হুলি গন্ধবণিক
হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা : রবীন্দ্রনাথের দাদুর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথের সমালোচনা
হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
আমি : আরও চার মাস, রাজকুমার ।
আমি, হুলি গন্ধবণিক, রাজকুমারের ভৃত্য, আমার সমস্যা হলো যে, মাথায় চুলের জঙ্গলে ভাববার কুয়াশা গড়ার দরকার হয় না, মুখ খুললেই নর্দমার পাঁকের তোড়ের মতন কথা ওগরাতে থাকি, গাঁয়ের নর্দমা নয়, সুতানুটি-গোবিন্দপুরের বর্ষাকালের আধকাঁচা নর্দমা, যে নর্দমায় জোব চার্নক দাঁড়িয়ে হিসি করে গেছেন, লর্ড হবার আগে পোঁদপোঁছা টয়লেট-কাগজ ফেলে গেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাহি লুটেরা রবার্ট ক্লাইভ, চার্লস স্টুয়ার্ট যাকে আমরা বলতুম হিন্দু স্টুয়ার্ট যিনি প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করতেন আর নিজের হিন্দু বউকে পাল্কিতে বসিয়ে নিজের সঙ্গে স্নান করাতে নিয়ে যেতেন, ব্রিটিশ আমল থেকে জেরা করার মতন করে বকবক, বর্ষা ফুরোলেই কথা বন্ধ, পচা গন্ধের সঙ্গে আমোদে ফুলতে থাকে, এখন, কয়েকশো বছর পরে, বাতিল প্লাসটিকের থলে, নেতাদের হাসিমুখের পোস্টার আর কন্ডোমে জ্যাম ।
আমার কথা বলতে হলে বলতে হয় যে, গ্রামসমাজ, ধর্ম আর গোষ্ঠীজীবন কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ লোক, যাঁদের মতামত আদ্যিকালে সমাজের সব স্তরে প্রভাবী ছিল, সেই লোকগুলোর পরের প্রজন্মকে দেয়া একপ্রস্হ আচার আচরণকে ঐতিহ্য আর পরম্পরা বলে মেনে নিতে খটকা লাগে ; সেসব আজ উপড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে, আর তার জায়গায় এসেছে কারখানার পাতিমার্কা জীবন, সেই সঙ্গে জটিল আমলাবাজির বাড়বাড়ন্ত, নিয়মকানুন, হ্যান কোরো না, ত্যান কোরো না, ওখানে ঢুকতে পারবে না, সেখানে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে । তাহলেই বুঝুন ।
আইডেনটিটি কার্ড হাতে, দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিচি চুলকোন ।
যাকগে যাক, এখন রাজকুমারের ব্যাপারটাই বলি ; পরে অন্য ।
আমি একজন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড, ক্লিপার জাহাজে করে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে, রাজকুমারের নিজের বাড়িতে ফিরছি, তাঁর ছেলেদের জিম্মায় হৃৎপিণ্ড বা হৃৎখণ্ডখানা হিল্লে করে আমার ছাড়ান, ওনাদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তি , এর আগে আফ্রিকার পোঁদের তলা দিয়ে ফিরতে হতো, সেই যে-জলরাস্তায় ভাস্কো ডাগামা এসেছিল, আর তার পেছু-পেছু পর্তুগিজ জলদস্যুর দলবল, ওরা অবশ্য আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টোমাটো এনেছিল, তার আগে আমরা সেসব খেতুম না, রাজকুমারের বাড়ির লোকজনও খেতো না, জাত যাবার আঁৎকানির দরুন, রাজকুমার নিজে কিচ্ছু মানতেন না, বলতেন ওরা সময়-অন্ধ, নিজের সময়কে চিনতে পারছে না, বাইরের জগতের বদলে নিজেদের মাথার পাঁকে সাঁতরায় ।
রাজকুমার ছিলেন আত্মগর্বী, বেপরোয়া, রুচিবাগীশ, কড়া-মেজাজের, বেয়াদপি করলে চাবকাতে কুন্ঠিত হতেন না, আয়েশি, ধবধবে ফর্সা, আদেশ না শুনলে বরখাস্ত করতেন, টাকা রোজগারের আর খরচ করার ঘাঁতঘোঁত খুঁজতেন, অন্নসত্র খুলে কাঙালিভোজন করাতেন, যোয়ান বয়সে খড়াদার গোঁসাইয়ের শিষ্য ছিলেন, পেঁয়াজও ছুঁতেন না, কিন্তু ‘চৈতন্য মঙ্গল’ পড়া সুতানুটি-গোবিন্দপুরের বামুনরা ওনাকে ঠ্যাটা করার পর উনি বললেন, আচ্ছা দাঁড়া তোদের দেখাচ্ছি, আমি তোদের চেয়ে কতো বড়ো হই, কতো উঁচু হই, সেই যে উনি পালটে গেলেন, তারপর ওনার উন্নতি শুধু মরণই থামাতে পেরেছে । রাজকুমারের ভেতরে যে একজন সম্রাট রাজত্ব করছে, তা উনি বামুনদের খেলো-করা কথা শোনার পরই টের পেলেন ।
ওনার বংশে কেউই ওনার মতন শ্বেতাম্বর টাইকুন হতে পারেননি, দিগম্বর হয়ে গেছেন ।
রাজকুমার বলতেন, বাঙালিরা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, যেকোনো নতুন ধারণাকেই মনে করে বিপজ্জনক, যেকোনো নতুন আবিষ্কার দেখলেই ভাবে আবার সেই খেটে মরতে হবে, সমাজে এগিয়ে যাবার নতুন পদক্ষেপকে মনে করে বুঝি বিদ্রোহ করে ফেলছে, তাই যখানে বসে আছে সেখাইনেই পাথরের মতন বসে থাকতে চায় ।
রাজকুমারের বড়ো ছেলে ঠাকুর-দেবতা দেখতে পান না, ওনার ঠাকুর-দেবতা নাকি নিরাকার, যেমন মোচরমানদের হয়, বলেছিলেন আমায় রাজকুমার ।
এই সমুদ্রযাত্রা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের, শান্তি আর অশান্তির জগাখিচুড়িতে ডুবে অদ্ভুত আনন্দ গড়ে ফেলতে পেরেছি, রাজকুমারের জন্য, চোখ বুজলেই আকাশে প্রায় কুড়িটা পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পাই ।
আমার প্রতিটি জন্মে থেকে গেছে এই নাতিশীতোষ্ণ বোধ, থেকে গেছে সমুদ্রে দেখা উড়ন্ত মাছেদের নোনা হাওয়া, ঢেউদের ওপরে ফেনার গান ।
সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের একজন হাবশিকে, সে বলতে গেলে বাঙ্গাল হয়ে গেছে, পর্তুগিজরা আফ্রিকার সিমলোপা প্রদেশ থেকে আরও অনেক ছেলে-ছোকরার সঙ্গে ওকে জাল ফেলে চুরি করে এনেছিল, যাতে যুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে, তা সে যাদের সঙ্গেই যুদ্ধ হোক না কেন, রণে বনে জঙ্গলে, রাজকুমার পর্তুগিজদের মোটা টাকা দিয়ে হাবশিটাকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন, এখন ব্যাটা নিজের দেশে ফিরতে চায় না, গিয়ে করবেটাই বা কী, নিজের ভাষাও তো ভুলে গেছে । সমুদ্রপথে আঁকশি দিয়ে, ও দুটো উড়ুক্কু মাছ ধরে লোহার চৌবাচ্চায় ঢাকা দিয়ে রেখেছে, এই জাহাজে, মাংসের টুকরো খেতে দেয়, শুকনো মাংস, উটের, ভেড়ার, হলুদ আর লঙ্কাগুড়ো মাখানো, যাতে পচে না যায়, জাহাজের খালাসি ক্যাপ্টেন সকলেই ওই মাংস খায় ।
হাবশিটা আমার দেখাশোনা করে, আমি তো চাকর, ও হলো চাকরের ভৃত্য । সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ এখন বাংলাদেশে । রাজকুমারের সময়ে বাংলাদেশ ছিল না, অখণ্ড বঙ্গদেশ ছিল, সেখানে ওনার জমিদারি ছিল, সে অনেক জমিজমা ছিল, মোচোরমানরা ভেন্ন হয়ে যেতে চাইলো, তাই আলাদা হয়ে গেছে, তারপর নিজেদের মধ্যে কচুকাটা খুনোখুনি করে আলাদারও আলাদা হয়ে গেছে, এখন সেই আলাদার আলাদার মধ্যেও আলাদা হবার মারিকাটারি চলছে, আদালত চত্বর থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি হাপিশ করে দিয়েছে, নেড়ে সালাফিস্টদের যা তে মন ভরে।
সুতানুটি-গোবিন্দপুরের এখনকার লোকেরা বলে যে ওরা আলাদা হয়ে ভালোই করেছে, নয়তো ছেচল্লিশের খুনোখুনি বজায় থাকতো, এখন নিজেরা লড়ে মরছে, সে-ই ভালো ।
রাজকুমার চোগা-চাপকান পরতে ভালোবাসতেন, কাঁধে কাশ্মিরি কাজ করা শাল, নাগরা জুতোয় মুক্ত বসানো, সবই বিলেতে ছেড়ে আসতে হয়েছে, ওনার সুইটহার্টরা কেউ-না-কেউ হাতিয়ে নিয়ে থাকবেন । এখন যাকে অ্যাটিচিউড বলে, ওনার চাল-চলন থেকে তা গর্বের গুঁড়ো হয়ে ঝরে-ঝরে পড়তো, হাওয়ায় উড়তো ওনার জ্যোতি ।
ক্লিপার জাহাজ মানে তিন মাস্তুলের জাহাজ, সবকটা মাস্তুলে চারচৌকো নস্যি রঙের ছোটো-ছোটো পাল, সবচেয়ে উঁচু মাস্তুল মায়িস, দ্বিতীয়টা ফোরমাস্ট, তৃতীয় মেজ্জিন ; দুবার বিলেত যাওয়া আর দুবার আসায় ক্লিপার জাহাজের অনেক ব্যাপার জেনে ফেলেছি ।
আমি পেয়েছি চারচৌকো কেবিন, কাঠের মেঝেয় নীল রঙের কার্পেট, বার্নিশ-করা সেগুনকাঠের দেয়াল, ল্যামিনেশানে চকচকে, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে যাচ্ছি বলে আমার দেখাশোনার জন্যে হাবশিটা রয়েছে, সে আফ্রিকার মোচোরমান ছোঁড়া, কিন্তু বাঙ্গাল হয়ে গেছে, না ও আমার ঘটি ভাষা বোঝে আর না আমি ওর বাঙ্গাল ভাষা বুঝি । সঙ্গে ঢিলা কুলুপ আনেনি, সমুদ্রের নোনতা জল ব্যবহার করে-করে নুনুতে নুনের পলি জমে হেজে যেতে বসেছে, নোনতা জল মানে যে জলে উড়ুক্কু মাছ দুটো পুষেছে, ফিদিন বদলাতে হয়, ক্যাপ্টেন বলেছে খাবার জল ব্যবহার করতে পারবে না । সুতানুটি-গোবিন্দপুর না পৌঁছানো অব্দি বেচারার অঙ্গখানা আস্ত থাকলে হয় ; নুনুর খোসা ছাড়ানোয় যেমন সুবিধে আছে, তেমন অসুবিধেও আছে।
রাজকুমারের এক মেয়ে আর পাঁচ ছেলে , ওনাদের পরিবারে বছর বছর বিয়োবার রীতি, তা সত্বেও উনি বেশি ছেলেমেয়ে পয়দা করতে পারেননি কেননা ওনার বউ, ব্রাহ্মণ পুরুতদের পরামর্শে, ওনাকে ছুঁলে সাতবার পাল্কিসুদ্দু গঙ্গায় চান করতেন, তখন অবশ্য গঙ্গা এরকম গুয়ে গোবরে পাঁকে নর্দমার-কারখানার জলে দুর্গাকালীর মূর্তি-ভাসানো খড়ে কালোকেলটে হয়ে যায়নি, মাদি ইলিশরা দুরছাই করে বর্মায় বিয়োতে পালায় নি, শুশুকরা এই নদীতে যাতে না সেঁদোতে হয় তার প্রতিজ্ঞা করেনি, দলদাসদের খুন করা মুন্ডুহীন ধড় ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় গাইতে-গাইতে ভাসতো না।
ওনার বউ ছিলেন গোঁড়াবামুন- বাড়ির মেয়ে, বরের দেহের চেয়ে বেশি গঙ্গার জলকে পবিত্র মনে করতেন ।
রাজকুমার বলতেন, যারা গোঁড়া তারা অজানার চেয়ে পরিচিতকে পছন্দ করে, যা পরখ করা নয় তার চেয়ে বেশি পছন্দ করে যা আগে থাকতে পরখ করা, রহস্যের চেয়ে ঘটনাকে পছন্দ করে, সম্ভাব্যের চেয়ে যথাযথকে পছন্দ করে, অসীমের চেয়ে সীমিতকে পছন্দ করে, দূরের চেয়ে কাছেরকে পছন্দ করে, প্রাচুর্যের তুলনায় যা যথেষ্ট তাকে পছন্দ করে, নিখুঁতের হবার চেষ্টার চেয়ে যা সুবিধাজনক তাকে পেতে চায় ।
একটা উড়ুক্কুমাছ লাফিয়ে উঠে বললে, গুড স্পিচ ।
রাজকুমারকে বিদেশিনী বন্ধুনিরা এতো চাইতো যে বউয়ের দরকার পড়তো না, নিজের চোক্ষে দেখা, কানে শোনা । আমার মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয় যে কোনো বিদেশিনী বন্ধুনি ওনার টাকাকড়ি মণিমুক্তো চুরি করে ওনাকে মেরে ফেলার তাল করেছিল, তাই অতো কম বয়সে হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন । তখনও ওনার কতো কাজ বাকি ।
চাকর তো, তাই হলফ করতে পারি না, নইলে তাও করতুম আপনাদের খাতিরে ।
যতোদূর মনে পড়ে, আমি আমার গত চার জন্মের কথা পুরোটা মনে রাখতে পেরেছি, গ্রীষ্মের কী-গরম কী-গরম ঘামে গলগল খরার গাঁয়ের ছমছমে রাত ( অক্ষাংশ ২২.৩৪ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৮৮.২৪ পূর্ব ) ।
হেমন্তের ফুরফুরে হাওয়ার সোনালি বিকেল ( অক্ষাংশ ২৫.৬ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৮৫.৭ পূর্ব ) ।
শীতের হিহি ঠাণ্ডা লালশালুর দুপুর ( অক্ষাংশ ২৫.৩৬ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৮৩.১৩ পূর্ব ) ।
বর্ষার ঝমাজঝম বরফের সুপুরি বৃষ্টির সকাল ( অক্ষাংশ ১৯.০১ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৭৩.০১ পূর্ব )। বিশ্বাস না হলে লাহোরে আকবরের ফারসিতে খাকের কলমকারি নথি , ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা রানি ভিক্টোরোয়ার গেজেট আর দুই বাংলার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, দুইরকম বাংলায় ছাপানো খবরের কাগজ দেখতে পারেন ; প্রতিবারই আমার নাম হুলি রেখেছেন আমার নিজের বাবা-মা বা অন্যের বাবা-মা, আমার চোখ কটা বলে তিনবার আর একবার আকাশ কালো করে নিম্নচাপের হুলোরাঙা মেঘ জমেছিল, তাই ।
তার আগের জন্মগুলোর ঘটনা একটু-আধটু কখনও সখনও মনে পড়ে বটে, তবে গোলমাল হয়ে যায় যে তা ছয় বারের জন্মে ঘটেছিল নাকি দশ বারের, নাকি অন্য কোনো, তবে হুলি নামটা পালটায়নি, বড়ো জাতে জন্মালে পদবি পালটেছে, ছোটো জাতে জন্মালে পদবির দরকার হয়নি ।
রাজকুমার, মানে ছয় ফুটের গৌররাঙা যে মানুষটার কথা থেকে-থেকে মনে পড়ছে, যিনি মেমদের কোমরে হাত রেখে সুইটহার্ট বলতেন, যদিও সুইটহার্ট বলতে যে ঠিক কী বোঝায় তা আজও জানি না, মিষ্টি হৃদয় মানেই কি মিষ্টি মেয়ে, ভেতরে নোনতা বাইরে মিষ্টি কিংবা ভেতরে নোনতা বাইরে নোনতা হলেও তো তাকে চাওয়া যায়, নয় কি ?
সেই রাজকুমারের, যাঁর গোলাপি প্রজাপতির ডানার মতন কাঁপতে-থাকা হৃৎপিণ্ডও বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে, ওনার সঙ্গে কথাবাত্রার আগেও আমি জন্মেছিলুম, উনি যে ভাবছেন হুলি নামটা ওনার দেয়া, তাও ভুল।
রাজকুমার ঠাকুর ঘরে গরদের ধুতি কাঁধে সিল্কের চাদর দিয়ে দেবী-দেবতার এতো পুজোআচ্চা করতেন, অথচ বিশ্বাস করতে পারলেন না যে আমি এর আগেও জন্মেছি, হিন্দু যখন, তখন বার বার জন্মাবার সুযোগটা নেবো না কেন ! অ্যাঁ ? শীতেও খালি গায়ে পুজো করতেন উনি ।
এই জন্মটা না হয় শুদ্দুর হয়ে জন্মেছি, আগের জন্মে তো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য হয়ে জন্মেছিলুম। মনুস্মৃতির প্রোটোকলটা যে কোন খাতে বয়, তা ঠাহর করতে মাথা ডগমগ করে, বামুনের মধ্যেও এতো রকমের বামুন কেন, উনি রাঢ়ীশ্রেণির বামুন, অন্য বামুনগুলো বোধহয় আড়িশ্রেণি, ঘড়িশ্রেণি, বড়িশ্রেণি, নুড়িশ্রেণি, চুড়িশ্রেণি । নাহ, সংসারত্যাগী বামুন, দীক্ষা বিলোবার বামুন, গেরস্ত বামুন, জজমানি বামুন, মন্দিরের পুজুরি বামুন, ছেরাদ্দের বামুন, ব্রাত্য বামুন যারা পৈতে ফেলে দিয়েছে, বর্ণহীন বামুন যে জাতিপ্রথা মানে না । তাহলে বামুনদের মধ্যেও উঁচু জাত-নীচু জাত আছে, অ্যাঁ ।
বাঙালিদের মধ্যে ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য নেই কেন, যার জন্যে আমাকে দুবার অবাঙালি হয়ে জন্মাতে হয়েছিল, শুদ্দুরদের মধ্যেও এতো ভাগাভাগি কেন, ওফ কতো রকমের শুদ্দুর যে হয় তা শুদ্দুররাই বলতে পারে না, কামার কুমোর ছুতার স্যাকরা লোহার মালি মালো তাঁতি তেলি জেলে চাষি, তারা তো কৌরব পক্ষে ছিল, তবে ক্ষত্রিয় নয় কেন !
পাটনার আফিমকুঠীর এক আফিমচাষীর বিধবাকে বিয়ে করেছিল জোব চার্ণক, চাষীরা তো তখন শুদ্দুর ছিল না !
পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়, উগ্রক্ষত্রিয় বাঙালিরা সব গেলো কোথায় ? তারা তো ক্ষত্রিয় ছিল !
নেপালের লুম্বিনীর গৌতমও রাজকুমার ছিলেন, তিনিই যখন এই প্রোটোকল নষ্ট করতে পারলেন না, গাছের তলায় বসে বুদ্ধ হয়ে গেলেন, তখন যে-রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড আমি ফরম্যালিনের শরবতে চুবিয়ে সুতানুটি-গোবিন্দপুর ফিরছি, তিনি কীই বা করতে পারতেন ।
কলকাতায় লুম্বিনী পার্ক নামে একটা পাগলামি সারাবার হাসপাতাল আছে যেখানে ঋত্বিক ঘটক, বিনয় মজুমদার, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমি ছিলুম দিনকতকের জন্যে, বিজলির ছোবল মেরে-মেরেও কোনো সুরাহা হয়নি।
পুরুষের পাগলামি সারে না, সে যদি রাজকুমার হয়ে জন্মায়, তাহলেও ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না টু-পিস সাঁতারের পোশাকে বিদেশিনীদের ।
তুই ভাবছিস দেখিনি, আমি চিরটকাল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছি ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগীতায় জিতে ফেরা ভারতীয় নিকোল ফারিয়া, দিয়া মির্জা, সুস্মিতা সেন, ঐশ্বর্য রায়, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, লারা দত্ত, যুক্তা মুখি, ডায়না হেডেনকে।
তুই ভাবছিস জানতে পারিনি, আমি সবই আগাম জানতে পারি রে ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না সুচিত্রা সেনকে ; সুচিত্রা সেনও দেখে যেতে পারলেন না রাজকুমারকে ।
আমরা দুজনে দুজনকে দেখেছি, তুই জানিস না ।
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে আমার কথাবাত্রা হয়েছিল ১৮৪৬ সালে, যখন কিনা আজ এটা ২০১৭ সাল, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ, সেই সময় থেকে বয়সের হিসাব ধরলে এখন আমার বয়স ১৭১ বছর, দাড়ি-চুল-গোঁফে চিরুনি পড়েনি বহুকাল, যশোর থেকে পালিয়ে আসার সময়ে আনা হয়নি, মেহেদি লাগিয়ে বাদামি জটাজুট হই, আর ভালো না লাগলে ন্যাড়া হয়ে যাই ।
জাহাজের কেবিনে বসে কথা বলার সময়ে টের পাচ্ছিলুম যে দুঃখে-দুঃখে আমার গলার ভেতরে চার-পাঁচটা কাক ঢুকে বসে আছে ।
এই ১৭১ বছরেও, চাকরদের হেড হরিখুড়ো যে গাঁয়ে থাকে, সেখানে এই ব্যাপারগুলো এখনও পালটায়নি : ১) শ্রাদ্ধ আর বিয়ের ভোজে বামুনদের আগে খাওয়ানো হয়, সব শেষে শুদ্দুরদের ; ২) নিচুজাতের মানুষকে খেতে দেবার জন্যে উঁচু জাতের বাড়িতে কাপ-গেলাস এমন অচ্ছুত করে রাখা থাকে যেন সেগুলো হাতবোমা ; ৩) গাজন বা শিবের অন্য পুজো্য নিচুজাতের কাউকে সন্ন্যাসী সাজতে দেয়া হয় না ; ৪) উঁচুজাতের বউ-মেয়েরা নিচুজাতের বউমেয়েদের ছুঁতে চায় না, এড়িয়ে যায় ; ৫) একজন পৈতেধারী বামুনের বারো বছরের ছেলেকে নিচুজাতের সত্তর বছরের বুড়ো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চায় ; ৬ ) অনেক গ্রামে জাত অনুযায়ী পাড়া ভাগ করা আছে ; ৭ ) গরিব পুজারী আর পিণ্ডদানকারী বামুনকে অন্য বামুনরা নিচু নজরে দ্যাখে ; ৮) উঁচুজাতের রান্নাঘর, শোবারঘর আর ঠাকুরঘরে নিচুজাতের লোকেদের ঢুকতে দেয়া হয় না ; ৯ ) নীচুজাতের মানুষকে যে থালায় খেতে দেয়া হয় তা উঁচুজাতের বাড়ির বউরা ধুতে চায় না, কাজের লোককে দিয়ে ধোয়ায় আর যদি কাজের লোক না থাকে তাহলে বাড়ির পুরুষরা ধুয়ে দ্যায় ; ১০ ) মোচোরমানদের জন্যে বাসন-কোসন আলাদা।
হরিখুড়োর গাঁয়ে মোচরমানদের মধ্যেও উঁচু জাত নীচু জাত আছে, তাদের মধ্যে বিয়ে হয় না । সুন্নি মুসলমান আর শিয়া মুসলমান আছে, তাদের মধ্যে বিয়ে হয় না ।
আমি বিয়েথা করিনি, রাজকুমারের দেখাশুনা কে করবে আমি যদি সংসারি হয়ে যাই !
১৭৫৬ সালে সিরাজ উদ দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন, তখন আমি দু’পক্ষের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে খুন হয়ে গিসলুম, তারপর গোবিন্দপুরের জঙ্গলে এক গর্ভবতী বাঘিনী আমাকে খেয়ে ফেলেছিল, যখন ওর বাচ্চা হলো, সেই সঙ্গে আমিও সুন্দরবনে জন্মেছিলুম, বাঘ হয়ে নয়, মানুষ হয়েই, বাঘিনী আমাকে অন্য রকমের দেখতে বলে খুবই আদর করতো, আমার সারা শরীর চাটতো আর আমার কাতুকুতু লাগতো। বাঘিনীর পেটের ভেতরে আরও বেশ কয়েকজন মানুষ ছিল, তারা বললে, না, না, পেছন দিক দিয়ে জন্মাতে পারব না, বাঘিনী হজম করে আমাদের বদবুদার ন্যাড়ে প্রসব করে দিক সেও-ভি-আচ্ছা, আমাদের দাবি মানতেই হবে, আমরা সামনে দিক থেকে জন্মাতে চাই, ফলে সেই মানুষগুলো আর জন্মাতে পারলো না, সুন্দরীগাছের গোড়ায় বাঘিনীর গু হয়ে অমর হয়ে গেল ।
ভাটার সময়ে সুন্দরীগাছের আকাশমুখো শেকড়ের মাঝে ন্যাড় হয়ে যাওয়া মানুষরা দেখা দিতো যখন, তারা চেঁচাতো সর্বহারা হওয়া ভালো, গরিব হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, জবরদখল করা ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো ; এই সমস্ত কথা আউড়ে তারা অমর হতে চাইলে ।
যে লোকটা এইসব স্লোগানের নেতা ছিল, সে নিজের মরিচঝাঁপি নামে উদ্বাস্তুদের দ্বীপকে চারিদিক থেকে ঘিরে গুলি চালিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে লাশগুলোকে সমুদ্রে ফেলার হুকুম দিয়ে বিলেতে গরমকাল কাটাতে হার সিঙ্গল মল্ট খেতে চলে গিয়েছিল ।
মানুষ যতোদিন বেঁচে থাকে, অমর হতে চায়, তা সে গু হয়েই হোক, কিংবা নিরাকার গোল্লা হয়েই হোক।
বাঘিনীর কাছ থেকেই আমি কাঁচা মাংস খেতে শিখেছিলুম, জন্তু আর মানুষ মেরে খেয়ে ফেলতুম, পরে শুনেছি যে বাঘিনীর ছেলেপুলেরা এইশাল ওইশাল হ্যানশাল ত্যানশাল নাম নিয়ে মানুষ মারতো আর খেয়ে ফেলতো, লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতো আর যাদের জমিজমা আছে তাদের জবাই করতো, ওদের দেখাদেখি সেপাই সান্ত্রিরাও ঝাঁটছাল বালছাল আঁড়ছাল গাঁড়ছাল সেজে মানুষ খাওয়া আরম্ভ করেছিল, কিন্তু সেসময়ে আমি আরেকবার জন্মাইনি, দুই জন্মের মাঝে আরাম করছিলুম । ওদের কারোর গায়েই আমার মতন বাঘের চামড়ার ডোরা দাগ ছিল না, যে কজনের গায়ে চিতাবাঘের ফুটকি ছিল তারা শীতকালেও পুকুরে কুয়োয় কলতলায় নদীতে চান করে ধুয়ে ধুয়ে ফুটকির দাগ চামড়া থেকে মুছে ফেলতে পেরেছিল, মুছে ফেলে বলেছিল এইশাল ওইশাল হ্যানশাল ত্যানশাল চিতাবাঘদের দাগগুলো ছিল পদ্ধতিগত ভুল, এগুলোকে বাঘের ডোরার মান্যতা দেয়া যায় না ।
ওরা কিন্তু অমর হতে পারেনি, ওদের নাম-সাকিনও কেউ মনে রাখেনি ; যে গেছে সে গেছে ; যা গেছে তা গেছে । ওদের যারা হালুমখোর বানালে, আর যারা হাপিশতোড় শেখালে, সেই , চারু এম, জ্যোতি বি, সিদ্ধার্থ আর, আজ অমর, হাসি মুখ, ছবি হয়ে, ভক্তদের চুনওঠা দেয়ালে, দরমার বেড়ায়, চ্যাঁচারির কুঁড়েঘরে এই যে হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্নমধুর গাইছেন ।
আমি তো যতোদূর জানি ভুল মানে ভুল, তা সে পদ্ধতিগত হোক বা দিবঙ্গতবা সদগতিগত হোক ।
বাঘিনীর পেছন দিক দিয়ে জন্মেছিলুম বলেই তো আমি এককালে ঠগীদলের সর্দার হতে পেরেছিলুম ; কমিউনিস্ট দলের সর্দার হবো তাও ভেবেছিলুম, কিন্তু বার বার জন্মাবার ফলে এমন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলুম যে আর আগ্রহ হয়নি । ততোদিনে কমিউনিজমও ক্লান্ত, ভোদকা টেনে ইয়েল্তসিন নামে এক মাতাল কামান দেগে উড়িয়ে দিলে হাজার হাজার লোকের জোর করে দেখানো স্বপ্ন ।
আসলে কমিউনিজম হোক বা অন্য কোনো ইজম, সব ইজমই একসময়ে ক্লান্ত হয়ে যায়, তত্বতে গাঁটে-গাঁটে আরথ্রাইটিস হয়ে যায় । পুঁজির হলকা ভেতরে ভেতরে ফোঁপরা করে ফ্যালে সবকটা ইজমকে ।
চীন দেশে কমিউনিজম ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল, তাই ওরা নতুন উপায় বার করলে, বললে সর্বহারা হওয়া ভালো নয়, গরিব হওয়া ভালো নয়, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো নয়, ন্যাড়ের জীবন ভালো নয়, যে করেই হোক ইংরেজি শিখতেই হবে , ব্যাস, ওরা এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর দেশ, ওদের চেপ্টা নাক প্রতি বছর একটু-একটু করে উঁচু হয়ে চলেছে। ওরা সব রকমের মাংস খায়, যেকোনো প্রাণী হলেই হলো, ঘাস থেকে ফড়িং তুলে খেতে ভালোবাসে, তেঁতুলে বিছের বড়া খেতে ভালোবাসে, রাস্তার ধারে কাঠিতে গিঁথে সাপের ফুলুরি বিক্রি করে । যখন মনোজ বসুর সঙ্গে চীনে গিয়েছিলুম, তখন খেয়েছি ।
যারা চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান হাঁকতো, তারা বাঙালির গাঁ-গেরাম-গঞ্জ-শহর থেকে উধাও । চীনও সেই চেয়ারম্যানকে উধাও করে দিয়েছে ।
এই যে গোরু-মোষের মাংস খাই, তার কোনো শাস্ত্রগত ভুল নেই, কিন্তু হিন্দিওয়ালারা, যারা শাকাহারি, মানে শাক দিয়ে ঢেকে টাকা খায়, টাক পড়ে গেছে বলে টিকি ঝরে গেছে, টিনের ত্রিশূলকে মনে করে সমাজ পালটানোর তত্ব, ভাবে, তাদের যা শেখানো হয়েছে তা-ই তো তারা ভাববে, মনে করে, গোরু-মোষ খেলে নরকে যাবে।
কী বোকামি বলুন ! আরে আমি তো হিন্দু, বার বার জন্মাই, জন্মাবো, জন্মেছি, সেখানে নরকে যাওয়া স্বর্গে যাওয়ার গোলমাল আসছে কোথ্থেকে শুনি, অ্যাঁ !
মহাভারত বইয়ের, মহাভারত তো আমাদের ইতিহাস, কী না, অ্যাঁ, ব্যাসদেবজীর লেখা, তা ওই ইতিহাসের অনুশাসন পর্বে পাণ্ডবদের ক্যাবলা বড়ো ভাই যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম বলেছিলেন শ্রাদ্ধে যাদের নেমন্তন্ করা হয়েছে তাদের যেন গোরুর মাংস ভালো করে রেঁধে খাওয়ানো হয়, তাহলে পূর্বপুরুষরা স্বর্গসুখ পাবেন ।
বিরাট রাজা তো পুরো একটা খাটাল খুলেছিলেন টেস্টি-টেস্টি গোরু পোষার জন্য, এখনকার দিন হলে অবশ্য সেগুলো পাচার হয়ে যেতো আর গৌরাক্ষসরা পাচারকারীদের আড়ং ধোলাই দিয়ে তক্তা করে মাটিতে মিশিয়ে দিতো ।
আরেকটা ইতিহাস, যেটা বাল্মীকিজি লিখেছিলেন, তাতে আছে যে বনবাসের পথে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ যখন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে পৌঁছেছিলেন, তখন ভরদ্বাজ সন্ন্যাসি ওনাদের মধুপর্ক, বৃষমাংস আর ফলমূল দিয়ে লাঞ্চ করিয়েছিলেন । বাল্মীকিজি শুদ্দুর ছিলেন শুনেছি, নারদের আশীর্বাদে ব্রাহ্মণ হয়ে গিসলেন ।
চাণক্যর কথা তো জানেন, যাঁর সমান আই কিউ সেই সময়ে কোনো পণ্ডিতের ছিল না, উনি অর্থশাস্ত্র বইতে লিখে রেখে গেছেন যে রাখালরা মাংসের জন্য ছাপ দেয়া গোরুর মাংস কাঁচা কিংবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারে । ছাপ দেয়া মানে এখন যাকে বলে আধারকার্ড ।
তারপর চরক, ওই যিনি ডাক্তার ছিলেন, উনি ওনার সংহিতায় লিখে গেছেন যে গোরুর মাংস খেলে বাত, নাক-ফোলা, জ্বর, শুকনোকাশি, রোগা হয়ে যাওয়া, পেট গরম সারে । চরক কিন্তু সত্যিকারের ডাক্তার, দেড়-দুকোটি টাকা দিয়ে এমবিবিএস আর এমডি হতে হয়নি ।
ব্যাপারটা আমি জানি, তার কারণ বাবর আর ইব্রাহিম লোদি দুটো পার্টিকেই পানিপতের যুদ্ধের সময়ে আমি মাংস নুন তেল কাঠকয়লা সাপলাই দিতুম । সেই জন্মে আমার নামছিল হুলিকাঞ্চন গুপ্তা, বেনের বাড়ি জন্মেছিলুম, বাপ-ঠাকুর্দা আগে থাকতেই ব্যবসার ঘাঁতঘোঁত জানতো, সিংহাসনে যে পার্টিই বসুক না কেন, মাল তাকে তো বেচবেই, তার শত্তুরকেও বেচবে । শত্তুরকে একটু বেশি দামে খারাপ মাল বেচবে, যাতে যে সিংহাসনে বসে আছে, সে চটে না যায় । বেনে বলে আমরা ছিলুম শাকাহারি, দইয়ের রায়তা দিয়ে পুদিনার পরোটা খেতুম, কিন্তু ব্যবসা তো যেকোনো জিনিস নিয়ে করা যায়, কেনবার পার্টি হলেই হলো ; এই যে আজকাল বুদ্ধি ছড়ানোর এতো বই বিক্রি হচ্ছে, তাও তো ব্যবসা, মুকখুরা তো কিনছে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।
বাবর এসেছিল বাইরে থেকে, নাক চেপটা, দাড়িতে চারটে চুল, গোঁফে দুটো করে, সেই চেঙ্গিজ খানের বংশধর, যার তত্ব ছিল ধরো আর মারো, মেয়েদের লোটো আর তুলে নিয়ে যাও, বাড়িঘর পুড়িয়ে পাবলিকদের ভাগাও । সেই টেকনিক রপ্ত করে তিনি আজ অমর, ওনার স্টেনলেস স্টিলের বিরাট মূর্তি বসেছে মোঙ্গোলিয়ার ফাঁকা মরুভূমিতে, সেই চেঙ্গিজ খান, তার কোনো এক প্রজন্ম ছিল বাবর, চেঙ্গিজ খানের একশো আটাত্তরটা বউ ছিল, বাবর নিশ্চয়ই কোনো তাগড়া বউয়ের নসল থেকে জন্মেছিল ।
আসবার আগে বাবর এদেশের কিছুই জানতো না, শুধু তরমুজ খাওয়া জানতো । তবে বাবর লোকটা দিন নেই দুপুর নেই রাত নেই সন্ধে নেই লড়ে লড়ে যুদ্ধু বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল, সেই তখনকার দিনে, মানে ১৫২৬ সালে, মোটে পনেরো হাজার সেনা নিয়ে সুলতান ইব্রাহিম লোদির চল্লিশ হাজার সেনাকে গুহারান হারিয়ে দিলে, তার কারণ বাবরের ছিল কামান বন্দুক আর ঘোড়সওয়ার, যখন কিনা ইব্রাহিম লোদির এক হাজার হাতি বাবরের কামানের গোলায় ক্ষেপে গিয়ে নিজের সেনাদেরই পায়ে পিষে মেরে ফেললে, তাছাড়া সুলতানের সেনায় অনেক হিঁদু ছিল যারা মাংস খেতে চাইলে না, তাদের জন্যে ফলমূল চালডাল সাপলাই দিতে হয়েছিল, তারা বোধহয় ভেবেছিল নেড়ের সঙ্গে নেড়ে লড়ে মরুক, আমাদের তাতে কি, এক নেড়ে গিয়ে আরেক নেড়ে আসবে, অবস্হা যে কে সেই ।
বাবরের পার্টি অনেক দূর দেশ থেকে এসেছিল বলে ওদের শুকনো মাংস খাইয়ে চালিয়ে দিয়েছিলুম, শুকনো মাংসই ওরা পছন্দ করতো, সঙ্গে কাঁচা মাংস নিয়ে তো আর যুদ্ধুর মাঠে যাওয়া যায় না । সেনারা তো সবাই নেড়ে, মাংস পেয়ে বাবর কতো যে সোনাদানা দিয়েছিল, বাড়িতে মাটির তলায় পুঁতে রাখতে হয়েছিল । এই যে শেষ পর্যন্ত বাবর জিতে গেল, তা তো আমাদের সাপলাই দেয়া শুকনো মাংসের জোরে, নয়তো ভারতে মোগল সাম্রাজ্য হতেই পারতো না । সিংহাসনে হাঁটু মুড়ে বসেও বাবর শুকনো মাংসের দোপেয়াজা রিজালা খেতে চাইতো, এক পিস তরুমুজ খেয়ে এক কামড় রিজালা, তখন জোরে ঢেঁকুর তোলা আর পাদায় ছিল সম্রাটদের একচ্ছত্র অধিকার ।
একটা উড়ুক্কুমাছ লাফিয়ে উঠে বলল, গুড স্পিচ ।
বাবরের ছেলেও রাজকুমার, বড্ডো রোগে ভুগতো, সাত মাসের মাথায় পয়দা হয়েছিল, হুমায়ুন, সেও বেশি দিন সিংহাসনে টিকলো না, আটচল্লিশ বছর বয়সে ওই যাকে বলে ইন্তেকাল, তাই করলো, যখন কিনা বাবর পশ্চিম দিকে মুখ করে নিজের জীবনের বদলে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে বলেছিল । পরে একজন কাব্যলিখিয়ের সুবিধে হল বাবরের পশ্চিমমুখো দোয়া চাইবার ব্যাপারটা নিয়ে ; না, বাবরের ভাষায় নয়, সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ভাষায় ।
হুমায়ুন বড্ডো আফিম খেতো, নেশার ঘোরে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে ইন্তেকাল করেছিল, তার দোষ আমার বাপ-ঠাকুর্দার ওপর এসে পড়েছিল, ভালো জাতের আফিম সাপলাই করার জন্য, আমরা তো ওনার দরবারের সকলকেই, যারা আফিম ভালোবাসতো, তাদের বিশুদ্ধ আফিম সাপলাই দিতুম । তারপর থেকে বিশুদ্ধ জিনিস বিক্রি বন্ধ করে সবেতেই ভেজাল মেশাতে হয় ।
হুমায়ুনের পরে যে সিংহাসনে বসল, সে সত্যিই কচি খোকা রাজকুমার, আকবর । উনিও যুদ্ধু করতে ভালোবাসতেন, আমারাও শুকনো মাংস সাপলাই করতে ভালোবাসতুম ।
আমি যে রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ফিরছি, সেই রাজকুমারের বাপ-ঠাকুর্দা চালাক-চতুর লোক ছিলেন, সিরাজের দলকে সমর্থন করেননি ; বিলেতের সায়েবদের পক্ষে ছিলেন, যেমন ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, যাকে সায়েবরা রাজা করে দিলে, রাজা নয় মহারাজা, আলিবর্দি খাঁ তাকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা দিতে পারেননি বলে, কিন্তু লোকটা ঘোড়েল, যেদিকে হাওয়া বয় সেই দিকে মুখের তত্বে বিশ্বাস করতেন ।
অন্য দেশে জামশেদজি টাটা, ঘনশ্যামদাস বিড়লা, ধিরুভাই আমবানি, আজিম প্রেমজি, নারায়ণ কৃষ্ণমূর্তি, রাহুল বাজাজ, ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ, পালোনজি মিস্ত্রি, ইন্দু জৈন, কস্তুরভাই লালভাই, জামশেতজি জিজিভয়, টি ভি সুন্দরম আইয়ার, নবীন জিন্দল, অজিত গুলাবচাঁদ, আনন্দ মহেন্দ্র, অজয় পিরামল, আরদেশির গোদরেজ, বি এল মুঞ্জল, জি আর গোপীনাথ, কিরণ মজুমদার শা, এল আর কিরলোসকর, শিব নাদার, ভেনুগোপাল ধুতদের মতন ধনী পাঁয়তাড়া-বিশেষজ্ঞ জন্মেছেন , অথচ রাজকুমারের পর, আমার এই-ওই জন্মে আমাদের দেশে কেউই অমন হতে পারল না ।
রাজকুমার বিশ্বাস করতেন ইউরোপীয় বৌদ্ধিক প্রগতিতে, সময়ের সামাজিক প্রগতিতে, যুক্তিবাদী বিচার বিবেচনা আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে পাওয়া মুক্তিতে, ইতিহাসের এমন এক গতিতে যার গড়াগ্গড় রাস্তা হলো মানব কল্যাণমুখী । গোঁড়া হিন্দু বাঙালির মামদোবাজি থেকে সমাজকে ছাড়িয়ে এনে আরও তাড়াতাড়ি বাঙালির জীবনে যুক্তি আর বিচারবুদ্ধির ভূমিকাকে গূরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন উনি, কিন্তু সেই জন্যে সকলেই ওনাকে ইউরোপের নকলনবীশ বলে দুষতে লাগলো । বিলেতে গিয়ে ইউরোপীয়দের এমন তারিফ করলেন যে সে খবর পেয়ে সুতানুটি-গোবিন্দপুরের হিন্দু নেতারা খাপ্পা ।
রাজকুমার কি কখনও বিষাদে ভুগেছেন ? নাহ, কক্ষোনো নয় ।
হ্যাম, টেণ্ডারলয়েন, ফিলেটো, কোপা, বোস্টন বাট, হকস, চপস, রিবটিপ, জোল, বেকন, স্পাটা, টেস্টা কিংবা সালামির সঙ্গে দুপেগ সিঙ্গল মল্টে বিষাদ ছাক্কাস।
হায়, কম বয়সেই মারা গেলেন রাজকুমার ।
রাজকুমার পড়ে যেতে পারলেন না ওনার জগৎবিখ্যাত নাতির এই লেখা, ‘সুবিচারের অধিকার’ শিরোনামে নাতি লিখেছিলেন, “মুসলমান ভ্রাতাদের প্রতি ইংরেজের স্তনে যদি ক্ষীরসঞ্চার হইয়া থাকে তবে তাহা আনন্দের বিষয়, কিন্তু ‘আমাদের’ প্রতি যদি কেবলই পিত্তসঞ্চার হইতে থাকে তাবে সে আনন্দ অকপটভাবে রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে।”
রাজকুমার পড়ে যেতে পারলেন না ওনার জগৎবিখ্যাত নাতির এই লেখা, ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ’ শিরোনামে নাতি লিখেছিলেন, “অতএব যদি মুসলমান মারে আর ‘আমরা’ পড়ে পড়ে মার খাই — তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু ‘আমাদের’ দুর্বলতা । আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও, ‘আমাদের’ নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে । ‘আমরা’ প্রতিবেশীদের কাছে আপিল করতে পারি, ‘তোমরা’ ক্রুর হোয়ো না, ‘তোমরা’ ভালো হও, নরহত্যার উপরে কোনো ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না — কিন্তু সে আপিল যে দুর্বলের কান্না।”
হায়, রাজকুমার পড়ে যেতে পারলেন না, সতেরো বছর বয়সে লেখা ‘দেবদাস’ উপন্যাসের লেখকের জ্ঞানবাক্যি, যা নিয়ে কতোবার যে সিনেমা হয়েছে কতো ভারতীয় ভাষায়, দেবদাস সেজেছে ফণী শর্মা, প্রমথেশ বড়ুয়া, কে এল সায়গল, নাগেশ্বরা রাও, দিলিপ কুমার, হাবিব তালাশ, ঘাট্টামামেবি কৃষ্ণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বুলবুল আহমেদ, ভেনু নাগাভাল্লি, প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, শাহরুখ খান, অভয় দেওল, নাদিম শাহ, শাকিব খান, রাহুল ভাট, সেই লেখকের ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শিরোনামে এই মতামত, “হিন্দুস্তান হিন্দুর দেশ । সুতরাং এ-দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই । মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে, — এ দেশে তাহার চিত্ত নাই । যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কি, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে । আজ এই কথাটাই বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে এ কাজ শুধু হিন্দুর, — আর কাহারও নয় ।”
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না তাঁর প্রপৌত্রের আঁকা ভারতমাতা ।
তুই কী করে জানলি দেখিনি ? আমি তো আগাম দাঙ্গাও দেখে ফেলেছি ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না তাঁর ছেলের অতিবামুন কাল্টের নিরাকার পরমব্রহ্ম কেমন করে ছবি আঁকার পৌত্তলিকতায় পৌঁছে গিয়েছিল ।
তুই জানিস না, আমি তখনই জানতুম, কোথাকার ঠাকুর-দেবতা কোথায় পৌঁছোবে ।
হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
আমি : আরও তিন মাস, রাজকুমার ।
রাজকুমার আমায় বলেছিলেন যে, আমবাগানে পড়াশুনা শেখাবার বদলে, দোলখেলার নাচানাচির বদলে, বাউলদের ছিলিমটানা হইচইয়ের বদলে, একটা ইন্সটিউট অফ টেকনোলজি খোলার ইচ্ছে ছিল তাঁর, উনি বেঁচে থাকলে তা-ই করতেন, ওনার অতিবামুন কাল্টগুরু হবার আদেখলাপনা ছিল না ; জমিদারি আর ব্যবসা অবহেলা করে ওনার ছেলে অতিবামুন কাল্টগুরু হয়ে গিয়েছিল বলে রাজকুমার মারা যাবার আগের বছর, ১৯৪৫ সালের মে মাসে কড়া চিঠি লিখেছিলেন তাকে, মনে আছে আমার :
“আই হ্যাভ দিস মোমেন্ট রিসিভড ইয়োর লেটার অফ ৮থ এপ্রিল অ্যাণ্ড কোয়াইট ভেক্সড উইথ দি নেগলিজেন্স শোন বোথ অন দি পার্ট অফ রাজা বরদাকান্ত অ্যাণ্ড ইয়োর ওন মোক্তারস অ্যাবাউট দি সেল অফ শাহুশ তালুক । অ্যাজ ফর দি ফরমার, হি ডাজ নট কেয়ার এ পাইস অ্যাবাউট হিজ ওন অ্যাফেয়ার্স — বাট হাউ ইয়োর সারভেন্টস ক্যান শেমফুলি নেগলেক্ট টু রিপোর্ট দিজ ম্যাটার্স ইজ সারপ্রাইজিং টু মি । অল দ্যাট আই হ্যাভ হিদারটু হার্ড ফ্রম আদার কোয়ার্টার্স, অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ হোয়াট মিস্টার গর্ডন হ্যাজ রিটন টু মি অ্যাবাউট ইয়োর আমলাজ নাউ কনভিনসেস মি অফ দি ট্রুথ অফ দেয়ার রিপোর্টস । ইট ইজ ওনলি এ সোর্স অফ ওয়ানডার দ্যাট অল মাই এসটেটস আর নট রুইনড । ইয়োর টাইম, আই অ্যাম শিওর, বিইং মোর টেকন আপ ইন রাইটিং ফর নিউজপেপার্স অ্যাণ্ড ইন ফাইটিং উইথ দি মিশনারিজ দ্যান ইন ওয়াচিং ওভার অ্যাণ্ড প্রোটেক্টিং দি ইমপরট্যান্ট ম্যাটার্স হুইচ ইউ লিভ ইন দি হ্যাণ্ডস অফ ইয়োর ফেভারিট আমলাজ — ইনস্টেড অফ অ্যাটেণ্ডিং দেম ইয়োরসেল্ফ ভিজিল্যান্টলি ।”
হাবশিকে বলছিলুম, ও বুঝুক বা না বুঝুক, জানিস, রাজকুমার বলেছিলেন, বুঝলি হুলি, ধনী হবার চেষ্টা করবি, পয়সাঅলা হবার চেষ্টা করবি, বৈভবশালী হবার চেষ্টা করবি, ব্যবসাদার হবার চেষ্টা করবি, কারখানা খোলার চেষ্টা করবি । অতিবামুন হবার চেষ্টা করিসনি, জাতধর্ম যাক চুলোয় । ধর্ম নিয়ে এতো ঢাকঢোল পেটাবারই বা কী দরকার ।
উড়ুক্কু মাছ দুটো লাফিয়ে উঠে বললে, গুড ফিলোজফি, বাট বেঙ্গলিজ লাভ হোয়াইট কলার জবস ।
রাজকুমারকে যদি সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ইংরেজরা, যারা নেটিভদের ভালো চোখে দেখতো না, আর বাড়ির লোকেরা, জলচল বন্ধ করে একঘরে না করতো, তাহলে উনিও ধিরুভাই আম্বানি হতে পারতেন, এমনকি ওদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকতে পারতেন, ধিরুভাই আম্বানিও তো আরবদেশে ভুঁড়িকাঁপানো মেয়েদের নাচ দেখতো। তবে রাজকুমারের দোষ ছিল যে উনি কারখানা বসাবার চেয়ে সবকিছু কেনা আর বেচায় এতো জড়িয়ে পড়েছিলেন যে পরে গিঁট খুলে বেরোতে পারেননি, নয়তো রানিগঞ্জ থেকে কলকাতা, বর্ধমান থেকে হাওড়া পর্যন্ত রেল লাইন উনিই বসিয়ে দিতেন ।
ধিরুভাইয়ের বিরাট কারখানা কেমন খেপে-খেপে বিদেশ থেকে লুকিয়ে আনা হয়েছিল তা কি আর আমি জানি না, সকলেই জানে, ওনার মা, ছেলেরা, গাঁয়ের লোকেরা, দিল্লির নেতারা, কিন্তু কই ওনার কাগজপত্র তো ওনার নাতিরা পুড়িয়ে দেয়নি, উল্টে ওনার বড়ো ছেলে বড়োলোকদের মধ্যে সবচেয়ে বড়োলোক হয়ে গেল । সেই কারখানা বসানোর তিকড়মবাজি নিয়ে সিনেমাও হলো, ওনাদের কিন্তু কেউ কমপ্রাডর বলে টিটকিরি মারে না, তার কারণ যারা টিটকিরি মারতো তারা আজ ভিখিরি । এক নৌকরি দে দে ও বাবু, ভগবান তেরা ভলা করেগা, ভিক্ষে করে মরে ।
বড়োলোক হতে হলে যা দরকার রাজকুমারের চরিত্রে কাজকম্মে সবই ছিল, বাধ সাধলো ওনার আশেপাশের বাঙালিরা আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হিংসুটে সায়েবরা ।
বাংলার ইতিহাসে রাজকুমার ছিলেন প্রথম প্রেমিকবয় ।
উনি যে মারা গেলেন সে খবর অব্দি কলকাতায়, পৌঁছোয়নি, তখন তো আর পাবলিকের জন্যে টেলিগ্রাফ ছিল না, ফোনও ছিল না, চিঠি পৌঁছোতেই তিন মাস লাগতো, বিলেতে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল, তা খুঁজে বের করতেই কতোকাল লেগে গিয়েছিল। কেমন বংশ রে বাবা ।
ওনার বাড়ির লোকে গঙ্গার ঘাটে কুশপুতুল জ্বালিয়ে অন্ত্যেষ্টি করলে, এখন ওনার হৃৎপিণ্ড নিয়ে যাচ্ছি আসল শ্রাদ্ধের জন্যে, জানি না কী করবে বাড়ির লোকে, হয়তো লুকিয়ে ফেলবে । অতিবামুন কাল্টের তো নতুন হুজুগ জেগেছে, সব ঠাকুরদেবতাকে এক জায়গায় জড়ো করে তাদের হাপিশ করে ফেলে সেই ফাঁকা জায়গাটাকে পুজো করা, নিরাকার গোল্লাছুট যাকে বলে ।
নেইকে পুজো করা আর নেইকে পুজো না করার মধ্যে তফাত আছে কোনো ? বলুন দিকি ।
রাজকুমার যখন সুতানুটি-গোবিন্দপুরের বাড়িতে থাকতেন তখন রোজ বাড়ির ঠাকুদেবতার ঘরে বসে কতোক্ষণ পুজো করতেন, তখন তাঁকে কেউ ডাকতে পারতো না, লোকে দেখা করতে এলেও দু’ঘণ্টা বসে থাকতে হতো । যারা নেইকে পুজো করতে লাগলো তারা ওনাকে কতো যে হ্যাটা করেছে তা ইয়ত্তা নেই ।
হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, ঠগীর একটা দল বাঘিনীর বাচ্চাদের সঙ্গে আমাকে জন্মাতে দেখে নিজেদের দলে নেবার জন্যে তক্কে তক্কে ছিল, তার কারণ আমার মাথার চুলের রঙ ছিল আগুনের মতন, বাঘিনী মায়ের কাছ থেকে পাওয়া । একদিন ওদের দলটা আমাকে কম্বল চাপা দিয়ে ধরে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করে জানতে চেয়েছিল যে ওরা সবাই তো ওদের মায়ের সামনে দিক থেকে জন্মেছে, তাহলে আমি কোন যাদুবলে বাঘিনীর পেছন দিক থেকে জন্মালুম ।
ঠগীর দল আরও অবাক হলো যখন দেখলো যে প্রতি বছর আমার বয়স চার বছর বেড়ে যায়, যার দরুণ আমি পাঁচ বছর বয়সে কুড়ি বছরের হয়ে গিসলুম । আঠেরো বছর বয়সে আমাকে শেখানো হলো কেমন করে সিল্কের হলদে রুমালে দুটো রুপোর সিক্কা বেঁধে পেছন দিক থেকে মানুষ খুন করতে হবে, একজন পা চেপে ধরবে, একজন মাথা মাটিতে চেপে ধরবে আর একজন গলায় ফাঁস দেবে ।
ঠগীজন্মের রুপোর টাকাগুলো যদি লুকিয়ে রাখতুম, তাহলে এই জন্মে বিলেত আমেরিকার নিলামঅলাদের দিয়ে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতুম ।
আমাদের ঠগী সর্দারের মোহোল্লা আর লোকাল কমিটির ক্যাডাররা আশেপাশের গাঁয়েগঞ্জে লোক পাঠিয়ে খবর যোগাড় করতো, কোন পথ দিয়ে বানিয়ারা তীর্থযাত্রীরা যাবে, কখন যাবে, আর সেই খবর অনুযায়ী আমরা রাস্তার ধারে লুকিয়ে ওৎ পেতে থাকতুম, এখন যেমন মাওবাদীরা পুলিশ মারার জন্যে রাইফেল হাতে লুকিয়ে থাকে আর দনাদ্দন গুলি ছোঁড়ে । পাশের রাষ্ট্রের ছোঁড়ারা যেমন এদেশে কয়েকজনের ঘুমন্ত গোষ্ঠী তৈরি করে বোমা মারার জন্য প্যাঁচ কষে, তেমনি আমরা তিনজন ঠগীর ক্যাডার তৈরি করে তক্কে তক্কে থাকতুম ।
আমাদের ঠগী দলটা এক রাতে স্লিম্যান নামে একজন সাহেবের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে গেলুম । সকলের সঙ্গে আমারও ফাঁসি হয়েছিল, কিন্তু আমি যখন বললুম যে আমাকে কোনো বাঘের খাঁচায় হাতপা বেঁধে ফেলে দেয়া হোক তখন সাহেবরা তাই করেছিল । দুটো বাঘ আমাকে কেমন করে খাচ্ছে দেখার জন্য সাহেব মেমরা ঝিলমিলে চকরাবকরা পোশাক, পালকদেয়া রঙিন টুপি পরে সকাল থেকে জড়ো হয়েছিল । তাদের অমন জড়ো হতে দেখে পরে গোবিন্দপুরের বাইরে একটা চিড়িয়াখানা খোলা হয়েছিল, যেখানে শাদা চামড়ার সাহেব-মেমরা যেতো, পরে বাদামি চামড়ার সাহেব-মেমরা, আরও পরে ধুতি-শাড়ি শার্ট-প্যান্ট পরা দেশি পাবলিকরা, এতো পাবলিক হতে লাগলো যে তাদের তিতকুটে ঘামের গন্ধে চিড়িয়াখানার মাটি থেকে সব ঘাস লোপাট হয়ে গেল ।
ঠগীর দলে প্রথম দিন ছিল আমার খুনোখুনি-লুটপাটের শিক্ষানবিশির, তাই রাস্তার ধারে জঙ্গলের আড়ালে ওৎ পেতে তীর্থযাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি খুন করিনি । যারা খুন করলো তারা তীর্থযাত্রীদের টাকাকড়ি সোনাদানা কেড়ে নিয়ে মরা লোকগুলোর পেছন দিক দিয়ে আর মরা মেয়েমানুষদের সামনে দিক দিয়ে ঝর্ণাপতন খেলা খেললো, তারপর তাদের হাড়গোড় ভেঙে আগে থাকতে খুঁড়ে রাখা গর্তে কবর দিয়ে দিলে, তার ওপর এক বস্তা পাথুরে নুন ।
আমরা ঠগীরা পয়দা হয়েছিলুম মা-ভবানী, মানে মা কালীর ঘাম থেকে । দেবীমূর্তিই তিরিশ ইঞ্চির সিল্কের রুমালে বাঁধা সিক্কা দিয়েছিলেন ।
শিখে যাবার পর আমি শুধু মেয়েমানুষদের খুন করতুম, সে তার বয়স যতোই হোক, ওই পেছন দিক দিয়ে আমি কিছু করতে পারতুম না, কেননা আমি বাঘিনী মায়ের পেছন দিক দিয়ে জন্মেছিলুম, দলের ঠগী ক্যাডাররা বলতো যে মেয়েমানুষদের ছেড়ে দেয়া উচিত, খুন করা তো এক্কেবারে অনুচিত, আর খুনের পরে সামনে দিয়ে ঝর্ণাপতন খেলা নোংরামির চূড়ান্ত । আমি বলতুম যে ঠগী কভাডারই যখন হয়েছি, তখন আবার নোংরামি নিয়ে ভাববো কেন, যতো রকমের নোংরামি হয় চালিয়ে যাবো ।
এখনকার দিনের ঠগীরা এই ধরনের খেলা ট্যাক্সিতে, বাসে, আড়ালে করে বেড়ায়, লুকিয়ে নয়, খোলাখুলি, বুক ফুলিয়ে । যে যতো নোংরামি করতে পারে, তার ততো বেশি ফোটো কাগজে ছাপা হয়, টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়, টেলিভিশনে দেখানো আর কাগজে ছাপা হবে জেনে তারা ছ্যাদলাপড়া দাঁত বের করে হাসে ।
এই যে লুট শব্দটা ইংরেজিতেও তিনশো বছর যাবত চালু, শব্দটা তো আমরা, ঠগী ক্যাডাররাই, ইংরেজদের দিয়েছিলুম । ওরা কোনো শব্দ চুরি করতে কুন্ঠিত হয় না, যেমন কুন্ঠিত হয় না অন্য দেশের মালপত্তর হাতাতে। একে ওরা বলে ইউরোপিয় মূল্যবোধ ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না, গরিবের টাকা লোটার লুচ্চাদের ।
তুই জানিস না, আমি আগাম দেখে যেতে পেরেছি, আর এরাই কিনা আমায় বদনাম করে দিয়েছিল।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না, বাড়ির চালে আগুন লাগিয়ে সর্বস্ব লোটার লাফাঙ্গাদের ।
তুই জানিস না, চোখ বুজে আমি জ্বলন্ত খেত-খামার আর চালাবাড়ি দেখেছি ।
এক বছরে চার বছর করে বাড়তে থাকার দরুন ষোলো বছর বয়সে আমার চৌষট্টি বছর বয়স হয়ে গেলে আমাকে সবাই মিলে ঠগীদলের হাইকমাণ্ড-পলিট ব্যুরোর নেতা করে দিলে, লুটপাটের সোনাদানা টাকাকড়ি আমিই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতুম । হুলিঠগী নামে আমি বিখ্যাত হয়ে উঠলুম, গাঁয়ে-গাঁয়ে আমার নাম নৈরাজ্যের নাট্যকার হিসাবে ছড়িয়ে পড়েছিল । আমার ভয়ে রাতের দিকে মানুষ দলবেঁধেও বেরোতো না ।
হুলিঠগীর মা-ভবানী নামে যে কালীবাড়িতে বউরা পাকা তাল আর মুলো নিয়ে আজকাল পুজো দিতে যায়, সেই মন্দির আমিই প্রতিষ্ঠা করেছিলুম, লুটের টাকায় । লুটের টাকা না হলে মানুষ কিছুই প্রতিষ্ঠা করতে পারে না । প্রতিষ্ঠান মানেই লোটালুটির কারবার ।
এখন বুদ্ধিমান পাঁয়তাড়াবাজরা পনজি-স্কিম নামে লুটের টাকা যোগাড়ের খেলা আরম্ভ করেছে, অনেকে সেই খেলা খেলতে গিয়ে ল্যাংটো পোঁদে বাড়ি ফিরেছে, অনেকে আত্মহত্যা করে নিয়েছে, কিন্তু লুটের টাকা সেই যে একবার ওরা হাতিয়ে নিলে, তারপর সেসব টাকাকড়ি যে কোথায় ডানা মেলে উড়ুক্কু মাছ হয়ে গেল কেউই জানতে পারলে না । মূর্খগুলো ভাবলোই বা কী করে যে টাকা খাটিয়ে হুশহুশিয়ে ডবল করা যায় ! টাকার কি মানুষের মতন ফিবছর বাচ্চা হয় !
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললে, বাঙালি আর বাঙালি নেই, মহামূর্খের কৌম হয়ে গেছে ।
আমার নাম হুলি, এখন আমি জাতে শুদ্দুর, না চণ্ডাল-শুদ্দুর নয়, গন্ধবেনে, আড়কাঠির লোকেরা মা-বাপকে পালতোলা জাহাজে চাপিয়ে কালাপানি পেরিয়ে আখকাটার জন্যে ভিনদেশে নিয়ে চলে গিয়েছিল, আমি তখন ঝুপড়িতে ছিলুম না, খোসা ছাড়িয়ে বস্তায় পোস্ত ভরছিলুম, আফিম চাষ না হলে বাঙালি কি আর পোস্ত খেতে শিখতো, অ্যাঁ ?
বাঙালিরা পোস্ত খেতে ভালোবাসে, আলুপোস্ত, পেঁয়াজ পোস্ত, ধুঁধুল পোস্ত, কাঁচা পোস্তবাটা সর্ষের তেল মেখে, পোস্তর বড়া, সেই থেকে আমি রাজকুমারের বাড়ির চাকর, আসলে রাজকুমারের খাস-চাকর, ওনার আফিম কারখানায় কাজ করতো বাবা আর মা, কারখানা মানে অনেক উঁচু ছাদের ঘরে আফিমের বস্তা সাজিয়ে রাখা, আমিও খাটতুম, কিন্তু বেগার, আমার চোখ কটা বলে ছোটোবেলা থেকে আমার নাম হুলি।
কোম্পানি পাঁচ হাজার চাষিকে দিয়ে আফিম চাষ করাতো, আফিমের হিসেব রাখা, রপ্তানি করা, রপ্তানির খরচ-খতিয়ান লেখা, এই সবের জন্যে কোম্পানি অঢেল কেরানি, হিসেবের খাতা লেখার লোক আর ছড়িদারদের চাকরি দিয়েছিল। দিকে দিকে গজিয়ে উঠল বাঙালি কেরানির দল, বাবুর দল, তারা ভদ্দরলোক হবার চেষ্টা করে করে হেদিয়ে কাঁকুড় হয়ে গেল, কিন্তু বাংলাদেশে কেরানির পাল পয়দা করে গেল, সরকারি চাকরির জাঁতিকল পেতে যেতে পারলো ।
রাজকুমারের সঙ্গে আমিও কালাপানি পেরিয়ে পালতোলা ক্লিপার জাহাজে চেপে বিলেতে গেছি, পরপর দু’বার, আমি শুদ্দুর বলে কালাপানি পেরিয়ে জাত যায়নি, কিন্তু রাজকুমারের জাত চলে গিয়েছিল, যখন প্রথমবার গেলেন, ফেরার পর গঙ্গাজলে চান করিয়ে কুলীন পুরুত ডাকিয়ে নিজের জাতে ফিরেছিলেন, তা সত্ত্বেও ওনার ভারিভরকম বউ আলাদা ঘরে থাকতেন-শুতেন, ফলে রাজকুমার বিলেতে গিয়ে আশ মেটাতেন । জ্ঞানীগুণিরা রাজকুমারকে গ্রিস দেশের রাজা ক্রিসাসের সঙ্গে তুলনা করতেন, যিনি গ্রিসদেশের মানুষকে অনেক কালের জন্যে বড়োলোক করে তুলেছিলেন ।
রাজকুমারের কাজকারবারের দরুনই তো সুতানুটি-গোবিন্দপুর আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠল, দেখা দিলো অন্য রকমের মানসিক জীবন । শহুরে জটিলতার হ্যাঙ্গামের সঙ্গে নিয়মানুবর্তীতা, হিসাবনিকাশ, নিখুঁত হবার চেষ্টাচরিত্তির । বাঙালির, যে বাঙালি তখন বাঙালি হিসেবে গড়ে উঠছিল, তার গঠন-বিগঠনের গলনপাত্র হয়ে উঠল সুতানুটি-গোবিন্দপুর । গাঁগেরাম থেকে জনে জনে মানুষ এসে জড়ো হতে লাগলো, যারা একে আরেকজনকে চেনে না, বোকা-হাবার মতন তারা দিন আনি দিন খাইতে চরকিনাচন দিতে লাগলো ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না তাঁরই অবদান হিসাবে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে তাৎপর্য পেয়েছে জেলখানার গিজগিজে ডিগডিগে বিচারাধীন কয়েদি , থানার পেটমোটা ওসি যেন সাত মাসের অন্তঃসত্বা, চিনের রঙিন আলোয় ঝলমলে বেশ্যালয়, ভাটিখানার ঠেলাঠেলি, মল, মালটিপ্লেক্স, ডিসকো, নাইট ক্লাব, পাগলা গারদ, দেওয়ানি আর ফৌজদারি আদালতের চাকুরে বিচারক, মোক্তার, অপরাধী, পাগল, দ্রোহী, বিরোধী ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না শহর এখন সংঘাতক্ষেত্র ।
তুই কেমন করে জানলি, ক্লাইভের পোষা গুণ্ডারা তো দেখিয়েছিল, সেটাই রিপিট হতে থাকে, শুনিসনি নাকি, হিস্ট্রি রপিটস ইটসেল্ফ ?
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না লাঠিবাজ ক্যাডারের দল, কে কাকে কেন পেটায় কেউই জানতে পারে না ।
তুই জানিস না, আমি যেসব লাঠিবাজ পুষতাম, এরা তাদেরই বংশধর, তারা ধুতি পরতো বা লুঙ্গি, এরা প্যাণ্টালুন পরে, এই যা তফাত ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না গাঁয়ে গঞ্জে শহরে বেকার ছেলেদের ক্লাব নামের অলস আড্ডাখানা, যেখানে তারা দিনভর ক্যারাম আর তাস খেলে ।
আমি জানি হুলি, দিনভর লোকে চণ্ডীমণ্ডপে বসে গ্যাঁজাতো, দাবা খেলতো, এরা তাদেরই চেলাচামুণ্ডা।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না অকর্মণ্য বুকনিবাজ দলনেতা, দলদাস, মন্ত্রী, আমলা, ট্রেড ইউনিয়ান, কেরানি ইউনিয়ান নেতাদের ।
দেখেছি, দেখেছি, হিন্দুদের নেতারা আমার বিরুদ্ধে কতো বদনাম দিয়ে বেড়াতো, সেই তাদেরই তো রক্ত বইছে এখনকার বুকনিবাজদের শিরায়, আর তুই বলছিস আমি দেখে যেতে পারলুম না । আমার শবের বদলে কুশপুতুল পুড়িয়ে শ্রাদ্ধের সময়ে হিন্দুদের চাঁইরা কতো হ্যাঙ্গাম করেছিল ; ওদের কথা মানা হয়নি বলে ওরা একঘরে করে দিলে, আমার ছেলেরাও চটে-মটে হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে গেল, আর আমার ব্যবসাও লাটে উঠে গেলো ।
চিনে আফিম চালানের জন্যে রাজকুমারের দুটো ক্লিপার জাহাজ ছিল, একটার নাম এরিয়েল, সেই যে সিলভিয়া প্লাথ এরিয়েল নামে কবিতার বই ছাপিয়ে ছিলেন, তা তো রাজকুমারের কাছ থেকেই পাওয়া । সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে রাজকুমারের দেখা হয়নি, রাজকুমার অনেক আগেই জন্মেছিলেন তো । সিলভিয়া প্লাথের যেমন অকাল মৃত্যু হয়েছিল, তেমনই এরিয়েল জাহাজেরও অকাল মৃত্যু হয়েছিল, কেননা জাহাজটাকে চীন বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল, বিলেতি কোম্পানির ওসকানিতে, যারা রাজকুমারকে এক্কেবারে পছন্দ করতো না, এদিকে বাইরে-বাইরে দেখাতো কতোই না রাজকুমারকে ভালোবাসে ।
রাজকুমারের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কীই বা বলি, অন্য জাহাজটা, যার নাম ছিল ম্যাভিস, তার ওপর সমুদ্রে বাজ পড়ল একদিন, জাহাজ পুড়ে ছাই, বিলেতি কোম্পানিরা সে খবর পেয়ে মাগি-মরদের মদ গেলার আর আস্ত পোড়ানো শুয়োর খাবার আর নাচানাচির পার্টি দিয়েছিল । ওয়ান টু থ্রি ফোর, হোয়্যার ইজ দি পার্টি টুডে ? অন দিস ডান্স ফ্লোর, ঝিংকিচিকিং ঝিংকিচিকিং ঝিংকিচিকিং ।
রাজকুমারের বাড়িতে কেউই ওনাকে পছন্দ করতো না, অথচ ওনার টাকাতেই সবাই ফুটানি মারতো । এই যে রাজকুমারের এক ছেলের বারোটা বাচ্চা হলো, সাত ছেলে আর পাঁচ মেয়ে, তার খরচ যোগানো কি সোজা কথা, সেসব খরচের টাকা তো রাজকুমারের কাজকম্মো থেকেই আসতো, এখন খরচের মজাও নেবে আবার রোজগারের উপায়কে খারাপ ভাববে, এ কেমন ধারা কথা বাপু, অ্যাঁ । বারোটা বাচ্চা বিয়োতে বউটার যে কষ্ট হয়েছিল, তা কি রাজকুমারের বড়ো ছেলে অনুভব করতে পেরেছিল ? রাতে বিছানায় গেলেন, মশারি টাঙালেন আর ব্যাস, অ্যাঁ, কী মানুষ রে বাবা, ধন্যি মহাপুরুষ । দিনের বেলা সকাল থেকে নেই-ঠাকুরের পুজো ।
রাজকুমারের টাকাতেই তো একটা বাঙালি রাজবংশ গজিয়ে উঠলো ; রাজকুমারের দেখাদেখি নিজেদের নামে নাথ জুড়তে হলো ।
বাঙালি পাবলিক অবশ্য মনে করে যে ওনার এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা জরুরি ছিল, নয়তো বাঙালিরা নোবেল প্রাইজ পাবার গর্ব করতে পারতো না, নোবেলের মেডেল চুরি যাবার গর্ব করতে পারতো না, এই পার ওই পারের জাতীয় সঙ্গীতের গর্ব করতে পারতো না, যদিও ওই পারের দাড়িয়াল টুপিয়াল লোকেরা চোপোর দিন চেল্লাতে থাকে যে ওনার লেখা জিম্মি মালাউন জাতীয় সঙ্গীত চলবে না, কোনো পাকিস্তানিকে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত লেখাও । পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের শিরোনাম দিয়ে হুমায়ুন আজাদ নামে এক জ্ঞানীগুণী মানুষ একটা বই লিখেছিলেন, তার জন্যে তাঁকে রামদা-কাটারি মেরে-মেরে কোতল করলে সউদি আরবের বাঙালি চুটকিদাড়ি ট্যাংরাটুপি খিদমতগাররা ।
রাজকুমারের বড়ো ছেলে নিজের অতিবামুন কাল্টের জন্যে লিটল ম্যাগাজিন বের করা আরম্ভ করলে, বন্ধুবান্ধবদের জড়ো করে কফিহীন কফিহাউস তৈরি করলে, সবই তো রাজকুমারের টাকায় । সেই টাকাকে তোমরা ঘেন্না করোনি, অথচ রোজগারের উপায়কে ঘেন্না করলে । কী আর বলি, বড়োলোকদের ব্যাপার-স্যাপারই ভিতরঘুন্না। তবে তারপর থেকে লিটল ম্যাগাজিন বের করার আর অতিবামুনগোষ্ঠী হবার চল আরম্ভ হতে পেরেছিল । সবচেয়ে পেল্লাই যে অতিবামুনগোষ্ঠী গড়ে উঠল তা বিগ ম্যাগাজিন, দুর্গন্ধবনিকের দরিয়া।
রাজকুমারের পরিবারও বামুন, তবে উঁচু বামুন নয়, কায়েত আর বামুনের মাঝ-মদ্যিখানে, তবে বদ্যি নয় । ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্তয় বলেছে যে পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শুদ্র লোকেরা জন্মেছিল । যদি তাই হয় তাহলে পুরুষের মুখ থেকে বেরিয়ে কোথায় আটকে গিয়েছিলেন রাজকুমারের পরিবার যে খাঁটি বামুনের ছাতার তলা থেকে সরে গেলেন ।
রাজকুমারের এতো টাকাকড়ি থাকা সত্বেও বাড়ির ছেলে আর মেয়েকে খাঁটিমার্কা বামুনরা বিয়ে করতে চায়নি, রুপোর সিক্কার পুঁটলি দিতে চাইলেও তারা রাজি হয়নি, কনে সুন্দুরী হলেও চায় নি, তাই ওনার ছেলেপুলেরা বামুন থেকে অতিবামুন কাল্ট হয়ে গিয়েছিল ।
আসলে ওনাদের বাপঠাকুদ্দার কেউ একজন মোচোরমানের বাড়ির রান্নাঘরের মম গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলেন, তারা বোধহয় গোরুর শিককাবাব কিংবা দোপেয়াজা রাঁধছিল, রেগেমেগে রাজকুমার এখন বিদেশে গেলে অন্য মাংসও খান ।
আমিও খেয়েছি, খুবই ভালো খেতে, আহা বিলেতের গোলাপি শুয়োরের তো তুলনাই হয় না, জড়িয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, মাদি শুয়োরের গোলাপি থনে চুকুস-চুকুস করতে মন চায় । গোরুর মাংসের চেয়ে হাজার গুন সুস্বাদু, মোচোরমানরা তো শুয়োরের মাংস খায় না, হালাল করা যায় না বলে, কিন্তু হিন্দুর ঝটকাতেও শুয়োর মরে না, বিলেতে শুয়োরের মাংস পাঁঠার মাংসের চেয়েও মোলায়েম, মুখে দিলেই গলে যায়, কিন্তু গোরুর মাংস তো ছিবড়ে, অ্যাহ, বিটকেল, ভাবা যায় না ।
রাজকুমার গোরুর মাংস খান না, রুচিতে বাধে ।
আমি তো শুদ্দুর হুলি, আমাদের কোনো রুচি রয়েছে দেখলে বামুনরা চটে যায়, বামুন মানে জাতবামুন নয়, টাকাবামুন ।
ঢাকনা দেয়া ভেনিশিয়ান কাঁচের জারে ফরম্যালিনে চোবানো রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে আমি লণ্ডন থেকে পালতোলা জাহাজে চেপে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ফিরছি । ফরম্যালিন মানে একরকমের শরবত, তাতে মরা মানুষের হৃৎপিণ্ড বেঁচে ওঠে, শরবত খায় আর অনেককাল তাতে আয়েশ করে শুয়ে থাকে, সেই হৃৎপিণ্ড ইচ্ছে হলে কথা বলতে পারে, হাসতে পারে, গাইতে পারে, কাঁদতে পারে ।
ওই শরবতে মরা মানুষের যে-কোনো অঙ্গ চুবিয়ে রাখা যায় । এই জন্মে যদি বিয়ে করে সংসার পাতি, আমি মরে গেলে আমার ছেলেপুলেদের বলে যাবো যেন ওরা আমার দুই অণ্ডকোষ আর লিঙ্গখানা শরবতে চুবিয়ে রাখে, পছন্দ হলে পরের জন্মে এসে ওটাই ফিট করে নেবো, যদি আগামি জন্মেরটা মনের মতন না হয় ।
প্রথমবার গিসলুম ‘দি ইন্ডিয়া’ নামের ক্লিপার জাহাজে, তিনটে মাস্তুল । অনেক ঘুরে যেতে হয়েছিল, আফ্রিকার পোঁদের তলা দিয়ে কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে, আমার বেশ ভালোই লেগেছিল, তিন মাস জাহাজে কাটিয়েছিলুম, কতো দেশ দেখতে দেখতে গিয়েছিলুম, কালো হাবশি, শাদা চামড়ার লোক, নানা রঙের শাদা চামড়ার মেম । দেখলেই লোভ হতো । হাবশি মেয়েদের দেখেও আমার খুব লোভ হতো, ওদের পাছা আর বুক বেশ উঁচু-উঁচু, টাটকা, বুক খুলেই ঘুরে বেড়ায়, সুতানুটি-গোবিন্দপুরের শুদ্দুর বউদের মতন ঢিলেঢালা নয়, বউবাজারের সন্ধ্যাবাজারে যদি অমন হাবশি মেয়েদের আনতে পারতো, আহা, জীবন সার্থক হয়ে যেত গো ।
দ্বিতীয়বার রাজকুমারের সঙ্গে ‘বেন্টিঙ্ক’ নামের জাহাজে করে সুয়েজখাল পেরিয়ে বিলেতে গিসলুম, জাহাজখানা বিরাট, তাতে আশিজন যাত্রী ছিল আর রাজকুমারের ছোটো ছেলে , ভাগ্নে , ইংরেজ সচিব আর আমরা তিনজন চাকর, অন্য দুজন আমার চেয়ে বয়সে বড়ো। । সুয়েজ খাল তৈরি হবার দরুন যাওয়া-আসার সময় অনেক কমে গিসলো ।
মিশরে ইব্রাহিম পাশার অতিথি ছিলেন রাজকুমার, আমি তো ওনার খাস চাকর, ওনার আদর-যত্নের ভাগ আমিও পেইচি । পাশা ওনাকে লাল মখমলের পোশাক আর নিজের খচ্চরঘোড়া দিয়েছিলেন ঘুরেফিরে শহর-বাজার দেখার জন্য । পাশা ওনাকে শাহজাদা অফ বেঙ্গল বলে ডাকতেন ।
মিশর দেশটা যে এতো পুরোনো তা জানতুম না, মরুভূমির মাঝখানে কী বিরাট বিরাট তিনকোনা বাড়ি, যাকে ওরা বলছে পিরামিড, ওর ভেতরে নাকি আগেকার রাজা রাজড়াদের অনেক গল্প আছে, তাদের মলম মাখানো সোনায় মোড়া বাক্সবন্দী লাশ আছে, কতো যে গয়নাগাটি আছে তার ঠিকঠিকানা নেই, সেকালের মানুষদের শক্ত শক্ত ভাষায় গল্প লেখা আছে দেয়ালে-দেয়ালে । মরুভূমির মাঝখানে কেন যে এমন তিনকোনা বাড়ি বানিয়েছিল সেকালের রাজারা তার খোঁজ-খবর নিচ্ছে সায়েবের দলবল ।
মিশরের লোকেরা তাদের মন্দিরকে বলে মসজিদ, তার ভেতরে ঠাকুর-দেবতা নেই, রাজকুমারের ছেলে যেমনধারা পুজো করে এরাও তেমনি ধারা পুজো করে, কিন্তু হাঁটু মুড়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে সবাই মিলে কাতারে বসে পুজো করে, কোনো শুদ্দুর বামুন তফাত নেই । এখানে মরে গেলে কাউকেই পোড়ায় না, আমাদের দেশে নেড়েদের যেমন গোর দেয়া হয় এখানেও তাই । মেয়েদের দেখতে খুবই সুন্দর, জড়িয়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল, একজন স্বামী চারজন বউ রাখতে পারে, শুনে বড়ো ভালো লাগলো, চারজন বউই স্বামীর সঙ্গে থাকে, স্বামী মরলে বউদের কবরে পোঁতা হয় না । যারা অনেক বড়ো লোক, যেমন পাশা, বউ ছাড়া বাঁদিও রাখে, তাকে বলে হারেম, আমাদের দেশে সায়েবরা আসবার আগে নেড়ে সুলতানদের যেমন ছিল ।
মিশর থেকে আমরা গেলুম মাল্টা নামে একটা দ্বীপে, দিনকতক সেখানে থাকতে হল, আমাদের কারো ছোঁয়াচে রোগ আছে কিনা যাচাই করার জন্যে । দ্বীপটায় বিলেতের রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব, মন্দিরকে বলে চার্চ, ওদের ঠাকুর-দেবতাকেও দেখা যায় না, তবে ওরা মনে করে কুরুশকাঠে পেরেক-বেঁধা পোশাক-খোলা লোকটাই ভগবানের ছেলে । সেই দিক থেকে রক্ষে । ঠাকুর-দেবতাকে দেখতে না পেলে সে আবার কেমনতর পুজো ! যা নেই তাকে পুজো করার বদলে এখানকার সায়েবরা চার্চে একজনকে আছে নাম দিয়ে পুজো করে, তা সে পোশাক পরে না থাকলেই বা ।
মাল্টা দ্বীপ থেকে রাজকুমারের পুরো দল গেলুম ফরাসিদেশের বোর্দো নামে একটা জায়গায়, মদের উৎসব আরম্ভ হয়েছিল, এখানকার মদকে বলে ওয়াইন, রাজকুমার মদ খেতে ভালোবাসতেন, আর ওনার যে কোম্পানি ছিল, সেই সিটি কোম্পানি তো সুতানুটি-গোবিন্দপুরে, মায় তার বাইরেও, যেখানে-যেখানে সাহেব-মেমরা বাসা বেঁধেছিল, সেখানেও মদ বিক্রি করতো । মদ খেয়ে মেমরা এতো হাসতো যে তাদের ঠোঁটের হাসি খাবার ইচ্ছে হতো আমার, মনের ভেতরেই চেপে রাখতুম, যদ্দিন না রানি ভিক্টোরিয়ার মুনশির সঙ্গে আলাপ হলো ।
বোর্দো থেকে আমরা রাজকুমারের সঙ্গে গেলুম প্যারিস নামে একটা শহরে, দশদিন ছিলুম, সেখানের লোকগুলো কী বোকা, প্যারিসকে বলে পেয়ারি । মেমদের দেখতে কী সুন্দর কি বলব, তাই বোধহয় প্যারিসকে পেয়ারি বলে, কচি মেমগুলো যেন নরম তুলতুলে পুতুলের মতন, দেখলেই চটকাতে ইচ্ছে করে । যে কচি মেমরা রাজকুমারকে পছন্দ করতো, তারা রাত্তিরে ওনার হোটেলের ঘরে এসে ফুর্তি করতো, বিলিতি বাজনার তালে তালে ফরাসি নাচ নাচতো, কুঁচির থাক দেয়া ঘাগরা পরে । আমারও ইচ্ছে করত ফরসা মেমদের সঙ্গে ফুর্তি করার, রাজকুমারের দেয়া হাতখরচের টাকায় এখানকার বউবাজারে গিয়ে করতে পারতুম, কিন্তু আমি ওনার খাস চাকর বলে সাহসে কুলোয়নি, আর ভাষাও তো জানিনে, দরদস্তুর করতুম কেমন করে ।
অন্য দুজন চাকরের মধ্যে যাকে আমরা হরিখুড়ো বলতুম, ঘুরে এসেছিল পিগালে নামের পাড়ায়, ওই ঘোরার জন্যেই দেশে ফিরে নুনুর রোগ দেখা দিয়েছিল, সেই রোগের যন্তন্না থেকে ছাড়ান পেতে দলা-দলা আফিম খেতো, এসব কথা আমি হরিপদ খুড়োর খুড়িকে বলিনি কখনও, খুড়ি টের পেয়ে গিয়েছিল নিশ্চই, খুড়িকেও তো ওই রোগে ধরল, খুড়ো-খুড়ি দুজনে আফিমের দলা খে্যে ভোম মেরে পড়ে থাকতো ।
মানুষের আনন্দের পথে কেন যে রোগের লাইন টেনে দেয় ভগমান তা বুঝতে পারি না । ভগমানই আনন্দ তৈরি করেছে, আবার ভগমানই আনন্দের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, এ কেমন বিচার, অ্যাঁ !
রাজকুমারের সঙ্গে আমরা সবাই ১৮৪৬ সালের ১৮ই মার্চ লণ্ডনে পৌঁছেছিলুম । ওনার ছোটো ছেলের লণ্ডন আর সেখানকার আদবকায়দা একেবারেই পছন্দ হলো না । রাজকুমার আমায় বলেছিলেন, বেশ দুঃখ করে বলেছিলেন, পলকাটা মদের গেলাসে সোনালি রঙের মদে চুমুক দিতে দিতে, এরা বঙ্গদেশকে ডুবিয়ে দেবে, কিছুই শিখতে চায় না, বিলেতের লোকেরা কেমন দিকে দিকে কল-কারখানা বসিয়ে দেশটাকে সারা পৃথিবীর মালিক করে তুলছে, আর আমার নিজের রক্তই আমাকে বুঝতে পারলে না । ওরা আমিন, বানিয়ান, সেরেস্তাদার, বানিয়া, মুৎসুদ্দি কথাগুলোকে খারাপ মনে করে, ঘরের খেয়ে মিছিল দিয়ে রাস্তা জ্যাম করবে, আর নিজেদের ভদ্রলোক ছাপ্পা মেরে বারফট্টাই দেখাবে, দেখে নিস তুই, একদিন ভদ্দরলোক নামের প্লেগ ছড়িয়ে পড়বে দেশময়, কেরানি হবার জন্যে মানুষ হত্যে দিয়ে কালীঘাটের কালীর দোরে পড়ে থাকবে ।
লণ্ডনে রাজকুমার রোজই খানাপিনার ব্যবস্হা করতেন, কিংবা অন্য বড়োলোক সাহেবরা ওনার জন্যে খানাপিনার ব্যবস্হা করতো । রাজকুমার যে কেন মদ খেতে এতো ভালোবাসতেন কে জানে, বরং আমাদের মতন আফিম আর তাড়ি খেলে ওনার স্বাস্হ্য ভালো থাকতো । শুধু তো মদ খাওয়া নয়, কচি সুইটহার্ট মেমদের নিয়ে আমোদ করতেন, সারারাত মেতে থাকতেন আমোদে, মেমগুলোরও লজ্জা শরম ছিল না, এমন পোশাক পরতো যে অনেক কিছুই দেখা যেতো, আমার মতন হেলাফেলার চাকরেরও পুঁইমেটুলি দেখে শরীর চিনচিন চিনচিন করতো, চাকরদের চানের ঘরে গিয়ে চিনচিন কমাতে হতো ।
৩০ জুন ডাচেস অফ ইনভেরনেসের প্রাসাদে রাতের খাবারের নেমন্তন্নয় খাবার টেবিলে বসে হঠাৎই রাজকুমারের তেড়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো । ওই অসুখেই উনি পয়লা আগস্ট মারা গেলেন, মাত্র একান্ন বছর বয়সে। আমার আর হরি খুড়োর কাঁদতে কাঁদতে গলা বুজে গিয়েছিল ।
কলকাতায় লোক মুখে খবর পাঠানো হয়েছিল, সে খবর পৌঁছোলো আড়াই মাস পরে । ইতিমধ্যে ওনার অন্ত্যেষ্টিতে কী করা হবে কেউ ঠিক করতে পারল না বলে কবর দেয়া হলো ; একজন হিন্দুকে গোর দিয়ে দেয়া হলো, এতো বড়ো একজন মানুষ, লাখ লাখ টাকার মালিক, তাকে মুখে আগুন দেবার লোক পাওয়া গেল না । হাসপাতালের বিছানায় উনি যদি একবার বলতেন, হুলি, তুইই আমার মুখে আগুন দিবি, কেউ দিক বা না দিক, তাহলে আমিই দিতুম, হলেই বা শুদ্দুর ।
নিজের মা-বাপের মুখে আগুন তো দিতে পারিনি, কে তাদের মুখে আগুন দিয়েছিল তাও জানি না, গুজব আসতো যে যারা আড়কাঠির ফোসলানোয় বিদেশে আখখাটার মজুর হয়ে গেছে, তাদের সবাইকে ধরে-ধরে কেরেস্তান করে দিয়েছে সেখানকার পাদ্রিরা, মুখে আগুনের আর দরকার নেই, মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিলেই কাজ শেষ, মাটিতে মিশে ভালো সার হয়ে যাবে, আখকে আরও মিষ্টি করে তুলবে, সায়েবরা সেই মিষ্টি আখ থেকে চিনি তৈরি করে চায়ের কাপে চামচের টুঙটুঙি বাজাবে, জন্মদিনের কেকে চিনির আরক দিয়ে লিখবে,, হ্যাপি বার্থডে টু ড্যাডি রামু গাণ্ডুবনিক, হ্যাপি বার্থডে টু মাম্মি হরিমতি গাণ্ডুবনিক ।
রাজকুমারের গোর যেমন অনেককাল রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অচেনা পড়েছিল, তেমন ছিল ক্লাইভ নামে সাহেবটার, কেউ জানতোই না কোথায় তেনাকে গোর দেয়া হয়েছিল ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ভিড়, জঞ্জাল, জ্যাম, মারামারি, মিছিল, বিশৃঙ্খলা, হুমকি ।
তুই কেমন করে জানলি যে আমি জানি না, আমি সবই আগাম দেখতে পাই ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না মোটর সাইকেলে চেপে মাঝরাতে কোটিপতি-বাড়ির যুবকদের হার ছিনতাই দল ।
জানি হুলি জানি, তোকে আর আপশোষ করতে হবে না ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ ।
জানি হুলি জানি, ওরা তো আমার পোষা লাঠিয়ালদেরই ছেলেপুলে ।
এখন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড যত্নকরে সামলে দেশে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাকেই দেয়া হয়েছে, ওনার তিনজন চাকরের মধ্যে আমাকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন উনি । আমি সব সময় নজর রাখছি যাতে সমুদ্রের ঢেউয়ে ফরম্যালিন শরবত চলকে না ওঠে, যাতে গোলাপি প্রজাপতির মতন হৃৎপিণ্ডের কষ্ট না হয় ।
জাহাজে একদিন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড আমাকে ডেকে বললেন যে একা-একা ভাল্লাগছে না, তাই একটু গল্প করতে চান । আমি তো থ । কোথায় আমার মালিক একজন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড, আর কোথায় আমি গৃহস্বামীর পরিবারের থাকা-খাওয়ার ছোকরা চাকর যাকে ওনারা বলেন ভৃত্য, কীই বা গল্প করব রাজকুমারের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে, রাজকুমার সামনে থাকলে না হয় তাঁর পায়ের কাছে বসে ওনার নানা দেশ ঘোরার গল্প শুনতুম, মোজরি জুতো খুলে পা টিপে দিতুম, সব দেশে তো আমি সঙ্গে যাইনি ।
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললেন, জানি তুই আমাকে মনে-মনে হৃৎপিণ্ড বলছিস, কিন্তু হুলি, তুই তো আমার খাস-চাকর, বিশ্বাস কর, এটা আমার হৃদয়, হৃৎপিণ্ড আর হৃদয়ের তফাত জানিস তো ।
আমি গলার ভেতরে জমে থাকা কুয়াশা সরিয়ে বললুম, মাফ করবেন হুজুর, আপনি তো আপনার মাথার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তবে হৃদয় কেটে নিয়ে যাচ্ছি কেন আমরা ?
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললেন, দ্যাখ, লোকে সামনাসামনি আমাকে যাই বলুক না কেন, তুই তো জানিস আড়ালে ওরা আমাকে বানিয়ান, মুৎসুদ্দি, মহাজনি সুদখোর, আবগারি ঘুষখোর, বউবাজারের বাড়িগুলোর মালিক, আফিমচাষি, কোম্পানির দালাল এইসব কথা বলে বেড়ায় ।
আমি ভেবে পেলুম না কী বলি, আমরা চাকররা তো এসব কথা আলোচনা করি না, করার সময় পাই না, তবু বললুম, ওরা বলুকগে, ওদের সংসারে যারা জন্মাবে তারা এইসব কাজ একেবারে ভুলে গিয়ে দেশটাকে ডোবাবে, বিলেতের লোকেদের তো দেখলুম, সকলেই বানিয়াগিরি করে কিংবা করতে চায় ।
রাজকুমারের হৃদয় বললে, তুই তো জানিস, হরিমোহনের ছেলে উমানন্দ, ওই যার আরেকটা নাম নন্দলাল, বলে বেড়িয়েছিল যে যৌবনের গরমে, টাকাকড়ি, ক্ষমতা-প্রতিপত্তির জোরে, আমি নাকি কুসঙ্গে পড়ে ধর্ম আর জনমতকে ভয় পাই না, টিকি কেটে ফেলে দিয়েছি, পৈতে ফেলে দিয়েছি, মদ খাই আর মুসলমান মেয়েদের সঙ্গে শুই, মুসলমানের হাতের রান্না খাই ।
আমি বললুম, হুজুর, আপনি যে মদ ইচ্ছে খাবেন, যার সঙ্গে ইচ্ছে শোবেন, তাতে অন্যলোকের মাথাব্যথা কেন হয় ? আপনার মুসলমান বাবুর্চি এতোভালো রাঁধে, যা বেঁচেখুচে থাকে, তা খেয়ে দেখেছি, আহা, মন ভরে যায় । আর কুসঙ্গ মানে তো চোগা-চাপকান পরা আপনার জমিদার বন্ধুরা ।
জাহাজের ক্যাপ্টেনের দেয়া মদ খেয়ে আমার গলায় লাল রঙের মেঘ জমে আছে, ঘড়ঘড়ানির দরুন টের পেলুম । আর সবাই যাবার সময়ে আর আসার সময়েও ঢেউ সামলাতে না পেরে বমি করেছিল, আমি করিনি, বরং নীল সমুদ্র আমার খুবই পছন্দ হচ্ছিল, দূর-দূর পর্যন্ত কিচ্ছু দেখা যায় না, দেখা পাওয়া যায় না বলেই আরও ভালো লেগেছিল ।
সমুদ্রে মাঝে মাঝে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক, তিমি মাছেদের ঘাই দেখতে দেখতে যেতুম ।
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললে, উনি বন্ধু নয় রে, ওই চোগা-চাপকান পরা জমিদার আমার পথদেখানোর লোক ছিলেন ; তবে ওনার দেখানো পথে চলতে গিয়ে আমার বড়ো ছেলেটা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে ।
পরের জন্মে তো দেখেছি রাজকুমারের নিজের একজন নাতি বানিয়াগিরি-জমিদারি ভুলে গিয়ে পদ্য লিখে আর গান গেয়ে বাঙালি জাতটাকে ক্যাবলা করে দিলে, কতো লোকে চট দিয়ে ওনার নকল দাড়ি তৈরি করে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখে, যাতে ছেলেপুলেরা ক্যাবলা-টাইপ হয় । হয়তো সেই কারণেই চটকলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেল, সায়েবদের থেকে কিনে নিয়ে মেড়োপার্টিরা চটের ফাটকা খেলে ডুবিয়ে দিলে ।
এখন সকলেই পদ্য লিখতে চায় আর গান গাইতে চায় । ছেলে-ছোকরারা যখন বিপ্লব আরম্ভ করলে তখনও পদ্য লেখা আর গান গাওয়া শুরু করলে, সেই সঙ্গে খুনোখুনি। ব্যাস দেশের দফারফা । সেসব নিয়ে সিনেমাও হয়েছে । যাক, বিপ্লব ফেল মারলেই বা, পদ্য আর সিনেমা তো পাওয়া গেছে ।
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড আমার মালিকের, যিনি পয়লা আগস্ট ১৮৪৬ লণ্ডনের সেইন্ট জর্জ হোটেলে একান্ন বছর বয়সে মারা গেলেন, আর ৫ আগস্ট তারিখে কেনসাল গ্রিন গোরস্তানে তাঁকে এলেবেলে সমাধি দেয়া হলো ; হিন্দু, খ্রিস্টান ব্রাহ্ম কোনো রীতিই মানা হয়নি ।
ওনার শব তো কলকাতায় পায়নি পরিবারের লোকেরা, তাই গঙ্গার ধারে একটা কুশপুতুল তৈরি করে ওনার নামে শ্রাদ্ধশ্রান্তি করেছে । তাও আবার হিন্দু বামুন আর অতিবামুন কাল্ট মিলে ঝগড়া বাধিয়ে ফেলেছিল, কোন মন্তর পড়া হবে, পিণ্ডদান করা হবে কি না, বড়ো ছেলে ন্যাড়া হবে কিনা । ছেলেরা তো বাপকে কেয়ারই করেনি কখনও, ওনাদের কথা না বলাই ভালো ।
সমাধি দেবার দু’মাস পরে কবর থেকে তুলে ওনার বুক থেকে হৃৎপিণ্ডখানা কেটে বের করে নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে অন্ত্যেষ্টি করতে চাইলেন আত্মীয়স্বজন ছেলেপুলেরা, তাই নিয়ে যাচ্ছি সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ।
প্রথমবার আসার সময়ে রাজকুমার নিজের সঙ্গে ইংরেজ ডাক্তার , ভাগনে , বাঙালি সহকারী , আমাকে নিয়ে তিনজন চাকর আর মুসলমান বাবুর্চি আসলাম মিয়াঁকে এনেছিলেন ।
ডাক্তার বলেছিল যে রাজকুমারের স্বাস্হ্য ভালোই আছে, চিন্তার কারণ নেই । সেবারও রাজকুমার রোজই নানা হোটেলে খানাপিনার আয়োজন করতেন, কতো কতো বিলিতি সাহেব-মেমরা আসতো, রাজকুমার অনেকের হাতে মুঠো-মুঠো হীরে-মুক্ত গুঁজে দিতেন ।
মেমদের দেখেছি, হাঘরে, আদেখলাপনার শেষ নেই, তারা ওনাকে দেখনদারি দিয়ে ভালোবাসতো, ঢলাঢলি করতো, জড়িয়ে ধরে, হাত ধরে হোটেলের ঘরে টেনে নিয়ে যেতো । একজন মেম তো রোজই আসতো রাজকুমারের কাছে, পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরতো । নিশ্চই কোনো ইংরেজ খোচর এই খবরগুলো সুতানুটি-গোবিন্দপুরে পৌঁছে দিয়েছে । বাঙালিরা তো কালাপানিতে জাত যাবার ভয়ে যায়না ।
যাক, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি থেকে খোচর হবার শিল্পখানা বাঙালিরা শিগগিরই আয়ত্ত করে ফেললে ।
রাজকুমার যেদিন মারা গেলেন, সেদিন এমন ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল যা আমি বিলেতে কেন, সুতানুটি-গোবিন্দপুরেও আগে কখনও দেখিনি ; আবদুল করিম, রানি ভিক্টোরিয়ার মুনশি, উনিও বলছিলেন যে ব্রিটেনে এসে পর্যন্ত এমন ঝড়বৃষ্টি দেখেননি ।
মুনশি আবদুল করিমের সঙ্গে আমার ভালো আলাপ-পরিচয় হয়ে গিয়েছিল, মুনশিজি যেচে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেই যেদিন রাজকুমারকে রাতের ভোজে ডেকেছিলেন রানি, তারিখটা মনে আছে, আট জুলাই, সে রাতেও প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিল, রানির মতন করে রাজকুমারও কাঁটা-চামচ-ছুরি দিয়ে মাংস কেটে-কেটে খেয়েছিলেন, ছাগলের মাংস নয়, অন্য কিছুর, বেশ ভালো গন্ধ বেরিয়েছিল । তার আগে রানির সঙ্গে একদিন রাজকুমার বিলেতের রাজা-রানিদের সেনাবাহিনীর সেলাম নিয়েছিলেন, ওদের পোশাক কেমন যেন বিটকেল, চোখ পর্যন্ত গোল টুপিতে ঢাকা, দেখতে পায় কেমন করে ভাবছিলুম ।
রানির পছন্দ হয়েছিল রাজকুমারকে, নিজের ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন, ‘ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকটি বেশ ভালো ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ।’
রানির মুনশিও বিশ্বাস করতে চায়নি যে আমি এর আগেও জন্মেছি, বলতো কাফেররা এরকম বিশ্বাস করে, তোরা মুরতাদ, তোরা মালাউন, তোরা জিম্মি, কাফেরদের তো জন্নতে যাবার নেই, আর কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করারও বালাই নেই। রানি ভিক্টোরিয়ার জন্যে দুজন চাকর এদেশ থেকে গিয়েছিল, অন্যজনের নাম মোহম্মদ বক্স, তার সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি, রানির খাস-আর্দালি বলে তার পোঁদে খুব তেল ছিল । আবদুল করিমের তো কোমরে তরোয়াল ঝুলতো, বুকে রানির দেয়া মেডেল ঝুলতো, মোহম্মদ বক্স অমন তোল্লাই পায়নি, তাই হয়তো খিটখিটে মেজাজের হয়ে গিয়েছিল ।
আবদুল করিম একটা গোপন খবর দিয়েছিল । রানি আর রাজবাড়ির সবাই নাকি জল দিয়ে ছোঁচায় না, পাতলা কাগজে পুঁছে নেয় । আবদুল করিম তাই রানির কাজ সেরে নিজের ঘরের চান করার ঘরে গরম জলে চান করে শুদ্ধ হয়ে নিতো, নইলে নামাজ পড়বে কেমন করে । শুদ্ধ হবার জন্যে পাশপকেটে ঢিলা কুলুপ রাখতো।
চাকরদের মুখ উঁচু করে তোলা অনুচিত, সব সময়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তবুও আমি রানিকে দেখেছিলুম, দেখতে ভালো নয়, বড্ডো মোটা, জানি না মুনশির কেন পছন্দ হয়েছিল, হয়তো রানি বলে, হয়তো শাদা চামড়া বলে, সোনাদানা পেতো বলে ।
যদিও রানির পরিবারের সবাই বলাবলি করতো যে মুনশির সঙ্গে ৬৮ বছরের রাণির একটা গোলমেলে সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে, নয়তো একজন আরেকজনকে অতো চিঠি লেখালিখি করবেই বা কেন, বালটিমোর, বাকিংহাম, বালমোরাল প্রাসাদের সোনালি গলিঘুঁজিতে রানির সাতহাতি ঘাঘরার কাপড় ধরে পেছন পেছন হাঁটবে কেন, মাঝরাত পর্যন্ত রানির ঘরে থাকবে কেন !
মুনশি আমায় বলেছিল যে রানিকে উর্দু হিন্দি আর ফারসিতে সড়গড় করে তোলার জন্যেই ও চিঠি লিখতো আর রানিও ওকে চিঠি লিখতেন । সেসব চিঠিপত্তর অবশ্য রানি মারা যেতেই রানির পরিবারের লোকেরা হাপিশ করে দিয়েছে । রানিকে পাঠানো একটা চিঠিতে মুনশি করিম যে দু লাইন কবিতা লিখেছিল, তা আমার এই জন্মেও মনে আছে, ও পড়ে শুনিয়েছিল আমায়,
মোহব্বত মেঁ নহিঁ হ্যায় ফর্ক জিনে অওর মরনে কা
উসি কো দেখ কর জিতে হ্যাঁয় জিস কাফির পে দম নিকলে
তবে মুনশি আবদুল করিমের যে কেন গনোরিয়া হয়েছিল তা আমি জানি, রানির নিজের ডাক্তারই করিমের রোগ ধরে ফেলেছিল । রানি কেন জানতে চেয়েছিলেন করিমের যৌনরোগ আছে কিনা ! আসলে রাজারাজড়াদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা । রানির তো আর গনোরিয়া হতে পারে না, হলে পুরো বিলেতি সাম্রাজ্যে ঢি-ঢি পড়ে যেতো ।
বেচারা আবদুল করিম চব্বিশ বছর বয়সে ব্রিটেনে এসেছিল, ওর কি সাধ-আহ্লাদ হয়নি লণ্ডনের মেমদের সঙ্গে শোবার, দেশে ফিরে গেলে সেই তো বাদামি চামড়ার বউ বা আগ্রার কালো-বাদামি চামড়াউলিদের কোঠা । আবদুল করিমের সঙ্গে আমি লিডসের হলবেক শহরতলিতে গিয়েছি, ওটাই তখন মেমদের রমরমে বউবাজার ছিল, পরে তো সোহো হয়ে উঠল বউবাজার, বউবাজার মানে বউদের বাজার নয়, মেমদের বাজার, যাকে এক রাতের জন্যে কিংবা কিছুক্ষণের জন্যে বউ করে নিয়ে ভালোবাসাবাসি করা যায়, আমাদের সুতানুটি-গোবিন্দপুরেও আছে, আমার এতোগুলো জন্মের আগে-পরেও আছে ।
রানির সঙ্গে ইউরোপের অন্য দেশগুলোয় যখন আবদুল করিম যেতো তখন এক ফাঁকে শহর দেখার নাম করে সেখানের মেমদের বউবাজারেও ঢুঁ মারতো, আমার সঙ্গে সেসব গল্প করতো, আমি ছাড়া তো দেশের আর কোনো মানুষ ছিল না যার সঙ্গে নিজের লুকোনো ব্যাপারগুলো ভাগ করে নেয়া যায় ।
দশ বছর বিলেতে ছিল আবদুল করিম, নিজের লুকোনো জীবনের ঘটনাগুলো একটা ডায়রিতে লিখে রাখতো । আবদুল যখন দেশে ফেরার জন্য তৈরি তখন ওর বাক্স-প্যাঁটরা ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল রানির পরিবারের লোকেরা, ডায়রিটা পাবার জন্যে, কিন্তু আবদুল করিম তো মহা চালাক, আগেই ডায়রিখানা এক আত্মীয়ের হাতে আগ্রায় পাচার করে দিয়েছিল ।
যখন পাকিস্তান হলো তখন ওর ভাইপোরা সেই ডায়রিখানাকে বাঁচাবার জন্য লুকিয়ে পাকিস্তানে চলে গিসলো কেননা ভাইপোদের সন্দেহ ছিল যে জওহারলাল নেহেরু মাউন্টব্যাটেনের বউয়ের চাপে পড়ে ডায়রিখানা খুঁজে বের করবে আর নষ্ট করে ফেলবে, হয়তো জেলেই পুরে দেবে আবদুল করিমের আত্মীয়দের ; ওই ডায়রি বাঁচাবার জন্যেই ওদের পাকিস্তানে যেতে হয়েছিল নয়তো যেতো না, সেখানে গিয়ে ওরা মোহাজির নামে অনেককাল বদনাম ছিল, সে তো দাউদ ইব্রাহিম নামে এক মোহাজির পাকিস্তানে যাবার পর ওরা করাচিতে এখন শান্তিতে আছে ।
দেখি পরের জন্মে যদি মোহাজির হয়ে পাকিস্তানে জন্মাতে পারি, ওদের বউগুলো অপরূপ সুন্দরী হয় আর উপরি পাওনা হলো যে চারটে করে অমন কচি সুন্দরীকে বিয়ে করা যায় ।
বলেছি তো, আবদুল করিম বিশ্বাস করতো না যে আমি এর আগেও জন্মেছি । ওদের ধর্মে নাকি বার বার জন্মানো বারণ । যাক আমার তো অমন ধর্মের বালাই নেই, তাই জন্মাতে পেরেছি, মনেও রাখতে পেরেছি আগের জন্মের কথা । রাজকুমারও বিশ্বাস করতেন না যে আমি এর আগেও জন্মেছি, আর আগের জন্মের বেশ কিছু ঘটনা আমার মনে আছে । এই যেমন জব চার্নকের হিন্দু বউয়ের কবরের ওপর যে মুর্গিটাকে বলি দেয়া হয়েছিল, সেটা তো আমিই গাঁ থেকে এনে দিয়েছিলুম । সিরাউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেছিল, তখন দুদলের সেনারাই ভাবলে আমি অন্য দলের, বর্শায় গিঁথে মেরে ফেললে, বর্শার ডগায় আমার মুণ্ডুটা রাস্তায় পোঁতা ছিল, সুন্দরবন থেকে একটা বাঘ এসে ধড় আর মুণ্ডু দুটোই চিবিয়ে-চিবিয়ে আয়েস করে খেয়ে নিলে , চিবোবার আওয়াজ এখনও আমার কানের খোলে রয়ে গেছে।
বাঘের পেটে দু’রাত এক দিন আমার মুণ্ডুটা ভালোই ছিল, তবে বাঘের পেটের ভেতরটা বড্ডো গরম।
হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
আমি : আরও দুই মাস, রাজকুমার ।
আমি এপর্যন্ত চারবার জন্মেছি, যা আমার মনে আছে, বাকিগুলো তেমন মনে রাখতে পারিনি, অ্যালঝিমারের রোগের দরুণ, আর চারবারই আমি পাঁচের নামতায় মারা গেছি, পঁচিশ থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে, মানুষ হয়ে জন্মাবার কথা বলছি, হয়তো তার আগে কীট পতঙ্গ জন্তু জানোয়ার হয়ে জন্মে থাকবো, সেসব স্মৃতি ধরে রাখতে পারিনি, কেননা কীট পতঙ্গ জন্তু জানোয়ারের পূর্বজন্মের স্মৃতি হয় কি না জানি না, আগের জন্মে কালেজে পড়ার সময়ে ডারউইন সাহেবের বই পড়ে দেখেছি তাতে উনিও কিছু লিখে যাননি ।
আমার এখনকার জন্ম দিয়েই শুরু করি । আমি ছিলুম রাজকুমারের খাস-চাকর । উনি আমাকে হুকুম দিয়েছিলেন যেন আমি ওনাকে অন্য লোকের সামনে হুজুর বলে সম্বোধন করি । উনি যেখানে যেতেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, আমি না হলে ওনার গোপন ফাই-ফরমাস খাটার লোক ছিল না, সকলকে বিশ্বাস করতেন না, বলতেন ওরা সব হাফলিটারেট ইডিঅট ।
রাজকুমারের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি ইংরেজি শিখে নিয়েছিলুম । উনি ফারসি আর ইংরেজিতে বেশ তুখোড় ছিলেন, সুতানুটি গোবিন্দপুরের বিলেতি সাহেব-মেমরাও ওনার ইংরেজি শুনে মাথা দোলাতো, নিজের চক্ষে দেখা । আফিম, চিনি, নুন, নীল, রেশম, কয়লার ব্যবসায় ওনাকে টক্কর দেবার মতন কোনো বাঙালি মাই-কা লাল ছিল না ।
একটা মজার কথা তোকে বলি, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড বললেন, বাবর ওনার বাবরনামায় কতোকিছু লিখে গেছেন হিন্দুস্তান সম্পর্কে, উনি জানতেন না যে এদেশে কয়লা নামে এক রকমের পাথর মাটির তলায় পাওয়া যায় ; ওনারা কাঠকয়লার কথা জানতেন, গাছ পুড়িয়ে রান্নার জন্যে কাঠকয়লা তৈরি করতেন । আমিই তো ইরেজদের কয়লার কথা বললাম, এই বাংলার মাটির তলায় অঢেল কয়লা পাওয়া যায়, বিশ্বাসই করতে চায়নি ব্যাটারা ।
বললুম, হুজুর, আমি এর আগে একটা জন্মে হুলিকাঞ্চন গুপ্তা হয়ে বেনের বাড়িতে জন্মেছিলুম, তখন আমরাই বাবর আর ইব্রাহিম লোদিকে মাল সাপলাই করতুম । নেড়েরা কয়লার কথা জানতো না, যুদ্ধু করতে গিয়ে ওদের কাঠ কয়লার দরকার পড়তো, সেগুলো আমরাই সাপলাই দিতুম, শুকনো আর কাঁচা মাংস, সেনাদের জন্যে মদ, আফিম সাপলাই দিতুম । শ্মশান থেকে অঢেল কাঠ কয়লা পাওয়া যেতো, শ্মশানের পাশেই আমাদের কাঠ কয়লার গুদোম খুলতে হয়েছিল ।
হৃৎপিণ্ড কিম্বদন্তি হতে চাননি ।
রাজকুমার ইতিহাস হতে চাননি ।
ওনার পা ব্যথা করলে আমি অনেকক্ষণ পা-টিপে ঘুম পাড়াতুম ।
পুরুতের পরিবার কেন ব্যবসাদার হয়ে গেল, সবাই জানতে চায় ।
পুরুত না হয়ে কেন আমিন, মুৎসুদ্দি, সেরেস্তাদার, বানিয়ান, মহাজন, কোম্পানির দালাল, কমিশনখোর, গোমস্তা, আমলা, জাহাজের কারবারি হয়ে গেল, জানতে চায় ।
কেন আবার ! সমাজের দেয়া চোট-জখম থেকে উচ্চাকাঙ্খার বোধ, সমাজ একঘরে করে দেয়ায় গভীর চোট-জখম, পরিবারের সদস্যদের দেয়া আঘাত, স্বদেশবাসীর রক্ষণশীলতা । সুতানুটি-গোবিন্দপুরের কোনো বামুন রাজকুমারের বাড়ি গেলে, তার জরিমানা ধার্য ছিল, সেই বামুন পুরুতদের পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে নিজের ব্রাহ্মণ পিঁড়িতে ফিরতো, বিগট, বিগট, বিগট, বিগট ! কে এক পুরুষোত্তম পীর আলি খানের রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানি রাঁধার খাইখাই গন্ধ পেয়েছিল, ব্যাস, কিম্বদন্তি চালু ।
সুতানুটি-গোবিন্দপুরকে মেট্রপলিস কে বানালো ?
মফসসলগুলোয় গথিক স্হাপত্যের জমিদারবাড়িগুলো, যা ভেঙে-ভেঙে চুনবালিসুরকির চুরো হয়ে গেছে, কার বাড়ির নকল ?
দলপতির বিরুদ্ধতা কে করল ? রেনিগেড, রেনিগেড, রেনিগেড । দলপতির বাড়ি থেকে নিজের বাড়ির দূরত্ব এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ করতে করতে একশো কোশ সরে গেলো।
মেট্রপলিসের প্রথম প্রেমিকবয় ।
হৃৎপিণ্ড : প্রেমিকবয় হওয়া ভালো, নাকি গুচ্ছের অ্যাণ্ডাবাচ্চা পয়দা করে দেশের জনসংখ্যা বাড়ানো ভালো, বল তুই ?
আর কেউ রাজকুমারের পরিবারের পেডিগ্রির সমকক্ষ করে তুলতে পারেনি নিজের পরিবারকে ।
রাজকুমার ব্যবসার কাজে বাইরে গিয়েছিলেন, সেই সুযোগে ওনার মাকে, যিনি রাজকুমারকে ছোটোবেলা থেকে নিজের ছেলের মতন মানুষ করেছিলেন, তাঁকে যখন গঙ্গার ধারে অন্তর্জলী যাত্রায় নিয়ে গিয়ে রাখা হল, বলেছিলেন, রাজকুমার বাড়িতে থাকলে তাঁকে এই জ্বালাযন্ত্রণা পোয়াতে হতো না, বাড়িতে নিজের ঘরেই মারা যেতাম ।
হৃৎপিণ্ড বলল, আমার সম্পর্কে তুই যেসব গুজব শুনিস, সবই সত্যি হুলি, তুই তো আমার খাস চাকর, সবই দেখিস । হ্যাঁ, নুনের মোলুঙ্গিদের আমি চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতুম । নিলামে পড়ন্ত জমিদারদের জমিদারি কিনে নিতুম, কড়া জমিদার ছিলুম, গরিব হলেও নীলচাষিদের রেয়াত করতুম না, কিন্তু আমার আইনি পরামর্শতেই তো যশোরের রাজা বরোদাকান্ত রায়, বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখার্জি, কাসিমবাজারের হরিনাথ রায়, পাইকপাড়া রাজ পরিবারের রানি কাত্যায়নি নিজেদের জমিদারির নিলাম হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল। আমাকে কোম্পানির কমপ্রাডর বললে আপত্তি করব না ।
রাজকুমার চুপ করে গেলেন বেশ কিছুক্ষণের জন্যে ; সেই সুযোগে আমি ওনাকে আমার আগামি জন্মে ঘটে যাওয়া দেশভাগ, বাংলাদেশে বাঙলা ভাষার জন্যে লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ, লক্ষ-লক্ষ উদ্বাস্তুর যশোর রোডে চ্যাঁচারির চালায় ঠাঁই, সেই যশোর রোডের ছায়াকে কেটে ফেলার ঠিকেদারি, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্যে ভারতীয় সেনার আক্রমণ, পাকিস্তানিদের নব্বুই হাজারের বেশি সেনা ভারতের হাতে বন্দী, বাংলাদেশের গদ্দার বাহিনী রাজাকর, আল বদর, তাদের ফাঁসি আর পাকিস্তানের বিফল হয়ে যাওয়া রাষ্ট, সব গল্প শোনালুম । এখনকার বাংলাদেশে হিন্দুদের দেবী-দেবতার মন্দির ভেঙে ফেলার, বাঙালি মুসলমানদের গোঁপ কামিয়ে দাড়ি রাখার, হিন্দুদের তাড়িয়ে-তাড়িয়ে পুরোদেশটাকে নেড়েভূমি করার ঘটনা বললুম ।
হৃৎপিণ্ড বলল, জানিস, কখনও ভাবিনি যে বাঙালিদের দেশটা পাকিস্তানের মতন একটা ফেলমারা এলাকা হয়ে যাবে, ইউরোপিয়রা যাকে বলে ফেইলড স্টেট ।
আমি তো পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে কতো কমপ্রাডরকে দেখেছি, চীনের ঘুষ খেয়ে দালালি করতো, রাশিয়ার ঘুষ খেয়ে দালালি করতো, তারাও তো বেনিয়ান, রেনিগেড, ভিনদেশের দালাল, সব ভোঁভাঁ, হামবড়াই ফুসকি, দেয়ালে লেখালিখি ফুসকি, দলপতি ফুসকি, দল ফুসকি ।
আমিও যে একটা জন্মে প্রেমিকবয় ছিলুম, তা আর রাজকুমারকে বললুম না, মনে হবে ওনার সমকক্ষ হবার চেষ্টা করছি, প্রেমিকবয় মানে সেকেলে লোকেরা যাকে বলে দুশ্চরিত্র হওয়া, এই যেমন যারা চিরকুমার আর শাকাহারি তারা নিজেদের মনে করে সাত্বিক, তারা যদি কাউকে মদমাংস খেতে দেখে, বউ ভাড়ার কোঠায় যেতে দেখে, রেসের মাঠে যেতে, জুয়ার আড্ডায় যেতে, নাইট ক্লাবে গিয়ে নাচতে, কিংবা বছরে বছরে প্রেমিকা বদলাতে দেখে, তাদের মনে করে তামসিক, সোজা বাংলায় চরিত্রহীন, আমি তা-ই ছিলুম । দুর্গাপুরের বড়ো রাস্তায় মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলুম, সেই যে জায়গাটা দুর্ঘটনার জন্যে তৈরি হয়েছে, ফি বছর দু’চারটে গাড়িতে মানুষ থেঁতো হয় ।
দুশ্চরিত্র জীবনে, আমার নাম হুলিই ছিল, পদবি ছিল শিট, পদবিটা আমার পছন্দ ছিল না, শিট মানে তো গু, তাই আমি সবাইকে নিজের পরিচয় দিতুম হোলি শেঠ নামে ; বাবা হুমকিপতি দলদাস ছিলেন, প্রচুর টাকাকড়ি গ্যাঁড়াতে পেরেছিলেন, তোলাবাজি কমিশন ঠিকেদারি দালালি ঘুষ সিণ্ডিকেট থেকে, বাড়ির ওয়াশিং রুমের দেয়ালে যে আলমারি ছিল তা বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়া যেতো না, রিমোট দিয়ে খুলতে হতো, সোনার বিস্কুটও সেখানেই রাখা থাকতো । আমি তখন বাঙালি গেস্টাপো গুণ্ডা-ক্যাডারদের পুষতুম ।
আমার সম্পর্কে এক মহিলা, যার সঙ্গে কিছু দিনের প্রেমিকবয় সম্পর্ক পাতিয়েছিলুম, কমপ্লিকেটেড, সে আমার সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখে রেখে প্রচুর কোকেন নিয়ে বাথটবে চান করার সময়ে ডুবে মারা গিয়েছিল :
“হে ভগবান, কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই ।”
“হে ভগবান, হীরের আঙটি পরিয়ে আটকে রেখেছে ।”
“হে ভগবান, কিনারায় নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে ।”
“হে ভগবান, আমিই একমাত্র নই ।”
“হে ভগবান, ছেড়ে চলে যাওয়া যে সম্ভব হচ্ছে না ।”
“হে ভগবান, এ যে এক নম্বরের ফ্লার্ট ।”
“হে ভগবান, কাজকর্ম ব্যবসা দেখার এর আগ্রহ নেই ।”
“হে ভগবান এর যে কী কাজ আর কী ব্যবসা তাও জানতে পারলাম না এতো দিনে ।”
“হে ভগবান, সম্পর্কের বনেদ কেবল যৌনতা ।”
“হে ভগবান, এ যে ঢ্যাঙা ফর্সা রূপবান জলের মতন টাকা খরচ করে ।”
“হে ভগবান, এর কাজের সঙ্গে কথার মিল নেই ।”
“হে ভগবান, এ মূল প্রশ্নের উত্তর দেয় না, এড়িয়ে যায় ।”
“হে ভগবান, এর বাড়ির চাকরানি এতো সুন্দরী যে চাকরানি বলে মনে হয় না ।”
“হে ভগবান, এ যে সব সময়েই নিখুঁত ।”
“হে ভগবান, এর সব সময়েই এতো তাড়া কেন যে ।”
“হে ভগবান, এ রোজই একটা ফুলের তোড়া পাঠায়, সঙ্গে হাল আমলের গানের ক্যাসেট ।”
“হে ভগবান, এ প্রতিদিন নতুন পোশাক পরে থাকে, নতুন পারফিউম লাগায় ।”
এই সব ভাবতে ভাবতে রাজকুমারের বন্ধুনি কবি ক্যারোলিন নরটনের কথা মনে পড়ছিল আমার, অপরূপ সুন্দরী, রাজকুমারকে ভালোবাসতেন । বজরায় ওয়াল্টজ, কোয়াড্রিলো, গ্যালপ নাচতেন দুজনে । ক্যারোলিনের বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তালাক নয়, এমনিই ছাড়াছাড়ি, ক্যারলিন লর্ড মেলবোর্নের সঙ্গে ইশক ওয়ালা মোহব্বত করতো, তা ধরে ফেলেছিল ওর বর, ফলে ছাড়াছাড়ি, ছাড়াছাড়ির দরুন ক্যারোলিনের টাকাকড়ির এমন খাঁকতি পড়েছিল যে রাজকুমার মণিমুক্তো বিলিয়ে দেন শুনে আঁকড়ে ধরেছিল, রাজকুমারকে ফুসলিয়ে অনেক সোনাদানা আদায় করতে পেরেছিল ।
রাজকুমার মারা যেতে মনের দুঃখে ক্যারোলিন একখানা কবিতা লিখেছিল, ‘আমার হৃদয় এক শুকনো বাদাম’ শিরোনামে, তার গদ্য করলে এরকম দাঁড়ায় :
আমার জীবন এক শুকনো বাদামের মতো
ফাঁকা খোলের ভেতরে ঝুমঝুমির মতো বাজে
তুমি আমার বুকের ভাঁজ খুলে তার ভেতরে রাখতে পারবে না
তাজা কোনো জিনিস যা সেখানে বাসা বাঁধতে পারে
আশা আর স্বপ্নে ভরা ছিল এক সময় যখন
জীবনের বসন্তগৌরব আমার দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে
বিদায় নিয়েছে আজ সেখানে আনন্দ নেই দুঃখ নেই
আর শুকনো হৃদয় কখনও উদ্বেলিত হবে না
আমার জীবন এক শুকনো বাদামের মতো
এক সময়ে প্রতিটি স্পর্শে জেগে উঠতো
কিন্তু এখন তা কঠিন ও বন্ধ হয়ে গেছে
আমি তার হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারবো না
প্রতিটি কন্ঠস্বরের আলো আমার ভ্রুপল্লবকে কাঁপাতে পারতো
প্রতিটি মৃদু বাতাসে দুলে উঠতো গাছের ডাল
যে ডালে রোদের আলোয় দোল খেতো বাদামফল
এখন তা শীতে আক্রান্ত, আমার মতো কঠিন আর দুঃখী
আমার হৃদয় এক শুকনো বাদামের মতো
যে দেখতো সে-ই আকর্ষিত হতো এক সময়
কিন্তু যবে থেকে দুর্ভাগ্য আমাকে ভেঙেচুরে দিয়েছে
তেতো হয়ে গেছে মুখের স্বাদ গন্ধ
তার চঞ্চল যৌবনের নতুন পরাগ
শেষ হয়ে গেছে আর ফিরবে না কোনোদিন
আর আমি অনুভব করি আমার দুঃখী হৃদয়ের সত্য
রোদ নেই, হাসি নেই, যা আমাকে ঔজ্বল্য দেবে ।
চাকরদের মুখ তুলে অতিথিদের দিকে তাকানো অনুচিত, তবু আমি ক্যারোলিন নর্টন এলেই ওনার দিকে তাকিয়ে দেখতুম, কী ফর্সা গোলাপি চেহারা, এখানের মেমরা কেউই ওনার মতন বুকের খাঁজ দেখানো পোশাক পরে না, আমি আড়চোখে খাঁজের দিকে তাকাতুম, বুকের পুঁইমেটুলি দেখতুম ।
চাকরের দুর্বলতা শোভা পায় না, আমি বেশ দুর্বল বোধ করতুম, ওনাকে চোখ বুজে কল্পনা করতুম চান করার সময়ে । জমিদার আর কোম্পানি বাহাদুর ছাড়া মেমদের ছোঁয়াও অপরাধ, তবু আমি ছলছুতোয় ছুঁতুম ওনাকে, ফুলের তোড়া দেবার সময়ে, মদের গ্লাস এগিয়ে দেবার সময়ে ।
বিদেশিনীরা রাজকুমারকে ভালোবাসতেন বলে, বিদেশে গিয়ে নানা রকমের মাংস খেতেন বলে, সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ওনাকে বামুনরা সমাজের বাইরে একঘরে করে দেবার তাল করেছিল, ওনার বাড়ির মেয়ে-বউরা যদি ওনাকে ছুঁয়ে ফেলতো, তাহলে তারা গঙ্গাজলে চান করে পবিত্রতা ফিরে পেতো, রাজকুমার পবিত্রতার কেয়ার করেননি, বাড়িতে বৈঠকখানাঘর তৈরি করে সেখানেই থাকতেন, বন্ধুবান্ধবরা আর ব্যবসার লোকরা, দেশি হোক বা বিদেশি, সেই ঘরেই দেখা করতো, আরাম কেদারায় বসে হুঁকো টানতো ।
রাজকুমার মারা যাবার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন ক্লিভল্যাণ্ডের ডাচেস এসে ওনার সঙ্গে সময় কাটাতেন ।
হৃৎপিণ্ড বহুক্ষণ চুপ করে ছিলেন, হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ের দোল খেতে খেতে শৈশবের কথা ভাবছিলেন, সৎমায়ের আদর-যত্নের কথা ভাবছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, বুঝলি হুলি, তুই যেমন ম্যাজিকে বিশ্বাস করিস, আমার বড়োছেলেও তেমন ম্যাজিকে বিশ্বাস করে, মঙ্গলকাব্যের কবিরা যেমন স্বপ্নাদেশ পেয়ে কবিতা লিখতেন, আমার বড়োছেলেও তেমন স্বপ্নাদেশ পায়, কোথা থেকে জ্ঞানের কাগজ ওর হাতে উড়ে এসে পড়ে, আর ও নিরাকার ব্রহ্মের খোঁজে লীন হয়ে যায়, তখনই ব্রহ্ম ব্রহ্ম ব্রহ্ম জপতে থাকে, ব্যবসা লাটে উঠিয়ে দিলে ।
রাজকুমার রোমে গিয়ে পোপের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, প্যারিসে গিয়ে রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, লণ্ডনে থ্যাকারে আর চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, প্যারিসে ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন । এই দেখা করার কায়দা ওনার কাছ থেকেই তো শিখেছিলেন ওনার ছোটো নাতি ।
আমি বললুম, হ্যাঁ, রাজকুমার, জানি, ব্রহ্ম ব্রহ্ম জপে জপে আলাদা স্বর্গে গেলেন । বিষয়সম্পত্তিকে উনি মনে করতেন বিষ, মন বিষিয়ে দেয়, অনেক লোককে জড়ো করেছেন ওনার অতিবামুন কাল্টে । ওনার সময় থেকেই দিকে দিকে ভদ্রলোক বিয়োবার যুগ আরম্ভ হলো । বাঙালি আর ব্যবসাবাণিজ্য করবে না, কারখানা খুলবে না, শুধু ভদ্রলোক হয়ে কেরানিগিরি করবে । আপনার সময়ে উনিশ শতকের আশির দশক আর নয়ের দশকটুকুই বাঙালির এগিয়ে যাবার সময় ছিল, কেরানি হবার আর সরকারি চাকুরে হবার দৌড়ঝাঁপ ছিল না, শুধু আপনার ছোটোছেলে ওই লাইনে চলে গিয়েছিলেন ।
হৃৎপিণ্ড বললেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হ্যাঁ, আধ্যাত্মিকতাই এখন বাঙালির ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
আমি বললুম, এই আধ্যাত্মিকতা আপনার সময়ের আধ্যাত্মিকতা নয় । এই আধ্যাত্মিকতার কোনো দার্শনিক বনেদ নেই । দিকে-দিকে আকাট গুরুদেবের ছড়াছড়ি, গেরুয়া পোশাক পরে মাফিয়ারা বোকাদের ঠকিয়ে বিরাট বিরাট দল তৈরি করে সরকারি জমিজমা দখল করছে, আর সেখানে মন্দির গড়ে মেয়েদের ফুসলিয়ে ধর্ষণ করছে । প্রতিদিন তার বিজ্ঞাপনও বেরোচ্ছে কাগজে, বাড়ি-বাড়ি হ্যাণ্ডবিল বিলি করছে তারা । এমন বাঙালি আর দেখতে পাবেন না যার হাতের আঙুলগুলোয় গ্রহরত্নের গোটা পাঁচেক আঙটি নেই, গলায় কিংবা বাহুতে মাদুলি নেই ।
হৃৎপিণ্ড বললেন, আমি সারাজীবন এই গুরু ব্যাপারটার বিরোধী ছিলাম, আমার কোনো গুরুর দরকার হয়নি, নিজে ঠেকে শিখেছি, নিজে নিজের রাস্তা গড়ে তুলেছি ।
আমি জিগ্যেস করলুম, রাজকুমার আপনি শনিদেবতার নাম শুনেছেন ?
হৃৎপিণ্ড বললেন, শুনেছি, কখনও শনিদেবতার পুজো হতে দেখিনি বা শুনিনি, আমার জমিদারিতে কতো চাষি থাকতো, বিপদে পড়তো, আমি তাদের চাপ দিয়ে পাওনা আদায় করতাম, তবুও তো তারা শনি নামে কোনো দেবতার আশ্রয়প্রার্থী হয়নি ।
বললুম, আপনি জানেন না, মোড়ে-মোড়ে রিকশা স্ট্যাণ্ডে এখন শনি মন্দির, নাস্তিক মার্কসবাদীরা বসিয়ে দিয়ে চলে গেছে, এখন গান্ধিবাদীরা তাদের কাছ থেকে ফি-হপ্তায় চাঁদা তোলে । রিকশাস্ট্যাণ্ডগুলোয় আর মোড়ে মোড়ে আরেকটা পুজো হয়, বিশ্বকর্মা পুজো, আপনি জাহাজের মালিক হয়ে যে পুজো করেননি, এখন কেউ রিকশা টানলে বা কোনো সাঁড়াশি নিয়ে কাজ করলেও লাউডস্পিকার বাজিয়ে পুজো করে, ইয়ে দুনিয়া পিত্তল দি, হো বেবি ডল ম্যায় সোনে দি, হো মেরে হুস্ন দে কোনে কোনে দি, বেবি ডল ম্যায় সোনে দি, জয় বাবা বড়োঠাকুর, তুমি ঠাকুরদের মধ্যে সবচে বড়ো, পেন্নাম হই ।
হৃৎপিণ্ড জানতে চাইলেন, শরবতের বয়ামের দেয়ালে এসে, হ্যাঁরে, লাউডস্পিকার কি জিনিস, স্টিম ইঞ্জিনে চলে ?
বললুম, না রাজকুমার, বিজলিতে চলে, তার ভেতরে একহাজারটা ষাঁড়ের গলার আওয়াজ লুকোনো থাকে, কেউ কোনো কথা বাজালে কিংবা গান করলে, সেই ষাঁড়েরা মানুষের মাথার ওপরে চেঁচাতে চেঁচাতে উড়তে থাকে। যে গান গায় বা বক্তৃতা দেয় তাকে তখন পাগলা ষাঁড় বলে মনে হয় ।
হুলি, তুই কি বলতে চাইছিস, ওগুলো আমার বড়ো ছেলের প্রভাবের কুফল ? জিগ্যেস করলেন হৃৎপিণ্ড ।
বললুম, একবার আধ্যাত্মিকতার গাড়ি চালিয়ে দিলে স্পেনের ধর্মধ্বজাধারীরা যে পথে সমাজকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই পথেই সমাজটা দৌড়োতে থাকে, গড়াতে থাকে, জানেন তো । স্পেন ওই ধ্বজাগুলো লাতিন আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে পুঁতেছে আর সেখানকার মানুষদের হতভাগ্য করে দিয়েছে, দক্ষিন আমেরিকা হয়ে গেছে উত্তর আমেরিকার চেয়ে গরিব ; এখন উত্তর আমেরিকা ভাবছে দক্ষিণ আমেরিকার লোকদের আসা বন্ধ করতে দেয়াল তুলবে ।
হৃৎপিণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ফরম্যালিনের শরবত দুলে উঠল, বললেন, আমেরিকায় যাবো ভেবেছিলুম, কিন্তু তার আগেই মারা গেলুম রে ।
আমি আমার বাকি কথাগুলো বললুম, আপনি বলুন না, এসব এলো কোথা থেকে, এই যে শীতলা পুজো, মনসা পুজো, কার্তিক পুজো, আরও কতো অজানা অচেনা দেবীদেবতার পুজো ? মাঝ রাস্তার ওপরে, লোকের বাড়িতে ঢোকার দরোজা বন্ধ করে, নর্দমার ওপরে পাটাতন পেতে, খেলার মাঠে খুঁটি পুঁতে ? বাজারগুলোয় লাটে-লাটে মূর্তি বিক্রি হয়, দরাদরি হয় ।
কিন্তু আমার বড়োছেলের প্রভাব তো কবেই মুছে গেছে, টিকে আছে শুধু আমার নাতির গান, বললেন হৃৎপিণ্ড, আর সবায়ের নামে লেজুড় হিসাবে নাথ আর ইন্দ্র জুড়ে দেবার রেওয়াজ ।
ঘণ্টাখানেক পরে রাজকুমার বললেন, কার্ল মার্কস লিখে গেছেন যে চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের কারণে বাঙালিদের পুঁজি ব্যবসাবাণিজ্য আর শিল্পোদ্যোগ থেকে জমিজমায় নিবেশের দিকে চলে গিয়েছিল ; আমি তা নিজের জীবন দিয়ে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছি । আমি যেমন বেশ কয়েকটা জমিদারির মালিক ছিলাম, তেমনি ব্যবসাবাণিজ্যও করেছি, ব্যাঙ্ক খুলেছি, জাহাজ চলাচল শুরু করেছি, খবরের কাগজ শুরু করতে সাহায্য করেছি, মেডিকাল কলেজ শুরু করার চেষ্টা করেছি, বিলেতে যাতে ভারতীয়রাও পার্লামেন্টে সিট পায় তার চেষ্টা করেছি, আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে দেখতিস গঙ্গায় স্টিম ইঞ্জিনের স্টিমার চলতো, বর্ধমান থেকে কলকাতা রেলগাড়ি চলতো, কলকাতায় জাহাজ তৈরির কারখানা বসাতাম, স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে যে-যে কারখানা বসানো যায় তার চেষ্টা করতাম ।
আমি বললুম, হুজুর, কার্ল মার্কস তো আর জানতো না যে বাঙালিবাবু আর বাঙালি ভদ্রলোক নামে একরকমের জীব জন্মাবে যারা আস্তিক হয়েও দুর্গাপুজো-কালীপুজোয় পুরুতকে নাচতে বলবে, নিজেরা ধুনুচি নাচ নাচবে, মিষ্টি দই খেয়ে ডায়াবেটিসে ভুগবে, আর বলবে যে এটা ধর্মবিশ্বাস নয়, এটা হলো গণতন্ত্রে মানুষের কৌম আনন্দ ।
রাজকুমার বললেন, আমিই তো আমার পরিবারের পুরুতের বাংলা পদবিকে ইউরোপীয় করে তুলেছিলাম ; সেই পদবি নিজেদের নামে লেজুড় হিসেবে সেঁটে পরের প্রজন্মে সবায়ের কতো গর্ব দেখেছিস তো ? উপযোগীতাবাদ, খোলা বাণিজ্য, প্রবুদ্ধ করে তোলার উদ্যোগ, স্বাধীনতাবোধ, একেশ্বরবাদে বিশ্বাস, এসব আমিই তো এনেছিলাম।
আমি শুনছিলুম রাজকুমারের কথা, তার দুশো পঁচিশ বছর পরে দুনিয়ায় যা ঘটছে তা জানিয়ে ওনাকে ওয়াকিবহাল করতে চাইলুম, বললুম, যে পথে আপনার জাহাজ গিয়েছিল, সেপথে এখন জোর যুদ্ধু চলছে, মোচরমানরা দলাদলি করে কার ব্যাখ্যা কার চেয়ে বড়ো প্রমাণ করার জন্যে নিজেদের মধ্যে লড়ে মরছে, মিশর আর পাশাদের দেশ নয়, মিলিটারির দেশ, সেখানে খ্রিস্টানদের গির্জায়, খ্রিস্টান ছাত্রছাত্রীদের বাসে বোমা মারছে মোচোরমান ধর্মের মানুষ, যতো বেশি পারে খুনোখুনির রেশারেশি চলছে ।
আমার মনে পড়ল যে ‘অপর’ বলতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যে অর্থগুলো পুরোনো বাংলা কাব্য থেকে যোগাড় করেছেন, তার মানে অন্য, ভিন্ন পৃথক, ইতর, অর্বাচীন ,নিকৃষ্ট, অশ্রেষ্ঠ, বিজাতীয়, অন্যজাতীয়, প্রতিকূল, বিরোধী, শত্রু ইত্যাদি । অথচ উনি লিখেছেন যে অপর বলতে আত্মীয় স্বজন মিত্রও বোঝাতো ।
শত্রুও আবার মিত্র ।
একই শব্দের যে এরকম উলটো মানে হতে পারে তা ইংরেজি-শেখা বাঙালিরা ভুলে গেছে । ইংরেজি শেখা বাঙালিরা নিজেদেরই ভুলে গেছে । মার্কস এঙ্গেলস লেনিন মাও তারা ইংরেজিতেই পড়েছে, বাংলায় অনুবাদ করে চল্লিশ বছর আগে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে বিক্রি হতো সেসব বই । যারা বিক্রি করতো তারা সকলেই পেল্লাই বাড়ি তুলে ফেলেছে, গাড়ি হাঁকাচ্ছে, আর বই বিক্রির স্টল খোলে না, অপমান বোধ করে ।
একটা জন্মে যখন আমি সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলুম তখন জেনেছিলুম, ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে অপর ভাবনার কিছু মিল আছে । উপনিষদ বলছে, ব্যক্তির নিজস্ব বা অহংবোধ বহু কিছুকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে । আত্মন বলতে যদিও নিজেকেই বোঝায়, কিন্তু শুধু এইটুকু বললে তার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশিত হয় না । আত্মন এমন এক অস্তিত্ব যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র পরিব্যপ্ত । এই জায়গা থেকে উপনিষদ চলে গেছে অদ্বৈত দর্শনের দিকে ।
আশ্চর্য যে মানুষ নিজেকে মাপে বড়ো করে আর অপরকে মাপে ছোটো করে । এক পক্ষের অপর তৈরি হয় অপর পক্ষের অপরকে বাদ দিয়ে । অপরীকরণে তারাই সক্রিয় পক্ষ যাদের হাতে নির্ণায়ক ক্ষমতা থাকে । অপরীকরণে এক পক্ষ নিজ, আরেক পক্ষ অপর । এই নিজ যতোই ব্যক্তির সত্বা হোক, তার মূলে আছে সমাজ । মানুষ নিজের সমাজ, ও সম্প্রদায়ের সংস্কার, বিদ্বেষ, ভীতি, পছন্দ-অপছন্দ, ক্ষোভ, আশা-নিরাশা, ধর্মচেতনা, ন্যায়-অন্যায়বোধ, ঘৃণা-লালসা, পুরোনো ইতিহাস, বন্ধুতা-শত্রুতা, রাজনীতি দ্বারা সব সময়েই প্রভাবিত হয় । সমাজ মানুষকে যে-ছাঁচে গড়ে তোলে, সে তারই আকার নেয় । পরিবার, পরিবেশ, নানা রকমের মিডিয়া, সভা-সমিতি, সরকার, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সঙ্গঠন, শিক্ষাব্যবস্হা, রাজনৈতিক আর সামাজিক মতবাদ, হুজুগ, ধর্মীয় উন্মাদনা, এ-সবেরই কিছু-না-কিছু ছাপ পড়ে তার ওপর — চেতনা-অবচেতনার নানা স্তরে তা ছড়িয়ে পড়ে ।
আমি তো শুদ্দুর, তাই বাদ দেয়া অপর ।
হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
আমি : আর এক মাস, রাজকুমার ।
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না বিয়ের আগেও ছেলে-মেয়েরা ট্যাবলেট খেয়ে যতোবার যতোজনের সঙ্গে ইচ্ছে সেক্স করতে পারে । ইচ্ছে মেয়েদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে ।
তুই অতো ভাবছিস কেনো, দেখে যেতে পারিনি বটে, মেয়েদের স্বাধীনতা তো আমার জন্যেই সম্ভব হয়েছে, আমি যদি না অঢেল টাকা রোজগার করতাম, আমাদের বাড়ির মেয়ে-বউরা কি নারী স্বাধীনতা আনতে পারতো?
হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না কানির বদলে মেয়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধে ।
তুই ভুল ভাবছিস, হুলি ।
হায়, রাজকুমার এতো সাহসী ছিলেন হয়তো নিজেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের কারখানা বসাতেন ।
হ্যাঁ, আমিই কারখানা বসাতুম, ওতে বিশেষ লগ্নির দরকার হয় না ।
আমার মনে পড়ল যে বিশ শতকের সাতের দশক আমি একটা কলেজে সমাজবিজ্ঞান পড়াতুম, আমার নাম ছিল হুলিচরণ ভট্টাচার্য, স্নাতকোত্তর সিলেবাসে ‘ভুতবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র’ নামে একটা বই ছিল, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে পৌঁছোতে মোটে এক সপ্তাহ বাকি, আশঙ্কায়, কী করবে ঘাটে নেমে ঠিক করে উঠতে পারছিলুম না, কেননা রাজকুমারে এতো শত্তুর ছিল, তারা নিশ্চই জেটিতে এসে ব্যাগড়া দেয়া আরম্ভ করবে ।
চোখ বুজে আঁচ করতে পারলুম, জেটির খালি-গা হেটো ধুতি বামুনগুলো আর অতিবামুন কাল্টের কোরাধুতি কাঁধে চাদর লোকেদের নির্ঘাত ভুতে পেয়েছে, জানি আমি, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ডের দিকে এক ঠায় তাকিয়ে এক্কেবারে নিশ্চিত হলুম ।
‘ভুতবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র’ বইয়ের মন্তর মনে পড়ে গেল যা স্নাতোকোত্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্হ করাতুম যাতে ওরা জীবনে বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে কেউকেটা হয়ে উঠতে পারে, আইআইটি আইআইম-এ ভর্তি হতে পারে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশুনা করে সেদেশের মেম বিয়ে করে এদেশে মাবাপকে ভুলে যেতে পারে । জাহাজের জেটিতে পৌঁছে, যাদের ভুতে পেয়েছে, আর তাদের মগজে ঢুকে নানা উৎপাত করছে, তাদের কাছে গিয়ে চুপিচুপি এই মন্তরটা তিনবার পড়তে হবে আর ওদের শরীরে তিনটে ফুঁ দিতে হবে ।
জেটিতে নামার পরে তো কাছ-ঘেঁষতে দেবে না ওরা, আমি যে শুদ্দুর, তাই জাহাজের কেবিনে বসেই এই মন্তরটা তিনবার পড়লুম :
ভুত কে ? আমি কে ? কে বলতে পারে ?
ভুতের সন্ধান করি বেড়াই ঘুরে ঘুরে ।
ভুতের দেখা পেলাম হেথা ।
ভুতের সঙ্গে কই কথা ।
শুনাই কানে হরেকৃষ্ণ হরেরাম ।
সজীব ছিল নির্জীব হলো শুনে রামনাম ।
ভুতের রাজা মহাদেব রাম নামেতে খেপা ।
ভুতকে ডেকে নিলেন কাছে বুকে পেয়ে ব্যথা ।
দোহাই শিবের, দোহাই রামনামের ।
জেটিতে যারা দাঁড়িয়ে থাকবে তাদের ঘাড় থেকে শিগগির যা ।
জয় ভুতনাথ জয় জয় শিবশঙ্কর ।
মনে মনে মন্তরটা তিনবার আওড়ালুম ।
রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড শুনতে পেলে চটে যাবেন, বলবেন তোদের এইসব ভুতপ্রেতে বিশ্বাস গেলো না, বিলেত ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম, তবুও গেঁয়ো মুর্খ থেকে গেলি, সভ্য মানুষ হতে পারলি না ।
না, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড সেসব কিছুই বললেন না । বয়ামে ফরম্যালিনের শরবতে হয়তো উনি এখন ঘুমোচ্ছেন, সমুদ্রের এমন ঢেউ, এমনিতেই ঘুম পায়, মনে হয় মায়ের কোলে দোল খাচ্ছি । আর ওনার তো নিজের মা ছিলেন না, যদিও সৎমা ওনাকে খুবই ভালোবাসতেন ।
ভুত যার কিংবা যাদের ঘাড়ে ভর করে সহজে তাদের ছেড়ে যায় না । আমার মনে হতে লাগলো জেটিতে যারা হৃৎপিণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের ঘাড়ের ভুতগুলো হয়তো তাদের ঘাড় থেকে নেমে তাদের ছেলেপুলের ঘাড়ে চাপবে, ছেলেপুলের ঘাড় থেকে নেমে তাদের ছেলেপুলের ঘাড়ে চাপবে, হয়তো কেন, নিশ্চই ঘাড়ের পর ঘাড়ে চেপে সব বাঙালির ঘাড়ে ভুতেরা ভর করেছে, তাদের আর যাবার নাম নেই, রাজকুমারকে হিংসে করার লোক কি কম আছে আজকের দিনে ? একজন আরেকজনকে হিংসে না করলে শ্বাস নিতে পারে না।
রাজকুমারের মতন রাজসিক আর জাঁকজমকঠাশা জীবন দেখলেই লোকেদের ভুতে পায়, ঈর্ষায় জ্বলে খাক হয়, কাউকে মুকেশ আমবানি হতে দেখলেই গালমন্দ করে, তার কারণ নিজেরা তো কুটোটি নাড়তে পারলেন না, যারা রাজকুমারের দেখানো পথে এগিয়ে গেল, যেমন গৌতম আদানি, তাদের হিংসে করে, তাদের প্যাঁচ-পয়জার তিকড়মবাজি শিখতে না পেরে ভুতের জিম্মায় নিজেদের ছেড়ে দেয়, যাতে ভুতেরা এক বছরেই টাকা ডবল করে দিতে পারে, যেন ভুতেরা দাউদ ইব্রাহিমের বংশধর, দাউদের বোন হাসিনার ছেলেপুলে ।
রাজকুমার জন্মেছিলেন ১৭৯৪ সালে আর আজ ২০১৭ সাল, কতো বছর হলো ? দুশো তেইশ বছর ! এরই মধ্যে বাঙালিরা ভুতের আক্রমণে আধপাগল হয়ে গেছে, কাজের বদলে বইতে লেখা বাক্যিকে মনে করে এগিয়ে যাবার রাস্তা । নিজেরা একা এগোতে চায়না, সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গো চাই, মিছিল চাই, ধুলোট চাই, জুলুস চাই, যেন তাতেই রাজকুমারের স্বপ্নের বাঙালিরা পয়দা হবে ।
হায়, রাজকুমার, কিছুই হয়নি, প্রতিটি বাঙালির ঘাড়ে চেপে বসেছে বুকনির ভুত, বাগাড়ম্বরের ভুত, লেকচারবাজির ভুত, দলবাজির ভুত, দলদাসের ভুত ।
ঘাড় থেকে ভুত না নামলে কী করতে হবে তা স্নাতকোত্তরের সমাজবিজ্ঞানের সিলেবাসে ‘ভুতবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র’ বইতে আছে, তখন অগ্নিবাণ উচ্চারণ করতে হবে, যাকে বা যাদের ভুতে পেয়েছে, তাকে বা তাদের ভুতছাড়া করার জন্যে খড়ের মশাল তৈরি করে এই মন্তর আউড়িয়ে আগুনে জোরে ফুঁ দিতে হয় যাতে মশালের ধোঁয়া ভুতে পাওয়া মানুষদের গায়ে লাগে, লাগলে ভুত তাদের ছেড়ে যেতে বাধ্য । আমি তাই চুপি চুপি এই মন্তর আওড়ালুম যাতে রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড শুনতে না পান, মশাল তো নেই, এমনিই ফুঁ দিলুম ।
অষ্টবজ্র করলুম এক অষ্ট্ দেবতার বরে
অষ্টবজ্রের তেজ নিলুম শক্তির শক্তি ধরে
অগ্নিবাণ সৃষ্টি হলো ব্রহ্মার দোহায়ে
হান হান শব্দে বাণ চল্লো আকাশ ছেয়ে
ওঁ হরি নারায়ণ বাণের মুখে জ্বলে
নাগ-মানব দেব-মানব কাঁপলো ব্যাকুল হয়ে
স্বর্গ কাঁপে, মর্ত্য কাঁপে, পাতাল কাঁপে ভয়ে
যা চলে বাণ গঙ্গাতীরের জেটির মানুষদের দিকে
যে দেহ আশ্রয় করে পুড়িয়ে ফ্যাল, কটি অঙ্গ তার
তেত্রিশ কোটি দেবতার হুকুম
লাগ লাগ শিগগির লাগ..
রাজকুমার : আর কতো দূর হুলি ?
আমি : আমাদের জাহাজ পৌঁছে গেছে রাজকুমার । ঘাটে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না ।
জাহাজ গঙ্গায় ঢোকার আগেই আমার হাবশি সহচর উড়ুক্কু মাছ দুটো নিয়ে সমুদ্রে নেমে গিয়েছিল, সাঁতরে মার্টিন দ্বীপে চলে যাবে ; উড়ুক্কু মাছ দুটো ওকে সমুদ্রের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে ।
আমি শরবতের বয়ামে রাজকুমারের হৃদয় হাতে নিয়ে জেটির ঘাটে নামলুম । অপেক্ষা করলুম সন্ধ্যা পর্যন্ত, কাউকে আসতে না দেখে কুমোরটুলির দিকে রওনা দিলুম ।