Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আজান

পুজো এলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় পৃথার ।এই গতবছরও কত হই হই করে মা,বাবার সাথে পুজো কাটিয়ে বেড়াতে যাচ্ছিল হরিদ্বার । দিল্লি থেকে গাড়ি নিয়ে ওরা তিন জন, সফর শুরু করে খুব সকালে।মায়ের ইচ্ছা ছিল দুপুরের আগে পৌঁছে গঙ্গা স্নান করে তবে হোটেলে ঢুকবে । কিন্তু মাঝপথে কি  যে বিপদ! কোন একটা বড় সড়ো জনপদে পুলিশ গাড়ি আটকে দেয়,সামনে সারি সারি গাড়ি,বাস ট্রাক আর উদ্বিগ্ন জনতার ভিড়ে,চাপা একটা উত্তেজনা! ড্রাইভার বাইরে বেরিয়ে একটু এগুতেই ভটাম করে লাঠির মার খেয়ে সুরুৎ করে ঢুকে পড়লো।ওরই মুখে শোনা গেল,হিন্দু-মুসলমান ঝামেলা হয়েছে ,তাতেই উত্তপ্ত অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি কাল রাত থেকে।

একদল মুসলিম ছেলে মাথায় ফেটি বেঁধে হাতে কাটারি,বল্লম,লাঠি নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল পুরো রাস্তা,মহল্লা।বেছে বেছে হিন্দু পরিবারের গাড়িগুলো খুঁজে, মহিলাদের সিঁথিতে সিঁদুর দেখলেই গাড়িতে ভয়ংকর রকমের ভাঙচুর চালাচ্ছে । ড্রাইভার দাদা,জলদি সামনে থেকে বৈষ্ণোদেবীর ছবি,ফুল,মালা লুকিয়ে ফেললেও শকুনের দৃষ্টি কিন্তু গাড়ির ভেতর। লাল টকটকে শাঁখা-সিঁদুর পরিহিত পৃথার মা কে দেখতে পেয়ে সটান হাজির তারা।পৃথা হার্টের পেশেন্ট বাবা কে সামলাবে,না মা কে সামনের সিট থেকে,এই সব সাত পাঁচ ভাবার আগেই ঝুর ঝুর করে  গাড়ির পেছনের কাঁচ গুলো ভেঙে পড়লো ওদের অত্যাচারে ! সে এক বিচ্ছিরি ভয়ের পরিবেশ।পৃথা,হেল্প হেল্প করে চিৎকার করেই চলেছে একনাগাড়ে ,কিন্তু কে শোনে আর করবেই বা কে সাহায্য !

সারি সারি গাড়ির লাইনে কাঁচ বন্ধ করে সবাই উদ্বিগ্নতার প্রহর গুনছে একটা থমথমে পরিবেশে। হটাৎ কে একজন উল্লসিত চুয়ারে মার্কা হাসিতে পেছনের ভাঙা কাঁচ দিয়ে, যুবতী পৃথার ওড়না টানা হেঁচড়া করতেই ,মা পড়িমড়ি করে উল্টো দিক থেকে রনংদেহী মূর্তিতে একজনের চুলির মুঠি ধরে ফেলে। “মা ওদের সাথে লাগতে যেও না”বলেই পৃথা দেখে,বুকের যন্ত্রনায় বাবা কেমন একটা যেন করছে।নিজেকে সামলাবে না মা ,বাবাকে, ততক্ষনে বাইরে আরো ওদের কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জুটে ড্রাইভার দাদাকে হেনস্থা শুরু করেছে।সে তো বেচারা এমন পরিস্থিতিতে ভয়ে,কাঁচু মাঁচু হয়ে নিজেকে কোনোমতে  হিঁচড়ে চম্পট দিলো। আর ঠিক এই অসতর্ক মুহূর্তে,মায়ের হাতে মার খাওয়া সেই লাল চোখের অপমানিত বীরপুঙ্গবটি,ঘ্যাথ করে বসিয়ে দিলো মায়ের কাঁধে ধারালো টাঙ্গির কোপ! মুহূর্তে সব যেন এক লহমায় স্তব্ধতা নেমে এসেছে! রক্তে ভেসে যাচ্ছে সাদা স্করপিও গাড়িটা,লুটিয়ে পড়েছে মা ছটফট করতে করতে বাবার কোলে! উদ্ভ্রান্তের মতো পৃথা মাঝরাস্তায় জনে জনে, হাতজোড় করে মা কে হাসপাতাল নিয়ে যাবার অনুরোধ করছে!

হটাৎ একটা মিলিটারি গাড়ি,কিছু আর্মি যুবক পরিস্থিতি বুঝে সদয় হয়ে, কুড়ি কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শেষ রক্ষা হলো না।অত্যধিক রক্তক্ষরণে সেই দিনের ভয়াবহতায় মা কে হারানো,শব দেহ নিয়ে কলকাতায় ফেরা পৃথাদের মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দেয়।সেদিনের  অগ্নিগর্ভ,ভয়াবহ পরিবেশের পর অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বাবা, কেমন যেন আধপাগলের মতো আচরণ করতো! এই মানসিক যন্ত্রনা উনি নিতে পারেন নি,কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকেন মাথা উঁচু করে থাকা মানুষটা।পরিণতিতে,গত ছয় মাস আগে বাবাকেও হারিয়ে চনমনে মেয়ে পৃথাও কেমন যেন চুপষে যায়।

খুব খারাপ লাগে এম টেক করতে দিল্লি তে হোস্টেল জীবন কাটিয়ে কোথায় ভাবলো মা বাবার সাথে কিছু দিন থাকবে পৃথা।ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি হয়ে গেছে, পুণে চলে যাবার আগে অন্তত কিছু দিন বাড়ির আনন্দঘন পরিবেশকে চুটিয়ে উপভোগ করবে!কোথা থেকে কি যে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল! ওদের পরিকল্পনা ছিল হোস্টেল থেকে মালপত্র নিয়ে কলকাতা আসার আগে মা বাবা গেছে যখন একবার হরিদ্বারে পুজো দিয়ে ফিরবে তিনজন কিন্তু এই ভাবে পরিবারটা যে শেষ হয়ে যাবে তা কে জানতো!

এপ্রিলে বাবা মারা যাবার পর পৃথা,ঘর দোর চাবি তালা দিয়ে পুণে চলে যায়।কলকাতায় তার এক মামা অবশ্য থাকতো কিন্তু তিনিও বিদেশে বেশ কয়েক বছর।গতসপ্তাহে কলকাতার বাড়িতে কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে পৃথা।নিজের হাতে বন্ধ ঘর পরিষ্কার করে একদম পরিষ্কার করেছে।আগামীকাল মহালয়া,মায়ের গুছিয়ে রাখা রেডিওটা সকাল থেকে ব্যাটারি পাল্টে রেখে দিয়েছে পৃথা। প্রথমে ভেবেছিল, না শুনবো না,কষ্ট লাগবে  কিন্তু সেই মায়ের হাঁক ডাকে,প্রতিবছর  ঘুম ভাঙ্গে পৃথার। তিনজনে মিলে, মহালয়া শুনতে বসা, সে ভোলে কি  করে,না ভোলা সম্ভব! কষ্ট হবে তার খুব,একা ভূতের মতো মহালয়া  শুনতে তবু  কান্না ভেজা শরৎ ভোরের স্মৃতি তাজা করার সুযোগ হারাতে চায় না পৃথা।এসব সাত-পাঁচ ভেবে শুতে প্রায় সাড়ে বারোটা হয়ে গেছিল কাল।শুধু এই চিন্তা হচ্ছিল মা তো নেই,এলার্মে ঘুম আদৌ ভাঙবে তো!

ভোর ভোর বেলায়,হালকা শির শিরানী ঠান্ডায়  চাদরটা গায়ে টেনে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল পৃথা । ধরফর করে ঘুম ভেঙে গেল ,আজানের মাইকে,মা যেন,হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল পরম মমতায়।চোখ বেয়ে অজান্তে গড়িয়ে যাওয়া দু ফোঁটা জল মুছে জলদি রেডি হতে লাগলো সে। মা,বাবার স্মৃতি,তাজা করতে মহালয়া যে,তাকে শুনতেই  হবে এটা ভাবতে ভাবতে আরো উদাস হয়ে গেল পৃথা।ধর্মের যে উগ্রতা,লেলিহান শিখা তার মা ও পরোক্ষ ভাবে বাবাকে কেড়ে নিয়েছে সেই ধর্মেরই প্রভাত প্রার্থনা “আজান”ধ্বনি ভাগ্যিস আজ পৃথাকে জাগিয়ে তুললো!উদাস হওয়া এক শূন্যতা আর মা, বাবা যেন তাদের আদরের মেয়েকে মাঝে বসিয়ে মহালয়া শোনার অপেক্ষায় এটা ভেবে রান্না ঘরে গিয়ে তিন কাপ চা বানিয়ে নিলো জলদি। বাবার চিনি ছাড়া, মায়ের কম চিনি আর এক কাপ নিজের জন্য ট্রেতে সাজিয়ে ধীর পায়ে সোফার মাঝখানে বসে রেডিওটার নভ ঘুরিয়ে দিলো।এক অদ্ভুত শিহরণ,মহালয়ার সেই অপূর্ব গম্ভীর কণ্ঠস্বর সঙ্গে দলা পাকানো এক রাশ পাথরচাপা কষ্ট  পৃথাকে কেমন যেন,আচ্ছন্ন করে তুলছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress