কাঁচা ভাগাড়
বাঘমুন্ডি,,,,,,,পুরুলিয়ায় প্রত্যন্ত আদিম, গ্রাম্য অঞ্চল॥ আদিমতার অন্ধকারের চাদরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে অঞ্চলটা॥সদ্য শিক্ষিকার চাকরী নিয়ে এখানকার প্রাথমিক স্কুলে জয়েন করেছি॥নাগরিক সভ্যতাতে বড় হয়ে ওঠা,তাই প্রথম প্রথম এই গ্রাম্য, আদিম,কোলাহলবিহীন, জনমানব শূণ্য অঞ্চলে মন বসতে চাইতো না॥আস্তে আস্তে চারপাশের অঞ্চলে ঘোরাঘুরি শুরু কোরলাম॥আমারস্কুল থেকে এক কিমি মত দূরে একটা সরু খাল! সবাই বলে ”তমালনদী”॥এর একতীর উঁচু,মালভূমির মত॥এখানে মাঝে মাঝে কাঠগোলাপ,কাঞ্চন,টগর,করবী গাছ॥ফুলে ফুলে ছাওয়া॥বেশ ভালোলাগতো॥মাঝে মাঝে বিকেলে ওখানে বসতাম॥আমার সব কাজের সঙ্গী ,,,বীণা,,,,বীণা মুড়া,এক আদিবাসী মেয়ে॥
ও হঠাৎ সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করলো,,,”দিদিমণি,তুমি কোথায় ঘুরতে যাও?”
আমি যখন বললাম জায়গাটার কথা, ও আতঙ্কে শিউরে উঠলো,,,,,”’কাঁচাভাগাড়”’,,,,,,ওখানে যাও কেন গো?” আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম,,,,,”কঁাচা ভাগাড়” কি?ভাগাড় মানে তো যেখানে মৃত পশু ফেলা হয়! বললাম,,,”ভাগাড় হতে যাবে কেন?কি সুন্দর ফুলের গাছেছাওয়া॥” ও বললো,ওটাই এখানকার ,,,কঁাচা ভাগাড়!”কেউ ওপাশে যায় না গো! তুমি ওখানে যেও নি তো,”বা,,বাতাস” লাগবে॥” আমার আবার বেকুব বনার পালা!”বা,,বাতাস” কি? লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেসই করে বসলাম সোজাসুজি,,,,,,”কাঁচা ভাগাড়”কি? বা,,বাতাসই বা কি?”
বীণা যেন আকাশ থেকে পড়লো,,,”তুমি কাঁচাভাগাড় কি জানো না??বা,,বাতাস ,,ও?তোমরা শহরের লোকেরা এমনই! আরে পাঁচ বছরের নিচের
কচিছানা দের সমাজ দেওয়া হয় না, যেখানে,তাকেই কাঁচাভাগাড় বলে॥ঐ যেখানে তুমি গিয়েছিলে না, সেটাই এখানকার কাঁচাভাগাড়॥ঐ ফুলগাছ গুলো তো ঐ ”গঙ্গাপুত্রে’,’র পাগলী বউ টা লাগিয়েছে॥খারাপ বা বাতাস থাকে ওখানে! আর যেওনি ওখানে॥”
বীণা আর কথা বাড়ালো না! আমিও চুপ করে গেলাম॥আবার মন কুটকুট করে উঠলো,,,,,আচ্ছা গঙ্গাপুত্র তো ভীষ্ম!এখানে ”গঙ্গাপুত্রটা কে?”কৌতূহলের মাত্রাটা দিন দিন বেড়েই চললো!সেদিনটা ছিল একটা ছুটির দিন!সকালে একটা অদ্ভুতআহ্বানে চমকে বাইরে বেরিয়ে দেখি,,,,,একটা ২৮;২৯বছরের ছেলে কোরা কাপড়ের ধড়াওউড়ুনি গায়ে,হাতে একটা মাটির সরা,,,,,গৃহস্থের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ডাকছে,,,,”গঙ্গাপুত্র এসেছে মা,,,,,॥ দেখলাম বউ,,ঝিরা ওর সরাতে চাল আনাজ ঢেলে দিচ্ছে॥ দুরে গাছ তলাতেএকটা২২,,,২৩ বছরের মেয়ে বসেআছে,দোহারা শ্যামলা চেহারা,!বড় করুন,বড় আতুর বসার ভঙ্গীটি॥ বিষাদময় চোখ দুটো যেন কেঁদেই চলেছে॥ আমি জিজ্ঞেস করলাম,,,”তুমি কে?” ও মুখতুলে উ ত্তর দিলো ,,,”আমি বেহুলা, গঙ্গাপুত্রের পরিবার গো!” বললাম,,”তোমার স্বামী গঙ্গাপুত্র?” ও বললো,,,”হ্যাঁগো,ও গঙ্গাপুত্র,যাকে তোমরা ডোম বল না, তাই!ও কাঁচাভাগাড়ের গঙ্গাপুত্র॥”
এবার সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল॥ঐ ফুলগাছে ঢাকা জায়গাটা শিশুসমাধিক্ষেত্র॥পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের সমাধি দেওয়া হয় এখানে॥
বীণা বলছিলো বেহুলা ওখানে ফুলগাছ লাগায়!
ও নাকি পাগলী!আমি বেহুলার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা শুরু কোরলাম॥ও কোন কথা বললো না॥ কেটে গেছে বেশ কিছু দিন॥সেদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছি॥হালকা মেঘ করেছে॥ হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সমাধি ক্ষেত্রে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি॥একটা ফুলে ছাওয়া কাঠটগর গাছের পাশে বসলাম! গন্ধে ম ম করছে জায়গাটা॥ চুপ করে বসে ছিলাম,,,,,,,হঠাৎ দেখলাম বেহুলা আনমনে হেঁটে চলেছে সমাধিক্ষেত্রের ঢালের দিকে॥ওখানে বেশ কটা টগর ও গন্ধরাজ গাছ॥ কঁুড়ি এসেছে গাছটাতে॥ও গাছটার সামনে এসে আদর করে গাছটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে কত কিছু বলে যেতে লাগলো॥আমি পিছন থেকে ,,”বেহুলা” বলে ডাকতেই ও মুখ ফেরালো! দেখলাম ওর গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে!আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বসালাম পাশে!বললাম,,,”আমাকে বল,কেন কাঁদছো?”ও মুখ নিচু করে বললো,,,”দিদি,ইটা আমার ব্যেটা গো! দু বছর আগে,উর বাপ উকে ইখানেই ঘুম পাড়াইছ্যে গ!আমি গন্ধরাজ টো লাগাইছি!দেখ্যো কত বর হই গেল! এবার ফুল ফুটব্যে॥আমার বেটা জোয়ান হই গেল গো॥”
ওর সাথে অনেক কথা ,আলাপচারিতায় জানতে পারলাম এখানকার আদিম সংস্কারের কথা!
বেহুলা বাড়ির অমতে গঙ্গাপুত্রকে বিয়ে করে ঘর ছাড়ে॥গঙ্গাপুত্ররা সমাজে ব্রাত্য! কেউ বিয়ে করে না এদের॥আর ”কাঁচাভাগাড়ের” গঙ্গাপুত্রদের সবাই এড়িয়ে চলে!লোকশ্রুতি এদের নাকি সন্তান হয় না!
বেহুলারও তাই মনে হতো কিন্তু বিয়ের দুবছর পরে ওর কোলজুড়ে যখন ”শঙ্কর” এলো তখন ও খুশি মনা সবাই কে এই সংস্কার যে মিথ্যে তাই বলতো! কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস,,,,,দ,ুবছরের শঙ্কর জলে ডুবে মারা যায়॥সেই থেকে বেহুলা কেমন হয়ে যায়॥যখনই ওর স্বামী কোন মৃতদেহ সমাধি দেয় ও সেখানে একটা ফুলগাছ পোঁতে॥ঐ ফুলগাছ গুলো বড় হয়ে ফুল ফোটালে ওর মাতৃহৃদয় তৃপ্ত হয়!ওই গাছগুলোর মধ্যে ও ওই শিশুগুলোকে ফিরে পায়॥
সবাই ওকে পাগলী বলে!আমি ওর সুন্দর মন টাকে
মনে মনে প্রণাম করলাম॥সত্যিই তো এইভাবেই সে
তার মনের ক্ষতে মলম লাগাচ্ছে॥
আস্তে আস্তে কাঁচাভাগাড় ছেড়ে বেরিয়ে আসছি,,,,
শুনতে পেলাম বেহুলা করুন সুরে গান গাইছে,,,,সেই বিষাদকরুন সুর,আর্তি বাতাসের সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে বাঘমুন্ডির ডুংরি,,,,,টিলা,,,জঙ্গলে,,,,,,,॥