আর-একজন কোকিল
নমোসকার। এখোন যেটা লিখবো সেটা বড়দের জননো নয় কিনতু। মানে শুধু ছোটদের জনননা। আমাদের বাংলা বইয়ে পড়েচি–বড়োরা লিখেচে আর ছোটরা–মানে আমরা পড়ছি। বুটু কিনতু অনেক ছোট। আমার চেয়েও ছোট। তাই ওর জননো কে লিখবে। কেউ তো লিখছে না। তাই আমি লিখছি। বুটুর জননো বাংলা বই। ওর পড়ার বই।
অনেকদিন ভেবেছি কি করে বই লেখা যায়। লিখে-লিখে আর ভেবে পারি না। কী যে মুসকিল এই বই লেখা। একটু কঠিন করে লিখতে হবে কিনতু। গলপের বই তো নয় আর। পড়ার বই। সব্বাই বলে গলপের বইয়ের চেয়ে পড়ার বই কঠিন হয় তাই।
আমি গোটা বইটা একা লিখবো না কিনতু। সব বইতে দেখি একেকজন একেকটা পড়ার কঠিন গলপো (ওটাকে কি বলে ঠিক জানি না) লিখেছে। আমিও তাই। সেইরকোম আমি একটা লিখবো। অননোগুলো পাপিয়া, সুমি, কণিকে দিয়ে লেখাবো। তারপর একসংগে বই করে বুটুকে দেবো। আর না পড়তে পারলে বাবার বেতটা নিয়ে মারবো। বাবার মতোন জোরে মারবো না, কিনতু অলপো আস্তে মারবো যাতে ব্যথা লাগবে না মোটেই, কিনতু ভয় পাবে।
নমিতাকে দিয়েও বই লেখাতাম। কিনতু না। ওর সংগে আমার দারুণ ঝগড়া হয়ে গ্যাচে। ঝগড়া হোত না, কিনতু ও-ই আমাকে কালো বলেচে। আর কেউ কিনতু বলেনি। আমাকে মা বলেছিল, যে যাই তাকে তাই বললে খারাপ হোলে রেগে যায়। যেমান ভিকু খোঁড়াকে ল্যাংড়া বললে রেগে গিয়ে আমাদের মারতে আসে। বাবাকে একদিন মা মাতাল বলেছিল। তাই শুনে বাবার কি রাগ। মারতে আসে আর কি মাকে। আমি শুয়ে শুয়ে চোখ পিটপিট করে দেখচিলুম। ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলুম। মাতাল মানে আমি জানি, বুটু জানে না। জানবে কি, ও বাবাকে শুধু বা বলে। আর কাঠের যে ঘোড়াটা মামু দিয়েচিল ওটাকে বলে ঘোরা। আমি ঘোড়া বলি কিনতু। বুটু তো বলবেই। বাচচা তো।
মাতাল মানে আমি পাপিয়াকে জিগগেস করেছিলাম। ও জানে না। আমার মনে হয় বেতাল বলে যে ছোটদের বই আচে (গলপের বই কিনতু) মাতাল মনে হয় তাই। শুধু ব এর জায়গায় ম। মানে বেটাছেলের জায়গায় মেয়েছেলে। তাই বোধহয় ব এর জায়গায় ম। মাতাল মানে বোধহয় তাহোলে মেয়ে বেতাল। কিনতু মা যে বাবাকে মাতাল বোললো বাবা কি মেয়ে? কে জানে!
তাই রাগ হোয়েচিলো আমার যখন নমিতা আমাকে কালো বলেছিল খেলবার সময় মাঠে। ওদের মসতো গাড়ি আছে। ভালো জামা পরা লোক চালায়। কিরকম সব মেশিন লাগিয়েছে আবার গাড়ির ভেতরে। তাতে গান হয়, পাখা ঘোরে। নমিতা ঐ গাড়ি চোড়ে ইসকুলে আসে। আমাদের সংগে খেললে ওর মা বকে, কিনতু তবু ও খেলে। দারুণ স্টাইল করে থাকে সবসময় সিনেমার পোসটারে দেখা সব মেয়েদের মতোন। আমি কিনতু বেশি সাজি না মা মারবে বলে।
যাগগে, যেকথা বলছিলুম। নীলাদি বোলতো যার মা ফরসা, বাবা ফরসা হয় সেও ফরসা হয়। নমিতার বাবা সবাই ফরসা, আমার কিনতু নয়। বাবা ফরসা খালি, মা কিনতু কালো, ফরসা নয়। মাঝে মাঝে তাই ভাবি ইশ মাও যদি ফরসা হোতো। নমিতা সবসময় আমাকে কালি বলে ডাকে, তাতে কিনতু আমি রাগি না। কালি তো ঠাকুরের নাম। কিনতু আমায় কালো বলেছিলো বলেই রাগ হয়েছিলো আমার।
আমি কি ইচ্ছে করে কালো হয়েছি? আমি মাকে জিগগেস করেছিলুম, আমি কালো কেন, ফরসা নই কেন। মা হেসে বলেছিলো, ভগোবান যে রং দেন সে রংই ভালো।
মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক সাবান মেখেচি কিনতু ফরসা হইনি। শুধু শীতকালে একটু অল্প ফরসা হই কারণ সাবান মাখলে গাটা কিরকম সাদা সাদা খড়ির মতোন হয়। পাপিয়া সুমি, কণি–ওরা খড়ি উঠলে জল দিয়ে ধুয়ে দেয় কিনতু আমি দিই না। যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ রেখে দিই। মাকে ডেকে দেখাই। আয়নায় বার বার দেখি। আসলে আমার গায়ের রংটাই কালো।
কিনতু একটা কথা ভাবলে অবাক লাগে। আমাদের অমলকাকুর কথা। অমলকাকু আমার মতোন কালো ছিল কিনতু একদিন দেখি অমলকাকুর ঠোঁট দুটো সাহেবদের মতোন সাদা। আর সব কিনতু তেমনি কালো, সাদা নয়। মাকে আমি জিগগেস করেছিলুম, মা বলেচে ওটা একটা অসুখ। কিনতু অনেকদিনের মধ্যেই অমলকাকুর হাত পা সব সাদা হয়ে গেল। সাহেবদের মতোন। আমার কিনতু ইচ্ছে করছিলো ওরকম হয়ে যেতে। ঠিক মেমদের মতোন। কিনতু আমার হোলো না।
বুটু কিনতু আমার চেয়ে ফরসা, কিনতু বাবার চেয়ে কালো। মা বলে বড়ো হলে ও নাকি আমার মতোই কালো হয়ে যাবে। পাপিয়া, সুমি, কণি, ওরা ফরসা নয় কিনতু অলপো কালো। আমাকে একদিন কণি বলেছিলো ইস, তুই অলপের জননো ফরসা হতে পারলি না। তোর মা যদি ফরসা হোতো তবে তুইও ফরসা হোতি। তাহোলে আর তোর বিয়ের জননো কষ্টো হোতো না।–তখোন থেকেই আমি ভাবচি কি করে ফরসা হওয়া যায়। আবার ভাবি এখোন মা যদি ফরসা হয় তবে কি আমিও হবো। মনে হয় হবো। তাহোলে প্রথমে মাকে ফরসা করা দরকার কিনতু কি করে হবে। মাকে রোজ বলি সাবান মাখতে, মা হাসে। ভেবে ভেবে বুঝতে পারি না কি করে উপায় হবে। ধুর ছাই।
পড়ার বইতে যেমন চ্যাপটা (এক, দুই এমনি) থাকে আমার লেখারও তেমনি থাকবে কিনতু এক দুই নমবোর না দিয়ে তারার ছোবি দেবো। বুটু তারা ভালোবাসে।
কণিকে, সুমিকে আর পাপিয়াকে বলেছি পড়ার বই লেখার কথা। ওরা তো হেসেই খুন। লিখবে কি, খালি হাসছে। কিন্তু বলেছে লিখবে। সবগুলো হোলে চাদুমিয়াকে দিয়ে একসঙ্গে বাঁধিয়ে বই করে বুটুকে দেবো।
কাল রাতে বোতল ভেঙে বাবার হাত কেটে গেছে। তাই বাবা কি অসোব্য সব কথা বলছিলো মাকে। আমি ছুটে গিয়ে বুটুর কান চেপে ধরেছিলুম। যদি ও শোনে তাই। আমি তো বড় হয়েছি, সব বুঝি, বুটু ছোট তো তাই। বাবার হাত দিয়ে দরদর কোরে রকতো পড়চিলো৷ কিরকম করে যেন বাবার ফরসা হাতটা আরো অনেক ফরসা হয়ে যাচচিলো। ঘরে রকতো আর বিচচিরি গনধো ভরতি। বোতলের মধ্যে জল ছিলো, সব পড়ে গ্যাচে মাটিতে, তার গন্ধ বোধহয়। বাবা কি তাহলে নরদমার জল খায় যে ওতে এমোন বাজে গনধো।
তখখুনি কিনতু মাথায় এলো ফনদিটা। মানে ফরসা হওয়ার কায়দাটা। কাউকে এখোন বলবো না। কিনতু মাকে বোলতেই হবে, কারণ মাকে আগে ফরসা করতে হবে।
বেশী চ্যাপটা করলে বাচচাদের ভালো লাগে তাই আরো একটা চ্যাপটা কোরলুম। বুটুর ভাল লাগবে। কিনতু আর একটু কঠিন কোরতে হবে লেখাটাকে। বেশি কোঠিন হচছে না। পাপিয়া লিখতে সুরু করেছে। ও আমাদের খেলার কথা আর ভিকু খোঁড়ার কথা লিখছে। সুমি নীলাদি কবে ওকে লজেনস দিয়েচিলো সেকথা লিখছে। কণি কিনতু ওদের কুকুর আর বেড়ালটার কথা লিখেছে খালি। একদিকে ভালোই হয়েছে। সব রকমের লেখা থাকা ভালো। আজ সককালে মার হাত কেটে গেচিল তরকারি কুটতে গিয়ে। ঠিক বাবার মতোন রকতো পড়চিলো খুব। কিনতু একই রকতো ঠিক বাবার মতোন। যারা ফরসা তাদের রকতো আর যারা কালো তাদের রকতো কি একই রকোম হয়। তাই হবে বোধহয়। তাই মা আর বাবার রকতো একইরকম লাল। রকতো পড়ে পড়ে মার হাতটা সাদা হয়ে গেলো। ব্যানডেজ বেঁধেও রকতো বনধো হচছে না। শেষে অনেক পরে বনধো হলো রকতোটা। মা যনতোনায় মুখ কুচকে রইলো। এটটু পরেই মাকে বললাম ফনদিটা। শুনে মা এতো বকলো যে কি বলবো। মাকে বলেচিলুম মা আমার হাতটা তুমি অমনি করে কেটে দাও তবে আমার হাতটাও সাদা ফরসা হয়ে যাবে। বকুনি খেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। বুটুকে নিয়ে বাইরে চলে এলাম। এখন আর তাহোলে লিখবো না। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি তাই ঘুম ভেঙে গেল চিৎকারে। আমি রোজ মার পাশে বুটুকে নিয়ে শুই। আজও তাই। ঘরে শুধু একটা পিদিম জ্বলচে। সেই আলোয় দেখি মা বিছানায় বসে কাঁদছে আর বাবা ঘরময় ঘুরে বেড়াচে ঠিক যেন কণিদের এলসিয়ান কুকুরটা। বুটুর কানে হাত চাপা দিলাম যাতে ওর ঘুম না ভেঙে যায়, উঠে পড়ে। বাবা চেঁচিয়ে বলচিলো–রোজ রোজ আমি সঝঝে কোরবো না। আজ আমার চাই। কোথায় আছে বলো শিগগিরি। মা কাঁদচিলো, মুখ তুলে বললো আমার যা আছে সবই তোমার পিণ্ডি গিলতে (বেঁচে থাকলে পিণ্ডি হয় নাকি। পাপিয়ার দাদু তো মারা গেছে। তাই ওরা পিণ্ডি দিয়েচে। পিণ্ডিটা বোধহয় খাবারটাবার কিছু হবে।) যাচছে। আর কত চাও। ছেলেমেয়ের মুখটা একবার দেখবে না। বাবা কণিদের পুসির মতোন দাঁত খিঁচিয়ে বললো–চুপ কর মাগী, কথা বলবি তো জিব টেনে ছিঁড়ে নেবো। কোথায় আছে বের কর। মা একবার পেছন দিকে চেয়ে দেখল আমরা শুয়ে আছি কিনা। আমি চুপ করে শুয়ে চোখ বেশী নয়। অলপো ফাঁক করে দেখচিলুম। তাই মা বুঝতে পারলো না। বাবাকে বললো–ওগো, তোমার পায়ে পোরচি, রাত বিরেতে এখন চেঁচামেচি কোর না। ওরা উঠে পোড়বে। একটু থেমে মা আবার বললো– সবই তো তোমাকে দিয়েছি। যা অলপো সনচয় রেখেছি তা মেয়েটা আর ছোট ছেলেটার জন্য। তাও তুমি ওসব অখাদটো জিনিসের পেছোনে ওড়াবে। আমি বেঁচে থাকতে তা হোতে দেবো না। তুমি নিজে তো একটা অমানুষ, এখন ছেলেমেয়েগুলোকেও অমানুষ করবে। বাবা হঠাৎ এগিয়ে এল। এক হ্যাঁচকায় টেনে তুললো আমাকে আর বুটুকে। টেনে নিয়ে চললো রাননাঘরে। ওখানে মেঝেতে দড়াম করে ফেলে দিয়ে দরজা বনধো করে দিল। তারপর দুপদুপ করে চলে গেল।
এদিকে বুটু ঘুম ভেঙে গিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে ঘুম পাড়াতে লাগলাম। অলপো পরেই ও আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আমি বসে রইলুম। কিনতু কিছুই শুনতে পেলাম না।
এইরে, বুটুর জননো লেখা বইয়ে বুটুর কথাই অনেক লিখে ফেলেছি। তবে কোন ভয় নেই। বাঁধাবার আগে যখন পুফ (সুমিদের পেরেস আচে। ওরা পেসে পুফ দেখে, ঠিক তেমন করে আমিও পুফ দেখবো) দেখবো তখন কেটে বাদ দিয়ে দেবো। নয়তো বুটু হাসবে। এখন আর লিখবো না। ভীষণ ঘুম পাচে। (এখোন কিনতু ঘুম পাঁচচে না। যখোনকার কথা লিখছি তখোন ঘুম পাঁচচিলো তাই লিখলুম। বড়োরাও এমনি লেখে।)
সককালে উঠে যা দেখলাম কি বোলবো। এতো মজা আননদো আর খুশি হোল যে আমার নাচতে ইচচে কোরছিলো। সকালে উঠে দেখি রাননাঘরে পড়ে আছি। দরজা তো বাইরে থেকে বনধো। কেমনি করে বেরই। বুটু কিনতু ঘুমোচচে। বাচচা তো। তখনই দেখলুম বেড়ার তলার ফাঁকটা, যেখান দিয়ে ভুলু রাননাঘরে ঢোকে মাংসের হাড় খাবার জননো। চটপট সেখান দিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। অমলকাকু যে ফ্রকটা দিয়েছিলো ওটা পরেছিলাম। একটু ছিঁড়ে গেলো। ছুটটে গিয়ে সদর দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। তারপর রাননাঘরে গিয়ে দরজা খুলে বুটুকে বের করে আনলাম। তারপর শোওয়ার ঘরে গিয়েই আননদোটা হোল। তাড়াতাড়ি বুটুকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম তারপর ছুটটে গেলাম মার কাছে। মা শুয়েচিলো আর–আর কি ফরসা। অনেক-অনেক ফরসা। আগের বারের মতোন শুধু হাত নয়, এবার পুরোটা ফরসা।
হটাৎ দেখি একটু দুরে মার আঁচলের চাবিটা পড়ে আচে আর এটটু রকতো। তাহলে বোধহয় মারামারির সময় বাবার হাত থেকে, মার হাত থেকে কাটা থেকে রকতো পড়েছে। বাবা দেখলুম রোজকার মতোনই বাড়িতে নেই। মাকে অনেক ডাকাডাকি কোরলুম–মা, দেখো, তুমি ফরসা হোয়ে গেচো। মা–ওমা। কি মজা এবার। তাহোলে আমিও ফরসা হবো। নীলাদি বোলেছিলো যে তোর মা যদি ফরসা হোত তবে তুইও ফরসা হোতিস। তাহোলে মা তো হয়েই গেছে, এবার আমি হব। বুটুর হওয়ার কোনো দরকার নেই–ও তো ছেলে। যতোককন মা ঘুমোচছে ততক্ষণ এটা লিখে ফেলছি। শেষদিকটা ইচচে করে একটু কঠিন দিলুম। পড়ার বই তো, গলপের বই তো নয় আর। আজ গিয়ে নমিতাকে কোষে বকুনি লাগাবো আমাকে কালি বলার জননো। রোজ রোজ ইয়ারকি ভালো লাগে না। ওকে বোলবো–এত বড় ধেড়ে মেয়ে হোয়ে মিতথে কথা বলিস কেমন করে রে। চোখের ওপর দেখছিস আমি ফরসা তবু কালি বোলচিস, বানচো তোদের কুকুরটার নাম কালি রাখিস। নাঃ, বড়ডো খিদে পেয়ে যাচে। কতোকখন যে বসে থাকতে হবে কে জানে। বাইরে মনে হয় কারা আসছে। একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। তারপরই গসগস গসগস করে বুটের শবদো। বোধহয় হরিশ কাকুরা বেড়াতে এল। সোততি, কি অবাকই না ওরা হয়ে যাবে মাকে দেখে। কিনতু আর এটটু দেরি কোরে আসতে পারলো না ওরা! ততোকখনে আমিও ফরসা হোয়ে যেতুম। একেই বলে কানডোজ্ঞানহীন এর মতো কাজ করা। মরণ…!