অফিসপথে হঠাৎ করে
সপ্তাহের অন্যান্য ছয় দিনের মত আজও বৈষ্ণব ঘাটা পাটুলীর সব কাজকর্ম চুকিয়ে রওনা দিলাম ঢাকুরিয়ার উদ্দেশ্যে। বাঘাযতীন ফ্লাইওভার ক্রস করে হাইল্যান্ড পার্কের সামনের সার্ভিস রোড থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ডান ফুটে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই দুটি হাত রাস্তার দিকে বাড়িয়ে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় কিছু ভিক্ষার আবেদন জানাচ্ছেন। সকাল দশটার মধ্যে আমার কর্মস্থলের হাজিরা দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই আমার মোটরসাইকেলের গতি বেশ দ্রুত ছিল। খানিকটা সামনে এগিয়ে আমার মোটরসাইকেল বাঁদিকে এপেক্স হসপিটালের গলিতে টার্ন নিয়েছে। উনাদের দুজনকে দেখার মুহূর্ত থেকেই আমার মন যেন পড়ে আছে উনাদের ঐ আকুতিময় মুখখানির প্রতি। এপেক্স হসপিটাল পর্যন্ত যাওয়ার আগেই মোটরসাইকেলটি দাঁড় করিয়ে দিলাম। আমার মোটরসাইকেলের সাথে থাকা কালো বাক্সটি খুলে চিরুনি তল্লাশি চালালাম যদি কোন খুচরো পয়সা পাওয়া যায় তাহলে উনাদেরকে দিয়ে আসব। শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও আমি গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাক্স এবং আমার হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে থাকা দুটি পকেট ও প্যান্টের চারটি পকেট খুঁজেও তেমন কোন খুচরো টাকা পয়সা পেলাম না। কি করি, কি করি, বড় বিড়ম্বনায় মনে পড়লাম যে………! ওহো মনে পড়েছে পকেটে একটা ৫০০ টাকা এবং একটা ২০০ টাকার নোট মোট ৭০০ টাকা আজি সকালে পেলাম যে। ওনাদের কাছে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে পৌঁছে গেলাম নিমেষের মধ্যে।
প্রশ্ন করলাম, “কি হয়েছে জেঠিমা”?
ঐ ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, “বাবা আমার মেয়ের বিয়ে; কিছু সাহায্য করে যাও না”।
আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার ছেলেপুলে নেই”? ঐ জেঠিমা কাঁদো কাঁদো অবস্থাতেই উত্তর দিলেন;”তা আর বলনি বাবা”। ছেলের একটা পা অকেজো হয়ে বিছনা সজ্জা আজ বহুদিন হয়ে গেল।
আমি: জেঠু কিছু করেন না?
উত্তরে জেঠিমা বললেন,”না বাবা উনি আর শরীরে কুলুতে পারেন না”।
আমি: “আমি যাওয়ার সময়ই আপনাদেরকে দেখছিলাম। বেশ খানিকটা দূর এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসলাম। কিন্তু, জেঠিমা আমার কাছে তো খুচরো নেই। দুশো টাকার নোট দিচ্ছি ভাঙ্গিয়ে দিতে হবে। ইচ্ছা থাকলেও ২০০ টাকার নোটের পুরোটাই আপনাকে দিয়ে দেওয়া বেমানান হয়ে যাবে। কারণ আমি নিজেও একজন গরিব মানুষ। আমি এই ২০০ টাকার নোটের থেকে কিছুটা টাকা আপনাকে দেব”।
জেঠিমা বললেন : “হ্যাঁ বাবা দাও”।
আমি ২০০ টাকা ওনাদের হাতে দেওয়ার পরে উনারা যে খুচরো নোটগুলো আমাকে দিচ্ছিলেন সেগুলো দেখে এই সমাজের ভদ্র মানুষদের প্রতি আমার এক নোংরা ধারণার আবিষ্কার হলো।
উনারা যে টাকাগুলি আমাকে খুচরো হিসেবে দিচ্ছিলেন তার অধিকাংশ টাকারই কোনও টা পুড়ে যাওয়া, কোনও টা ছিড়ে যাওয়া, কোনও টা ফাটল ধরা অর্থাৎ যে টাকা কোথাও সচল বলে মান্য করা অসম্ভব সেই নোটগুলোই কোন না কোন মানুষ এনাদেরকে সাহায্য হিসেবে দিয়ে গেছেন। উনাদের সামনেই একরাশ রাগ উকরে দিয়ে বললাম, “জেঠু………
জেঠিমা…………….
তোমাদেরকে কে এই টাকাগুলো দিয়ে গেছে বলতো?
জেঠু জেঠিমা, দুজনেই খুব শান্ত মেজাজে উত্তর দিলেন,”কি আর বলব বাবা? কি আর করব বাবা? এইগুলোই দিয়ে গেছে আর কি।
আমি: আরে এই টাকাগুলো তো আপনি নিজেও কাজে লাগাতে পারবেন না। আমার তো মনে হয় যারা এই টাকাগুলো কোথাও চালাতে পারবেন না বলে রেখে দিয়েছিলেন সেই টাকাগুলোই আপনাদেরকে দিয়ে গেছে।
ছিঃ ছিঃ ছিঃ…..!
এইরকম উপকার করার কোন মানে হয়?
ঠিক আছে জেঠু জেঠিমা। আমি আসলাম।
এই কথা বলে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে ওখান থেকে বিদায় নিলাম।