Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কালোচিতার ফটোগ্রাফ || Samaresh Majumdar

কালোচিতার ফটোগ্রাফ || Samaresh Majumdar

এ যেন স্বর্গের সিঁড়ি

এ যেন স্বর্গের সিঁড়ি, উঠছে তো উঠছেই, শেষ আর হয় না। এই পাহাড়ি শহরটার নিচ নথেকে ওপরে শর্টকাট পথ তৈরি করতে এমন বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে বড় প্যাকেটে পুরে সেটা বুকের ওপর চেপে ধরে তার একটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল মতিলাল। আজকাল টানা উঠতে বুকে হাঁপ ধরে। হঠাৎ তার নজরে পড়ল একেবারে ওপর থেকে একটি মানুষ তরতরিয়ে নিচে নেমে আসছে। এ নিশ্চয়ই। কোনও ডানপিটে তরুণ, নইলে ওই গতিতে নামার কথা চিন্তা করত না। ওভাবে নামতে হলে রীতিমতো অভ্যস্ত হওয়া দরকার। মতিলাল সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। সিঁড়িটা চওড়া নয়, একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে খাদ। কিন্তু সে ভালো করে সরে যাওয়ার আগে ছেলেটি তাকে মৃদু ধাক্কা মেরে নিচে চলে গেল একটুও গতি না কমিয়ে। আর ওই সামান্য ধাক্কাতেই মতিলালের হাতের প্যাকেট ছিটকে পড়ল মাটিতে। বেরিয়ে এল চিনি-চায়ের ছোট্ট প্যাকেটগুলো, দুটো ম্যাগাজিন।

চাপা গলায় গালাগালি করতে করতে উবু হয়ে বসে সে প্যাকেটদুটো এবং ম্যাগাজিন তুলছিল। যৌবনের শুরুতে মানুষ নিজেকে কী না কী মনে করে। ভাগ্যিস এই প্যাকেটগুলো ছিঁড়ে যায়নি। উঠে দাঁড়াবার আগে সে যে জিনিসটাকে দেখতে পেল সেটা তার নয়। একটা সেলোফেন কাগজে মোড়া বস্তু পড়ে আছে পায়ের কাছে। হাত বাড়িয়ে তুলেই বুঝতে পারল জিনিসটা বেশ ভারী। মতিলাল নিশ্চিত যে ওই অতি স্মার্ট ছেলেটি ধাক্কার সময় টের পায়নি জিনিসটা পড়ে গেছে। সে নিচের দিকে তাকাল। ছেলেটি এবার সিঁড়ি থেকে নেমে বাজারের দিকে যাচ্ছে। পরনে নীল জিনস্ এবং ওপরে চামড়ার জ্যাকেট, মাথায় একটা সাদা টুপি। সে চিৎকার করে ঢাকার চেষ্টা করল কিন্তু ছেলেটা মুখ তুলল না। মতিলাল জিনিসগুলো নিয়ে যতটা সম্ভব জোরে নিচে নামতে লাগল। আজকাল ধীরেসুস্থে হাঁটাচলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। কিন্তু ছেলেটাকে ধরতে হবে বলে সে জোরে নামছিল। বেচারা হয়তো এখন টের পাবে না জিনিস পড়ে গেছে। যখন পাবে তখন আফসোস করবে। তাই এখন ওটা ওকে ফেরত দিয়ে কিছু কথা শোনানো যেতে পারে।

নিচে নামার পর সে ছেলেটাকে দেখতে পেল না। ওপর থেকে সে দেখেছে ছেলেটি গিয়েছে বাজারের দিকে। অতএব সেদিকেই চলল সে। সাদা টুপি চামড়ার জ্যাকেট পরা মানুষের চেহারা খুঁজে খুঁজে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেল মতিলাল।

এখন কী করা যায়? অন্যের জিনিস বাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া কোনও মানে হয় না। আবার যেখানে পেয়েছিল সেখানে ফেলে রেখে যেতেও ভদ্রতায় লাগছে। এই দোকানদারদের কাছে দেওয়ার চেয়ে সবাইকে জানিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। সে সেলোফেনের মোড়কটা ধীরে-ধীরে খুলছিল। কী জমা দিচ্ছে তা দেখেই জমা দেবে। হঠাৎ মোড়কের ফাঁক দিয়ে একটা সরু কালো নল বেরিয়ে আসামাত্র সে চমকে উঠল। হায় ভগবান! এটা একটা পিস্তল! সে তাড়াতাড়ি মোড়কটা জড়িয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাতেই দেখল এক মাঝবয়সি গোঁফওয়ালা লোক চট করে চোখ সরিয়ে নিল। লোকটা কি পিস্তল দেখতে পেয়েছে? বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছিল কেউ। মতিলাল বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। এই পিস্তল আইনি না বেআইনি তাই বা কে জানে। যদি ছেলেটা এটা আইনসঙ্গত মনে করত তা হলে কি ওভাবে ফেলে যেত! এত ভারী জিনিস যখন পড়েছিল তখন কোনও আওয়াজ কানে যায়নি তো? আচ্ছা, এমন হতে পারে ছেলেটা এই পিস্তলের কথা জানেই না, তার হাত থেকে কিছু পড়েনি ওখানে। পিস্তল অনেক আগে কেউ রেখে গিয়েছিল ওখানে। না হলে পড়ার সময় নিশ্চয়ই আওয়াজ পেত সে। অন্য কারও পিস্তল সে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে। পুলিশকে গিয়ে এই কথা বলে পিস্তল জমা দিলে ওরা বিশ্বাস করবে? গত কয়েক মাস ধরে উগ্রপন্থীদের ধরার জন্য পুলিশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই পাহাড়ি শহরে এখন সামান্য গোলমাল হলে ব্যাপক ধরপাকড় হয়। কিছুদিন আগে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে কারও-বা কারও মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এখন অবস্থা কিছুটা শান্ত হলেও পুলিশ সহজে তার কথা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই বাজারের রাস্তায় পিস্তল হাতে কেউ যদি তাকে ধরে তা হলেও তো কৈফিয়ত দেওয়ার কিছু থাকবে না। মতিলাল আর ভাবতে পারছিল না। মোড়কটাকে বড় ব্যাগের ভেতরে চালান করে দিয়ে সে মুখ তুলতেই দেখল গোঁফওয়ালা লোকটা আবার তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার মানে ওই লোকটা তাকে লক্ষ করছে। কেন? পা-দুটো হঠাৎ দুর্বল হয়ে গেল ওর। লোকটা কী করে জানল তার কাছে পিস্তল আছে? সে এই প্রশ্নের জবাব না পেয়ে নিজেকে বোঝাল হয়তো অন্য কারণে লোকটা তাকে লক্ষ করছে। এখন সর্বত্র পুলিশের লোক ছড়ানো। বাজারে ফিরে এসেও কেনাকাটা না করে ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে ওর সন্দেহ হতে পারে।

মতিলাল পা চালাল। কিছুটা যাওয়ার পর মুখ ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে সে আর গোঁফওয়ালা লোকটাকে দেখতে পেল না। ওর মন একটু হালকা হল। খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এল সে। লোকজন অবশ্য ওঠানামা করছে কিন্তু সন্দেহ করার মতো কাউকে তার চোখ পড়ল না।

একপাশে ঢালু পাহাড়, অন্যপাশে সুন্দর বাড়িগুলো। দুপুর গড়ালেই রোদ এসে পড়ে এখানে আবহাওয়া ভালো থাকলে। মতিলাল একটু দ্রুত হাঁটছিল। রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ উঠে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সে নিজের বাড়ির দরজার সামনে পৌঁছে গেল। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে আগে বড় প্যাকেটটাকে টেবিলের ওপর রাখল। দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে সে প্যাকেট থেকে সেলোফেনের মোড়কটাকে বের করে সন্তর্পণে খুলতে লাগল। হ্যাঁ, সত্যি-সত্যি এটা একটা পিস্তল। পিস্তলটা রাখা হয়েছে একটা রবারের খাপের মধ্যে। মতিলালের মনে হল এই কারণে সিঁড়ির ওপর পড়া সত্ত্বেও কোনও আওয়াজ কানে আসেনি। পিস্তলকে রবারের খাপে রাখার নিয়ম কি না তার জানা নেই। সে দেখল অস্ত্রটির বুকের ভেতর গুলি ভরা আছে। অর্থাৎ এখনই ব্যবহার করতে চাইলে কোনও অসুবিধে নেই।

পিস্তলটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে সে বাইরের দিকে তাকাল। কাচের জানলার বাইরে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকঝক করছে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। মতিলাল পৃথিবীর সবাইকে এখন ক্ষমা করে দিল। যারা তার শত্রুতা করেছে, যাদের সে সহ্য করতে পারে না তার লিস্ট তৈরি করতে হলে প্রথমে সুভদ্রার নাম লিখতে হয়। সে একা থাকে। এই ছোট্ট বাড়িটায় একা থাকতে তার খারাপ লাগে না আজকাল। তবু সুভদ্রা তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। পিস্তলটা যদি কারও ওপর ব্যবহার করতে সে বাধ্য হয় তা হলে প্রথমে সুভদ্রা। মতিলাল চোখ বন্ধ করল। তার বন্ধ চোখের পাতায় এখন সুভদ্রার মুখ! ফোলা-ফোলা চোখ, সবসময় কিছু একটা ভেবে চলেছে। বিশ্বাস শব্দটি ওর অভিধানে নেই। গুলিটা ছুড়লে ঠিক কোথায় গিয়ে লাগলে সুভদ্রাকে কেমন দেখাবে তা ভেবে পাচ্ছিল না মতিলাল। ধীরে-ধীরে মুখটা তার কাছে অন্যরকম হয়ে গেল। যতই ঝগড়া করুক, গালমন্দ দিক, আলাদা থাকুক, যে মুখে এককালে সে আদর করেছে, যদিও খুবই গোনাগুনতি ব্যাপার, তবু সেই মুখ গুলিতে ক্ষতবিক্ষত করতে পারবে না। সুভদ্রার জন্যে তার ক্রমশ মায়া হতে লাগল। আর তখনই বেল বাজল।

কে এল! উঠে দরজা খুলতে গিয়ে খেয়াল হল। পিস্তলটা তার হাতে দেখতে পেলে যে আসবে তারই চোখ বড় হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে গুজব তৈরি হবে। কোথায় রাখা যায় এটা? দ্বিতীয়বার বেল বাজাতেই মতিলাল তড়িঘড়ি করে দেওয়ালে ঝোলানো একটা তিব্বতি ব্যাগের ভেতর মোড়কসমেত পিস্তলটা ঢুকিয়ে দিল। সুভদ্রা চলে যাওয়ার পর থেকে ওই ব্যাগে হাত দেওয়া হয়নি। যতটা পারে শান্ত মুখে দরজা খুলেই হকচকিয়ে গেল সে। গম্ভীর মুখে সুভদ্রা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলামাত্র তাকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল সুভদ্রা।

কে আছে, অ্যাঁ? এতক্ষণ কার সঙ্গে ফুর্তি করা হচ্ছিল। বেল টিপতে টিপতে হাতে কড়া পড়ে গেল আর বাবুর খোলার নাম নেই? দুমদুম শব্দ করে ভেতরে ঢুকে চারপাশ দেখে নিল সুভদ্রা।

দরজাটা বন্ধ করে প্রায় চোরের মতো খানিকটা দূরত্বে এসে দাঁড়াল মতিলাল।

এতক্ষণ কী করছিলে?

কিছু না।

তা হলে দরজা খুলছিলে না কেন?

এমনি।

এমনি? উত্তর শুনে শরীর গুলিয়ে ওঠে। শুধু এই কারণে তোমার সঙ্গে আমি ঘর করতে পারিনি, বুঝলে? শোনো, তোমাকে এবার টাকা বাড়াতে হবে।

টাকা?

আকাশ থেকে পড়লে কেন? যা টাকা দিচ্ছ তাতে কোনও ভদ্রমহিলার মাস চলে না।

আমি কী করতে পারি? মিনমিন করে বলল মতিলাল।

কী করতে পারি মানে? ইয়ার্কি? তোমার বউ-এর খাওয়া-পরা চলছে না আর তুমি বলছ কী করতে পারি? অন্য কেউ হলে মুখ ভেঙে দিতাম আমি। গজগজ করে উঠল সুভদ্রা, একেই দুর্নাম রটাচ্ছ আমি নাকি মুখরা, খারাপ ব্যবহার করি, তার ওপর মুখ ভেঙে দিলে আর দেখতে হবে না। এখন থেকে প্রত্যেক মাসে দুশো টাকা করে বেশি দেবে।

আমি কোত্থেকে পাব? আমি যা রোজগার করি তা তো জানো!

আমি কিছুই জানি না। কেন, যেসব মেয়েছেলের সঙ্গে দিনরাত ফুসুর-ফুসুর করতে তাদের গিয়ে বলো না। অকম্মের বাদশা।

ঠিক আছে, কিন্তু আমারও তো একটা কথা ছিল।

তোমার কোনও কথা থাকতে পারে না।

কিন্তু ছিল, বিশ্বাস করো।

ল্যাঙটের আবার বুক পকেট। বলো, বলে ফেলো।

ইয়ে, তুমি তো আমাকে ছেড়ে গেছ–।

হ্যাঁ। গেছি। ওরকম মাদিমুখো পুরুষের সঙ্গে কেউ থাকতে পারে না।

ঠিক আছে। এখন তুমি যার কাছে আছ–।

তার মানে? তুমি আমাকে চরিত্রহীনা বলছ?

না, না, এখন তো তোমার সঙ্গে বলরাম থাকে; থাকে না?

তাতে কী এল-গেল। সে কি আমার মন্ত্রপড়া স্বামী? বিয়ে করেছি তাকে? আমি কি নিতান্তই উল্লুক? বিয়ে করলে তোমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে নাকি?

ও। তা হলে বিয়ে না করে এমনি-এমনি আছ?

হ্যাঁ। সাহেব-মেমরা যেমন থাকে। তা তোমার এখানেও বুড়ি-বুড়ি মেয়েছেলেরা যাতায়াত করে বলে শুনেছি। যদি কাউকে দেখতে পাই! সুভদ্রা ঘুরে দাঁড়িয়ে সদ্য কিনে আনা প্যাকেটগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওগুলো কী?

চা, চিনি।

আমি নিয়ে যাচ্ছি। কীসে নিই! চোখ ঘুরল সুভদ্রার। তারপর এগিয়ে গিয়ে দেওয়াল থেকে তিব্বতি ব্যাগটা টেনে নামিয়ে প্যাকেটগুলো তাতে ফেলে দিল। হাঁ-হাঁ করে উঠল মতিলাল, আরে, আরে করছ কী? ওই ব্যাগটা নিও না!

কেন? এটা তোমার বাবার সম্পত্তি? আমি কিনেছিলাম না? আমার জিনিস নিতে আমাকেই নিষেধ করা হচ্ছে। যদি বিয়ে করতাম তবে এবাড়ির সব জিনিসই নিয়ে যেতে হতো আমাকে। আজ যাচ্ছি। সামনের মাস থেকে দুশো টাকা বেশি দেবে। যেমন এসেছিল তেমনি ঝড়ের মতো চলে গেল সুভদ্রা।

দরজা বন্ধ করে ধীরে-ধীরে কিচেনে গেল মতিলাল। গ্যাস জ্বেলে এক কাপ কফি বানিয়ে বসার ঘরে এল। সামনের জানলা দিয়ে পাহাড়ের অনেকটা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিল সে। বেতের চেয়ারে বসে পাহাড় দেখতে-দেখতে সময় কাটানো ওর প্রিয় অভ্যেস। সুভদ্রা চলে গেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু মনে হচ্ছে ওর কথাগুলো এই ঘরে ভাসছে। জীবনের একটা ভুল অনেক দাম দিয়ে গেল। বলরাম তারই বন্ধু। কন্ট্রাক্টরি করে। কঁচা পয়সা হাতে। সুভদ্রার শরীরের দিকে নজর ছিল অনেকদিন। এখন সে সুভদ্রার কাছেই থাকে। অথচ সুভদ্রা নাকি ওর কাছ থেকে একটা পয়সাও নেয় না। অভাবে থাকবে, তবু সাহায্য নেবে না। প্রয়োজন হলে এ বাড়িতে এসে সে ঝামেলা করবে। মানুষের চরিত্র বোঝা মুশকিল।

মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স তার। চাকরি করে ব্যাঙ্কে। সুভদ্রা চলে যাওয়ার পর কোনও মেয়েমানুষের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয়নি। এই বয়সে বন্ধুরা রুমাল পালটানোর মতো মেয়েমানুষ পালটায়। তার উৎসাহ হয় না। আজ রবিবার। ব্যাঙ্ক বন্ধ। কোনও কাজ নেই। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে চা খাবে। সন্ধে থেকে হুইস্কি। রাত বাড়লে একটা চমৎকার ঘুম। এইভাবেই বাকি জীবন যদি কাটিয়ে দিতে পারত। সে কফি শেষ করে নিজের ঘরে এল। বিছানার ওপরে একটা সিনেমার পত্রিকা। মাধুরী দীক্ষিতের মুখ। এখনকার নায়িকারা বেশি সুন্দরী না মধুবালা, মালা সিনহারা? বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসলে বেশ ভালোভাবে সময় কেটে যায়। অড্রে হেপবার্ন, সোফিয়া লোরেন না প্রিটি ওম্যানের সেই মেয়েটা। কী যেন নামটা?

এইসময় দরজার বেল বেজে উঠল গাক-গ্যাক করে। লোকটা রসকষহীন। বেল বাজানোর ধরনের ওপর মানুষের চরিত্র অনেকটা বোঝা যায়। মতিলাল এগিয়ে গেল দরজা খুলতে। নিশ্চয়ই সুভদ্রা ফিরে আসেনি। এমনভাবে বেল ও বাজায় না।

দরজা খুলতেই হকচকিয়ে গেল মতিলাল। এক জিপ পুলিশ সামনে দাঁড়িয়ে। থানার ওসি থাপাকে সে চেনে। দয়া মায়া স্নেহ বলে বোধগুলো ঈশ্বর ওর জন্মের সময় দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। থাপার হাতে রিভলভার। সেটা মতিলালের নাকের ডগায় নাচিয়ে থাপা বলল, হ্যান্ডস আপ। চালাকির চেষ্টা করলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।

কোনওরকমে দুটো হাত মাথার ওপর তুলতেই ধমক খেল সে, ঘরে চলো।

অতএব ঘরে ঢুকতেই হল। পুলিশ বাহিনীকে সদর দরজায় রেখে থাপা দুজনকে নিয়ে ভেতরে এল, বাড়িতে আর কে-কে আছে?

কেউ নেই। মাথার ওপর হাত তুলেই রেখেছিল সে।

কী কী বেআইনি অস্ত্র আছে বাড়িতে?

অস্ত্র? অস্ত্র থাকবে কেন? করুণ গলায় পালটা প্রশ্ন করল সে।

মারব মুখে এক থাবড়া, আমাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে। বের করো পিস্তলটা।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না, বিশ্বাস করুন! ককিয়ে উঠল সে।

তোমার কাছে কোনও পিস্তল নেই? ছোট-ছোট চোখে তাকাল থাপা।

না নেই।

আজকে একজন তোমাকে পিস্তল পাচার করেনি?

না। বিশ্বাস করুন!

অ্যাই সার্চ করো। সব খুঁজে দ্যাখো। নো মার্সি। থাপা আদেশ দেওয়ামাত্র বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল তল্লাশি করতে। মতিলাল দেখল ওরা ঘর লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। দুটো কাচের প্লেট ভাঙল। সব গেল।

ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে করেন। চিনি, দুধ, চা যা ইচ্ছে সুভদ্রা নিয়ে যাক, আর কোনওদিন সে বাধা দেবে না। ভাগ্যিস ও আজ এসেছিল এবং তিব্বতি ব্যাগে পিস্তলটাকে রাখায় ব্যাগের সঙ্গে আপদটাকেও নিয়ে গিয়েছে সুভদ্রা।

হাত নামাও। থাপার গলা।

আদেশ শুনে চোখ খুলে ধীরে-ধীরে হাত নামাল মতিলাল।

কোথায় রেখেছ?

মতিলাল চোখ ঘুরিয়ে দেখল বাহিনী হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি কিছুই জানি না।

সঙ্গে-সঙ্গে থাপার হাত এগিয়ে এল। তার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দেখল লোকটা। শেষে তাকে বলল, যদি প্রমাণ পাই মালটা তোমার কাছে ছিল তা হলে তোমার চামড়া ছাড়িয়ে নেব। এই, ডাকতো লোকটাকে। আজ ওর একদিন না আমার, দেখি?

সেপাইরা বাইরে থেকে যাকে ধরে নিয়ে এল তাকে দেখে মতিলাল অবাক। সেই মাঝবয়সি গোঁফওয়ালা লোকটা। থাপা এগিয়ে গিয়ে ওর জামার কলার এমনভাবে মুঠোয় ধরল যেন দম আটকে গেল, অ্যাই শালা। এই খবর এনেছিস? কোথায় পিস্তল?

লোকটা হাউমাউ করে উঠল, মাইরি বলছি ওর প্যাকেটে ছিল। আমি দেখেছি।

থাকলে কোথায় যাবে?

ও ওই প্যাকেট নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছে।

ঢুকে আর বের হয়নি?

তা বলতে পারব না। মাঝখানে আমি কিছুক্ষণের জন্যে আপনাকে ফোন করতে গিয়েছিলাম। প্যাকেটটা পেয়েছেন? লোকটা সেই অবস্থায় বলল।

এখানে কোনও প্যাকেটই নেই। শোন, এবার থেকে ইনফরমেশন কারেক্ট না হলে, প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল লোকটাকে। তারপর সদলবলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। জিপের চলে যাওয়া শব্দ কানে যাওয়ার পর মতিলাল দেখল লোকটা চেষ্টা করছে উঠে বসতে। পড়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে লোকটা।

মতিলাল একটা চেয়ার টেনে বসল। ওঠার চেষ্টা করে লোকটা হাঁটু মুড়ে বসে বলল, আমাকে দেখে খুব মজা লাগছে, না?

মতিলাল বলল, পিস্তলটা পাওয়া গেলে আমার অবস্থা তোমার চেয়ে খারাপ হতো।

দৃশ্যটা কল্পনা করে লোকটা যেন নিজের কষ্ট একটু কম করে দেখল, আচ্ছা, মালটা কোথায় হাওয়া করে দিলে ভাই? তাজ্জব ব্যাপার?

কী মাল?

ইয়ার্কি? আমি স্পষ্ট দেখেছি তুমি প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিলে। ওটা যে তোমার নয় সেটা বুঝতে পেরেই পেছনে লাগলাম। বাজারের মধ্যে কাউকে খুঁজে না পেয়ে তুমি যখন মোড়ক খুলছিলে তখন স্পষ্ট পিস্তলের নলটা দেখতে পেয়েছি।

তুমি তা হলে পুলিশের লোক?

তোমার ঘটে একটুও বুদ্ধি নেই। পুলিশের লোক হলে থাপা আমার গায়ে হাত তুলতে সাহস পেত? আমার কাজ হল গোপন খবর ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে কিছু কামাই করে নেওয়া। তুমি আমাকে আজ বোকা বানালে। আমি জানি পিস্তলটা এই বাড়িতেই আছে। লোকটা উঠে দাঁড়াল।

মতিলাল দার্শনিকের মতো বলল, খুঁজে দ্যাখো, ওরাও তো খুঁজল।

লোকটা যেন আদেশের অপেক্ষায় ছিল। সঙ্গে সঙ্গে জিনিসপত্র সরিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতে বলল, তুমি কি বিবাহিত? বউ কোথায়?

পিস্তলটা আগে খোঁজ তারপর খেজুরে আলাপ করো। মতিলাল খেঁকিয়ে উঠল।

খুঁজতে খুঁজতে লোকটা কিচেনে পৌঁছে গেল। একটু বাদে তার গলা ভেসে এল, খুব খিদে পেয়েছে। তোমার রুটি আর সবজি খেতে পারি?

দুটোর বেশি নেবে না। প্লেটে করে নিয়ে এখানে চলে এসো।

মতিলাল হুকুম করল। লোকটা প্লেট নিয়ে রুটি চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এসে বলল, ওঃ বাঁচলাম।

লোকটা কে? মতিলাল এখন যেন কর্তৃত্বে।

কোন লোক?

যে সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নামছিল। যার প্যাকেট পড়ে যেতে তুমি দেখেছিলে?

আমি কি পৃথিবীর সব মানুষকে চিনি? মুখ ঘুরিয়ে নিল লোকটা।

তুমি মিথ্যে কথা বলছ।

বিনা পয়সায় আমি খবর দিই না।

পুলিশকে তো নাম বলেছ। একই খবর বিক্রি করে কবার পয়সা নেবে।

মাইরি আর কী? পুলিশকে ওর কথা বলতে যাব কেন? বলেছি তুমি বাজারের মধ্যে পিস্তল নিয়ে ঘুরছিলে। ছেলেটার কথা ভুলেও পুলিশকে বলিনি।

তুমি তো আচ্ছা শয়তান! মতিলাল অবাক।

শয়তান বলো আর যাই বললো আমার তাতে কিছু যায় আসে না। বিজনেস ইজ বিজনেস, আমার বউ তো পৃথিবীর সব গালাগাল শিখে ফেলেছে আমাকে দেবে বলে। তাতে কোন কাজটা হয়েছে শুনি? এখন তুমি জিগ্যেস করতে পারো কেন আমি পুলিশকে ছেলেটার কথা বলিনি। প্রথম কথা, যদি তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ তা হলে তোমার অপরাধ কমে যাবে, পুলিশের কাছেও তেমন গুরুত্ব থাকবে না। দ্বিতীয়ত, যদি তুমি পুলিশের চোখ এড়িয়ে পিস্তলটা রেখে দিতে পারো তা হলে আমি ওই ছেলেটার কাছে গিয়ে বলতে পারি তার পিস্তল কোথায় আছে এবং টাকা খিচতে পারি। লোকটা খাওয়া শেষ করে হাসল।

যে পিস্তল মাটিতে ফেলে দিয়ে যায় সে কেন তোমার কাছে খবর পেয়ে সেটা নিতে আসবে?

অনেক সময় বাধ্য হয়ে ফেলে। বিপদ এড়াবার জন্যে ফেলতে হয়। তা হলে পিস্তলটাকে তুমি এ বাড়ি থেকে পাচার করে দিয়েছ। দারুণ ঘোড়েল মাল তুমি।

অনেকক্ষণ থেকে গালাগাল দিচ্ছ তুমি!

দেব না? আজ তোমার জন্যে কামাই বন্ধ, উলটে মার খেতে হল!

কী নাম তোমার?

শান বাহাদুর।

থাকো কোথায়?

বোটানিক্যাল গার্ডেনের রাস্তায়।

মাঝে-মাঝে এসো। মন ভালো থাকলে গল্প করা যাবে।

মন খারাপ হয় নাকি খুব?

তাতো হয়ই। একা মানুষ।

ও। তা হলে চলো। আমার বউ-এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, তোমার মন একদম ভালো হয়ে যাবে। শান বাহাদুর হাসল।

এই বললে তোমার বউ গালাগালির এক্সপার্ট।

তাই তো নিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ গালাগালি শুনলে দেখবে মনটা আর মনে থাকে না। কেমন উদাস হয়ে যায়।

মাপ করো ভাই। তুমি গিয়ে তোমার চেনা সেই ছেলেটাকে খবর দাও। তাতে যদি কিছু রোজগার হয় তোমার। মতিলাল প্রায় জোর করে শান বাহাদুরকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

চেয়ারে বসতেই তার সুভদ্রার কথা মনে এল। পিস্তলটা দেখতে পেয়েও নিশ্চয়ই চেঁচিয়ে উঠবে। এখনও যে দ্যাখেনি তার প্রমাণ দেখলে এতক্ষণে ছুটে আসত। কিন্তু পুলিশ যদি জানতে পারে ওর কাছে পিস্তল আছে তা হলে আর দেখতে হবে না। মেরে কিমা বানিয়ে দেবে সুভদ্রাকে। বিনা দোষে কষ্ট পাবে বেচারা।

মতিলালের মনে হল এখনই সুভদ্রার বাড়িতে গিয়ে ওকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। সে উঠল। কিন্তু তারপরই মনে পড়ল শান বাহাদুরের কথা। লোকটা যদি বাইরে গিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। তা হলে নিশ্চয়ই ওর পিছু নেবে। সুভদ্রার কাছে গেলে দুই-এ দুই চার করে নিতে অসুবিধে হবে না ওর। এমনিতে হয়তো কিছু হতো না, সে আগ বাড়িয়ে বিপদ ডেকে আনবে।

মতিলাল নিজের বিছানায় চলে এল। জুতো খুলে মোজা-পায়েই শুয়ে পড়ল সে। আঃ কী আরাম! একটু ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেল নাগাদ সুভদ্রার খোঁজে গেলেই হবে, ততক্ষণ শানবাহাদুরের ধৈর্য থাকবে না দাঁড়িয়ে থাকার। চোখ বন্ধ করল সে। চোখের পাতায় হেমা মালিনী, রেখা অথবা জিনাতের শরীর ঘুরে-ঘুরে আসত লাগল। এইভাবে কল্পনা করা ওর দীর্ঘদিনের অভ্যেস।

.

বাড়ির সামনে রাস্তার গায়ে একটা দেওয়ালের ওপর বসেছিল শানবাহাদুর। থাপার কাছে। মার খাওয়াটা অবশ্য ইতিমধ্যে তেমন মনে পড়ছে না, কিন্তু ওই শুটকো লোকটা কীভাবে যে পিস্তল হাওয়া করে দিল তা বুঝতে না পেরে সে খুব অবাক হচ্ছিল। বাড়িটা বড় নয়। সে যখন থাপাকে টেলিফোন করতে গিয়েছিল তখন যদি কেউ এই বাড়িতে এসে থাকে যার হাতে মতিলাল পিস্তলটা পাচার করতে দিয়েছে তা হলে নিশ্চয়ই বোকা বনতে পারে। কিন্তু যেই আসুক তাকে সতর্ক করতে মতিলাল নিশ্চয়ই এখনই বের হবে।

প্রায় একঘণ্টা বসে থাকার পর শানবাহাদুরের শীত করতে লাগল। মতিলালের বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। ক্রমশ তার মনে হতে লাগল অনর্থক সময় নষ্ট করছে। পিস্তলটার পিছনে পড়ে না থেকে অন্য কিছুর সন্ধানে গেলে দু পয়সা কামাই হতে পারত। সে পুলিশের খোচড় নয়। কিন্তু অনেকেই তাই মনে করে। এই শহরে যারা অস্ত্র নিয়ে কারবার করে তারা তাকে ভালো চোখে দেখে না। ওদের অস্ত্রের কথা পুলিশ যদি জানতে পারে তা হলে যে শেষ হয়ে যাবে এমন হুমকি সে পেয়েছে। ভুলেও অমন কাজ করবে না সে। বাজারে মতিলালকে দেখে মনে হয়েছিল এ লাইনের লোক নয়। তাই কামানোর ধান্দা হয়েছিল। যে ছেলেটা রিভলভার ফেলে গেছে তাকে বের করতে পারলে রোজগারের আশা আছে। কিন্তু মুশকিল হল, ছেলেটাকে সে দেখেনি। মতিলাল দেখেছে। ওকে দিয়ে যদি ছেলেটাকে বের করা যায়! হঠাৎ শানবাহাদুরের চোখ চকচক করে উঠল। মতিলাল বের হচ্ছে। দরজায় তালা দিল। সন্ধে হয়ে আসছে বলে ফুলহাতা সোয়েটার আর টুপি পরেছে। কোনওদিকে না তাকিয়ে লোকটা হাঁটছে এখন। কিছুটা যেতে গিয়ে শানবাহাদুর ওকে অনুসরণ করল।

উঁচু রাস্তা ভেঙে চিড়িয়াখানার পথ ধরল মতিলাল। ওদিকে যাওয়া মানে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মতলবখানা কী? কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে মতিলালকে অসহায়ের মতো তাকাতে দেখল। বাড়িটার সামনে জিপ দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে মতিলাল সেটাকে ধরাল। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। শানবাহাদুর ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। এদিকে বাড়িঘর কম। যা আছে সব কাঠের।

আলো মরে যাওয়া আলোয় মতিলালের মুখের যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে শানবাহাদুরের মনে হল লোকটা বেশ কষ্টে আছে। হয়তো ওই জিপের জন্যেই বাড়িতে ঢুকতে পারছে না। শানবাহাদুরের মায়া হল। সে কাছে এগিয়ে গেল। মতিলাল তাকে দেখে অবাক। শানবাহাদুর। হাসল, আবার দেখা হয়ে গেল ভাই।

না। তুমি আমার পিছন পিছন এসেছ। মতিলাল রেগে গেল।

আহা! রাগ করছ কেন? আমি তো তোমার উপকারেও লাগতে পারি।

আমার কোনও দরকার নেই। কেটে পড়ো এখান থেকে।

জিপটা কার?

কার আমি কী করে বলব?

এইসময় একটা চিৎকার ভেসে এল। ওরা দেখল বিপরীত দিক থেকে একটি যুবতী। ছুটে আসছে। যুবতী সুন্দরী নয়, কিন্তু স্বাস্থ্যবতী। মতিলাল অস্বস্তিতে পড়ল।

যুবতী কাছে এসে মতিলালের হাত ধরল, ওমাঃ, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাড়িতে চলুন।

মতিলাল বলল, এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাই কথা বলছিলাম।

তাই? যুবতী শানবাহাদুরের দিকে তাকাতেই সে ঘাড় নেড়ে না বলল।

কেন মিছিমিছি দুঃখ পেতে এখানে আসেন আপনি? জানেন তো রোজ এইসময় বলরামদা জিপ নিয়ে এখানে আসে। যুবতী বিষণ্ণ গলায় বলল।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। কথাটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল মতিলাল।

মোটেই ঠিক নেই। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। দিদি আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। নিজে আপনাকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে বসে বলরামদার সঙ্গে প্রেম করবে তার বেলা দোষ নেই, আর আমি একটু থেমে গেল যুবতী।

শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেলে ভালো করতে না? মতিলাল জিজ্ঞাসা করল।

ঝি-এর মতো খাটাবে। বড় ভাই-এর বিধবা বউকে কে পুষতে চায়? তা ছাড়া, আমার কথাও তো ভাবতে হবে। কী-বা বয়স আমার। যুবতী ঠোঁট ফোলাল।

এসব কথা একটা বাইরের লোকের সামনে থোক চাইছিল না মতিলাল। সে সস্নেহে বলল, মানু, যাও, ভেতরে যাও।

ঠিক তখনই বাড়ির সদর দরজা খুলে গেল। ওরা দেখল বলরাম বেরিয়ে এল, পেছনে সুভদ্রা। শকুনের চোখ বলতে হয়, সেখান থেকেই দেখতে পেয়ে চিৎকার শুরু করল সুভদ্রা। অ, তুই ওই মিনসেকে ডেকে এনেছিস? এত বড় স্পর্ধা। মায়ের পেটের বোন হয়েও তুই আমাকে চাকু মারতে চাস। আর তুমিও কেমন পুরুষ? সুড়সুড় করে চলে এলে?

মতিলাল রেগে গেল। আচ্ছা নির্লজ্জ মেয়েছেলে! সে চিৎকার করল, আমাকে কেউ এখানে ডেকে আনেনি। মিছিমিছি তুমি সুজাতাকে দোষ দিচ্ছ!

ইস! দরদ যে উথলে পড়ছে। অল্পবয়সের শালি পেয়ে নোলা ঝরছে! চিৎকার করল সুভদ্রা। এবার তাকে থামাতে যেন বলরাম কিছু বলল। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সুভদ্রা বলল, তুমি চুপ করো। আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে না।

শানবাহাদুর চাপা গলায় মন্তব্য করল, এ যে আমার বউ-এর এক কাঠি ওপরে।

কিন্তু ততক্ষণে ওপরে একটা ঘটনা ঘটে গেল। বলরামকে ধমকানো মাত্র সে ঘুরে চড় মারল সুভদ্রার গালে। সুভদ্রা পড়তে-পড়তে সামলে নিল। মতিলাল দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। সুজাতা চাপা গলায় বলল, দিদি আর চেঁচাবে না।

ওরা দেখল মার খেয়ে সুভদ্রা চোখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। বলরামকে এবার একটু অপ্রস্তুত দেখাল। সে হাত ধরে সুভদ্রাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আর সুভদ্রাও সুড়সুড় করে অনুসরণ করল তাকে।

সুজাতা এবার হাসল, দিদিকে আপনি কখনও মেরেছেন?

না, কখনও না। কেউ বলতে পারবে না ও কথা। প্রতিবাদ করল মতিলাল।

ওইটাই ভুল করেছেন।

মানে?

বলরামদার হাতে মার খেলে দিদি কেঁচো হয়ে যায়। তখন খুব ভালোবাসে।

সে কি?

হ্যাঁ। যারা মুখে চেঁচায় তাদের ওষুধ ওটা।

শানবাহাদুর কান খাড়া করে শুনছিল। হঠাৎ সে সোজা হয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। তার এভাবে চলে যাওয়াটা অবাক করল ওদের। সুজাতা বলল, আপনার বন্ধু কিছু না বলে চলে গেল কেন?

মতিলাল মাথা নাড়ল, কী জানি?

আপনি আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

তোমার দিদির সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।

এখন কোনও চান্স নেই। হাসল সুজাতা, মার খেয়েছে, এবার আদর খাবে।

মাথা গরম হয়ে গেল মতিলালের, তুমি জানো এটা বেআইনি। এখনও ও আমার বউ।

মোটেই না। সবাই জানে আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

ছাড়াছাড়ি হলে ও আমার কাছে যায় কেন? প্রতিমাসে আমার কাছে টাকা নেয় কেন?

নরম মাটি পেলে সবাই আঁচড়ায়। আপনার ঘরে আবার বউ এলে ও কি বারবার সেখানে যেত? আপনি শোক-শোক মুখ করে পড়ে থাকেন বলেই যায়! সুজাতা হাসল।

মতিলাল ভেবে পাচ্ছিল না তার কী করা উচিত। যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা তা বলরাম চলে না যাওয়া পর্যন্ত করা যাবে না। আবার নিজের বউ তার বন্ধুর সঙ্গে চোখের সামনে। ঘরের দরজা বন্ধ করে আছে এমন দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব। সে বলল, আমি যাচ্ছি।

কী বলতে এসেছিলেন দিদিকে?

বলতে না, করতে! দৃঢ় গলায় বলল মতিলাল।

করতে মানে? হাঁ হয়ে গেল সুজাতা।

সাহায্য করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে এখন তার কোনও দরকার নেই।

তার মানে?

এখন তোমার দিদির যে সর্বনাশই হোক না কেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না।

আপনি মনের কথা বললেন না।

বিশ্বাস করো সুজাতা, আমি আর পারছি না।

আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।

তোমার দিদি আমাকে ছেড়ে এখন বলরামের সঙ্গে, উঃ।

যে দিন চলে গেছে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখতে পারবেন? অতীত ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকান আপনি। কী করতে এসেছিলেন বলুন।

কিন্তু কিন্তু করেও না বলে পারল না মতিলাল, তোমার দিদি আজ দুপুরে আমার ওখানে গিয়ে অনেক গালমন্দ করে আমার কেনা মুদির দোকানের জিনিসপত্র একটা তিব্বতি ব্যাগে পুরে নিয়ে এসেছে এখানে। ওই ব্যাগটা আমার চাই, জিনিসপত্র সমেত।

ব্যাগটা দিদির ঘরে। এখন তো পাওয়া যাবে না।

তুমি ওকে ব্যাগটা নিয়ে ফিরতে দেখেছ?

হ্যাঁ। বলল, চা-চিনি আছে। আর তখনই বলরামদা এসে গেল বলে দিদি ব্যাগটা ঘরের কোণে রেখে দিয়েছে।

জিনিসপত্র বের করেনি?

না। কিন্তু আপনি সর্বনাশ থেকে বাঁচার জন্যে সাহায্য করতে এসেছিলেন, বললেন। ওই ব্যাগটা ফেরত আনলেই সেটা হবে?

না। জিনিসপত্র সমেত ব্যাগটা নিয়ে আসতে হবে। তুমি যেমন করেই হোক কেউ ওর ভেতরে হাত দেওয়ার আগেই সরিয়ে ফেলে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে? প্লিজ! মতিলাল কাতর গলায় বলল।

কী আছে ব্যাগের ভেতরে?

বলব। সব বলব। আগে তুমি ব্যাগটাকে নিয়ে এসো।

ঠিক আছে। আপনি বাড়ি চলে যান। আমি চেষ্টা করব নিয়ে যেতে। সুজাতা বলল।

.

পরনে জিন্স আর জ্যাকেট, গলায় সিল্কের মাফলার, মাথায় আঁটা টুপি, পা ফেলছিল সে হিন্দি ছবির নায়কের মতো। এই ভর বিকেলেও তার চোখ রোদ চশমার আড়ালে। দার্জিলিং এ মেঘ না থাকলেও এমনসময় রোদের গায়ে তুলতুলে আনন্দ থাকে, চোখ ঢাকার প্রয়োজন। হয় না। তবু সে চোখ ঢেকে রেখেছিল।

ভানুভক্তের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে সে সতর্কভাবে চারপাশে তাকাল। না, সন্দেহজনক কাউকে নজরে পড়ছে না। এখন ট্যুরিস্ট মরশুম। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাল ভরে আছে প্রচুর আদেখলে বাঙালিতে। প্রথম-প্রথম মজা লাগত, এখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। রোগা খচ্চরের ওপর চল্লিশে পা দেওয়া আমাশা রুগি বাঙালিবাবু তার বেঢপ বউকে কোনওরকমে তুলে ক্যামেরা বাগিয়ে ধরছে ছবির জন্যে। আটপৌরে বউ-এর পরনে ধার করা প্যান্ট যা শরীরটাকে আরও কিস্তৃত করে তুলেছে। কিন্তু লোকগুলোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে চাঁদের মাটিতে সবে পা দিচ্ছে। এই দৃশ্য এখানে রোজ কতবার কতভাবে অভিনীত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখতে পেল থাপাকে। এমন হারামি পুলিশ অফিসার দার্জিলিং-এ এর আগে কখনও আসেনি। কাউকে কেয়ার করে না। এমনকী এম পি সাহেবের চিঠিকেও পাত্তা দেয়নি একবার। আজ দুপুরে খবর এল থাপার লিস্টে তার নাম উঠেছে। অস্ত্র সমেত তাকে ধরতে পারলে চামড়া ছাড়িয়ে নেবেই। আর খবরটা পাওয়ার পর হঠাই লোকটার মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল সে। খুব জোরে কেটে পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছিল। বাজারে। নামবার সময় এমন নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল যে পিস্তলটাকে ফেলে দিয়েছিল সিঁড়ির কোণে। পরে যখন বুঝতে পারল থাপা তার পিছু নেয়নি, তখন আফসোস হয়েছিল খুব। ছুটে গিয়েছিল সিঁড়ি ভেঙে। আশ্চর্য, এরই মধ্যে হাওয়া হয়ে গিয়েছে পিস্তল।

এখন এখানে একটা পিস্তল জোগাড় করতে বেশি কসরত করতে হয় না। কিন্তু টাকা লাগে। কিছু টাকা ফালতু খরচ হবে। সে দেখল থাপা চারপাশে তাকাতে তাকাতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এখন এখান থেকে কেটে পড়ার চেষ্টা করা বোকামি। সে চেষ্টা করল সহজ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে। পাশ দিয়ে যেতে-যেতে থাপা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটা তাকে দেখছে। এখনও পর্যন্ত পুলিশের খাতায় দাগি হিসেবে তার নাম ওঠেনি। সন্দেহভাজন হিসেবে যে লিস্ট ও তৈরি করেছে তাতে উঠলেও উঠতে পারে।

বহুৎ আচ্ছা! চাপা গলায় বলল থাপা।

এবার তাকাতেই হয়। সে মুখ ফিরিয়ে হাসল, ইয়েস স্যার!

নামটা যেন কী?

প্রদীপ, প্রদীপ গুরুং।

আজ দুপুরে তোমার সঙ্গে কি আমার দেখা হয়েছিল?

না, স্যার, আমি তো আপনাকে দেখিনি।

তুমি জানো আমি কে?

ইয়েস স্যার। আপনি দার্জিলিং থানার ওসি।

কী করে জানলে? কোনও ভদ্রলোকের ছেলে পুলিশ অফিসারকে চিনতে পারে না।

আমার বাবা কিন্তু ঠিক ভদ্রলোক নয়।

তার মানে?

বাবা ব্যবসা করে। ইধার কা মাল উধার। দো-নম্বরি।

আচ্ছা। কী নাম তার?

জি, নরবাহাদুর গুরুং।

আচ্ছা। তোমার এই ওপিনিয়নের কথা নরবাহাদুরজি জানেন?

হা স্যার।

তুমি আর একঘণ্টা পরে থানায় এসো।

থানায়? কেন স্যার?

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না থাপা। ছোট ছড়ি হাতে হেঁটে চলে গেল ম্যালের ওপাশে। প্রদীপ ঠোঁট কামড়াল। বেশি কথা বলা হয়ে গেল। এখন কী করবে? থানায় গেলে থাপা তাকে নির্ঘাৎ পুরে দেবে গারদে। ঘুমের রাস্তায় তিন-তিনটি জিপ রবারি হয়ে গেছে। পুলিশ কারও নাম পায়নি। পেতে কতক্ষণ? একঘণ্টা অনেক সময়। তার আগে ঘুরে আসতে হবে। প্রদীপ এগিয়ে গেল অজিত ম্যানসনের পেছনের দিকে। মডার্ন টেলার্সের সামনে দাঁড় করানো তার মোটরবাইকটায় উঠে স্টার্ট দিল। তারপর তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেল লেবং রেসকোর্সের দিকে।

টিবেটিয়ান রিফুজিস সেন্টার ছাড়িয়ে আর একটু এগিয়ে ডানদিকের কঁচা পথ দিয়ে মোটরবাইক তুলতেই সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল, পরম আনন্দ। আরও একটু যেতে ছোট ব্যারাকবাড়ি আর তার সামনের চিলতে মাঠ নজরে এল। মোটরবাইকের আওয়াজ কানে যেতেই ব্যারাক থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে এল জনা কুড়ি বাচ্চা ছেলে। স্টার্ট বন্ধ করতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রদীপের ওপর। কেউ বাইকে উঠে বসল, কেউ ওর কাঁধে। সবচেয়ে পুচকেটাকে কাঁধে নিয়ে প্রদীপ বাইক থেকে নামল। বাচ্চাগুলো তখন চেঁচাচ্ছে, বাইক-আঙ্কল জিন্দাবাদ, বাইক-আঙ্কল জিন্দাবাদ। প্রদীপ ধমকাল, আরে, চুপ, একদম চুপ। আমি তোমাদের বাইক-আঙ্কল নই, শুধু আঙ্কল। তা আজ পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো সবার?

সবাই একসঙ্গে হ্যাঁ বলল। প্রদীপ বলল, তা হলে একটা গান শোনাও।

সঙ্গে-সঙ্গে বাচ্চারা শোলে ছবির গান ধরল, এ দোস্তি।

প্রদীপ ওদের সঙ্গে গলা মেলাতে-মেলাতে দেখল মিসেস এভার্ট বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রমহিলার মুখ স্বাভাবিক নয়। এই আমেরিকান মহিলা একা কারও কোনও সাহায্য ছাড়া এইখানে হোম বানিয়েছেন পিতৃপরিচয়হীন অসহায় ছেলেগুলোকে মানুষ করার জন্যে। ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছে। দুজন সহকারিনীকে নিয়ে উনি যা পরিশ্রম করেন তা দেখে শ্রদ্ধায় মন ভরে যায়। তিন-তিনটে জিপ লুঠের অর্ধেক টাকা প্রদীপ ওঁর হাতে তুলে দিয়েছে হোমের খরচ চালানোর জন্যে। অবশ্য সে বলেনি টাকাগুলো কী করে পাওয়া গেল।

গান শেষ হওয়া মাত্র প্রদীপ মিসেস এভার্টের সামনে গিয়ে মাথা নাড়ল, গুড ইভনিং।

গুড ইভনিং প্রদীপ।

আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনও সমস্যায় পড়েছেন।

সমস্যা ছাড়া তো জীবন নয়।

আমাকে বলুন, যদি কিছু সাহায্য করতে পারি।

না। এটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে। অনলি গভর্নমেন্ট ইচ্ছে করলে পারে। আমি এম পি-র কাছে গিয়েছিলাম, দরখাস্ত দিয়ে এসেছি।

আপনার কি সমস্যার কথা বলতে আপত্তি আছে?

না। এই যে বাড়ি, মাঠ, এসবের জন্যে আমি প্রতিমাসে আড়াইশো টাকা ভাড়া দিই। এ নিয়ে কখনও কোনও ট্রাবল হয়নি। হঠাৎ মিস্টার প্রধান আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি এইসব জমি-জায়গা বিক্রি করে দিচ্ছেন একজন ব্যবসায়ীকে যিনি এখানে ফ্যাক্টরি খুলবেন। আমাকে উঠে যাওয়ার নোটিস দিয়েছেন উনি।

তারপর?

আমি কোথায় যাব এতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে? আমি ওঁর কাছে অ্যাপিল করলাম। উনি বললেন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে মাড়োয়াড়িকে সম্পত্তিটা বিক্রি না করে আমাকে দিতে পারেন। কিন্তু অত টাকা একসঙ্গে আমি পাব কোথায়? অসম্ভব। তাই সরকারকে লিখেছি যদি তাঁরা সাহায্য করেন।

পঞ্চাশ হাজার টাকা?

ইয়েস।

কোন মাড়োয়াড়ি এই জমিটা নিচ্ছে?

জানি না। এইসব ফুলের মতো বাচ্চাদের নিয়ে আমি কোথায় যেতে পারি তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।

আপনার হাতে আর কতদিন সময় আছে?

তিনমাসের একটু কম সময়। তার মানে–

ঠিক আছে। আমি আপনার সঙ্গে সাতদিন পরে দেখা করব। ততদিন আপনি কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।

এ ব্যাপারে তুমি কী করতে পারো প্রদীপ?

এই বাচ্চাগুলোর জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি ম্যাডাম।

দেখো এমন কিছু করো না যাতে ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হন। আগামীকাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, একটা ভালো খবর কাল পাব।

তাহলে তো ভালো কথা। কিন্তু সেটা না হওয়া পর্যন্ত আজকাল আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আচ্ছা, আজ আমি আসছি।

ম্যাডামের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া যত সহজ, শিশুদের কাছ থেকে তত কঠিন। তবু খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রদীপ বাইক চালু করল। আর মিনিট দশেক সময় আছে। থাপা বলে গেছে এক ঘণ্টার মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করতে। সে কঁচা পথটা ধরেই যে গতিতে বাইক চালাচ্ছিল তাতে আচমকা ব্রেক কষে থামানো মুশকিল। এখন এই সন্ধে হয়ে আসার সময়ে পথ পরিষ্কার থাকার কথা। কিন্তু বাঁক ঘুরতেই সে দেখতে পেল রাস্তা বন্ধ। দুটো জিপ ঠিক পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এখন ব্রেক করলে ছিটকে যেতে হবে। পাশ দিয়ে রাস্তা নেই যে কাটিয়ে যাবে। মরিয়া হয়ে জিপের কাছে এসে সামনের চাকা ঝাঁকুনি দিয়ে ওপরে তুলল সে। বাইকে গতি এমন প্রবল ছিল যে বাইক উঠে গেল জিপের বনেটে এবং ছাদ ছুঁয়ে লাফিয়ে পড়ল ওপাশের পথে। পড়ার সময় ব্যালেন্স হারাতে-হারাতেও সামলে নিল প্রদীপ। এখন বাইক থামিয়ে ঘুরে গিয়ে লোকগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, কিন্তু সময় নষ্ট হবে তাতে। প্রদীপ শুন্য রাস্তা ধরে দার্জিলিং থানার দিকে বাইক ছোটাল।

এরকম একটা দৃশ্য দেখবে জিপের আরোহীরা কল্পনা করেনি। ওরা ভেবেছিল সামনে বাধা দেখে বাইক থেমে যাবে। কিন্তু ওটা যে গতি বাড়িয়ে সার্কাসের খেলা দেখাবে তা কে জানত। অথচ ওই লোকটাকে ধরতেই তারা এসেছিল। ওদের বস-এর কাছে খবর গেছে একমাত্র একটি বাইকে করা আসা লোকের সঙ্গেই হোমের ম্যাডামের সংযোগ আছে। সেই লোক প্রত্যেক। সপ্তাহে অন্তত দু-দিন হোমে আসে। সরকারি মহল নিয়ে বস চিন্তা করে না। এই ছেলেটি কে, কী তার পরিচয়–বের করার দায়িত্ব দিয়েছিল ওদের ওপর। কিন্তু লোকটা যে এমন সার্কাস দেখাবে তা ওরা অনুমান করেনি।

আধঘণ্টা বাদে জলাপাহাড়ের রাস্তায় একটি সুন্দর বাংলো বাড়ির বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে বস্ যখন কাহিনিটা শুনল তখন তার মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটল, তোমরা কজন ছিলে ওখানে?

স্যার, চারজন।

চারজন যখন একজনকে আটকাতে পারোনি তখন তোমাদের যে টাকা দেওয়া হয়ে থাকে তা ওকে দেওয়া যায়। কী বলো? আমি ঠিক বলছি কি না? বস একটুও উত্তেজিত নয়।

.

ঠিক সেই সময় থাপার সামনে ভদ্রলোকের মতো বসেছিল প্রদীপ।

নরবাহাদুর গুরুং তোমার বাবা?

ইয়েস স্যার।

কিন্তু তিনি সম্পর্কটা অস্বীকার করেছেন।

মানে?

আমি একটু আগে তাকে টেলিফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, ওই নামে তার এক ছেলে ছিল কিন্তু এখন সে মৃত। তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন তিনি।

একথা বাবাই বলতে পারেন।

কেন একজন বাবা ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন?

প্রদীপ মুখ তুলল, স্যার, এর জবাব উনি দিতে পারবেন।

তুমি কোথায় থাকো?

লা ডেন লা রোডে।

কোন বাড়িতে?

পোস্ট অফিসের নিচে।

কী করো তুমি?

টুকটাক বিজনেস।

দু-নম্বরি?

না স্যার। ওটা পারলে তো বাবার সঙ্গেই থাকতে পারতাম।

প্রদীপ গুরুং। আমি চাই না দার্জিলিং-এ কোনও গোলমাল হোক!

আমিও চাই না স্যার।

কয়েকদিন আগে ঘুমের রাস্তায় তিনটে ডাকাতি হয়েছে। প্রায় তিরিশ হাজার টাকার কমপ্লেন আছে। এ ব্যাপারে তুমি কিছু জানো?

স্যার।

এত তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে হবে না। ভেবে দ্যাখো। আমি কাউকে ধরতে পারিনি বটে কিন্তু বর্ণনা পেয়েছি। তার একজনের সঙ্গে তোমার বেশ মিল আছে।

ফাঁদটা এগিয়ে আসছে। প্রদীপের শরীর শিরশির করে উঠল।

আমি এখনই তোমাকে কিছু বলছি না। ইচ্ছে করলে তোমাকে দুরমুশ করে সব কথা বের করে নিতে আমি জানি। সেটা পরে করা যাবে যদি তুমি নিজে থেকে না বলো। থাপার কথা শেষ হওয়ামাত্র টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলার পর থাপার মুখ উজ্জ্বল হল, ইয়েস, অ্যাঁ? আচ্ছা! কী রকম দেখতে? আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। হ্যাঁ, আপনি কমপ্লেন করছেন না? ঠিক আছে, ঠিক আছে! রিসিভার নামিয়ে রেখে থাপা সরাসরি তাকাল, ম্যাল থেকে বেরিয়ে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করতে।

কোথায়?

পরম আনন্দ-এ।

ওখানে তোমার কী দরকার?

হোমের বাচ্চাদের আমি ভালোবাসি।

সত্যি কথা বলছ না এর মধ্যে দুনম্বরি কিছু আছে?

আমি দু-নম্বরি কাজ করি না।

আস্তে কথা বলো। কেউ চেঁচিয়ে কথা বললে আমার মাথা ঠিক থাকে না।

আই অ্যাম সরি স্যার।

মাটি থেকে উঁচুতে বাইক তুলতে পারো?

অবাক চোখে থাপাকে দেখল প্রদীপ। এর মধ্যে লোকটার কাছে খবর এসে গেল? সে হাসার চেষ্টা করল, ইচ্ছে করলেই যে পারব তা নয়, হঠাৎ-হঠাৎ হয়ে যায়।

শোনো, প্রদীপ, আজ সকালে তোমার কাছে একটা বেআইনি রিভলভার ছিল?

না স্যার, রিভলভার ছিল না।

আমার লোক বলছে ছিল। কিন্তু ওটা যদি আবার তোমার কাছে ফিরে আসে তাহলে তোমাকে আমি পুঁতে ফেলব। কথাটা মনে রেখো। আমি তোমাকে দেখা করতে বলছিলাম যে কারণে সেটা আর প্রয়োজন হবে না।

কারণটা কী ছিল স্যার?

যখন প্রয়োজন হবে না তখন তোমাকে বলে আমার লাভ নেই।

থাপা হাত নাড়ল, তোমাকে আর-একটা কাজ দিতে পারি। কিছু রোজগার হতে পারে তোমার।

রোজগার হলে আমি রাজি স্যার।

একটা কাগজে ঠিকানা, নাম লিখে এগিয়ে দিল থাপা, এঁর সঙ্গে আজই দেখা করো। উনি তোমাকে খুঁজছেন, তোমারও উপকার হবে।

নাম-ঠিকানা পড়ল প্রদীপ। বিখ্যাত মানুষ। এই শহরে একে চেনে না এমন কেউ নেই।

ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।

স্যার। একটা রিকোয়েস্ট ছিল।

থাপা তাকাল। প্রদীপ বলল, পরম আনন্দ যিনি চালান তাঁকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন। অমন মানুষ হয় না। বাচ্চাগুলোও খুব ভালো। কিন্তু হোমের বাড়িটা যাঁর, তিনি বিক্রি করে দিচ্ছেন একজনকে। সেই লোকটা ফ্যাক্টরি বানাবে ওখানে। এর ফলে ওই বাচ্চাগুলোর মাথা গোঁজার জায়গা থাকবে না। আপনি ওদের বাঁচান স্যার।

ওই সম্পত্তি কার?

মিস্টার প্রধানের।

কেউ যদি তার পার্সোনাল প্রপার্টি বিক্রি করে দিতে চায় তা হলে আইন বাধা দিতে পারে না।

আমি জানি স্যার। শুধু মানবিকতার কারণে যদি কিছু করা যায়।

তোমার এতে কী স্বার্থ?

বাচ্চাগুলো আমাকে ভালোবাসে!

অদ্ভুত। তাহলে মিসেস এভার্টকে বলো প্রধানের কাছ থেকে সম্পত্তিটা কিনে নিতে।

হোমের সেই সামর্থ্য নেই। জনসাধারণের দানের ওপর হোম চলে।

তোমার যখন এত দরদ তখন তুমি কিনে নিয়ে হোমকে দান করে দাও।

টাকাটা আমার পক্ষে অনেক।

থাপা কাঁধ নাচাল, সরি প্রদীপ, আমার পক্ষে এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করা সম্ভব নয়। কেউ আইন ভাঙলে আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি কিন্তু–। ওয়েল, গুডবাই।

বাইরে বেরিয়ে এসে প্রদীপ দেখল দার্জিলিং শহরে ইতিমধ্যেই সন্ধের অন্ধকার ঘন হচ্ছে। একটু বাদেই কুয়াশারা নামবে দল বেঁধে, রাস্তা ভালো করে দেখা যাবে না। থাপার লেখা কাগজটা ওর হাতের মুঠোয় ছিল। সেটাকে পকেটে পুরে বাইক চালু করল সে। তারপর হেডলাইট জ্বেলে ছুটে গেল জলাপাহাড়ের পথে। ম্যাল পেরিয়ে ঘোড়ার আস্তাবলের কাছে এসে গতি কমাতেই সে ডাকটা শুনতে পেয়ে বাইক থামাল। দৌড়ে কাছে এল লিটন। বেঁটে, কিন্তু শরীরে ভালো শক্তি। মাথায় বুদ্ধি পুরোপুরি নেই। লিটন বলল, কোথায় থাকো? সারাদিন খুঁজে বেড়াচ্ছি!

কেন?

তোমার পিস্তল হাওয়া হয়ে গেছে?

তোকে কে বলল?

আগে বলল, হ্যাঁ কি না?

হাওয়া হয়নি। থাপার হাত থেকে বাঁচার জন্য সিঁড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম।

বড় সিঁড়িতে তো? পরে আর পাওনি, ঠিক?

হ্যাঁ। কে বলল তোকে?

শানবাহাদুর নামে একটা লোক বাজারের পাশে ভাটিখানায় বসে এই গল্পটা সবাইকে শোনাচ্ছিল। এমনকী যে লোকটা পিস্তলটা পেয়েছিল পুলিশ তার বাড়িতেও নাকি সার্চ করতে গিয়েছিল অথচ কিছু পায়নি।

লোকটা আমার নাম বলেছে?

নাঃ। বর্ণনা দিচ্ছিল। বুড়ো ভানুপ্রসাদ সেটা শুনে এসে আমাকে বলে। শুনে আমার সন্দেহ হয়, ওটা তুমি হতে পারো!

তুই এখানে অপেক্ষা কর। আমি ঘুরে আসছি এখনই। তারপর কথা বলব। বাইক চালু করল প্রদীপ। লিটন কোমরে হাত দিয়ে ওর যাওয়া দেখল। তারপর পাশের চায়ের দোকানে। ঢুকল। প্রদীপ সম্পর্কে ওর প্রবল আস্থা আছে। ইদানীং সে প্রদীপের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকে। প্রদীপ বাঁ হাতে পিস্তল চালিয়েও লক্ষ্যভেদ করতে পারে। তিন-তিনটে ছোট অপারেশন থেকে লিটন ছয় হাজার টাকা পেয়েছে। তাই এখন প্রদীপ যে আদেশ করবে তাই তাকে শুনতে হবে। সে সিগারেট পাকাতে লাগল একমনে।

গেট বন্ধ। হেডলাইটের আলো ফেলে হর্ন দিল প্রদীপ। একটু বাদে একজন বন্দুকধারীকে দেখা গেল। এক হাতের আড়ালে চোখ ঢেকে অন্যহাতে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে আসছে।

কৌন হ্যায়?

আমার নাম প্রদীপ গুরুং। তোমার সাহেব আমাকে ডেকেছেন।

লোকটা কোনও কথা না বলে গেট খুলে দিল। ওর ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল যে এই নামের লোক যে আসবে তা জানা ছিল। বাইক নিয়ে সোজা বাংলোর সিঁড়ির সামনে চলে এল প্রদীপ। নিচে নেমে দাঁড়ানো মাত্র একটি লোক এগিয়ে এল, প্রদীপ গুরুং?

ইয়েস।

আসুন।

লোকটিকে অনুসরণ করে সে যে ঘরে ঢুকল সেটিতে আসবাব বলতে চারটে সাদা সোফা এবং একটি সাদা রঙের টেবিল। প্রদীপকে সেখানে বসিয়ে লোকটা চলে গেল। পায়ের তলায় কার্পেট। দেওয়ালে কোনও ছবি নেই। ওপাশের দরজায় ভারী সাদা পর্দা ঝুলছে। দেওয়ালের রঙও সাদা। প্রদীপ উশখুশ করছিল। থাপা তাকে বলতেই সে এখানে চলে এল। থাপা বলেছে এই লোকটা তাকে যে কাজ দেবে তা করতে পারলে রোজগার হবে। কাজটা নিশ্চয়ই দুনম্বরি কিছু হবে না, হলে থাপা তাকে এখানে পাঠাত না।

এইসময় লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দেখল প্রদীপ। এর আগে দূর থেকে সে দেখেছে। এত বড় মানুষের কাছাকাছি পৌঁছবার ক্ষমতা তার এখনও হয়নি। কাছ থেকে সাদা শার্ট, সাদা হাফস্লিভ সোয়েটার, সাদা প্যান্ট এবং সাদা চপ্পল মানুষটিকে তার বেশ সাদাসিধে বলে মনে হল। ফরসা গায়ের রঙের সঙ্গে চওড়া টাক চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। উল্টোদিকের সোফায় বসে তিনি বললেন, গুড ইভনিং।

গুড ইভনিং স্যার। আমি প্রদীপ গুরুং।

এ বাড়িতে ঢোকার সময় থেকে তো দু-দুবার নামটা বলেছেন। আমি থাপার কাছে কিছুটা শুনেছি, বাকিটা জেনে নিয়েছি। মোটর বাইক ভালো চালাতে পারেন?

এমন কিছু নয় স্যার। নম্র গলায় বলল প্রদীপ।

দু-নম্বরি করেন না কিন্তু দু-নম্বরি জিনিস রাখেন?

তার মানে?

গতকাল পর্যন্ত আপনার কাছে একটা বেআইনি পিস্তল ছিল।

এখন নেই ভাবলেন কী করে?

যন্ত্র বলে দিল আপনি কোনও অস্ত্র ছাড়া এখানে এসেছেন। গুড। আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে। আপনার মধ্যে যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে তা ছোটমাপের বেআইনি কাজ করে নষ্ট করবেন না। থাপার কাছে প্রমাণ না থাকলেও তিন-তিনটে ছিনতাই-এর কাজ আপনি এবং আপনার সঙ্গী করেছেন, এটা আমি জানি। জানি কিন্তু প্রমাণ নেই। তাই আপনি চ্যালেঞ্জ করলে কিছু বলতে পারব না। চা না কফি?

প্রদীপের হঠাৎ শীত-শীত করছিল। এই লোকটি খুব শান্ত গলায় কথা বলছেন। মুখচোখে একটুও উত্তেজনা নেই। অথচ তার সম্পর্কে যেসব কথা বলে গেলেন তা ওঁর মতো মানুষ কী করে জানলো তা ওর জানা নেই।

সে মাথা নাড়ল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

ও কে। শুনুন। আপনার মতো এনার্জেটিক ইয়ংম্যান আমি খুব পছন্দ করি। আমি আপনাকে একটা কাজ দিতে পারি। লেপার্ড দেখেছেন?

সিনেমায় দেখেছি।

হুম। ব্ল্যাক লেপার্ড।

না স্যার, রঙ মনে নেই।

এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে সিকিম-টিবেট বর্ডারের কাছে কিছু ব্ল্যাক লেপার্ড এখনও আছে বলে শোনা যাচ্ছে। খুব বিরল প্রজাতির প্রাণী। আজ সকালে তাদের দুজনকে দেখা গিয়েছে। তারা তখন যৌনমিলনে ব্যস্ত ছিল।

ইমপসিবল।

হোয়াই?

এইসব প্রাণীদের মেটিং-এর সময় সাধারণত কেউ দেখতে পায় না।

সাধারণত। কিন্তু দেখেছে। সিকিমের একটা ট্যুরিস্ট বাস ওই সময় ওই পথ দিয়ে ওখানে পৌঁছে যায়। তাদের তিনজন যাত্রী ওই দৃশ্যের ছবি তোলে। বাসটা আজই গ্যাংটকে ফিরে গেছে। যাওয়ার পথে বাসের ড্রাইভার একটা পুলিশ স্টেশনে খবরটা দিয়ে যায়। পুলিশ স্পটে গিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি।

আমাকে কী করতে হবে?

ওই তিনজন যাত্রীর নাম-ঠিকানা জোগাড় করতে হবে।

কেন?

ব্ল্যাক লেপার্ড ভারতবর্ষে নেই। আছে হিমালয়ের এই এলাকায়। এতদিন পর্যন্ত ওদের। অস্তিত্ব কেউ জানতই না। আমার হবি রেয়ার ফটোগ্রাফ কালেক্ট করা। আমি যখন জানতে পারলাম তিনজন ট্যুরিস্ট ওই ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্যের ছবি তুলেছে তখন মনে হল ছবিগুলো একমাত্র আমার কালেকশনেই থাকবে। আমার টাকা আছে তাই ছবিগুলো আমি চাইতে পারি। তিনটে সাধারণ ট্যুরিস্ট ওই ছবি তুলে বাড়ি ফিরে তাদের অ্যালবামে সেঁটে রাখবে। কিন্তু আমার কাছে। থাকলে ওগুলো অন্যমাত্রা পাবে। ওই তিনজনের খবর পেলে আমি ছবিগুলো কিনে নেব। আজ ওরা গ্যাংটকে ফিরে গেছে। হয়তো ওদের ফিল্মের রোল শেষ হতে আরও দু-একদিন লাগবে। অতএব আমি আপনাকে ওই দু-একদিন সময় দিচ্ছি। ভদ্রলোক হাসলেন।

আপনি তো ট্যুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগযোগ করলেই ওদের ঠিকানা পেতেন!

না পেতাম না। গ্যাংটকে সাইট সিয়িং টুর করে অন্তত পনেরোটা নামী কোম্পানি। এ ছাড়াও আনরেজিস্টার্ড কোম্পানি আছে। যারা ডেইলি টিকিট কিনে ওইসব বাসে ওঠে তারা নিজেদের ঠিকানা কোম্পানিকে দেয় না, কোম্পানি সেটা চায়ও না।

বুঝলাম। কিন্তু আমি ওদের কী করে খুঁজে বের করব?

সেটা আপনার সমস্যা।

এর জন্যে আমি কত টাকা পারিশ্রমিক পাব?

পাঁচ হাজার টাকা।

ওই তিন ক্যামেরায় তোলা ছবির দাম আপনার কাছে তিন হাজার?

নো। নট দ্যাট। হয়তো ওদেরও আলাদা টাকা দিতে হবে।

সেইজন্যে আপনার বাজেট জানতে চাইছি।

ধরুন, ছয় হাজার।

আমার পক্ষে কাজটা করা সম্ভব নয়।

কারণ?

অত কম টাকার জন্যে এমন ঝামেলা।

কত টাকা হলে কাজটা করতে পারবেন?

পঞ্চাশ হাজার।

মাই গড! আর ইউ ম্যাড?

নো স্যার। ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্য পৃথিবীতে আর কারও কাছে আছে কি না জানি না। না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে আপনি ছবিগুলোর বিনিময়ে কয়েক লক্ষ টাকা রোজগার করবেন! আমি কি পাগলের মতো কথা বলছি?

পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে আপনি কী করবেন?

সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি ইয়ংম্যান। প্রধানের জমিটার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাই তো! বেশ, ইটস এ ডিল। ছবিগুলো নিয়ে আসতে পারলে আপনি প্রধানকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে হোমের নামে জমি ট্রান্সফার করতে পারবেন। আর এই নিন, তিন হাজার টাকা। এটা আপনার ইনসিডেন্টাল এক্সপেন্স। পকেট থেকে তিরিশটা একশো টাকার নোট বের করে প্রদীপের সামনে রেখে ভদ্রলোক গলা পাল্টালেন, এবার কাজের কথায় আসি। জায়গাটা এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে হলেও গ্যাংটক থেকে মাইল পনেরো উত্তরে। এর খুব কাছাকাছি জনবসতির নাম টিংলা। টিংলা পর্যন্ত একটা বাস যায় দিনে একবারই। যে জায়গায় ব্ল্যাক লেপার্ড দুটোকে দেখা গিয়েছিল তার বর্ণনা আমি পাইনি। সেটা আপনাকেই উদ্ধার করতে হবে। আর এর জন্যে আপনি দুদিন সময় পাবেন।

সরি স্যার। আগামীকাল গ্যাংটক পৌঁছতেই দুপুর হয়ে যাবে। আমি অন্তত তিনদিন সময় চাইছি। তিনটে পুরো কাজের দিন। টাকাগুলো তুলে নিল প্রদীপ।

ভদ্রলোক পকেট থেকে কার্ড বের করলেন, এইটে আমার নিজস্ব টেলিফোন। আমি না থাকলে রেকর্ডার আপনার পাঠানো ম্যাসেজ রেকর্ড করে রাখবে।

ও কে স্যার। প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোক হাসলেন। মাথা নেড়ে প্রদীপ যখন দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছে তখন ভদ্রলোক বললেন, আমি এক প্রোডাক্টে বিশ্বাস করি। চেষ্টা করেছিলাম তবু হয়নি এসব কথার কোনও মূল্য আমার কাছে নেই।

প্রদীপ নীরবে মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress