উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 01
মেধা ভাটনগর একটা দুর্দান্ত পাটকিলে রঙের শাড়ি পরছিলেন। পাটকিলের সঙ্গে বোধহয় সবুজ সুতো মেলানো আছে। হেলিকপ্টার থেকে দেখলে ঋতু পরিবর্তনের কোনও কোনও বিশেষ সময়ে ফসলের খেত বা গুল্ম-জাতীয় গাছের জঙ্গলে এই মিশ্রিত বর্ণ ধর্ম দেখতে পাওয়া যায়। লম্বা দিকে সরু-সরু ডোরা। আঁচলের দিকে যত এগিয়েছে ডোরাগুলো ততই আরও চওড়া আরও অলঙ্কৃত হয়ে গেছে। কালো, মেটে লাল আর গাঢ় সবুজ। কলাক্ষেত্র শাড়ি। শাড়ি বিষয়ে মেধার একটা অদ্ভুত আগ্রহ ও বিস্ময় আছে। তাঁর আলমারিতে হ্যাঙারে ঝুলছে এই রকম বিভিন্ন স্থানের বাছাই করা শাড়ি। সংখ্যায় কুড়ি একুশটার বেশি নয়। কিন্তু প্রত্যেকটি আলাদা করে বিস্ময় জাগাবার মতো। এর মধ্যে যে কোনও শাড়িই তিনি যখন পরে বেরোন, তাঁর নিজের কিরকম একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব হয়। তিনি শুধু পোশাক পরেন নি, যেন এক টুকরো ভারতীয় সংস্কৃতি অঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এই কলাক্ষেত্র শাড়ি তাঁকে উপহার দিয়েছে এক মার্কিন ছাত্র। মেধার উৎসাহে যে তার থিসিসের উপকরণ সংগ্রহের জন্য ভারত দর্শনে আসে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতর যখন সে পলিথিনের মোড়ক খুলে ভারতীয় শাড়ি-বাক্স এবং তার ভেতর থেকে এই অসাধারণ উপহারটি বার করে, তখন মেধা চমৎকৃত, রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। শুধু ছাত্রের দেওয়া উপহার বলে নয়। ভারতীয় ইতিহাসের মেরুদণ্ড যে একাধারে তার গতিশীল গ্রহিষ্ণু ধ্রুপদী শিল্প এবং লোকসংস্কৃতি এই কথাটি টেডকে এবং টেডের মতো অনেককে বোঝাতে পেরেছেন বলে।
মেধা আশা করছেন এখন, ভারতে ফেরবার পর তাঁর শাড়ি কেনার এবং পাওয়ার গতি বেড়ে যাবে, তাঁর সংগ্রহের লাইব্রেরিটা যদি এশিয়াটিক সোসাইটিকে দিয়ে যান, শাড়িগুলো তিনি মিউজিয়ামকে দিতে পারেন, কিন্তু না। তার পরেও এগুলো পরা হবে, তাঁর ছাত্রীদের দিয়ে যাবেন। সযত্নে সংরক্ষিত সুরভিত শাড়িগুলো যাঁরা তাঁকে ভালোবাসে তাদের পরতে নিশ্চয়ই আপত্তি হবে না। এই ভাবে তাঁর সংগৃহীত তথ্য পরবর্তী প্রজন্মের কাজে লাগবে। কারণ ব্যক্তি মানুষ আসে, ব্যক্তিমানুষ যায়, কিন্তু বহু ব্যক্তিমানুষের প্রতিভা ও একাগ্র সাধনার ফল যে সংস্কৃতি তা প্রবাহিত হতে থাকে চিরকাল। সেই প্রবাহ যখন পঙ্কিল, সংকীর্ণ, অগভীর হয়ে ওঠে তখনই দেশ আর দেশ থাকে না ভূখণ্ড হয়ে যায়।
মেধার সব শাড়িই যে উপহার তা নয়, কিন্তু প্রত্যেকটার পেছনে একটা না একটা ইতিহাস আছে। যেমন, গোলাপি-নীলের বমকাই শাড়িটা। এটা তিনি এক ওড়িশি নর্তকীর অঙ্গে দেখেছিলেন। মাছরাঙা উড়ে যাচ্ছে যেন গোলাপি পদ্মবনের ওপর দিয়ে। শাড়িটার সঙ্গে ওড়িশি নৃত্যের সব অসাধারণ ত্রিভঙ্গগুলি মিলে-মিশে আছে। এটা যেদিন পরেন ত্রয়োদশ শতকের নরসিংহদেবের সময়কার কোনও অসামান্য ছন্দোময়ী দেবনর্তকী তাঁর পাশে পাশে ছায়ার মতো ঘোরে। অনেক খুঁজেও যখন কুমকুম সৎপথী নামে ওই নৃত্যশিল্পীটির শাড়ির জোড়া পাওয়া গেল না, মেধা তাকে লেখেন। ফেরৎ ডাকে ভি পি-তে অবিকল ওই শাড়িটি পেয়ে যান। কুমকুম একটা চিরকুটে জানায় এসব শাড়ির জোড়া পাওয়া খুবই মুশকিলের ব্যাপার। সবই অর্ডারি মাল। মেধা আজও জানেন না কুমকুম তাঁর জন্য অত কষ্ট কেন করতে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কুমকুমকে আনা হয়েছিল। অভ্যর্থনা-সমিতিতে তিনি ছিলেন। তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে গিয়ে যেটুকু আলাপ।
বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েই মেধা প্রথম শাড়ির মূল্য বুঝতে পারেন। সেখানে সুবিধের জন্য অনেক সময়েই প্যান্ট পরতে হত। শাড়ি ধোয়া ইস্ত্রি করার অনেক হাঙ্গাম। আইওয়াতে একটা সেমিনার ছিল। ওদেশে যাবার দু চার মাসের মধ্যেই। মেধা পেপার পড়তে উঠলেন, ঘি-ঘি রঙের ওপর বহুবর্ণ বুটির-ফুলিয়া টাঙাইল। লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে দুতিন জন ওদেশী মহিলা প্রতিনিধি তাঁকে এসে বললেন—অসাধারণ, অসামান্য, তুলনাহীন। ভেতরে ভেতরে খুবই আনন্দ মেধার, তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছেন মহিলাদের একজন বললেন—‘সত্যি অসাধারণ, তোমার শাড়ি, তোমার এই পোশাক। এ পোশাক তোমাকেও তুলনাহীন, অপূর্ব করেছে। পরার ভঙ্গিটাই বা কি আর্টিস্টিক। দা সুঈপিং এণ্ড, দা গ্রেসফুল প্লীটস ইন দা স্কার্ট।’ অপর দুজন অবশ্য তখন বলতে শুরু করেছেন—‘ইয়োর পেপার টূ-ইজ ফ্যানটাসটিক…’
ওদেশে এখন বহু বাঙালি, ভারতীয়, বাংলাদেশী রয়েছেন। কিন্তু কাজ-কর্মের জায়গায় প্রায় কেউই শাড়ি পরেন না। কোথাও কোথাও নিষিদ্ধ। অন্যত্র অসুবিধাজনক। কিন্তু মেধা তাঁর ক্লাসগুলো নিতেন শাড়ি পরেই। ক্রমশই তিনি এবং তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা শাড়ি-সৌন্দর্য-সচেতন হয়ে উঠতে থাকেন। একবার একটি ক্লাসে লেকচার আরম্ভ করতে যাচ্ছেন। একটি ফরাসী ছেলে বলে উঠল—‘মাদমোয়াজেল, এক মিনিট অপেক্ষা করুন লক্ষ্মীটি, আমাদের এখনও আপনার শাড়িটা দেখা শেষ হয় নি।’
জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন সন্ধে হয়ে আসছে। আর বেশি দেরি না করাই ভালো। মৈথিলী ভীষণ ক্ষুন্ন হবে। মেধা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, ঘরের জানলা বন্ধ করলেন, দরজায় তালা লাগালেন। সম্প্রতি ছোড়দা এসে জোর করে দোতলায় একটা কোল্যাপসিব্ল করিয়ে দিয়ে গেছে। সিঁড়ির সৌন্দর্য নষ্ট করে দিচ্ছে বলে কোনও লাভ হয়নি। পরের বারে এসে নাকি বার্গলার অ্যালার্মও লাগাবে। কোল্যাপসিব্লটা বন্ধ করতে হবে। তারপর নিচের দরজা, বাইরের গেট। ছোট্ট একটু লন মতো আছে, ধারে ধারে কিছু গুল্ম, কিছু ফুল।
ডাঃ অশোক ভাটনগরের এই বাড়িতে অবশেষে মেধা একলা। তিনি ডাঃ ভাটনগরের তৃতীয় সন্তান। তাঁর বাবার দেশ মীরাট, মায়ের বাংলা। ছেলেমেয়েরা সাধারণতঃ পিতার নাম এবং মাতার সংস্কৃতি গ্রহণ করে। বিশেষত যদি মাতৃভূমিতে থাকে। অশোক ভাটনগর এবং লীলা দত্তের আলাপ-পরিচয়-পরিণয় সব পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে হলেও তাঁরা যখন কলকাতায় কর্মজীবন শুরু করলেন অশোক আস্তে আস্তে কলকাতার উপান্তে এই বাড়ি করেন। লীলা কি ভেবে তাঁর বাড়ির নাম ‘অলম্’ দিয়েছিলেন জানা যায় না। কারণ বাড়ি করলেও অশোক-লীলার জীবনে শেকড় বলতে কিছু ছিল না। অশোক ভুলে গিয়েছিলেন তিনি উত্তর প্রদেশের, লীলাও ভুলে গিয়েছিলেন তিনি বাংলার। যতদিন বেঁচে ছিলেন পৃথিবীর এখানে ওখানে অতিথি-অধ্যাপক, ফেলো ইত্যাদি হয়ে থেকেছেন, ভারতবর্ষের আদ্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন কর্ম উপলক্ষ্যে। ছেলে মেয়েরা কলকাতার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। তাদের বলতেন—‘পালা, পালা। কোথাও শেকড় গাড়বি না। আগ্রহ আর সুযোগ তোদের যেখানে টেনে নিয়ে যায়, চলে যাবি।’ জ্যেষ্ঠ কীর্তি ভাটনগর তাই লণ্ডনে ডাক্তারি করেন। ডাক্তারদের পেশা নামেই স্বাধীন। তাদের কোথাও না কোথাও শেকড় গাড়তেই হয়। মেজ মুক্তি সরকারি চাকুরে। সম্রান্ত বুরোক্র্যাট। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে ঘোরাফেরা করছেন—চাকরি জীবনের এই পর্বে। তাঁরও এক হিসেবে শেকড় নেই। কিন্তু নিজের তাগিদে তো নয়! সবই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ছোট প্রজ্ঞা অবশ্য প্রচণ্ড শেকড় ছিঁড়েছে। গুজরাতি ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে তার পার্টনার হিসেবে সে সিঙ্গাপুর, হংকং, টোকিও, ইংল্যাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। কখন তাকে কোথায় পাওয়া যাবে জানতে হলে তার কলকাতার সেক্রেটারিকে ফোন করতে হয়, সে হংকং-এর সেক্রেটারিকে ফোন করে জেনে দেয়। একমাত্র মেধাই শেকড় ছিঁড়তে পারলেন না। ভাটনগর নামের শেকড়, ফার্ন প্লেসের বাড়ির শেকড়, কলকাতার শেকড়। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার প্রশস্ত করিডরে যে লম্বা মেয়েটি ছেলেদের মতো বড় বড় পা ফেলে হেঁটে যেত, তার চেতনার অভ্যন্তরে বসে বসে বিনুনি নিয়ে খেলা করত আশুতোষ বিল্ডিং-এর দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে উপচোনো কলেজ স্ট্রিট দেখতে থাকা একটি উনিশ কুড়ির মেয়ের ইতিহাস। বোম ফাটছে, টিয়ার শেল…মেধা সরে আয়…লাঠি চার্জ…অসীমাভ পায়ে গুলি খেয়েছে, মেধা চলে আয়…লেট মী বি…প্যাকিং কেসের ওপর চড়ে রোকেয়া বক্তৃতা দিচ্ছে…বন্দুকের গুলির চেয়েও তীব্র, অগ্নিময়..ইউনিভার্সিটি লনে ছাত্রসভা…ইনকিলাব জিন্দাবাদ…মেধা ওদিকে নয়…যেদিকে ইচ্ছে যাবো… ইস্স্ চোখের জলে নাকের জলে করে ছেড়েছে। ছোট কমনরুম, মুখে-চোখে জল দে, জলের ঝাপটা, চোখের মণির ওপর জল আছড়ে পড়ছে, আলো চম্কে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে, আলো অমন টুকরো টুকরো কেন? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইলেকট্রনের কণার মতো। অ্যাটমিক বৃত্ত থেকে ছিটকে যাচ্ছে ইলেকট্রন। অ্যাটম বিশেষিত হবে। হয়ে যাচ্ছে ভেতরের প্রচণ্ড জোরালো তাগিদে। মেধা ভাটনগর এইরকম এক বিশেষ তড়িৎকণা বা মানুষ নামধারী সচেতন মৌলের এক ইতিহাসময় আইসোটোপ।
মেধা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা শক্তপোক্ত কাঠামো। দু দফায় সাত বছর সাত বছর চোদ্দ বছর, বেশিটাই যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরে কাটাবার ফলে এখন ভারতীয়, বিশেষত বাঙালি মানদণ্ডে বেশ ফর্সাই। সোজা ভুরু, বসা লম্বা চোখ, চোখের মণি গাঢ় বাদামি। মেধার ঠোঁটও লম্বাটে, বিবর্ণ গোলাপি। চুল সোজা, চকচকে। মধ্যিখানে সিঁথি করে একটা বেঁটে বিনুনি, কিম্বা ছোট্ট হাত খোঁপা। চিবুকে একটি টোল। মেধা এই টোলটি ভয়ানক অপছন্দ করেন। টোল, কোঁকড়া চুল, তিল বা বিউটি স্পট এইসব বিখ্যাত সৌন্দর্য লক্ষণ তাঁর ঘোর অপছন্দ। তাঁর ধারণা এগুলো মেয়েদের ন্যাকা করে দেবার ষড়যন্ত্র। তাঁর মতে বেশির ভাগ মেয়ে তিন শ্রেণীর হয়ে থাকে, হয় ন্যকা, নয় বোকা, নয় তো দুইই। অ্যাফেকটেশন বা ন্যাকামি এক ধরনের স্ত্রীরোগ, জরায়ুর ব্যাধির মতোই। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা এবং ব্যায়াম করে সারানো দরকার। নইলে মনের স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়ে পড়বে। এর বাইরেও আরও নারী-প্রজাতি তিনি শনাক্ত করেছেন যাঁরা সচেতনভাবে পুরুষদের নকল করেন। এঁদের থেকেও মেধা শত হস্ত দূরে থাকার পক্ষপাতী। নিজের চিবুকের টোলটি তিনি রীতিমতো ঘৃণা করেন। ছাত্রজীবনে এর দরুণ তাঁর নাম হয়ে যায় ডিম্পল ভাটনগর। সে সময়ে এবং পরবর্তীকালেও অনেকেই তাঁর এই মারাত্মক টোলের প্রেমে পড়েন। শোনা যায় এরকম একটি নাছোড়বান্দা প্রেমিককে তিনি একবার তাঁর টোলটি উপড়ে নিয়ে তাঁকে অব্যাহতি দেবার প্রস্তাব দেন। একবার প্লাস্টিক সার্জনের কাছেও ঘুরে এসেছেন। টোলের সার্জারির প্রস্তাব সম্ভবত ভদ্রলোক জীবনে এই প্রথম পেলেন। বলেন—‘হোয়াটস রং উইথ ইট?
মেধা নিজের মনের কথা ডাক্তারকে বলবেন কেন। তিনি ডাক্তারের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, নিজের প্রশ্নটাই আবারও করলেন। টোলটার কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না।
মেধার মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের টোলটা বেশ পছন্দ হয়ে যায়। তবে তিনি চালাক লোক। মনের ভাব চেপে গম্ভীরভাবে বলেন—‘ইমপসিব্ল। হয়ত স্ক্রেপ করে গ্র্যাফ্ট্ করে ঠিক করে দিলাম, তারপরেও ইয়োর চিন মে গ্রো অ্যানাদার ডিম্পল।’
এখন মেধা টোলের সঙ্গে সহবাস করতে শিখে গেছেন। ছোটখাটো ব্যাপারে আপস করা যায়। কিন্তু জীবনে আরও অনেক সমস্যা আছে, আরও বৃহৎ, আরও গম্ভীর, গভীর, ব্যাপক, আরও অনেক ভাবে অনিষ্টকর। সমাজের পক্ষে, মানুষের পক্ষে। মেধা সেখানে একেবারে আপসহীন। তবে তিনি আর অসহিষ্ণু নেই। এই সব অনিষ্টের নিরাকরণে তিনি অস্ত্র ধারণ করেন না। কোনও প্রসাধন, প্রহরণ, বাগ-যুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ এসব ছাড়াই তিনি কেল্লাফতে করতে চান। তাঁর হৃদয়ের গভীরে আশা তিনি সোজাসুজি ঠিক সড়কটা দিয়ে হেঁটে চলবেন, সমস্যাগুলো আপনা থেকেই কোনও চৌম্বক শক্তিতে হতাহত হয়ে তাঁর পথের দুপাশে লুটিয়ে লুটিয়ে পরবে। মেধা জানেন তিনি কোনও গড়-উওম্যান নন। এরকম ধারণা করা স্বপ্ন দেখার শামিল। তবু কিছু কিছু মানুষের স্বপ্ন মরতে চায় না। মেধার নিজের অমর হবার সাধ নেই। তিনি চান তাঁর স্বপ্নগুলো অমর হোক, সত্য হোক।
দাদা ছিল কীর্তিশরণ, সে কারো, কোনও কিছুর শরণ নিতে চায় না। বড়ই স্বরাট। মেজদা ছিল মুক্তিনাথ, সে নাথ ত্যাগ করেছে। ছোট বোন ছিল প্রজ্ঞাপারমিতা, সে প্রজ্ঞার পারে যেতে ইচ্ছুক নয়। শুধুই প্রজ্ঞা দেশাই। মেধারও আদি নাম ছিল মেধাশ্রী। তিনিও শ্রীটুকু ত্যাগ করতে চাইলেন। শ্রীহীন হবার ইচ্ছেয় নয়। শ্ৰী-এর সঙ্গে যে হতাশা, অত্যাচার, অবিচার এবং আত্মতুষ্টির অনুষঙ্গ এতকাল ধরে চলে এসেছে তার প্রতি তাঁর তীব্র অনীহা। শ্রী থাকুক, কিন্তু কারো দৈন্যের ওপর ভর করে নয়। সৌন্দর্য থাকুক, কিন্তু কখনোই কুশ্রীতাকে আড়াল করবার জন্য নয়।
কাজেই মেধা সুন্দর, অথচ সুন্দর নন। পৃথিবী যদি সত্যিই কোনদিন বিমুক্ত মনের মানুষের বসতি হয়, যেখানে সৌন্দর্য কোনও পরিমাপগত ধারণা নয়, মুখ যেখানে সত্যি-সত্যিই মনের আয়না, সেখানে মেধা ভাটনগর আরও অনেক স্বাধীন-ছন্দ মানুষের ভিড়ে সানন্দে মিশে যাবেন। সবাই রাজা, সবাই সুন্দর, কারণ সবাই ছন্দোময়, শুভময়। সসাগরা ধরিত্রীর আপন সন্তানের মতো। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন মেধা তাঁর অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক দৈর্ঘ্য নিয়ে ভিড়ের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে থাকবেন। অনেকে বলবে—‘কেমন কাঠ-কাঠ’, ‘ফেমিনিন নয়’ কিম্বা ‘বাপ রে, এতো মেয়ে মেয়ে নয়’ আবার কেউ-কেউ আর কোনও বিশেষণ খুঁজে না পেয়ে বলবে—‘কী চমৎকার! কী অনন্য!’ ভিন্নরুচিৰ্হি লোক:।
খুবই কৌতূহল হয় জানতে মেধা বিয়ে করেন নি কেন। তিনি কি নারীমুক্তিতে বিশ্বাসী উগ্ৰক্ষত্রিয়া? কাউকে পতিত্বে বরণ করবেন না পাছে বিন্দুমাত্র দাসীত্ব করতে হয়। না কি তাঁর কোনও যৌন অক্ষমতা আছে? না কি তেমন কেউ তাঁকে কোনদিনও ডাক দেয় নি। মেধার জীবনে একটা গোপন খবর আছে। তিনি সবার অজ্ঞাতে বিয়ে করেছিলেন। এখনকার তুলনায় সে শৈশবকাল। মাত্র উনিশ বছর বয়সে এক বিশ বছরের বড় রাজনৈতিক দাদাকে। ভদ্রলোক যখন পর্যায়ক্রমে অজ্ঞাতবাসে এবং জেলে, তখন তাঁর আরব্ধ কর্মের কিছু কিছু ভার মেধার ওপর পড়েছিল। তখন তিনি ছাত্রী। ছাত্রফ্রন্টে কাজ করার দায় তাঁর। খুব সম্ভব ছাত্রীর স্বভাববশেই প্রচুর প্রশ্ন করতেন। প্রথম প্রথম জবাব পেতেন, তারপর নিরুত্তর কঠিন দেয়াল। জেল থেকে স্বামীর আদেশ এলো পার্টিপতিদের নির্দেশ নির্বিচারে মেনে চলার। বিস্মিত, ব্যথিত পত্নী প্রবল জেহাদ লিখে পাঠালেন, ক্রমশ চিঠির ধারা ক্ষীণ হয়ে এলো। জেলের মধ্যেই বছর দেড়েকের মধ্যে স্বামী যখন মারা গেলেন তখন মেধার সঙ্গে তাঁর আর কোনও সম্পর্ক নেই বললেই চলে। কাজেই মেধা নিজেও ঠিক জানেন না, তিনি বিধবা না বিবাহ-বিচ্ছিন্ন। তিনি বোধহয় যযাতি-কন্যা মাধবীর মতো। বিবাহিত কিন্তু কুমারী।
মা মারা যাবার পর ফার্ণ প্লেসের বাড়িতে বাবা আর মেধা। বাবা বলতেন—‘কি রে মেধা, সেট্ল্ কর এবার? ত্রিপাঠী বার বার বলছে। ছেলেটা তো ভালোই। মুক্তি খুব সার্টিফিকেট দিচ্ছে।’
মেধার কি খেয়াল চাপল, বললেন—‘ঠিক আছে করব, কিন্তু ওকে এখানে এসে থাকতে হবে। মেয়েরাই বা কেন খালি শ্বশুর-বাড়ি যাবে, বাবা?’
অশোক বললেন—‘যুক্তির দিক দিয়ে তো কথাটা ঠিকই বলেছিস মা। কিন্তু সমাজের কতকগুলো বহুদিনের তৈরি অভ্যাস আছে তো! তাছাড়াও কথাটা কি জানিস? ছেলেরাই শ্বশুরবাড়ি যায়। মেয়েদের মতো ঘটাপটা করে কন্যাবিদায় হয় না বটে, কিন্তু ছেলেরাই যায়। দেখ না, আমিই তো সারাজীবন শ্বশুরবাড়ি পড়ে রইলাম, মীরাট ফিরে গেলাম কি! এখন আমাকে বাঙালি ছাড়া লোকে কি বলবে?
বাবা বাংলা বলেন চমৎকার। শব্দচয়ন, প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার লক্ষ্য করবার মতো। কিন্তু কথায় একটু হিন্দি টান আছে। মেধা হাসল, বলল—‘মীরাটে যে তুমি ফিরে যাবে, কে আছে সেখানে তোমার?’
—‘কেউ না থাক মেধা মাটি আছে?’
—‘হ্যাঁ যে মাটি থেকে উৎখাত হয়েছ মাত্র পনের বছর বয়সে। তাছাড়া বাবা, মাটিটা দেশ, তোমাদের এই পুরনো ধারণাটা ছাড়ো তো! ছাড়ো। মাটিটা দেশ নয়, মানুষগুলো দেশ। দেশের মাটি বলে মাটিতে মাথা ঠেকাও, বিশ্বমায়ের আঁচল-টাঁচলও পাতা থাকতে দেখো কিন্তু দেশের মানুষগুলোই দেশের রূপটা তৈরি করে।’
—‘আমারও তো তাই ধারণা ছিল রে! যত বুড়ো হচ্ছি মনে হচ্ছে মাটিটাই দেশ। মানুষ বদলে যায়, মাটি বদলায় না। হাওয়া, জল, মাটি এসব বদলায় না কখনও। কখনও মিথ্যে বলে না।’
মেধা দেখল বাবা আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছেন। শরিকি বিবাদে উত্যক্ত হয়ে একসময়ে অতি অল্প বয়সে বাবা-মার সঙ্গে তাঁদের কর্মস্থল কলকাতায় চলে আসেন। আর কখনও তেমনভাবে ফিরে যান নি। মীরাটের শুকনো হাওয়া, গরম কালের লু, হাড়ের ভেতর ঢুকে যাওয়া শীতের কামড় এমন কি ভয়ানক দিগ-দিগন্ত অন্ধকার-করা দম-বন্ধ আঁধি পর্যন্ত এখন স্মৃতির আদুরে বেরাল হয়ে গেছে। আবেগপ্রবণ সে নিজেও কম না। সেইসঙ্গে দুঃসাহসী। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। নইলে বিশ বছরের বড় মানুষটিকে অমন গোপনে বিয়ে করতে যাবে কেন? বাবা-মাকে বললে কি করতেন? একটু বোঝাবার চেষ্টা করতেন হয়ত—‘দ্যাখ, ম্যাচটা ঠিক হচ্ছে না, একটু ভাব্।’ কিন্তু সে জেদী মেয়ে, সেরকমভাবে জেদ করলে আপত্তি করতেন না। বরং তার দুঃখের সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন স্তম্ভের মতো। কিন্তু কিরকম একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের মতো করে তখন নিয়েছিলেন ব্যাপারটা। ভেলায় করে একা আটলান্টিক পেরোনোর মতো। প্রজ্ঞা ছাড়া কেউ জানত না। এখনও জানে না।
বাবা বললেন—‘ত্রিপাঠী যদি এক কথায় এসে থাকতে রাজী হয়ে যায় তোরই কি ভালো লাগবে? তার চেয়ে বিয়ে হোক। শ্বশুরবাড়ি যা। তারপর তুই তো তোর বাবার কাছে বেশিটা থাকবিই। কান টানলে মাথা আপনি এসে যাবে।’
মেধার এক গোঁ—‘না। ত্রিপাঠীকে শর্ত করতে হবে।’
বাবা বললেন—‘ঠিক আছে। ওকেই বল কথাটা।’
মজার কথা রঘুনন্দনও প্রস্তাব শুনে ওই একই মন্তব্য করেছিল—‘আমি যদি এ শর্তে রাজি হয়ে যাই তুমি কি আমাকে সম্মান করতে পারবে?’
—‘কেন পারবো না?’ বললেও কিন্তু মেধার এই প্রশ্নের-উত্তরে-প্রশ্নে দুর্বলতা ছিল। প্রশ্নটা সে নিজেকেও করছিল—‘কেন পারবো না?’ এবং জবাবে একটা দ্বিধাগ্রস্ত ‘না’ শুনে মরমে মরে যাচ্ছিল। প্রচলিত সংস্কার ভাঙা অত সহজ না। তখনই মেধার ক্ষীণভাবে মনে হয় পুরুষ সম্পর্কে মেয়েদের যেমন একটা সংস্কার আছে, সে স্বনির্ভর, শক্তিমান হবে, কোনও কোনও জিনিস মেনে নেওয়া তার চরিত্রকে দুর্বল করে, মেয়েদের সম্পর্কেও পুরুষদের সংস্কার থাকাটা স্বাভাবিক। মেয়েরা ধীর-স্থির অথবা লোভনীয় ভাবে চঞ্চল হবে, সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না, অকারণে হাসবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা ভাঙবো না। অথচ অন্যটা ভাঙতে বলব—এটা সুবিচার নয়। মেধা অত্যন্ত সৎ মেয়ে। নিজে নিজেই এই আবিষ্কারটা করার পর থেকে তার বিদ্রোহিণী ভাবটাতে একটু চিড় খায়। অস্বস্তি ছিল, ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু তখন থেকেই সে তার প্রহরণগুলো একে একে বর্জন করছে। তবু, প্রহরণ বর্জন করলেও মহাবিদ্যা মহাবিদ্যাই থাকে। মেধা ভাটনগর শক্তিরূপা। যে ভুঁড়োপেটা বুড়ো শিবটিকে সে বরণ করেছিল, সে তার শক্তির স্বরূপ বোঝে নি। সে উপলক্ষ্য। তাকে উপলক্ষ্য করেই মেধার মধ্যে শক্তির খেলা আরম্ভ হয়। এখন কোনও উপলক্ষ্যের দরকার আর নেই, সমস্ত পৃথিবী, গোটা সিসটেমটাই তার শিব, তাকে অবলা অনিমন্ত্রিতা বলে দক্ষযজ্ঞে যেতে দিচ্ছে না। মেধাও একটার পর একটা রূপের খোলস মোচন করে নতুন নতুনতর শক্তিরূপ দেখাচ্ছে, দেখিয়ে চলেছে। কিন্তু হায়, একদম একলা-একলা বুঝি সতিই কিছু হয় না।
ত্রিপাঠীর সঙ্গে বিয়েটা হল না। বাবা মারা গেলেন, মেধা ফেলোশিপ নিয়ে বস্টন গেল। সেখানে থাকাকালীন একটি ব্রিলিয়ান্ট ডিভোর্সীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অলয় মুখার্জি। ছেলেটির কেরিয়ার সোনার জলে লেখা। অ্যাকাডেমিক মহলে সুনামও খুব। মেধা যখন প্রায় ঠিকই করে ফেলেছে তার প্রস্তাবে মত দেবে, সেই সময়ে তার পূর্বর্তন স্ত্রী তনিমা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সাক্ষাৎকারটা পুরোপুরি অনুধাবন করবার মতো। ডিসেম্বর মাস। জানলার বাইরে তাকালে সব শুধু সাদা দেখাবে। হাওয়া আছে বেশ। বরফের ঝুরোগুলো তাই হিসহিসিয়ে দিক পরিবর্তন করছে ঘন ঘন। এই শব্দ ভীষণ ভালো লাগে বলে টয়লেটের স্কাইলাইটটা মেধা খুলে রেখেছে। বসবার ঘরে জানলার দু’ পাশে পর্দা ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। কোলের ওপর লাল পাতলা কম্বল। একটা বিখ্যাত রুশ নভেল পড়ছে মেধা। ‘ডেড সোলস।’ প্রথম খণ্ডের শেষ অধ্যায়ে এসে গেছে সে, পেঙ্গুইন এডিশনের ২৫৯ পাতা, এখনও মনে আছে—‘ইজ ইট নট লাইক দ্যাট দ্যাট য়ু টূ রাশিয়া, আর স্পীডিং অ্যালং লাইক আ স্পিরিটেড এয়কা দ্যাট নাথিং ক্যান ওভারটেক?…’ ড্রাইভ ওয়ে দিয়ে একটা ওল্ডসমোবিল ঢুকে এলো, ওয়াইপারের কাঁটাগুলো প্রাণপণে উইণ্ড স্ক্রীন থেকে বরফ সরাচ্ছে। দুদিকে দুটো অ্যাপার্টমেন্ট। ডানদিকেরটা ওর। মাঝখানে ড্রাইভ ওয়ে, ভায়োলেট রঙের মনে হল গাড়িটা, খুব অদ্ভুত রং, গাড়িতে চট করে দেখা যায় না। তবে না-ও হতে পারে। একে ঘন তুষারপাত, তার ওপর আধা-অন্ধকার। ভুল হতে পারে। ভায়োলেট গ্রেটকোট, টুপি নেমে এলো, গাড়ি লক করল। মেধা দেখছে। তার অ্যাপার্টমেন্টে রিং হল। দরজা খুলে দিয়েছে, সামনে ভায়োলেট ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে পুতুলের মতো একটি মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
—‘আসতে পারি?
—‘নিশ্চয়ই! আপনি!’
—‘আমি তনিমা ভট্টাচার্য। এক্স মিসেস অলয় মুখার্জী।
—‘আসুন।’
মেয়েটিকে বসিয়ে মেধা রান্নাঘরে গেল। দুটো লম্বাটে বিয়ার মগে কফি নিয়ে ফিরে এলো। বলল—‘আমি বড় বড় কাপে বেশি-বেশি কফি খেতে ভালোবাসি। তোমার অসুবিধে হচ্ছে না তো!’
—‘না না। খুব ভালো হয়েছে। তাছাড়া কফি ইজ দি থিং। আমিও প্রচুর কফি খাই।’ কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর তনিমা বললে—‘তোমার ক্র্যাকার্স নেই;
—‘ওহ্ হো, ভুলে গেছি। মনে করো না কিছু। আনি।’
ক্র্যাকার্স-এ কামড় দিয়ে সে বিনা ভূমিকায় বলল—‘তোমাকে সাবধান করে দিতে এলুম। আমার যা অভিজ্ঞতা সেটা তোমাকে না বলা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আফট্রল আমরা দুজনেই ইন্ডিয়ান। শুনে তুমি নিজে ঠিক করো কি করবে।’
আর এক চুমুক কফি পান হল, তনিমা বলল—‘অলয় মুখার্জি ইজ আ ফার্স্ট ক্লাস স্কাউন্ডেল। হ্যাণ্ডসম চেহারা। বিতিকিচ্ছিরি রকমের ভালো কেরিয়ার। সাংঘাতিক ভালো চাকরি। দেখেশুনে আমার বাবা মা আমি স-ব গলে বাটি বাটি জল হয়ে গেলুম। পাত্রপক্ষের চাহিদা কি? কিচ্ছু না, বনেদী ঘরের সুন্দরী গ্র্যাজুয়েট মেয়ে। দেখো আমি তাই কি না।’
তনিমা উঠে দাঁড়িয়ে তার টুপি খুলে সোফায় রাখল, চুল থেকে কি একটা খুলে নিল। কালো প্রপাতের মতো চুলের স্রোত ঝাঁপিয়ে পড়ল, সে চুলের, শুধু চুলেরই কী শোভা! মায়াপ্রপঞ্চময়। টুকটুকে ফর্সা। এরকম গোলাপি ইংরেজরা যাকে মিল্ক অ্যাণ্ড ক্রিম, বাঙালিরা যাকে দুধে-আলতা রঙ বলে এ জিনিস বনেদী আরব্য কি পারস্য ঘরানার মুসলমানী মেয়ে ছাড়া চট করে দেখা যায় না। কুচকুচে কালো চোখ, কালো ভ্রূ। ছোট্ট নাক। চিবুকটা যেন কাট্ গ্লাসের, নিখুঁত তার কাটিং, ছোট ছোট ঝিনুকের মতো আভাময় কান।
তনিমা বলল—‘হয়েছে?’
—‘কি হবে?
—‘দেখা হয়েছে আমি সুন্দরী কি না?’
—‘হয়েছে। তুমি পুতুলের মতো সুন্দর।’
—‘এটা কি একটা কমপ্লিমেন্ট হল?’
মেধা সতর্ক হয়ে গেছে, বলল—‘হল না?’
—‘কি জানি! ডল’স হাউজের অলুক্ষুণে অ্যাসোসিয়েশনটা পুতুল-টুতুল বললেই মনে এসে যায়। এনি ওয়ে আই টূ হ্যাভ ব্যাংগ্ড্ আ ডোর, দো ইট হ্যাজ ফেইলড্ টু রিজাউন্ড নাইক নোরা’জ। যাই হোক, এখানে এসে চমৎকার সাজানো সংসার পেয়ে গেলুম। সংসার করতেই আমি ভালোবাসুতুম। বি এটা পাশ করে কোনমতে বা্বাঃ বলে নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছিলুম। ম্যাগাজিন পড়ে পড়ে আর টি ভি দেখে দেখে শিখে নিলুম কত কিছু যা বাগবাজারের চক মিলোনা বাড়িতে কল্পনাও করতে পারতুম না। ফুল পাতা গাছ। পর্ক, বেকন, ক্র্যাব, লবস্টার, কত রকম, কত কিছু। ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি রূপবান গুণবান বরখানাকে। একবার এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। অনেকে আসবে। খুব সেজেছি, অলয় গাড়ি চালাচ্ছে আমি পাশে বসে। গাড়ি স্পীড নিয়েছে ভীষণ, আমার মনে হচ্ছে দুজনে মিলে আকাশে উড়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে যমদূতের মতো ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে ধরল। এ দেখাও, সে দেখাও, ট্রাফিক রুল ভেঙেছ, অমুক কোর্টে তমুক দিন জবাবদিহি করতে হবে। জানোই তো এখানকার ব্যাপার-স্যাপার। যমদূত চলে গেল। হঠাৎ আমার গালে একটা ঠাস করে চড় এসে পড়ল। অবাক হয়ে ফিরে দেখি অলয় লাল চোখে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। বলল—‘পেছনে সার্জেন্ট ধেয়ে আসছে, দেখোনি কেন? আমায় বলে নি কেন?’ চোখ দিয়ে ব্যথায় জল ঝরছে, আমি বললুম—‘এই জন্য তুমি আমায় মারলে?’
অলয় বলল—‘সী হোয়াট আই ডু নেক্সট্।’
আরেকটা ঘটনা। রবিবার। আমার শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে। অলয়ও বিছানায় শুয়ে মুখে সিগারেট নিয়ে আয়েস করছে। বলল—‘চা নিয়ে এসো।’ আনতে যাচ্ছি, টেলিফোনটা বেজে উঠল, হঠাৎ পেছন থেকে আমার চুলে হ্যাঁচকা টান। অবাক হয়ে দেখি অলয় ডান পায়ের বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা দিয়ে আমার চুলের তলার দিকটা সাঁড়াশির মতো ধরেছে, মুখটা আমার আপনি উল্টে ওদিকে ফিরে গেছে। মুখের সিগারেট দাঁত দিয়ে চেপে বলল—‘টেলিফোনটা না ধরে কোথায় যাচ্ছো মহারাণী! হু ডু য়ু থিংক য়ু আর?’
আরও অনেক আছে। বলবার দরকার নেই। মনে হয় দুটোই যথেষ্ট। দেশেও অ্যাড দিয়েছে—ব্রিলিয়ান্ট ডিভোর্সী আমেরিকান গ্রীন কার্ড-হোল্ডার ওয়ান্ট্স্ সুটেব্ল্ ম্যাচ। রেস, কাস্ট, নো বার। ভালো মন্দ খেতে ভালোবাসে। রান্না বা গৃহস্থলীর কাজ করতে ঘেন্না করে। এখন তুমি ভেবে দেখো।’
তনিমা উঠে দাঁড়াল, চলে যাচ্ছে। মেধা বলল—‘দাঁড়াও দাঁড়াও, এ যে অদ্ভুত উপন্যাস শোনালে। এসব কথা তো গুজব হিসেবেও রটে। কাউকে তো কখনও বলতে শুনিনি।’
—‘কি করে বলবে? চড় মেরে যখন গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেল, গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল—‘আজ আর শেঠীর বাড়ি যাবো না। যদ্দিন না গালের দাগ মেলায় শপিং-এ পর্যন্ত বার হবে না।’ লোকের সামনে ডার্লিং-ডার্লিং করে আদিখ্যেতা করত তো সব সময়ে। ডিভোর্সের সময় অনেককে বলেছি। কেউ বিশ্বাস করে নি। তুমিও করতে না চাও করো না, মরো, আমি আমার কর্তব্য করে গেলুম। দু বছরের কনট্রাক্টে একটা কাজ করছিলুম, এপ্রিলে শেষ হয়ে যাবে। দেশে মা-বাবার কাছে ফিরে যাবো। আবার বিয়ে করবো। তবে আমেরিকায় আর আসছি না। আমার কাছে আমেরিকা ইজ ইকোয়াল টু অলয় মুখার্জি।
আই হেট দিস কানট্রি।’
মেধার আর অলয় মুখার্জিকে বিয়ে করা হল না। বেশ কিছুদিন ঘুরঘুর করেছিল ভদ্রলোক। কিন্তু দেখলেই তার হাতের দিকে চোখ চলে যেত মেধার। ধ্যাবড়া হাতটা। টকটকে লাল। আঙুলগুলো খুব ক্ষিপ্র মনে হয়। তনিমার গলায় কে যেন বলতে থাকত—‘আই হেট দিস কানট্রি, আই হেট দিস ম্যান।’
গ্যারাজ থেকে স্কুটারটা বার করলেন মেধা। মাথায় হেলমেট চাপিয়ে নিলেন। মৈথিলীর অনুষ্ঠান যখন তখন কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় আরম্ভ এখন পাঁচটা বেজে একত্রিশ মিনিট, যেতে হবে মধ্য কলকাতা। সময়মতো পৌঁছতে পারবেন তো?