অচ্ছুত
ছোট একটা নিকনো উঠান, কোণে তুলসীমঞ্চ বহু পুরাতন। পলেস্তারা খসে গেছে। ঠিক বিন্দির জীর্ণ ঘরের মতই কিন্তু পরিস্কার। মেথরপট্টির ঘিঞ্জি পরিবেশ, একধারে গুচ্ছের নোংরা আবর্জনা জড়ো করা। ছেলেবুড়ো বউঝি একগাদা মানুষের বাস। বিন্দির ঘরদোর একদম আলাদা পুরাতন হলেও মাটি দিয়ে লেপা মেঝে ঝকঝকে।শিউলি আর জবাফুল গাছ উঠানের একপাশে। কুলুঙ্গিতে ছোট মূর্তি।
বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে আছে বিন্দি। গায়ে কাঁথা ভীষণ জ্বর, কাঁপছে। বেলা পড়ে এলো আজ উনুনে হাঁড়ি চড়েনি, পায়ের কাছে পোষা বেড়াল ক্ষিধেয় ডাকছে। সকালে স্কুলে গেছে বিশাল, এখনো ফিরছে না কেন! চিন্তা হচ্ছে কিন্তু কাউকে ডেকে খোঁজ নেবে, জ্বরের ঘোরে মাথা তুলতেই পারছে না।
বিশাল বিন্দির ছেলে, সবে প্রাইমারি পাশ করেছে মেথর পাড়ার স্কুল থেকে। কিছুদূরে ধূপচর হাইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে বিন্দি। আজ তার হাই স্কুলে প্রথম দিন। জ্বরের ঘোরে মাঝে মাঝে সব গুলিয়ে যাচ্ছে বিন্দির। কিছু দিন থেকেই এমনধারা রোগের বাড়াবাড়ি। শান্তি মাসি উঠোন থেকে ডাকলো, ” বিন্দি, এই বিন্দি কি কচ্ছিস রে তুই,জ্বর কমেছে? সারাদিন দেখতে পেলুম না যে। রেধেছিস কিচু? ” বিন্দি কোন সাড়া দিলো না, শুধু গোঙ্গানির মৃদু শব্দ শোনা গেলো।
মাসি কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলো, “এমা একি গায়ে আগুনের মতো তাপ যে। ছোড়া এখনো ফিরলোনি ডাক্তার বাবুকে ডাকতে হবে যে গা। “
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, সেই যে স্কুল ছুটির পরে বিশাল নদীপাড়ে পাথরের উপর গিয়ে বসেছে, যেন সে আর একটা স্তব্ধ পাথরের মূর্তি। কত কথা মনের ভিতর আলোড়ন তুলে ঝড় বইছে, সে শুধু নিজেই জানে। কোন দিক দিয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ পাখিদের ঘরে ফেরার কিচির মিচির ডাকে সচকিত হয়ে উঠলো। মায়ের কথা বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে গেলো তার।
মায়ের জ্বর কদিন, মন এতো খারাপ ছিলো ভুলেই গিয়েছিল তারাতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
আজ স্কুলে ক্লাসের ছেলে মেয়েদের আচরণ তাকে বিমর্ষ করে তুলেছে। শিক্ষকের বাবার নাম জানতে চাওয়া, তার বলতে না পারার লজ্জা কুঁকড়ে দিয়েছে ভেতরটা। তার মা সুইপার তারা মেথর পাড়া বাস করে এটা কি অপরাধ! তারা সনাতন ছোট জাত অস্পৃর্শ্য অচ্ছুত। এটা কোনো জন্মের পাপ?
সে জানে না তার বাবা কে, কোথায় তিনি বেঁচে আছে না কি নেই?
এতো টুকু জীবনে কঠিন বাস্তবতার কশাঘাতে জর্জরিত। বাবার স্নেহ পায়নি, তাকে কখনো দেখেইনি সে।
ক্লাসের সারাটিক্ষণ শেষ ব্রেঞ্চের এক কোণে বসেছিলো। কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব তো দূর কথাও বলেনি। টিফিনের সময় সবাই মাঠে গল্প আর হাসাহাসি করছিলো। ও চুপটি করে শুধু চেয়ে দেখেছে। রূঢ় বাস্তবতা তাকে কষ্ট দিচ্ছে কিন্তু সে ভেঙ্গে পড়েনি। ছোটবেলা থেকেই দেখেছে ওরা অচ্ছুত ছোটজাত। ছুটির পরে বাড়ি না গিয়ে নদীর ধারে চলে এসেছে। কত জল বয়ে চলেছে নিরবধি, সূর্যের আলোয় আগুন গলা স্রোত যেন। মাছ ধরা জেলে নৌকা, যন্ত্রচালিত ট্রলার ভেসে যাচ্ছে নদীর বুক চিরে। কত অজানায় ছুটে চলেছে মানুষ! কে বা কারা, কোথাকার! কি জাতপাত কে মনে রাখে তা।এতো ভেদাভেদ ধর্মের ভিতরে ধর্মের এতো ভেদাভেদ,জন্ম সেতো ঈশ্বরের দান! উঁচু-নিচু মানুষের গড়া পদানত আর বঞ্চনার প্রয়াস যুগে যুগে।
মায়ের কাছে অনেক বার জানতে চেয়েছে বাবার কথা, বরাবর মৌন থেকেছে মা, শুধু বলেছে, “আমি তোর সব আর কেউ নাই, কেউ না…।”
মেথর পাড়ায় বিন্দি যখন আসে, তখন বিশাল ছোট কোলের শিশুটি। কেউ কখনো তার স্বামী কে? দেখেনি,শোনেওনি! জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পায়নি। হাতে শাখাপলা কপালে সিঁদুরের চিহ্ন কখনো কেউ দেখেনি। তার হাসি মুখ, পরিচ্ছন্ন গৃহস্থালি, চালচলন!কোথায় যেন সুক্ষ্ম ব্যবধান তাকে ভিন্ন পরিচিতি দিয়েছে।
বিশাল বাড়িতে এসে থমকে গেলো, উঠোন অন্ধকার। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলেনি। সে জোরে মা.. মা ডেকে উঠলো।
অন্ধকারে ক্ষীণ কন্ঠ শোনা গেল, ” এয়েচিস বাবা। কোথায় ছিলি রে তুই!”
বিশাল ছুটে এসে মায়ের শিয়রে বসে কপাল ছুঁয়ে দেখলো গা ভীষণ গরম! সে তারাতারি বাতি জ্বেলে ডাঃ বাবুকে ডাকতে চলে গেলো। সারাদিন তার নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি। নদীতীর থেকে আসার সময় সে একটা সংকল্প করেছিলো,মাকে বলবে! বলা হলো না।
সে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলো, আমার মা কে বাঁচিয়ে দাও। আর কিচ্ছুটি চাইনে আমি, কিচ্ছুটি না…।
সারারাত বিশাল মায়ের পা দুটি ধরে বসে রইলো, তার ঈশ্বর, ভগবান,ধ্যান জ্ঞান সবই তার মা।
সে আকুল হয়ে কাঁদছে, তার ছোট্ট বুকে অভিমানের পাহাড়। সমাজ সংসারের বৈষম্য তাকে যেন একদিনেই পরিনত করে তুলেছে।
ভোর হয়ে এলো পাখি ডাকছে, শিউলি ফুলের গন্ধে উঠোন ভরে আছে। ধীরে ধীরে বিন্দি চোখ খুলে তাকালো। বিশালের কান্না ভেজা চোখে আনন্দ ছলকে উঠলো। এখন বিন্দি কিছুটা সুস্থ, দূর্বল হাতে ছেলের মলিন মুখটা আঁচল দিয়ে মুছে দিলো।
বিন্দি এখন পুরাপুরি সুস্থ। মা-ছেলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো। সব কিছু পড়ে রইলো শুধু বই আর ছোট্ট পুটুলীতে তাদের ব্যবহৃত কাপড় বেঁধে নিলো।
সকালে সবাই দেখলো বিশালদের ঘরে বড় তালা ঝুলছে। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে বিন্দিরা আর ফেরেনি।
সেই তুলসীতলা তেমনি আছে, ঝরা শিউলি ফুলে ভরে উঠেছে উঠান, লাল জবা ফুলে ছেয়ে গেছে ডাল। বিশালরা এই মেথরপাড়ার চেনা ডেরায় ফেরেনি আর।
তার জায়গায় এসেছে নতুন কেউ। কোন কিছুই শূন্য থাকে না, কেউ না কেউ পূর্ণ করে।
বিন্দি আর বিশাল তাদের ক্ষুদ্র জীবনে অচ্ছুত ছোট জাতের সনাতন গন্ডি পেরিয়ে হয়তো মিশে গেছে নতুন কোন জীবন স্রোতে….।