একঘরা
এই “একঘরা” কথাটি ছোটবেলা থেকেই জানি এবং তখন খুব প্রচলিত ছিল। গৃহস্থ ঘরে, আড্ডাখানায়, স্কুলে, ঠাট্টাতামাশায় বইপাঠে বিশেষ সাহিত্য পুস্তকে। জীবন্ত বর্ণনা পেতাম কাকে বলে “একঘরা” এবং কেন , ঐ সাহিত্য ভাণ্ডারেই। আর মায়ের কাছে সংক্ষিপ্ত কথায়। প্রায় একশ বছর আগেও— বিশেষ, গ্রামেগঞ্জেই এ রীতি চালু ছিল, বেশি। তখন একটু মৃদু প্রতিবাদ মনকে নাড়া দিতো, “একঘরা ” হবার কারণগুলি ত অকারণ !! হিন্দুত্বের অনেক কুপ্রথার মধ্যে এও ছিল এক স্মৃতিবাহিত পুরাণ শাস্ত্রকারকদের স্বার্থান্বেসি কিছু বিধান। আর ঐ শাস্ত্র হয়ত অপঠিত কিছু পুরুষ ও নারীদের কার্যকরী করবার ছিল চরম তাগিদ।
কি কারণে “একঘরা” করার বা কেন করা হতো কোন পরিবারকে সমাজে? এবং কি প্রথায়। সবচেয়ে বড় অজুহাত (যথাযথ শব্দই) যদি কন্যাকে বয়স কালে বিবাহ দিতে না পারলে– এজন্য তড়িঘরি যেমন তেমন হোক এক পাত্তর যোগাড় করে বিয়ে দিতেই হতো, দরকার হলে গাছ বা পাথরের শিবঠাকুরের সাথে। এ ছাড়া কোন কন্যা যদি বিপথগামী (বিপথের সংজ্ঞা উল্লেখ করছি না) হন, অথবা বংশের কেউ যদি সাগর পাড়িতে বিলেত যান বা নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করেন, (অবশ্যই বারাঙ্গনাবাড়ি গমনে বা মদ্যপানে চূড়ান্ত ছাড়), কোন কারণে গো-হত্যা হলে ইত্যাদি। তবু পুরুষেরা (বিত্তবান) গোবর ভক্ষণে বা তার বিকল্প ভাণে, রক্ষা পেতেন। কিন্ত বেশিরভাগই ঐ ভোগ্যবস্তু ত মেয়েরা, তাই বাড়ির কন্যাদের উপরই চাপভার থাকতো। তো “একঘরা” হলে কি হতো—- ধোপা নাপিত বন্ধ, পুকুর ব্যবহার চলবে না, কেউ কোন সামাজিক নেমতন্ন করবে না বা “একঘরা” বাড়িও কারোকে করতে পারবে না। এককথায় তাকে ভিটেমাটি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে হবে। এমনই এক নিয়ম, আইন করে বন্ধ করার চিন্তা হয়ত স্বয়ং বিদ্যাসাগরও ভাবতে সময় পান নি, কতদিক তিনি আর করতে পারতেন।
প্রগতি তাগিদে দিনে দিনে শিথিল হতে হতে এ রীতি এখন প্রায় লুপ্ত। এ ব্যাপারে আমার কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রশ্ন ওঠে না, পুরোটাই এক প্রাচীন কুপ্রথার ইতিহাস। কিন্ত আজ— একবিংশ শতাব্দীর বিশ দশকে যখন সারা দুনিয়া আন্দোলিত হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত virtual জগতের সংস্করণে, উন্নতির পরাকাষ্ঠা তখন এলো এমন এক সব ক্ষুদ্র দানব, এক কথায় নিখিলের সকল মনুষ্যদের জাতি, বর্ণ, ভাষা, ধর্ম , কৃষ্টি, বিত্ত, সাধু অসাধু, সৎ অসৎ সব নির্বিশেষে, বেমালুম সব ভুলিয়ে এক কথায় সকলকে “একঘরা” হতে বাধ্য করল। তাই এর গন্ডি আর হিন্দুত্বের ধ্বজার আড়ালে থাকল না। এখন সব একঘরে বন্দি, পোষাকি নাম Quarantine যা কিনা ল্যাটিন শব্দ “quadriginta” মানে “চল্লিশ ” ও ইতালীয় ভাষায় চল্লিশ দিন। ইতিহাস বলে পনেরোশ শতাব্দীতে প্লেগরোগে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে এক জাহাজ ইয়োরোপের এক বন্দরে আটকে ছিল চল্লিশ দিন, বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকবার কারণে, অর্থাত “একঘরা”। ঐ জব্বর এক ছোয়াচে রোগের জন্য। তারপর quarantine কথাটা থেকে গেল, কিন্তু দিনের মেয়াদ অসুখ বুঝে।
এই “একঘরা” হতে হলো সাথে আর এক দোসর lock-down…..ধোপা নাপিত বন্ধ, বাজার হাট বন্ধ, সিনেমা থিয়েটার বন্ধ, অফিস কাছারি বন্ধ,স্কুল কলেজ বন্ধ,একসঙ্গে নাচাগানা খানা পিনা আড্ডা জলসা সব বন্ধ। কোন পরস্পরের নেমতন্ন বা আতিথেয়তা নেই, নেই দেখা হলে হাসি বিনিময় বা কোলাকুলি। রাস্তা গলি নিঝুম, নেই গাড়ি চলাচল, বা লোকজন। তবে এ “একঘরা”কে তোয়াক্কা না করে অনিয়ম চলছে, চলছে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া। এ “একঘরা” স্বেচ্ছাবন্দিত। কুসংস্কারযুক্ত হিন্দুদের কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া নয়। তাই এ “একঘরা” নামে এক হলেও শত্রু দমনের জন্য স্বাগত।