Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আমার বন্ধু উনু

উনর সঙ্গে আমার পরিচয় ফুটবল খেলার মাঠে। রোগা টিঙটিঙে একটা ছেলে–বড় বড় চোখ, খাদা নাক, মাথাভরতি ঝাঁকড়া চুল।

দুদলে তমূল খেলা চলছে। আমি মাঠের বাইরে। গায়ে জ্বর বলে খেলতে পারছি না। জ্বর এমন বাড়াবাড়ি যে বসে থাকতে পারছি না আবার উঠে চলে অতেও পারছি না। এমন সময় উনুকে লক্ষ্য করলাম। যে খুব মন দিয়ে ঘাস খাচ্ছে।

সত্যি সত্যি ঘাস পাচ্ছে। দুআঙুলে ঘাসের কচি পাতা দ্রুত তুলে চপচপ শব্দে চিবিয়ে খাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ঘাস খাচ্ছ কেন?

সে গম্ভীর গলায় বলল, আমার ইচ্ছা।

বলে পুরো সুফি-সাধকদের নির্লিপ্ততা নিয়ে ঘাস চিবুতে লাগল। এমনভাবে চিবুচ্ছে যেন অতি উপাদেয় কোনো খাবার। তার খাওয়া দেখে জিভে পানি চলে আসে। আমি কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম, ঘাস খাচ্ছ কেন?

সে উদাস গলায় বলল, ভাইটামিন আছে।

এরকম একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুতু না হওয়ার কোনো কারণই নেই। দশ মিনিটের মাথায় আমরা জন্মের বন্ধু হয়ে গেলাম। সে শিখিয়ে দিল ঘাসের কোন অংশ খেতে হয়, কোন অংশ খেতে হয় না। দুটা পাতার মাঝখানে সুতার মতো যে-ঘাসটা বের হয় সেটাই খাদ্য, তবে ডগার খানিকটা বাদ দিতে হবে। ডগাটা বিষ।

উনু আমার চেয়ে এক ক্লাস উপরে পড়ে। আমাদের স্কুলে না, অন্য কী-একটা স্কুলে। তার মা নেই, বাবার সঙ্গে থাকে। বাবা প্রতিদিন রুটিন করে উনুকে দুবেলা মারেন। স্কুল থেকে ফিরে আসার পর একবার, সন্ধ্যাবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরে আসার পর একবার। সেই মারও দর্শনীয় মার। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মারপর্ব শেষ হবার পরই দুজনই অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যেন কিছুই হয়নি।

উনুর বাবা ছোট চাকরি করতেন। বাসার সাজসজ্জা অতি দরিদ্র। বাঁশের বেড়ার ঘর। পাশেই ডোবা। ময়লা নোংরা পানি। খেলা শেষ করে বাসায় ফিরে উনু সেই নোংরা পানিতে দিব্যি হাত-মুখ ধুয়ে ফেলে।

উনুর বাবাকে মানুষ হিসেবে আমার খুব পছন্দ হল। ছোটদের সঙ্গে কথা বলেন এমনভাবে যেন তারা ছোট না। তার সমবয়স্ক মানুষ। আমাকে একদিন বললেন, এই যে আই আই চুন্দ্রীগর সাহেব দেশের ভার নিল, লোকটা কেমন?

তোমার কি মনে হয় উনিশ-বিশ কিছু হবে?

আই আই চুন্দ্রীগর কে, সে কবেই-বা দেশের ভার নিল কিছুই জানি না। তবু খুব বুঝদার মানুষের মতো মাথা নাড়লাম। মুখে বললাম, হবে।

উনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, মনে হয় না। সব এক। দেয়াল কাঠি। ফুস কইরা একবার জ্বলল, তারপর শেষ। চমৎকার সব উপমা ওর কাছে শুনেছি। যেমন মেয়েমানুষ সম্পর্কে তাঁর একটা ছড়া–

মায়ে পুরা
ভইনে থুরা
কন্যায় পাই,
স্ত্রীর কপালে
কিছুই নাই।

এই ছড়ার অর্থ জানি না। অসংখ্যবার র কাছে শুনেছি বলে এখনও মনে আছে।

উনু একবার আমাকে চিতইপিঠা খাওয়াবার দাওয়াত দিল। তার বাবা চিতইপিঠা বানাবেন। যথাসময়ে উপস্থিত হলাম। উঠোনে চুলায় পিঠা সেকা হচ্ছে। পিতা এবং পুত্র মিলে পিঠা বানাচ্ছে। গল্পগুজব করতে করতে পিঠা খাওয়া হচ্ছে। ওদের দুজনকে দেখে যা হিংসা লাগল। মনে হল ওরা কত সুখী। আমার যদি মা না থাকত কী চমৎকার হত!

উনুর কপালে সুখ দীর্ঘস্থায়ী হল না। তার বাবা বিয়ে করে ফেললেন। উনু গম্ভীর হয়ে আমাকে বলল, সত্মার সংসারে থাকব না। দেশান্তর হব।

আমি বললাম, কোথায় যাবে?

এখনও ঠিক করি নাই। ত্রিপুরা, আসাম এক জায়গায় গেলেই হয়।

প্রাণের বন্ধুকে একা ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ঠিক করলাম আমিও সঙ্গে যাব। বন্ধুর শোকে আমার ভিতরেও খানিকটা বৈরাগ্য এসে গেছে।

এক সকালে সিলেট রেলস্টেশন থেকে ছাড়ছে এমন একটি ট্রেনের কামরায় দুজন উঠে বসলাম। ট্রেন কোথায় যাচ্ছে কিছুই জানি না। ট্রেন ছাড়ার পরপরই আমার মন থেকে দেশান্তরি হবার যাবতীয় আগ্রহ কপূরের মতো উবে গেল। বাসার জন্য খুব যে মন-খারাপ হল তা না। প্রচণ্ড ভয়ে অস্থির হলাম এই ভেবে যদি টিকিট চেকার ওঠে তখন কী হবে! কান্না শুরু করলাম। ট্রেনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কান্নার শব্দও বাড়তে লাগল। কেন জানি বাকি ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে নেই। আবছা আবছা মনে আছে। পরের স্টেশনে আমাদের নামিয়ে দেয়া হল। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পরা এক ভদ্রলোক বাসে করে আমাদের সিলেট শহরে পৌঁছে দেন। আমার ভেতর থেকে দেশান্তরি হবার আগ্রহ পুরোপুরি চলে গেলের ভেতর সেটা থেকেই যায়। প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তিন-চারদিন কোথায় কোথায় কাটিয়ে আবার ফিরে আসে।

উনু শুধু যে আমার বন্ধু ছিল তা-ই না, শিক্ষকও ছিল। জগতের অনেক তপর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি। মন আকাশে প্লেন দেখলেই দৌড়ে গাছের নিচে কিংবা বাড়ির ভেতর ঢোকা। চত। কারণ প্লেনের যাত্রীরা পেসাব-পায়খানা করলে তা মাথায় এসে পড়তে পারে।

নানান ওষুধপত্রের টোটকা দাওয়াইও তার জানা ছিল। যেমন মখে ডিম নিয়ে যেসব লাল লাল পিপড়া হেঁটে যায় ঐসব পিপড়া দৈনিক পাচটা করে খেলে অর্শরোগ সেরে যায়।

যেহেতু আমার অর্শরোগ ছিল না কাজেই সেই মহৌষধ পরীক্ষা করে দেখা হয়ে ওঠেনি।

উনুকে আমি কখনো হাসিখুশি দেখিনি। সারাক্ষণ সে চিন্তিত ও বিষণ্ণ। শুধু একদিন হাসতে হাসতে দৌড়ে তাকে আমাদের বাসার দিকে আসতে দেখা গেল। জানলাম তার একটা বোন হয়েছে। দেখতে সে নাকি পরীর মতো সুন্দর। জন্মের পরপর সে হাসতে শিখে গেছে। সারাক্ষণ নাকি হাসছে।

আমি পরদিন সদাহাস্যময়ী উনুর ভগিনীকে দেখতে গেলাম। উনুর মা শাড়ির আঁচল ফাঁক করে লাল টুকটুকে শিশুটিকে দেখিয়ে খুশি-খুশি গলায় বললেন, নজর লাগাইও না। মাটিতে পুঁক দেও। যাতে শিশুটির উপর নজর না লাগে সেজন্যেই আমি এবং উনু দুজনই মাটিতে একগাদা থুথু ফেললাম। এই ঘটনার খুব সম্ভব এক সপ্তাহের ভেতর উনুর বাবা সন্ন্যাসরোগে মারা গেলেন।

অন্যের দুঃখে অভিভূত হবার মতো বয়স বা মানসিকতা কোনোটাই তখন ছিল না। কাজেই এই ঘটনা আমার মনে কোনো ছাপ ফেলল না। আমাদের বাসায়ও তখন বড় ধরনের সমস্যা। গনি চাচার চাকরি চলে গেছে। অ্যান্টিকরাপশনের মামলা চলছে তার বিরুদ্ধে। জেল হয়ে যাবে, মোটামুটি নিশ্চিত। তিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় তার স্ত্রী এবং পালক-পুত্রকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসে উঠেছেন। গনি চাচার স্ত্রী রাতদিন কাঁদেন। সেই কান্নাও ভয়াবহ কান্না। চিৎকার, মাটিতে গড়াগড়ি। আমরা ছোটরা অবাক হয়ে দেখি।

গনি চাচা উঠোনে পাটি পেতে সারাদিন শুয়ে থাকেন এবং তালপাতার পাখায় হাওয়া খান। দীর্ঘদিন তাঁরা আমাদের বাসায় রইলেন। দুটি সংসার টানতে গিয়ে মা হিমশিম খেয়ে গেলেন। তার অতি সামান্য যেসব ছিল সব বিক্রি হয়ে গেল। সেবার ঈদে আমরা কেউ কোনো কাপড় পেলাম না। আমাদের বলা হল, অদিন পরেই বড় ঈদ আসছে। বড় ঈদে সবাই ডাবল কাপড় পাব।

যেহেতু খানিকটা বড় হয়েছি চারপাশের জগৎ কিছুটা হলেও বুঝতে শিখে, সে–কারণে মনের কষ্ট পুরোপুরি দূর করতে পারছি না। মন-খারাপ করে, বেড়াই। আশেপাশের বাচ্চারা বাবাদের হাত ধরে দোকানে যায়। কলরব কম। করতে ফিরে আসে।

মনের কষ্ট দূর করতে উনুর চেয়ে ভালো কেউ নেই। মুহূর্তের মধ্যে সে অন্যের মন-খারাপ ভাব দূর করে দিতে পারে যদিও সে নিজে আগের চেয়ে বিষণ্ণ হয়ে যায়।

উনুকে বাসায় পেলাম না, উনুর মাকেও না। তারা সবাই কোথায় নাকি চলে গেছে। খুব খারাপ লাগল। উনুদের পাশের বাসার এক ছেলে বলল, উন জল্লারপাড়ের এক চায়ের দোকানে কাজ করে। বাবাবিহীন সংসারের দায়িত্ব এই বয়সেই সে মাথায় নিয়ে নিয়েছে।

খুঁজে খুঁজে একদিন তাকে বের করলাম। ময়লা হাফপ্যান্ট পরা। টেবিলে টেবিলে চা দিচ্ছে। আমি বাইরে থেকে ডাকলাম-এই উনু! সে তাকাল কিন্তু দোকান থেকে বেরিয়ে এল না।

বাসায় ফিরে এলাম।

বাসায় খুব আনন্দ। খুব উত্তেজনা। বাবা জগদল থেকে আমাদের নিতে এসেছেন। এবং ঘোষণা করেছেন এই ঈদেই আমাদের সবাইকে কাপড় এবং জুতা দেয়া হবে। কেনাও হবে আজ।

আনন্দে লাফাতে লাগলাম।

উনুর কথা মনে রইল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress