Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হাঙরের পেটে হিরে (২০১৩) || Samaresh Majumdar » Page 2

হাঙরের পেটে হিরে (২০১৩) || Samaresh Majumdar

৪.

ঠিক আটটায় ওরা হোটেল ছেড়ে বের হল। কিছুদিন আগে একটা চমৎকার সামারজ্যাকেট কিনেছিল অর্জুন, মেজরের সঙ্গে, টাইম স্কোয়ারের একটা দোকান থেকে। সেটা চাপানোয় এখন গরম লাগছে। লস অ্যাঞ্জেলিসের আবহাওয়া পাজামা-পাঞ্জাবি পরার মতো। নিউইয়র্কের ভয়ংকর শীতের ছায়াও এখানে নেই। ওরা খানিকটা হাঁটতে মেজর লাঠিটা ঠুকে ফুটপাতের দিকে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। অর্জুন দেখল, ফুটপাতের ওপর পেতলের প্লেট সার-সার আটকানো। প্রতি প্লেটে এক-একজন বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী অথবা পরিচালকের নাম খোদাই করা। ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্ক, ক্যাথরিন হেপবার্ন, গ্রেগরি পেক, রক হাডসন, গ্রেটা গার্বো থেকে শুরু করে চার্লি চ্যাপলিন, হিচকক, সর্বত্র ছড়িয়ে। এঁদের ওপর দিয়ে মানুষজন হেঁটে যায়। হাঁটার সময় প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হয়, এঁরা ছিলেন। হেনরি বললেন, ফুটপাতের প্লেটে নাম না-ওঠা পর্যন্ত হলিউডের শিল্পী-পরিচালকরা জাতে ওঠেন না। অর্জুনের খুব মজা লাগছিল। সে জানত, খোদ হলিউড এখান থেকে বেশি দূরে নয়। বস্তুত এখানেই তার কিছুটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ডানদিকে এক জাপানি বাজিকর বাজি দেখাচ্ছে টিকিট বিক্রি করে। প্রেক্ষাগৃহের সামনে জাপানিদের ভিড়। টেলিফোনের হুঁশিয়ারির কথাটা অর্জুন এখনও মেজরকে জানায়নি। জানালে উনি যেমন বুক চিতিয়ে, থ্রি পিস সুট পরে লাঠি ঝুলিয়ে হাঁটছেন, তেমন হাঁটতেন কিনা সন্দেহ। হেনরি ডিমকও বেশ সাজগোজ করেছেন।

সাহেব দারোয়ান সেলাম করে দরজা খুলে দিতেই একটা রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকে গেল ওরা। চোরা আলোর ব্যবস্থা থাকলেও টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে খাবার সার্ভ করে এরা। কোণের দিকে একটা টেবিলে বসল ওরা। অর্জুনের মনে হল জায়গাটা বেশ অভিজাত। মেজর এবং হেনরি হলিউডের ইতিহাস নিয়ে গল্প করছেন। ব্যাপারটা সত্যিই মজাদার, কিন্তু অর্জুনের নজর চারপাশে ঘোরায় সে মন দিতে পারছিল না। মৃত্যু বারবার খালি হাতে ফিরে যায় না। যারা তাদের সব খবর রাখছে, তারা নিশ্চয়ই এখানে অনুসরণ করে এসেছে। কিন্তু এখানে এই অভিজাত জনসাধারণের মধ্যে কে তাদের লক্ষ করছে, তা ধরা শক্ত। সে চোখ ঘোরাতেই চমকে উঠল। ঠিক তাদের পাশের টেবিলে এক ভদ্রমহিলা একজন কিশোরের সঙ্গে খাচ্ছেন। ভদ্রমহিলাকে তার খুব চেনা মনে হচ্ছে। এবং তখনই নামটা মাথায় এল, সোফিয়া লোরেন। জলপাইগুড়ির সিনেমা হলে সে টু উইমেন’, ইয়েসটারডে টুডে টুমরো’ দেখেছে। লম্বা স্বাস্থ্যবতী ভদ্রমহিলা, মুখ ফেরাতেই মনে হল বয়স হয়েছে, কিন্তু খুব পালটাননি। সে কোনওদিন সোফিয়া লোরেনের এত কাছে বসে থাকবে ভাবা যায়? এই সময় আর এক লম্বা ভদ্রলোক সাদা হাফস্লিভ আর খয়েরি রঙা প্যান্ট পরে অতি সাধারণ ভঙ্গিতে সোফিয়া লোরেনের টেবিলে এসে কিশোরের মাথায় হাত বুলিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। এবং বসামাত্র অর্জুন প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। মেজর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

গ্রেগরি পেক। গানল অব নাভারোন-এর নায়ক, রোমান হলিডে…।

হেনরি ডিমক বললেন এখানে তো প্রায় সব ফিল্মস্টার খেতে আসেন। চোখ মেলে থাকলেই সবাইকে দেখতে পাবে। এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে ওঁরা বিরক্ত হতে পারেন।

অর্জুন সেটা জানে। কিন্তু এমন অভাবনীয় ব্যাপার দেখে নিজেকে সামলানো শক্ত হল। হেনরি অর্ডার দিয়েছিলেন, এখন সেটা পরিবেশিত হল। কিছুটা খাওয়ার পর অর্জুনের আর খেতেই ইচ্ছে করছিল না। এই মুহূর্তে যে সে সব বিস্মরিত। গানল অব নাভারোন’-এর পাহাড়ে ওঠার সময় গ্রেগরি পেক একটা গর্তে হাত ঢোকানো মাত্র বিশাল একটা বাজপাখি চিৎকার করে বেরিয়েছিল, সেই দৃশ্যটার কথা বারবার মনে পড়ছে। এইসময় মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, খাবে না?

আর ভাল লাগছে না। কিন্তু নষ্ট করতেও ইচ্ছে করছে না। অর্জুন। জানাল।

মেজর বললেন, জোর করে খেয়ো না। দাও, আমি তোমাকে সাহায্য করছি। তিনি অর্জুনের বাটিগুলো টেনে নিতেই বিদ্যুৎ-চমকের মতো একটা চিন্তা অর্জুনের মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। মেজর তখন কাঁটা-চামচ দিয়ে অর্জুনের খাবার আক্রমণ করেছেন। ধরা যাক ওই স্মোকড চিকেনে বিষ মেশানো আছে। ওটা অর্জুনের পেটে যেত। এখন মেজর খেয়ে নিতেই আততায়ী লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। প্লেনেও তো একই ব্যাপার হতে পারে। যে ছেলেটি খুন হল, সে জানত না অর্জুনের জন্যে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেচারা খিদের চোটে সেটাই খেয়ে নিয়েছিল। অর্জুন যে পার্কিং লটে গিয়ে খবর নিয়েছে, রিনসেক কোম্পানিতেও হাজির হয়েছিল, তা যদি প্রতিপক্ষের জানা হয়ে গিয়ে থাকে, তবে জোন্স অ্যান্ড জোন্স কোম্পানির ব্যাপারটাও অজানা নেই। সেক্ষেত্রে ওরা যদি তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা…হ্যাঁ, তাই তো, নইলে বলবে কেন, মৃত্যু বারবার খালি হাতে ফিরে যায় না। সে বিল মেটানো পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর হেনরি ডিমককে বলল আমি এয়ারপোর্টে যাব।

হেনরি অবাক, কেন?

একটু ইতস্তত করে অর্জুন তার সন্দেহের বিষয় এবং টেলিফোনের কথাটা জানাল। সব শুনে মেজর হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলেন, এজন্যে এয়ারপোর্ট অথরিটির কাছে যাওয়ার কী দরকার! এসব কথা বিস্তারিত জানাতে গেলেই হিরেটার কথাও বলতে হবে। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি। সি ওয়ার্ল্ড থেকে ঘুরে এসে না হয় সব বলা যাবে।

হেনরি বললেন, তা ছাড়া অনুমানটায় একটা বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বিষ মেশাল কে? প্লেনে যে খাবার সার্ভ করা হয়, তা অত্যন্ত দায়িত্ববান কেটারার সাপ্লাই করে। যদি বিশেষ একটি প্লেটে বিষ মেশানো থাকে, তা হলে সে প্লেটটা বিশেষ এক যাত্রীর কাছে সে পৌঁছে দিতে পারে না। তোমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তা হলে বিষটা মিশিয়েছে যে এয়ারহোস্টেস, তোমাকে প্লেটটা দিয়েছে সে-ই। এয়ারলাইনসের কোনও হোস্টেস এমন কাজ করবে না। কারণ তাতে তার সরাসরি ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।

অর্জুন মাথা নাড়ল, আমি কিছু জানি না। কিন্তু এ ছাড়া ওর মরে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। থাকলে টেলিফোনটা আসত না।

হেনরি বললেন, তাহলে আমি একটা ফোন করছি এয়ারপোর্ট অথরিটিকে। তোমার গলা শুনলে ওরা বুঝতে পারবে যে, আমেরিকান নয়।

রাস্তার পাশেই একটা বুধে ঢুকে পড়লেন হেনরি। মেজর লাঠি দিয়ে ফুটপাত ঠুকছিলেন। অর্জুন সেদিকে তাকিয়ে হাসল। মেজর কি নার্ভাস? ওই লাঠির ভেতরে লুকোনো সম্পত্তিটির জন্যে একদল লোক এখন মরিয়া। এবং তারপরেই মনে হল, খাবারের ব্যাপারটা মাথায় ঢোকামাত্রই সে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, বেরোবার আগে পাশের টেবিলের দিকে তাকাতেই ভুলে গেছে।

এখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। অথচ অন্ধকারের বালাই নেই। বিকেল বিকেল ছায়া মেলেছে শুধু। সে দেখল, পথের পাশেই একটা স্ট্যাচু রয়েছে। একজন মানুষ এক পায়ে দাঁড়িয়ে টুপি পেতে রয়েছে। সে কয়েক পা এগিয়ে স্ট্যাচুটার সামনে দাঁড়াল। বাড়ানো টুপিতে বেশ কিছু ডলার পড়েছে। স্ট্যাচুকে কেউ ভিক্ষে দেয়? সে মুখের দিকে ভাল করে তাকাতেই স্ট্যাচুর একটা চোখ বন্ধ হয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল। চমৎকার! এটাও এক ধরনের অভিনয়, এই স্ট্যাচু সেজে থাকা। খুব কষ্ট হচ্ছে মানুষটার, হাত-পা-মুখ মায় সমস্ত শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হচ্ছে। শুধু পয়সার জন্যে?

হেনরি বেরিয়ে এসেছেন দেখে অর্জুন ফিরে এল। হেনরি মাথা নাড়লেন, ইউ আর রাইট। আমি রিপোর্টার পরিচয় দিতে ওরা জানাল, লোকটির পেটে বিষ পাওয়া গিয়েছে। বিষক্রিয়া শুরু হওয়ার তিন মিনিটের মধ্যে হার্ট ব্লক হয়েছে। লোকটা যে খাবার খেয়েছিল, তাতেও একই বিষ পাওয়া গিয়েছে। সন্দেহভাজন হিসেবে ওরা এয়ারহোস্টেস ও কোরারের লোককে গ্রেফতার করেছে। এখন ওরা সেই ইন্ডিয়ান ছেলেটির খোঁজ করছে, যে ওর পাশে বসেছিল।

শোনামাত্র অর্জুনের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। লস অ্যাঞ্জেলিসের পুলিশ তাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করবে? সে খামোখা ওই ছেলেটাকে খুন করতে যাবে কেন? তারপরেই সেই অফিসারের দৃষ্টি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে যখন মৃতদেহ খুঁটিয়ে দেখছিল, ভদ্রলোক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। একদম অজানা সহযাত্রীর পায়ের জুতোর তলা কেউ খুঁটিয়ে দেখে না। সে নিজেই ওদের হাতে সন্দেহের সূত্র তুলে দিয়ে এসেছে।

মেজর চিৎকার করে উঠলেন, ইন্ডিয়ান ছেলে? মানে তুমি? তোমাকে খুঁজলেই হল? মামদোবাজি? চলো, আমরা সবাই মিলে এয়ারপোর্টে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, এর মানে কী?

অর্জুনের সত্যি অস্বস্তি হচ্ছিল। ওরা ইচ্ছে করলে তাকে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু নিশ্চয়ই প্রমাণ করতে পারবে না যে, সে খুন করেছে। কিন্তু এখন এয়ারপোর্টে গেলে আর হিরের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখা যাবে না। অবশ্য পুলিশ যদি ইচ্ছে করে, তা হলে হোটেলেই তাকে ধরতে পারে। সে হেনরি ডিমকের দিকে তাকাল। ডিমকসাহেবের যদি শুধু সি-ওয়ার্ল্ডে গিয়ে দুটো হিরের মিলিত আলো দেখাই উদ্দেশ্য হয়, তা হলে সেটা পুলিশের সঙ্গে গিয়েও দেখা যেতে পারে। তিনি আলাদা যেতে চাইছেন কেন?

হেনরি বললেন, অবশ্য পুলিশ যে আমাদের খুঁজছে, তা আমাদের জানার কথা নয়। চলো, হোটেলে ফিরে যাই।

আবার হাঁটা শুরু হতেই অর্জুন মুখ ফিরিয়ে সেই স্ট্যাচু হয়ে থাকা লোকটির দিকে তাকাতেই দেখল, সেখানে কেউ নেই।

.

৫.

ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভিং-সিটে হেনরি ডিমক, তার পাশে অর্জুন, পেছনের আসনে মেজর শরীর এলিয়ে রেখেছেন। এখন সকাল। লস অ্যাঞ্জেলিস শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটছে চওড়া হাইওয়ে ধরে। রাস্তার ওপরে পথ-নির্দেশ টাঙানো। ইংরেজি অক্ষর, কিন্তু নামগুলো ইংরেজি নয়। এই এলাকাটায় স্প্যানিশ নামের ছড়াছড়ি। একটু আগে মেজর এই অঞ্চলের ইতিহাস বলছিলেন। ইংরেজরা যেমন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে থেকে গেল, তেমনি পোর্তুগিজ এবং স্পেনীয়রা এদেশে এসেছে, থেকেছে। কালিফোর্নিয়াতে তাই স্প্যানিশ ভাষা এবং নমের বহুল প্রচলন আছে।

গত রাত্রে চমৎকার কাণ্ড ঘটেছে হোটেলে। মাছরাত্রে কেউ বা কারা তাদের দুটো ঘরে হানা দিয়েছিল। সমস্ত জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করেছে এবং বোঝা যাচ্ছে, আগন্তুকরা মন খারাপ করে ফিরে গিয়েছে। তবে তারা জুতোর শুকতলা পর্যন্ত উলটে দেখেছে, কিন্তু হ্যাট-র্যাকে ঝোলানো মেজরের লাঠিটা ছোঁয়নি। অর্জুনের সম্পত্তি বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু সেগুলো এলোমেলো করে রেখে গেছে ওরা। আর এটা ঘটেছে ওরা যখন ঘরেই ছিল। এমন কিছু ব্যবহার করা হয়েছিল, যাতে ওদের ঘুম ভোরের আগে না ভাঙে। সকালে এসব দেখে মেজর হোটেল-কর্তৃপক্ষের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে খেপে উঠেছিলেন। হেনরি তাকে বুঝিয়েছেন, সেটা করলে পুলিশ ওদের হদিশ জেনে যাবে। যখন আসল জিনিস খোয়া যায়নি, তখন এ নিয়ে ঝামেলা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। সকলেই ওরা ব্যাপারটা সম্পর্কে মুখ বন্ধ করে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে গাড়ি ভাড়া করে।

মাঝে মাঝে দু’পাশে ঢেউ-খেলানো সবুজ মাঠ, চটজলদি এসে যাওয়া রঙিন একগুচ্ছ বাড়ি, আর হাইওয়েতে সমুদ্রাভিমুখী গাড়ির ভিড় দেখতে ওরা স্যান ডিয়াগোতে এসে পৌঁছোল। এখন দশটা বেজে গেছে। শহরে ঢুকলেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু লোনা জলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

হেনরি কোথাও না থেমে একটা বিশাল পার্কিং লটে পৌঁছে গেলেন। অন্তত তিনটে ফুটবল-মাঠ জুড়লে এত বড় পার্কিং লট হতে পারে। থিকথিক করছে গাড়ি। মেজর আর অর্জুনকে একটা জায়গায় নামিয়ে, তিনি গাড়ি পার্ক করতে গেলেন। বেশ ভাল ব্যবস্থা। পরিচয়পত্র দেখিয়ে, গাড়ি ভাড়া নিয়ে, সারাদেশ ঘুরে বেড়ানো যায়।

অর্জুন বাঁদিকে তাকাল। পাঁচিল-ঘেরা একটা বড় বাড়ির ওপর লেখা রয়েছে সি-ওয়ার্ল্ড। ভিড় দেখা যাচ্ছে তার সামনে। অর্জুন মেজরকে বললে, আমরা তো ওদিকেই যাব, না?

বোধহয়। তবে হেনরির জন্যে অপেক্ষা করা ভাল। দলবদ্ধ হয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। অর্জুনের মনে হল মেজর বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।

ওরা যখন টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকল, তখন আশেপাশে কেউ নেই। ঢোকার সময় একটা নোটিশ দেখে অবাক হয়েছিল অর্জুন। তাতে লেখা আছে, কোনও হরেকৃষ্ণ প্রচার এই এলাকায় চলবে না। নিউইয়র্কে ওর চোখে সাহেব বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী পড়েছে। এখানে তাদের প্রতি এই নিষেধাজ্ঞা কেন, তা বুঝতে পারল না।

হেনরি বললেন, আমাদের তিনজনের একসঙ্গে হাঁটাটা ঠিক হবে না। দাঁড়াও, সি-ওয়ার্ল্ডের ম্যাপটা নিয়ে নিই।

পাশের কাউন্টার থেকে তিনটি ম্যাপ নিলেন হেনরি। সমুদ্রের তলায় যাদের বাস, তাদের নিয়ে নানান মজাদার ব্যবস্থার আয়োজন আছে বিভিন্ন ব্লকে। সবকিছু ঘুরে দেখতে গেলে একটা দিন ফুরিয়ে যাবে। হেনরি আঙুল রাখলেন যেখানে হাঙরদের আস্তানা। বললেন, ঠিক দু’ঘণ্টা পরে আমরা তিনজনে এখানে উপস্থির হব। ঘড়ি মিলিয়ে নাও সবাই। এই দু’ঘণ্টা আমরা আলাদা-আলাদা ঘুরব। মেজর, লাঠিটা এবার আমাকে দেবে নাকি?

অর্জুন প্রতিবাদ করল, যদি কেউ আমাদের অনুসরণ করে থাকে সে নিশ্চয়ই লাঠিটার হাতবদল লক্ষ করবে।

হেনরি একটু হতাশ হলেন বলে মনে হল। তারপর ঘড়ি মিলিয়ে নিয়ে তিনজনে বেরিয়ে পড়লেন। কয়েক পা এগিয়ে অর্জুন ঠিক করল, সে মেজরের অজান্তে ওঁর পেছন পেছন ঘুরবে। যদি কেউ মেজরকে অনুসরণ করে, তা হলে সেটা তার চোখে পড়বে। বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে সে মেজরের পেছনে হাঁটছিল। ছেলে-মেয়ে-বুডোর ভিড় চারধারে। আইসক্রিম থেকে বুড়ির মাথার পাকাচুল বিক্রি হচ্ছে এখানেও। মেজর মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখছেন এবং লাঠি ঘুরিয়ে হাঁটছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও অনুসরণকারী চোখে পড়ল না। হাতের ম্যাপ দেখে মেজর এবার একটা সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন। প্রচুর মানুষ তার আগেপিছে উঠছে। অর্জুন পা চালাল। ওপরে উঠে অর্জুন দেখল একটা ছোট্ট স্টেডিয়াম। সামনে মাঝারি সুইমিং পুল। তার নীল জল টলটল করছে। স্টেডিয়াম লোকে ভরতি। সে মেজরকে খুঁজে বের করে ধীরে ধীরে ওঁর দুটো সারি পেছনে গিয়ে বসল।

একটু বাদেই অনুষ্ঠান শুরু হল। একজন মানুষ সুইমিং পুলের ওপাশ থেকে জলের গায়ে এসে দাঁড়িয়ে শিস দিতেই জলে আলোড়ন শুরু হল। ওদের চমকে দিয়ে জল কাঁপিয়ে দুটো ডলফিন সেই মানুষটির নির্দেশে মজার খেলা দেখাতে লাগল। শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া বল ঝল ছেড়ে ভারী শরীর নিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে প্রায় হেড দেওয়ার ভঙ্গিতে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। সুন্দরী এক মহিলা ডলফিনের পিঠে চড়ে অনেকটা ঘুরে বেড়ালেন। শেষপর্যন্ত ডলফিনটি সবাইকে চমকে দিয়ে তার ট্রেনারকেই জলে ফেলে দিতে সমস্ত স্টেডিয়াম হোহো করে হেসে গড়িয়ে পড়তে অর্জুনের নজরে এল, মেজর নেই।

সে দেখল, মেজরের লাঠিটা একপাশে পড়ে আছে, জায়গাটা ফাঁকা। অর্জুন দ্রুত উঠে গেল হেসে লুটিপাটি লোকগুলোকে কাটিয়ে। তখনও মজার খেলা চলছে। এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি,’ বলতে বলতে সে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে ওপরে উঠে আসতেই দেখতে পেল, মেজর হেঁটে যাচ্ছেন। তার দুপাশে দুটো লোক ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছে। সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনের মাথার ভেতরে চিন্তাটা চলকে উঠল, লাঠিটাকে ত্যাগ করতে হবে। তার বয়সি ছেলে লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ায় না। দ্রুত পাঁচ খুলে ঝাঁকাতেই হিরেটা বেরিয়ে এল। লাঠিটাকে আবার ঠিক করে পাশের দেওয়ালে ঠেকিয়ে রেখে দ্রুত নেমে পড়ল অর্জুন।

মেজর নিশ্চয়ই নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছেন না। তার হাঁটার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে পাশের লোকদুটোর কাছে অস্ত্র রয়েছে। অর্জুন যথেষ্ট দূরত্ব রাখছিল। এখন কী করা যায়, বুঝতে পারছিল না সে। আর যাই হোক, ওদের নজর এড়িয়ে তাকে মেজরকে সাহায্য করতে হবে। সেটা কী করে সম্ভব?

ভিড়ের মধ্যে দিয়ে লোকদুটো যেভাবে মেজরকে নিয়ে হাঁটছে তাতে বোঝা যায় ওরা এসব ব্যাপারে রীতিমতো পেশাদার। সি-ওয়ার্ল্ডের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে ওরা দাঁড়াল। অর্জুন লক্ষ করল, এদিক দিয়েও বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পথ আছে। একটা আইসক্রিমের দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে অর্জুন ওদের লক্ষ করছিল। সেইসময় একজন দাড়িওয়ালা লোক ওদের সামন এসে দাঁড়াল। লোকটা মেজরকে কিছু প্রশ্ন করল। কিন্তু মেজরের দুই প্রহরী পাশ থেকে সরছিল না। মেজর মাথা নাড়লেন। বোধহয় তিনি অস্বীকার করছেন। আর এইসব হচ্ছে হাজার হাজার লোক যেখানে ঘুরছে, সেখানে, দিনদুপুরে। দাড়িওয়ালা আরও কিছু কথা বলার পর মেজর একইভাবে মাথা নাড়লেন। দূরে থাকায় অর্জুন ওদের সংলাপ শুনতে পাচ্ছিল না। এবং তারপরেই বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটল। ওদিকের একটা ঝোঁপ থেকে আরও দুটো লোকের মাঝখানে হেঁটে এলেন হেনরি ডিমক। তার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। দাড়িওয়ালা লোকটি হেনরিকে দেখিয়ে মেজরকে কিছু বলতে মেজর চিৎকার করতে গিয়ে যেন থেমে গেলেন। হেনরি মাথা নেড়ে কিছু বললেন। অর্জুনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আচমকা তাকে সতর্ক করল। কারণ, দাড়িওয়ালার হুকুমে একটি লোক তখন ছুটছে সুইমিং পুলের দিকে। অর্থাৎ লাঠিটার কথা মেজর বলতে বাধ্য হয়েছেন। একটু বাদেই ওরা যখন লাঠিটা খোলার পর দেখবে যে, ওতে হিরে নেই, তখন…।

অর্জুন হঠাৎ একটা ছায়া দেখল বাঁ-চোখের কোণে। ছায়াটা মানুষের, কিন্তু নড়ছে না। সে আর দাঁড়াল না। উলটোদিকে জোর পায়ে কিছুটা হাঁটতেই মনে হল ছায়াটা পিছু পিছু আসছে। চোখের সামনে একটা পুলিশ বুথ। দু’জন স্বাস্থ্যবান পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে। কিছু না ভাবতে পেরে অর্জুন সোজা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আমার দু’জন সঙ্গী খুব বিপদে পড়েছেন। তাদের কেউ বন্দুক দেখিয়ে আটকে রেখেছে।

কোথায়? একজন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল।

ওই ওপাশে, আইসক্রিমের দোকানের উলটোদিকে।

অ্যাঁ? সি-ওয়ার্ল্ডের ভেতরে? পাগল! নিজের কাজে যাও।

অর্জুন কী বলবে বুঝতে পারছিল না। সে চারপাশে তাকিয়ে কোনও অনুসরণকারীর ছায়া দেখতে পেল না। লোকটা আবার ধমকের গলায় বলল, গেট লস্ট।

তখন অর্জুন পকেট থেকে সেই কার্ডটা বের করল। কার্ডের লেখাটা পড়ে পুলিশ দুটোর চেহারা পালটে গেল। অর্জুন ওদের একজনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটল আইসক্রিমের দোকানের দিকে। দ্বিতীয়জন বুথ থেকে টেলিফোনে অন্যদের খবর দিচ্ছিল।

কেউ কোথাও নেই। জায়গাটা যেন মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পুলিশটা ওর দিকে আবার অবিশ্বাসের চোখে তাকাল। অর্জুন তাকে বোঝাতে চাইছিল, ব্যাপারটা মনগড়া নয়। কিন্তু লোকটা আর কোনও কথা শুনতে রাজি নয়। ওরা আবার বুথে ফিরে আসতে দ্বিতীয় পুলিশটি ওকে জিজ্ঞাসা করল তোমার পাসপোর্ট সঙ্গে আছে?

অর্জুন মাথা নেড়ে সেটা এগিয়ে দিতেই লোকটা দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, লস অ্যাঞ্জেলিস পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। তোমাকে গ্রেফতার করা হল।

অর্জুন হতভম্ব হয়ে বলল, কেন?

আমি জানি না। তোমার খবরটা টেলিফোনে হেড কোয়ার্টার্সে জানানো মাত্র ওরা বলল একজন ভারতীয় যুবককে খোঁজা হচ্ছে, যার নামের সঙ্গে তোমার কোনও ফারাক নেই।

আমাকে খুঁজলেই গ্রেফতার করতে হবে?

পুলিশ গ্রেফতার করার জন্যেই মানুষকে খোঁজে।

এবার অন্য পুলিশটি বলল, কিন্তু ওর কাছে যে কার্ড আছে, তা তো অন্য কথা বলছে জেমস। বসদের বলো এখানে এসে কথা বলতে।

অর্জুন বলল, শোনো, আমি চোর-বদমাশ নই। আমি একজন সত্যসন্ধানী। তোমাদের এখানে হাঙরের বাক্সের হিরেটা চুরি গিয়েছে, সেটার ব্যাপারে এসেছি।

হাঙরের বাক্সের হিরে? লোকটা অবাক হল। তুমি সেটা খুঁজতে এসেছ?

হ্যাঁ। অর্জুন নরম পুলিশটিকে বলল, আমি একবার হাঙরের ঘরে যেতে চাই। তুমি আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে? তোমার ওপরওয়ালারা এখানে আসার আগেই আমরা ফিরে আসব কথা দিচ্ছি।

প্রথম পুলিশটি বলল, লুক! তুমি একবার বললে তোমার দু’জন সঙ্গীকে কেউ বন্দুক দেখাচ্ছে, আবার বলছ হিরে খুঁজতে এসেছ। কোনটা বিশ্বাস করব?

কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর দ্বিতীয় পুলিশটি ওকে নিয়ে রওনা হল। অর্জুন বুঝতে পারছিল, সরকারি নির্দেশের কার্ড সঙ্গে থাকায় ওরা কিছু করতে সাহস পাচ্ছে না। যেতে যেতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, দ্বিতীয় হিরেটা এখন কোথায় আছে?

সেটাও দিন দশেক হল নেই।

নেই মানে?

প্রথম ভোয়া গিয়েছিল হাঙর কাচ ভেঙে ফেলার পর। দ্বিতীয়টা এতদিন ওই বাক্সের মধ্যেই ছিল, কিন্তু দশদিন ওটাকে দেখা যাচ্ছে না।

দেখা যাচ্ছে না মানে?

হাঙরের বাক্সের ভেতরে একটা হুকে ওই হিরেটা ছিল। দিনদশেক আগে দেখা যায়, সেই হুকে কিছু নেই। হাঙরের বাক্সে কেউ হিরে রাখে? যেমন বুদ্ধি!

রেখেছিল কেন?

কোনও এক বিজ্ঞানীর মাথায় কী একটা এক্সপেরিমেন্টের ইচ্ছে খেলেছিল।

কথা বলতে বলতে ওরা ম্যাপে দেখানো জায়গার কাছে চলে এসেছিল। এদিকটায় বেজায় ভিড়। বাইরে তিনটে চৌবাচ্চায় হাঙরের বাচ্চা ছাড়া রয়েছে। তারা নিরীহ ভঙ্গিতে আপনমনে ঘুরছে। অর্জুন চারপাশে তাকাল। চেনা মুখগুলোকে চোখে পড়ছে না। মেজর এবং হেনরি ডিমকের জন্যে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। যারা বন্দুক দেখিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে চাপ দিতে পারে, তাদের কাছে খুন করা কিছুই নয়।

পুলিশটির সঙ্গে অর্জুন ভিড়ের সঙ্গে মিশে হাঙরের ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। বিশাল হলঘরে প্রকাণ্ড কাঁচের বাক্সে জল ভরে তাতে হাঙর ছাড়া হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটা। হাঙরগুলো আপনমনে সাঁতরাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-একচা ভয়ংকর চেহারার হাঙর ছুটে এসে কাঁচে ঢু মারছে। সেই শব্দ বাইরে থেকে ভীতিকর শোনাচ্ছে। বাইরের মানুষের মুখ দেখে ওরা। ক্রুদ্ধ হয়ে যখন হাঁ করছে, তখন শিউরে উঠতে হয় বীভৎস দাঁত দেখে। অর্জুনের মনে পড়ে গেল রূপমায়াতে দেখা জস’ ছবিটার কথা। সবচেয়ে বড় চেহারার হাঙরটকে অবিকল সেইরকম দেখতে। অর্জুন কয়েক পা এগিয়ে কাঁচের সামনে দাঁড়াল। বড় হাঙরটার শরীরের সবকিছু এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেকটা দূরে পিছিয়ে গিয়ে সেটা তেড়ে এল এমনভাবে অর্জুনের দিকে যে, সে দু’পা না পিছিয়ে পারল না। আর তখনই তার নজরে পড়ল দাড়িওয়ালা লোকটিকে। হাঙরের বাক্সের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে একদষ্টিতে তাকে লক্ষ করছে।

হেনরি ডিমক ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন, তা অৰ্জুন জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল, তার হাতে আর বেশি সময় নেই। সে চট করে পকেট থেকে। হিরেটা বের করে কাঁচের দেওয়ালের সামনে নিয়ে গিয়ে ঘোরাতে লাগল। কোনওরকম আলো যে এর থেকে বের হচ্ছে, তা অর্জুনের মনে হল না। পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশটি এই কাণ্ড হাঁ করে দেখছিল। এবার জিজ্ঞেস করল, হোয়াটস দ্যাট?

আর তখনই ঘটনাটা ঘটল। বড় হিংস্র হাঙরটা আর একবার ঢু মারার জন্যে অর্জুনের দিকে ছুটে আসছিল। হঠাৎ সেটা সেই গতি নিয়ে ডিগবাজি খেতে লাগল। যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে জলের ভেতর। অর্জুন। হিরেটাকে স্থির রাখছিল। হিরেটা থেকে কোনও আলো বের হচ্ছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু হাঙরটা যেন পাগল হয়ে গেল। সমস্ত শক্তি দিয়ে সে কাঁচের ওপর আঘাত করতে লাগল। অথচ পেছন দিকে সরে যাওয়ার ক্ষমতা। তার নেই, বোঝা যাচ্ছিল। এবং তখনই অর্জুনের মনে হল, দুটো হিরের আলো একত্রিত হলে যে রেখা তৈরি হয় বলে সে শুনেছে, তাই হয়তো হয়ে গেছে। আর তা হলে অন্য হিরেটা নিশ্চয়ই হাঙরটার শরীরে রয়েছে। সে দ্রুত অন্য হাঙরদের দিকে হিরেটা ঘুরিয়ে দেখল, তাদের কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। ওরা অবাক হয়ে তাদের নেতার দুরবস্থা দেখছে। অর্জুন হিরেটা সামান্য সরাতেই সম্ভবত হাঙরটা কিঞ্চিৎ শক্তি ফিরে পেয়েছিল। পঁত বের করে সে এবার অর্জুনের দিকে যেন ঝাঁপিয়ে পড়তেই সে আবার হিরেটা তাক করল। অর্জুন খেয়ালই করেনি, দর্শকরা ভীত হয়ে কাঁচের বাক্সটা ছেড়ে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। তারা এবার অর্জুনকে লক্ষ করেছে। পুলিশটি কী করবে বুঝতে পারছে না। এবার হাঙরটা পাগলের মতো পাক খাচ্ছে। অর্জুন চিৎকার করে বলল, এখানকার কর্তৃপক্ষকে ডাকো। শিগগির!

চারপাশে ততক্ষণে শোরগোল পড়ে গেছে। পুলিশটি চিৎকার করল, তুমি কী করছ?

অর্জুন চোখ না সরিয়েও যেন দাড়িওয়ালা লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখতে পেল। সে পুলিশটিকে বলল, ওই দাড়িওয়ালাটাকে ধরো। হি ইজ এ মার্ডারার।

পুলিশটি ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল। অর্জুন কয়েক পা পিছিয়ে এসে দাড়িওয়ালার দিকে নজর দিতেই লোকটা ক্ষিপ্রগতিতে কাঁচের বাক্সের সামনের দিকে ছুটে এল। অর্জুন অজান্তেই হাঙরটার দিকে হিরেটা তুলে ধরতে অদ্ভুত ব্যাপার হল। দাড়িওয়ালা লোকটা যেন এগিয়ে আসার চেষ্টা করেও পারছে না। তার পিছু হটার পথ কাঁচের বাক্স থাকায় বন্ধ। দু’ফুট জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটা ছটফট করছে। চিৎকার করে বলছে অর্জুনকে হিরেটা সরিয়ে নিতে।

অর্জুনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। দুটো হিরের সংযোগ-রেখা যদি হাঙরের পক্ষে অতিক্রম করা অসাধ্য হয়, তা হলে মানুষ তো পারবেই না।

এইসময় একজন বৃদ্ধ দৌড়োতে দৌড়োতে ভেতরে ঢুকলেন। তাঁর পেছনে তিনজন পুলিশ অফিসার। বৃদ্ধ পেছন দিক দিয়ে অর্জুনের কাছে চলে এসে চিৎকার করতে লাগলেন, ইয়েস, ইটস দেয়ার? হি গট ইট।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল চোখ না সরিয়ে, আপনি কে?

আমি, আমি প্রোফেসর লুইস জ্যাকব। আমিই ওই বিচিত্র হিরে দুটো নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম। সেবার একটা হাঙর পাগল হয়ে কাচ ভেঙে ফেলায় একটা হিরে হারিয়ে গিয়েছিল। অন্যটাকে আমি ভেতরে রেখে দিয়েছিলাম, কিন্তু ওর একার রি-অ্যাক্ট করার ক্ষমতা ছিল না। সেই হিরেটাও অদ্ভুতভাবে মিসিং। অথচ বাক্সটা ইনট্যাক্ট আছে।

কথা শেষ হওয়ামাত্র অর্জুন বলল, প্রোফেসর, আপনার ভেতরে রাখা হিরেটা এখন ওই বড় হাঙরটার পেটে। দ্বিতীয়টা আমার হাতে। এটা আমি আপনাকে দিচ্ছি, কিন্তু তার আগে বন্দি হয়ে থাকা ওই দাড়িওয়ালা লোকটাকে অ্যারেস্ট করতে বলুন।

হিরেটা সরিয়ে নিতেই প্রোফেসর চেঁচিয়ে উঠলেন, অ্যারেস্ট হিম।

পুলিশের হাত এড়াবার উপায় ছিল না দাড়িওয়ালার। প্রোফেসর হিরেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন। একদম ছেলেমানুষ মনে হচ্ছিল তাকে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কাঁচের ওপর হাঙরটাকে লক্ষ করে হিরেটাকে চেপে ধরলেন। হাঙরটা ছটফট করল। হঠাৎ জলের রং পালটে গেল। লাল ঘোলা জল পেছনে রেখে হাঙরটাকে পেছনের দিকে ছুটে যেতে দেখল সবাই। জল পরিষ্কার হলে একটা সাদা আলোর রেখা দেখা গেল। প্রোফেসরের হাত থেকে বেরিয়ে রেখাটা গিয়ে মিশেছে বালির ওপরে, যেখানে হাঙরটা শুয়েছিল। সেখানে এখন দ্বিতীয় হিরেটা পড়ে আছে। প্রোফেসর বললেন, লেটসল হোপ ওর উন্ডটা যেন নিজে থেকেই শুকিয়ে যায়। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরলেন, ইয়ংম্যান, যেটা এতদিন ধরে করতে চেয়েছি, আজ তা পূর্ণ হল। এবং সেটা তোমার জন্যেই সম্ভব হল। এই দুটো হিরের সমান্তরাল রেখা এক মিটারের মধ্যে এলে হাঙরের পেটে ছিদ্র করতে সক্ষম হয়। জলের বাইরে মানুষকেও আটকে রাখতে পারে। আই অ্যাম গ্রেটফুট টু ইউ। হোয়াটস ইয়োর গুড নেম?

মিনিট দশেক পরে সি-ওয়ার্ল্ডের সিকিউরিটি রুমে বসে অর্জুন হিরের গল্পটা শেষ করল। তারপর দাড়িওয়ালা লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ওদের কোথায় রেখেছেন?

দাড়িওয়ালা মুখ খুলল, ওরা নিজেদের ভাড়া করা গাড়িতেই বসে আছে। পার্কিং লটে গেলেই দেখতে পাবে।

অর্জুন উঠতে যাচ্ছিল, পুলিশ অফিসার তাকে থামালেন। আপনি যেতে পারেন না। এয়ারপোর্ট পুলিশ আপনাকে খুঁজছে একটা মার্ডারের জন্যে।

অর্জুন বলল, কিন্তু আমি সে মার্ডার করিনি।

অফিসার বললেন, সেটা আপনাকে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে আপনার চার্জ শুধু আপনার দুই সঙ্গীকে বন্দুক দেখিয়ে আটক রাখার, তাই না?

না। অর্জুন বলল, ইনি লস অ্যাঞ্জেলিস থেকে একজন পেশাদার চোরকে নিউইয়র্কে নিয়ে গিয়েছিলেন হেনরি ডিমকের বাড়িতে হিরে চুরি করানোর জন্যে। আমার বিশ্বাস সেই চোরকে উনিই খুন করিয়েছেন।

মিথ্যে কথা। দাড়িওয়ালা প্রতিবাদ করে উঠতেই অর্জুন আচমকা হাত চালাল। সঙ্গে সঙ্গে দাড়ির খোলস খুলে মিস্টার রেগনের মুখ বেরিয়ে এল। প্রোফেসর চিৎকার করে উঠলেন, ওঃ মাই গড। ইটস ইউ? রেগন!

রেগন তখন দুই হাতে মুখ ঢেকেছেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, প্রোফেসর, আপনি ওঁকে চেনেন?

প্রোফেসর মাথা নাড়লেন, ইয়েস। এই হিরের জন্যে আমার কাছে ও কয়েকবার এসেছে, অনেক টাকা দাম দিতে চেয়েছে। আমি চেয়েছিলাম এই হিরে দিয়ে যাতে অস্ত্র ছাড়া অপারেশন করা যায় তার চেষ্টা করা। ওকে তাই বিক্রি করিনি। কিন্তু তুমি ওকে চিনলে কী করে?

অর্জুন বলল, ওঁকে কয়েক মিনিটের জন্যে দেখেছিলাম নিউইয়র্কের ম্যাকডোনাল্ডে। তখনই ওঁর বাঁ হাতে লাল পাথরের আংটিতে লেখা আর শব্দটা চোখে পড়েছিল। প্লেনে আমাদের পেছনের সিটে বসে থাকা একজন দাড়িওয়ালা যাত্রীর হাতেও ওই লাল আংটি দেখেছিলাম।… অফিসার, ওকে থামান।

অর্জুন চিৎকার করে উঠতেই দেখা গেল, লাল আংটির পাথরটা ঘুরিয়ে রেগন সেটা মুখে পুরেছেন। সাদা কিছু গুঁড়ো গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। রেগন হাসলেন, ব্যস, আমি ফ্রি। হ্যাঁ। আই কিলড দ্যাট ম্যান। এই আংটির বিষ খাবারে মিশিয়ে দিয়েছিলাম এয়ারহোস্টেস যখন এই ছোকরার জন্যে খাবার এনেছিল। ওরা নিজেদের আসনে না থাকার সময় ওর প্লেটে ঢেলেছি এয়ারহোস্টেসের অজান্তে। কিন্তু আমার লোভী লোকটি ওর খাবার খেয়ে নিল লোভের বশে। প্রোফেসর, ওই হিরে আপনাকে বিক্রি করেছিলেন আমার কাকা। তিনি এর মূল্য জানতেন না। এটুকু বলার পরেই হঠাৎ চিরকালের জন্যে চুপ করে গেলেন রেগন। বাইরের পার্কিং লটে মেজর এবং হেনরি ডিমকের ঘুমন্ত শরীর পাওয়া গেল গাড়ির ভেতরেই। অনেক কষ্টে তাদের জাগানো হল। ছেলেটির পেটের বিষের সঙ্গে রেগনের আংটির বিষ মিলে গেল পরীক্ষায়।

নিউইয়র্কে মেজরের ফ্ল্যাটে বসে ওরা গল্প করছিল। এবার দেশে ফিরতে হবে অর্জুনকে। বিষ্টসাহেব সুস্থ হয়ে উঠছেন, কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে দেরি হবে। বন্দুকের ভয়ে লাঠির কথা ফাঁস করায় মেজর মুষড়ে পড়েছেন। রেগনের ভাড়াটে লোকদের পুলিশ ধরতে পারেনি। এইসময় একটা ট্রাঙ্ককল এল। টেলিফোন ধরে কথা বলে মেজর উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে উঠলেন, ব্যাটা মার্শাল! ছুঁচো! আমাকে ফাঁকি দিয়ে মুক্তো দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে ব্ল্যাকপুলে! চলো অর্জুন, দেশে ফেরার আগে হিথরোতে নামবে আমাদের সঙ্গে?

অর্জুন হতচকিত হয়ে বলল, মার্শাল কে? আর হিথরোটা কোথায়?

মার্শাল আমার অভিযাত্রী বন্ধু। হেনরির মতো। আর হিথরো হল লন্ডনের এয়ারপোর্ট। মেজর উঠে দাঁড়ালেন।

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress