অপ্রকাশিত ছোটগল্প
—কী রে! দরজা খুলে আমাকে দেখেই তোর মুখ অমন গোমড়া হয়ে গেল? আমি তো থাকতেও আসিনি, খেতেও আসিনি. জাস্ট গ্যাঁজাব বলে এলুম, আর কোথায়ই বা যাই বুড়ো বয়সে, বল, সত্তর বছর হতে চলল…. রমেন তো মেয়ের বিয়ে দেবার পর বাড়িটা এমন আধ-খ্যাঁচড়া করে রেখেছে যে ওর বাড়িতে বসার জায়গা নেই, নেপাল ব্যাটা এই বুড়ো বয়সেও বউয়ের অনুমতি ছাড়া কাউকে বাড়িতে অ্যালাউ করে না, আর অনিমেষ সারাদিন পুজোর ঘরে….
—আরে তোকে দেখে গোমড়া হইনি রে… বয়সের সঙ্গে মুখটাই এমন আদল নিচ্ছে… চল, বিছানায় রোদে বসবি…ঘরটা অবশ্য মাকড়সাদের ব্যাবিলন হয়ে আছে…
—তোর ওপরতলার ধাপ্পাচারী টাকলাটা তো টেঁসেছে… সেই যেটা তোর বিরুদ্ধে পুরসভায় কমপ্লেন ঠুকে-ঠুকে তোর বাড়ির ট্যাক্স বাড়িয়ে দিলে…
—হ্যাঁ… লাশ নাবাবার সময়ে মুখ থেকে নকল দাঁতের পাটি সিঁড়িতে ছিটকে পড়ল… শবযত্রীরা কড়র-মড়র করে মাড়িয়ে নেবে গেল…সিঁড়িটা তো এজমালি…সে-সব কুচোনো দাঁত মাসখানেক অব্দি পড়েছিল সিঁড়িময়… তারপর একদিন ওই টাকলাটারই পোষা কুকুরটা ছাড়া পেয়ে কুঁইকুঁই কান্না সহযোগে চেটেপুটে সাফ করেদিয়েছিল সে-সব…মরার দিন টাকলাটা নাকি নোনা ইলিশ খেয়েছিল… তুই ওখানটায় বস… রোদ্দুরটা আবার লোক দেখলেই সরে যায়…
—ওহ, তার মানে সাফল্যের অম্ল-পিত্ত-কফে শেষ পর্যায়ে গোমড়াই হতে হচ্ছে… আমার তো আবার জন্মাবার সময়ে পা প্রথমে বেরিয়েছিল বলে মুখটা তেমন ভাল নয়… প্রেমে পড়েও সফল হতে পারিনি, এমন থ্রি বাই ফোর মোঙ্গোলিয়ান কাট মুখ… তার সঙ্গে আবার মিশেছে বয়েসকালের ডায়াবিটিসের তিতকুটে কথাবার্তা… এ একেবারে মেছুনির মাছিসঙ্গ, বুঝলি… এই বুড়োনো… মেয়েমানুষ ছাড়াই লিঙ্গ অকারণে দাঁড়িয়ে যায়… হয়তো প্রসটেটের সিগনাল… তা তুই এমন পেঁচিয়ে আছিস কেন…
—না রে, রতন বিশ্বাস নামে এক সম্পাদক ওনার আহবকাল নামের পত্রিকার জন্যে একটা অপ্রকাশিত ছোটগল্প চেয়েছেন… অথচ মাথার ভেতর গল্প নেই… ভেবেই পাচ্ছি না কিছু…
—আরে এতে আবার ভাবাভাবির কী আছে? আজকাল আবার কেউ গল্প পড়ে নাকি? টিভিতে দেখে নিল, ব্যাস, হয়ে গেল… সাহিত্য বলতে ভাষার কাজ তো আর বোঝায় না… সে-সব তো বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, বিভুতিভূষণের সঙ্গে চুকে গেছে… ঝেঁপে দে কিছু একটা ঘতনা… চেনা-জানে ঘটনা নিয়ে বেরিয়ে পড়… ছোট করে লেখ…
কিন্তু ঘটনা যে পাচ্ছি না…
—তোর জানলা দিয়ে পুকুর পাড়ের দৃশ্যটঅ দারুণ… দিশি মদের নিষ্পাপ স্বচ্ছতা… হ্যাঃ হ্যাঃ, পুকুরটার টলটলে আলো দেখে কাব্যি করার মুড হল… আররে… ও কী রে … তোদের পাঁচিলের দিকেই মুখ করেই তো সব মুততে বসছে চানে যাবার আগে… ওহ, দাঁড়িয়েও মুছে যে রে… দেখে তো মনে হচ্ছে সাবলটার্ন লিঙ্গ… এতো রকমের কালো শেডের লিঙ্গ… মাপও আলাদা-আলাদা মনে হচ্ছে… এ নিয়ে গভীর গবেষণা হতে পারে… রণজিৎ গুহর ম্যাগনাম ওপাসটায় আছে কী…অ্যাঁ?
—হ্যাঁ, বর্ষায় ঝোপঝাড়ে সবুজ এলেই দেখি মোতবার ঝোকটা একটু বাড়ে… প্রকৃতির সঙ্গে ট্রাইবাল একাত্মতা বোধহয়…
—সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসে খবর দিতে পারতিস… লুফে নেবে… যা একখানা সাবজেক্ট… সাবজেক্ট আবার নিজেই অবজেক্ট…
—যার লিঙ্গ সে কেন লোফালুফি করতে দেবে…
—তাও হক কথা…এত সংবেদনশীল বিষয়…
—তাছাড়া কেবল লিঙ্গ নিয়ে হলে নারীবাদীরা চটে যাবেন… ওনারা বলবেন যোনি কেন বাদ গেছে…
—তা ঠিক, তবে নারীবাদ ব্যাপারটা আজকাল কেমন যেন হেদিয়ে এসেছে… লেখালিখি-সেমিনার কিছুই তো দেখি না…
—তার ওপর হিন্দু-মুসলমান লিঙ্গ ভেদাভেদ না করতে পারলে মহা হ্যাঙ্গাম… একদিকে সেকুলারিস্টরা চটবে, আরেকদিকে মৌলবাদীরা…
—আমার মনে হয় হিসির সঙ্গে বেরোনো ছুটকো-ছাটকা স্পার্ম থেকে পাঁচিলের ধারের রেড়ি-গাছগুলো হয়েছে…রেড়িফলগুলোর সাইজ দ্যাখ… কতো ভ্যারায়টি…
—হতে পারে, বলা যায় না, মহাভারতে আছে…
—মহাভারতের পৌরাণিক স্পার্ম আর আজকের দিনে কোথায়… সে-সব ছিল সুপারস্পার্মের যুগ… এখন তুই খন্ডিত ভারতের খন্ডস্পার্ম পাবি…
—তুষারচাপা অর্জুনের শব হয়তো পাওয়া যেতে পারে মহাপ্রস্হানের গ্লেসিয়ারে… বডি-সেল থেকে একটা অর্জুনক্লোন… একজন জুরাসিক অর্জুনের খুবই দরকার…
—আমার মনে হয় রামায়ণ-মহাভারতের লোকেরা এভাবে প্রাসাদের পাঁচিলের ধারে মুতে-মুতে রেড়িগাছ ফলাত না…
—কে জানে… ঠিক বলতে পারছি না… সংস্কৃত ভার্শানগুলো পড়িনি…
—তবে সঙ্গমকে নৈর্ব্যক্তিক করার দক্ষতা ছিল ওনাদের…
—তা হবে না কেন? তখনকার দিনে পোশাকের খোসাছাড়ানো যৌনকর্মী ছিল না…
—অন্ধকার খুলে ফেলে আলোর নগ্নতা পরে নিত…
—এখন তো মিনিটকতকে দুর্গাটুনটুনির উড়ন্ত কাঁপন… ব্যাপারটা বর্ণনা করতে হলে যতটা সময় দরকার তার আগেই কাজ খাল্লাস…
—যাকগে, ফালতু কথা ছাড়… রতন বিশ্বাসকে দেবার মতন গল্প লেখার আইডিয়া দে…
—তোর আবার গল্পের অভাব কিসের… পঁয়ষট্টি বছর হিল্লিদিল্লি করে কত কেলো তো করলি… সে-সব থেকে এক খাপচা লেখ… কিংবা তুই দুলালকান্ডটা লেখ না… সেই যে…
—কে দুলাল? আমাদের ক্লাসে যে সংস্কৃত টিচারের মেয়েকে নিয়ে আজমেরশরিফ না বিহারশরিফ কোথায় পালিয়েছিল…
—মেয়ে নয়… দুলালকে নিয়ে ইলোপ করেছিল সংস্কৃতস্যারের বউ… আজমের নয়, ওরা পালিয়েছিল বৃন্দাবন… দুলাল আমাদের ক্লাসে ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেত বলে একদিন ইস্কুলের গেট থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল… দুলালের ইংরেজি স্পার্মকে নিজের বাংলা ওভামের সঙ্গে মেলাবার জন্যে… দু-বেলা একসপ্তাহ যাবত মিলিয়েও কিছু হয়নি… দুলাল সংস্কৃতস্যার আর ওর বউ তিনজনেই ছিল বাঁজা… বাঁজাদের মজা বড়ই গলদঘর্ম ট্র্যাডেজি… কিন্তু আমি ওই দুলালের কথা বলছি না… আমি বলছি দমদমের কমরেড দুলালের কথা, যে তোলা আদায় করতে গিয়ে দুজনকে পিটিয়ে ইউটোপিয়ায় পাঠিয়ে দিলে… অবশ্য ওটা সাব জুডিস, কেস চলছে… তার চেয়ে তুই কেশপুর-গড়বেতার ঘটনা নিয়ে লেখ… ওখানে আগুনে পুড়িয়ে ইউটোপিয়ায় পাঠিয়েছে…. ক্লাইম্যাক্স দিতে পারবি… হুইপ ক্র্যাক এনডিং… ইংরেজি স্যার বলতেন শর্টস্টোরিতে ওই লজিকাল ক্লিক-শাট জরুরি…
—কিন্তু ওসব ঘটনা তো অলরেডি ঘটে গেছে…
—ঘতলেই বা…
—তুই বুঝতে পারছিস না… রতন বিশ্বাস একটা অপ্রকাশিত ছোটগল্প চেয়েছে…অপ্রকাশিত বুঝতে পারলি?
—কিন্তু কেশপুর-গড়বেতা বা দমদম-দুলাল নিয়ে কেউ এখনও গল্প লেখেনি… কারোর পোঁদে দম নেই লেখার… তুই লেখ না একটা…
—যে ঘটনা ঘটে গেছে তা তো অলরেডি প্রকাশিত… আমায় একটা অপ্রকাশিত লেখা দিতে হবে…
—বুঝলুম না ঠিক…
—যা প্রকাশিত নয়… মানে যা প্রকাশিত হয়নি, তাই অপ্রকাশিত…
কিন্তু তুই লিখেছিস নাকি? কেউই তো লেখেনি…
—না লিখিনি…
—তবে? লিখবি, ছাপা হবে, তবে তো তাকে অপ্রকাশিত বলা হবে…
—তা কী করে হয়… ঘটনা ঘটে গেছে… কাগজে বেরিয়ে গেছে… লোকে জেনে ফেলেছে…
—ওওও, তুই বলতে চাইছিস যে যা কোথাও বেরোয়নি অথচ ঘটে গেছে…
—না না, ঘটে গিয়ে থাকলে তো হয়েই গেছে… ঘটে গিয়েছে মানে তো প্রকাশিত হয়ে গেছে… আমায় অপ্রকাশিত লেখা দিতে হবে…
—তুই বলতে চাইছিস যে, যা ঘটেনি কিন্তু তুই তাকে ঘটাতে চাস… অথচ ঘটিয়ে ফেললে তা প্রকাশিত হয়ে যাবে… এবার বুঝেছি… কিছু না বলে সব-কিছু বলে দিতে হবে… ওফ, অপ্রকাশিত ছোটগল্প লেখা কম ঝকমারি নয় দেখছি…
—বুঝলি তো? যা ঘটেনি তা ঘটানো চলবে না…
—নাঃ…সত্যিই কঠিন ব্যাপার…
—তাই তো চিন্তায় আছি… রতন বিশ্বাস কাল টেলিফোন করেছিল…
—তুই আমাকে টেংরির সুপ আর চিকেন ভর্তা খাওয়াচ্ছিস, এরকম একটা লেখা লেখ… তুই খাওয়াবি না, ফলে ঘটনা ঘটবে না…
—কিন্তু আমি লিখে ফেললেই তো তোর খাওয়া হয়ে গেল… তাহলে আর অপ্রকাশিত রইল কই…
—যা বলেছিস… তুই ওসব লিখলে বাড়িতে ভাববে ডাক্তার বারন করেছে বলে লুকিয়ে তোর বাড়িতে এসে খাচ্ছি… শেষে যাওবা তোর কাছে গ্যাঁজাতে আসি তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে…
—তাহলেই ভেবে দ্যাখ… যা ঘটেনি তা দুবার ঘটে যাবে, দুবার প্রকাশিত হয়ে যাবে… একবার যখন লিখব… আরেকবার যখন তোর বাড়ির লোকে জানতে পারবে…
—কি দুর্গতি বল দিকিন… নইলে কত ঘটনাই তো ছিল… সেই হামিদ ভাল্লুকওয়ালা, যার বউটা অনয় লোকের সঙ্গে সুযোগ পেলেই শুত… হামিদ রোজ রাত্তিরে ভাল্লুকনিটার সঙ্গে শুত বলে… ভাল্লুকটাকে করে-করে হামিদ নিজেও ভাল্লুক হয়ে যাচ্ছিল… ওর বউয়ের বোরখায় তুইও তো দুচারবার শীতের দুপুরে ঢুকেছিলিস… বলেছিলিস একবার, বোরখার মধ্যেকার নগ্নতা…
—মানুষ হয়ে রোজ রাত্তিরে একটা মাদিভাল্লুককে স্যাটিসফাই করা চাট্টিখানি কথা নয়… ওর বউটা কিন্তু যাব বলে তেতে থাকত… দশ মিনিটেই কেল্লা ফতে…
—ওটাই লেখ না… সেক্স ব্যাপারটায় যে কাস্ট-ক্রিড-রিলিজিয়ন… এমনকি মানবেতর ডাইমেনশান আছে… এসব নিয়ে তো কেউ গল্প-উপন্যাস লেখেনি এখনও… কিংবা বাদুড়িয়ার সেই বউটার গল্প লিখতে পারিস, যে জোনাকি ধরে ছুঁচসুতোর মালা গেঁথে কোমরে-হাতে-গলায়-খোঁপায় জড়িয়ে মাঝরাত্তিরে ল্যাংটোপোঁদে শকুন্তলা সেজে ঘুরে বেড়াত…
—হ্যাঁ, অনেক আংটি জড়ো করেছিল… আমাদেরো কত আঙটি গেল ঘটনা ঘটাতে… পেতলের নাহলে ফতুর হয়ে যেতুম… সে-সব কৃষ্ণপক্ষের তুনা হয় না… অন্ধকার না থাকলে প্রিয়তমা শব্দটা একেবারে বেমানান…
—তারপর আমাদের বন্ডেল রোডের মিসেস বসুরায়ের ঘতনাটা রয়েছে… সকাল থেকে সন্ধে মিস্টার বসুর সংসার সামলান… আর সন্ধে থেকে ভোর পর্যন্ত সামলান মিস্টার রায়ের সংসার… রাস্তার এপার-ওপার বাড়ি… শনি-রোববার মিস্টার বসুর ছুটি থাকে বলে মিসেস বসুরায়কে ছোঁননা মিস্টার রায়…
—আর বাচ্চা-কাচ্চা?
—দিনের বেলা যেগুলো হয়েছে তারা মিস্টার বসুর সঙ্গে থাকে… বাবা বলে ডাকে… আর রাত্তিরে যেগুলো হয়েছে সেগুলো মিস্টার রায়ের সঙ্গে… ড্যাডি বলে ডাকে… দুবাড়ির শ্বশুর-শাশুড়ি দেওর-ননদের মধ্যে যাতায়াত আছে… ছেলেমেয়েরা মেশামিশি করে… কারোর কোনোরকম টেনশান নেই… হ্যাপি এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি… তা আজ সতেরো বছর হতে চলল… বসুরায় নামটা অবশ্য পাবলিকেই মহিলাটিকে দিয়েছে…
—বুড়ো হলে?
—বসুরায়, বসু আর রায় তিনজনের জন্যে গোয়ার সমুদ্রের ধারে বৃদ্ধাশ্রমে অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে এখন থেকেই বুক করা আছে…
—কিন্তু ক্লাইম্যাক্স বা হুইপক্র্যাক এনডিং কী হবে… সমাপ্তির ব্যঞ্জনা?… ছোটগল্প বলে কেউ মানবে না ওই ব্যাপারটা না থাকলে…
—মিসেস বসুরায়ের একটা প্রেমিক আছে, সিক্রেট, বোধহয় গড়িয়াহাটে, যেদিন ওনার মেন্সের ব্লিডিং বন্ধ হয় সেদিন প্রেমিকের বাসায় ঢুঁ মারেন… আসলে বাচ্চাগুলো ওই প্রেমিকের…
—সত্যি অনেক ঘটনা আছে তোর স্টকে… কিন্তু প্রবলেম হল যে রতন বিশ্বাসকে অপ্রকাশিত ছোটগল্প দিতে হবে… তুই যা বললি তা তো অলরেডি প্রকাশিত… বন্ডেল রোডের সবাই জানে… গড়িয়াহাটের লোকেও জানে… তুই তো গড়িয়াহাটে থাকিস…
—তাহলে শিবমন্দিরের সেই পুরুতমশায়ের ঘটনাটাও তো ছিল… সেই যে… যিনি গরদের শাড়ি পরে মন্দিরে পুজো করতেন যাতে শিব তুষ্ট হন…শল্যচিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন পুরুষমানুষ থেকে মেয়েমানুষ হয়ে পার্বতী হবার জন্যে…
—উঁহু, লেখা যাবে না… যা ঘটে গেছে তা নিয়ে কী করে লিখি বল… যা ঘটে গেছে তা তো স্বতঃপ্রকাশিত… আর আমায় তো দিতে হবে অপ্রকাশিত ছোটগল্প…
—তাহলে তোদের পাড়ার ওই ছেলেটার কথা লেখ না, যে প্রচুর মদ খেয়ে আত্মহত্যা করল, গায়ে কেরোসিন ঢেলে, যাতে হুইস্কিতে আগুন ধরে বুকপেট তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়… আগে কখনও মদ খায়নি…
—বড় স্যাড ঘটনাটা… ওর মা ওর প্রেমিকাকে বিয়ে করতে দ্যায়নি, নিচু জাত বলে… ওর মা তো আগেই আরেকটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে রেজিস্ট্র অব্দি সেরে ফেলেছিল… কিন্তু বিয়ের আগের দিন মোক্ষম একখানা চোট ওর মাকে দিল…
—আত্মহত্যা করার কী আছে বুঝি না… আরে একজন মেয়ের যা-যা থাকে আরেকজন মেয়েরও একই জিনিস থাকে… মাপের হেরফের হতে পারে কেন না ব্যাপারটা প্রাকৃতিক… সত্তর বছর বয়সে পৌঁছে আমি তো কোনো তফাত দেখতে পাই না…
—লেখা যাবে না… লেখা যাবে না… ঘটে গেছে… প্রকাশিত হয়ে গেছে… যদিও ছেলেটার মা পাড়ায় একটা বিকল্প গল্প ছড়াবার চেষ্টা করছে… ছেলেটার প্রেমিকাই নাকি ল্যাং মেরেছে…
—মানুষ ছাড়া ছোটগল্প লেখা যায় না? ওই পুকুরে কতরকম মাছ রয়েছে… পলাশ গাছে কতরকম পাখি রয়েছে… নারকেল গাছে কাঁদি-কাঁদি ডাব রয়েছে… ঝোপে প্রজাপতি রয়েছে… ওই তো একটা বেঁজি দৌড়ে গেল… ওদের নিয়ে লেখ…
—ওদের তাহলে মানুষের মন দিতে হয়… সে তো শিশুসাহিত্য কেলেংকারি হয়ে যাবে… সবকিছুকে, সমস্তপ্রাণীকে, মানুষ বলে চালাবার ধান্দাবাজি…
—মানুষ বাদ দিয়ে ছোটগল্প হয় না?
—নাঃ… মানুষ কত মহান, কত দুঃখী, কত হেন, কত তেন, কত এই, কত সেই, তা দেখাতে হবে ইনিয়ে-বিনিয়ে… নইলে সার্থক লেখা হবে না… সার্থক লেখা না হলে আর গল্প কীসের… মহান গল্প না হলে মহান লেখক হওয়া মুশকিল… লেখকের মহান হওয়াটা ছোটগল্পের আল্টিমেট এইম…
—এতক্ষণে বুঝলুম রে… যা হয় না… যা হবার নয়… যা ঘটেনি… যা ঘতবে না… যা ঘটানো চলবে না… তাদের সাজিয়ে-গুজিয়ে তুলে ধরতে হবে…
—আহবকাল পত্রিকাটা বেরোলে তুই দেখিস… দেখবি সবাই রসিয়ে-রসিয়ে মানুষের মানুষগিরির কথা লিখেছে…
—এই দ্যাখ, তোর কলিং বেল বাজল… কেউ এসেছে বোধহয়…
—এখন আবার কে? কেবলওয়ালা, খবরের কাগজ তো পেমেন্ট নিয়ে গেছে… কাজের লোক কাজ করে চলে গেছে..
—দ্যাখ, চাঁদা-টাদা হবে হয়তো…
—কে?
—আজ্ঞে আমি…
—দরজা খোলা আছে… ভেতরে চলে এসো…
—গল্পটা আজকে দেবেন বলেছিলেন… হয়ে গেছে?
—এই যে, এনার কথাই তোকে এতক্ষণ বলছিলুম… রতন বিশ্বাস… আহবকাল পত্রিকার সম্পাদক…
(রচনাকাল: জুলাই ২০০২ । আহবকাল পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সংখ্যায় প্রকাশিত )