উপহারের রোজনামচা
“স্নেহ উপহার এনে দিতে চাই
কী যে দেব, তাই ভাবনা-
যত দিতে সাধ করি মনে মনে
খুঁজে পেতে সে তো পাব না। “
কবিগুরুর লাইন দিয়ে শুরু করা যাক। ‘উপহার’- চার বর্ণের এই শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে হাসি-আনন্দ আর সুখ স্মৃতির হাতছানি। সদা কর্মব্যস্ত মানব জীবনের প্রতি পদে পদে বিপদের হাতছানি। জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মাঝে মাঝেই এসে উপস্থিত হয় বিশেষ কিছু দিন। তার মধ্যে রয়েছে অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, জন্মদিন থেকে শুরু করে হালফিলের ভ্যালেন্টাইনস ডে। এইসমস্ত দিনগুলোতে যেমন আত্মার আত্মীয়দের সঙ্গে মিলনের সুযোগ পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি তাদের দেয় নানাবিধ উপহারের ডালিতে হৃদয় আনন্দে ভেসে যায়।
উৎসব-পার্বণ কিংবা বিভিন্ন দিবসে প্রিয়জনকে উপহার দিয়ে তার খুশি মুখ দেখতে কে না চায়! উপহারের আকার বা পরিমাণ সে তো গৌণ। আসল ব্যাপার হলো উপহার দাতার বড়ো হৃদয়। সময়ের আবর্তে উপহারসামগ্রীর ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। পুরানো দিনে উপহার হিসেবে মানুষ সবথেকে বেশি যেটা পছন্দ করতেন, তা হলো মহান লেখকের লেখা উপন্যাস, কবিতা বা গল্পের সংকলন। বৈচিত্র্যময় উপহার সামগ্রীর বর্তমান প্রাচুর্যের কারণে বই হয়তো তার স্থান থেকে অনেকটাই অপসারিত হয়েছে। বইয়ের স্থানে আজকাল নানান ইলেকট্রনিক দ্রব্য পুরস্কার হিসেবে দেবার চল হয়েছে। তবে বই হলো এমন একটি উপহার যাকে প্রতিদিনই খোলা যায়।
ছোট্ট একটি উপহার সম্পর্কের মাঝে গভীরতা বাড়াতে পারে অনেক। আর সে উপহার যদি হয় মনের মতো, তাহলে তো কথাই নেই। আজ এই স্বল্প পরিসরে উপহারের গুণ এবং মানুষের জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
উপহারের গুরুত্ব মানব জীবনে অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে অনেক গুণী অনেক কথা বলেছেন। আসলে মঙ্গল ময় স্রষ্টা তোমাকে যা বানিয়েছে তা হলো তার পক্ষ থেকে তোমার জন্য উপহার, আর জীবনে তুমি যা হও তা হলো স্রষ্টার প্রতি তোমার উপহার। এই উক্তির প্রধান বিষয়বস্তু হলো মানুষ ঈশ্বরের এক উন্নত সৃষ্টি। সে তার সৃষ্টিশীলতার দ্বারা , সেবার দ্বারা সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আর সেটাই হবে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে দেওয়া তার সেরা উপহার। উপহারের ক্ষেত্রে কোন দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক থাকবে না।
উপহারের চেয়ে উপহার দাতাকে আমাদের ভালোবাসার চোখে দেখতে হবে। কারণ উপহার যিনি দিচ্ছেন তার গুরুত্ব অনেক বেশি, উপহারের আকারের থেকে। এ প্রসঙ্গে বলি-
‘ কাঙালের দেওয়া ছোট উপহার-
ডাস্টবিনে দিলি ফেলে
জানিস কতটা ভাগ্যে তোদের
এই উপহার মেলে?
অনাথ শিশুর হাসিমুখ দেখা
স্বর্গ শোভন যেন-
ধনী লোকের দামি উপহার
ভলো লাগা নেই হেন। ‘
কাউকে যখন কিছু দেওয়া হয় তখন আমাদের ভাবনা টা এমন হওয়া উচিত যে, এর ফলে আমার জীবন থেকে কিছু চলে যাচ্ছে না। উপরন্তু ঐ একটুখানি দেবার ফলস্বরূপ তার সঙ্গে আমার অন্তরের বন্ধন তৈরি হচ্ছে। যেটার কাছে ঐটুকু কিছু না। এটি অনেকটা মুদির দোকানে তুমি দশ টাকা দিয়ে দশ লক্ষ টাকার জিনিস পাওয়ার অবাস্তব প্রাপ্তি। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই মানবজীবন ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া এক শ্রেষ্ঠ উপহার। এর গুরুত্ব বুঝে আমাদের এমন কিছু করা উচিত যার দ্বারা পৃথিবী উপকৃত হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জীবন পথ মসৃণ হবে।
বর্তমানে এই বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে মানুষ কিছু ক্ষেত্রে সচেতন হচ্ছে। আজকাল বিবাহ, অন্নপ্রাশনের মতো অনুষ্ঠানে গাছের চারা, হেলমেট ইত্যাদি উপহার দেওয়ার চল হয়েছে। পার্থিব নানান উপহারের মধ্যে এই সব উপহার নজর কাড়ে। এছাড়া এর প্রভাব সুদূর প্রসারী। মানুষ সচেতন হচ্ছে, বুঝতে শিখছে। এটাও বিবেকের কাছে একটা উপহার। এছাড়া জীবনের কোনো সন্ধিক্ষণে গুরুজনদের থেকে পাওয়া আশীর্বাদের থেকে বড়ো উপহার আর কি আছে। আসল উপহার তো কাগজে মোড়ানো হয় না, হয় ভালোবাসায় মোড়ানো।।