Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আরোগ্য || Ashutosh Mukhopadhyay

আরোগ্য || Ashutosh Mukhopadhyay

ব্যবস্থা দেখে রাধারাণী খুশী।

জীবন এখানে যত্নের জিনিস, লালনের সামগ্রী। পায়ে পায়ে ক্ষয়ের খোড়ল হাঁ করে নেই। এখানে শুধু জীবনের মূল্যবোধটুকুই স্পষ্ট। চারদিক শুচিশুভ্র আরাম দিয়ে ঘেরা। বেশ ঠাণ্ডা নিরাপদ আরাম।

ঘরের দুই কোণে দুটো তকতকে বেড। এর অর্ধেকেরও অনেক ছোট ঘরে চারজনে থেকে অভ্যস্ত তারা, ওইটুকুর মধ্যেই একটা গোটা সংসার। বিবাহিত জীবনের বাইশ বছরের মধ্যে এই প্রথম যেন নতুন বাতাসের স্বাদ পেলেন রাধারাণী। বাঁচার আগ্রহ বোধ করতে লাগলেন, মনের তলায় এক ধরনের উৎসাহ উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।

দিনে ছ টাকা চার্জ। তাও ভূতনাথবাবু ওপর-ওলাদের ধরে পড়ে অর্ধেক দক্ষিণায় রাজী করাতে পেরেছেন বলে। নইলে চার্জ বারো টাকা। কিন্তু দিনে ছ টাকাই রাধারাণীর কাছে আঁতকে ওঠার মত–মাসে একশ আশী টাকা। তার ওপর ওষুধ-পত্ৰ ফল টলে মাসে কম করে আরো পঞ্চাশ টাকার ধাক্কা–হল দুশ তিরিশ! শুনেই রাধারাণী বিগড়ে গিয়েছিলেন। কমাস থাকতে হবে কে জানে…। কিন্তু তিনি নিশ্চিত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন দেখেই মুখ কালো করে ভূতনাথবাবু সরাসরি তাকে এখানে এনে ফেলেছেন। রাধারাণী সাহস করে আর আপত্তি করতে পারেন নি। মুখ খুললেই কুরুক্ষেত্র বাধবে জানেন, তখন আর ভদ্রলোক রোগিণী বলে রেহাই দেবেন না ওঁকে। ছেলেমেয়ের সামনেও এমন কথা বলে বসেন যে চামড়ার নিচে হাড়-পাঁজরসুদ্ধ খটখটিয়ে ওঠে। কিন্তু এখানে জীবন-রক্ষার উপকরণ দেখে রাধারাণীর মনে হল তাদের নেই-নইলে, এর তুলনায় দিনে ছ টাকা ছেড়ে বারো টাকাও কিছু নয়।

ও পাশের বেডে যে মেয়েটি থাকে তার বছর তিরিশ বয়েস। কিন্তু এরই মধ্যে কঠিন রোগ বাধিয়ে বসেছে। পেটে জল হয়েছে নাকি। দেখতে বেশ সুশ্রী। কিন্তু বড় বেশি রকম অবুঝপনা আর বায়নাক্কা। রোজ চারটে বাজতে না বাজতে মেয়েটির স্বামী দেখতে আসে ওকে-কালো মোটাসোটা, বছর চল্লিশ হবে বয়েস। সচ্ছল অবস্থা বোঝা যায়। রাধারাণী শুনেছেন কাগজের কারবার তাদের। লোকটি রোজই কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসে। দুর্মুল্যের ফল, দামী দামী টনিক ফুড, গল্পের বই, শখের ব্লাউস, রুমাল, এমনকি গয়নাও। রাধারাণী দূর থেকে লক্ষ্য করেন, কিছুতে যেন মন ওঠে না মেয়েটার–কোনো কিছুতেই তুষ্ট নয়। লোকটি ঘড়ি ধরে পুরো দুঘণ্টই বসে থাকে তার শয্যার পাশে, স্ত্রীর সব কথাতেই সায় দেয়, সব আক্ষেপে সান্ত্বনা দেয়। দু-তিনদিন অন্তর বছর আটেকের একটি ছেলেও আসে বাপের সঙ্গে মাকে দেখতে। রাধারাণী শুনেছেন, ওই একটিই ছেলে ওদের, পুরনো ঝিয়ের জিম্মায় থাকে, বাড়িতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই।

রাধারাণী অবাক হয়ে ভাবেন, ছেলেটা রোজ আসে না কেন, আর ওই মা-ই বা ছেলেকে রোজ না দেখে থাকে কি করে! ওদিকে স্বামীটির আসতে আধ মিনিট দেরি হলে আধঘণ্টা তার জের চলতে দেখেছেন রাধারাণী। অনেক অনুনয় অজুহাত সাধ্য-সাধনায়ও সহজে মন গলে না। রাধারাণীর এক একসময় রাগই হয় মেয়েটার ওপর, অত পায় বলেই পাওয়ার ওপর এতটুকু শ্রদ্ধা নেই। হত তার ঘরের লোকটির মত, এক দাবড়ানিতে সব ঠাণ্ডা।

যাই হোক, এখানকার এত সব সুব্যবস্থার মধ্যে এসে পড়েও রাধারাণীর মনের তলায় কোথায় যেন যাতনার মত একটু। দু-বেলা খাবার সময় মন বেশ খারাপ হয়। দীর্ঘকালের রক্তাল্পতার রোগী তিনি, হাসপাতালের নির্দেশ অনুযায়ী আহারের রাজসিক ব্যবস্থা। মাছ-মাংসর ছড়াছড়ি। রাধারাণী অর্ধেকও খেয়ে উঠতে পারেন না। এমনি একটুকরো মাছ বাড়িসুদ্ধ লোকের একবেলার বরাদ্দ। এখন খরচের ধাক্কায় তাও জুটছে না নিশ্চয়। মেয়েটা কলেজের আগে ছেলেটাকে সময়মত দুটো ভাত ফুটিয়ে দিতে পারে কিনা তাই সন্দেহ। তার ওপর উঠতে বসতে বাপের বকুনি তো আছেই-বকুনির চোটেই এখন সারা হল বোধ হয় দুটোতে।

সঙ্গে সঙ্গে সামনের বেডের মেয়েটির কথা মনে হয়, আর তার স্বামীর কথা। অবশ্য সাত তাড়ার মধ্যেও ভূতনাথবাবু প্রায় রোজই একবার করে দেখে যান তাকে। দরকারী ওষুধ-পত্র সবই কিনে দেন, তারও মিটসেফে ফলমূল, থাকে কিছু। কিন্তু সে-সবই কিসের বিনিময়ে আসছে সেটা রুক্ষ মূর্তিটির দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়। ভিতরে ভিতরে গুমরে ওঠেন রাধারাণী, এতবড় অসুস্থতার চিন্তাটাও মানুষটার সব থেকে বড় চিন্তা নয় যেন, এখানে এসেও দু-দণ্ড হাসিমুখে কথা বলার নাম নেই। ফলে মেজাজ সব দিন রাধারাণীরও ঠিক থাকে না, এক কথায় তিন কথা শুনিয়ে দেন। বিশেষ করে ওই বেডের মেয়েটির স্বামীটিকে দেখে দেখে তার সহিষ্ণুতা কমেছে অন্যের ঘরে কি, আর তার ঘরেই বা কি…।

সেদিন ভূতনাথবাবু আসতে ইঙ্গিতে রাধারাণী ওই মেয়েটিকে দেখিয়ে কথায় কথা বললেন, কাল সরস্বতীপূজো উপলক্ষে ওর স্বামী ওকে চমৎকার একজোড়া ফরাসডাঙর শাড়ি এনে দিয়েছে–আমাকে আবার ডেকে দেখাল।…ভদ্রলোক কত তোয়াজে রেখেছে মেয়েটাকে, রাধারাণী সেই গল্পও করলেন।

ভূতনাথবাবু হঠাৎ রুক্ষ বিরক্তিতে বলে উঠলেন, আমার তো সাধ্য নেই তোমাকে এখন ফরাসডাঙার শাড়ি এনে দিই–এইতেই তো শেষ হয়ে গেলাম।

শুনে রাধারাণী গুম হয়ে বসে রইলেন। তিনি শাড়ি চাননি। ওই রকম মন চেয়েছিলেন। ওই রকম অনুরাগটুকুই লোভনীয় ছিল।

এক মাসের মাথায়, এই ঘরে একটি মর্মান্তিক ব্যাপার ঘটল।

ওই মেয়েটার স্বামী দুঘণ্টার জায়গায় চার-ঘণ্টা ছ-ঘণ্টা কাটিয়ে যেতে লাগল। শেষ অবস্থা বলেই অনুমতি মিলেছে বোধ হয়।

সেদিন দুপুর থেকেই অক্সিজেন চলছে।

রাধারাণীর বুকের ভিতরটা সারাক্ষণ কাঁপছে থরথর করে। ওই মেয়েটার ভাগ্যর ওপর চোখ দিয়েছিলেন বলে ভিতরে ভিতরে অপরিসীম যাতনা একটা। দুপুরে খুব কেঁদেছেনও, আর প্রার্থনা করেছেন, ঠাকুর ওকে বাঁচিয়ে দিও!

সন্ধ্যে থেকে তার স্বামী নিজেই অক্সিজেন ধরে বসে আছে। শান্ত বিষণ্ণ মূর্তি। রাধারাণীর সেদিকে তাকাতেও কষ্ট।…একসময় দেখলেন, লোকটি অক্সিজেনের নল রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। চুপচাপ স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর বুকের কাছে মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল।

রাধারাণী চমকে উঠলেন। বুকের ওপর ভেঙে পড়বে নাকি এখনো যে শেষ হয় নি। অবশ্য শেষ হতে বাকিও নেই…কিন্তু লোকটা করছে কি!

রাধারাণী হঠাৎ নিস্পন্দ কাঠ একেবারে।

লোকটি মেয়েটির গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি, বালা, আঙটি, সব একে একে খুলে পকেটে ফেলল। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আধঘণ্টার মধ্যে সব শেষ। ডাক্তার মাথা নেড়ে চলে গেলেন। রাধারাণীর বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত তখনো। চেয়ে আছেন বিস্ফারিত নেত্রে। দেখছেন।

…লোকটি শান্ত মুখে একটা ঝোলার মধ্যে স্ত্রীর শাড়ি কটা নিল, মিটসেফ খুলে নিজের আনা বোতলের খাবার আর টনিকগুলো দেখে দেখে পুরল, তারপর ভালো করে স্ত্রীকে আর একবার দেখে নিয়ে শ্রান্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাধারাণী চিত্রার্পিত।

ছেলে এবং লোকজন নিয়ে লোকটি ফিরল প্রায় ঘন্টা দুই বাদে। বারান্দায় খাঁটিয়া পাতা-ওখান থেকেই শ্মশান-যাত্রা।

.

এই একমাসে শরীরের আশাতিরিক্ত উন্নতি হয়েছিল রাধারাণীর। কিন্তু এর পরের তিনদিনের মধ্যেই অনেকটা খারাপ হয়ে গেল। রাতে ঘুম নেই, চোখ বসা, আহারে রুচি নেই, হজমে গোলমাল। দিনরাত গুম হয়ে ভাবেন কি যেন! ছেলে আসে, মেয়ে আসে, ভূতনাথবাবু আসেন–রাধারাণী ভালো করে কথাও বলেন না কারো সঙ্গেই। সকলেই চিন্তিত।

সেদিন সকালে ছেলে একটা ওষুধ দিয়ে যেতে এসেছিল। রাধারাণী তার হাতে খুব যত্ন করে বাঁধা একটা পুঁটলি দিয়ে বললেন সাবধানে নিয়ে দিদির হাতে দিবি, ওনার বড় ট্রাঙ্কের একেবারে তলায় রেখে দেয় যেন।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হতভম্ব মুখে মেয়ে এসে হাজির। এক নজরে দেখে নিল মায়ের হাতে শুধু দুগাছা শাঁখা আর একটা লোহা।

–ওগুলো সব খুলে পাঠালে কেন মা?

রাধারাণী নিস্পৃহ মুখে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন–তুলে রেখেছিস?

-না, চাবি তো বাবার কাছে, বাবা বাড়ি নেই, তুমি

–বাড়ি নেই তো তুই ওগুলো কার কাছে রেখে এলি? ভয়ানক রেগে গেলেন রাধারাণী, কে তোকে এখানে আসতে বলেছে এখন?

–কিন্তু তুমি হঠাৎ ওগুলো সব খুলে পাঠালে কেন?

–পাঠিয়েছি, আমি মরলে ওগুলো তোদের কাজে লাগবে বলে, সবেতে তোর বাড়াবাড়ি–যা শীগগির!…খানিক বাদে একটু ঠাণ্ডা হয়ে বললেন, শরীরের যা অবস্থা, এখানে এ-সব পরে থাকা ঠিক নয়–শেষে হয়ত এটুকুও যাবে তোদের।

মেয়ে কাদ কাদ মুখে উঠে চলে গেল।

রাধারাণীর গত তিনদিনের জ্বালা একটু জুড়োল যেন। টাকাওয়ালা লোকেরই স্ত্রীর প্রতি যে দরদ দেখেছেন…নিজেদের তো প্রতি পয়সার হিসেব! তার অন্তিম শয্যায় কেউ তার গায়ের গয়নার কথা ভাবছে সে-দৃশ্য কল্পনা করেও রাধারাণী বারবার শিউরে উঠেছেন।

.

সেই পুটলি হাতে মেয়ে কাঁদ কাঁদ মুখ করেই বিকেলে ফিরল আবার। রাধারাণী সমাচার শুনলেন।…ছেলে বাপের হাতে পুঁটলিটা দিয়েছিল, আর মেয়েকে বলতে হয়েছিল মায়ের অবুঝপনার কথা। শুনে উনি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েছিলেন খানিকক্ষণ, তারপর আচমকা এক চড়ে ছেলের গালে পাঁচটা আঙুলই বসিয়ে দিয়েছেন, গয়নাগুলো ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিয়েছেন, তারপর না খেয়ে অফিসে চলে গেছেন।

প্রত্যেকটা খবরই রেগে ওঠার মত। রাধারাণী রাগতে চেষ্টাও করলেন। কিন্তু রাগটা তেমন হল না।

সেদিন আর ভূতনাথবাবু তাকে দেখতে এলেন না। তার পরদিনও না।

তার পরদিন এলেন।

গয়না কটা রাধারাণী আবার পরেছেন। একখানা মোটামুটি ভালো শাড়িও পরেছেন। একটু বোধ হয় প্রসাধনও করেছেন। শয্যায় বসেছিলেন, বললেন, বোসো

ভূতনাথবাবু টুলটা টেনে বসলেন। তারপর চুপচাপ চেয়ে রইলেন।

কোটরগত চকচকে দুটো অনুযোগ-ভরা চোখ, হাড় বার-করা চোয়াল, আর শুকনো কালচে মুখের দিকে চেয়ে রাধারাণীর বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল কেমন। সব সময় এই ক্ষয়ের জ্যোতি পোড়া চোখে পড়েও পড়ে না। বিনা ভনিতায় বললেন, আর কতকাল পড়ে থাকব এখানে, সেরেই তো উঠেছি, ডাক্তারকে বল, বাকি চিকিৎসা বাড়িতেই হতে পারবে–আর ভালো লাগছে না।

ভূতনাথবাবু চেয়েই আছেন।

কি কারণে মিট-সেটাই একবার খুলে দেখা দরকার হয়ে পড়ল রাধারাণীর। তাড়াতাড়ি ঘুরে বসে ঝুঁকে সেদিকে হাত বাড়ালেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress