Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হারানো কাকাতুয়া || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 4

হারানো কাকাতুয়া || Shirshendu Mukhopadhyay

লাফের চোটে গোবিন্দ

লাফের চোটে গোবিন্দ তিরিশ ফুট খুঁটির ওপরে আরও চারফুট উঁচুতে উঠে গেল। ধনুকের মতো বাঁকা পথে আগুনের বেড়াজাল টপকে গিয়ে পড়ল আরও অন্তত সোল সতেরো ফুট দূরে। অন্য কেউ হলে এই বিশাল লাফের পর মাটিতে আছড়ে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে দ হয়ে থাকত। কিন্তু গোবিন্দ পড়ল বেড়ালের মতো প্রায় নিঃশব্দে, এবং বিনা দুর্ঘটনায়।

পড়ে সে আগুনের দিকে চেয়ে দেখছিল। এত বড় আগুন সে বহুকাল দেখেনি। গেরস্তর খড়ের গাদাগুলো সবই বিশাল। আগুনটাও তেমনি বিকট হয়ে আকাশ ছুঁয়ে চলেছে। তার চেয়েও বড় কথা, একটু দূরে-দূরে আরও দুটো খড়ের গাদা আছে। আগুনটা যেরকম ফুলকি ছড়াচ্ছে, আর শিখা যেমন উত্তরে বাতাসে দক্ষিণামুখো বেঁকে যাচ্ছে, তাতে আর দুটো গাদা আর গেরস্তর বাড়িতেও আগুন ধরল বলে।

গেরস্ত তার বাড়ির মেয়েপুরুষ মিলে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে “গেল, গেল সব গেল! জল দে, জল দে শিগগিরি।”

কিন্তু এই শীতে টানের সময় খালবিল শুকিয়ে দড়ি। কুয়োর জল পাতালে। এই বিশাল আগুন নেভানো সহজ কর্ম নয়। মুনিশরা লাঠি দিয়ে খড়ের গাদায়। পেটাপটি করেছিল বটে, কিন্তু আগুনের তাতে ঝলসে সবাই হটে এল।

অত আগুনের আলোয় চোখ ঝলসে গেছে বলে গোবিন্দর হনুমান লাফটা কেউ লক্ষ করেনি। গেরস্ত বুক চাপড়ে চিৎকার করে বলছিল, বোবা-কালা অবোধ লোকটা সেদ্ধ হয়ে গেল রে। আহা বেচারি চেঁচানোরও সময় পায়নি।

গোবিন্দ পড়েছিল বেগুন-খেতের মধ্যে। সামনে ডালপালার বেশ উঁচু বেড়া। সুতরাং তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এই সময়ে হঠাৎ গোবিন্দর মাথায় একটি বুদ্ধি এল। খড়ের গাদায় আগুন লেগে সে মরেছে, একথাটা প্রচার হয়ে গেলে কেমন হয়? যারা তাকে মারতে চেয়েছিল তারা অন্তত কিছুদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে।

গা-সুদ্ধ লোক আগুন দেখতে ধেয়ে আসছে। গোবিন্দর উচিত ছিল এই অবস্থায় গেরস্তকে কিছু সাহায্য করা। কিন্তু সে দেখল, এই আগুনকে কজায় আনা তার অসাধ্য। গেরস্তর কপাল ভাল থাকলে বাঁচবে।

এই ভেবে গোবিন্দ হামাগুড়ি দিয়ে বেগুন-খেতের পিছনে বাঁশের বন ডিঙিয়ে বাঁশবনে পড়ল। জিনিসপত্র কিছু পড়ে রইল বটে গেরস্তর বাড়িতে, কিন্তু সে তেমন কিছু নয়।

ঘুরপথে হেঁটে সে শহরের রাস্তায় উঠে পড়ল। খুবই অন্ধকার আর ঠাণ্ডা রাত। চারদিকে হিম কুয়াশা। গোবিন্দ তার গায়ের কথাটা পর্যন্ত আনেনি। শীতে একেবারে জমে যাচ্ছে। এই ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় খুব জোরে জোরে হাঁটা। গোবিন্দ হাঁটতে লাগল।

এতকাল ফাঁসির দড়ির ভয় ছিল। পুলিশের ভয় ছিল। এবার তার সঙ্গে এ আর এক অচেনা বিপদ এসে জুটল। সাতনা, কিন্তু আগুন যে সাতনাই দিয়েছে, তার কোনো মানে নেই।

তবে কে? গোবিন্দকে মেরে তার কী লাভ?

ভাবতে ভাবতে কুলকিনারা পায় না গোবিন্দ। সে বুদ্ধিমান বটে, কিন্তু আজকের আচমকা সব ঘটনায় বুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় সবটা বিশ্লেষণ করতে পারছে না।

গাঁয়ের সীমানা ডিঙিয়ে যখন ভোলা মাঠে পা দেবে গোবিন্দ, তখন হঠাৎ পিছনে শুনল কে যেন দৌড়ে আসছে। তবে এক জোড়া পায়ের আওয়াজ।

গোবিন্দ একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেল। লোকটা শক্ত হলেও যদি একা হয় তবে গোবিন্দর ভয় নেই। যে-কোনো একজন লোকের সঙ্গে সে

অনায়াসে পাল্লা টানতে পারবে।

কে যেন ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে ডাকল, “রাখালদা! ও রাখালদা?”

গেরস্তর মেজো ছেলে। গোবিন্দ চাপা স্বরে বলল, “এখানে।”

কাছে এসে হাঁফাতে-হাঁফাতে সে জিজ্ঞেস করল, “পালাচ্ছ কেন?”

“না পালিয়ে উপায় নেই। তোমাদের বাড়িতে কি আগুনটা ছড়িয়েছে।

‘না। গাঁয়ের লোকেরা বড় বড় বাঁশ দিয়ে গাদার আগুন প্রায় ঠাণ্ডা করে এনেছে। খড়ের আগুন বেশিক্ষণ তো থাকে না।”

“আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম যে। মনে হচ্ছিল, তুমি অত সহজে মরবার পাত্র নও। ঠিক বেঁচে যাবে। তোমাকে লাফ দিয়ে বেগুন খেতে পড়তেও দেখেছি।”

“আর কেউ দেখেনি তো?”

“আমাদের বাড়ির কেউই দেখেনি তবে তুমি পালানোর পর লম্বা আর জোয়ান একটা লোক বেগুনখেতে গিয়ে টর্চ জ্বেলে কী যেন দেখছিল। সে এই গাঁয়ের লোক নয়।”

গোবিন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাতনা।

ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কে গোবিন্দ?”

“একটা দুঃখী লোক। দুঃখ অনেক সময় মানুষের ভাল করে। কখনো কখনো খারাপও করে। এ-লোকটার খারাপ করেছে।”

“তার মানে?”

“গল্পটা বলার তো সময় নেই। লোকটা কী করল বল।”

“কিছু করল না। খানিকক্ষণ চারদিক দেখে খুব গম্ভীর মুখে একদিকে চলে গেল।”

“সঙ্গে কাউকে দেখলে?”

“কাউকে না।”

“তাহলে ঐ লোকটাও জানে যে, আমি মরিনি!”

“তা জানতে পারে। কিন্তু আগুনটা দিল কে বলো তো। বাবার ধারণা তুমি বিড়ি খেতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছ। সত্যি নাকি?”

ম্লান হেসে গোবিন্দ বলে, “খেলোয়াড়দের বিড়ি সিগারেট খাওয়া বারণ জানো না?”

ছেলেটা অবাক হয়ে বলে, “তুমি খেলোয়াড় নাকি? কিসের। ‘সারকাসের। কিন্তু সে-গল্পও আর একদিন শুনো।”

“বাঃ রে, এসব কথা আমাকে বলোনি কেন? “তুমি ছেলেমানুষ। তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনি।”

“কিসের বিপদ?”

“এখন বলার সময় নেই।”

গেরার মেজো ছেলে অভিমানভরে বলল, “কিছুই তো আমাকে বলছ। কিন্তু আমি যে তোমাকে খুব ভালবাসতাম।”

গোবিন্দ একটু ভাবল। তারপর বলল, “বেশ কিছুদিন আগে কাশিমের চরে একটা লোক খুন হয়েছিল। তার নাম হরিহর পাড়ুই। জানো?”

“জানি। সারকাসের খেলোয়াড় মাস্টার গোবিন্দর তো সেই জন্যই ফাঁসি হবে।”

“হয়নি। কারণ আমিই গোবিন্দ মাস্টার।”

“তুমি?” বলে যেন ভূত দেখে আঁতকে ওঠে ছেলেটা।

গোবিন্দ তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “খুনটা যে আমি করিনি সেটা অনেকেই বিশ্বাস করে না। তবে হরিহরের সঙ্গে সেই রাতে কাশিমের চরে আমি গিয়েছিলাম বটে।”

“তবে কে খুনটা করল?”

“তা জানি না। কিন্তু জানতেই হবে। যেমন করেই হোক। খুনিকে ধরতে না পারলে পুলিস শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরবেই।”

“তাহলে তুমি পালাও।”

“তাই পালাচ্ছি।”

.

১৭.

উদ্ধববাবু ঠিক করলেন আজকের রাতটা জেগে পাহারা দেবেন। বাড়ির লোকেরা খুব-একটা রাত জাগাতে আগ্রহী নয়। চাকরবাকরেরা দায়ে পড়ে জাগবে বটে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস

নেই! উদ্ধববাবু একাই জাগবেন বলে ঠিক ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর দুজন সঙ্গী জুটে গলে। একজন তার ছোট ছেলে রামু। বাচ্চাদের রাত জাগা উদ্ধববাবু পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু রামুটা বেস ডাকাবুকা আছে, গুলতির হাতটাও বেশ পাকা। লেখাপড়ায় বুদ্ধি না খুললেও অন্যান্য ব্যাপারে যে রামুর বুদ্ধি খুব চটজলদি খেলে তা উদ্ধববাবু জানেন। কাজেই রামু যখন বাবার সঙ্গে পাহারা দেওয়ার প্রস্তাব করল তখন তিনি খুব-একটা আপত্তি করলেন না। কটমট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, “ফুলহাতা সোয়েটার পরে, মাথায় কানে বেশ করে কমফর্টার জড়িয়ে নেবে। পায়ে জুতো মোজা থাকে যেন।” দ্বিতীয় সঙ্গী জুটল নবৃহ বছরেরর জাফর মিঞা। বয়স নবৃই হলেও জাফর মিঞার শরীরটি মেদহীন, দীর্ঘ এবং খুবই কর্মক্ষম। তিনি সামান্য দুধ আর ফল ছাড়া অন্য কোনো খাবার খান না। দিনে পাঁচবার নমাজ পড়েন। তাঁর মাথাটি ঠাণ্ডা, মেজাজটি ঠাণ্ডা, মুখে সর্বদা হাসি। তবে জাফর মিয়া কানে কম শোনেন। উদ্ধববাবুকে সেই ছোট অবস্থা থেকে দেখে আসছেন। সেই উদ্ধববাবুর বাড়িতে ডাকাত পড়বে শুনে তিনি নিজেই যেচে একটা লাঠি হাতে চলে এলেন। গাল কান মাথা ঢাকা বাঁদুরে টুপি, মোটা কম্বল আর নাগরা জুতোয় তাকে বেশ জম্পেশ দেখাচ্ছিল।

উদ্ধববাবু নিজেও সঙ্গে একটা অস্ত্র রাখলেন। বহুকাল আগে তার এক রাজপুত মক্কেল মামলায় জিতে একটা তরোয়াল উপহার দিয়েছিল। বংশের স্মৃতিচিহ্ন। তরোয়ালটা বেশ লম্বা আর ভারী। রাজপুত বলেছিল, এই তলোয়ার যদি খোপ থেকে কখনো বের করেন তবে রক্ত না খাইয়ে খাপে ভরবেন না। আজ পর্যন্ত এই তলোয়র রক্ত না খেয়ে খাপে ঢোকেনি কখনো। এমনি রক্ত না জোটে তো কুকুর-বেড়াল পোকামাকড় যা হোক একটা মেরে নিয়মটা রাখবেন।

উদ্ধববাবু রক্ত খাওয়ানোর কথা শুনে তরোয়ালটা কখনও খাপ থেকে বের করেননি। আজ করলেন। দেখে অবাক হলেন, দশ বছর খাপের মধ্যে একটানা বন্ধ থেকেও তলোয়ারটার গায়ে একটু মরচে পড়েনি। এখনো ঝকঝক

করছে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার, অস্ত্রটা হাতে নিলেই শরীরের রক্ত কেমন একটু চনমন করে ওঠে। ঘোড়ার পিঠে চেপে এক্ষুনি যুদ্ধযাত্রায় পড়তে ইচ্ছে করে।

কিন্তু উদ্ধববাবুর ঘোড়া নেই। ধারেকাছে কোথাও কোনো যুদ্ধও হচ্ছে না। তাই তিনি শূন্যে কয়েকবার তলোয়ারটাকে ঘুরপাক খাইয়ে নিলেন। মনে দুর্জয় সাহস এল।

রাত এগারোটার পর তিনজন বাইরের বারান্দায় শতরঞ্চি পেতে বসলেন। ফ্লাক্সে চা, টিফিন ক্যারিয়ারে লুচি আর আলুর দম। তিনটে নতুন ব্যাটারি ভরা টর্চ।

জাফর মিঞা বললেন, “পুলিশে একটা খবর দিয়ে রাখলে পারতে হে উদ্ধব। বদমাশগুলো যদি দেল বেঁধে আসে তাহলে আমরা তিনজন কী করব?”

উদ্ধববাবু বলেন, “সেটা একবার ভেবেছিলাম। তবে একটা পাখির জন্য পুলিশ পাহার বসালে লোকে আমাকে পাগল ভাববে। তাই অতটা আর করিনি! এমনিতেই আজ আদালতে আমার সম্পর্কে একটু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন হাকিম।”

ভালমানুষ জাফর মিএ কী বুঝলেন কে জানে। শুধু বললেন, “ ভাল। ভাল।”

রাত বারোটার মধ্যেই জাফর মিঞা ঢুলতে লাগলেন। রামু প্রথম দিকটায় তেজে পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু বাচ্চা ছেলে, হঠাৎ কোন সময়ে শতরঞ্চিতে কোণ ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। উদ্ধববাবু একা।

তবে একা হলেও ভয়ের লেশমাত্র তিনি টের পাচ্ছেন না। হাতের তরোয়ালটা ঝকঝক করছে। শরীরের রক্ত এতই গরম হয়ে উঠেছে যে এই শীতেও তার ঘাম হতে লাগল। তিনি প্রথমে আলোয়ানটা খুললেন, তারপর সোয়েটার ছেড়ে ফেললেন। তাতেও গরম বোধ করায় গায়ের জামাটা খুলে সেটা ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে লাগলেন। গায়ের গেঞ্জিটাও ভিজে গেছে ঘামে। সেটাও খুলবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় থানার ঘড়িতে একটা বাজবার ঢং শব্দ হল। উদ্ধববাবু তরোয়াল-হাতে পায়চারি করতে করতে দরবারি কানাড়া রাগের একটি মুড তৈরি করতে লাগলেন। ভারী গভীর এবং গম্ভীর রাগ। তার গলায় রাগটা খোলেও ভাল। গাইতে গাইতে বেশ আত্মহারা হয়ে গেলেন তিনি। পাখির কথা মনে রইল না, পাহারার কথা মনে রইল না। সুরের ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তরোয়ালটাও উঠছিল নামছিল। পা পড়ছিল লেতালে। চোখ বোজা। উদ্ধববাবু স্পষ্টই টের পাচ্ছিলেন, আজ র গলায় অন্য কেউ ভর করেছে। এ যেন তার সেই পুরানো গলাই নয়। সুরের এক মায়ারাজ্য থেকে রাগরাগিণীর বাতাস ভেসে আসছে। চারদিকে এক সুরের সম্মোহন ছড়িয়ে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ বাদে যখন চোখ মেললেন তখন তিনি ঠিক বাস্তবজগতে নেই। নিজের সুরের রেশ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বেশ অনেকটা সময় গেল ধাতস্থ হতে। তখন অবাক হয়ে দেখেন, রামু উঠে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। জাফর মিএ ঘন-ঘন চোখের জল মুছছেন। বারান্দায়, সামনের বাগানে, ডাইনে বাঁয়ে বিস্তর পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হয়েছে। প্রত্যেকেই হাঁ করে দেখছে তাকে।

উদ্ধববাবু একটু লজ্জা পেলেন। গান তিনি ভালই গেয়ে থাকেন বটে, কিন্তু এত রাতে লোক জড়ো হওয়ার মতো ততটা কি? যাই হোক, তিনি হাতজোড় করে শ্রোতাদের নমস্কার জানালেন।

ঠিক এই সময়ে বেরসিক গবা পাগল বলে উঠল, “আপনি তো গানের ঠেলায় পাড়া জাগালেন। ওদিকে যে হয়ে গেছে।”

উদ্ধববাবু মিটিমিটি হেসে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করেন, “কী হল রে আবার?”

“আবার কী?” যেনাদের আসবার কথা ছিল তেনারা এসে কাজ হাসিল করে হাওয়া।

উদ্ধববাবুর মাথাটা আজ বড় ভাল। এই শীতের রাতে গান গেয়ে তিনি সকলের ঘুম ভাঙিয়েছেন। তার সুরের চুম্বকে সকলে ছুটে এসেছে। এই সাফল্যের পর তার এলেবেলে কথা ভাল লাগছে না। তবু গলাটা মিষ্টি রেখেই বললেন, “আরো লোক এসেছিল বুঝি? তা বসতে দিলি না কেন?”

“তারা বসবার জন্য এলে তো বসতে বলব! তারা কাজ গুছোতে এসেছিল, কাজ গুছিয়ে সরে পড়েছে।

তাই নাকি?” উদ্ধববাবু তবু গা করেন না।

গবা পাগলা বলল, “আমিও গোয়ালঘরের চালে বসে পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি আপনি তরোয়াল ঘুরিয়ে গান ধরেছেন। তরোয়ালের ডগাটা একবার রামুর পেটের ধার ঘেষে গেল, আবার জাফরচাচার নাকের ডগা ছুঁয়ে এল। মারাত্মক কাণ্ড। ভাবছি নেমে এসে আপনাকে জাপটে ধরি। ঠিক এই সময়ে নোরা এলেন। পাঁচ-সাতজন তাগড়া জোয়ান। আপনি চোখ বুজে গানে মত্ত।“

তারা আপনার চোখের সুমুখ দিয়ে, বগলতলা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল যন্ত্র দিয়ে, তারপর চোখের পলকে পাখির দাঁড়টা নিয়ে আপনার সুমুখে দিয়েই বেরিয়ে গেল। গান যে কী সবর্বনেশে তা আজ বুঝলাম।

উদ্ধববাবু এখনো সঙ্গীতের সুরলোক থেকে নেমে আসতে পারেননি। চোখে এখনো ঘোর। মিষ্টি করে বললেন, “পাখি নিয়ে গেছে? যাক। পাখি যাক, সুর তো ধরা দিয়েছে। তুই বরং রাঘব ঘোষকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়।”

লোকজনের ভিড় ঠেলে হঠাৎ দারোগা কুন্দকুসুম বারান্দায় উঠে এলেন। মুখ গম্ভীর। বললেন, “উদ্ধববাবু, আপনার মতো বিশিষ্ট লোককে হ্যাঁরাস করতে চাই না। কিন্তু আপনার পাড়া প্রতিবেশীদের কয়েকজন গিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করেছেন যে আপনি গভীর রাতে বিকট চিৎকার করে তাদের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। ইন ফ্যাক্ট, আমিও থানা থেকে একটা চেঁচানি শুনতে পেয়েছি। প্রতিবেশীরা আপনাকে থামানোর জন্য এসে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু আপনি একটি বিপজ্জনক অস্ত্র ঘোরাচ্ছেন দেখে তারা কেউ কাছে আসতে ভরসা পাননি। তাদের ধারণা, আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আপনার বিরুদ্ধে বিপজ্জনক অস্ত্র রাখা ও ব্যবহার এবং লোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটানোর দু-দফা অভিযোগ। আমি আপনাকে গ্রেফতারও করতে পারি। কিন্তু অতটা না-করে আজ কেবল একটা ওয়ার্নিং দিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আর এরকম করবেন না।“

কুন্দকুসুম চলে যাওয়ার পর উদ্ধববাবু সুরলোক থেকে দড়াম করে বাব জগতে নেমে এলেন। কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তিনি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “পাখিটা তবে নিয়ে গেছে?”

গবা বলল, “তবে আর বলছি কী?”

উদ্ধববাবু খিঁচিয়ে উঠলেন, “তবে চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গেল, তুই কিছু করলি না?”

গবাও সমান তেজে বলে, “সে তো আপনারও চোখের সামনেই নিয়ে গেছে। আমাকে দোষ দিচ্ছেন শুধু-শুধু। আমি একা অতজনের সঙ্গে পারব কেন?”

“চেঁচাতে তো পারতিস!”

গবা হেসে বলে, “আজ্ঞে, আপনার গানের চোটে আর সব শব্দ তো লোপাট হয়ে গিয়েছিল আমার চেঁচানি শুনবে কে? তবু চেঁচিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার গলার দাপটে আমার চেঁচানি ঢাকা পড়ে গেল।”

জাফর মিঞা হঠাৎ একগাল হেসে বললেন, “উদ্ধব আমি বেশ শুনতে পাচ্ছি। বুঝলে! হঠাৎ কানের ভিতরকার ঝিঝি ভাবটা কেটে গেছে।”

উদ্ধববাবু কটমট করে তাকিয়ে বলেলেন, “তাই নাকি?”

ওঃ তোমার গান যে কী উপকারী তা আর বলার নয়। প্রথমটায় একটু আঁতকে উঠেছিলাম বটে। কিন্তু তার পর থেকেই কান ভেসে যাচ্ছে হাজার রকম শব্দে।

‘‘ বলে উদ্ধববাবু তবোয়াল-হাতে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিলেন। রক্ত না-খাইয়ে তরোয়াল খাপে ভরা বারণ। উদ্ধববাবু তরোয়ালটার দিকে চেয়ে বললেন “খাওয়াচ্ছি রক্ত। নে খা।”

বলে তরোয়ালটা দিয়ে নিজের কণ্ঠনালী চেপে ধরলেন।

.

১৮.

ভোর রাত্রে সামন্তমশাইয়ের তাঁবুতে একটা লোক ঢুকল। চাপা গলায় ডাকল, “সামন্তমশাই!”

সামন্ত ঘুম পাতলা। এক ডাকেই জেগে লক্ষ্যটা উসকে দিয়ে বলে “কে?”

“আমি গোবিন্দ। শুনলাম সারকাস এখান থেকে চলে যাচ্ছে।”

সামন্ত একটা শ্বাস ফেলে বলে, “রাত ভোর হলেই গোছগাছ শুরু হবে। বেলাবেলিই রওনা হওয়ার কথা।”

“আমি কি পড়ে থাকব এখানে? আমাকেও সঙ্গে নিন।”

সামন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তোকে না নেওয়া কি আমার ইচ্ছে? কিন্তু পুলিশ কড়া নজর রাখছে। যেখানে যাব সেখানেও রাখবে। লুকিয়ে থাকতে তো পারবি না।”

“তাহলে?”

“তাহলে যে কী তা আমার মাথায় খেলছে না। রোজই তোর কথা ভাবি। কিন্তু কোনো ফন্দিফিকির খুঁজে পাচ্ছি না!”

“সারকাস ছাড়া যে আমি বাঁচব না।” বলে গোবিন্দ সামন্তর বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। তার চোখে জল।

সামন্ত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “কী যে গেরোয় পড়েছিস বাবা। ভগবান তোকে কেন এমন বিপদে ফেলল তাও বুঝি না। ভাল লোকেরাই দেখছি এই দুনিয়ায় সবচেয়ে হতভাগ্য।”

গোবিন্দ মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটু কাঁদল। তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি আমার বাবার মতো আপনাকেই তাই বলতে বাধা নেই। আমি ভাল লোক নই সামন্তমশাই।

সামন্ত চোখ বড়-বড় করে বলে, “তোকে আমি এইটুকু বয়েস থেকে জানি। বলতে কি আমার কাছেই প্রতিপালিত হয়েছিস। কোনোদিন চুরিটুরি করিস নি, মিথ্যে কথা বলিস নি, লোকে বিপদে পড়লে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করেছিস, তবু তুই ভাল লোক নোস, এ আবার কেমন কথা?”

গোবিন্দ চোখের জল মুছে বলে, “সে-সব আপনিই শিখিয়েছেন। ভাল লোকের কাছে থাকলে লোকে সৎ শিক্ষাই পায়। কিন্তু কয়লা ধুলে কি ময়লা যায়? আমার ভিতরে যে গরল ছিল।”

“সে আবার কী কথা?”

গোবিন্দ ধীর গম্ভীর গলায় বলে, “হরিহরকে আমি খুন করি নি বটে, কিন্তু আমার মনে পাপ ছিল। গুপ্তধনটা খুঁজে পেলে আমার ইচ্ছে ছিল, হরিহরকে খুন করে সবটুকু আমি হাতিয়ে নেব। তারপর সেই টাকায় নিজের একটা সারকাসের দল খুলব।”

“বটে।” সামন্ত একটু বিষমুখে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি তো তোকে অনেকবার বলেছি, আমি মরলে এই সারকাস তোরই হবে। আমি জানি, তোর মাথায় ব্যবসা করে টাকা রোজগারের মতলব নেই। সারকাস একটা আনন্দের জিনিস। লোকের কাছ থেকে পয়সা আমরা নিই বটে কিন্তু সেটাই কথা নয়। বড় কথা হল, ছোট-ঘোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে সাহস আর আনন্দ জাগিয়ে তোলা আর নিজেরাও তা থেকে আনন্দ পাওয়া। লোভ থাকলে ভাল খেলোয়াড় হওয়া যায় না, ভাল মানুষ হওয়া যায় না। তার হঠাৎ লোভ এল কোথা থেকে?”

“লোভটা বাইরে থেকে আসে না, সামন্তমশাই। লোভ মানুষের ভিতরেই থাকে।” গোবিন্দের চোখে আবার জল। চোখ মুছে সে বলল, “হরিহরকে খুন করার কথা ভেবেছিলাম দুটো কারণে। একে তো হরিহরের মতো বদমাশ দুটো নেই। আর একটা কারণ হল, আমি ওকে খুন না করলে ও-ই আমাকে খুন করত।”

সামন্ত চোখ ছোট করে খুব একদৃষ্টে গোবিন্দর দিকে চেয়ে ছিল। বলল “তোর সঙ্গে হরিহরের চেনা-পরিচয় হল কী করে?”

“হরিহরকে সবাই চিনত। আমরা যখন কাশিমের চরের কাছে খেলা দেখছিলাম তখন একদিন হরিহর আমার কাছে লুকিয়ে আসে। আমাকে বলল, সে এক জায়গায় গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। আমি যদি সেই গুপ্তধন উদ্ধারে তাকে সাহায্য করি তাহলে সে আমাকে অর্ধেক বখরা দেবে। গুপ্তধনের কথা গুনেই প্রথম আমার ভিতরে লোভ জেগে উঠল।”

“সন্ধান পেয়েছিলি?”

“না। গুপ্তধনটা ছিল এক বুড়ির। সে সম্পর্কে হরিহরের পিসি হয়। সেই বুড়ির তিন কুলে কেউ নেই? এমন-কী সেই গুপ্তধনও নাকি বুড়ি চোখে দেখে নি। তবে সন্ধানটা সে-ই জানত। বুড়ি একটা কাকাতুয়া পুষত, আর সেটাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসত। গোপনে নাকি বুড়ি কাকাতুয়াটাকে সেই গুপ্তধনের সন্ধান শিখিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর কাউকে বলত না। হরিহর বুড়ির গুপ্তধনের সন্ধান জানার জন্য বিশু নামে নিজের এক সাকরেদকে পিসির বাড়িতে চাকরের কাজ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বিশুও কোনো সন্ধান রে, করতে পারে নি। তবে একদিন বিশু কাকাতুয়াটাকে চুরি করে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে হরিহর বিশুর পিছু ধাওয়া করে এক মাঠের মধ্যে তাকে খুন করে। কিন্তু বিশু খুন হওয়ার আগে পাখিটার পায়ের শিক্‌লি খুলে উড়িয়ে। দেয়। ওদিকে হরিহরের পিসি কাকাতুয়ার শোকে মারা যায়। তবে মরার আগে সে যখন ভুল বকছিল তখন হরিহর সেইসব কথা থেকে গুপ্তধনের জায়গাটা আঁচ করে ছিল। কিন্তু তা উদ্ধার করা বড় সহজ কাজ ছিল না। তাই আমার কাছে এসেছিল হরিহর।”

“তারপর কী হল?”

“সে অনেক ঘটনা। কাশিমের চরে একটা মস্ত পুরনো বাড়ি আছে। সেই বাড়ির অনেকগুলো গম্বুজ আছে। কোনো গম্বুজেই উঠবার কোন সিঁড়ি নেই। আর এমন সমান করে তৈরি যে কোন খাজ-টাজও নেই যা বেয়ে ওঠা যায়। হরিহর বলেছিল তার মধ্যে একটা গম্বুজের মাথায় নাকি একটা ঢাকনা নীচে গভীর এক কুয়োর মুখ। গম্বুজের মাথা থেকে সেই কুয়ো নেমে একেবারে মাটির তলায় চলে গেছে। আর মাটির তলায় কোনো কুঠুরীতে আছে সেই গুপ্তধন। সেই কুঠুরিতে পৌঁছানো খুব শক্ত কাজ। সারকাসের খেলোয়াড় ছাড়া সে-কাজ করার সাধ্য খুব কম লোকের আছে।”

“তুই হরিহরের কথায় রাজি হলি?

“প্রথমে হইনি। পরে লোভ হল। ভীষণ লোভ। মনে হল, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার এমন সুযোগ আর পাব না।”

“তা বলে খুনের কথা ভাববি?”

“লোভ একটা নেশার মতো সামন্তমশাই, যখন ঘাড়ে চাপে তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না।”

“তারপর কী হল?”

“কথা ছিল, আমি সন্ধেবেলা সেই পোড়ো বাড়িতে হাজির থাকব। হরিহর আসবে। কিন্তু সে সময়তো এল না। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই বাড়িতে বহু গম্বুজ। কোটা যে গুপ্তধনের সুড়ঙ্গ তা তো জানি না। হরিহর এসে চিনিয়ে দেবে। কিন্তু সে আর হল না। কাশিমের চরে অন্য একদল বদমাশের হাতে হরিহর খুন হয়ে গেল সেই রাতে। আমার চোখের সামনেই ঘটনা। দোষের মধ্যে আমি গিয়ে হরিহরের লাশটাকে নাড়াচাড়া করেছিলাম, বেঁচে আছে কিনা দেখতে। যদি তার কাছ থেকে কোনো কথা আদায় করা। যায়। ঠিক সেই সময়ে কিছু লোক এসে পড়ল সেখানে। ধরা পড়ে গেলাম।”

“তুই বলেছিলি, জেলখানা থেকে তোকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেটা কেন দেওয়া হল তা জানিস?”

গোবিন্দ একটু হেসে বলল, “একটু-একটু বুঝতে পারি। জেলখানায় পুরনো এক ডাকাতির দাগি আসামী আছে। এখন সে ওয়ার্ডেন। কথায় কথায় তাকে একদিন গুপ্তধনের গল্পটা বলেছিলাম। মনে হয় লোকটা সেই থেকে লোভের খপ্পরে পড়ে গেছে। আমার ফাঁসি হলে তো সে আর গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যাবে না। তাকে আমি জায়গাটার নাম বলতেও রাজী হই নি। কাজেই সেপাইদের। সঙ্গে বন্দোবস্ত করে সে সে আমাকে পালানোর পথ করে দিয়েছিল। সে তো জানে পালিয়ে গিয়ে আমি সেই গুপ্তধনের সন্ধান করবই। গুপ্তধন উদ্ধার করবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পাকড়াও করা হবে। শুনেছি সেই দাগি আসামীর দলটা এখনো বেশ দাপটে ডাকাতি করে বেড়ায়, আর সে জেলে থেকেও তাদের সর্দার।

.

১৯.

গলায় তরোয়ালের ধারালো দিকটা চেপে ধরে উদ্ধববাবু চোখ বুজে দুর্গানাম স্মরণ করে বিড়বিড় করে বললেন, “দুর্গে দুর্গতিনাশিনী মাগো! সন্তানকে কোলে তুলে নাও মা। দেখো, যেন বেশি ব্যথা-ট্যথা না পাই, রক্তপাত যেন বেশি না হয়। মরার পর যেন ভূত-টুত হয়ে থাকতে না হয়। সব দেখো মা!” বলতে বলতে তরোয়ালটায় একটু চাপ দিয়েছে।

আত্মহত্যর বিভিন্ন পন্থা নিয়ে চিন্তা করতে করতেই উদ্ধববাবু শোওয়ার ঘরে ঢুকেছিলেন। তরোয়ালটা হাতেই ছিল। রক্ত না খাইয়ে সেটাকে খাপে ভরা বারণ। সুতরাং তিনি চটপট স্থির করে ফেললেন, এক কাজে দুই কাজ সেরে ফেলাই ভাল।

“কে যেন খুব কাছ থেকে বলে উঠল “বাবামশাই, লুচি খাব।”

উদ্ধববাবু চোখ খুললেন। অবাক হয়ে দেখলেন, উত্তর দিকের জানালার গরাদ দিয়ে কাকাতুয়াটা সেঁধিয়ে ঘরে ঢুকছে। টালুক-টুলুক করে দেখছে তাকে। চোখে চোখ পড়তেই বলল “সব ভাল যার শেষ ভাল।”

উদ্ধববাবু তরোয়াল রেখে দিয়ে কাকাতুয়াটাকে বুকে তুলে নিয়ে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেললেন। ধরা গলায় বললেন, “তোর জন্যেই এ-যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলাম বাপ, কত লুচি খেতে চাস? তোকে ফাঁসির খাওয়া খাওয়াব।” বলে ভিতর-বাড়ির দিকে মুখ করে হাঁক দিলেন, “ওরে নয়নকাজল, শিগগির লুচির জন্য ময়দা মাখ।”

কিন্তু নয়নকাজল তখন ময়দা মাখার মতো অবস্থায় তো আর নেই। বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে একটা জঙ্গলের মধ্যে সে মাটির ওপর চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার বুকের ওপর দানবের মতো একখানা পা রেখে দাঁড়িয়ে সাতনা। গলায় বল্লমটা চেপে ধরে সাতনা বলছে, “প্রাণে বাঁচতে চাস তো সত্যি কথা বল।”

ভয়ে নয়নকাজল বাক্যিহারা হয়ে গেছে। দোষটা, অবশ্য তারই। পরশুদিনই একটা লোক তার মামাতো ভাই সেজে এসে তাকে দুশো টাকা দিয়ে বলে গেছে, “আমরা ঠিক সময়মতো আসব। উদ্ধব বাধা দেবে দিক। তুই পাছ দুয়ার দিয়ে পাখিটা বের করে দিবি।” নয়নকাজল সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পাখি গুপ্তধনের সন্ধান জানে। এমন পাখি হাতছাড়া করার জন্য মাত্র দুশো টাকায় রফা করে কোন আহাম্মক! সে পাপষ্টি বলে দিল “ওসব হবে না। আমাকে ভাগ দিতে হবে। পাখি নিয়ে আমি তোমাদের সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব।”

সেই কথাই ঠিক ছিল। ডাকাতরা বাড়ি ঢুকতেই নয়নকাজলও পাখিটাকে দাঁড় থেকে খুলে র‍্যাপারে চাপা দিয়ে পাছ-দুয়ার খুলে বেরোয়। তারপর সবাই মিলে হাঁটা দিয়েছে জঙ্গলের দিকে। কিন্তু কাকাতুয়া খুব ছোটখাটো পাখি তো নয়? বেশ বড়সড়, আর ওজনও অনেকটা। জঙ্গলের কাছ-বরাবর এ-বগল থেকে ও-বগলে নেওয়ার সময় পাখিটা হঠাৎ ঝাঁপটা মেরে উড়ে গেল।

নয়নকাজল সাতনার দিকে চেয়ে চি-চি করে বলল, “মাকালীর দিব্যি বলছি, হাতটায় ঝি-ঝি ধরেছিল বলে, ইচ্ছে করে ছাড়িনি।”

দলের ষণ্ডামতো আর-একটা লোক সাতনাকে ডেকে বলল, “এক্ষুনি মারিস। ওটাকে দিয়ে কাজ হবে।”

সেই লোকটা এসে সাতনাকে সরিয়ে নয়নকাজলকে টেনে দাঁড় করাল। তারপর দু-গালে ফটাস ফটাস করে দুখানা চড় মেরে বলল, “আবার যা। এবার শুধু পাখি নয়, উঁকিলের ছোট ছেলেটাকেও চুরি করবি। উকিলটা মহা উঁদড় আছে। থানা-পুলিশ করতে পারে। ছেলেটা আমাদের হাতে থাকলে তা আর করতে সাহস পাবে না।” চড় খেয়ে নয়নকাজলের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত ঝিনঝিন করছিল। সে কোনো মতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সাতনা তার গলায় বল্লমটা আবার ধরে বলল, “শোন্ বাপু, গুপ্তধনের ভাগ চাস সে অনেক বড় কথা। কিন্তু এখন প্রাণ বাঁচানোর জন্যই ঠিক ঠিক কাজ করিস। একটু গুবলেট হলে যমদোরে গিয়েও আমাদের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। মনে থাকবে?”

নয়নকাজল মাথা নাড়ল। একটু দম নিয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

বাড়ি পৌঁছুতে ফর্সা হয়ে গেল চারদিক। উদ্ধববাবুর হুংকারে পাড়া কঁপছে। “কোথায় গেল সেই পাজি ছুঁচোটা? সেই তখন থেকে কাকাতুয়া লুচি লুচি করে হেদিয়ে মরছে!”

নয়নকাজল হাঁফাতে হাঁফাতে উদ্ধববাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “আজ্ঞে বাবামশাই, ধরতে ধরতেও ধরতে পারলাম না। একটুর জন্য….”

উদ্ধববাবু নয়নকাজলের উড়োখুড়ো চেহারা দেখে আঁতকে উঠে বললেন, “কাকে ধরতে পারলি না?”

‘দলে পাঁচ জন ছিল। হাতে ঈয়া বড় দা, বন্দুক, কুড়ুল, বল্লম। তা ভাবলাম, যার নুন খাই তার জন্য না হয় প্রাণটা দেব। পাখিটা চুরি করে যেই না তারা পালাচ্ছে। আমিও লাঠি নিয়ে পিছু ধরলাম। মাইলটাক পর্যন্ত দৌড়ে ধরেও ফেলেছিলাম প্রায়। কিন্তু ভয় খেয়ে তারা এমন ছুটতে লাগল যে, একটুর জন্য…….”

উদ্ধববাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুঁ! ঠিক আছে, এখন গিয়ে দু’সের ময়দা মাখ ভাল করে। ডাকাতদের ব্যবস্থা আমি করছি।”

নয়নকাজল উদ্ধববাবুর কাঁধে বসা পাখিটার দিকে কটমট করে একবার চেয়ে ময়দা মাখতে গেল।

.

২০.

গতকাল রাতে কাকাতুয়াকে চুরি করতে ডাকাত এসেছিল কিন্তু চুরি করতে পারেনি। সকালে কাকাতুয়াকে লুচি খাইয়ে উদ্ধববাবু থানায় গেলেন। এতকাল এ-ব্যাপারে পুলিশকে জড়াননি তিনি। কিন্তু রাত্তিরে যা হয়ে গেল তাতে তিনি ভাবনায় পড়েছেন। ডাকাতদলকে ঠেকানো তো একার কাজ নয়।

উদ্ধববাবু উকিল হিসেবে খুবই ডাকসাইটে। সবাই তাকে খাতিরও করে। কুন্দকুসুমও করতেন। কিন্তু রাত্রির ঘটনার পর আজ যেন উদ্ধববাবুকে তিনি বিশেষ পাত্তা দিতে চাইছিলেন না। ঘটনাটা শুনে বরং হোঃ হোঃ করে খানিক হেসে বললেন, “একটা পাখির জন্য সাতটা ডাকাত কাল আপনার বাড়ি চড়াও হয়েছিল, এ-কথা নিতান্ত আহাম্মক ছাড়া কে বিশ্বাস করবে বলুন!”

উদ্ধববাবুও জানেন, পাখির জন্য ডাকাতি হয় এ-কথা কেউ বিশ্বাস করবে। কিন্তু তাঁর পাখিটা যে গুপ্তধনের সন্ধান জানে এ-কথাটাও তিনি ফাস করতে চান না। গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, “পাখিটা আসলে খুব দামি। রেয়ার টাইপের জিনিস।”

কুন্দকুসুম ভ্রূ কুঁচকে উদ্ধববাবুকে একটু দেখে নিয়ে ফিচেল হাসি হেসে বললেন, “একটা খুব রেয়ার পাখিরও দাম নিশ্চয়ই এত বেশি হতে পারে

যার জন্য বাড়িতে ডাকাত পড়বে। আপনি কি আমাকে ছেলেমানুষ পেলেন উদ্ধববাবু?”

কথাটা যুক্তিযুক্তই। কিন্তু কুন্দকুসুম তো আর গোপন কথাটা জানেন না। উদ্ধববাবু তাই মাথা চুলকে বললেন, “সে যাই হোক, আমার বড় ভয় করছে। আজ রাত থেকে আমার বাড়িতে দুজন আর্মড গার্ড যদি রাখেন তবে বড় ভাল হয়।”

কুন্দকুসুম মাথা নেড়ে বললেন, “অসম্ভব। আমার হাতে যে ফোর্স আছে তা নিতান্তই সামান্য। তার ওপর এই থানার সব জায়গায় রিসেন্টলি ক্রাইম ভীষণ বেড়ে গেছে। ইন ফ্যাক্ট একজন ফেরারি খুনি আসামীর জন্য আমাকে সদর থেকে এক্সট্রা ফোর্স আনতে হচ্ছে। আপনি যত বড় উকিলই হোন উদ্ধববাবু, এই অবস্থায় আপনার পোষা পাখিকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক দিতে পারব না। মাপ করবেন!”

উদ্ধববাবু মরিয়া হয়ে বললেন, “ডাকাত যে পড়েছিল তার কিন্তু সাক্ষী আছে। তারা দরকার হলে আদালতে বলবে যে, আপনি আমার বিপদ জেনেও প্রোটেকশন দেননি।”

“বটে!” বলে কুন্দকুসুম সোজা হয়ে বসে কটমট করে উদ্ধববাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি আমার বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন বলে ভাবছেন। কারা সাক্ষী আছে বলুন তো! আমি তাদের স্টেটমেন্ট নেব।”

“গবা আছে, আমার ছোট ছেলে রামু আছে, জাফরচাচা আছে।”

কুন্দকুসুম বাজখাই গলায় আবার হাঃ হাঃ করে হাসলেন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “রামু বা জাফরচাচা সাক্ষ্য দেবে না। ওরা কিছু দেখেনি। বরং সাক্ষ্য দিলে ওরা উলেটো কথাই বলবে। এরা বলবে যে, আপনি বিপজ্জনক এক অস্ত্র নিয়ে বহু লোকের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন, বিকট চিৎকার করে লোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন।”

“ওরা দেখেননি!” চিন্তিত উদ্ধববাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “কিন্তু গবা তো দেখেছে।”

“গবাকে সাক্ষী দাঁড় করালে দেশসুদ্ধ লোকের কাছে আপনি হাস্যাস্পদ হবেন। কারণ সবাই জানে গবা বদ্ধ উন্মাদ। পাগলের সাক্ষ্য টেকে না, উকিল হয়ে এটা আপনার জানা উচিত ছিল।”

উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠলেন।

কুন্দকুসুম পিছন থেকে তিক্তমধুর গলায় বললেন, “সকালে আপনি রটিয়েছিলেন যে, আপনার পাখিটা চুরি গেছে বা ডাকাতি হয়েছে। কিন্তু আমি খবর রাখি যে, পাখিটা এখনো আপনার কাছেই আছে।”

উদ্ধববাবু কী একটা বলতে গেলেন, কিন্তু শেষ অবধি বললেন না। বলে লাভও নেই। এই মাথামোটা লোকটা তাকে বিশ্বাস করবে না। আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।

পাখিটার জন্য আজ রাতে ডাকাতরা আর একবার হানা দিতে পারে। সুতরাং সন্ধের আগেই উদ্ধববাবু তৈরি হতে লাগলেন। তবে অসুবিধে দেখা দিল লোকজন জোটানোর বেলায়। জাফরচাচাকে বলতে গিয়েছিলেন উদ্ধববাবু, “চাচা, আজও আমার সঙ্গে রাতটা গল্পগুজব করে কাটাবেন নাকি?”

জাফর মিঞা আঁতকে উঠে বললেন, “কানে শোনার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছি ভাই, সেটা আবার হারাতে চাই না। তাছাড়া আজ বাতের ব্যাথাটাও চাগাড় দিয়েছে।” |||||||||| উদ্ধববাবু রামুকে ডাকাডাকি করলেন, কিন্তু তার সাড়া পাওয়া গেল না। এমন কি নয়নকাজলকে পর্যন্ত ডেকে গলা ভেঙে ফেললেন। “কোথায় যে সব থাকে!” বিরক্ত হয়ে এই কথা বলে সন্ধেরাত্রিতেই উদ্ধববাবু বন্দুক কাঁধে নিয়ে বাড়ির চারদিকটা টহল দিলেন। টর্চ জ্বেলে বাড়ি সবচেয়ে দুর্বল অংশ কোটা এবং কোথা দিয়ে ডাকাতরা বাড়িতে ঢুকতে পারে তা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেন। বাড়িটা তার খুবই মজবুত এবং নিরাপদ। কিন্তু তা বলে কি আর রন্ধ্র থাকতে পারে না! লখিন্দরের বাসরঘরেও তো র ছিল।

ওদিকে তার স্ত্রী এবং অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও বাড়ির চারদিকে সার্চ করতে লেগে গেছে।

উদ্ধববাবু খিড়কির দরজাটা পেরেক দিয়ে একেবারে সেঁটে দিলেন, তারপর কয়েকটা পাথরের চাই এনে ঠেকা দিলেন তাতে। বাড়ির চারদিকে উঁচু পাঁচিলের

ওপর উঠে কাঁটাতার বিছিয়ে দিলেন। আর সামনের বারান্দায় সরষের তেল ঢাললেন। অনেকগুলো কলার খোসা ছড়িয়ে রাখলেন। ডাকাতরা হুড়মুড় করে এলে যাতে আছাড় খায়। কেলেহাঁড়ি দিয়ে একটা কাকতাড়ুয়াও বানালেন। সেটাকে সামনের দরজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন।

সবই হল, কিন্তু নয়নকাজলের পাত্তা নেই। সে নাকি বিকেলের দিকে দোকানের সওদা করতে গেছে। এখনো ফেরেনি। রামু গেছে খেলার মাঠে। তারও কোনো পাত্তা নেই। উদ্ধববাবু বেশ উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত। কী করবেন ভেবে না পেয়ে তিনি স্টোর রুমে তালা দিয়ে রাখা পাখিটাকে দেখতে গেলেন।

তালা খুলে তার চোখ কপালে উঠল। দাঁড় ফাঁকা। পাখির পালকটিরও পাত্তা নেই।

পাখি-রামু-নয়নকাজল! দুয়ে দুয়ে চার করতে উদ্ধববাবুর দেরি হল। অবশ্য পাখির দাঁড়ে একটা চিরকুটও লটকানো ছিল। তাতে লেখা-”পাখিটা বিধিসম্মত মালিকের হস্তগত হইয়াছে। ব্যাপারটি লইয়া শোরগোল করিলে আপনার কনিষ্ঠ পুত্রের প্রাণ সংশয় হইবে। জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী।”

কিন্তু তবু শোরগোল হল। পাড়া প্রতিবেশীরা খবর পেয়ে ছুটে এল। কিন্তু তাতেও দেখা দিল প্রবল গণ্ডগোল। বারান্দায় আর উঠোনে ধপাধপ লোজন আছাড় খাচ্ছে আর “বাবা রে, মা রে, গেছি রে” বলে চেঁচাচ্ছে। খুন্তিবুড়ি চোখে কম দেখেন। তিনি সামনের দরজায় কাকতাড়ুয়াটাকে দেখে ভূত ভেবে সেই যে ভিরমি খেলেন আর চোখ খোলার নামটি নেই। সামনের বারান্দায় ভিড় হওয়ায় জনাকয় লোক পাঁচিলে উঠেছিল। কাঁটাতারে জামা কাপড় আটকে তাদের বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। রামুর মা আর ঠাকুমা ডুকরে কাঁদতে লেগেছে, রামুর ভাইবোনেরা কাঁদছে। এই গোলমালে মাথা ঠাণ্ডা রাখা দায়। বারবার সবাইকে চুপ করতে বললেন উদ্ধববাবু। কে শোনে কার কথা! অবশেষে এই গোলমালে অসহ্য হয়ে উদ্ধববাবু বন্দুকটা আকাশে তাক করে দুম দুম করে দুটো ফায়ার করলেন। তাতে ফল হল উলটো। যারা কঁদছিল তারা আরো জোরে কাঁদতে লাগল। পাড়াপড়শির বাচ্চারা ভয় খেয়ে চেঁচাতে লাগল। বন্দুকের শব্দে যারা চমকে উঠে পালাবার ভাল করেছিল তারা ফের কলার খোসা আর তেল-হড়হড়ে মেঝেয় আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তবে উপকার হল একজনের। ভিরমি কেটে উঠে পড়লেন খুন্তিবুড়ি।

কিছুক্ষণ বাদে লোকজন বিদেয় হল, কুন্দকুসুম তদন্তে এলেন। চারদিক ঘুরেটুরে দেখে বললেন, “আপনার বন্দুকের লাইসেনস আছে তো?”

“আছে।” উদ্ধববাবু বুক চিতিয়ে বললেন।

কুন্দকুসুম বুক ফুলিয়ে বললেন, “থাকলেই কী! যখন-তখন ফায়ার করার আইন কিন্তু নেই। যাকগে, আপনার মন আজ অস্থির, বন্দুকের ব্যাপারে তাই কিছু বলছি না। আর রামুকে কিডন্যাপ, পাখিটা চুরি এবং নয়নকাজলের উধাও হওয়া–এগুলো আমার নোট করা রইল।”

কুন্দকুসুম চলে যাওয়ার পর বেশ একটু রাতের দিকে গবা পাগলা এসে ঢুকল। তার মুখ থমথমে।

উদ্ধববাবু বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে ভাবছেন। হাতে এখনো বন্দুক। ডাকাতরা শোরগোল করতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু শোরগোল কিছু বেশিই হয়ে গেছে। এখন রামুর কী হয় সেইটে নিয়েই তাঁর চিন্তা।

গবা ডাকল, “বাবু।”

“কী বলছিস?”

“একজন কাজের লোক রাখবেন? খুব ভাল লোক।”

এই দুঃসময়ে পাগলটা চাকর রাখার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে দেখে উদ্ধব অবাক হন। বলেন, “কী বলছিস?”

গবা তখন উদ্ধবের কানে-কানে চুপি-চুপি কটা কথা বলল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress