঁড়, চারকাঠি, মশলা প্রভৃতি মাছ ধরবার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ নিষ্কর্মার কর্ম৷

ওপাড়ার গণেশ মুচি একাজে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু৷ গণেশ এসে বললে, বাবাঠাকুর, তৈরি?

—সব ঠিক আছে, কোথায় যাবি, গড়ের পুকুরে না নদীতে?

—চারকাঠি বেঁধেছ কোথায়?

কেদার রাজা চোখে-মুখে স্বীয় কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার আত্মপ্রসাদসূচক একখানি হাস্য বিস্তার করে বললেন, ওরে বেটা, আজ ত্রিশ বছর বর্শেলগিরি করছি এটুকু আর বুঝিনে? ঘোলার শেষের গাঙ, সেখানে চারকাঠি না বেঁধে বাঁধব কিনা পুকুরে?…হ্যা-হ্যা হ্যা—

গণেশ কেদার রাজার ছিপ ও সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে চলল নিজের ছিপগুলোর সঙ্গে৷

গড়ের পুকুরের ধারে বেতস ও কণ্টকগুল্মের দুর্ভেদ্য জঙ্গল৷ গত বর্ষার জলে সে জঙ্গল বেড়ে মধ্যেকার অন্ধকার সুঁড়িপথটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে—তার মধ্যে দিয়ে দুজনে সন্তর্পণে চলল, পায়ের পাতায় কাঁটা না মাড়িয়ে ফেলে৷

পাড়ের ওপারে যেখানে জঙ্গলটা একটু পাতলা হয়ে এসেচে, সেখানে পৌঁছে গণেশ বললে, আমার কিন্তু বাবাঠাকুর জোড়া দেউলির নীচে চারকাঠি পোঁতা, দেখে যাব না একবারটি?

কেদার বললেন, উঃ ব্যাটা বড় চালাক তো! ওখানে পুঁতেছিস তা আমাকে বলিস নি মোটেই? চল দেখি—

গড়ের দিঘির বাঁ পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে থেকে সেকালের ভাঙা প্রকাণ্ড দেউলের চূড়া যেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, তারই নীচে দিঘির জলে গণেশ গিয়ে নামল৷

দিঘিটা এত বড় যে এপার থেকে ওপারের গাছপালা যেন মনে হয় ছোট৷ অনেকগুলো দেউল এখানে আছে গড়ের দিঘির গভীর জঙ্গলের মধ্যে—কোনো কোনো মন্দিরের গায়ে কালো স্লেট পাথরের ওপর মন্দির-নির্মাতার নাম ও সন তারিখ লেখা৷ একটার ওপর সন লেখা আছে ১০২৪৷ এ থেকে দেউলগুলির প্রাচীনত্ব অনুমান করা কঠিন হবে না৷

গণেশ বললে, ভালো মাছ লেগেছে বাবাঠাকুর, এখানেই বসবা এসো—

—আরে না না, চল গাঙে—এখানে আবার মাছ—

—আপনি নেমে দ্যাখোই না—আমি কি মস্করা করছি তোমার সঙ্গে?

দুজনে পুকুরের ধারেই মাছ ধরতে বসে গেল৷ কেদার রাজা যা হুকুম করেন, গণেশ মুচি তখনই তা তামিল করে, যদিও কার্যত সে কেদার রাজার ইয়ার৷

—তামাক সাজ গণশা, আর পাতা ভেঙে নিয়ে বসবার জায়গা করে দে দিকি!

গণেশ পাড়ের ওপরকার জঙ্গল থেকে বন-ডুমুরের বড় বড় কচি পাতা ভেঙে এনে বিছিয়ে দিলে৷ গণেশ নিজে কিন্তু সেখানে বসল না—বললে, আমি এই বাঁধাঘাটের সানে গিয়ে বসি বাবাঠাকুর—

একটু দূরে প্রাচীন দিনের প্রকাণ্ড বাঁধাঘাট যেখানে ছিল, এখন সেখানে পুকুরপাড়ে সোপানশ্রেণীর চিহ্ন দেখা যায় মাত্র৷ ঘট ব্যবহার করা চলে না, তবে ভাঙা চাতালে বসে মাছ ধরা চলতে পারে এই পর্যন্ত৷

দিঘির চারধারে বড় বড় বট, শিমুল, ছাতিম গাছের বহুকালের বন৷ ঘাটের ওপরকার বৃদ্ধ বট গাছটা দিঘির ঘাটের বাঁধা সোপানশ্রেণীর ফাটলে শিকড় চালিয়ে যদি তার কয়েকটা ধাপকে না ধরে রাখত, তবে প্রাচীন দিনের ঘাটের একখানা ইটও আজ খুঁজে পাওয়া যেত কি না সন্দেহ৷ এর প্রধান কারণ এই সব ধ্বংসস্তূপের পোড়ো ইট দিয়ে এ গ্রামের বহু গৃহস্থের বাড়ি তৈরি হয়ে আসছে আজ একশো বছর ধরে৷

ঘণ্টা-দুই পরে নিবিড় ছায়া নামল দিঘিটার চার পাশ ঘিরে৷ চারধারেই বন, বেলা তিনটে বাজতে না বাজতে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে এ বিচিত্র কথা কিছু নয়৷ কেদার হেঁকে বললেন, ওরে গণশা শীত শীত করছে, একটু ভালো করে তামাক সাজ, ইদিকে আয় তো—

গণেশের ছিপের ফাৎনা বড় মাছে দু-দুবার নিতলি করে নিয়ে গেছে সবেমাত্র, তার এখন ছিপ ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও কেদারের আদেশ সে অমান্য করতে পারল না৷ বিরক্ত মুখে উঠে এসে বললে—কিছু হচ্ছে-টচ্ছে বাবাঠাকুর?

—তোর কি হল?

—অই অমনি—তেমন কিছু নয়৷

বড় মাছের ঘাই মারার কথা গণেশ বললে না, কোনো বর্শেলই বলে না, যদি বাবাঠাকুর এখান থেকে উঠে গিয়ে ওখানে বসে!

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে কেদারের ছিপে দৈবক্রমে একটা বড় রুই মাছ টোপ গিলে ফাৎনা ডুবিয়ে একেবারে নিতলি হয়ে গেল৷ বহু ধস্তাধস্তি করে সুতো লম্বা করে ছেড়ে মাছটাকে অনেক খেলিয়ে কেদার সেটা ডাঙায় তুললেন৷

গণেশ ছুটে এসেছিল তাঁকে সাহায্য করতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণেশের সাহায্য তাঁর দরকার হল না৷ কেদার হাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাছটার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করে, তিনি বললেন— তোল রে গণশা, ক’সের বলে মনে হয় দ্যাখ তো?

গণেশ কানকো ধরে মাছটাকে তুলে বার-দুই ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, তা তিনসের চোদ্দপোয়া হবে বাবাঠাকুর, আপনাদের বরাত—আমার ছিপে ঘাই মেরেই পুকুরের মাছ নিউদ্দিশ হয়ে গেল—

নিরুদ্দেশ হওয়ার তুলনাটি কেদারের ভালো লাগল না, হঠাৎ মনে পড়ে গেল তাঁর পুত্রের কথা৷ আজ দশ বৎসর…হাঁ, প্রায় দশ বৎসর যাবৎ সে-ও নিরুদ্দেশ৷…কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না, কে বলবে? সচ্ছল অবস্থার লোক যারা, তারা এ অবস্থায় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, কত খোঁজখবর করে৷ দরিদ্র কেদারের সে সব করবার সঙ্গতি কই? —নীরবে ও নিশ্চেষ্ট ভাবে সব সয়ে থাকতে হয়েছে৷

কি করবেন উপায় নেই৷

কেদার নিজের অলক্ষিতে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, নিয়ে চল রে গণেশ, পৌঁছে দে মাছটা বাড়িতে৷ একেবারে কেটে দিয়ে তুইও কিছু নিয়ে যা—চল৷

সন্ধ্যার অন্ধকার গড়ের পুকুরের বনে দিব্যি ঘনিয়েছে—হেমন্তের প্রথম, ছাতিম ফুলের উগ্র গন্ধে ভরা অন্ধকার বনপথ বেয়ে দুজনে বাড়ির দিকে ফিরলে৷

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
Pages ( 1 of 15 ): 1 23 ... 15পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress