আলাপ
কলেজ থেকে বেরতে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে মনামীর। আসলে প্রাক্টিক্যাল ক্লাস শেষ করে আস্তে আস্তে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। তাই কলেজ থেকে বেরোতেই চোখের সামনে গিয়ে বাসটা হুস করে বেরিয়ে গেল। এরপর এক ঘন্টা পর বাস এবার বাধ্য হয়েই বাসস্ট্যান্ডের দিকে আস্তে আস্তে হাটতে থাকে ও। মেদিনীপুর কলেজের প্রথম বর্ষ উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্রী ও। রক্ষণশীল পরিবারের একমাত্র সন্তান বাবা রেলকর্মী মা গৃহবধূ। ওদের যৌথ পরিবার বাবা ও জেঠু। জেঠুর দুই ছেলে দুজনেই ওর থেকে বড়। দাদাগিরি ওর ওপর ভালই হয়। দুই দাদাই কর্মরত। বড় রেলে ছোট ব্যাংকে। বডদার স্ত্রী স্কুলশিক্ষিকা। ছোড়দা এখনো বিয়ে করেনি। ওর ঠাকুমা ওদের সঙ্গে থাকেন। ঠাকুমার রক্ষণশীলতার কারণে ওদের সবাইকেই মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত হতে হয়। উনি নারী শিক্ষার বিরোধী নাত বউয়ের শিক্ষকতার পেশা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি এই নিয়ে নিত্য মতান্তরে জেরবার এদের পরিবার। বডদা স্ত্রীকে নিয়ে মেদিনীপুরে আলাদা থাকে। এই পরিবেশে মেধাবী মনামীর যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। ওর কল্পনাপ্রবণ মন ইচ্ছে ডানা মেলতে চায় কিন্তু পায়ে যে সংস্কারের লোহার শেকল। কলেজের বন্ধুবান্ধব পড়ার পরিবেশে ও প্রাণ খুলে বাঁচে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা ও করেনা ফলশ্রুতিতে মাঝে মাঝেই দেরি হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে তারপর একপ্রস্থ ঝড়ঝঞ্জা চলে ওর উপর। ঠাকুমার শাসানি—-” ঢের হয়েছে আর পড়ার দরকার নেই এবার পাত্রস্থ করে দাও। এক ধিঙ্গি বউ তো সংসারই করল না। তিনিও সেই রাস্তাইধরবেন —–ইত্যাদি— প্রভূতি।
আজও সেই একই অবস্থাই হবে এইসব সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতে বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখে কেশিয়াড়ি বাস দাঁড়িয়ে। তাড়াতাড়ি উঠে একটা জানলার ধারে সিটে বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটা প্রায় ভর্তি হয়ে যায়। ওর পাশে একজন সেনা কর্মী এসে বসেন। বছর 27 /28 এর যুবক সতেজ শাল গাছের মত ঋজু, দুধে আলতা রং, খড্গ নাশা। এক মাথা রেশম কোমল কালো কোকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দুচোখ! দেখলেই ভালো লাগে! ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা ও হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছেন সবার সাথে! দেখেই বোঝা যায় বাংলায় সদ্য এসেছেন! মনামীর কোলে বোটানি প্রাক্টিক্যাল ফাইল টার নেমপ্লেট তা দেখে মনামী কে ইংরেজিতে প্রশ্ন করেন —আপনি কি মেদনীপুর কলেজের ছাত্রী? মনামীর উত্তর শুনে খুশি হয়ে ভাঙ্গা বাংলায় আলাপচারিতা শুরু করেন! ভারতীয় বায়ুসেনার আধিকারিক !ও র নাম এম এস নরসিমা ।কর্নাটকের বাসিন্দা। কলাইকুন্ডা তে পোস্টিং। মাঝে মাঝে সালুয়া রেডার সেন্টারে ও যান ।আজও তাই চলেছেন। মনামী কে বললেন—- তোমাকে সরস্বতীর মত লাগছে! তোমাকে” সারদা “বলে ডাকতে পারি কি?
বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি কালো ব্লাউজ পরা মনামী লজ্জায় ভালোলাগায় রক্তিম হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে আকাশ ছেয়ে কালবৈশাখীর কালো মেঘ বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় অঝোর ধারায় বৃষ্টি ওঝড়। ভয় দুর্ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়ে মনামী। নরসিমা সাহস দেয়— ভয় নেই আমি তো আছি, আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো! মনামী ভাবে —সেটাই তো আরো বেশি ভয়! রক্ষণশীল বাড়ির কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না উল্টোপাল্টা ধারণা করবে ও তার পড়াশোনাটাও বন্ধ করে দেবে।-সেই শুরু মনামী ও নরসীমার বন্ধুত্বের। মনামীর কাছে বাংলা শিখতে থাকে নরসিমা।তার ইচ্ছে রবীন্দ্রনাথ পড়বে বাংলায়। মনামী মুগ্ধ হয়ে যায় এক অবাঙালির বাংলা ভাষা প্রীতি ও তার প্রতি সম্মান দেখে। সপ্তাহে তিন দিন মেদিনীপুর আসেন নরসিমা। নিজের কাজ সেরে মনামীর জন্য অপেক্ষা করেন বাসস্ট্যান্ডে। মনামী ক্লাস শেষ করে একসাথে বাড়ি ফেরে। ওই যাত্রাপথ টুকুই ওদের ভালো লাগার সময়। দুজনেই মন খুলে পরস্পরের সাথে গল্প করে। নরসিমা কর্ণাটকী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান নিরামিষাশী।তিন ভাই এক বোন ।ওর ছোট বোনের বিয়ের কথা চলছে। ও মনামীকে বলে— বাঙালি বউদের মতো সাজ আমার ভীষণ ভালো লাগে! তুমি বোনের জন্য এই সাজ কিনে দাও না প্লিজ! আর পায়ে ওই যে লাগায় না— লাল মত— কি যেন বলে– লিকুইড— ওটাও দেবে!” মনামী অবাক হয়ে যায় ।এক অবাঙালি পুরুষের চোখে বাঙালি নারীর এই বধু বেশে এত ভাল লেগেছে যে নিজের প্রিয় ছোট বোনকে ওই বেশে সাজিয়ে বিদায় করতে চায়।
ধীরে ধীরে মনামীও নরসিমার বন্ধুত্ব এক বিশেষ দিকে মোড় নিতে থাকে। দক্ষিণী নরসিমার মানসিকতা এত সুন্দর যে মনামী অবাক হয়ে যায়। মেয়েদের সম্মান দেওয়া সেনাবাহিনীর জওয়ান দের কাছ থেকে শিখতে হয়। নরসিমা র সাহচর্যে মনামীর মন কুণ্ঠিত রক্ষণশীল মানসিকতার ঘেরাটোপ বের হতে থাকে। ওর ইচ্ছে ডানা মেলার ইচ্ছা সফল হয়। স্নাতক স্তরে খুব ভালো রেজাল্ট করে ওর শিক্ষকতা লক্ষ্য পূরণের জন্য বি এড এ ভর্তি হয়। এই শিক্ষক শিক্ষণ কলেজ পাঁশকুড়া তে। আবার যাত্রা পথের আলাপচারিতা শুরু হয়। মনামী ধীরে ধীরে নরসিমা কে ভালোবেসে ফেলে। ওর ভীষণ ভয় আতঙ্ক হতে থাকে যদি ওর পরিবারে সম্পর্কের কথা জানতে পারে তাহলে যে কি হবে তাও কল্পনাও করতে পারে না। নরসিমা নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে মনামীকে ঘিরে স্বপ্নের জগৎ রচনা করতে থাকে। এই সময়ে নারসিমার ট্রান্সফারের অর্ডার আসে। এবার আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ— নরসিমা মনামী কে বলে— তুমি যদি অনুমতি দাও আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের কথা বলতে যাব! মনামী র বুক কেঁপে ওঠে!
একবার বাড়িতে নরসিমা প্রসঙ্গ উঠাতে ওকে এক সপ্তাহ কলেজ যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছিল! ঠাকুমাকে ছুঁয়ে দিব্যি করতে হয়েছিল যে সেএই সম্পর্কে জড়াবে না। ও নরসিমা কে সব ঘটনা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। নরসিমা ওকে বোঝায় সব ভালোবাসা বিয়ের পরিণতি পায় না। ওদেরটাও হয়তো তার মধ্যেই পডল। ও এও বলে যদি মনামী রাজি থাকে তাহলে ও বাংলায় চলে আসবে। মনামীর অক্ষমতার অশ্রু বুকের আঁচল ভিজিয়ে দেয়। নারসিমা মনামী কে বলে–সারদা, এই প্রবাসে তোমার বন্ধুত্ব আমাকে পরিবারের থেকে দূরে থাকার কষ্ট ভুলিয়েছে! তোমার সাহায্য আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছি আমার কর্মক্ষেত্রে! তোমায় আমি কখনো ভুলব না! তুমি জীবনে সুখী হবে! তোমার মত মানুষরা কখনো কষ্ট পায় না! আর আমার মনে তোমার যে জায়গাটা আছে তা চিরদিনই থাকবে ওটা আর কেউ পাবে না তুমি কষ্ট পেওনা যেখানেই থাকি না কেন তোমার জন্য আমার শুভকামনা ও ভালোবাসা চিরদিন থাকবে! ভালোবাসা খালি পাওয়ার নাম নয়— ত্যাগেরও নাম! এক বাস যাত্রায় যে আলাপ শুরু হয়েছিল তিন বছর পরে চোখের জলে তার পরিসমাপ্তি ঘটল। আজও মনামীর এই যাত্রাপথে মনে পড়ে তার দক্ষিণী বন্ধুর আলাপচারিতার কথা—– তার দক্ষিণী বন্ধুর মিষ্টি মধুর–“সারদা” ডাক।