হিন্দুকুশের পাহাড়ি উপত্যকায় ওরা কারা
আলেকজান্ডারের সৈন্যদের বংশধর! পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশ। সেই প্রদেশেই আছে হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী। যাকে গ্রীকরা বলতেন ককেশাস ইণ্ডিকাস। সেই হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণীর দুর্গম একটি এলাকার মধ্যে দিয়ে উন্মত্ত গতিতে বয়ে চলেছে কুনার নদী। পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এক অজানা রহস্যের মোড়কে আবৃত। বিশ্বের কাছে সেই রহস্য এখনও পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।
তুষারাবৃত হিন্দুকুশের ঘন সবুজ গালিচা মোড়া উপত্যকা দিয়ে পাহাড়ি ঝর্না ছুটে চলেছে আপন খেয়ালে। প্রাচীন ওয়াল নাট, অ্যাপ্রিকট, ওক,পাইন,ফার,উইলো গাছের ভিতর দিয়ে উপত্যকায় নেমে আসে শৃঙ্গ ছোঁয়া মেঘের দল। চারদিকে রঙবেরঙের পাহাড়ি ফুলের শোভা। এমনই এক স্বপ্নের পরিবেশে বাস করে এক স্বাধীনচেতা প্রাচীন শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী।তাঁদের চুল সোনালী, চোখের মনির রঙ নীল। এই মানুষদের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। পাকিস্তানের আর কোনও গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে তাঁদের চেহারা, ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা ও খাদ্যাভাসের বিন্দুমাত্র মিল নেই। তাঁরা হলেন কালাশ।
এই নয়নাভিরাম উপত্যকায় থাকেন কালাশরা,ডান দিকে কুনার নদী পাকিস্তানের চিত্রাল জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি উপত্যকাগুলি হল বুম্বুরেট, রুম্বুর ও বিরির। এই তিনটি উপত্যকায় ছড়িয়ে আছেন কালাশরা। পাকিস্তান থেকে এযখন আজ শিখ, হিন্দু, খ্রিষ্টানদের বের করে দেওয়া হচ্ছে, তখন কালাশরা কী ভাবে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। যদিও সংখ্যায় এঁরা মাত্র ৪০০০।
যে তিনটি উপত্যকায় কালাশরা থাকেন, সেখানে সংঘর্ষের ছায়া পড়লেও পৌঁছতে পারেনি মৌলবাদ। এই স্বাধীনচেতা মানুষগুলি পাকিস্তানের শাসন মানেন না। কারণ তাঁরা মনে করেন কালাশ উপজাতি গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যসামন্তের বংশধর। এঁরা লড়াই করে বাঁচতে জানেন। কালাশরা জানেন মরলে লড়াই করেই মরতে হবে, কারও অধীনে থেকে নয়। পাকিস্তানও এদের ঘাঁটায় না।
কালাশ নারী
কারা এই কালাশ!
তাঁরা বলেন তাঁদের পূর্বপুরুষরা গ্রীস থেকে এসেছিলেন। ইতিহাসেও তার অনেকটাই প্রমাণ মিলেছে। ইতিহাসবিদদের মতে, কালাশরা এখন যেখানে বসবাস করেন, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সেই উত্তর পাকিস্তানের পাহাড়ি এলাকা জয় করেছিলেন ২,০০০ বছর আগে। কালাশ জনগোষ্ঠীর মানুষরাও এখানে বাস করছেন প্রায় দু’হাজার বছর ধরেই।
ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত যে ‘কালাশ’ ভাষায় কথা বলেন কালাশ উপজাতির মানুষেরা, তার সঙ্গে আরবী বা উর্দুর কোনও মিল নেই। কালাশরা বলেন, ইসলামেরও আগে সিকান্দার-ই-আজম (আলেকজান্ডার) ভারতে আসেন। যুদ্ধ জয়ের পর তিনি যখন গ্রিসে ফিরে যান, তাঁর কিছু সঙ্গীসাথী এখানেই থেকে যান। হিন্দুকুশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাঁদের ভালো লেগে যাওয়ায়। তাঁদের নেতা ছিলেন আলেকজান্ডারের এক সেনাপতি। তাঁর নাম ছিল শালাখাশ (সেলুকাস!)। তিনি তাঁর কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে পাহাড়ি উপত্যকায় বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় মহিলাদের বিবাহ করেন। হিন্দুকুশের কাফের কালাশরা তাঁদেরই বংশধর।
কালাশ উপজাতির নেতারা
কেমন ভাবে জীবন কাটান কালাশরা!
এক প্রাচীন জনগোষ্ঠী কালাশ। হিন্দুকুশের ভয়ঙ্কর পাহাড়ি ঢালে কালাশদের অতি সাধারণ বাড়িঘর। কালাশরা পৌত্তলিক, নানা দেবদেবীর পুজো করেন। মেয়েরা স্বাধীনচেতা, অবগুন্ঠনে থাকেন না। নিজেরাই নিজেদের স্বামী বেছে নিতে পারেন। পুরুষতন্ত্রের কোনও হুঙ্কার নেই কালাশ গ্রামগুলিতে। কালাশ গ্রামে নারী-পুরুষের সমান অধিকার।
কালাশ নারীদের স্বামী নির্বাচনের স্বাধীনতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বামী পরিবর্তন করার ক্ষমতাও। তবে আগের স্বামী নারীটিকে যা দিয়েছেন, তাঁর দ্বিগুণ দ্বিতীয় স্বামীকে দিতে হবে। আগের স্বামী একটি গরু দিলে, দ্বিতীয় স্বামীকে দু’টি গরু দিতে হবে। স্ত্রী ছিনতাইকে কালাশরা অপরাধ ভাবেন না। এক গ্রামের কালাশ বধূকে ‘ছিনতাই’ করে নিয়ে যায় অন্য গ্রামের কালাশ পুরুষ( উভয়ের সম্মতিতেই)। একে ঘোনা দস্তুর বলা হয়। কালাশদের বিভিন্ন উৎসবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক সময় এই ‘ছিনতাই’-এর ঘটনার কারণে গ্রামে গ্রামে লড়াই লেগে যায়। তখন দু’গ্রামের মাথারা মীমাংসা করে দেন। হেলেন অফ ট্রয়-এর ঘটনা এখানে আকছার।
কালাশদের জীবনযাত্রার সব কিছুতেই রঙের ছোঁয়া থাকে নিজেদের পশ নিজেরাই পোশাক তৈরি করেন। কালাশ পুরুষরা পরেন উলের শার্ট,প্যান্ট, টুপি, মহিলারা এমব্রয়ডারি করা লম্বা কালো গাউনের মতো পোশাক। মহিলারা অনেকসময় মুখে ট্যাটুও করেন। বাচ্চারা চুলে রঙচঙে পাথরের পুঁতি পরে। জীবনযাত্রার সব উপকরণ তাঁরা নিজেরাই বানিয়ে নেন।
জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁরা পাহাড়ের ঢালে চাষ করেন। নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদে ভরপুর জীবন তাঁদের। শীতের সময় কালাশ নারী পুরুষরা একত্রে বল নিয়ে বরফের উপর চিকিক গাল নামে এক ধরনের খেলা খেলেন। এখানকার অনুষ্ঠানগুলির একটা বিশেষত্ব রয়েছে। পুরুষরা অনেক সময়েই মহিলাদের পোশাক পরে নাচেন, আর মহিলারা পরেন পুরুষদের পোশাক। এই ধরনের কাফের সুলভ জীবনযাত্রা পাকিস্তানে অপরাধ ও মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। কিন্তু পাকিস্তানের আইন এখানে পৌঁছাতে পারে না।
গ্রামের মাঝখানে চারসো নামের একটি জায়গায় সবাই নাচগানের জন্য মিলিত হয়েছেন কালাশদের রীতিনীতি খুবই অদ্ভুত । যখন কোনও ছেলে কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেয়, ছেলেটিকে সারা গ্রীষ্মের জন্য ভেড়া নিয়ে উচুঁ পাহাড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বেঁচে ফিরলে বাদুলাক উৎসব হয়। এই উৎসবে সে এক দিনের জন্য, গ্রামের যে কোনও বিবাহিত, অবিবাহিত ও কুমারী মেয়ের সঙ্গে থাকবে এবং বাধ্যতামূলক ভাবে সঙ্গম করবে। এর জন্য কেউ গর্ভবতী হলে সেটাকে আশীর্বাদ বলে মনে করবেন গ্রামের সবাই। মহিলারা ঋতুমতী হলে বা সন্তান জন্মের সময় তাঁদের গ্রামের প্রান্তে বাশালেনি নামে একটা ঘরে থাকতে হয়।
সংস্কৃত ভাষাবিদ মিখাইল উইটজেল তাঁর The Origins of the World’s Mythologies বইতে বলেছেন, তিনি কালাশ ধর্মের কিছু প্রবাদ, কিংবদন্তি, আচার ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ঋগ্বেদ বর্ণিত তথ্যের মিল পেয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে কালাশরা প্রাচীন বৈদিক ধর্ম পালন করেন।
একই কথা বলেছেন রচেস্টার ইউনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপোলজির প্রফেসর বারবারা ওয়েষ্ট। তিনি Encyclopedia of the Peoples of Asia and Oceania বইতে বলেছেন ” kalash religion is a form of Hinduism that recognizes many gods and spirits” and that “given their Indo-Aryan language … the religion of the Kalasha is much more closely aligned to the Hinduism of their Indian neighbors”.
কালাশদের মূল ধর্মীয় উৎসব তিনটি। মে মাসে হয় ‘চিলাম জোশি’ ,শরৎকালে ‘উচাউ’, মধ্য শীতে হয় সেরা উৎসব ‘কাউমুস’। পাকিস্তান ইসলামে দীক্ষিত হলেও, এই কালাশ মানুষরা তাঁদের পৌত্তলিকতার সংস্কৃতি মেনে এখনও মন্দিরে প্রাচীন দেবতার পুজো করেন। ঈশ্বরের আবাসকে এঁরা ডেভালক (দেবলোক!) বলেন। তাঁদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘কাউমুস’ হয় একটি ‘টক’ গাছকে ঘিরে হয়। গ্রামের সেই জায়গাটার নাম ইন্দ্রাণকোট (ইন্দ্রকোট!)। কালাশদের প্রধান দেবতা বালুমেন, এছাড়াও আছেন বালুমেন-এর ভাই গরু বাছুরের দেবতা ইনডর( ইন্দ্র!) এবং সরিযান(সূর্য্য!) গসিদাই, মুনজেম মালিক,মাহানদিও, দেজাউ ,জেস্টাক, ডেজলিক নামের দেবতারা।
কালাশ দেবতার কাঠের প্রতিমা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই উৎসবে তাঁরা সারা গ্রামকে ঘিরে মানব শৃঙ্খল তৈরি করেন। মূল মন্দিরে হয় পুজো। পুরোহিতরা জুনিপার গাছের পাতা চামরের মতো ভক্তদের গায়ে বুলিয়ে দেন। দিনের শেষে গ্রামের মাঝখানে ‘চারসো’ নামে একটি জায়গায় সবাই নাচগান, খাওয়া দাওয়া করেন। এই উৎসবে ছাগল উৎসর্গ করা হয়।
কালাশরা বিশ্বাস করেন, এই সময়ে তাঁদের সবচেয়ে শ্রদ্ধার দেবতা ‘বালোমেন’ নাকি উপত্যকায় ঘুরে সকলের প্রার্থনা শোনেন। তাই পাহাড়ে পাহাড়ে বড় আগুন ও মশাল জ্বালানো হয় দেবতাকে শ্রদ্ধা জানাতে। তারপর তাঁরা আগুনের চারদিকে বাঁশি বাজিয়ে,পাইন কাঠ দিয়ে তৈরি ড্রাম বাজিয়ে, হাততালি দিয়ে, গান গাইতে গাইতে বৃত্তাকারে নাচেন।
মন্দিরের দরজা খোলার অপেক্ষায়
সত্যিই কালাশরা গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের সৈন্যদের বংশধর!
তবে তাঁদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন চিহ্ন, সমাজব্যবস্থার ধরন, সংস্কৃতিগত প্রমাণ এবং ডিএনএ রিপোর্টও প্রমাণ করতে চলেছে তাঁরা আলেকজান্ডারের সৈন্যদেরই বংশধর”। অ্যারিস্টটল ইউনিভার্সিটির ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এলিসাভেট মেলা তাঁর সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বলেছেন, কালাশ জনাজাতির মানুষ ও প্রাচীন গ্রীকদের কথ্য ভাষার মধ্যে অস্বাভাবিক মিল রয়েছে। ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, “কালাশ মানুষদের ডিএনএ বলছে, তাঁরা প্রাচীন ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভুত।
শিশুগুলির শরীরে বইছে গ্রীক রক্ত
২০০৪ সালে প্রকাশিত মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) রিপোর্ট বলছে, এশিয়ার সঙ্গে কালাশ উপজাতির জিনগত কোনও সম্পর্ক নেই, মিল আছে পাশ্চাত্যের ইউরেশিয়ানদের। ২০০৭ সালের ওয়াই- ক্রোমোজোমাল ডিএনএ (Y-DNA) রিপোর্টও বলছে একই কথা।
অতঃপর
ইউনিভার্সিটি মাস ডার্টমাউথের ইসলামিক স্টাডির প্রফেসর এবং লেখক ব্রায়ান গ্ল্যিন উইলিয়াম সম্প্রতি হাফিংটন পোষ্ট ম্যাগাজিনে The Lost Children of Alexander the Great: A Journey to the Pagan Kalash People of Pakistan শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন,” উনবিংশ শতাব্দীতে কালাশ উপজাতিকে নির্মমভাবে শেষ করার চেষ্টা করে আফগানরা। তাঁদের প্রাচীন মন্দির ও দেবতার কাঠের মূর্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
আফগানিস্তানের নুরিস্তানে থাকা অসংখ্য কালাশ নরনারী তালিবানি অত্যাচারে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি কালাশরা এখনও তাঁদের হাজার হাজার বছর ধরে আঁকড়ে রাখা ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়ে যাচ্ছেন। কারণ তাঁরা জানেন সুদূর গ্রিস থেকে লড়তে লড়তে এখানে এসেছেন তাঁদেরই রক্তের আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ও তাঁর সঙ্গীরা। স্বাধীনচেতা লড়াকু গ্রিক রক্তের সম্মান এখন তাই মাত্র ৪,০০০ কালাশের হাতে।