একজন অদ্ভুত বাবা
আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার লেখা প্রথম গ্রন্থ কপোট্রনিক সুখ দুঃখের উৎসর্গপত্রে লিখেছে ও।
পৃথিবীর সবচে ভালমানুষটিকে বেছে নিতে বললে
আমি আমার বাবাকে বেছে নেব।
বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখকরা সবসময় আবেগের বাড়াবাড়ি করেন। আমার ভাইয়ের এই উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত ধরে নিতে খানিকটা অসুবিধা আছে। সে যদি লিখত পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষ আমার বাবা এবং মা তা হলে আবেগের ব্যাপারটি চলে আসত। সে তা না করে বাবার কথাই লিখেছে। পৃথিবীর সবচে ভালোমানুষের মধ্যে মাকে ধরেনি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে তার উৎসর্গপত্র আবেগপ্রসূত নয়। চিন্তাভাবনা করে লেখা। ইকবালকে আমি যতটুকু চিনি সে চিন্তাভাবনা না করে কখনো কিছু বলে না এবং লেখেও না।
আমার বাবা পৃথিবীর সবচে ভালো মানুষদের একজন কি না তা জানি না, তবে বিচিত্র একজন মানুষ, তা বলতে পারি। তার মতো খেয়ালি, তাঁর মতো আবেগবান মানুষ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আবেগ ছাড়াও তাঁর চরিত্রে আরও সব বিস্ময়ের ব্যাপারও ছিল। তিনি ছিলেন জন স্টেইনবেকের উপন্যাস থেকে উঠে-আসা এক রহস্যময় চরিত্র।
সবার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। রাত প্রায় বারোটা। রঙমহল সিনেমা হল থেকে সেকেন্ড শো ছবি দেখে বাবা এবং মা রিকশা করে ফিরছেন। বড় একটা দিঘির পাশ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে। মা হঠাৎ বললেন, আহা দ্যাখো কী সুন্দর দিঘি! টলটল করছে পানি। ইচ্ছে করছে পানিতে গোসল করি।
বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রিকশা থামাও।
রিকশাওয়ালা থামল।
বাবা বললেন, চলো দিঘিতে গোসল করি।
মা হতভম্ব। এই গভীর রাতে দিঘিতে নেমে গোসল করবেন কী? নিতান্ত পাগল না হলে কেউ এরকম বলে?
মা বললেন, কী বলছ তুমি!
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, দ্যাখো আয়েশা, একটাই আমাদের জীবন। এই এক–জীবনে আমাদের বেশির ভাগ সাধই অপূর্ণ থাকবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব সাধ আছে, যা মেটানো যায় তা মেটানোই ভালো। তুমি আসো আমার সঙ্গে।
বাবা হাত ধরে মাকে নামালেন। স্তম্ভিত রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল হাত ধরাধরি করে দুজন নেমে গেল দিঘিতে।
এই গল্প যতবার আমার মা করেন ততবার তার চোখে পানি এসে যায়। তাঁর নিজের ধারণা, তাঁর জীবনে যে অল্প কিছু শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এসেছিল ঐ দিঘিতে অবগাহন তার মধ্যে একটি।
বাবার চরিত্রকে স্পষ্ট করার জন্যে আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ করি। বাবা তখন সিলেট সদরে পুলিশের ইন্টেলিজেন্সিতে আছেন। পদমর্যাদায় সাব ইন্সপেক্টর। বেতন সর্বসাকুল্যে মাসে নব্বই টাকা। সেই টাকার একটা অংশ দেশের বাড়িতে চলে যায়, এক অংশ ব্যয় হয় বই কেনা বাবদ। বাকি যা থাকে তা দিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে নিয়ে যান মা। যাকে বলে ভয়াবহ জীবনসংগ্রাম। জীবনসংগ্রামের এই অংশটি বাবার কখনো চোখে পড়ে না। কারণ দেশের বাড়িতে পাঠানো টাকা এবং বই কেনার টাকা আলাদা করে বাকি টাকাটা মার হাতে তুলে দেন। বাবার দায়িত্ব শেষ। বাকি মাস টেনে নিয়ে যাবার দায়িত্ব হচ্ছে মার। তিনি তা কীভাবে নেবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। বাবার কোনোই মাথাব্যথা নেই।
এইরকম অবস্থায় মাসের প্রথম তারিখে বাবাকে খুব হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল। তিনি বিশ্বজয়-করা হাসি দিয়ে বললেন, আয়েশা, একটা বেহালা কিনে ফেললাম।
মা বিস্মিত হয়ে বললেন, কী কিনে ফেললে?
বেহালা।
বেহালা কীজন্যে?
বেহালা বাজানো শিখব।
কত দাম পড়ল?
দাম সস্তা, সত্তর টাকা। সেকেন্ড হ্যান্ড বলে এই দামে পাওয়া গেল।
বাবা সংসার চালাবার জন্য মার হাতে দশটা টাকা তুলে দিলেন; মা হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না।
বাবার খুব শখ ছিল ওস্তাদ রেখে তাঁর কাছে বেহালা বাজানো শিখবেন। একাদকে বেতন দিয়ে বেহালা বাজানো শেখার সামর্থ্য তার ছিল না। কাজেই অতি যত্নে বেহালা তুলে রাখা হল। যেদিন সামর্থ্য হবে তখন ওস্তাদ রেখে বেহালা শেখা হবে।
মাঝে মাঝে দেখতাম কাঠের বাক্স থেকে তিনি বেহালা বের করছেন। অতি যতে ধুলো সরাচ্ছেন। হুড়ে রজন মাখাচ্ছেন এবং একসময় লাজুক ভঙ্গিতে বেহালায় হড় ঘষছেন। কান্নার মতো একরকম আওয়াজ উঠছে বেহালা থেকে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
বাবার অসংখ্য অপূর্ণ শখের মতো বেহালা বাজানো শেখার শখও পূর্ণ হয়নি। বাক্সবন্দি থাকতে থাকতে একসময় বেহালার কাঠে ঘুণ ধরে গেল। দুড়ের সুতা গেল ছিড়ে। বেহালা চলে এল আমাদের দখলে। আমার ছোট বোন শেফ বেহালার বাক্স দিয়ে পুতুলের ঘর বানাল। বড় চমৎকার হল সেই ঘর। ডালা বন্ধ করে সেই ঘর হাতলে ধরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
আরেক দিনের ঘটনা। শীতকালের এক ভোরে মার গলা শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কী নিয়ে যেন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করছেন। এরকম তো কখনো হয় না! তারা ঝগড়া-টগড়া অবশ্যই করেন, তবে সবটাই চোখের আড়ালে। আজ হল কী? আমি কান পেতে আছি যদি কিছু টের পাওয়া যায়। কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। মা বারবার শুধু বলছেন, ঘোড়া দিয়ে তুমি করবে কী? আমাকে বুঝিয়ে বলো, কে পুষবে এই ঘোড়া?
বাবা বলছেন, এত রাগছ কেন? একটা কোনো ব্যবস্থা হবেই।
মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, আমরা নিজেরা খেতে পাচ্ছি না, এর মধ্যে ঘোড়া! তোমার কি মাথা-খারাপ হল?
আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছে একটা ঘোড়া কেনা হয়েছে।
আমাকে জেগে উঠতে দেখে বাবা হাসিমুখে বললেন, ঘরের বাইরে গিয়ে দেখে আয় ঘোড়া কিনেছি।
কী অদ্ভুত কাণ্ড! ঘরের বাইরে সুপারিগাছের সঙ্গে বাঁধা বিশাল এক ঘোড়া। ঘোড়াটাকে আমার কাছে আকাশের মতো বড় মনে হল। সে ক্রমাগত পা দাপাচ্ছে এবং ফোঁসফোঁস করে শব্দ করছে। আমাদের কাজের ছেলে আহদ [তার নাম সম্ভবত আসাদ, সে বলত আছদ] ভীতমুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘটনা হচ্ছে—বাবা মাকে না জানিয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডে এ পর্যন্ত জমা সব টাকা তুলে একটা ঘোড়া কিনে ফেলেছেন। এই সেই ঘোড়া। মহাতেজি প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি প্রাণী, যে-প্রাণীদের সঙ্গে বাবার প্রথম পরিচয় হয় সারদা পুলিশ একাডেমীতে। তার বড়ই পছন্দ হয়। বাবা তার পছন্দের জিনিস যে-করেই হোক জোগাড় করেন। এতদিন পর ঘোড়াও জোগাড় হল। তখন পুলিশ অফিসাররা ব্রিটিশ নিয়মের সূত্র ধরে ঘোড়া পুষলে অ্যালাউন্স পেতেন। বাবা আশা করছেন সেই অ্যালাউন্সের টাকাতেই এর পোষর খরচ উঠে আসবে।
ঘোড়া সুপারিগাছের সঙ্গে বাঁধা। বাবা-মার মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে। উত্তাপ পুরোটাই মা-ই চালাচ্ছেন, বাবা শুধু কাটান দেয়ার চেষ্টা করছেন।
কী করবে তুমি এই ঘোড়া দিয়ে শুনি? সিলেট শহরে ঘোড়ায় করে ঘুরবে?
হুঁ। অসুবিধা কী? ছেলেমেয়েদেরও ঘোড়ায় চড়া শেখাব।
ছেলেমেয়েরা ঘোড়ায় চড়া শিখে কী করবে?
কিছু করবে না, একটা বিদ্যা শেখা থাকল।
ঘোড়ার পেছনে কত খরচ হবে সেটা ভেবেছ?
এত ভাবলে বেঁচে থাকা যায় না।
বেঁচে থাকা যাক আর না-যাক এই ঘোড়া তুমি এক্ষুনি বিদেয় করো।
পাগল হয়েছ? এত শখ করে কিনলাম!
বাবা ছিলেন আবেগনির্ভর মানুষ। যুক্তি দিয়ে তাঁকে টলানো মুশকিল। কিন্তু তাকেও টলতে হল। কারণ ঘোড়া দ্বিতীয় দিনেই লাথি মেরে আছদের পা ভেঙে ফেলল। মা হাতে অস্ত্র পেয়ে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন, তোমার ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ ঘোড়াকে ঘিরে নাচানাচি করে। লাথি খেয়ে ওরা মারা পড়বে। তাই কি তুমি চাও? বাবা ঘোড়া বিক্রি করে দিলেন। সেই টাকায় কিনলেন একটা দামি কোডাক ক্যামেরা। তবে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঘোড়ার জিন রেখে দিলেন। আমাদের খেলার সামগ্রী-তালিকায় আরেকটি জিনিস যুক্ত হল।
দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জিনিসের প্রতি তাঁর আমৃত্যু শখ ছিল-একটি হচ্ছে। পামিস্ট্রি, অন্যটি ফটোগ্রাফি। তার কোডাক ক্যামেরা তিনি আগলে রাখতেন যক্ষের মতো। শুধু যে ছবি তুলতেন তা-ই না, সেই ছবি নিজেই ডেভেলপ এবং প্রিন্ট করতেন। আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাদের শৈশবের আনন্দময় মুহূর্তের একটি হচ্ছে বাবাকে ঘিরে আমরা বসে আছি। একটা গামলায় পানি। সেই পানিতে কিছু কাগজ ভাসছে। ধবধবে সাদা কাগজে আস্তে আস্তে মানুষের মুখের আদল ফুটতে শুরু করেছে। আমরা আনন্দে লাফাচ্ছি। বাবার মুখে আনন্দের হাসি। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা লিখছি। সেই সময় পুলিশের একজন দরিদ্র সাব-ইন্সপেক্টর নিতান্তই শখের কারণে ঘরে ডার্করুম বানিয়ে ছবি প্রিন্ট করছেন-ব্যাপারটা বেশ মজার।
পামিস্ট্রি নিয়েও বাবার উৎসাহ ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। আমার মনে হয় তার রস ঝোকটা ছিল রহস্যময়তার দিকে। তিনি রহস্যের সন্ধান পেয়েছিলেন ফটোগ্রাফিতে, ঝুঁকে পড়েছেন সেদিকে। রহস্য ছিল জ্যোতিষবিদ্যায়, সেদিকেও ঝুঁকলেন।
কিছুদিন পরপরই ছুটির দিনের সকালে একটা আতশি কাচ নিয়ে বসতেন। গভীর গলায় বলতেন, বাবারা আসো তো দেখি, হাতের রেখায় কোনো পরিবর্তন হল কি না।
একবার ইকবালের হাত দেখে বললেন-চমত্তার রেখা। চন্দ্র এবং মঙ্গলের ক্ষেত্রও ভালো। দীর্ঘ আয়ু। তুই খুব কম করে হলেও আশি বছর বাঁচবি। সেই রাতের ঘটনা। ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে সবার ঘুম ভেঙে গেল। ইকবাল হাউমাউ করে কাঁদছে। কী হয়েছে, কী হয়েছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আশি বছর পর আমি মরে যাব এইজন্যে খুব খারাপ লাগছে আর কান্না পাচ্ছে।
বাবা বললেন, গণনায় ভুল হতে পারে। আরেকবার দেখা দরকার। কই, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দেখি।
গভীর রাতে বাবা তার আতশি কাচ নিয়ে বসলেন। আমরা সবাই তাকে ঘিরে বসলাম। ইকবালের এক হাত বাবার কাছে, অন্য হাতে সে চোখ কচলাচ্ছে। বাবা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, আগের গণনায় ভুল হয়েছিল। তোর হাতে আছে ইচ্ছামৃত্যুর চিহ্ন। তোর হবে ইচ্ছামৃত্যু।
ইচ্ছামৃত্যু কী?
যতক্ষণ পর্যন্ত মরার ইচ্ছা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তুই মরবি না। বেঁচে থাকবি।
কোনোদিন যদি মরার ইচ্ছা না হয়?
তা হলে বেঁচে থাকবি। মরবি না।
ইকবাল হৃষ্টচিত্তে ঘুমুতে গেল।
জ্যোতিষবিদ্যা কোনো বিদ্যা নয়। জ্যোতিষবিদ্যা হচ্ছে একধরনের অপবিদ্যা, অপবিজ্ঞান। মানুষের ভবিষ্যৎ তার হাতের রেখায় থাকে না। থাকার কোনো কারণ নেই। তবু অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে বলছি, আমাদের সব ভাইবোন সম্পর্কে তিনি যা বলে গিয়েছিলেন তা মিলে গিয়েছিল। তিনি নিজের মৃত্যু সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বলেছিলেন, তার কপালে অপঘাত মৃত্যু লেখা। সেই মৃত্যু হবে ভয়ংকর মৃত্যু।
এইসব তথ্য তিনি হাত দেখে পেয়েছিলেন, না অন্য কোনো সত্রে পেয়েছিলেন, আমার জানা নেই। মিলগুলি কাকতালীয় বলেই মনে হয়।
জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরেকটি বিষয়েও জড়িত ছিলেন। সেটাকে প্রেতচর্চা বলা যেতে পারে। প্লানচেট, চক্র, ভূত নামানো এইসব নিয়ে খুব মাতামাতি ছিল। দাদাজান এই নিয়ে বাবার উপর খুব বিরক্ত ছিলেন। তিনি বাবাকে ডেকে তওবা করালেন যাতে তিনি কোনোদিন প্রেতচর্চা না করেন। বাবা তওবার পর প্রেতচর্চা ছেড়ে দেন, তবে এই বিষয়ে বই পড়া ছাড়েননি। বাবার সগ্রহের বড় অংশ ছিল প্রেতচর্চাবিষয়ক বইপত্র।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, তিনি আস্তিক মানুষ ছিলেন। আমরা কখনো তাকে রোজা ভাঙতে দেখিনি। নামাজ খুব নিয়মিত পড়তেন না, তবে রোজ রাতে এশার নামাজে দাঁড় হতেন। গম্ভীর স্বরে সুরা আবৃত্তি করতেন। পরিবেশ হয়ে উঠত রহস্যময়।
আমার বাবা যে একজন রহস্যময় পুরুষ ছেলেবেলায় তা কখনো বুঝতে পারিনি। তখন ধরেই নিয়েছিলাম সবার বাবাই এরকম। আমার বাবা অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু না। তা ছাড়া বাবার সঙ্গে আমাদের কিছু দূরত্বও ছিল। ছেলেমেয়েদের প্রতি আদরের বাড়াবাড়ি তার চরিত্রে ছিল না। নিজে খুব ব্যস্তও থাকতেন। সারাদিন অফিস করে বিকেলে বই পড়তে যেতেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। ফিরতে ফিরতে রাত নটা। দিনের পর দিন কাটত, তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হত না। এই কারণে মনেমনে চাইতাম তার যেন কোনো-একটা অসুখ হয়। বাবার অসুখ খুবই মজার ব্যাপার। অসুখ হলে তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের চারপাশে বসিয়ে উঁচুগলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। এতে নাকি তার অসুখের আরাম হত।
এই অসুখের সময়ই তিনি একবার ঘোষণা করলেন, সঞ্চয়িতা থেকে যে একটা কবিতা মুখস্থ করে তাকে শোনাতে পারবে সে এক আনা পয়সা পাবে। দুটো মুখস্থ করলে দুআনা।
আমি বিপুল উৎসাহে কবিতা মুখস্থ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে কোনো কাব্যপ্রীতি কাজ করেনি। আর্থিক ব্যাপারটাই ছিল একমাত্র প্রেরণা। যথাসময়ে একটা কবিতা মুখস্থ হয়ে গেল। নাম এবার ফিরাও মোরে। দীঘ কবিতা। এই দীর্ঘ কবিতাটা মুখস্থ করার পেছনের কারণ হল, এটা বাবার খুব প্রিয় কবিতা। তাঁদের সময় নাকি বি. এ. ক্লাসে পাঠ্য ছিল।
বাবা আমার কবিতা আবৃত্তি শুনলেন।
কোনো ভুল না করে এই দীর্ঘ কবিতাটি বলতে পারায় তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। এক আনার বদলে আমি চার আনা পয়সা পেলাম। সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে ওটাই ছিল আমার প্রথম রোজগার।
প্রসঙ্গ থেকে আবার সরে এসেছি। পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা হয়ে পসছে ফিরে যাই। বুঝতে পারছি, এরকম সমস্যা বারবার হবে, মূলধারা থেকে সরে আসব উপধারায়। কে জানে সেই উপধারাই হয়তোবা মূলধারা। তা হাড়া আত্মজীবনীমূলক রচনায় মূল্যহীন অংশগুলিই বেশি মূল্য পায়।
গানবাজনা বাবার বড়ই প্রিয় ছিল। বি. এ. পাশ করার পর কলকাতায় কী-একটা পার্ট-টাইম কাজ জুটিয়ে কিছু পয়সা করেন। তা দিয়ে যে-বস্তুটি কেনেন তার। নাম কলের গান। দম দিয়ে চালানো কলের গান। কোডাক ক্যামেরাটা ছাড়া অন্য কোনো জাগতিক বস্তুর প্রতি তার বিন্দুমাত্র মমতা ছিল না; কিন্তু এই যন্ত্রটির প্রতি তার মমতার সীমা ছিল না। পার্ট-টাইম চাকরিটি চলে যাবার পর তিনি অথই জলে পড়েন। কলকাতার যে-মেসে থাকতেন তার ভাড়া বাকি পড়ে। শখের জিনিস এক এক করে বিক্রি করে ফেলার অবস্থায় পৌঁছে যান। বিক্রি করার মতো অবশিষ্ট যা থাকে তা হচ্ছে কলের গান, যা বিক্রি করা আমার বাবার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। সেই সময় তাঁর বন্ধুবান্ধবরা বললেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের সঙ্গে দেখা করলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়।
শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক তখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। শিক্ষিত মুসলমান ছেলে তার কাছে চাকরির আবেদন করলেই কাজ সমাধা। কিছু-না কিছু তিনি জুটিয়ে দেবেনই। বাবা বি এ. পাশ করেছেন ডিসটিংশন নিয়ে। খুব শখ ছিল ইংরেজি সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়বেন। অর্থের অভাবে তা হয়ে উঠছে না। সেই সময় মুসলমান ছেলেদের চাকরিবাকরির প্রায় সব দরজাই বন্ধ। বাবা ঠিক করলেন, দেখা করবেন শেরে বাংলার সঙ্গে। এই অভাব আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
অতিব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী বাবাকে সাক্ষাতের সুযোগ দিলেন। তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল :
বি. এ. পাশ করেছ?
জি।
ফলাফল কী?
বি. এ.-তে ডিসটিংশন ছিল।
বাহ্, খুব খুশি হলাম শুনে। এম. এ. পড়বে তো?
জি জনাব, ইচ্ছা আছে।
ইচ্ছে আছে বললে হবে না—পড়তেই হবে। তুমি কি আমার কাছে বিশেষ কোনো কাজে এসেছ? কোনো সাহায্য বা কোনো সুপারিশ, কিংবা চাকরি?
বাবার খুবই লজ্জা লাগল। তিনি বললেন, জি না, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। অন্য কোনো কারণে না।
শেরে বাংলা বেশ খানিকক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সবাই আমার কাছে তদবির নিয়ে আসে। অনেকদিন পর একজনকে পাওয়া গেল যে কোনো তদবির নিয়ে আসেনি। আমি খুব আনন্দিত হলাম। তুমি এম. এ. পাশ করার পর পেশা হিসাবে শিক্ষকতা বেছে নেবে। আমার ধারণা তুমি ভালে। শিক্ষক হবে।
বাবা সেই রাতেই কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের কুতুবপুর চলে আসেন। বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে মীরকাশেম নগরের এক স্কুলে বিপুল উৎসাহে শিক্ষকতা শুরু করেন। মাসের শেষে বেতন নিতে গেলে হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, আদায়পত্র কিছুই নেই, বেতন দেব কী? দেখা যাক পরের মাসে।
পরের মাসেও একই অবস্থা। তার পরের মাসেও তা-ই। হেডমাস্টার সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন, শিক্ষকতা হচ্ছে মহান পেশা। আত্মনিবেদন থাকতে হয়। শুধু টাকা টাকা করলে কি হয়?
অভাব-অনটনে বাবার জীবন পর্যদস্ত হয়ে গেল। চাকরির দরখাস্ত করেন—চাকরি পান না। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেলেছেন। স্ত্রীকে নিজের কাছে এনে রাখার সামর্থ্য নেই। ঘোর অমানিশা। এই অবস্থায় কী মনে করে জানি ব্রিটিশ সরকারের বেঙ্গল পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টরির পরীক্ষায় বসলেন। সেই সময়ের অত্যন্ত লোভনীয় এই চাকরিতে নির্বাচিত হবার জন্যে কঠিন সব পরীক্ষায় বসতে হত। তিনি পরীক্ষা দিতে বসলেন। গ্রহের ফেরে এই পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গেলেন। ট্রেনিং নিতে গেলেন পুলিশ একাডেমী সারদায়।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুলিশের চাকরিটি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর দেখা গেল, এই জীবনে তিনি চার হাজারের মতো বই এবং পোস্টাপিসের পাশবই-এ একশত তিরিশ টাকা ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। বইয়ের সেই বিশাল সংগ্রহও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্দেশে পিরোজপুরের একদল হৃদয়হীন মানুষ লুট করে নিয়ে যায়। বাবাকে ধরে নিয়ে যায় বলেশ্বর নদীর তীরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। ভরা পূর্ণিমায় ফিনকি-ফোটা জ্যোৎস্নায় তার রক্তাক্ত দেহ ভাসতে থাকে বলেশ্বর নদীতে। হয়তো নদীর শীতল জল তার রক্ত সে-রাতে ধুয়ে দিতে চেষ্টা ভেবেছে। পূর্ণিমার চাদ তার সবটুকু আলো ঢেলে দিয়েছে তার ভাসন্ত শরীরে। মমতাময়ী প্রকৃতি পরম আদরে গ্রহণ করেছে তাকে।
এই প্রসঙ্গ থাক। এই প্রসঙ্গে আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। বরং মার কথা বলি।