কুট্টিমামার হাতের কাজ – Tenida Samagra
চিড়িয়াখানার কালো ভালুকটার নাকের একদিক থেকে খানিকটা রোঁয়া উঠে গেছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে আমাদের পটলডাঙার টেনিদা বললে, বল তো প্যালা–ভালুকটার নাকের ও-দশা কী করে হল?
আমি বললাম, বোধহয় নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে, তাই—
টেনিদা বললে, তোর মুণ্ডু!
–তা হলে বোধহয় চিড়িয়াখানার লোকেরা নাপিত ডেকে কামিয়ে দিয়েছে। মানুষ যদি গোঁফ কামায়, তাহলে ভালুকের আর দোষ কী?
–থাম থাম–বাজে ফ্যাক-ফ্যাক করিসনি। টেনিদা চটে গিয়ে বললে : যদি এখন এখানে কুট্টিমামা থাকত, তাহলে বুঝতিস সব জিনিস নিয়েই ইয়ার্কি চলে না।
–কে কুট্টিমামা?
–কে কুট্টিমামা?
–টেনিদা চোখ দুটোকে পাটনাই পেঁয়াজের মতো বড় বড় করে বললে : তুই গজগোবিন্দ হালদারের নাম শুনিসনি?
–কখনও না–আমি জোরে মাথা নাড়লাম : কোনওদিনই না! গজগোবিন্দ। অমন বিচ্ছিরি নাম শুনতে বয়ে গেছে আমার।
–বটে! খুব তত তড়পাচ্ছিস দেখছি। জানিস আমার কুট্টিমামা আস্ত একটা পাঁঠা খায়! তিন সের রসগোল্লা ঠুকে দেয় তিন মিনিটে?
–তাতে আমার কী? আমি তো তোমার কুট্টিমামাকে কোনওদিন নেমন্তন্ন করতে যাচ্ছি। প্রাণ গেলেও না।
–তা করবি কেন? অমন একটা জাঁদরেল লোকের পায়ের ধুলো পড়বে তোর বাড়িতে–অমন কপাল করেছিস নাকি তুই? পালাজ্বরে ভুগিস আর শিঙিমাছের ঝোল খাস–কুট্টিমামার মর্ম তুই কী বুঝবি র্যা? জানিস, কুট্টিমামার জন্যেই ভালুকার ওই অবস্থা।
এবারে চিন্তিত হলাম।
–তা তোমার কুট্টিমামার এসব বদ-খেয়াল হল কেন? কেন ভালুকের নাক কামিয়ে দিতে গেল খামকা তার চাইতে নিজের মুখ কামালেই তো ঢের বেশি কাজ দিত।
–চুপ কর প্যালা, আর বাজে বকালে রদ্দা খাবি–টেনিদা সিংহনাদ করল। আর তাই শুনে ভালুকটা বিচ্ছিরি রকম মুখ করে আমাদের ভেংচে দিলে।
টেনিদা বললে, দেখলি তো? কুট্টিমামার নিন্দে শুনে ভালুকটা পর্যন্ত কেমন চটে গেল।
এবার আমার কৌতূহল ঘন হতে লাগল।
–তা ভালুকটার সঙ্গে তোমার কুট্টিমামার আলাপ হল কী করে?
–আরে সেইটেই তো গল্প। দারুণ ইন্টারেস্টিং! হুঁ হুঁ বাবা, এ-সব গল্প এমনি শোনা যায় কিছু রেস্ত খরচ করতে হয়। গল্প শুনতে চাস–আইসক্রিম খাওয়া।
অগত্যা কিনতেই হল আইসক্রিম।
চিড়িয়াখানার যেদিকটায় অ্যাটলাসের মূর্তিটা রয়েছে, সেদিকে বেশ একটা ফাঁকা জায়গা দেখে আমরা এসে বসলাম। তারপর সারসগুলোর দিকে তাকিয়ে আইসক্রিম খেতে-খেতে শুরু করলাম টেনিদা :
আমার মামার নাম গজগোবিন্দ হালদার। শুনেই তো বুঝতে পারছিস ক্যায়সা লোক একখানা। খুব তাগড়া জোয়ান ভেবেছিস বুঝি? ইয়া ইয়া ছাতি–অ্যায়সা হাতের গুলি? উঁহু, মোটেই নয়। মামা একেবারে প্যাঁকাটির মতো রোগা–দেখলে মনে হয় হাওয়ায় উল্টে পড়ে যাবে। তার ওপর প্রায় ছ’হাত লম্বা মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল দূর থেকে ভুল হয় বুঝি একটা তালগাছ হেঁটে আসছে। আর রং! তিন পোঁচ আলকাতরা মাখলেও অমন খোলতাই হয় না। আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে করবি-ডজনখানেক নেংটি ইঁদুর ফাঁদে পড়ে চি-চি করছে সেখানে।
সেবার কুট্টিমামা শিলিগুড়ি স্টেশনের রেলওয়ে রেস্তোরাঁয় বসে বসে দশ প্লেট ফাউল কারি আর সের-তিনেক চালের ভাত খেয়েছে, এমন সময় গোঁ-গোঁ করে একটা গোঙানি। তার পরেই চেয়ার-ফেয়ার উল্টে একটা মেমসাহেব ধপাৎ করে পড়ে গেল কাটা কুমডোর মতো।
হইহই–রইরই। হয়েছে কী জানিস? চা বাগানের এক দঙ্গল সাহেব-মেম রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছিল তখন। মামার খাওয়ার বহর দেখে তাদের চোখ তো উল্টে গেছে আগেই, তারপর আর দশ প্লেট খাওয়ার পরে মামা যখন আর দুপ্লেটের অর্ডার দিয়েছে, তখন আর সইতে পারেনি।
–ও গড। হেল্প মি, হেল্প মি।বলে তো একটা মেম ঠায়-অজ্ঞান। আর তোকে তো আগেই বলেছি মামার চেহারাখানা–কী বলে–তেমন ইয়ে নয়।
মামার চক্ষুস্থির।
দলে গোটা-চারেক সাহেবকাশীর ষাঁড়ের মতো তারা ঘাড়ে-গদানে ঠাসা। কুট্টিমামা ভাবলে, ওরা সবাই মিলে পিটিয়ে বুঝি পাটকেল বানিয়ে দেবে। মামা জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে পৈতে খুঁজতে লাগল–দুর্গানাম জপ করবে। কিন্তু সে পৈতে কি আর আছে, পিঠ চুলকোতে চুলকোতে কবে তার বারোটা বেজে গেছে।
ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে দুটো সায়েব তখন এগিয়ে আসছে তার দিকে। প্রাণপণে সেঁতো হাসি হেসে মামা বললেন, ইট ইজ নট মাই দোষ স্যর–আই একটু বেশি ইট স্যর।
কুট্টিমামার বিদ্যে ক্লাস ফাঁইভ পর্যন্ত কিনা, তাও তিনবার ফেল। তাই ইংরেজী আর এগুলো না।
তাই শুনে সায়েবগুলো ঘোঁ—ঘোঁ—ঘুঁক–ঘুঁক–হোয়া-হোয়া করে হাসল। আর মেমেরা খি—খি—পিঁ–পিঁ—চিঁ–হিঁ করে হেসে উঠল। ব্যাপার দেখেশুনে তাজ্জব লেগে গেল কুট্টিমামারঅনেকক্ষণ হোয়া-হোয়া করবার পরে একটা সাহেব এসে কুট্টিমামার হাত ধরল। কুট্টিমামা তো ভয়ে কাঠ–এই বুঝি হ্যাঁচকা মেরে চিত করে ফেলে দিলে। কিন্তু মোটেই তা নয়, সাহেব কুট্টিমামার হ্যাঁন্ড শেক করে বললেন, মিস্টার বাঙালী, কী নাম তোমার?
কুট্টিমামার ধড়ে সাহস ফিরে এল। যা থাকে কপালে ভেবে বলে ফেলল নামটা।
–গাঁজা-গাবিন্ডে হাল্ডার? বাঃ, খাসা নাম। মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে, তুমি চাকরি করবে?
চাকরি! এ যে মেঘ না-চাইতে জল। কুষ্টিমামা তখন টো-টো কোম্পানির ম্যানেজার বাপের, অর্থাৎ কিনা আমাদের দাদুর বিনা-পয়সার হোটেলে রেগুলার খাওয়া-দাওয়া চলেছে। কুট্টিমামা খানিকক্ষণ হাঁ করে রইল।
সায়েবটা তাই দেখে হঠাৎ পকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে কুট্টিমামার হাঁ করা মুখের মধ্যে গুঁজে দিলে। মামা তো কেশে বিষম খেয়ে অস্থির। তাই দেখে আবার শুরু হল ঘোঁ-ঘোঁ–হোঁয়া-হোঁয়া-পিঁ-পিঁ–চি চি–হি-হি। এবারেও মেম পড়ে গেল চেয়ার থেকে।
হাসি-টাসি থামলে সেই সায়েবটা আবার বললেন, হ্যালো মিস্টার বাঙালী, আমরা আফ্রিকায় গেছি, নিউগিনিতে গেছি, পাপুয়াতেও গেছি। গরিলা, ওরাং, শিম্পাঞ্জি সবই দেখেছি। কিন্তু তোমার মতো একটি চিজ কোথাও চোখে পড়েনি। তুমি আমাদের চাবাগানে চাকরি নাও–তা হলে এক্ষুনি তোমায় দেড়শো টাকা মাইনে দেব। খাটনি আর কিছু নয়, শুধু বাগানের কুলিদের একটু দেখবে আর আমাদের মাঝেমাঝে খাওয়া দেখাবে।
এমন চাকরি পেলে কে ছাড়ে? কুট্টিমামা তক্ষুনি এক পায়ে খাড়া। সায়েবরা মামাকে যেখানে নিয়ে গেল, তার নাম জঙ্গলঝোরা টি এস্টেট। মংপু নাম শুনেছিস–মংপু? আরে, সেই যেখানে কুইনিন তৈরি হয় আর রবীন্দ্রনাথ যেখানে গিয়ে কবিতা-টবিতা লিখতেন। জঙ্গলঝোরা টি এস্টেট তারই কাছাকাছি।
মামা তো দিব্যি আছে সেখানে। অসুবিধের মধ্যে মেশবার মতো লোকজন একেবারে নেই, তা ছাড়া চারিদিকেই ঘন পাইনের জঙ্গল। নানারকম জানোয়ার আছে সেখানে। বিশেষ করে ভাল্লুকের আস্তানা।
তা, মামার দিন ভালোই কাটছিল। সস্তা মাখন, দিব্যি দুধ, অঢেল মুরগি। তা ছাড়া সায়েরা মাঝে-মাঝে হরিণ শিকার করে আনত, সেদিন মামার ডাক পড়ত খাওয়ার টেবিলে। একাই হয়তো একটা শম্বরের তিন সের মাংস সাবাড় করে দিত, তাই দেখে টেবিল চাপড়ে উৎসাহ দিত সায়েবরা–হোঁয়া হোঁয়া–হিঁ–হিঁ করে হাসত।
জঙ্গলঝোরা থেকে মাইল-তিনেক হাঁটলে একটা বড় রাস্তা পাওয়া যায়। এই রাস্তা সোজা চলে গেছে দার্জিলিঙেবাসও পাওয়া যায় এখান থেকে। কুট্টিমামাকে বাগানের ফুটফরমাস খাটাবার জন্যে প্রায়ই দার্জিলিঙে যেতে হত।
সেদিন মামা দার্জিলিঙ থেকে বাজার নিয়ে ফিরছিল। কাঁধে একটা বস্তায় সেরতিনেক শুঁটকী মাছ, হাতে একরাশ জিনিসপত্তর। কিন্তু বাস থেকে নেমেই মামার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
প্রথম কারণ, সন্ধে ঘোর হয়ে এসেছে–সামনে তিন মাইল পাহাড়ি রাস্তা। এই তিন মাইলের দু’মাইল আবার ঘন জঙ্গল। দ্বিতীয় কারণ, হিন্দুস্থানী চাকর রামভরসার বাসস্ট্যান্ডে লণ্ঠন নিয়ে আসার কথা ছিল, সেও আসেনি। মামা একটু ফাঁপরেই পড়ে গেল বইকি।
কিন্তু আমার মামা গজগোবিন্দ হালদার অত সহজেই দমবার পাত্র নয়। শুঁটকী মাছের বস্তা কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের পথ দিয়ে মামা হাঁটতে শুরু করে দিলে। মামার আবার আফিং খাওয়ার অভ্যেস ছিল, তারই একটা গুলি মুখে পুরে দিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে পথ চলতে লাগল।
দুধারে পাইনের নিবিড় জঙ্গল আরও কালো হয়ে গেছে অন্ধকারে। রাশি রাশি ফার্নের ভেতরে ভূতের হাজার চোখের মতো জোনাকি জ্বলছে। ঝিঁ ঝিঁ করে ঝিঁঝির ডাক উঠছে। নিজের মনে রামপ্রসাদী সুর গাইতে গাইতে কুট্টিমামা পথ চলছে :
নেচে নেচে আয় মা কালী
আমি যে তোর সঙ্গে যাব–
তুই খাবি মা পাঁঠার মুড়ো
আমি যে তোর প্রসাদ পাব।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টুকরো-টুকরো জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ মামার চোখে পড়ল, কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে একটা লোক সেই বনের ভেতর বসে কোঁ-কোঁ করছে।
আর কে! ওটা নির্ঘাত রামভরসা।
রামভরসার ম্যালেরিয়া ছিল। যখন-তখন যেখানে-সেখানে জ্বর এসে পড়ল। কিন্তু ওষুধ খেত না–এমনকি এই কুইনিনের দেশে এসেও তার রোগ সারবার ইচ্ছে ছিল না। রামভরসা তার ম্যালেরিয়াকে বড্ড ভালোবাসত। বলত, উ আমার বাপ-দাদার ব্যারাম আছেন। উকে তাড়াইতে হামার মায়া লাগে!
কুট্টিমামার মেজাজ যদিও আফিং-এর নেশায় ঝুঁদ হয়ে ছিল, তবু রামভরসাকে দেখে চিনতে দেরি হল না। রেগে বললে, তোকে না আমি বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলেছিলুম? আর তুই এই জঙ্গলের মধ্যে কোঁ-কো করছিস? নে–চল–
গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে রামভরসা উঠে দাঁড়াল।
কুট্টিমামা নাক চুলকে বললে, ইঃ, গায়ের কম্বলটা দ্যাখো একবার! কী বদখৎ গন্ধ! কোনওদিন ধুসনি বুঝি? শেষে যে উকুন হবে ওতে! নে–চল ব্যাটা গাড়ল! আর এই শুঁটকী মাছের পুঁটলিটাও নে। তুই থাকতে ওটা আমি বয়ে বেড়াব নাকি?
এই বলে মামা পুঁটলিটা এগিয়ে দিলে রামভরসার দিকে।
–এঃ, হাত তো নয়, যেন নুলো বের করেছে! যাক, ওতেই হবে।
মামা রামভরসার হাতে পুঁটুলিটা গুঁজে দিলে জোর করে।
রামভরসা বললে, গোঁ-গোঁ–ঘোঁক!
–ইস! সায়েবদের সঙ্গে থেকে খুব যে সায়েবি বুলি শিখেছিস দেখছি! চল–এবার বাসামে ফিরে কুইনিন ইনজেকশন দিয়ে তোর ম্যালেরিয়া তাড়াব। দেখব কেমন সায়েব হয়েছিস তুই!
রামভরসা বললে, ঘুঁক-ঘুঁক!
–ঘুঁক–ঘুঁক? বাংলা-হিন্দী বলতে বুঝি আর ইচ্ছে করছে না? চল–পা চালা–কুট্টিমামা আগে-আগে, পিছে পিছে শুঁটকী মাছের পুঁটলি নিয়ে রামভরসা। মামা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলে, কেমন থপাস থপাস হাঁটছে রামভরসা।
–উঃ, খুব যে কায়দা করে হাঁটছিস! যেন বুট পড়ে বড় সায়েব হাঁটছেন।
রামভরসা বললে, ঘঁচাৎ!
–ঘঁচাৎ? চল বাড়িতে, তোর কান যদি কচাৎ করে কেটে না নিয়েছি, তবে আমার নাম গজগোবিন্দ হালদার নয়!
মাইল-খানেক হাঁটবার পর কুট্টিমামার কেমন সন্দেহ হতে লাগল।
পেছনে-পেছনে থপথপ করে রামভরসা ঠিকই আসছে, কিন্তু কেমন কচমচর করে আওয়াজ হচ্ছে যেন! মনে হচ্ছে, কেউ যেন বেশ দরদ দিয়ে তেলেভাজা আর পাঁপর চিবুচ্ছে। রামভরসা শুঁটকী মাছ খাচ্ছে নাকি? তা কী করে সম্ভব? রামভরসা রান্না করা শুঁটকীর গন্ধেই পালিয়ে যায়কাঁচা শুঁটকী সে খাবে কী করে!
মামা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল কিন্তু বিশেষ কিছু বোঝা গেল না। একে তো নেশায় চোখ বুজে এসেছে, তার ওপর এদিকে একেবারে চাঁদের আলো নেই, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু দেখা গেল, পেছনে-পেছনে সমানে থপথপিয়ে আসছে রামভরসা, ঠিক তেমনি গদাইলস্করি চালে।
পায়ের নীচে পাইনের অজস্র শুকনো কাঁটাওয়ালা পাতা ঝরে রয়েছে। মামা ভাবলে হয়তো তাই থেকেই আওয়াজ উঠেছে এইরকম।
তবু মামা জিজ্ঞেস করল, কী রে রামভরসা, শুঁটকী মাছগুলো ঠিক আছে তো?
রামভরসা জবাব দিলে, ঘু–ঘু।
–ঘু–ঘু? ইস, আজ যে খুব ডাঁটে রয়েছিস দেখছি–যেন আদত বাস্তুঘুঘু।
রামভরসা বললে,–হুঁ–হুঁ।
কুট্টিমামা বললে, সে তত বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, চল তো বাড়িতে, তারপর তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
আরও খানিকটা হাঁটবার পর মামার বড্ড তামাকের তেষ্টা পেল। সামনে একটা খাড়া চড়াই, তারপর প্রায় আধমাইল নামতে হবে। একটু তামাক না খেয়ে নিলে আর চলছে না।
মামার বাঁ কাঁধে একটা চৌকিদারি গোছের ঝোলা ঝুলত সব সময়ে; তাতে জুতোর কালি, দাঁতের মাজন থেকে শুরু করে টিকে-তামাক পর্যন্ত সব থাকত। মামা জুত করে একখানা পাথরের ওপর বসে পড়ল, তারপর কল্কে ধরাতে লেগে গেল। রামভরসাও একটু দূরে ওত পেতে বসে পড়ল–আর ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল।
–কী রে, একটান দিবি নাকি?
–হুঁ–হুঁ।
–সে তো জানি, তামাকে আর তোমার অরুচি আছে কবে? আচ্ছা, দাঁড়া আমি একটু খেয়ে নিই, তারপর প্রসাদ দেব তোকে।
চোখ বুজে গোটা কয়েক সুখটান দিয়েছে কুট্টিমামা হঠাৎ আবার সেই কচর-মচর শব্দ। শুঁটকী মাছ চিবোবার আওয়াজ নির্ঘাত।
কুট্টিমামা একেবারে অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর রেগে ফেটে পড়ল :
–তবে রে বেল্লিক, এই তোর ভণ্ডামি?-শুঁটকী মাছ হাম হুঁতা নেই, রাম রাম।–দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে।
বলেই হুঁকো-টুকো নিয়ে মামা তেড়ে গেল তার দিকে।
তখন হঠাৎ আকাশ থেকে মেঘ সরে গেল, জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ দেখা গেল সেখানে। একরাশ ঝকঝকে দাঁত বের করে রামভরসা বললে, ঘোঁক-ঘরর–ঘরর—
আর যাবে কোথায়! হাতের আগুন-সুদ্ধ হুঁকোটা রামভরসার নাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে ‘বাপ রে–গেছি রে’–বলে কুট্টিমামার চিৎকার। তারপরই ফ্ল্যাট, একদম অজ্ঞান।
রামভরসা নয়, ভালুক। আফিং-এর ঘোরে মামা কিচ্ছুটি বুঝতে পারেনি। ভালুকের জ্বর হয় জানিস তো? তাই দেখে মামা ওকে রামভরসা ভেবেছিল। গায়ের কালো রোঁয়াগুলোকে। ভেবেছিল কম্বল। আর শুঁটকী মাছের পুঁটলিটা পেয়ে ভালুক বোধহয় ভেবেছিল, এ-ও তো মজা মন্দ নয়। সঙ্গে সঙ্গে গেলে আরও বোধহয় পাওয়া যাবে। তাই খেতে-খেতে পেছনে আসছিল। খাওয়া শেষ হলেই মামার ঘাড় মটকাত।
কিন্তু ঘাড়ে পড়বার আগেই নাকে পড়ল টিকের আগুন। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজ তুলে ভালুক তিন লাফে পগার পার।
বুঝলি প্যালা–ওইটেই হচ্ছে সেই ভালুক।
গল্প শুনে আমি ঘাড় চুলকোতে লাগলুম।
–কিন্তু ওইটেই যে সে-ভালুক-বুঝলে কী করে?
–হুঁ–হুঁ, কুট্টিমামার হাতের কাজ, দেখলে কি ভুল হওয়ার জো আছে? আরে–আরে, ওঁই-তো ডালমুট যাচ্ছে। ডাক–ডাক শিগগির ডাক—