Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আবার যদি ইচ্ছা কর || Narayan Sanyal

আবার যদি ইচ্ছা কর || Narayan Sanyal

অষ্টাদশ-পর্ব মহাভারত স্বহস্তে লিখেও বেচারি গণেশ মহাভারতকার হতে পারেননি। সে হিসাবে এ গ্রন্থের কাহিনীকার হিসাবে আমারও দাবী থাকা উচিত নয়। তবু একটু কিন্তু আছে। দেবাদিদেব গণপতি দ্রুতগতিতে শ্রুতি-লিখন লিখে গিয়েছিলেন মাত্র। আমি তা লিখিনি। নোট নিয়েছি–তারপর নিজের ভাষায় লিখেছি, কাট-ছাঁট করেছি, সাজিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি একমাত্র দ্বৈপায়ন-দাদুর মুখেই গোটা গল্পটা শুনিনি– কিছুটা পেয়েছি কীটদষ্ট পুরাতন দৈনিক ও মাসিক পত্রের পাতায়, কিছুটা বা পূর্বসুরীদের প্রকাশিত গ্রন্থে। তবু নিঃসংশয়ে স্বীকার করতে হবে, এ কাহিনী লেখার মূল প্রেরণাটা পেয়েছি দ্বৈপায়ন-দাদুর কাছে।

দ্বৈপায়ন-দাদু আমার মায়ের অতি দূর সম্পর্কের মামা। তবে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমার জন্মের আগে থেকেই। সম্পর্কটা মায়ের দিক থেকে হলেও বন্ধনটা দৃঢ়তর হয়েছিল বাবার সঙ্গেই। আমার বাবা ছিলেন শিবপুর কলেজের এঞ্জিনিয়ার, আর দ্বৈপায়ন-দাদু মেডিকেল কলেজের ডাক্তার। বয়সে বাবা কিছু বড় হতেন। অথচ দুই ভিন্নপথের বৈজ্ঞানিক কোথায় যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে ওঁদের বাড়িতে কতবার গিয়েছি। ওঁদের সেই বাগবাজারের সাবেকী বাড়িতে। বাবার সঙ্গে তাঁর কি সব আলোচনা হত। আমাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য দাদু আলমারি খুলে ছবির বই বার করে দিতেন। অপূর্ব সব রঙিন ছবির বই। আমি বিভোর হয়ে ছবি দেখতাম। ছবিগুলো আমার শিশুমনে গভীর রেখাপাত করেছিল সেই বয়সেই। তাই বাবা বাগবাজারে যাচ্ছেন শুনলেই আমি বায়না ধরতাম–তাঁর সঙ্গে যাব। মনে হয়, চিত্রশিল্পের দিকে ছেলেবেলা থেকে আমার যে ঝোঁকটা হয় তার জন্য দ্বৈপায়ন-দাদু অনেকাংশে দায়ী। তারপর আর তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না। আমার বাবা গত হয়েছে আজ প্রায় ত্রিশ বছর। এর মধ্যে দাদুকে আর দেখিনি। আসলে আমার বাবাই ছিলেন যোগসূত্র। তিনি গত হওয়ার পর দ্বৈপায়ন দাদুর সঙ্গে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা শিথিল হয়ে আসে। সামাজিক অনুষ্ঠানে দু’ তরফেই নিমন্ত্রণ হয়–মা থাকতে বিজয়ার একখানা করে পোস্টকার্ড ছাড়তেন মনে আছে। তারপর যেমন হয়ে থাকে-ফারাকটা বেড়েই গেছে। তার চেহারাটা আবছা মনে পড়ে। ত্রিশ বছর আগে তাকে শেষবার যখন দেখি তখনই তিনি পঞ্চাশোর্ধ। টকটকে ফর্সা রঙ, কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত একমাথা চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর বাঙলার বাঘের মত একজোড়া পুরুষ্ট গোঁফ। পেশায় ডাক্তার হলে কি হয়, তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল–ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য ও ললিতকলায়।

লেখাপড়া শেষ করে চাকরি-বাকরি করি–বড় হয়ে অনেকবার মনে হয়েছে একবার তাঁর কাছে যাই। গিয়ে দেখি, সেই আশ্চর্য বইগুলো এখনও টিকে আছে কিনা তার আলমারিতে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। দ্বৈপায়ন-দাদু যে এখনও বেঁচে আছেন এ খবরটা জানতাম। শুনেছি এখনও তিনি চলে ফিরে বেড়াতে পারেন। ছানি কাটাবার পর চোখেও আবার দেখতে পাচ্ছেন।

বছরখানেক আগেকার কথা। কী খেয়াল হল–আমার সদ্য প্রকাশিত একটি গ্রন্থের এক কপি তাঁকে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম। লিখলাম–আপনি হয়তো আমাকে ঠিক মনে করতে পারবেন না। খুব ছোটবেলায় আপনি আমাকে দেখেছেন। বাবার সঙ্গে আপনার ওখানে যখন যেতাম তখন আপনি আমাকে অনেক ছবির বই দেখতে দিতেন। তখন আমি নিতান্ত শিশু, কিন্তু তখনই আমার দৃষ্টি প্রথম ছবির জগতের দিকে যায়। এ বইটি সেই ছবির দেখার বিষয়েই। বইটি আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে ভাল লাগবে। বাবাকে তো আর দেখাতে পারলাম না।

দাদুর কাছ থেকে কোন প্রাপ্তিসংবাদ আসেনি। তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম সে কথা।

প্রায় মাস ছয়েক পরে ছোট্ট একটা পোস্টকার্ডে এল ততোধিক ছোট্ট একটি চিঠি। হস্তাক্ষরে বার্ধক্যের ছাপ। হরফগুলো কেঁপে কেঁপে গেছে। লিখেছেন, ছিয়াশী চলছে, তাই তোমার বইটি শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগলো। একবার এলে ও-বিষয়ে সাক্ষাতে আলোচনা হতে পারে। আসার সময় আর এক কপি ‘অপরূপা অজন্তা’ নিয়ে এস।

ভাল লেগেছে কি লাগেনি সেকথার ধার দিয়েও যাননি। উনি না যান, আমাকে যেতে হবে। ওঁর কাছে। একটু খটকা লাগল। দ্বিতীয় আর এক কপি বই নিয়ে উনি কী করবেন? যা হোক এক রবিবারের সকালে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। সেই সাবেক বাড়িতে আছেন এখনও। দোতলা বাড়ি। সংস্কারের অভাবে জীর্ণ। পলেস্তারা খসে গেছে এখানে-ওখানে। রেনওয়াটারপাইপ ফেটে গেছে। একটা অশ্বত্থের চারা মাথা চাড়া দিয়েছে কার্নিশে। একতলায় একটা ওষুধের দোকান। সে-আমলে এখানে বসেই উনি রুগী দেখতেন। এখন ডিসপেন্সারী। দোতলায় একটা অংশ ভাড়া-দেওয়া, অপর অংশে থাকেন দ্বৈপায়ন-দাদু আর তার মেয়ে-সীমামাসি। সীমামাসিই দরজা খুলে দিতে এসেছিল। পরিচয় দিতেই আমার হাতটা খপ করে ধরে বলে–ওমা, তুমিই সেই নরেন? এখন কত বড় হয়ে গেছ! পথেঘাটে দেখলে চিনতেই পারতুম না। বাবা! দেখ কে এসেছে।

সীমামাসিকে আমি আদৌ চিনতে পারিনি। কখনও ওঁকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বাবার সঙ্গে যখন আসতাম তখন আমি এইটথ কি নাইনথ ক্লাসে পড়ি। পকেট বোঝাই হয়ে থাকত লাট্টু অথবা মার্বেলে। কোন মাসিকে এ বাড়িতে দেখেছি কই মনে তো পড়ে না। দিদিমাকে মনে আছে। লালপাড় শাড়ি পরনে কাছে বসিয়ে খাওয়াতেন। বোধহয় তখন সীমামাসি শ্বশুরবাড়িতে থাকত। তখনও নিশ্চয় সে বিধবা হয়নি।

দাদুকে দেখেই কিন্তু চিনতে পারলাম। কারণ মায়ের অ্যালবামে তার ফটো দেখেছি। পরিবর্তনের মধ্যে মাথার চুলগুলো বিলকুল সাদা হয়ে গেছে। বসেছিলেন একটা ক্যাম্বিসের ইজি-চেয়ারে। কী একখানা বই পড়ছিলেন। হাতে লাল-নীল পেন্সিল। আমি প্রণাম করতেই বললেন বসো। আর একখানা বই এনেছ?

আমি তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় বইখানি বাড়িয়ে ধরি।

প্রথম পাতাটা উল্টে দেখে বললেন–কই, আমাকে দিচ্ছ তা তো লিখে দাওনি?

কোন পত্রিকায় সমালোচনার জন্য দু’কপি বই দাখিল করতে হয় শুনেছি; কিন্তু–

আমি বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে কলম বার করে ওঁর নাম লিখে বইটি ওঁর হাতে দিলাম। বৃদ্ধও বিনা বাক্যব্যয়ে ইজি-চেয়ার থেকে উঠলেন। টেবিলের টানা ড্রয়ার থেকে মোটা একখানা বাঁধানো খাতা দেখে বইটাতে একটি নম্বর বসালেন। আলমারি খুলে একটা নির্দিষ্ট তাকে বইয়ের নম্বর মিলিয়ে সেটিকে রাখলেন এবং ব্রাউন কাগজে মোড়া একখানি বই নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার বই।

আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে বললেন, আমি বনফুলের সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারিনি। একথা ঠিক যে, সাধারণ বাঙালী পাঠকের ক্ষীর হজম করার ক্ষমতা ক্রমশ লুপ্ত হতে বসেছে; আর দল বেঁধে ফুচকা খেতেই তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তবু আমার বিশ্বাস–তোমার এ বই একদিন দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপতে হবে। তখন এ কপিটা তোমার কাজে লাগবে।

বইটা খুলে দেখি–মার্জিনে অসংখ্য মন্তব্য! বর্ণাশুদ্ধি সংশোধন করেছেন, পাঞ্চয়েসন মার্ক বদলেছেন,–গোটা বইটা প্রুফ রীডিং করেছেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ। বেশ বোঝা যায় কী অপরিসীম পরিশ্রম করেছেন উনি বইটি পড়তে বসে। দু-এক স্থলে ওঁর সংশোধনের অর্থ বোধগম্য হল না। প্রশ্ন করলাম–লেঅনার্দোর ‘লাস্টসাপার’ কথাটা কেটেছেন কেন?

দ্বৈপায়ন-দাদুর চোখদুটি হাসিতে চিকচিক করে উঠল, বললেন, যেহেতু লেঅনার্দো দা ভিঞ্চি ‘লাস্ট সাপার’ নামে কোন ছবি আঁকেননি।

অবাক হয়ে বলি, তার মানে? ‘মোনালিসা’ ছাড়া ওঁর ‘লাস্ট সাপারই তো—

বাধা দিয়ে দাদু আবার বলেন, দেশ তো পাঁচিশ বছর স্বাধীন হয়েছে, নরেন। লেঅনার্দো যে ছবিটি এঁকেছিলেন তার নাম ‘লাস্ট সাপার’ তিনি দেননি। তাঁর ভাষায় যদি বল, তবে বলা উচিত ‘চেনা উলতিমা’ (Cena Ultima)। আর সে-ভাষায় যদি তোমার পাঠক অর্থ গ্রহণ করতে না পারে তবে যে ভাষায় বইটি লিখেছে সেই ভাষাতেই বল, ‘শেষ সায়মাশ’। ইংরাজের দেওয়া নাম এখনও চালাব কেন?

আমি সবিনয়ে ত্রুটি স্বীকার করে নিয়ে বলি, আর এখানে? সিংহল-অবদান জাতকের এখানে জিজ্ঞাসা চিহ্ন কেন?

দাদু বললেন, ঠিক মনে পড়ছে না। পড়ে শোনাও তো।

আমি পড়ে যাই-দ্বীপটির নাম তাম্রদ্বীপ–ইতিপূর্বে জম্বুদ্বীপের বণিক কখনও আসেনি এ দ্বীপে। নারিকেল-ছাওয়া সমুদ্র-মেখলা এই দ্বীপে–

দাদু বাধা দিয়ে বলেন, ও বুঝেছি। তোমার ও-বর্ণনায় আমার আপত্তি ‘নারিকেল ছাওয়া’ শব্দটায়। তুমি জাতকের গল্প শোনাচ্ছ–সিংহল দ্বীপে পলিনেশিয়া থেকে নারকেল আমদানি করা হয় খ্রীষ্টজন্মের পর। খ্রীষ্টপূর্ব সিংহলের বনরাজির বর্ণনায় ‘তমাল-তাল’ চলতে পারে। নারিকেল ওখানে আউট অফ বাউণ্ডস্!

কথা বলতে বলতে দুজনেই মেতে উঠি। আমি সদ্য অজন্তা চষে এসেছি। জাতীয় গ্রন্থাগারে না-হক মাস ছয়েক ঘোরাঘুরি করেছি–অথচ দ্বৈপায়ন-দাদু দেখছি আমার চেয়ে সব বিষয়েই খবর রাখেন বেশি। মতের অমিল হলেই বার করে আনছেন বই– গ্রিফিথ, ইয়াজদানি, লেডি হেরিংহ্যাম, মুকুল দে। টেবিলের ওপর স্তূপাকার হয়ে উঠল ঈশানচন্দ্রের জাতক, ফৌসবোলের জাচকাৰ্থ বৰ্ণনা, বুদ্ধের নানান জীবনী। কোন্ গ্রন্থটি কোন্ আলমারির কোন্ তাকে থাকে তা খুঁজে বার করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হচ্ছে না। দুজনেই ডুবে গেছি অজন্তাসমুদ্রে।

সকাল আটটায় শুরু হয়েছে। তারপর কখন যে ঘন্টা-চারেক কেটে গেছে একেবারেই টের পাইনি। হুঁশ হল সীমামাসি ডাকতে আসায়।

বাবা, তোমার স্নান করার সময় হল যে।

–এই যে সীমা এসেছিস! নরেনের জন্য একটু চা-টা—

–তুমি ছাড়লেই দিতে পারি।

–না না, চা খেতে খেতেই আমাদের চলতে পারে।

মনে পড়েছিল কাঁচি সিগারেটের সেই বিজ্ঞাপনটির কথা। আমি কী হারিয়েছি তা আমি নিজেই জানি না। বইটি লেখার পর ওঁর কাছে না এসে যদি লেখার আগে আসতাম!

সেদিন ওঁর স্নানের জল যে কবার ঠাণ্ডা হয়েছিল তা মনে নেই। তবে ছাড়া যখন পেলাম তখন বেলা দুটো।

কিন্তু ছাড়া কি সত্যিই পেলাম? এমন মানুষকে কি ছাড়া যায়? ত্রিশ বছরের লোকসানটা পুষিয়ে নিতে ঘন ঘনই আমাকে বাগবাজারমুখো ছুটতে হল। এখন বুঝতে পারি, কোন্ আকর্ষণে বাবা ওঁর কাছে আসতেন। দু’চার দিনেই বৃদ্ধ আপন করে নিলেন আমাকে। গিয়েছিলাম আলমারির লোভে কিন্তু এখন দেখছি আলমারির মালিকও কম লোভনীয় নন।

একদিন বললাম, আপনি লেখেননি কিছু? বই-টই?

বৃদ্ধ হাসলেন, পড়েই শেষ করতে পারলুম না-লিখি কখন?

-কখনই লেখেননি? প্রবন্ধ-টবন্ধ?

ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে কিছু লিখেছি। সে-যুগের মাসিক-সাপ্তাহিকে। বই করে ছাপাইনি কিছু।

–আপনার ছবির দিকে ঝোঁক হয় কতটুকু বয়সে?

বৃদ্ধ আবার হেসে বলেন, একেবারে ছেলে বয়স থেকেই। আমার ঠাকুরদা নিজে হাতে কালীপ্রতিমা বানিয়ে পুজো করতেন। তাঁর কাছ থেকে মাটি চুরি করে যখন পুতুল গড়তাম তখন মাজায় কড়িবাঁধা ঘুনসি-ছাড়া বোধহয় আর কিছু ছিল না।

তারপর আবার একটু চুপ করে থেকে বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল আর্টিস্ট হব। গভর্ণমেন্ট আর্টস স্কুলে ভর্তি হব। হলাম গিয়ে ডাক্তার!

-আর্টিস্ট হলেন না কেন?

-বাবা হতে দিলেন না। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ। ডাক্তারী পড়তে পাঠালেন আমাকে। বাবা যে যুক্তি দেখিয়েছিলেন সেটাই ইংরাজি করে বলেছেন হারীন্দ্রনাথ :

‘Doctor’s fees are heavy, lawyer’s fees are high,
Artists are just supposd to entertain and die!’

আবার একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলেন, আচ্ছা তুমি চন্দ্রভান গর্গের নাম শুনেছ? কিম্বা গগনবিহারী পালের?

বললাম, আজ্ঞে না। কে তাঁরা?

সে কথার জবাব না দিয়ে পুনরায় বলেন, অথবা বটুকেশ্বর দেবনাথের?

এবার বলি, হ্যাঁ। বটুকেশ্বর দেবনাথ সে-আমলের একজন নামকরা চিত্রকর। রবি বর্মার স্টাইলে ছবি আঁকতেন তিনি। বেশ জোরালো ড্রইং ছিল তার।

বৃদ্ধ ম্লান হেসে আমার কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন শুধু-নামকরা চিত্রকর! না? বেশ জোরালো ড্রইং! অথচ চন্দ্রভান আর গগনবিহারীর নামই শোননি তুমি।

আবার পেশ করতে হল একই প্রশ্ন, ওঁরা দুজন কে? ছবি আঁকতেন?

বৃদ্ধ যেন নিজের চিন্তাতেই ডুবে রইলেন অনেকক্ষণ। চোখদুটি আধবোজা। হাতদুটি কোলের ওপর জড়ো করে রাখা আছে। ক্যাম্বিসের ইজি-চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে উনি যেন অনেক অনেকদিন আগে ফেলে-আসা পথের বাঁকে বাঁকে পাক খাচ্ছেন। তারপর হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলেন, ওরা তিনজনই আমার সহপাঠী। ঐ চন্দ্রভান, গগন আর বটুক। একই স্কুলে পড়তাম আমরা। চারজনের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। ওর ভেতর আমি আর বটুক ছবি আঁকতাম। চন্দ্রভান আর গগন ছবি আঁকার ধারে কাছেও ছিল না। অথচ–

আবার হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকে। আমি নিশ্চুপ অপেক্ষা করি। খানিক পরে হঠাৎ আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, তুমি তো লিখতে পার। চন্দ্রাভান আর গগনের কথাটা লিখবে নরেন? দল বেঁধে যারা ‘ফুচকো’ খেতে চায় তাদের জন্যে তো অনেক কিছুই লিখছে–যারা ক্ষীর হজম করার ক্ষমতা নিয়ে নিরস্তু উপবাস করত তাদের কথাও কিছু বল না?

বুঝতে পারি একটা গল্পের প্লট এসে গেছে হাতের কাছে। কথা-সাহিত্যের যাঁরা বেসাতি করেন তাঁদের কাছে এ জাতীয় প্রস্তাবে উৎসাহিত হওয়ার কিছু থাকে না। অধিকাংশ মানুষই ভাবে তার জীবনে আছে উপন্যাসের উপাদান, ভাল একটা রোমান্টিক কাহিনীর হিরো হবার জন্যেই সে এসেছে পৃথিবীতে। তাই এ-জাতীয় কথায় কথাসাহিত্যিক কান দেন না। জানেন, কিছুটা সময় নষ্ট করা ছাড়া এতে লাভ নেই কিছু। কিন্তু এক্ষেত্রে বক্তা তার নিজের কথা বলতে চাইছেন না; তাছাড়া বক্তা এখানে রাম শ্যাম-যদু নয় স্বয়ং ডাক্তার দ্বৈপায়ন লাহিড়ী।

আমি এককথায় রাজী হয়ে যাই।

দাদু বলেন, ভাল হত জীবনী লিখতে পারলে কিন্তু ওদের গোটা জীবনটা তো আমি জানি না। যেটুকু জেনেছি তাও অসম্পূর্ণ। অনেক কার্যকরণ সম্পর্ক জানা নেই আমার। তবু ওদের সম্বন্ধে বোধকরি একমাত্র আমার স্মৃতিতেই বেঁচে আছে কিছু তথ্য। আমার সঙ্গে সঙ্গে তাও শেষ হয়ে যাবে। না–আমি কোন কিছুই সাজেস্ট করব না। তুমি ওদের জীবনী লিখতে পার, ওদের কাহিনী দিয়ে নাটক লিখতে পার, বা উপন্যাস লিখতে পার। সে দায়িত্ব তোমার। তবে যা হোক কিছু লিখ ওদের নিয়ে। চন্দ্রভান গর্গ আর গগনবিহারী পালের নাম বাঙালীর জানা উচিত।

আমি বলি, জীবনী কেউ পড়ে না, নাটক লিখলে সেটা মঞ্চস্থ করার হাঙ্গামা আছে। নাটকও কেউ পড়ে না। যদি বলেন, তাহলে একটা উপন্যাসই লিখব দাদু, তবে একটা শর্ত আছে!

কৌতুক উপচে পড়ে দ্বৈপায়ন-দাদুর মোটা ফ্রেমের চশমা ভেদ করে–শর্ত? কী শর্ত?

-আপনাকে একটা ভূমিকা লিখে দিতে হবে।

হো হো করে হেসে ওঠেন দাদু। বলেন, এই কথা? কিন্তু তাহলে আমিও একটি শর্ত আরোপ করব। কঠিন শর্ত!

এবার আমাকে গম্ভীর হতে হয়। বলি, বলুন!

রোজ সকালে উঠে তোমাকে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে হবে–হেই ভগবান, বইটা ছাপা হওয়া পর্যন্ত যেন বুড়ো দ্বৈপায়ন-দাদু টিকে থাকে!

আমি তৎক্ষণাৎ বলি, এ প্রার্থনা মঞ্জুর হলে ভগবানকে আচ্ছা জব্দ করা যাবে। কারণ সে-ক্ষেত্রে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটা আর কিছুতেই লিখব না আমি। দ্বৈপায়ন-দাদু অমর হয়ে থাকবেন।

অট্টহাস্যে ঘর ফাটিয়ে ফেলেন দাদু, এটা বড় জবর বলেছ হে।

সে হাসিটা আজও কানে বাজছে। কারণ এ বই ছাপাখানা থেকে বার হয়ে আসার আগেই দ্বৈপায়ন-দাদু আমাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছেন।

তাই তাঁর ভূমিকাটা আর যোগ করা গেল না।

.

০২.

অবশেষে চার বন্ধু রাজী হল। দেখাই যাক না পরখ করে, ক্ষতি তো নেই। আপত্তি ছিল গগনের। ও এসব বুজুরুকিতে বিশ্বাস করে না। একেবারে মূর্তিমান কালাপাহাড়। দেব-দ্বিজ-হাঁচি-টিকটিকি-মাদুলি-কবচ সব কিছুকেই সে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চায়। তা হোক, সেও রাজী হয়েছে সঙ্গে যেতে। আর কিছু নয়, সারাদিন একসঙ্গে হৈ-হৈ তো করা যাবে। পারানি-নৌকায় গঙ্গা পার হওয়া, কোম্পানির বাগানে বেড়ানো, তাই বা মন্দ কি? তাছাড়া দেখাই যাক না ভণ্ড সাধুর বুজরুকির পরিমাণ।

রবিবার ছুটির দিন। সকালবেলা বাবুঘাটের খেয়াঘাটে গুটিগুটি এসে জমায়েত হয়েছে ওরা চার বন্ধু। খবরটা প্রথমে এনেছিল বটুকটুকেশ্বর দেবনাথ। বরিশালের বাঙাল। সে খবর এনেছে যে, গঙ্গার ওপারে কোম্পানির বাগানে কে এক ত্রিকালজ্ঞ সাধু এসেছেন। প্রকাণ্ড বটগাছটার তলায় ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন প্রায় এক মাস। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারেন। কখনও হস্তরেখা বিচার করে, কখনও স্রেফ তার কপালের দিকে তাকিয়ে। এমন ত্রিকালজ্ঞ অবধূত হাতের কাছে থাকতে তিন-তিনটে মাস অপেক্ষা করার কি দরকার? চল সবাই মিলে ওপারে যাই। বাবার পা জড়িয়ে ধরি; তাহলেই তিনি বলে দেবেন, চারজনের মধ্যে কে জলপানি পাবে, কে স্রেফ পাস করবে আর কে গাড্ডু খাবে। আর্য মিশন স্কুলের চার বন্ধু প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেছে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে ওরা। পাস না ফেল– এ জল্পনার শেষ নেই। দীপু তো রোজ প্রশ্নপত্রগুলি নিয়ে বসে আর প্রশ্নে কত নম্বর পাবে তা আন্দাজে লিখে যোগ করে দেখে। পাস করলে সে সোজা গিয়ে ভর্তি হবে সাহেব-পাড়ার সরকারী আর্টস্কুলে। আর্টিস্ট হতে হবে তাকে। বশ্যা বাঙাল বটুকেশ্বর কথা দিয়ে রেখেছে–সেও লেজুড় ধরবে দীপুর। চন্দ্রভান জমিদারের ছেলে–বাপের মস্ত জমিদারী। ন’দে-মুর্শিদাবাদে হাজার হাজার বিঘে জমির মালিক ওরা। তিনপুরুষ বসে খেলেও সে সম্পত্তি শেষ হবে না। রোজগার তাকে কোনদিনই করতে হবে না। তবে সখের পড়াশুনা কতদিন চালাবে বলা যায় না। আর গগন পাল? ও ডাকাতটা দেহেই বেড়েছে শুধু বুদ্ধিটা বাড়েনি। বয়সে সে ওদের তিনজনের চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের বড়। দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে, তবু এখনও ম্যাট্রিকটা পাস করতে পারল না।

বাবুঘাটের এ পাশে পাটের গুদাম। খোয়া বাঁধানো চওড়া হ্যারিসন রোড দিয়ে সারি সারি ঘোড়ার গাড়ি, পাল্কি আর গো-যান চলেছে। মাঝে মাঝে ঘোড়ায়টানা ট্রামগাড়ির ঘরঘরানি। ভিস্তিতে সাত সকালে জল ছিটিয়ে গেছে, না হলে ধুলোর ঝড় উঠত এতক্ষণে। এক প্রহর বেলাতেই রোদ বেশ চড়া হয়েছে। হবে না? বোশেখ মাস চলছে যে।

ওরা এসে বসে শান বাঁধানো পাষাণ রাণার ওপর। খেয়া নৌকাটা সবেমাত্র ওপার থেকে ছেড়েছে। বোশেখ মাস হলে কি হয়, ডিহি কলকাতার গঙ্গা গ্রীষ্ম-বর্ষার ফর্মুলা মেনে চলে না, চলে জোয়ার-ভাটার আইনে। এখন গঙ্গায় ভরা জোয়ার। পাষাণ রাণার অনেকগুলি ধাপ ডুবে গেছে ঘোলা জলের গর্ভে। কচুরিপানার চাঁই দল বেঁধে ভেসে চলেছে কাকদ্বীপ-সাগরদ্বীপ থেকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির দেখতে।

বটুকেশ্বর বলে–দীপু তোর বাবা আর বাগড়া দিচ্ছেন না তো?

দীপু একটা আড়ামোড়া ভেঙে জবাব দেয়–বাবা আর কিছু বলেননি। মাকে কাল বলেছি বটুকও আমার সঙ্গে ভর্তি হবে। আমি ঐ আর্টস্কুলেই পড়তে যাব কিন্তু! তা মা বললেন, আগে পাস তো কর, তারপর ওঁকে বলব।

চন্দ্রভান গগন পালকে বলে–গগ্যা, তুই এবার কি পড়বি রে?

–আমি? আমি আসছে বছর আবার ম্যাট্রিক দেব!

দূর! এবার তুই ঠিক পাস করে যাবি!

গগন জবাব দেয় না। মাঠ থেকে একটা চোরকাঁটা উবড়ে নিয়ে তার ডাঁটা চিবোতে থাকে। উদাস নেত্রে গঙ্গার ওপারে কি যেন দেখতে থাকে।

কথাটা প্রথম খেয়াল হল বটুকেশ্বরের। বলে–হ্যাঁরে, আমরা সন্ন্যাসী দর্শন করতে যাচ্ছি, একেবারে খালি হাতে যাব?

–খালি হাত ছাড়া কি? কেন, মারামারি বাধবে নাকি?

দূর! তা নয়, আমি বলছিলাম কি, একটু মিষ্টি-টিষ্টি, কি ফল–

দীপু বলে– ঠিক কথা। আমার মাকে দেখেছি তার গুরুদেবের কাছে যাবার সময় ফলমিষ্টি নিয়ে যেতে। তোর কাছে পয়সা আছে বটুক?

চন্দ্রভান ওদের মধ্যে রেস্তওয়ালা বন্ধু। জমিদারের ছেলে। কামিজের পকেট থেকে একটা চকচকে দোয়ানি বার করে বলে–আমার কাছে আছে। যা হোক নিয়ে আয়।

দীপু করিৎকর্মা ছেলে। বড় রাস্তার ধারে দোকান বসেছে। চট করে সেখান থেকে কিনে নিয়ে আসে গোটা চারেক পাকা আম, কদমা আর চিনির মঠ। বলে–কী দাম হয়েছে সব জিনিসের! ভূতো-বোম্বাই আম, তাও পয়সায় দুটোর বেশি দিল না।

বটুক বলে-সামনেই অক্ষয় তৃতীয়া যে। আমের দাম তো এখন বাড়বেই।

চন্দ্রভান বলে–তাও তো এখন পাচ্ছিস। পরের বছর তাও পাবি না।

-কেন? পাব না কেন?

-পূর্ব বাঙলা আলাদা হয়ে গেলে চালান আসবে ভেবেছিস? আম তো আসে মালদা থেকে।

-তোর মাথা থেকে! সে হল গিয়ে ফজলি আম, ভূতো-বোম্বাই নয়। তাছাড়া পূর্ব বাঙলা আলাদা হয়ে গেলেও সে তো মহারানীর রাজ্য ছেড়ে যাবে না। বিহার থেকে কি চালান আসে না?

বটুক বলে, আর তাছাড়া বাংলাদেশ কেটে দুখণ্ড করব বললেই হল? সুরেন বাঁড়ুজ্জে বেঁচে থাকতে ওটি হবার জো নেই।

কিছুই বলা যায় না রে বটুক। সাহেবরা ইচ্ছে করলে না পারে কি?

দ্বৈপায়ন কাগজ পড়ে। অনেক খবর রাখে। সে বললে–অত সহজ নয় হে! লর্ড কার্জনের হুকুমে ছোটলাট ল্যাণ্ড-হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েসানে সব বড় বড় জমিদারদের ডেকে অনেক বুঝাবার চেষ্টা করেছে। এখনও কেউ হুঁ-হাঁ করেনি। ছোটলাট পূর্ব বাঙলায় লম্বা চরকিও মেরে এসেছে। শুনেছি মৈমনসিঙের মহারাজা সূরযকান্ত আচার্য চৌধুরী তার মুখের ওপরেই বলে দিয়েছেন বাঙলা ভাগের প্রস্তাবে বাঙালিরা প্রাণপণে বাধা দেবে।

চন্দ্রভান বলে–আরে মৈমনসিঙের মহারাজা তো হিন্দু। পূর্ব বাঙলার অনেক বড় বড় মুসলমান জমিদারও তো আছে। তারা এতে সারা দেবে। সব মুসলমানই চাইবে–

বাধা দিয়ে বটুক বলে ওঠে–না! আবদুল রসুলও পূর্ব বাঙলার মানুষ।

গগন বলে–ঝাঁট দে! একা আবদুল রসুল কি করবে?

–একা কেন? ঢাকার নবাব শল্লিমুল্লার ভাই আকাতুল্লা, মৌলবী আবদুল কাসেম, আবুল হোসেন, দেদার বক্স, দীন মহম্মদ, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, লিয়াকৎ হুসেন, ইসমাইল সিরাজী, আবদুল হালিম গজনবী–সবাই বঙ্গ-বিভাগের বিরুদ্ধে। এঁরা কেউই হিন্দু নন। পূর্ব আর পশ্চিম বাঙলা কি দুটো আলাদা দেশ, যে কেটে দু’খণ্ড করলেই হল?

এইবার ঝগড়া বেধে যায় বুঝি। চন্দ্রভান তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা বদলে বলে-কই, কি কি আনলি দেখা তো দীপু?

দ্বৈপায়ন কাগজের ঠোঙা খুলে দেখাতে থাকে।

–এ কী রে গর্দভ! পৈতে এনেছিস কেন?

–মাকে দেখেছি ফল মিষ্টির সঙ্গে একটা পৈতাও দিতেন গুরুদেবকে।

আরে দূর! সে তো গুরুদেব, ব্রাহ্মণ মানুষ। এ যে সন্ন্যাসী। এ তো পৈতে পুড়িয়ে ভগবান হয়েছে!

স্থির হয় পৈতেটা আপাতত সরিয়ে রাখা হবে। যদি দেখা যায় সন্ন্যাসীর গলায়, পৈতে আছে তখন কায়দা করে ওটা ঠোঙায় ফেলে দেওয়া হবে।

এবার ওঠ সবাই। ঐ দেখ, খেয়া নৌকা এসে গেছে এপারে।

কিন্তু শুভকাজে নানান বাধা। ঠিক এই শুভ মুহূর্তেই দুটি ছেলে লাফাতে লাফাতে এসে হাজির হল। সূরযভান আর সুশীল। সূরয বলে–দাদা, আমরাও কোম্পানির বাগানে যাব!

–তোরা কোত্থেকে খবর পেলি? কে বলেছে আমরা কোম্পানির বাগানে যাচ্ছি?

আমরা সব জানি। সব টের পেয়ে গেছি। তোমরা সন্ন্যাসী দেখতে যাচ্ছ।

কী আপদ! সূরয হচ্ছে চন্দ্রভানের ছোট ভাই। পিঠোপিঠি। আর সুশীল সেন সূরযের সহপাঠী। ও দুটি আবার মানিক-জোড়। দু ক্লাস নিচে পড়ে। এইটথ ক্লাসে।

হ্যাঁরে, সরকার মশাই জানেন?–চন্দ্রভান সভয়ে প্রশ্ন করে ছোট ভাইকে।

–পাগল! সরকার মশাই শুধু জানেন আমি তোমার সঙ্গে আছি।

তা হতভাগা ছেলে, মরতে খালি পায়ে এসেছিস কেন?

ত্রয়োদশবর্ষীয় সূরযভান তার ধূলি-ধূসরিত নগ্ন পদযুগলের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসে। বলে–এক্কেরে খেয়াল ছিল না।

-নে, আমারটাই পায়ে দে।

দু-ভাইয়ের জুতোর মাপ এক। সূরয মৃদু আপত্তি জানায়।

চন্দ্রভান একটি থাপ্পড় উঁচিয়ে ভাইকে শাসনে আনে। চিনেবাজারে ফিতে বাঁধা জুতো জোড়া খুলে দেয়। সূরয মুখ নিচু করে পরে নেয় দাদার জুতো।

দীপু বলে–এ এক নতুন বখেড়া হল। এসব আণ্ডাবাচ্ছা নিয়ে

বটুক ভিতরের কথা জানে। তাই বলে, আর উপায় নেই দীপু। লক্ষ্মণভাই যখন বায়না ধরেছেন তখন শ্রীরামচন্দ্রকে আর টলানো চলবে না।

চন্দ্রভান একগাল হাসে। স্বীকার করে নেয় অভিযোগটা। না করেই বা কি লাভ? জানতে তো আর বাকি নেই কারও।

পিঠোপিঠি ভাইয়ের এ রকম ভালবাসা সচরাচর নজরে পড়ে না। ঝগড়া নেই, বিবাদ নেই, ভাইয়ের দাদা-অন্ত প্রাণ–দাদাও ভ্রাতৃপ্রেমে অচৈতন্য। ন’দে-শান্তিপুরের জমিদার ওরা। বাপ-মা মরা দু-ভাই। কাকা রাশভারী মানুষ; তিনিই সংসারের কর্তা। শোনা যায়, দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার অগ্নিভান গর্গের শাসনে বাঘ আর গোরু একঘাটে জল খেতে না এলেও নিজ নিজ আবাসে শান্ত হয়ে থাকে। অগ্নিভান খানদানী জমিদার নন–তিন-পুরুষে জমিদারী। অগ্নিভানের পিতামহ ভানুভান গর্গ একদিন পশ্চিমদেশ থেকে এসেছিলেন লোটা এবং কম্বল সম্বল করে। ব্যবসাসূত্রে। গেঁওখালি থেকে কলকাতা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। তিনি ছিলেন উদ্যোগী পুরুষসিংহ। আকাশে তারার ঔজ্জ্বল্য কমতে শুরু করার আগেই তার দিন শুরু হত কানে পৈতা জড়িয়ে। সূর্যোদয়ের আগেই একশ ডন-বৈঠক সেরে ছোলাভিজে ও মিছরি সহযোগে এক লোটা দুধ খেয়ে ফেলতেন। তারপর সারাদিন কাজের চাকায় বাঁধা থাকত তার কর্মসূচী। ধুলিমুঠি নিয়ে সোনামুঠি করেছেন কাঁচামালের ব্যবসায়ে। হাটে হাটে মাল কিনেছেন, মাল বেচেছেন শহরগঞ্জে। প্রথম যুগে ঝাঁকা মাথায় করে, শেষদিকে শুধু হিসাব রেখে। শেষ বয়সে সূর্যাস্ত আইনের কল্যাণে হঠাৎ কিনে ফেললেন জমিদারী। জলাঙ্গীর উত্তর ধারে এক লপ্তে সোনা ফলানো প্রকাণ্ড এক ভূখণ্ড। পাগলাচণ্ডীর একজন জমিদার হয়ে বসলেন। আনন্দময়ী মায়ের মন্দিরের সোপানে তার নাম লেখা সাদা মার্বেলের ফলকটা আজও পায়ে পায়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় নি। ভানুভান নূতন দেশে এসে সবকিছুই করায়ত্ত করেছিলেন, পারেন নি শুধু এ-দেশের ভাষাটা আয়ত্ত করতে। বাঙলা হরফ আদৌ চিনতেন না। সেটা আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর পুত্র ইন্দ্রভান গর্গ। তিনি এমন সুন্দর বাঙলা বলতে পারতেন যে, বোঝাই যেত না বাঙলা ভাষাটা তাঁর মাতৃভাষা নয়। পরিবর্তনের পথে আর এক ধাপ এগিয়ে গেলেন পরবর্তী পুরুষ ভীমভান আর অগ্নিভান। বাঙলাই ছিল তাঁদের মাতৃভাষা। ভীমভান অবশ্য অকালে মারা গেছেন। জমিদারীর মালিক এখন অগ্নিভান। কনৌজী ব্রাহ্মণ ওঁরা। অগ্নিভান ভ্রাতৃপুত্রদ্বয়ের উপনয়ন দিয়েছেন এগারো বছর বয়সে। পাগলাচণ্ডীকে নিজের কাছে রাখেন নি রেখেছেন কলকাতায় গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। সরকার মশাই ওদের স্থানীয় গার্জেন।

চন্দ্রভানের বাবা ভীমভান কবে মারা যান তা ওর স্মরণ হয় না, কিন্তু মা যখন মারা যান তখন ওর বয়স আট, ওর ছোট ভাই সূরযের পাঁচ। মায়ের মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল চন্দ্রভান। মৃত্যুকে সে প্রথম চিনল; কিন্তু মৃত্যুর মহিমা উপলব্ধি করবার মত বয়স ছিল না তখন সূরযভানের। চন্দ্রভান দুটি বাহু দিয়ে আড়াল করে রেখেছিল ছোট ভাইকে। মায়ের অভাবটা বুঝতে দেয় নি। ব্যথা তো শুধু সেখানেই নয়, ব্যথা ছিল আরও গভীর। খুড়িমা ঐ দুটি শিশুকে দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। অগ্নিভান বদমেজাজী রাশভারী মানুষ, তাঁর স্ত্রী ওদের দেখতে পারেন না। ফলে চন্দ্রভানই হয়ে পড়ল ছোট ভাইয়ের একমাত্র অবলম্বন। দুই ভাই যেন কানাই বলাই

কাহিনীর সূত্র হারিয়ে ফেলেছেন দেখে বললাম সন্ন্যাসীর দেখা শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলেন?

দ্বৈপায়ন-দাদু গড়গড়ার নলটা মুখ থেকে নামিয়ে রেখে বলেন–তা পেয়েছিলাম। যদিও তার ভবিষ্যৎবাণী শুনতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল।

-কেন?

–আমরা খেয়ানৌকায় যখন ওপারে পৌঁছলাম তখন সূরয মাথার উপর। বোটানিক্সে আগেও এসেছি। ঝুরিনামা প্রকাণ্ড বটগাছটার অবস্থান জানা ছিল। গুটি গুটি সেখানে হাজির হয়ে দেখি জনমানবহীন বৃক্ষচ্ছায়ায় সন্ন্যাসী একা বসে আছেন পদ্মাসনে। সামনে একটা ধুনি জ্বলছিল, নিবে গেছে। পাশে পড়ে আছে একটা চিমটে আর ত্রিশূল। একটা কমণ্ডলু। কম্বলের একটা আসন বিছানো। সন্ন্যাসীর বয়স কত তা আন্দাজের বাইরে। মাথায় বিরাট জটা, আবক্ষ দাড়ি। শীর্ণ শিরাওঠা দেহ। পরিধানে কৌপীন, উর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। চোখ দুটি আধবোজা, আমাদের দেখতে পাচ্ছেন কিনা বোঝা গেল না। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড এই যে উনি যেখানে বসেছেন সেখানে গাছের ছায়া পড়ে নি। বোধ করি প্রথম যখন ধ্যানে বসেন, তখন ওখানে ছায়াই ছিল–এতক্ষণে ছায়াটা সরে গেছে। বৈশাখের প্রখর রৌদ্রের মধ্যে বসে আছেন উনি–কিন্তু সে অনুভূতি ওঁর নেই। বটুকেশ্বর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল তাঁকে। দেখাদেখি আমরাও। ধ্যানভঙ্গ হল না সাধুবাবার। বটুক ফল আর কদমার ঠোঙাটা ওঁর নাগালের মধ্যে রেখে উঠে দাঁড়ায়। সন্ন্যাসীর গলায় যে পৈতে নেই সেটা আগেই লক্ষ্য হয়েছিল আমাদের। বটুক তাই হাতসাফাই করে পৈতেটা সরিয়ে রেখেছিল। সে আমাদের চোখের ইঙ্গিতে সরে পড়তে বলে। কি আর করা যায়? ধ্যান ভাঙা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষাই করতে হবে। একটু দূরে আমরা গাছের ছায়ায় এসে বসি। গগন কাজের ছেলে। এক প্যাকেট তাস সঙ্গে করে এনেছিল। চন্দ্রভান তাস খেলতে জানে না। তা হোক, আমাদের অসুবিধা হয় নি। সূরযের বন্ধু সুশীল জানে। আমরা চারজনে টোয়েন্টিনাইন খেলতে বসি। চন্দ্রভান আর সূরয এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় আর বকবক করতে থাকে। বেলা তিনটে নাগাদ আমাদের সকলের খিদে পেয়ে গেল। চন্দ্রভান ব্যবস্থা করল। কোম্পানির বাগানের বাইরে বি. ই. কলেজের তিন নম্বর গেটের কাছে একটা মুদিদোকানের সন্ধান পেল সে। নিয়ে এল চিড়ে, গুড় আর সবরিকলা। দোকানিকে বলে-কয়ে বুদ্ধি করে একটা পেতলের লোটাও নিয়ে এসেছিল। ঐ লোটাতে ভেজানো হল চিড়েটা। সামনের পুকুর থেকে পদ্মপাতা তুলে এনে সবাই মিলে ফলার করা গেল।

হঠাৎ বটুক বলে ওঠে-এই, এই দ্যাখ! সাধুবাবার ধ্যান ভেঙেছে।

তাই তো! সাধুবাবা উঠে পড়েছে। আমাদের দেওয়া একটা আম খাচ্ছে বসে। দাড়ি বেয়ে নেমেছে আমের রস! আমরা তৎক্ষণাৎ পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে গুটিগুটি এগিয়ে যাই সেদিক পানে। বটুকেশ্বর আমাদের দলপতি। সকালে আমাদের সাড়ম্বর প্রণামটা সাধুবাবার আধবোজা চোখজোড়া দেখতে পেয়েছিল কিনা মালুম নেই-তাই বটুক আবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। আমরাও দেখাদেখি ঘাসের উপর লম্বা হয়ে পড়লাম। শুধু গগন হাত তুলে জাত বাঁচানো আলতো একটা নমস্কার ঠুকে দেয়। সাধুবাবা খুশি হয়েছেন মনে হল। মিষ্টি মিষ্টি হাসছিলেন তিনি। দক্ষিণ হস্তটি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই বাম হস্তটি প্রসারিত করে বললেন–জিতা রহো বেটা! ক্যা মাংতা রে?

দেখতে হাঁদা মত হলে কি হয়, বটুক তুখড় ছেলে। হাত দুটি কচলে বিনয়ে বিগলিত হয়ে বলে–আপনার দর্শন পেয়েছি। আর কি চাইব বাবা?

সাধুবাবা একটি চিনির মঠ ভেঙে নিদন্ত মাড়িতে সেটি চর্বনের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন; বলেন–সচ? বাঃ বাঃ! অব তো দর্শন হো গয়া। অব ভাগ!

বটুক হাত দুটি জোড় করে বলে–আজ্ঞে হ্যাঁ, যাব তো বটেই; তবে এসে যখন পড়েছি বাবা, তখন আপনার শ্রীমুখ থেকে দু-একটি বাণী শুনে যেতে চাই।

সন্ন্যাসী চিমটিখানা তুলে নিয়ে পুনরুক্তি করেন–যা ভাগ!

চন্দ্রভান ছিল একটু পিছনে। সেখান থেকে বলে ওঠে–চলে আয় বটুক!

সন্ন্যাসী এতক্ষণে নজর করেন ওকে। হঠাৎ ভ্রূ-যুগল কুঁচকে ওঠে ওঁর। চিমটেটা নামিয়ে রাখেন। ইঙ্গিতে চন্দ্রভানকে কাছে আসতে বলেন। চন্দ্রভান এগিয়ে যায়। বসে ওঁর সামনে হাঁটু মুড়ে। কোন কথা নেই। সন্ন্যাসী স্থির দৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন চন্দ্রভানের ভূ-মধ্যে। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ খপ করে ওর চুলের মুঠিটা খামচে ধরে বলেন-ক্যা নাম?

–শ্রীচন্দ্রভান গর্গ!

জনম তারিখ মালুম?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। ঊনত্রিশে জুলাই, আঠারশ নব্বই!

সাহব বন্ গয়্যা ক্যা? চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকি দেন সাধুবাবা।

চন্দ্রভান তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলে-সাতই শ্রাবণ, বারোশ সাতানব্বই।

–তো শিবলোক ইয়ে বৈকুণ্ঠ পসন্দ নেহি হুয়ে? ক্যা রে বেটা?

মাথা মুণ্ড কিছু বোঝা যায় না। চন্দ্রভান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

চুলের মুঠিটা এতক্ষণে ছেড়ে দিয়ে ওকে এক ধাক্কা মেরে সাধুবাবা বলেন–ভাগ। যবন কাহাকা।

চন্দ্রভান পালিয়ে বাঁচে।

কিন্তু বটুকেশ্বর অত সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। ইতিমধ্যে আর একটি আমের খোসা ছাড়িয়ে বাবাজীর ভোগের জন্য বাড়িয়ে ধরেছে। কাকের মত ছোঁ মেরে সেটি তুলে নেন বাবাজী। দু-চোখ বুজে ভূতো-বোম্বাই আম চুষতে থাকেন। আম এবং দাড়ির কিছু অংশ।

বটুক বলে–ও যবন নয় বাবা। বামুন! কনৌজী ব্রাহ্মণ!

বিলকুল যবন! তব শুন্!

সন্ন্যাসী অতঃপর ওঁদের এক বিচিত্র কাহিনী শোনান।

দ্বৈপায়ন-দাদু বলতে থাকেন–যাট-সত্তর বছর আগেকার কথা নরেন, তবু গল্পটা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। তার কারণ সে সময়ে অপরিণত কৈশোরের অবিশ্বাসে গল্পটা যতই আষাঢ়ে মনে হোক না কেন, পরবর্তী জীবনে বারে বারে মনে হয়েছে অদ্ভুত দিব্যদৃষ্টি ছিল সেই সন্ন্যাসীর। জীবনে তাকে ঐ একবারই দেখেছি সেই উনিশ-শ পাঁচ সালের এপ্রিল মাসে; কিন্তু তাঁকে ভুলতে পারি নি সারা জীবনে।

আমি জিজ্ঞাসা করি কী গল্প বলেছিলেন সাধুবাবা?

–গল্প নয়। চন্দ্রভানের জন্মান্তরের কাহিনী বলেছিলেন। শুনেছি, সাধনার এক পর্যায়ে সাধক পূর্বনিবাসজ্ঞান লাভ করেন। তখন তিনি জাতিস্মর হয়ে ওঠেন। পূর্বজন্মে কবে কি করেছেন তা বলে দিতে পারেন। বুদ্ধদেব ঐ দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন–যার ফলশ্রুতি জাতকের অনবদ্য কাহিনীগুলি। কিন্তু এক্ষেত্রে সন্ন্যাসী তাঁর নিজের পূর্বজীবনের কথা তো বলেন নি। বলেছেন চন্দ্রভানের পূর্বজন্মের কাহিনী। কেমন করে বললেন? উনি ওঁর ভাঙা ভাঙা ব্রজবুলিতে যা বললেন তার নির্গলিতার্থ হল–চন্দ্রভান পূর্বজন্মে ছিল যবন। খ্রীষ্টান। কিন্তু খ্রীষ্টান হলে কি হয়, সে ছিল পুণ্যাত্মা লোক। জ্ঞানতঃ পাপ কাজ কিছু সে করে নি। তাই তার মৃত্যুর পর শিবলোক আর বৈকুণ্ঠলোক থেকে দেবদূতেরা তাকে নিতে এল। সীনটা কল্পনা কর নরেন– সাহেব চন্দ্রভানের কোটপ্যান্ট পরা পূর্বজন্মের মৃতদেহ অসাড় হয়ে পড়ে আছে আর দুইদল দেবদূত ঝগড়া করছে। একদল ওকে বৈকুণ্ঠে নিয়ে যাবে, একদল নিয়ে যাবে শিবলোকে। সে ঝগড়া আর থামেই না। শেষে স্বয়ং যমরাজ মীমাংসা করতে সেখানে হাজির হলেন। যমরাজ বলেন, তোমাদের ঝগড়া থামাও! এই যবনের আত্মা কোথায় যেতে চায় তা জেনে নাও। সে যদি বৈকুণ্ঠে যেতে চায়, তবে ওর অক্ষয় বৈকুণ্ঠ লাভ হবে। আর যদি ও শিবলোকে যেতে চায়, তবে তাই হবে। তখন সদ্যমৃত সেই যবনের আত্মাকে জিজ্ঞাসা করল ওরা–সে কোথায় যেতে চায়। ইতিমধ্যে সাধুবাবা গঞ্জিকার কলকেটি হাতে নিয়েছিলেন। তাতে প্রচণ্ড এক টান মেরে তিনি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন–আর ও বেটা এমন বে-অকুফ, ব্যাটা বললে, সে আবার এই পৃথিবীতে জন্মাতে চায়! এই দুনিয়ায় ওর সারা বদনে গর্দা ফেঁকেছে, ওকে পাঁকের মধ্যে পেড়ে ফেলেছে, লাথ মেরেছে–তবু ওটা এমন পাগল, এমন বে-সরম, বে-অকুফ-ও বললে এই দুনিয়াদারীর পাঁকের মধ্যেই ও ফিরে আসতে চায়। কীরে বেটা বুদ্ধ! তাই বলিস নি?

চন্দ্রভান মুখ নিচু করে অপরাধীর মত বসে থাকে।

হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে ওর ছোট ভাই সূরযভান।

সন্ন্যাসী রাগ করে না। সেও অট্টহাস্য করে ওঠে। বলে সাধ মেটে নি এখনও? পাগল, বুদ্ধু কাহাকা!

আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। এমন পাগলের সঙ্গে দেখা করতে এত পরিশ্রম করে এসেছি? একা চন্দ্রভান কেন, আমরা সবাই তো পাগল!

বটুকেশ্বর কিন্তু আশা ছাড়ে নি। বলে–ওটা একেবারে বদ্ধ পাগল, বাবা। ওর কথা বাদ দিন। এবার আমার কথা বলুন। আমি পাস করতে পারব এ বছর?

সন্ন্যাসী মাছি তাড়াবার মুদ্রা করেন। বলেন-তোর কিছু হবে না, সরস্বতী মাইয়ের কৃপা তোর উপর হবে না। যা ভাগ!

বটুকের মুখটা ম্লান হয়ে যায়। বলে,–পাস করতে পারব না বাবা?

সন্ন্যাসী ততক্ষণে তার বড় ছিলিমে আর একটা অন্তিম টান দিয়ে ধোঁয়া গিলে বসে আছেন। মুখের উপর বিরক্তিকর মাছি বসলে লোকে যেভাবে হাত নেড়ে তাড়ায় সেইভাবে বিরক্তি প্রকাশ করলেন শুধু। আমার কিছুমাত্র বিশ্বাস হয় নি। শুধু মজা দেখতে ইচ্ছে হল। নিজের কথাটা সঙ্কোচে বলতে পারলুম না। গগনকে বলি–এই গগ্যা, বাবাকে হাতটা দেখা না; তোকে নিয়েই ভয়। আয়, কাছে আয়–

গগনটা চিরকালই ডাকাবুকো। সে যে এসব বুজরুকির ভিতর নেই এটা প্রমাণ করতে রীতিমত তফাতে দাঁড়িয়েছিল ততক্ষণ। সেখান থেকে ইংরাজীতে একটা জ্ঞানগর্ভ বাণী ঝাড়ল। ম্যাট্রিকে চার্লস ল্যাম্বের সেক্সপীয়র আমাদের পাঠ্য ছিল। ম্যাকবেথ-এর একটা প্যাসেজ ছিল মোস্ট ইম্পর্টেন্ট কোশ্চেন। আমরা মাত্র একবার ম্যাট্রিক দিয়েছি; কিন্তু বার কয়েক ম্যাট্রিক দিয়ে অমন ইম্পর্টেন্ট কোশ্চেনগুলো গগনের একেবারে ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছিল। ও শুনিয়ে দিল, ডাইনীদের ভবিষ্যত্বাণী শুনে ব্যাঙ্কোর সেই অনবদ্য উক্তিটি, ম্যাকেবেথের প্রতি। ব্যাঙ্কো বলেছিল–এরা ছোটখাট ব্যাপারে আমাদের কিছু সত্যিকথা বলে বিশ্বাস উৎপাদন করে। তারপর ভরাডুবি করায়। গগন সেই লাইনটা আউড়ে গেল গম্ভীর কণ্ঠে—“These ministers of darkness tell us truth in little things, to betray us into deeds of greatest consequence.”

সাধুবাবার ততক্ষণে তন্দ্রা এসে গেছে। কম্বলের বিছানায় তিনি লম্বা হয়ে পড়েছেন। শয়নে পদ্মনাভ–চোখ দুটি আরামে বোজা। ইংরাজী শুনে তাঁর চমক ভাঙল। গঞ্জিকাপ্রসাদে সে চোখ দুটি টকটকে লাল। যেন ভস্ম করে ফেলবে গগ্যাকে। গগ্যা ভস্ম হল না। সেও কটমট করে তাকিয়ে আছে। পরমুহূর্তেই সাধুবাবা এমন একটা কাণ্ড করে বসলেন যা স্বপ্নেও আশঙ্কা করি নি তাঁর কাছ থেকে। সাধুবাবা বললেন বাৎ তো ঠিক হ্যায় বেটা! লেকিন ম্যাকবেথ সিওয়া উহ্নোনে হ্যামলেটভি লিখিন থা! না ক্যা রে? নেহি শুনা হ্যায় তু ও “There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy?”

আমরা বজ্রাহত। লেংটিসার ভস্মমাখা জটাধারী বাবার ইংরাজী উচ্চারণ আমাদের থার্ড মাস্টার মহেন্দ্রবাবুর চেয়ে ভাল!

গগন স্তম্ভিত হয়ে এগিয়ে আসে। ঠোঁট দুটি কেঁপে যায় তার। অস্ফুটে বলে– বাবা?

সাধুবাবা ততক্ষণে পুরোপুরি পদ্মনাভ বনেছেন। যোগনিদ্রা আসন্ন। বিড়বিড় করে কোনক্রমে বলেন–হো গা রে বেটা! তেরা বনৎ বনৎ বনি যাই! তেরা বিগড়ি বনৎ বনি যাই!

তার মানে কি?

আমি দাদুকে প্রশ্ন করেছিলাম সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছিল? গগনবিহারী পাস করেছিলেন সে বছর?

দাদু বলেন–না, গগন পাস করতে পারে নি। আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সেই ফেল করেছিল। আমি এবং বটুক জলপানি পেয়েছিলাম, চন্দ্রভান মোটামুটি পাস করে। আর গগন আবার ফেল! আমার অবশ্য পাস করে গভর্ণমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া হয় নি। বাবা আমাকে জোর করে ভর্তি করে দিলেন প্রেসিডেন্সিতে–ফার্স্ট আর্টস পড়তে। বটুক চলে গেল বরিশালে, তার বাপের কাছে। ভর্তি হল ব্রজমোহন কলেজে। যদিও সে সেখানে টিকতে পারে নি। বছরখানেকের মধ্যেই আবার সেখান থেকে পালিয়ে আসে কলকাতায়। এবার ভর্তি হয় সরকারী আর্ট কলেজে। অবনীন্দ্রনাথ তখন আর্ট কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল। আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র বটুকেশ্বরই আর্টস্কুলের শিক্ষা শেষ করেছিল। সেই হয়েছিল পাস করা আর্টিস্ট। আমি ডাক্তার। চন্দ্রভান আর গগন তাদের জীবনে কোন প্রতিষ্ঠা পায় নি।

আমি বলি তাহলে সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী আর ফলল কোথায়?

দাদু বলেন–সেই গল্পই তো শোনাতে বসেছি। ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রীর ভবিষ্যদ্বানী বর্ণে বর্ণে ফলে গিয়েছিল।

আমি চমকে উঠে বলি কী নাম বললেন সন্ন্যাসীর? ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রী? কী আশ্চর্য! এঁর কথা যে আমি বাবার কাছে শুনেছি।

দাদু বলেন–তা তো হতেই পারে। তোমার বাবা তো শিবপুর কলেজ থেকে এঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন আঠারশ আটানব্বইয়ে। কলেজের পাশেই তো ঐ কোম্পানির বাগান। তা কি বলেছিলেন তোমার বাবা?

আমি বলি– তিনি বাবাকে বলেছিলেন দিনান্তে অন্তত একবার নির্জনে গিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবে, তাহলে নিজেকে চিনতে পারবে। প্রকৃতির কোন বিরাট মহৎ প্রকাশের সামনে যখন দাঁড়াই তখন আত্মার বিরাটত্ব উপলব্ধি করতে পারি। ধ্যানস্তিমিত পর্বতশ্রেণী, গহন অরণ্য, বিশাল সমুদ্র, এরা মানুষের মনের আগল সরিয়ে দেয়। সেই অর্গলমুক্ত মনের ভূমা স্পর্শ পাওয়া যায়। বাবা তখন সন্ন্যাসীকে প্রশ্ন করেছিলেন সংসারী মানুষ আমরা, দিনান্তে অমন অরণ্য-পর্বত-সমুদ্রের সাক্ষাৎ পাব কেমন করে? উত্তরে ধ্রুবানন্দ নাকি বলেছিলেন–উপর দেখতে রহো বেটা, ইসলিয়ে বহ্ তুমকো দে চুকা এক বিশাল নীলাকাশ! ইনসে বড়া, ইনসে বিশাল ঔর ক্যায় হ্যায়?

দাদু উদ্দেশে কাকে যেন প্রণাম করলেন যুক্ত করে। অস্ফুটে বললেন-বড় খাঁটি কথা। উনসে বড়া, উনসে বিশাল ঔর ক্যা হ্যায়?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *