কানু কহে রাই
ছোটনাগপুরের একটি বড় শহর হইতে যে পাকা রাস্তাটি ষাট মাইল দূরের অন্য একটি বড় শহরে গিয়াছে সেই রাস্তা দিয়া একটি মোটর গাড়ি চলিয়াছে। শীতান্তের অপরাহ্ন, বেলা আন্দাজ তিনটা। রাস্তার দুপাশে অসমতল জঙ্গল, কোথাও ঘন কোথাও বিরল, দূরে দূরে পাহাড়ের ন্যুজপৃষ্ঠ দেখা যায়। দৃশ্যটি নয়নাভিরাম, বাতাসের আতপ্ত শুষ্কতা স্পৃহনীয়।
মোটর মন্দগতিতে চলিয়াছে, ত্বরা নাই। স্টীয়ারিঙের উপর দুই অলস বাহু রাখিয়া মোটর চালাইতেছে একটি যুবতী। পরিণত-যৌবনা, বয়স অনুমান পঁচিশ। মুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের উপর প্রসাধনের নৈপুণ্য মুখখানিকে আরও চিত্তাকর্ষক করিয়া তুলিয়াছে। চোখে হরিদাভ মোটর-গগল, পরিধানে কাশ্মীরী পশমের শাড়ি ও ব্লাউজ। সর্বোপরি সর্বাঙ্গ জড়াইয়া একটি আমন্থর আত্ম-প্রসন্নতা।
যুবতীর নাম মমতা। মোটর যে-শহরের দিকে চলিয়াছে, সেই শহরের ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ভৌমিক তাহার স্বামী। সে যে-শহর হইতে ফিরিতেছে সেখানে তাহার মামার বাড়ি, সে মামার বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য বেড়াইতে গিয়াছিল, এখন স্বামিগৃহে ফিরিতেছে।
তাহার পাশে বসিয়া আছে তাহার মামাতো বোন সতী। বয়সে তাহার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট, দেখিতে তাহার মতো সুন্দরী নয়, কিন্তু শ্ৰী আছে। চোখদুটি চপল, অধর চটুল; সহজেই হাসিতে পারে। বেশভূষার বিশেষ পার্থক্য নাই, প্রসাধনের মধ্যে ভুর মাঝখানে সিঁদূরের টিপ, গালে রুজের একটু আভাস। সতীর বাবা লন্ডনে হাই কমিশনারের অফিসে বড় চারে; সতী সেই সূত্রে দুই বছর বিলাতে ছিল, সম্প্রতি ফিরিয়াছে। বর্তমানে সে মমতার সঙ্গে ভগিনীপতির গৃহে বেড়াইতে যাইতেছে।
গাড়িতে আর কেহ নাই। পিছনের আসনে দুজনের ফার কোট, হ্যান্ডব্যাগ, দুটা বিলাতি কম্বল; গাড়ির পশ্চাদ্ভাগে খোলের মধ্যে দুটা স্যুটকেস ইত্যাদি।
গাড়ি স্বচ্ছন্দ গমনে চলিয়াছে। দুই বোনে বিশ্রম্ভালাপ করিতেছে; সতীই বেশী কথা বলিতেছে, মমতা সায় উত্তর দিতেছে।
সতী একসময় বলিল—আমিই কেবল বলে চলেছি, তুই চুপটি করে আছিস। এবার তুই কথা বল, আমি শুনি।
মমতা আলস্যভরে বলিল—আমার বলার কিছু থাকলে তো বলব। তুই দুবছর বিলেতে থেকে এলি, কত নতুন জিনিস দেখলি, তা বিলেতের কথা তো কিছুই বলছিস না।
সতী বলিল—কি বলব? বিলেত দেশটা মাটির, মানুষগুলো আমাদেরই মতো, কেবল রঙ কটা।
আর কিছু বলবার নেই?
বলবার অনেক আছে, কিন্তু সেগুলো প্রশংসার কথা নয়। বিচ্ছিরি দেশ ভাই, আমার একটুও ভাল লাগেনি। এত মানুষ চারিদিকে যে মনে হয় যেন গিজগিজ করছে, একটু নিরিবিলি নেই কোথাও।
তা সভ্য দেশে মানুষ থাকবে না তো কি বাঘ ভাল্লুক থাকবে? আমি তো বাপু মানুষ না হলে একদণ্ড টিকতে পারি না, প্রাণ পালাই পালাই করে।
সতী হাসিল—তোর কথা আলাদা, তুই হলি সভ্য মানুষ। আমি একটু জংলী আছি। মানুষের সঙ্গ যে একেবারে ভাল লাগে না তা নয়, কিন্তু নিরিবিলিও চাই। এই দ্যাখ দেখি কি সুন্দর দেশের ভেতর দিয়ে আমরা চলেছি। কোথাও মানুষের চিহ্ন নেই; মাথার ওপর সূর্য, মিঠেকড়া বাতাস, চারিদিকে জঙ্গল। এমন দৃশ্য বিলেতে কোথাও নেই।
মমতা বলিল—গরম পড়ুক তখন এ দৃশ্যের চেহারা বদলে যাবে।
সতী বলিল—তা বদলাক। মাগো, বিলেতে কি ঋতু বলে কিছু আছে? শুধু হাড়ভাঙা শীত আর পচা বর্ষা। দ্যাখ দেখি আমাদের দেশ! শীত গেলেন তো এলেন ঋতুরাজ বসন্ত। তারপর এলেন গ্রীষ্ম, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দশদিক শুদ্ধ করে নিলেন। গ্রীষ্মের পর বর্ষা এসে সব কালিঝুলি ধুয়ে দিয়ে গেলেন। অমনি এল সোনার শরৎ, তারপর হিমের আমেজ নিয়ে হেমন্ত। তারপর আবার শীত। কী সুন্দর বল দেখি, যেন ছটা ঋতু এম্রাজের তারের ওপর সা রে গা মা সাধছে।
মমতার ঠোঁটের কোণ একটু অবনত হইল—তোর কবিত্ব রোগ এখনও সারেনি দেখছি।
সতী হাসিয়া উঠিল—ও সারবার নয়। কিন্তু সত্যি বলছি দিদি, বিলেতে দুবছর ছিলুম, একটাও কবিতা লিখিনি। যখন বড্ড মন খারাপ হত তখন ঘরে দোর বন্ধ করে গান গাইতুম।
কি গান গাইতিস?
গাইতুম–ধনধান্যপুষ্পভরা, গাইতুম—কোন্ দেশেতে তরুলতা, গাইতুম— কানু কহে রাই
মমতা চকিত বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল—কানু কহে রাই?
সতী হাসিভরা মুখে খানিক মমতার পানে চাহিয়া রহিল, তরলকণ্ঠে বলিল—া।–কেন, ও গান কি বিলেতে গাইতে নেই?
মমতা একটু গম্ভীর হইয়া রহিল, শেষে বলিল—যা বলিস, গানটা কেমন যেন চাষাড়ে গোছের।
সতী বলিল—তা তো হবেই। চণ্ডীদাস যে চাষা ছিলেন। ধোপানীকে নিয়ে কি কাণ্ডটাই করেছিলেন। কিন্তু গানটি ভারি মিষ্টি ভাই।
আমার একটুও ভাল লাগে না। ড্রয়িংরুমে ও গান চলে না। একটু নীরব থাকিয়া বলিল—ওই গান গেয়েছিল বলে একজনকে বিয়ে করিনি।
সতীর চোখে উত্তেজনাপূর্ণ কৌতূহল নৃত্য করিয়া উঠিল—ওমা, তাই নাকি! আমি তো কিছু জানি না। বিলেত যাবার মাস কয়েক পরে খবর পেলুম তোর বিয়ে হয়েছে। কী হয়েছিল বল না ভাই।
মোটর একটানা গুঞ্জন করিতে করিতে চলিয়াছে। মমতা ত্বরাহীন কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিল—দুবছর আগেকার কথা, তুই তখন সবে বিলেত গিয়েছিস। কলকাতার বাড়িতে রোজ সন্ধ্যেবেলা চার পাঁচটি যুবা পুরুষের আবির্ভাব হয়, কেউ মিলিটারি ক্যাপ্টেন, কেউ সিভিলিয়ান, কেউ শুধুই অভিজাত বংশের ছেলে। আমার কিন্তু কাউকেই ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। বাবার ইচ্ছে ক্যাপ্টেনটিকে বিয়ে করি, মার ইচ্ছে চীফ-সেক্রেটারির অ্যাসিস্ট্যান্টকে। আমি কিছু ঠিক করতে পারছি না; এমন সময় একজন এলেন। নূতন লোক, কলকাতায় থাকেন না, মাঝে মাঝে আসেন। শিক্ষিত, চেহারা ভাল, দেখে মনে হয় সিভিলাইজড় মানুষ। নাম মৌলিনাথ।
সতী বলিল—তুই বুঝি প্রেমে পড়ে গেলি?
মমতা বলিল—একটু একটু।
সতী বলিল—প্রেমে আবার একটু একটু পড়া যায় নাকি?
যায়! মনের জোর থাকা চাই। তারপর শোন। বেশ ভাব হয়ে গেল। মা বাবারও পছন্দ। বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেল। একদিন বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, মার ইচ্ছে ডিনারের পর এনগেজমেন্ট অ্যানাউন্স করবেন। ডিনারের আগে ড্রয়িংরুমে সবাই জড়ো হয়েছে। একজন অতিথি প্রশ্ন করলেন—মৌলিনাথবাবু, আপনি গান গাইতে জানেন? তিনি বললেন—জানি সামান্য। সবাই হেঁকে ধরল, একটা গান করুন। তিনি বললেন—আমি পিয়ানো বাজাতে জানি না, সাদা গলায় গাইছি। এই বলে মেঠো সুরে গান ধরলেন-কানু কহে রাই!
সতী কৌতুক-বিহ্বল কণ্ঠে বলিল—তারপর?
আমার মাথায় বজ্রাঘাত। অতিথিরা গা টেপাটেপি করে হাসছে। এ যেন একটা বোষ্টম ভিখিরি ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়েছে। আমি মাকে গিয়ে বললুম, আজ এনগেজমেন্ট অ্যানাউন্স কোরো না। —মৌলিনাথবাবু বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন। ডিনারের পর আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন—একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। আমার এখন যে রূপ দেখছেন এটা আমার ছদ্মবেশ, আসলে আমি অসভ্য মানুষ, বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। শহরে লোকজনের মধ্যে বেশী দিন থাকতে পারি না। আমাকে যিনি বিয়ে করবেন তাঁকে বনে জঙ্গলেই থাকতে হবে। আমি বললুম—তাহলে এক কাজ করুন, একটি সাঁওতাল মেয়ে বিয়ে করুন। তিনি বললেন—আপনি ঠিক বলেছেন, আচ্ছা নমস্কার।বলে সোজা বেরিয়ে গেলেন।
সতী বলিল—ভারি আশ্চর্য মানুষ তো! তারপর আর ফিরে আসেননি?
মমতা বলিল—না। এলেও আমি দেখা করতুম না। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে ইনি এলেন।
ইনি কে? ম্যাজিস্ট্রেট সায়েব?
হ্যাঁ। এক মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল।
সতী একটি গভীর নিশ্বাস ফেলিল, বলিল—নাটক বিয়োগান্ত কি মিলনান্ত বুঝতে পারছি না। দিদি, তোর মনে একটুও আপসোস নেই?
মমতা দৃঢ় ওষ্ঠাধরে বলিল—একটুও না। আমি যা চেয়েছি হাজারটার মধ্যে তাই বেছে নিয়েছি।
সতী কিছুক্ষণ বিমনা থাকিয়া বলিল—ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবকে ভালবাসিস?
মমতা বলিল—স্বামীকে যতটা ভালবাসা উচিত ততটা ভালবাসি। আর কি চাই?
কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হইল না। গাড়ি চলিয়াছে। সূর্যের রঙ ঘোলা হইতে আরম্ভ করিয়াছে।
হঠাৎ মোটরটা গোলমাল আরম্ভ করিল। এতক্ষণ বেশ অনাহতছন্দে চলিয়াছিল, এখন দুচার বার হেঁচকা দিয়া চলিতে চলিতে শেষে ইঞ্জিন বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। দুই বোন শঙ্কিত দৃষ্টি বিনিময় করিল।
সতী বলিল—এই মজিয়েছে।
গাড়িকে সচল করিবার চেষ্টা সফল হইল না। মমতা বলিল—বোধ হয় কারবুরেটারে ময়লা ঢুকেছে।
সতী বলিল—স্পার্কিং প্লাগও হতে পারে?
মমতা জিজ্ঞাসা করিল— তুই মেরামতের কিছু জানিস?
কিছু না। তুই?
আমিও না। সব দোষ ওই হতভাগা ওসমানের! ওকে বলে দিয়েছিলুম গাড়ির কলকব্জা সব দেখেশুনে রাখতে, তা এই করেছে! দাঁড়াও না, আজ বাড়ি গিয়েই তাকে বিদেয় করব।
সে তো পরের কথা। এখন বাড়ি পৌঁছুবার উপায় কি? সতী গাড়ি হইতে নামিল।
মমতা বলিল—উপায় তো কিছু দেখছি না। এক যদি এ রাস্তায় মোটর যায় তবে লিফ্ট পাওয়া যাবে। কিন্তু এ রাস্তায় যে ছাই মোটরও বেশী চলে না।
মমতা গাড়ি হইতে নামিল, চশমা খুলিয়া অত্যন্ত বিরক্তভাবে চারিদিকে চাহিল।
জঙ্গলের মধ্যে আজ রাত কাটাতে হবে দেখছি।
সতী প্রশ্ন করিল—শহর এখান থেকে কত দূর?
মমতা মাইল মিটার দেখিয়া হিসাব করিয়া বলিল—দশ-এগারো মাইল।
সতীর চোখে একটা নূতন আইডিয়ার ছায়া পড়িল, সে বলিল—দশ-এগারো মাইল! তা আয় না এক কাজ করি। এখনও বেলা আছে, এখন থেকে হাঁটতে শুরু করলে সন্ধ্যে হতে হতে শহরে পৌঁছে যাব। কি বলিস?
মমতা রাস্তার ধারে একটা পাথরের চ্যাঙড়ের উপর বসিয়া পড়িল—আমাকে কেটে ফেললেও আমি এগারো মাইল হাঁটতে পারব না।
সতী আর একটা চ্যাঙড়ের উপর বসিল—তবে তো মুশকিল। অন্য মোটর যদি না আসে। এইখানেই রাত্রিবাস করতে হবে। জঙ্গলে নিশ্চয় বাঘ ভাল্লুক আছে, আমাদের গন্ধ পেয়ে বেরিয়ে আসবে। নাঃ, আজ বেঘোরে প্রাণটা গেল।
মমতা দুহাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া রহিল। সতী ছটফট করিয়া বেড়াইতে লাগিল। একবার উঠিয়া একবার বসিয়া মোটরের কলকব্জা নাড়াচাড়া করিয়া অবশেষে আবার চ্যাঙড়ে আসিয়া বসিল।
দিদি, তোর ক্ষিদে পায়নি?
মমতা চোখ তুলিল—তেষ্টা পেয়েছে।
আমার পেট চুঁই চুঁই করছে। সঙ্গে খাবার কিছু আছে নাকি?
উঁহু। মামীমা দিতে চেয়েছিলেন, নিলুম না। ভেবেছিলুম চারটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে চা খাব।
হুঁ। সতী বনের পানে চাহিয়া রহিল।
দশ মিনিট এইভাবে কাটিবার পর সতী হঠাৎ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল—ও দিদি, দ্যাখ দ্যাখ—ধোঁয়া!
মমতা চোখ তুলিল। বনের মধ্যে আন্দাজ সিকি মাইল দূরে তরুশ্রেণীর মাথায় ধোঁয়ার একটা স্তম্ভ ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বে উঠিতেছে।
সতী বলিল—নিশ্চয় ওখানে সাঁওতালদের বস্তি আছে।—চল যাই। আর কিছু না হোক জল তো পাওয়া যাবে।
মমতা বলিল—যদি বস্তি না হয়! যদি জঙ্গলে আগুন লেগে থাকে?
দূর! আগুন লাগলে কি অমন তালগাছের মতো সোজা ধোঁয়া ওঠে। আয়—আয়—
কিন্তু—মোটর এখানে পড়ে থাকবে?
তোর ভাঙা মোটর কেউ চুরি করবে না। আয়।
এখনি কিন্তু ফিরে আসব। রাত্তিরে আমি বনের মধ্যে থাকছি না। মোটরের কাচ তুলে সারা রাত্তির বসে থাকব সেও ভাল।
ভাবিসনি একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
দুজনে গাড়ির ভিতর হইতে হ্যাণ্ডব্যাগ লইয়া গাড়ি লক করিয়া বনের মধ্যে প্রবেশ করিল। বন ক্রমশ ঘন হইয়াছে বটে কিন্তু অন্ধকার নয়। জমি উঁচু নীচু এবং শিলামিশ্রিত, মাঝে মাঝে নালার মতো খাঁজ পড়িয়াছে। দশ মিনিট হাঁটিবার পর তাহারা ধোঁয়ার উৎস মুখে উপস্থিত হইয়া হাঁ করিয়া দাঁড়াইল।
সাঁওতালদের বস্তি নয়। একটি মাত্র গৃহ। তাহাও এমন বিচিত্র যে মনে হয় ব্রহ্ম শ্যামদেশের ঙ্গেলে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
বিঘাখানেক মুক্ত স্থানে বড় বড় মহীরুহ দিয়া বেষ্টিত। মাঝখানে চত্বরের মতো একটি প্রস্তরপট্ট। প্রস্তরপট্টের সম্মুখে কয়েকটি ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের মাথা কাটিয়া কেবল স্তম্ভের মতো গণ্ডগুলিকে রাখা হইয়াছে, সেই স্তম্ভগুলির মাথায় কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটি ঘর। ঘরটি মাটি হইতে দশ বারো হাত উচ্চে, মই দিয়া উঠিতে হয়। মইটি ঘরের দ্বারের সম্মুখে লাগানো আছে।
ঘরে জনমানব আছে বলিয়া মনে হইল না। কিন্তু প্রস্তরপট্টের উপর আগুন জ্বলিতেছে, তার উপর পাথরের ঝিকে বসানো একটি প্রকাণ্ড জলের কেটলি।
সতী কিছুক্ষণ চক্ষু গোলাকার করিয়া দেখিল, তারপর করতালি দিয়া হাসিয়া উঠিল—দিদি! হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? জাপানী রূপকথা! আমরা এক দৈত্যের আস্তানায় এসে পড়েছি। দেখছিস না কত বড় কেটলিতে চা গরম হচ্ছে।
মমতা বলিল—হুঁ। কিন্তু দৈত্যটি কোথায়?
সতী বলিল-নিশ্চয় মানুষ শিকার করতে গেছে, চায়ের সঙ্গে খাবে। কিংবা হয়তো জাপানী দৈত্য নয়, আমাদের কুম্ভকর্ণ; ঘরে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। দেখব নাকি?
সতী উৎসাহে মাতিয়া উঠিয়াছে, অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া মইয়ের সাহায্যে ত ত করিয়া উপরে উঠিয়া গেল; মইয়ের সর্বোচ্চ ধাপে উঠিয়া দ্বারের ভিতর উঁকি দিয়ে সে কলকূজন করিয়া উঠিল—ও দিদি, শিগগির আয়, দেখবি আয় কি সুন্দর সাজানো ঘর!
মমতা মইয়ের নীচে হইতে উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিল—কেউ আছে নাকি?
কেউ না। মমতা তবু ইতস্তত করিতেছে দেখিয়া বলিল—তোর কি মই বেয়ে উঠতে ভয় করছে নাকি?
মমতা আর দ্বিধা করিল না, উপরে উঠিল। দুই বোন ঘরে প্রবেশ করিল।
টঙের উপর ঘরটি সমচতুষ্কোণ। তক্তার মেঝে, তক্তার দেওয়াল। তিনটি দেওয়ালে জানালা। মেঝের একপাশে বিছানা, বিছানার পাশে ভাল্লুকের চামড়ার উপর কয়েকটি বই। ঘরের অন্য পাশে দেওয়াল ঘেঁষিয়া সারি সারি গৃহস্থালীর দ্রব্য সাজানো; বড় বড় টিনে চাল ডাল, একটি জলের কলসী, থালা বাটি গেলাস, চায়ের প্যাকেট, বিস্কুটের টিন, প্রাইমাস স্টোভ, হ্যারিকেন লণ্ঠন ইত্যাদি। দেওয়ালের গায়ে সমতলভাবে টাঙানো একটি রাইফেল ও একটি ছরা বন্দুক। পরিমিত আরাম ও নিরাপত্তার সহিত জঙ্গলে বাস করিতে হইলে সভ্য মানুষের যাহা যাহা প্রয়োজন সবই আছে।
চমৎকৃত চক্ষে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে সতী বলিল—কি সুন্দর ঘর দিদি। আমার যদি এমন একটা ঘর থাকত আমি রাতদিন এই ঘরেই থাকতুম, একটিবার নীচে নামতুম না।
মমতা কহিল–জলের কলসী রয়েছে দেখছি, একটু খেলে হত।
খা না। এই নে। কলসী হইতে জল গড়াইয়া সতী মমতাকে দিল, তারপর বিস্কুটের টিন হইতে একমুঠি বিস্কুট লইয়া একটিতে কামড় দিল, অন্য বিস্কুটগুলি মমতার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল—খাসা বিস্কুট—এই নে।
মমতা বলিল—পরের বিস্কুট না বলে খেতে নেই, রেখে দে।
সতী বলিল—তোর সব তাতেই আদব কায়দা। গৃহস্বামী যত বড় দৈত্যই হোন, দুটি অভুক্ত অতিথিকে নিশ্চয় খেতে দিতেন। নে—খা। (মমতা একটি বিস্কুট লইল) আয় বসি।
বসব কোথায়? চেয়ার কৈ?
ঐ তো বিছানা রয়েছে।
না।
কেন, পরপুরুষের বিছানায় বসলে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রাগ করবেন? তবে আমিই বসি, আমার তো রাগ করবার লোক নেই।
সতী বিছানার প্রান্তে হাঁটু তুলিয়া বসিল। মমতা দাঁড়াইয়া টিয়া পাখির মতো বিস্কুটের কোণ টুকরাইতে লাগিল।
দুখানা বই মাথার বালিশের পাশে পড়িয়া ছিল, সতী একটা বইয়ের পাতা উল্টাইয়া বলিয়া উঠিল—ও দিদি—সঞ্চয়িতা। দৈত্য কবিতা পড়ে!—এটা কি বই দেখি—ও বাবা, মহাভারতের সারানুবাদ! আমাদের দৈত্য দেখছি ভারি শিক্ষিত দৈত্য।
মমতা বলিল—এবার চল, গাড়িতে ফিরে যেতে হবে। সন্ধ্যে হতে আর বেশী দেরি নেই।
আর একটু বসবি না? দৈত্য হয়তো এখনি ফিরে আসবে।
না—চল।
সতী অনিচ্ছাভরে উঠিল—আর একটু থেকে গেলে হত, হয়তো দৈত্য মোটর ইঞ্জিন মেরামত করতে জানে। সেকালের ময়-দানব কত বড় ইঞ্জিনীয়র ছিল জানিস তো।
মমতা বলিল—জঙ্গলে টঙ বেঁধে থাকে, সে আবার মোটর মেরামত করবে। আয়, নীচে যাই।
মই দিয়া উপরে ওঠা যত সহজ নীচে নামা তত সহজ নয়। দুজনে অতি সন্তর্পণে নামিল। মমতা হাঁফ ছাড়িয়া বলিল—বাঁচলুম।
সতী চারিদিকে লুব্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া ফিরিয়া যাইবার জন্য পা বাড়াইয়াছে এমন সময় বাধা পড়িল। জঙ্গলের ভিতর হইতে কে উচ্চৈঃস্বরে গাহিয়া উঠিল—
কানু কহে রাই
আচমকা গানের শব্দে দুই ভগিনী পরস্পর হাত চাপিয়া ধরিল। গান দ্রুত কাছে আসিতেছে—
—কহিতে ডরাই
ধবলী চরাই মুই।
সতী রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করিল—দিদি?
মমতা ফ্যাকাসে মুখে বলিল—মনে হচ্ছে মৌলিনাথবাবুর গলা—
এইবার দেখা গেল ঘন গাছপালার চক্র অতিক্রম করিয়া একটি লোক আসিতেছে। তাহার সঙ্গে একটা শ্বেতবর্ণ গাভী। গরুর দড়ি ধরিয়া লোকটি আসিতেছে; পরিধানে হাফ-প্যান্ট ও গরম খাকি শার্ট, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত হোস ও বুটজুতা। সে মনের আনন্দে তারস্বরে গাহিতেছে
আমি রাখালিয়া মতি কি জানি পিরিতি
প্রেমের পসরা তুই।
হঠাৎ লোকটির গান থামিল, সে দাঁড়াইয়া পড়িল; গরুর দড়ি তাহার হাত হইতে খসিয়া পড়িল। তারপর সে দ্রুত অগ্রসর হইয়া মমতা ও সতীর সম্মুখে দাঁড়াইল।
সতী দেখিল লোকটি সুপুরুষ, মুখের গঠন সুন্দর এবং দৃঢ়, বলিষ্ঠ আয়ত দেহ। মাথার চুলে কদম-ছাঁট, কিন্তু সেজন্য তাহার মুখ শ্রীহীন হয় নাই, বরং করোটির সুন্দর অস্থিগঠন আরও পরিস্ফুট হইয়াছে। সতী মনের মধ্যে একটা শিহরণ অনুভব করিল। এই মৌলিনাথ, যাহাকে মমতা প্রত্যাখ্যান করিয়াছিল।
মৌলিনাথ বলিল—আপনারা
সতী এক নিশ্বাসে বলিল—আমরা মোটরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলুম, মোটর খারাপ হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে বসেছিলুম, আপনার ধোঁয়া দেখে এখানে এসেছি। আপনার ঘরে ঢুকেছিলুম—বিস্কুট খেয়েছি। আপনি অ্যাত্তবড় কেটলিতে চায়ের জল চড়িয়েছেন কেন? এত চা খাবেন?
মৌলিনাথ গম্ভীর মুখে একবার কেলির দিকে তাকাইল, বলিল—ওটা চায়ের জল নয়, স্নান করব বলে চড়িয়েছিলুম।
সতী একটু হাঁ করিয়া বলিল—ও, আপনি গরম জলে স্নান করেন।
মৌলিনাথ বলিল—রোজ গরম জলে স্নান করি না, কাছেই একটা ঝরনা আছে তাতে মান করি। আজ গরম জলে নাইবার ইচ্ছে হয়েছিল তাই জল চড়িয়ে ধবলীকে আনতে গিয়েছিলাম।
সতী বলিল—ও—আপনার গরুর নাম ধবলী। কোথায় ছিল?
ঝরনার ধারে চরছিল।
ও—ওর বাচ্ছা কোথায়?
বাছুরটা মারা গেছে।
আহা, কি হয়েছিল?
হয়নি কিছু। বাঘে নিয়ে গেছে।
মমতা একটু অধীরভাবে ইহাদের বিশ্র বাক্যালাপ শুনিতেছিল, বলিল—এখানে বাঘ ভাল্লুক আছে নাকি?
মৌলিনাথ মমতাকে নিশ্চয় চিনিয়াছিল কিন্তু চেনার কোনও লক্ষণ প্রকাশ করে নাই; এখনও অচেনার মতোই বলিল—বাঘ আছে কিন্তু মানুষখেকো বাঘ নয়; ছোট জাতের চিতা বাঘ, নেড়ে বাঘ, এই সব। ভাল্লুকও আছে বটে কিন্তু তারা নিরামিষাশী। সে যাক, আপনারা দীনের কুটিরে পদার্পণ করেছেন আমার সৌভাগ্য। আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?
দুই বোন দৃষ্টি বিনিময় করিল। মমতা বলিল—আপনি মোটর মেরামত করতে জানেন?
মৌলিনাথ বলিল—জানি সামান্য। যদি সর্দি কাশির মতো মামুলি রোগ হয় তাহলে বোধ হয় সারাতে পারব, কিন্তু যদি টাইফয়েড কি মেনিঞ্জাইটিস হয় তাহলে আমার বিদ্যেয় কুলোবে না। চলুন দেখি।
তিনজনে মোটরের উদ্দেশ্যে চলিল। সতীর চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলিতেছে, অধরের কূলে কূলে উত্তেজিত চাপা হাসি। মমতার মুখের ফ্যাকাসে ভাব এখনও কাটে নাই, পাতলা ঠোঁট দৃঢ়বদ্ধ।
মোটরের কাছে যখন তাহারা পৌঁছিল তখন সূর্যাস্ত হইয়াছে। মৌলিনাথ বনেট খুলিয়া কলকব্জা নাড়াচাড়া করিল, কারবুরেটার দেখিল, স্পর্কিং প্লাগ খুলিল। তারপর বলিল—কি হয়েছে বুঝতে পেরেছি, কিন্তু আজ রাত্রে মেরামত করা যাবে না। অন্ধকারে কিছু দেখতে পাব না।
এতক্ষণে প্রায় অন্ধকার হইয়া গিয়া ঠাণ্ডা হাওয়া বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। মমতা ও সতী ফার কোট পরিয়া লইল।
তাহলে
আজ রাত্রিটা যদি দীনের কুটিরে কাটাতে রাজী থাকেন, কাল সকালে গাড়ি মেরামত করে দিতে পারি।
ক্ষণেক নীরবতার পর সতী থামিয়া থামিয়া বলিল—তাহলে—আজ রাত্তিরটা—দীনের কুটিরেই কাটানো যাক—কি বলিস দিদি?
মমতা সিধা উত্তর দিল না, বলিল—স্যুটকেস দুটো এখানে পড়ে থাকবে?
মৌলিনাথ বলিল—না, আমি নিচ্ছি।
সে পিছনের খোলের ভিতর হইতে স্যুটকেস দুটি বাহির করিয়া দুহাতে লইল। বিলাতি কম্বল দুটি সতী ও মমতা লইল।
মৌলিনাথ বলিল—চলুন।
তিনজনে আবার জঙ্গলে প্রবেশ করিল। মাঝখানে মৌলিনাথ, দুপাশে দুজন।
কিছুক্ষণ চলিবার পর মমতা বলিল—কোন দিকে যাচ্ছি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
মৌলিনাথ বলিল—আমাকে দেখতে পাচ্ছেন তো? আমার ওপর নজর রাখুন, আর কিছু দেখবার দরকার হবে না।
আরও কিছুক্ষণ অন্ধকারে চলিবার পর মমূতা যখন কথা কহিল তখন তাহার কণ্ঠস্বরে যেন একটু তীক্ষ্ণতা ধরা পড়িল—আমাকে বোধ হয় আপনি চিনতে পারেননি?
মৌলিনাথ সহজ সুরে বলিল—চিনতে পেরেছি বৈকি! আপনার কাছে আমি লজ্জিত। আপনি যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা এখনও পালন করা হয়নি। সাঁওতাল মেয়ে জোগাড় করতে পারিনি।
বাকি পথটা নীরবে কাটিল। গৃহের পদমূলে পৌঁছিয়া মৌলিনাথ বলিল—কম্বল দুটো আমায় দিন। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যান। এই নিন দেশলাই, ঘরে লণ্ঠন আছে জ্বেলে নেবেন।
মমতা জিজ্ঞাসা করিল—শোবার কি ব্যবস্থা হবে?
মৌলিনাথ বলিল—ঘরে বিছানা আছে, তাতে আপনাদের দুজনের কুলিয়ে যাবে। আমি নীচে শোব।
সতী বলিল—নীচে কোথায় শোবেন?
এই পাথরের চাতালের ওপর। গরমের রাত্রে বেশীর ভাগ এইখানেই শুই।
দুই বোন উপরে উঠিয়া গেল। সতী লণ্ঠন জ্বালিল। বাহিরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার হই। গিয়াছে। দুইজনে বিছানায় বসিয়া ফিকা হাসিল।
দিদি, ভয় করছে নাকি?
একটু একটু।—তোর?
উহু হাসি পাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে দ্বারের বাহিরে মৌলিনাথের মুণ্ড দেখা গেল।
আসতে পারি?
আসুন।
মৌলিনাথ আসিয়া সুটকেস দুটি মেঝেয় রাখিল। বলিল—চা খাবেন নিশ্চয়। আমার সব জোগাড় আছে, কেবল টাটকা দুধ নেই। টিনের দুধ চলবে কি?
সতী বলিল—খুব চলবে।
মৌলিনাথ স্টোভ জ্বালিল। দশ মিনিট পরে ধূমায়িত চায়ের বাটি ও বিস্কুট সামনে রাখিয়া বলিল—ডিম, ভেজে দেব কি? তাজা ডিম আছে, আজ সকালে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এক বন-মুরগীর বাসা থেকে কয়েকটি সংগ্রহ করেছি।
মমতা সতীর মুখের পানে চাহিল, সতী বলিল—এখন থাক, রাত্তিরে হবে।
মৌলিনাথ নিজের চা লইয়া তাহাদের অদূরে মেঝেয় বসিল।
রাত্তিরের খাওয়ার কথা আমিও ভাবছি। কী রান্না হবে এ সম্বন্ধে মহিলাদের কিছু বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা। আমার ঘরে চাল ডাল তেল ঘি আলু পেঁয়াজ আছে। এখন আপনারা ব্যবস্থা করুন কি রান্না হবে।
মমতা চায়ের বাটিতে একবার ঠোঁট ঠেকাইয়া বলিল—রান্না করা আমাদের অভ্যাস নেই, মৌলিনাথবাবু।
মৌলিনাথ কিছুক্ষণ মমতার পানে চাহিয়া রহিল, তারপর নিজের চায়ে একটি চুমুক দিয়া সহজ সুরে বলিল—তা বটে! বেশ, আমিই রাঁধব। শুধু ভয় হচ্ছে আমার রান্না আপনারা মুখে দিতে পারবেন না।
সতী লজ্জিতভাবে একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—আমি মোটামুটি রাঁধতে জানি। বিলেতে যখন দিশী রান্না খাবার ইচ্ছে হত তখন নিজেই রেঁধে খেতুম।
মৌলিনাথ এবার সতীর পানে ভাল করিয়া চাহিল। প্রথম সাক্ষাতের পর হইতে মৌলিনাথ। যখনই কথা বলিয়াছে সিধা মমতাকে লক্ষ্য করিয়া কথা বলিয়াছে; অপর পক্ষ হইতে সতী বেশী কথা বলিলেও মৌলিনাথ উত্তর দিয়াছে মমতাকেই। এতক্ষণে সে যেন সতীর স্বতন্ত্র সত্তা টের পাইল। সে কিছুক্ষণ নিবিষ্টভাবে সতীকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল—আপনি রাঁধবেন। তাহলে তো ভালই হয়। অনেক দিন মেয়েদের হাতের রান্না খাইনি। কিন্তু যে উপকরণ আছে তাতে বেশী কিছু রাঁধা চলবে না।
সতী বলিল–খিচুড়ি রাঁধা চলবে।
মৌলিনাথ হৃষ্টমুখে বলিল—খুব ভাল হবে। শাস্ত্রে লিখেছে—আপকালে খিচুড়ি।
সতী বলিল—আপনি খিচুড়ি ভালবাসেন তো? অনেকে ভালবাসে না।
মৌলিনাথ বলিল—খুব ভালবাসি। এ বিষয়ে আমি সম্রাট সাজাহানের সমকক্ষ।
সতী হাসিল। মমতার মুখখানা কিন্তু কেমন যেন বিমর্ষ হইয়া রহিল। ভিতরের বাধা ঠেলিয়া তাহার ব্যবহার স্বাভাবিক হইতে পাইতেছে না।
চা শেষ হইলে মৌলিনাথ উঠিল, বলিল—আমি এবার নীচে যাই, ধবলীকে বাঁধতে হবে।
সতী জিজ্ঞাসা করিল—কোথায় থাকে ধবলী?
এই ঘরের নীচে একটা খোঁয়াড় করেছি, রাত্রে সেখানেই বেঁধে রাখি। দিনের বেলা চরে বেড়ায়।
মৌলিনাথ নামিয়া গেল। মমতা মুখ গম্ভীর করিয়া বসিয়া ছিল, পায়ের উপর একটা কম্বল টানিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল। সতী তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া ফিস ফিস করিয়া বলিল—দিদি, তুই অমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? আমার তো খুব মজা লাগছে।
মমতা চোখ বুজিয়া বলিল—বিপদে পড়লে তোর মজা লাগতে পারে, আমার লাগে না।
সতী বলিল—বিপদ কৈ? বিপদ তো কেটে গেছে। কাল সকালেই বাড়ি যাবি।
মমতা মুদিতচক্ষে ক্ষণেক নীরব রহিল, তারপর বলিল—মৌলিনাথবাবুর কাছে অনুগ্রহ নিতে আমার ভাল লাগে না।
সতী বলিল—অনুগ্রহ কিসের? বাড়িতে অতিথি এলে সবাই যত্ন করে। তোর যে ওর সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল তা ভুলে যা না। উনি তো ভুলেই গেছেন মনে হচ্ছে।
মমতা একবার চোখ খুলিয়া সতীর পানে চাহিল, তারপর পাশ ফিরিয়া শুইল।
সতী তখন উঠিয়া ফার কোট খুলিয়া ফেলিল, কোমরে আঁচল জড়াইয়া রান্নার আয়োজনে লাগিয়া গেল।
নীচে নামিয়া মৌলিনাথ ধবলীকে খোঁয়াড়ে বন্ধ করিয়া আসিল। প্রস্তর-চত্বরের মাঝখানে আগুন প্রায় নিব-নিব হইয়াছিল, তাহাতে কয়েকটি শুকনা গাছের ডাল ফেলিয়া দিয়া সম্মুখে বসিল, দুই জানু বাহুবেষ্টিত করিয়া শান্ত মুখে বসিয়া রহিল। উপরের লণ্ঠনের আলোতে ঘরের দরজায় একটি চতুষ্কোণ রচিত হইয়াছে, একটি অস্পষ্ট মূর্তি চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে—মনে হয় যেন মর্ত্যলোক হইতে স্বর্গের একটি আবছায়া দৃশ্য দেখা যাইতেছে।
ঘণ্টাখানেক পরে সতী দ্বারের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল, ডাকিল—এবারে আপনি আসুন। খিচুড়ি তৈরি।
মৌলিনাথ উপরে উঠিয়া গেল।
লণ্ঠন মাঝখানে রাখিয়া তিনজনে খাইতে বসিল। সতী ও মমতা বিছানার ধারে বসিল, মৌলিনাথ ভাল্লুকের চামড়ার উপর।
বাটিতে করিয়া গরম খিচুড়ি, সঙ্গে আলু-পেঁয়াজের চচ্চড়ি এবং ডিম ভাজা। মৌলিনাথ এক গ্রাস মুখে দিয়াই লাফাইয়া উঠিল—আরে সর্বনাশ, একি!
সতী শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল—খেতে ভাল হয়নি?
মৌলিনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল—এ তো খিচুড়ি নয়, এ যে পোলাও।
সতীর মুখে হাসি ফুটিল। সে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—তবু ভাল। আপনি এমন ভয় পাইয়ে দিতে পারেন। দিদি, সত্যি খিচুড়ি ভাল হয়েছে?
মমতা বিরক্তি দমনের বিশেষ চেষ্টা না করিয়া বলিল—হয়েছে রে বাপু হয়েছে। আমার মুখে এখন কিছুরই স্বাদ নেই। কোনও মতে রাতটা কাটাতে পারলি বাঁচি।
সতী অপ্রতিভ হইল। মৌলিনাথ গম্ভীর চোখে মমতাকে নিরীক্ষণ করিয়া ধীরে ধীরে বলিল—আপনার বিরক্তি স্বাভাবিক। কিন্তু উপায় তো নেই, কথায় বলে দুরবস্থায় পড়লে বাঘ ফড়িং খায়। আমারও এমন দুর্ভাগ্য অতিথিদের মনোরঞ্জন করতে পারলাম না।
মমতা বোধ হয় নিজের রূঢ়তায় একটু লজ্জিত হইয়াছিল, হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—আপনাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। আপনি যথাসাধ্য করেছেন, আপনাকে ধন্যবাদ।
অতঃপর আহার প্রায় নীরবে সমাপ্ত হইল।
মৌলিনাথ নিজের কম্বলটা হাতের উপর ফেলিল, দেওয়াল হইতে রাইফেল নামাইয়া বগলে লইল, কয়েকটা টোটা পকেটে পুরিল, হাসিমুখে বলিল—এবার আপনারা শুয়ে পড়ুন।
সতী বলিল—আপনি রাইফেল নিয়ে যাচ্ছেন, তার মানে—
মৌলিনাথ বলিল—দরকার হবে বলে নিয়ে যাচ্ছি তা নয়। ওটা সঙ্গে থাকলে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোনো যায়।
মৌলিনাথ সিঁড়ি দিয়া নামিতে লাগিল, সতী দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
বাঘ কি মই বেয়ে উঠতে পারে?
না, ওদের ও বিদ্যে নেই। তবু দরজা বন্ধ করে দিন।
এই সময় সতী নিজের কব্জিতে ঘড়ি দেখিয়া বলিয়া উঠিল—একি, এখন যে মোটে সাড়ে সাতটা। আমি ভেবেছিলুম কত রাত্তির হয়ে গেছে।
মৌলিনাথ বলিল—জঙ্গলে সাড়ে সাতটাই রাত দুপুর। শুয়ে পড়ুন।
এত শিগগির ঘুম আসবে কেন। তার চেয়ে—আপনি বলছিলেন অতিথিদের মনোরঞ্জন করতে পারেননি। তাই না হয় করুন না।
কী করব? মহিলাদের মনোরঞ্জনের কোনও বিদ্যেই যে জানা নেই।
কেন, গান গাইতে তো জানেন।
গান! হঠাৎ মৌলিনাথের কণ্ঠ হইতে স্বতঃস্ফূর্ত হাসির আওয়াজ উৎসারিত হইয়া উঠিল—কি গান শুনবেন? কানু কহে রাই?
না, অন্য কিছু। গাইবেন?
মৌলিনাথ উত্তর দিবার পূর্বেই মমতা বলিয়া উঠিল—সতী, বাড়াবাড়ি করিসনি। যা রয়-সয় তাই ভাল। দোর বন্ধ করে দে।
সতী ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল মমতা শুইয়া পড়িয়াছে। সে ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করিয়া দিল, আলো কমাইয়া মমতার পাশে গিয়া শুইল। কম্বলটা ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইয়া তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিল। বলিল—যাই বলিস, আমাদের ভাগ্যি ভাল যে এই জঙ্গলের মধ্যে একজন ভদ্রলোকের দেখা পেয়েছি। ভদ্রলোক না হয়ে ছোটলোকও হতে পারত।
মমতা গলার মধ্যে কেবল একটা শব্দ করিল।
নীচে মৌলিনাথ প্রস্তরপট্টের উপর শয়ন করিয়াছিল; অর্ধেক কম্বলের বিছানা, বাকি অর্ধেক আবরণ। মাথায় রাইফেলের কুঁদা। সে ঊর্ধ্ব মুখে আকাশের পানে চাহিয়া রহিল; তাহার অধরে বিচিত্র কৌতুকের হাসি খেলা করিতে লাগিল।
তারপর সে গান ধরিল; প্রথমে গুঞ্জরণ, তারপর স্পষ্ট স্বর—
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
অতীত দিনের স্মৃতি।
কেউ জ্বালে না আর বাতি
তার চির-দুখের রাতে
কেউ দ্বার খুলি জাগে
চায় নব চাঁদের তিথি।
গান শেষ হইল। উপরের ঘর হইতে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। মৌলিনাথ পাশ ফিরিয়া চোখ বুজিল।
ঘরে মমতা ও সতী পাশাপাশি শুইয়া আছে। মমতার চক্ষু মুদিত, হয়তো ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সতী নিষ্পলক নেত্রে চাহিয়া আছে।
আজ বোধ হয় কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া কি চতুর্থী। জঙ্গলের মাথা ছাড়াইয়া চাঁদ উঠিতেছে। নব চাঁদের তিথি। …
চাঁদ যখন মধ্যগগনে তখন মৌলিনাথের ঘুম ভাঙিয়া গেল। কোথায় যেন খুট করিয়া শব্দ হইয়াছে। একেবারে রাইফেল হাতে লইয়া সে উঠিয়া বসিল।
বাঘ নয়। মই দিয়া একজন নামিয়া আসিতেছে, ফার কোট পরা চেহারা—পিছন দিক হইতে দেখিয়া মৌলিনাথ চিনিতে পারিল না, মমতা না সতী।
সতী আসিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল। ঊর্ধ্বমুখী হইয়া চাঁদের পানে চাহিল, চারিদিকে ঘাড় ফিরাইয়া আলো-ঝিলমিল বনানী দেখিল, তারপর পাথরের উপর বসিয়া পড়িল। বিছানায় বালিশের ঘর্ষণে তাহার খোঁপা খুলিয়া বেণী এলাইয়া পড়িয়াছে।
মৌলিনাথ রাইফেল রাখিয়া বলিল—আপনি!
সতী বলিল——ঘুম হল না, তাই নেমে এলুম। দিদি ঘুমুচ্ছে।
মৌলিনাথ বলিল—নতুন জায়গায় সকলের ঘুম আসে না।
সতী বলিল—সেজন্যে নয়। এত ভাল লাগছে যে ঘুমুতে পারছি না।
মৌলিনাথের কণ্ঠস্বরে একটু সকৌতুক বিস্ময় প্রকাশ পাইল—এত ভাল লাগছে!
বিশ্বাস করছেন না? সত্যি বলছি। যদি সারা জীবন এমনি জঙ্গলে কাটাতে পারতুম বোধ হয় আর কিছু চাইতুম না।
এখন তাই মনে হচ্ছে, দুদিন থাকলে মন তখন পালাই পালাই করবে।
আপনার মন কি পালাই পালাই করে?
না। এ আমার নিজের জঙ্গল, এর প্রত্যেকটি গাছ আমার চেনা, প্রত্যেকটি পাখির সঙ্গে আলাপ আছে। বাঘ ভাল্লুকেরাও অপরিচিত নয়, কে কোথায় থাকে তার ঠিকানা জানি।
সতী চুপ করিয়া রহিল। অনেক দূর হইতে ঐক্যতানের শব্দ ভাসিয়া আসিল; শৃগালেরা রাত্রির মধ্যম ঘোষণা করিতেছে।
আপনার কি শহরে যেতে একেবারেই ভাল লাগে না?
মাসে দুমাসে একবার যাই। যখন ফিরে আসি তখন আরও মিষ্টি লাগে।
আপনি মানুষের সঙ্গ ভালবাসেন না?
মৌলিনাথ স্মিতমুখে নীরব রহিল।
চুপ করে রইলেন যে! বলুন না।
ও কথা যেতে দিন না।
না, বলুন।
মৌলিনাথ আর একটু ইতস্তত করিয়া বলিল—কি বলব, মনের কথা কি স্পষ্ট করে বলা যায়। মোটামুটি এইটুকু বলা যায় যে মনের মানুষ যারা তাদের সঙ্গ ভাল লাগে, যারা তা নয় তাদের সঙ্গ ভাল লাগে না। কিন্তু সমানধর্মা মানুষ পৃথিবীতে বেশী নেই। যেখানে যত বেশী মানুষ সেখানে তত বেশী বিরোধ, তত তীব্র স্বার্থপরতা। তার চেয়ে আমার জঙ্গল ভাল।
সতী একটু চিন্তা করিয়া বলিল—জঙ্গলে কি বিরোধ স্বার্থপরতা নেই?
আছে। কিন্তু অহেতুক বিরোধ নেই, দলবদ্ধ স্বার্থপরতা নেই। বাঘেরা দল বেঁধে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে না, হরিণেরা সংঘবদ্ধ হয়ে হরিণের সঙ্গে ঝগড়া করে না। আর আমি তো জঙ্গলের মধ্যে একা, কার সঙ্গে ঝগড়া করব
তাহলে মোট কথা এই যে, মনের মানুষ অর্থাৎ সমানধর্মা মানুষ পেলে আপনি ঝগড়া করবেন না।
ঝগড়া আমি কোনও অবস্থাতেই করব না, ঝগড়ার উপক্রম দেখলেই পালিয়ে যাব।
আপনি পুরুষ মানুষ, ঝগড়ার নামে পালাবেন? এ যে পলাতক মনোবৃত্তি।
হোক পলাতক মনোবৃত্তি। আমি পালাব।
মৌলিনাথের বলিবার ভঙ্গি শুনিয়া সতী কলকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল।
সতী!
দুজনে একসঙ্গে উপর দিকে তাকাইল। মমতা দ্বারের সামনে দাঁড়াইয়া। পশ্চিমে ঢলিয়া পড়া চাঁদের আলো তাহার মুখে পড়িয়াছে।
সতী বলিল—দিদি, তোর ঘুম ভেঙেছে। নীচে আয় না।
মমতা বলিল—না, তুই ওপরে চলে আয়। এত রাত্রে ওখানে থাকতে হবে না।
কটা বেজেছে? সতীর হাতে ঘড়ি নাই, সে ঘড়ি খুলিয়া শয়ন করিয়াছিল।
তিনটে বেজে গেছে।
তবে তো ভোর হয়ে এল। আর ঘুমিয়ে কি হবে!
সতী! চলে এস। বড় বাড়াবাড়ি করছ তুমি। আইবুড় মেয়ের অত ভাল নয়। মমতার স্বর কঠিন।
সতী কিছুক্ষণ হতবাক হইয়া রহিল, তারপর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল মৌলিনাথ নিঃশব্দে হাসিতেছে। সে আর বাঙ্নিষ্পত্তি করিল না, উঠিয়া উপরে চলিয়া গেল।
রাত্রির যবনিকা উঠিয়া যাইতেছে; ভোর হইতে আর দেরি নাই। প্রথমে একটি বন-মোরগ তরুশীর্ষ হইতে ডাক দিল; তাহার ক্রোশন থামিতে না থামিতে দূরে আর একটি মোরগ ডাকিল; তারপর আরও দূরে আর একটি ডাকিল। এই শব্দে দোয়েল হাঁড়িচাঁচা টিয়া চড়ই পায়রা ছাতারে সকলের ঘুম ভাঙিয়া গেল। বন মুখর হইয়া উঠিল।
সূর্যোদয় হইল।
মমতা ও সতী টঙ হইতে নামিয়া আসিল। তাহাদের কাঁধে বড় টার্কিশ তোয়ালে, হাতে টুথব্রাশ ও সাবানের কৌটা। মমতার মুখ গম্ভীর, সতীর মুখে গাম্ভীর্য ও হাসি লুকোচুরি খেলিতেছে।
মমতা মৌলিনাথকে বলিল-ঝরনাটা কোন দিকে দেখিয়ে দিন তো!
মৌলিনাথ তাহাদের ঝরনা পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিল, ফিরিয়া আসিয়া চায়ের জল চড়াইল। ধবলী খোঁয়াড়ের মধ্যে হাম্বারব করিতেছিল, তাহাকে ছাড়িয়া দিল।
ঝরনার নির্জনতা হইতে ফিরিবার পথে মমতা কাঁটা-ঝোপের আকর্ষণ বাঁচাইয়া চলিতে চলিতে বলিল—বাবা, জঙ্গলে মানুষ থাকে? ভাগ্যিস ওকে বিয়ে করিনি।
সতী বলিল—ভাগ্যিস।
তাহারা ফিরিয়া আসিয়া দেখিল মৌলিনাথ পাটাতনের উপর চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া অপেক্ষা করিতেছে।
ডিমসিদ্ধ ও বিস্কুট সহযোগে চা খাওয়া শেষ হইলে মৌলিনাথ বলিল—এবার তাহলে মোটর মেরামতের চেষ্টায় যাওয়া যাক। আপনারা কি আমার সঙ্গে আসবেন?
তাহার বক্তব্য শেষ হইল না, জঙ্গলের মধ্যে বিলাতি ব্লাড়-হাউন্ড কুকুরের গভীর ডাক শোনা গেল। তারপর কয়েকজন লোক তরুচক্রের মধ্যে প্রবেশ করিল।
সর্বাগ্রে আসিতেছেন কুকুরের শিকল ধরিয়া মমতার স্বামী ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ভৌমিক; তাঁহার পিছনে উর্দি-পরা কয়েকজন লোক। মিস্টার ভৌমিকের চেহারা ইঞ্জিনের মতো, কাষ্ঠ-লোষ্ট্র-ইষ্টক-দৃঢ় ঘনপিনদ্ধ কায়া! এবং তাহার অভ্যন্তরে যে লৌহ-গলন শৈল-দলন অচল-চলন মন্ত্র নিহিত আছে। তাহাও নিঃসংশয়ে বলা যায়।
মমতা ত্বরিতপদে গিয়া স্বামীর বাহুর সহিত বাহু জড়াইয়া লইল, কুকুরের মাথায় হাত বুলাইয়া আদর করিল! সেইখানে দাঁড়াইয়া মিস্টার ভৌমিক স্ত্রীর জবানবন্দি শুনিলেন, নিজের হালও বয়ান করিলেন। কাল রাত্রি দশটা পর্যন্ত স্ত্রী ও শ্যালিকা পৌঁছিল না দেখিয়া তিনি টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছিলেন, তারপর আজ প্রাতঃকালে কুকুর লইয়া খুঁজিতে বাহির হইয়াছেন।
এদিকে সতী ও মৌলিনাথ একক দাঁড়াইয়া আছে। সতী অনাবশ্যক সংবাদ দিল—দিদির স্বামী মিস্টার ভৌমিক—ম্যাজিস্ট্রেট।
উত্তরে মৌলিনাথ শুধু ভ্রূ তুলিল।
মিস্টার ভৌমিক স্ত্রীকে বাহুলগ্ন করিয়া অগ্রসর হইলেন। সতীর সম্মুখে আসিয়া টুপি খুলিয়া বলিলেন—এই যে সতী। কেমন আছ?
সতী বলিল—আপনি কেমন আছেন?
শ্যালিকাকে সাদর সম্ভাষণ জানাইয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মৌলিনাথের দিকে ফিরিলেন, কড়া সুরে বলিলেন—এই ঘর আপনার?
মৌলিনাথ বলিল—হ্যাঁ।
ম্যাজিস্ট্রেট বলিলেন—আশা করি এ জমি আপনার, আপনি গভর্নমেন্টের খাস মহলে trespass করেননি।
মৌলিনাথ বলিল—এ জঙ্গল আমার, আমি গভর্নমেন্টের খাস মহলে trespass করিনি। এবং গভর্নমেন্ট যদি আমার জঙ্গলে trespass করে আমি গভর্নমেন্টের ঠ্যাং ভেঙে দেব।
সতী অবাক হইয়া মৌলিনাথের পানে চাহিল; ঝগড়ার নামে যে-লোক পলায়ন করিতে বদ্ধপরিকর কথাগুলা তাহার মতো নয়। সতী হঠাৎ সজোরে হাসিয়া উঠিল। ম্যাজিস্ট্রেট কিন্তু হাসিলেন না, রাগও করিলেন না। আপন শক্তিতে তিনি অটল। স্ত্রীকে বলিলেন—চল, এবার যাওয়া যাক। ভাঙা গাড়িটা টেনে নিয়ে যেতে হবে। তোমাদের জিনিসপত্র কোথায়?
মমতা আঙুল দেখাইয়া বলিল—ঐ ঘরে আছে। দুটো স্যুটকেস।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালিকে হুকুম দিলেন স্যুটকেস দুটা নামাইয়া আনিতে। আদালি উপরে উঠিবার উপক্ৰম করিলে সতী বলিল—আমার স্যুটকেস নামাবার দরকার নেই।
সকলের সপ্রশ্ন চক্ষু সতীর দিকে ফিরিল। সতী সহজ সুরে বলিল—আমি এখন যাব না, এখানেই থাকব।
সকলের চোখের প্রশ্ন কণ্টকবৎ তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল। মমতা আর্ত অবিশ্বাসের সুরে বলল—সতী!
সতী বলিল—এতে আশ্চর্য হবার কি আছে। জায়গাটা আমার ভাল লেগেছে তাই থাকব।
কিন্তু—একলা থাকবি কি করে?
একলা কেন, উনিও তো থাকবেন, বলিয়া সতী চিবুকের সঙ্কেতে মৌলিনাথকে দেখাইল।
মমতা জ্বলিয়া উঠিল—তুই হলি কি! শিক্ষা-দীক্ষা মান-মর্যাদা সব জলাঞ্জলি দিলি। ও সব হবে না, আমার সঙ্গে এসেছিস, আমার সঙ্গে ফিরে যেতে হবে। মামা-মামীমার কাছে আমার একটা দায়িত্ব আছে।
আমি যাব না।
ম্যাজিস্ট্রেট এতক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চন করিয়া নীরব ছিলেন, মৌলিনাথের দিকে ফিরিয়া বজ্রগম্ভীর স্বরে বলিলেন—এর মানে কি?
মৌলিনাথ বলিল—মানে আমিও জানি না। একটু অপেক্ষা করুন, দেখি যদি বুঝতে পারি।
হাতের সঙ্কেতে সতীকে ডাকিয়া মৌলিনাথ একটু দূরে লইয়া গেল, গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিল—ব্যাপার কি?
সতীর চোখ ছল ছল করিতেছে, স্ফুরিত অধরে সে বলিল—আমি যাব না, কিছুতেই যাব না।
কিন্তু—না যাওয়ার মানে বুঝতে পারছ?
পারছি। ছেলেমানুষ নই, একুশ বছর বয়স হয়েছে।
তার মানে আমাকে বিয়ে করতে রাজী আছ?—কেমন?
সতীর বাঁ চোখ হইতে একফোঁটা জল গড়াইয়া গালের উপর পড়িল। সে উত্তর দিল না।
মৌলিনাথ বলিল—মৌনং সম্মতিলক্ষণম্। —কিন্তু যতক্ষণ বিয়ে না হচ্ছে ততক্ষণ এখানে থাকবে কোথায়?
কেন, আমি ঘরে শোব, তুমি নীচে শুয়ো।
চমৎকার ব্যবস্থা। আমাকে যদি বাঘে নিয়ে যায়?
বেশ, আমি নীচে শোব, তুমি ঘরে শুয়ো।
আরও চমৎকার। তোমাকে বাঘে খেতে পারে না?
সে আমি জানি না।
স্ত্রীজাতির ইহাই শেষ যুক্তি। মৌলিনাথ কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া ঘাড় চুকাইল, তারপর সতীর হাত ধরিয়া বলিল—এস দেখি, যদি কিছু ব্যবস্থা হয়।
দুজনে পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। ম্যাজিস্ট্রেট ইতিমধ্যে একটা প্রকাণ্ড সিগার ধরাইয়া ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়িতেছিলেন, মৌলিনাথ বলিল— সতী এখানেই থাকবে। এমন কি সেজন্যে আমাকে বিয়ে করতে পর্যন্ত তৈরি আছে। আমারও অমত নেই।
ম্যাজিস্ট্রেট বলিলেন— ড্যাম্।
মমতা দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল— এমন বেহায়া মেয়ে দেখিনি। ছি ছি!
মৌলিনাথ বলিল— ঠিক বলেছেন। কিন্তু উপায় নেই, ও সাবালিকা। মিস্টার ভৌমিক, এক্ষেত্রে আপনিই সব দিক রক্ষে করতে পারেন। সতী আপনার শালী একথাটা স্মরণ রাখবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট বলিলেন— হোয়া জু মীন?
মৌলিনাথ বলিল— আপনি ম্যাজিস্ট্রেট, বিয়ে দেবার অধিকার আপনার আছে। সাক্ষী-সাবুদও উপস্থিত। আপনি যদি বিয়ে না দিয়ে চলে যান একটা কেলেঙ্কারী হবে। সতী আপনার শালী, সুতরাং দুর্নাম হবে আপনারই বেশী।
ম্যাজিস্ট্রেট ঘন ঘন ধূম উদগিরণ করিয়া মৌলিনাথ ও সতীকে দৃষ্টিপ্রসাদে অভিষিক্ত করিতে লাগিলেন। তারপর তাঁহার ইঞ্জিনের মতো মুখে অতি সামান্য একটু বাষ্পচ্ছন্ন হাসির আভাস দেখা দিল। কখন পিছু হটিতে হয় ইঞ্জিন তাহা জানে।
অতঃপর এক ঘণ্টা কাটিয়া গিয়াছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বিবাহক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া সস্ত্রীক সানুচর প্রস্থান করিয়াছেন। মমতা যাইবার সময় সতীর সঙ্গে কথা বলে নাই, মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গিয়াছে।
প্রস্তরপট্টের কিনারায় সতী ও মৌলিনাথ পা ঝুলাইয়া বসিয়া ছিল। দুজনের মুখই চিন্তাগ্রস্ত।
মৌলিনাথ বলিল— হিন্দুদের আট রকম বিয়ের ব্যবস্থা, তার মধ্যে গান্ধর্ব বিবাহ আছে, পৈশাচ বিবাহ আছে, রাক্ষস বিবাহ আছে, আমাদের বিয়েটা কোন্ বিবাহ বুঝতে পারছি না।
সতী বলিল— বোধহয় খোক্কস বিবাহ।
মৌলিনাথ সতীর কাছে ঘেঁষিয়া বসিল। বলিল—কি কাণ্ডটা করলে বল দেখি। এক রাত্তিরে এত হয়?
সতী বলিল— যার হবার তার এক রাত্তিরেই হয়। জামাইবাবু কিন্তু খুব ভাল লোক। দিদিটা ইয়ে। ভাগ্যিস তোমাকে বিয়ে করেনি।
ভাগ্যিস। কিন্তু ও কথা যাক। যে কাণ্ড করলে তার ফলাফল চিন্তা করেছ কি?
কী ফলাফল?
রোজ নিজের হাতে রাঁধতে হবে।
রাঁধতে আমি ভালবাসি।
বাসন মাজতে হবে।
মাজব।
বাথরুম নেই, জলের কল নেই। ঝরনায় গিয়ে নাইতে হবে।
নাইব। কেটলিতে জল গরম করেও নাইব।
ধবলী চরাতে হবে।
সতী ঘাড় তুলিয়া বলিল— আমি ধবলী চরাব কেন? চণ্ডীদাস কী লিখেছেন? ধবলী চরাবে তুমি।
আচ্ছা আচ্ছা।
সতী মুচকি হাসিল।
এবার তাহলে গানটা গেয়ে ফেল।
কোন্ গান?
কানু কহে রাই।
দুজনে আরো ঘনিষ্ঠ হইয়া বসিল। জঙ্গলে পশুপক্ষী ছাড়া সাক্ষী নাই, তাহারাও পরের প্রণয়লীলা গ্রাহ্য করে না। মৌলিনাথ সতীকে দৃঢ়ভাবে জড়াইয়া লইয়া গান ধরিল। একটা কাঠঠোকরা অদৃশ্য থাকিয়া গানের সঙ্গে ঠেকা দিতে লাগিল।