Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কুকুর-মেকুরের গল্প || Buddhadeb Guha

কুকুর-মেকুরের গল্প || Buddhadeb Guha

মামা। অ মামা! দেকিচো, এরা ক্যানাল বানানও জানে না গো! ফটিক বলল, তার একমাত্র, শহুরে মামা পলানের পাঞ্জাবির পকেট আচমকা টেনে ধরে।

কী কইরতেচিস ছোঁড়া। পাঞ্জাবিটা ছিঁড়বি নাকি?

লজ্জা পেয়ে ফটিক বলল, না। কিন্তুক, ওই দেকো।

একটু আগেই জাদুঘর থেকে বেরিয়েছে ওরা দু-জনে। কাকদ্বীপ থেকে কলকেতাতে এই প্রথমবার বেড়াতে-আসা বোনপোকে হাওড়া হাটের গামছার নগণ্য ব্যাপারি পলান, কলকেতা শহর দেখাতে বেরিয়েছে তাকে সঙ্গে নে। ভালো করে ঘুইরে-ঘাইরে দেখার উত্তেজনায় উত্তপ্ত হইয়ে, বাইরে বেইরেই ফুটপাতের উপরের চাকা-লাগানো বাক্সের চলন্ত দোকান থেকি কিনে লালরঙা ঠান্ডা বরফ-জল খেইয়ে গরমকে কিছুটা প্রশমিত করে মামা, ভাগনেকে নিয়ে মেয়ো রোড ধইরে হাঁটতি নেগেচে গঙ্গার উপরে যে নতুন ব্রিজ হইয়েচে সেদিক পানে।

ইতিমদ্দে এই বিভভম।

মামা পলান, কেলাস সেভেন অবধি পড়েছিল গেরামের ইস্কুলে। তাদের বাড়ি বদমান জেলার এক অখ্যাত গেরামে। বাগনান থেইকি প্রায় চার কোশ মতন পড়ে। বাস-টাস নাই। হেঁইটেই। যেতি হয় একনও শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়। কষ্ট আছে অবশ্যই তবে আনন্দও কম নাই।

পলান মানুষটা স্বাধীনচেতা এবং রগচটা। বিয়ে-থা করেনি। গামছার ব্যবসাটা তার একটা শখ। আসলে সে একটু কবি-গোছের মানুষ। নুকিয়ে কবিতা নেকে। সুহাসিনী নাট্য কম্পানির হয়ে। যাত্রার জন্যে গানও নেকে। অসতীর পাপ এবং সতীর পুণ্য এই দুইট পালারই জইন্যে গান নিকেচে পলান এবারে। সুহাসিনী নাট্য কম্পানিতে চিংড়ি নামের যে নতুন হুঁড়িটা আমদানি হইয়েছে, যে জেলেনির পার্ট কইরবে বলে রিহার্সাল দিতিচে, গাছ-কোমর করে পাছাপেড়ে ডুরে শাড়ি পরে, সে দারুণ নাচে কোমর আর বুক দুলিয়ে দুলিয়ে। কালো রঙের মদ্দি ভারি মিষ্টি চেহারা-ছিরি। সে ছুঁড়িকে দেখলিই বুকের মদ্দি কে যেন মশলা বাইটতে শুরু করে, গাবুক-গুবুক করে।

চিংড়ির কতা ভাইবতে ভাইবতে মেয়ে রোড পেরুতি যেয়ি একটা নাল মারুতির নীচে চাপা পইড়েচেল পলান আর এটু হলেই। বোনপো ফটিকচাঁদ গেরামের ছেলে হলি কী হয়, খুবই চালাক-চতুর বটেক। সে-ই বলতি গেলি, তার সবেধন মামার হাত ধইরে হ্যাঁচকা টান মেইরি তাকে সইরে নে যায়। সাক্ষাৎ যমের হাত থেকি। সি-কারণে পলান সেই মুহূর্তে তার বোনপোর উপর খুবই প্রসন্ন ছেল। কিন্তুক সদ্য পেরাণ ফিরে পেইয়েই যেই পকিট থেইকি একটা ভুবনমোহিনী বিড়ি বের কইরে, কেরোসিনের লাইটার জ্বেইলি সবে ধইরেচে, আর অমনি ফটিকচাঁদের নতুন প্রশ্ন।

ছোঁড়াটার জানার আকাঙক্ষা খুব। এমন ছেইলে শহরের ভালো ইস্কুলে পইড়তে পারলি জজ ম্যাজিস্টের কোন ছার সি এম ডি-র ঠিকেদার পয্যন্ত হইয়ে গিয়ে লালে লাল হইয়া যেতি পারত। তাপ্পর চাই কি এম এল এ কি এম পি-ও। অমন সব লাভজনক ব্যবসা তো দেশে একন আর কিছুই নেই!

ইচ্চে কইরলেই পলান ফটকেকে কাকদ্বীপ থেইকি নিয়ে এসি তার নিজের কাছেই রাইখতে পারত কিন্তুক তার ভগ্নিপোত, মানে ফটকের বাবা হরিপদটা একটা নম্বরি হারামজাদা। সে শালা ভাবে যে, সে যা বোঝে তেমনি আর কেউই বোঝে না। ভাবে। গাঁড়ল, তাই ভাবে। এককানা বিয়ে দেছিল বটে একমাত্র কন্যের, পলানের বাবা গোবদ্দন! তক্কনকার দিনে র‍্যালে সাইকিল, এইচ এম টি হাতঘড়ি, ফিলিপস-এর রেডিয়ো, নেপতোষক, এমনকী ঝিং-চ্যাক জিনস-এর প্যান্ট পয্যন্ত। কিন্তুক হলি কী হয়! তাপ্পরেও তার বোন চাঁপাকে কি একটুও সুখ দিল সে? ছ্যাঃ! ছ্যা!

এইসব কারণেই ফটিকের উপরে ভারি মায়া পলানের। ফটিকও মামাকে খুব ভালোবাসে। যেন। পলকে হারায়।

কী মামা? বললে না তো যে ক্যানাল বানানটা ভুল নিকেচে কেন তোমার কইলকেতার পণ্ডিতেরা?

ক্যানাল আবার কোতায় দেকলি তুই?

হোই তো!

আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল এবারে ফটিক।

পলান দেকল, তাই তো! বড়ো বড়ো হরপে ইঞ্জিরিতে নেকা আছে CALCUTTA KENNEL CLUB।

ফটিক একটু এগিয়ে গেল গেটের দিকে। পেচনে পেচনে পলানও। দেখল একটা সাদা নেড়ি শুয়ে আছে মাটিতে। ওদের দেইকেই সে শরীরের সামনের অংশ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ওদের। দিকে। মামা-ভাগনে তাকিয়ে থাকল তার দিকে কিছুক্ষণ। নেড়ি মাথা নামিয়ে নিজের দু-পায়ের উপরে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।

ভারী চিন্তাতেই পইড়ে গেল পলান। সত্যিই তো! ক্যানালের ইংরেজি বানানটা সে জানে। কারণ, তাদের গাঁয়ে দুৰ্গাপুর থেইকে যে ক্যানালটা এইয়েচে তার পাশেই মস্ত টিনের বোর্ডে নেকা আচে চুনচুনিয়া ফিডার ক্যানাল–ওপেনড বাই চিপ মিনিস্টের অব ওয়েস বেঙ্গল ছিরি জ্যোতি বসু অন…।

ক্যানাল ওপেন করার তারিকটার উপরে কাগে হেইগি হেইগি এমন কইরে রেকিচে যে সিটা আর পড়া যায় না। কাগেরা বোর্ডের উপরে হেইগে খুব সুক পায়। মাঝে মাঝে বগেরাও হাগে। কাগা বগার হাগায় তারিক হাপিস হইয়ে গেছে।

সেই টিনের বোর্ডে ক্যানাল বানান নেকা চেলো CANAL। কিন্তু কইলকেতার ময়দানের এই ছাইনবোর্ডে দেকতিচে নেকা আছে KENNEL। CALCUTTA KENNEL CLUB।

পলান বলল বোনপোকে, হয়তো ভুল নিকেচে।

কিন্তুক তার বোনপো ফটিক অত সহজে মেনে নেবার পাত্রই নই। সে বলল, হ্যাঃ, কী যে বলো মামা! ইকানে ক্যানাল কোতা? ই তো মাঠ! মাঠের পর মাঠ। তুমিই না বইলচিলে এরি কয় গড়ের মাঠ। আমরা তো সেই গড়ের পাশ দেই যাব গঙ্গার দু-নম্বর বিরিজ দেখতি, না, কি?

তা বটে।

চিন্তিত গলাতে বলল পলান।

ইকানেই তো মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল কেলাব আচে বইলেচিলে না তুমি? যেতে যেতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল কেলাবের তাঁবুও তো দেকাবে বইলেছিলে। তা, এই ক্যানাল কেলাবটা আবার কী ব্যাপার? কোন খেলা হয় ইকানে?

বলেই বলল, এই দেকো। ইটা আবার কী মামাচাঁদু?

জুড়ো কেলাব।

জুড়োটা কী খেলা মামা? লুডোর দাদা নাকি?

আরে না, নাঃ।

তাচ্ছিল্যের গলাতে বলল পলান, গ্রাম্য বোনপোকে চুপ করিয়ে দিয়ে। লুডোর দাদা-টাদালয় রে, শুনিচি, জুড় ব্যাপারটা নাকি জাপানি কুস্তি। হাওড়া হাটের আলুর পাইকের রাখোহরি একবার বইলেচেল। কিন্তু কেনেলটা কী খেলা? ই খেলার নাম তো শুনিনি আগে।

KENNEL শব্দর মানেটা যে ফটিক জানে না অথবা JUDOশব্দরও সঠিক মানে, তা বুঝতে পেইরে, এবং ভাগ্নের কাছে তার জ্ঞানের স্বল্পতা ধরা পইড়ে যাওয়াতে সে অত্যন্তই অস্বস্তি বোধ করল। মনে মনে ঠিক করল আজ দুনম্বর বিরিজ দেইকে ফিরে গিয়েই হাতিবাগানের হাতি মিত্তিরের কাছে যেইয়ে একেবারে বডি থ্রো দেবে।

হাতি মিত্তিরের বাড়িতে পলান গামছা সাপ্লাই কইরতেচে আজ পেরায় গত দশ বছর হল। সে বাড়ির সব মেয়ে-মরদ গামছা পইরে চানে যায়। আহা! তাদের গায়ের রঙের কী বাহার। যেন হলুদরঙা চিনি-চাঁপা কলা। লাল গামছা যেন ফেইটি যেতি চায় রঙের জেল্লাতে।

হাতি মিত্তির কলকেতা শহরের সব খবরই রাকেন। পাড়ার লোকে বহতই মানি-গণ্যি করে তাঁকে। তিনি KENNEL খেলার মানে অবিশ্যি জানবেন।

পলান ঠিক করল আজ ফটিককে গঙ্গার ব্রিজ দেকানো হয়ে গেলেই তাকে হাতিবাগানের মেস-এ জিম্মে করে দিয়েই দৌড়ে যাবে মিত্তির-বাড়ি। সত্যিই তো! এত দিন কলকেতাতে বাস করছে, চৌরঙ্গি রোড আর মেয়ে রোড ধরে কত হাজার বার গেচে এইসেচে আর এই KENNEL

CLUB-টাকী বস্তু তা জানার কৌতূহলই হয়নি কোনোদিন! নাঃ! ও সত্যিই একটা আনকালচার লোক। তবে ফটকেটার হবে! সব কিছুই ও জানতি চায়, শিখতি চায়। কাকদ্বীপের মতো ছোট্ট জায়গাতি জন্মালে কী হয়, ও একদিন নিশ্চয়ই কোনো কেওকেটা হবেই।

হাতি মিত্তিরেরা সাত ভাই। হাতি মিত্তির মেজো। সকলে বলে মেজোকর্তা। তিনিই বাড়ির সর্বেসর্বা। যদিও বে-থা করেন নাই।

পলান গিয়ে যখন পৌঁছোল মিত্তির-বাড়িতে, দেখল, হাতি মিত্তির যথারীতি বাইরের লাল সিমেন্ট করা রক-এ খেটো ধুতি পরে খালি গায়ে বইস্যে মুড়ি আর তেলেভাজা খেতিচেন। মানুষটার অগাধ পাণ্ডিত্য। পেকিত কেলচার মানুষ বটে। হিন্দু স্কুলে ক্লাস নাইন অবদি পড়ে যথেষ্টই। পড়েছেন বিধায়, পড়াশুনো ছেইড়ি দেন। জ্ঞান-গম্মি যাদের গজাবার তাদের মগজে স্যাঁতলার মতো এমনিতেই গজায়, স্কুল-কলেজের বেঞ্চিতে পোঁদ ঘষতি হয় না তাদের।

হাতি মিত্তির পলানের প্রশ্ন শুনে হাসলেন একটু। বললেন, KENNEL শব্দর মানে হচ্ছে। কুকুরদের ঘর।

কুকুরেরা কি খেলা খেলে সেকানিমানে, ময়দানে?

অবাক হয়ে শুধোলো পলান।

হাতি মিত্তির হেসে বললেন, কুকুরেরা কোনও খেলাই খেলে না। বছরে একদিন সেকানে ডগ শো হয়।

ডগ-শো কাকে বলে মেজোবাবু?

মেজোবাবুর গভীর জ্ঞানে অবাক হয়ে বলল পলান।

কলকাতার বড়োবাবুরা, সায়েব-মেমেরা তাঁদের কুকুরদের নিয়ে আসেন সেদিন কেনেল ক্লাবে। কুকুরদের কোনো খেলা হয় না সেখানে।

কী কুকুর? নেড়ি?

দুস। কুকুর কি শুধু ন্যাড়া-নেড়িই হয়? কত জাতের কুকুর হয়। দাড়িওয়ালা কুকুর হয়, টোপিওয়ালা কুকুর, খুঁড়িওয়ালা কুকুর, চর্বিহীন কুকুর। মোটা মোটা বকলেস লাগানো থাকে তাদের গলায়। তারা সার সার বসে থাকে। মুকে না-বলে যারা সেই শো দেখতে আসে তাদের বলে, একবার পরীক্কা পারথনীয়।

কীসের পরীক্কা?

অবাক হয়ে আবারও শুধোলো পলান।

কে কত বড়ো কুকুর, কত বড়ো বাধ্য কুকুর, কে মালিকের থুতু-পাইকানা-মুত নিপুণভাবে চাটতে পারে, কার মধ্যে কুকুরত্ব কত বেশিমাত্রায় আছে, মালিকের আজ্ঞা কে কত নিখুঁতভাবে পালন করতে পারে, লেজ নাড়িয়ে বা লেজ না-নাড়িয়ে, তারই পরীক্কা। মালিকের মুকের দিকে চেয়েই কে কত তাড়াতাড়ি তার মনের ভাব বুঝে নিতে পারে, এই সব গুণাবলিরও পরীক্কা হয় বই কী।

কতরকমের কুকুর হয় মেজকত্তা? এক রকমের কুকুর আচে শুনেছি, তাদের আলশাসি না কী যেন–তাদের গায়ে নাকি বাঘের চেয়েও বেশি জোর?

মেজবাবু বললেন, তুমি পলান সত্যিই বড়ো বোকা। হাতিবাগানে বাস করো, আর রবিবারে সকালে বাজারটিও কি দেখোনি কোনোদিন? সেখানে কত ও কত রকমের কুকুর আসে রবিবার সকালে। পাখপাখালি, গাছগাছালি! কনস্যুলেটের সায়েব-মেমেতে ভরে যায় বাজার। তুমি কী

না বাবু। শুনিচি বটে। দেকিনি ককখনও। আমরা গরিব মানুষ ঘুম থেকে উঠেই হাটে দৌড়ই। তা ছাড়া পেতি রবিবার যে আমি গেরামে যাই, বাগনানে নেইম্যি। বুড়ি মাটো যে আজও বেঁইচে আচে।

অ! তা অ্যালশাসি নয়, অ্যালসেশিয়ান।

আর কী কুকুর আচে?

কত্তরকম। গ্রেন ডেন, বুল ডগ, বুল-টেরিয়ার, স্প্যানিয়েল, ককার-স্প্যানিয়েল, ডালমেশিয়ান, গ্রে-হাউন্ড, পিকিনিজ, ড্যাশ-হাউন্ড, ফক্স-টেরিয়ার, রিট্রিভার–বহুরকমের হয়–শিকারিদের সঙ্গী। শিকার রিট্রিভ করে আনে জল, স্থল, অনেকসময়ে অন্তরীক্ষ থেকেও। মালিক ধরে আনতে বললে, এরা বেঁধে আনে। কোনো জাতের কুকুর আবার চেহারাতেই ভয়াবহ–আসলে তারা। ফসফস–। কিন্তু সেকথা তো জনগণ জানে না, তাদের দিয়ে ভয় দেখায় মালিকেরা জনগণকে, যারা কুকুরের জাত চেনে না, তাদের। আবার এতরকমের কুকুর আছে, তাদের নাম সালুকি। কয়েক লক্ষ টাকা দাম।

বলেন কী বাবু? কয়েক লক্ষ?

বিষম খেয়ে বলল পলান।

হ্যাঁ বাপ। লক্ষাধিক।

বলেই, মেজোকত্তা বললেন, তুমি কাঙ্গপোকপি পড়েছ?

কাঙ্গপোকপি?

আজ্ঞে হ্যা! একটি গোয়েন্দা উপন্যাস। কুকুর সম্বন্ধে যদি জানতে চাও, তো পোড়ো।

আমি মুকু মানুষ মেজকত্তা। উপন্যাস-টাস পড়তি গেলে হাঁস-ফাঁস লাগে। আনন্দবাজারটা পড়ি। কিন্তুক এই ডগ-শোটা ককন হয়? কবে হয়? আর যে সাদা নেড়িটাকে দেইক্যে এলাম শুয়ে আছে। কেনেল কেলাবের মাঠে, সে কি রোজদিনই শো দেকায় সিকানে?

ছিল বুঝি সেখানে কোনো নেড়ি? অ! তালে সে বেটি টেন্টের মালিরই হবে। গলায় বকলেশ ছিল কী?

বকলেস? সেটা কী বস্তু মেজোবাবু?

আরে সেটাই তো বড়োলোকের পোষা কুকুরের চিহ্ন। যাদের গলাতে বকলেস নেই, তারা হয় স্বাধীন কুকুর, নয় গরিবের কুকুর। পেডিগ্রি নেই তাদের। গলায় বকলেস এঁটে, ঠান্ডা গাড়ি চড়ে আসে। মালিকের হাতের রুপোর বা সোনার চেনে বাঁধা থাকে সে-সব কুকুর।

পেডিগ্রিটা আবার কী ব্যাপার মেজকত্তা?

হাঃ হাঃ।

পলান বোকার মতো জিজ্ঞেস করল।

যে-সব ডিগ্রিধারী কুকুরদের আমরা দেখি, আকছার দেখতে পাই নানা প্রতিষ্ঠানে, সেই সব এম এ, পি এইচ ডি মালিক-চাটা ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে পেডিগ্রিধারী কুকুরদের অনেকই তফাত আছে। অনেকই। বুঝলে পলান। ডিগ্রি আর পেডিগ্রি এক নয়।

পেডিগ্রি কি শুধু ককুরদেরই হয়?

শুধু কুকুরই নয়, ঘোড়া এবং অন্য বহত জানোয়ারদের মধ্যেও পেডিগ্রি হয়।

ইরি বাবা। অনেক ডিগ্রির কতা শোনা ছেল কি পেডিগ্রির কতা তো জন্মে শুনিনি মেজোকত্তা! তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা কি কখনো ডগ-শো দেকতে পারি না? পাইরলে, আমার বোনপোটাকে দেকাতাম একবার।

ডগ-শো দেখতে হলে, কেনেল ক্লাবের মেম্বার হতি হয়, নইলে তাঁদের গেস্ট। আর ডগ-শো তো হয় শীতকালে। কলকাতার বাবু-বিবিরা যখন চেগে ওঠেন–ক্রিকেট, টেনিস, ফ্লাওয়ার-শো, হর্স রেস, ক্রিসমাস, নিউ-ইয়ার। শালা কবে চলে গেল সায়েবরা, তবু তাদের গু-চাটা ফুরোল না কলকাতার বাবুদের।

তা হলে তো আমাদের দেকার কোনোই উপায় লাই মেজকত্তা, ডগ-শো?

মেজকত্তা খুব জোরে হেসে উঠলেন।

উপায় নেই কেন?

তারপর বললেন, চোখ খুলে রাখো, কান খুলে রাখো, প্রতিদিনই ডগ-শো দেখতে পাবে। খবরের কাগজের পাতা খোলো সকালবেলা দেখবে পাতায়-পাতায় ডগ-শোর ছবি। কেঁদো-কেংদো বা। চিমসে-চিমসে কুকুরেরা সভা আলো করে বসে আছে। সব শালা মালিকের কুকুর। গলায় তাদের বকলেসের দাগ খালি-চোখে দেখতে পাবে না। কিন্তু তারা সব মোটা মাইনের, গাড়ি-চড়া, মেরুদণ্ডহীন পোষা কুকুর। যদি কখনো মুখ হাঁ করিয়ে দেখতে পার, তবে দেখতে পাবে, শুধুই কুৎসিত মাড়ি। কারো লাল, কারো কালো। বিষদাঁতের কথা ছেড়েই দাও, তাদের যে দাঁতই। নেই। তাদের চোখেও ঠুলি, মালিকের বোল-চাল ছাড়া তাদের কানও কিছু শোনে না। থাকার মধ্যে তাদের শুধু লেজ আছে। সেই লেজ মালিক যেদিকে নাড়তে বলে, সেদিকেই নাড়ে। সেই লেজ তুলেই মালিককে সেলাম ঠোকে। ডগ-শো দেখতে শীতকাল অবধি অপেক্ষা করতে যাবে

তুমি কোন দুঃখে পলান? কেনেল ক্লাবেই বা যাবে কেন? চারধারে চেয়ে দেখো, কুকুরে কুকুরে ছয়লাপ। এ তো ল্যাজওয়ালা কুকুরদেরই শহর, গলায় বকলেশ লাগানো মালিকের দয়ার আর অপমানের অন্নে প্রতিপালিত হাজার কুকুরদের আর তাদের বড়োলোক, দাম্ভিক এবং ল্যাজকাটা মালিকদেরই।

পলান একটা সহজ প্রশ্ন করতে গিয়ে বড়ো গোলমালে পড়ল। নানারকম ভাবনাতে মাথাটা ভারী হয়ে এল। বলল, আচ্ছা মেজোকা এবারে আসি। আমার বোনগোটা বইসে আচে মেস-এ।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ভ্যাপসা গরমের মদ্দি মেসের ঘরের সামনের এক চিলতে বারান্দাতে মাদুর পেইতি শুয়েচেল পলান আর ফটকে। গরমে ঘুম আইসতেচেল না। ফটকে একটা হাই। তুলল। গরম থাকলিও ক্লান্তিও কম ছেলনি। সারাদিন রোদে টো টো কইরে হেঁইটেচে। চোক বন্দ হইয়ে আইসতেচেল ফটকের।

পলান বলল, কী রে? ঘরের মদ্দিই সেঁদোবি নাকি আবার?

নাঃ। ইকানে তাও ভগমানের হাওয়া আচে এটু। মিষ্টি লাগে। তোমাদের ওই পাকার হাওয়াতে, মনে হয় ফোস্কা পইড়বে গায়ে।

বলেই বলল, আমি…।

কী?

পলান শুধোলো।

নাঃ।

বল না।

আমি ভাইবতেছিলাম সেই সাদা নেড়িটার কতা। তোমাদের ওই ক্যানাল কেলাবের।

কেন? ক্যানাল নয়, কেনেল বল।

ওই হল। ভাবতেচিলাম, কুকুরটা কুকুর বটে কিন্তু কারোই গোলাম করে না।

তা ঠিক।

একটা হাই তুলে, চটাস করে বাঁ গালে একটা মশা মেরে পলান বলল।

তারপর বলল, নেড়িটার চোক দুটো খুব সুন্দর, নারে। দেইকেচিলি কি?

ফটকে উত্তেজিত হয়ে বলল, তুমিও তাইলে দেইকেচিলে? আমি তো তার চোকের কতাই ভাইবতেচিলাম গো। কী উজ্জ্বল, কালো, সুন্দর নেড়িটার চোক দুটি। শুয়েচিল কাটালি চাঁপা গাছটার নীচে ছাইগাদাতে, কিন্তুক কেমন একটা রানি রানি ভাব লক্ষ কইরেচিল মামা?

করি আর নি! হবেই বা না কেন বল? তার তো কোনো মালিক নেই। সে যে স্বাধীন। স্বাধীন মানুষকে যেমন এক আলাদা সৌন্দর্য দেয়, তেমন হয়তো কুকুরকেও দেয়। উঁচু-মাথার সেই সৌন্দর্য চাকর-বাকরেরা পাবে কোথা থেকি বল?

হুঁ। ঠিকই বইলেচ বটে!

ফটকে বলল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress