Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হঠাৎ হয়ে যায় || Samaresh Majumdar

হঠাৎ হয়ে যায় || Samaresh Majumdar

দক্ষিণের বারান্দায় বেতের চেয়ারে শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে রবিবারের সকালটা কাটিয়ে দেওয়ার বিকল্প আর কিছু নেই ইন্দ্রজিতের কাছে। সারা সপ্তাহের পরিশ্রমের পর এই সময়টা তার নিজস্ব, আরাম করার সময়। যোধপুর পার্কের এই বিরাট ফ্ল্যাটটার বাসিন্দা ছয়জন। ওরা তিনজন আর কার্মচারী তিনজন। কর্মজীবনের প্রথম দিকে এটা মেনে নিতে পারত না ইন্দ্রজিৎ, এখন এটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। এখন ইন্দ্রজিতের চোখ বন্ধ, পাশের টুলের ওপর তিন তিনটে খবরের কাগজ, পায়ের তলায় সুন্দর বেঁটে মোড়া।

একটা ঘর পেরিয়ে ছোট লাইব্রেরি রুমে তখন সুনেত্রা। ইন্দ্রজিতের পড়ার অভ্যেস এবং সময় না থাকলেও সুনেত্রার আছে। টিভি দেখতে ওর মোটেই ভালো লাগে না। কখনও কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান দেখালে সামনে গিয়ে বসে। সেই ছেলেবেলা থেকে যেসব বই পড়ে এসেছে তাদের একত্রিত করে রাখার ব্যাপারে সে সচেষ্ট। যে বইটি পনেরো বছর বয়সে পড়েছিল তার। বিষয়বস্তুর আকর্ষণ তেমন না থাকলেও সেটি স্পর্শ করলে সেই দিনটিতে ফিরে যেতে পারে অনায়াসে। বাবার কিনে দেওয়া বইটিতে পনেরো বছরের হাতে লেখা নামটা এখন ওর কাছে বড় আদরের। বইগুলোতে ধুলো জমার কোনও সুযোগ নেই তবু ঝাড়ন বোলাচ্ছিল সুনেত্রা, এই। সময় দরজায় এসে দাঁড়াল ছেলে, মাম।

ছেলের বয়স উনিশ। ফরসা, সুন্দর চেহারা, ছয় ফুট এক ইঞ্চি লম্বা। কথা বলতে গেলে মুখ তুলে তাকাতে হয়। যাদবপুরে পড়ছে কম্পিউটার বিজ্ঞান। জয়েন্টে প্রথম পঞ্চাশ জনের মধ্যে ছিল।

কিছু বলবি? সুনেত্রা পথের পাঁচালিটা বের করল।

আই অ্যাম ইন প্রব্লেম! ছেলে বেঁকে দাঁড়াল।

কি ব্যাপার? মুখ তুলে তাকাল সুনেত্রা।

কাঁধ নাচাল ছেলে, ঠোঁট বেঁকাল, শি হ্যাজ মিসড হার মান্থ!

কি? চেঁচিয়ে উঠল সুনেত্রা।

ইটস নট আওয়ার ফল্ট। হয়ে গেছে। টিলা খুব আপসেট। প্লিজ হেল্প হার। আমি সুইমিং-এ যাচ্ছি। বাই। ছেলে বলে গেল।

কয়েক সেকেন্ড শরীর অসাড়, শুধু বুকের ভেতরটা দুমড়ে উঠেছে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই কয়েক সেকেন্ড লাগল। তারপর মাথা খারাপ হয়ে গেল সুনেত্রার। পথের পাঁচালিকে যথাস্থানে না রেখে সে দ্রুত বেরিয়ে এসে কমলাকে দেখতে পেল, বাবি কোথায়?

ছোটবাবু তো বেরিয়ে গেল!

সুনেত্রা নিশ্বাস নিতে পারছিল না। এত বড় কাণ্ড করে কীরকম নির্লিপ্ত গলায় বলে গেল, সাহায্য করো। মাথা ঝিমঝিম করছিল সুনেত্রার। বেডরুমে গিয়ে সে শুয়ে পড়ল। মাস তিনেক আগে ডাক্তার বলেছিল, আপনার প্রেসারটা গোলমাল করছে ম্যাডাম, এখন থেকে রোজ অ্যামটাফ ফাইভ আর ইকোস্পিন সেভেন্টি ফাইভ খেয়ে যেতে হবে যতদিন বাঁচবেন। ওই ওষুধ দুটো। ব্রেকফাস্টের পর খেয়ে সে বেশ ভালোই ছিল। এখন মনে হচ্ছে পায়ের তলা ঝিমঝিম করছে, মাথা ঘুরছে। মিনিট দশেক চুপচাপ শুয়ে থাকতে-থাকতে টিলার মুখ মনে পড়ল। মেয়েটাকে মাত্র একদিন দেখেছে সে। ছেলের সঙ্গে পড়ে। খুব ভালো মেয়ে। প্রায় পুতুলের মতো দেখতে। ছেলের থেকে তিন নম্বর বেশি পেয়েছিল জয়েন্টে। জনা চারেক ছেলেমেয়ে আধঘণ্টার জন্যে এসেছিল, তখন আলাপ হয়েছিল টিলার সঙ্গে। খুব মিষ্টি আর শান্ত বলে মনে হয়েছিল ওকে। ব্যস এটুকুই।

সুনেত্রা উঠল।

দক্ষিণের বারান্দায় যেতেই ইন্দ্রজিৎ ইজিচেয়ারে অর্ধশায়িত অবস্থায় বিরক্তি প্রকাশ করল, ইটস টু মাচ। তোমার ছেলেকে আমি বারবার বলেছি গাড়িতে হাত না দিতে কিন্তু ওটা ওর কানে ঢুকছে না। একটু আগে কাউকে কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল!

চাবিটা তোমার কাছে রাখলে কী অসুবিধে হয়!

আশ্চর্য! আমার বাড়িতে আমি চোরের ভয়ে জিনিস লুকিয়ে রাখব? ও যে কথা শুনছেনা সেটা। তোমার নজরে পড়ছে না? সোজা হল ইন্দ্রজিৎ, এইজন্যেই বলে বেশি আদর দিলে মাথায় চড়ে বসে। আমার বাবা কোনও নিষেধ করলে আমি সেটা অমান্য করার কথা ভাবতেই পারতাম না। গায়ে হাত তোলা যাবে না, বলে লাভ হচ্ছে না, এখন শুধু গিলে যেতে হবে।

হ্যাঁ, গেলা ছাড়া আর উপায় কি? দ্বিতীয় চেয়ারটিতে বসল সুনেত্রা।

গত রবিবার দু-দুটো অ্যাকসিডেন্ট করেছে। বললেই বলে অন্য গাড়ির দোষ। কিন্তু আমার। পকেট থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে গ্যারাজের বিল মেটাতে। তাও যদি পুরোনো অ্যাম্বাসাডারটা নিত গায়ে লাগত না, ওর এস্টিম ছাড়া নবাবি দেখানো চলবে না। তা ছাড়া আজকাল ওর কথাবার্তা শুনেছ?

শুনেছি।

স্ত্রীর দিকে তাকানোয় গলার স্বর বদলে গেল ইন্দ্রজিতের, তোমার কী হয়েছে?

কিছু না।

চেপে যাচ্ছ কেন? প্রেসার বেড়েছে?

জানি না। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

কি ব্যাপার বল তো?

সুনেত্রা চুপচাপ সামনের রাস্তার দিকে তাকাল। বুকের ভেতরটা কীরকম করছিল তার। তারপর বলল, একটা কথা রাখবে?

আশ্চর্য! কথাটা কী তা বলবে তো?

না। আগে তোমাকে কথা দিতে হবে।

অস্বস্তিতে মাথা নাড়ল ইন্দ্রজিৎ। তারপর মেনে নিতে বাধ্য হল, ঠিক আছে।

আমি যা বলব তা শুনে তুমি উত্তেজিত হবে না। সুনেত্রা নিশ্বাস ফেলল, এখন আমাদের যা করার মাথা ঠান্ডা রেখে করতে হবে।

ইন্দ্রজিৎ চোখ বড়-বড় করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিল। সুনেত্রার কথা বলার ধরন তার ভালো লাগছিল না। খুব বড় রকমের কাণ্ড না হলে সুনেত্রা এমনভাবে কথা বলবে না।

তুমি তো টিলাকে চেনো না। সুনেত্রা বলল।

টিলা? কে টিলা?

বাবির সঙ্গে পড়ে।

অ। তো কি হয়েছে তার?

টিলা সম্ভবত কনসিভ করেছে। নিচু গলায় বলল সুনেত্রা।

সে কি! নিশ্চয়ই বিয়ে হয়নি?

আশ্চর্য! এই তো স্কুল থেকে বেরিয়ে জয়েন্ট দিয়ে বাবির সঙ্গে পড়ছে।

দ্যাখো, কী অবস্থা! এইটুকু মেয়ে কোথায় নেমে গেছে। ভাগ্যিস তোমার মেয়ে নেই, ছেলেকে নিয়ে একরকম সমস্যা, মেয়ে থাকলে তো! ওর বাবা-মা জানেন? ইন্দ্রজিৎ প্রশ্ন করল।

জানি না। বোধহয় জানে না।

কিন্তু তুমি জানলে কী করে?

বাবি বলল।

বন্ধুকে জানিয়েছে অথচ নিজের বাবা-মাকে জানায়নি! তা এ নিয়ে তোমার এত আপসেট হওয়ার কী কারণ আছে। এটা ওর মা-বাবার সমস্যা, তোমার নয়।

আমাদেরও।

তার মানে? ইন্দ্রজিতের গলা আচমকা শুকিয়ে গেল।

তোমার ছেলে বলল, ইটস নট আওয়ার ফল্ট, হয়ে গেছে।

হোয়াট? চিৎকার করে উঠল ইন্দ্রজিৎ।

চিৎকার কোরো না।

কী বলছ তুমি? ওইটুকুনি ছেলে, উনিশ বছর বয়স, জুতো মেরে ওর মুখ ভেঙে দেব আমি। কোনওদিন গায়ে হাত দিইনি বলে–। ওছ হারামজাদা আমাকে পাগল করে দেবে। কোথায় গিয়েছে সে, জানো?

কেন? সেখানে যাবে?

হ্যাঁ যাব। আমি ওকে এমন শাস্তি দেব যা জীবনে ভুলবে না। আমার ছেলে ব্রিলিয়ান্ট, হান্ডসাম, স্মার্ট শুনতে-শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। ছেলে যে একটি অবাধ্য বাঁদর তাই এতদিন জানতাম। কিন্তু কোথায় গেছে সে? উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রজিৎ। তার মুখের চেহারা বদলে গেছে।

বোসো!

সুনেত্রা!

আমি তোমাকে অনুরোধ করেছি উত্তেজিত না হতে।

আরে, এই কথা শোনার পর আমাকে তুমি শান্ত হতে বলছ? ওইটুকুনি ছেলে, সবে স্কুল ছেড়েছে, কখন ক্রিমিনাল হয়ে গেল! আমার ছেলে রেপ করেছে আর আমি শান্ত হয়ে বসে থাকব? ইন্দ্রজিৎ আবার বসে পড়ল।

রেপ বলছ কেন? নিচু গলায় বলল সুনেত্রা।

ওই হল! মাথা নাড়ল ইন্দ্রজিৎ, এই সেদিন জন্মাল, চোখের ওপর বড় হতে দেখলাম, সে কি না–তোমার কাছে সোজাসুজি বলল?

হ্যাঁ। এটাই প্লাস পয়েন্ট, লুকোয়নি।

আশ্চর্য! আমি খুনটুন করে এসে লুকোলাম না, আমার সাত খুন মাপ হয়ে যাবে? আমাদের তখনই বোঝা উচিত ছিল।

কখন?

একটা বাচ্চা, কোনও ভাইবোন নেই, এদের বেশিরভাগই শয়তান হয়। এই যে মুখার্জির ছেলেটা, ব্রিলিয়ান্ট বয়, কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের জন্যে বাপমাকে ফেলে চলে গেল। এখন শুনেছি ফোন পর্যন্ত করে না।

অন্যের কথা না ভেবে কী করা যায় চিন্তা করো।

মেয়েটা কে?

ওর সঙ্গে পড়ে।

কীরকম ফ্যামিলির মেয়ে? তোমার ছেলেকে নিশ্চয়ই কলেজে ঢোকার পর চিনেছে, এর মধ্যেই এতটা এগিয়ে গেল? বাপ-মায়ের কোনও শিক্ষা নেই?

সেটা তোমার ছেলের ক্ষেত্রেও তো বলা যায়।

আমার ছেলে বলবে না।

ছেলে তো আমার একার হতে পারে না।

ইন্দ্রজিৎ কিছুক্ষণ কথা বলল না। সুনেত্রাও চুপ করে বসে রইল। ইন্দ্রজিতের মনে হচ্ছিল বুকের ভেতরটা কীরকম হুঁ-হুঁ ফাঁকা হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত সে কথা বলল, ব্যাপারটা হয়েছে কোথায়?

আমি জানি না। বলেনি।

এই বয়সে হোটেলে ঢুকেছে। ভাবো। ভেতরে-ভেতরে কত বড় ক্রিমিন্যাল হয়ে উঠেছে। উঃ। কখন আসবে কিছু বলে গেছে?

না। সুনেত্রা বলল, শুধু বলেছে মেয়েটাকে সাহায্য করতে।

সাহায্য করতে? আমরা কী সাহায্য করব? যাদের মেয়ে তারা করবে। মেয়েটার বাবা-মা জানে?

আমি কিছু জানি না। বললাম তো কথাটা শুনে এমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম যে–! তা ছাড়া বলেই ও সুইমিং-এ চলে গিয়েছিল।

সুইমিং? আমি ক্লাবে ফোন করছি।

দাঁড়াও। ও তো ব্যাপারটা নাও বলতে পারত।

না বলে উপায় নেই। বিয়ে করে খাওয়াতে হলে বাপের হোটেলে বউকে নিয়ে আসতে হবে। অতএব বলতে বাধ্য। অতএব ওই উনিশ বছরের ছেলের বিয়ে দাও। বাকি জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাক।

বিয়ে ছাড়া কি অন্য কোনও উপায় নেই?

অন্য উপায়? অ। সেটার জন্যে তোমাকে বলার কি দরকার? নিজেরা যখন অতটা এগিয়েছে তখন বাকিটাও পারবে। কলকাতা শহরের অলিতে-গলিতে এখন ওসবের ব্যবস্থা আছে।

বিরক্তিতে স্থির হতে পারছিল নাইন্দ্রজিৎ।

নিশ্চয়ই সাহস পায়নি। পেলে বলত না, আমরা জানতেও পারতাম না। তুমি ওকে ক্রিমিন্যাল বলছ, পুরোপুরি তাই হলে আমাদের জানাত না।

সুনেত্রার বক্তব্য অস্বীকার করতে পারল না ইন্দ্রজিৎ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মেয়েটা ওর সঙ্গে পড়ে। তার মানে সমান বয়স। বড়ও হতে পারে। না হলেও সমবয়সি ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি ম্যাচিয়োর্ড হয়। ওই মেয়েটা ইন্টেনশনালি করেনি তো?

সুনেত্রা উঠে দাঁড়াল, তোমার মাথা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে!

ছেলে ফিরল ঘণ্টা দুয়েক পরে। স্নান সেরে ঝকঝকে হয়ে। ড্রইংরুমে ঢুকে দেখল বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে ভাঁজ পড়ল তার, কিছু বলবে?

ইন্দ্রজিৎ হতভম্ব হয়ে গেল। এতবড় একটা কান্ড করার পর এই গলায় প্রশ্নটা করে কি করে? এই সময় সুনেত্রা ঘরে ঢুকল, বোস, কথা আছে।

ছেলে বলল, তাড়াতাড়ি বলো, কুইজটা শুনতে হবে।

সুনেত্রার গলার স্বর বদলাল, তোমাকে এখন এখানেই বসতে হবে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বসল ছেলে, ইন্দ্রজিতের উলটো দিকে।

তুমি যা বলে গেলে সেটা সত্যি? সুনেত্রা জিগ্যেস করল।

বাঃ, মিথ্যে বলব কেন?

তো-তোর লজ্জা করছেনা এইভাবে কথা বলতে। ইউ-ইউ! ইন্দ্রজিতের কথা জড়িয়ে গেল। সুনেত্রা বলল, প্লিজ, আমাকে কথা বলতে দাও।

ছেলে বলল, আমি বুঝতে পারছি না। মিথ্যে কথা বলব কেন! বলে আমি কি খুব অন্যায় করেছি। বাবা এত এক্সাইটেড হয়ে পড়েছে কেন?

সুনেত্রা হাত তুলল, তোমার কি একবারও মনে হচ্ছে না কাজটা অন্যায় হয়েছে?

ওয়েল, এখন মনে হচ্ছে। ছেলে মাথা নাড়ল, বাট উই নেভার থট অফ ইট। টিলা এখন এতটা আপসেট যে মনে হচ্ছে অন্যায় হয়েছে।

ওর বাবা-মা জানে? সুনেত্রা প্রশ্ন করল।

ওঃ, নো। জানলে ওর বাবা ওকে কেটে ফেলবে।

ফেলাই উচিত। শুধু ওকে নয়, তোমাকেও। ইন্দ্রজিৎ চিৎকার করল।

সুনেত্রা বলল, প্লিজ! তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, টিলা ওর মাকে বলছেনা কেন?

মায়ের কোনও ভয়েস নেই। শুনলেই বাবাকে বলে দেবেন।

কিন্তু এটা তো বেশিদিন গোপন করে রাখা যাবে না।

জানি! আমি অলরেডি স্টাডি করেছি। তাই তো তোমাকে সাহায্য করতে বললাম।

কিন্তু আমরা কীভাবে সাহায্য করব?যাদের মেয়ে তারা যদি না করে!

সুনেত্রার কথার পরেই প্রশ্ন করল ইন্দ্রজিৎ, কোথায় গিয়েছিলি? কোন হোটেলে?

হোটেলে? হোটেলে যাব কেন? অবাক হল ছেলে।

হতাশ চোখে ইন্দ্রজিৎ সুনেত্রার দিকে তাকাল।

ব্যাপারটা কি করে হল তোর বাবা জানতে চাইছে।

তাই বলো। সুভদ্রদের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমরা। জাস্ট আড্ডা মারতে। সুভদ্রর বাবা-মা। বাড়িতে ছিল না। ওরও কোথাও যাওয়ার দরকার ছিল। আমাদের বলেছিল ঘণ্টাখানেক বাড়ি পাহারা দিতে। ওয়েল, হঠাৎই, বিশ্বাস করো, কোনও প্ল্যান ছিল না। জাস্ট হ্যাপেন্ড।

বাড়িতে চাকরবাকর ছিল না? ইন্দ্রজিতের গলা ফ্যাসফেসে শোনাল।

দোতলায় না ডাকলে ওরা ওঠে না।

ইন্দ্রজিৎ উঠে দাঁড়াল, শোনো, তোমার এখানে থেকে পড়ার দরকার নেই। ব্যাঙ্গালোর, আমেদাবাদ, দিল্লি যেখানে হোক চলে যাও পড়তে। তোমার এখানে থাকা চলবে না।

বাঃ। আমি এখন ওসব জায়গায় অ্যাডমিশন পাব?কবে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি চলে গেলেই টিলার প্রব্লেম সলভ হবে?

সেটা টিলার প্রবলেম।

না। আমাদেরও। আমারও। ছেলে উঠে দাঁড়াল।

সুনেত্রা কথা বলল, ঠিক আছে, আমি টিলার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওকে এখানে আসতে বল।

সোমবার বিকেলে যখন ছেলের সঙ্গে টিলা বাড়িতে এল তখন ইন্দ্রজিৎ অফিসে। এক নজরেই সুনেত্রা বুঝতে পারল মেয়েটার মুখ শুকনো। বসতে বলে কয়েক মুহূর্ত ভাবল সে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, এমন বোকামি করলে কেন?

টিলা বাবির দিকে তাকাল, কাঁধ ঝাঁকাল।

কটা মাস মিস করেছ?

একটা।

এটা অন্য কারণেও হতে পারে।

মাথা নাড়ল টিলা, না। আমি ইউরিন পরীক্ষা করিয়েছি।

সে কি? তুমি নিজে প্যাথলজিতে নিয়ে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ। অন্য নাম বলেছিলাম।

তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ে এতবড় ভুল করতে পারে ভাবা যায় না।

ওর একার দোষ নেই মা? ইনফ্যাক্ট ওর ইচ্ছে ছিল না। আমি ইনসিস্ট করলাম বলেই। বাবি বলল।

ছেলের দিকে তাকাল সুনেত্রা। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে পারল সে। এরা কি নির্লজ্জ যা বলছে তার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না?

টিলার দিকে তাকাল, সে, তোমার মাকে বলছ না কেন?

আমার মায়ের কোনও পার্সোনালিটি নেই। ওঁকে বললেই বাবা জানবে। বাবা এটাকে কিছুতেই মেনে নেবে না। টিলা বলল।

কী করবেন?

আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন।

নিজের একমাত্র মেয়েকে কেউ বাড়ি থেকে বের করে দেয় না।

আপনি জানেন না আন্টি, বাবা পারেন।

তাহলে তো এই ব্যাপারটাকে আইনসঙ্গত করতে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হয়।

অন্যমনস্ক গলায় বলল সুনেত্রা।

ইম্পসিবল। মাথা ঝাঁকাল টিলা।

মানে?

আপনি কি বিয়ের কথা ভাবছেন? সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল টিলা। এটাই তো স্বাভাবিক।

আপনি বুঝতে পারছেন না, ওকে আমি বিয়ে করতে পারি না। কী আশ্চর্য! বিয়ে করব কেন?

অবাক হয়ে গেল সুনেত্রা, মানে? তোমরা, ভালোবাসো, অথচ—

না তো। ভালোবাসি কে বলল? উই আর নট ইন লাভ। কিরে, বল না আমি যা বলছি ঠিক কি না! টিলা বাবির দিকে তাকাল।

ঠিক। বাবি মাথা নাড়ল।

হতভম্ব হয়ে গেল সুনেত্রা, সে কি?

টিলা বলল, ওকে দেখে কখনই মনে হয়নি ভালোবাসব। এই রকম, কোনও চিন্তা মাথাতেই আসেনি। টিলার গলায় জোরাল প্রতিবাদ।

অসহায় চোখে ওদের দেখল সুনেত্রা। তারপর বলল, তুমি তো যথেষ্ট বড় হয়ে গেছ। সমস্যার সমাধান নিজেই করে নাও।

চোখ বন্ধ করল টিলা, আমার ভয় লাগছে আন্টি।

আশ্চর্য! অতটা এগোতে পেরেছ যখন তখন এটাও পারবে। সুনেত্রা মাথা নাড়ল।

টিলা বাবির দিকে তাকাল। বাবি বলল, মা, প্লিজ! উই ডোন্ট নো এনি প্লেস। যদি কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়–।

তুমি কি চাও তোমার মা-বাবাকে না জানিয়ে তোমাকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাব আমি? এটা কত বড় অন্যায় জানো? সুনেত্রা রেগে গিয়ে প্রশ্ন করল টিলাকে।

কেন? অন্যায় কেন? আমি এখন অ্যাডাল্ট। আমার সব কাজের জন্যে মা-বাবাকে কৈফিয়ত দিতে হবে, না দিলে অন্যায় হবে কেন? টিলা বলল।

তোমাদের বোঝানো শিবের পক্ষে সম্ভব নয়। ঠিক আছে, আমি ভাবি। কিন্তু যদি তাই করি তাহলে একটা কন্ডিশনে করব!

বলুন! টিলা তাকাল।

তোমাদের দুজনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক থাকবে না।

সম্পর্ক মানে? বাবি জিজ্ঞাসা করল।

তোমরা আর কখনও পরস্পরকে মিট করবে না।

বাঃ, কলেজে গেলেই তো দেখা হবে।

সেটা হোক। কিন্তু ক্লাসের বাইরে কথা বলবে না। টিলা মাথা নাড়ল, ঠিক আছে, নো প্রবলেম অ্যান্টি।

কথাগুলা শোনার পর ইন্দ্রজিৎ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। সুনেত্রা জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলছ না যে?

এখন সবে সন্ধে পেরিয়েছে। অফিস থেকে ফিরে সদ্য শেষ করা চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ বলল, এদের কেউ বুঝতে পারবে না।

বোঝাবুঝি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। মেয়েটার তো সর্বনাশ হবে।

আমাদের কি দায়িত্ব আছে? ইন্দ্রজিৎ তাকাল।

আছে। যদি উলটোপালটা জায়গায় গিয়ে অ্যাবরশন করিয়ে খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে তো পুলিশ তোমার ছেলেকে ধরবে। সুনেত্রা বলল। আমার ছেলে বোলো না। মাথা নাড়ল ইন্দ্রজিৎ, আমি ওর ব্যবস্থা করেছি।

কি ব্যবস্থা?

ওকে এখানে রাখব না। চেন্নাইতে পাঠিয়ে দেব। ওখানে সেসন দেরিতে আরম্ভ হয়। কম্পিউটার ওখানেও শিখতে পারবে।ইন্দ্রজিৎ বলল।

তুমি পাগল হয়ে গেলে? যে ছেলে জয়েন্ট দিয়ে যাদবপুরে সুযোগ পেয়েছে তাকে পাঠাবে একটা কম্পিউটার স্কুলে পড়তে? সুনেত্রা আঁতকে উঠল।

ওর ওই ট্রিটমেন্ট দরকার। মাথা নাড়ল ইন্দ্রজিৎ, ভালোবাসাবাসি নেই অথচ ওটা হয়ে গেল। এ তো পশুদের মধ্যে হয়।

আমার কিন্তু মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে।

মানে?

একটা মেয়ে এমন সমস্যায় পড়েও সত্যি কথাটা বলছে এটা কজন পারে? ও বাবিকে ভালোবাসে না, বাবিও না। কিন্তু এখন তো বলতেই পারত ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে হবে বাবিকে। সেটা তো বলেনি। সুনেত্রা বলল।

হুম!

শোনো, ডক্টর চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা বলব?

কী বলব?

একটা ব্যবস্থা করে দিতে–।

চমৎকার বুদ্ধি! ছেলে একটা কাণ্ড করে ফেলেছে অতএব আপনি মুক্তির ব্যবস্থা করে দিন। এই বলবে?

তুমি আমার সব কথার খুঁত ধরো অথচ নিজে কোনও রাস্তা বলবে না।

দ্যাখো, মেয়েটা নাবালিকা নয়। তুমি ওকে নিয়ে সোজা কোনও নার্সিংহোমে যেতে পারো। তোমার মেয়ে পরিচয় দিয়ে মুক্ত করিয়ে আনতে পারো। কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? ওর মা-বাবা যদি জানতে পারেন তাহলে কী কৈফিয়ত দেবে?

ঠিকই! তা ছাড়া যদি নার্সিংহোমে খারাপ কিছু হয়ে যায় তাহলে তো হাতে হাতকড়া পড়বে। শিউরে উঠল সুনেত্রা।

আরও আছে। এই ঘটনাটা মেয়েটাকে ভবিষ্যতে বিপদে ফেললেও ফেলতে পারে। না-না, ওকে বলো নিজের বাপ-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

সুনেত্রার কথাটা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু চোখ-কান বুজে পরের সকালে ছেলেকে জানিয়ে দিল।

দিন চারেক বাদে বাবি কলেজে কীসব অনুষ্ঠান আছে বলে সকাল-সকাল বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ফোনটা বাজল। সুনেত্রা ফোন ধরল।

নমস্কার। আমি টিলার মা।

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল সুনেত্রার, ও হো। নমস্কার।

টিলা আপনাদের বাড়িতে পৌঁছেছে?

না, মানে–।

ওকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। ও গেলে প্লিজ বলে দেবেন যাতে ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। নইলে ওর বাবা রাগারাগি করবেন।

আচ্ছা!

আপনাদের কথা শুনেছি, আলাপ হয়নি, একদিন আসুন না।

ঠিক আছে, বেশ তো–।

রিসিভার নামিয়ে স্বস্তি পেল সুনেত্রা। ভদ্রমহিলা এখনও কিছু জানেন না। কিন্তু টিলার কি এ বাড়িতে আসার কথা আছে? কই, বাবি কিছু বলে যায়নি তো! কেন আসবে! কেন আসবে? যা বলার বাবিকেই বলে দেওয়া হয়েছে, নতুন কিছু তো বলার নেই। তারপরেই খেয়াল হল, বাবি গিয়েছে কলেজের অনুষ্ঠানে। সারাদিন হবে। নিশ্চয়ই টিলা সেখানে যাবে। হয়তো যাওয়ার আগে তার সঙ্গে কথা বলে যেতে চায়। বাড়িতে নিশ্চয়ই কোনও অজুহাত দিয়েছে এখানে আসার ব্যাপারে।

বিকেল তিনটে নাগাদ ফোন এল, মা, কী করছ?

কী করছি মানে? তুই কোথায়?

নার্সিংহোমে। এক্ষুনি চলে এসো। এটা থার্টি থ্রি বাই সি পার্কসার্কাস স্ট্রিট। নার্সিংহোমের নাম সানফ্লাওয়ার–প্লিজ।

তুই নার্সিংহোমে কী করছিস? সুনেত্রা অবাক।

টিলার জন্যে। এভরিথিং সেটলড। কিন্তু তোমাকে আসতে হবে। মা, প্লিজ।

এভরিথিং সেটলড? তার মানে ওরা নিজেরা গিয়ে সবকিছু করিয়েছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল সুনেত্রার। কোনও মতে জিজ্ঞাসা করল, কখন হল?

আজ সকালে। এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল, একটু ঘুমিয়েছে।

এখন?

কথা বলছে, তবে এখনও পুরো ফিট নয়। হঠাৎ রাগ হয়ে গেল সুনেত্রার, আমি গিয়ে কী করব?

নার্সিংহোমে বলেছি রিলিজের সময় মা আসবে।

আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। টেলিফোন রেখে দিল সুনেত্রা। কয়েক মিনিট পর ভাবনাটা মাথায় এল। একবার ভাবল স্বামীকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করবে কী করা উচিত। এমন হতে পারে ওদের কাছে নার্সিংহোমের বিল মেটানোর মতো টাকা নেই। তাহলে তো বিরাট সমস্যায় পড়বে। মেয়েটার যে কিছু হয়নি সেটা জেনে অবশ্য ভালো লাগছে। কিন্তু বাড়িতে যখন ফিরবে তখন মায়ের চোখে ধরা পড়ে যাবে না? সুনেত্রারই কীরকম ভয়-ভয় করতে লাগল।

শেষপর্যন্ত আর পারল না সে। গাড়ি দুটো, কিন্তু ড্রাইভার একটা–যে ইন্দ্রজিতকে অফিসে নিয়ে গিয়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে সুনেত্রা পৌঁছাল নার্সিংহোমে গেটেই ছেলে দাঁড়িয়ে? তাকে দেখতেই মুখ হাসিতে ভরে গেল। সুনেত্রা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

তিন নম্বর কেবিনে। চলো। পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ছেলে।

টিলা শুয়েছিল, চোখ বন্ধ। সুনেত্রা ঢুকতেই চোখ খুলল। দেখে উঠে বসল চট করে। সুনেত্রা বাধা দিল, আরে, উঠছ কেন? শুয়ে থাকো।

না। না। আই অ্যাম ওকে, ফাইন।

কিন্তু তোমার চোখে ঘুম আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে অসুস্থ।

এই সময় একজন নার্স ঢুকল, কেবিনে, ও কিছু নয়, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কেটে যাবে। তারপর দেখবেন ঘুমোবে। কাল সকালে ওকে দেখে বুঝতেই পারবেন না।

আজই ছেড়ে দেবেন? সুনেত্রা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। ও এখনই চলে যেতে পারে। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে না হয় থাকুক।

নার্স চলে গেলে সুনেত্রা জিজ্ঞাসা করল, বিল কত হয়েছে?

তোমার কাছে টাকা ছিল?

বাবি বলল, ফিফটি-ফিফটি দিয়েছি। এখন আমি বেগার।

তাহলে আমাকে ডাকলি কেন?

আন্টি, প্লিজ একটা অনুরোধ করব? টিলা অনুনয় করল।

সুনেত্রা তাকাল, কথা বলল না।

আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন?

তোমাকে?কেন?

আপনি জাস্ট বলবেন দুপুরে আজেবাজে খেয়ে আমার পেটে গোলমাল হয়েছে। আপনার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। আপনি ওষুধ দিয়েছেন। এখন ভালো আছি। ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাব। তাই পৌঁছে দিয়ে গেলেন। আমি এত মিথ্যে বলতে যাব কেন? আমাকে বাঁচাতে। নইলে মা-বাবা ঠিক।

সুনেত্রা ভাবল। এমন তো হতেই পারে। টিলাকে তো সে নার্সিংহোমে নিয়ে আসেনি। ভেবে বলল, একটাই শর্ত, যা আগে বলেছি, তোমরা আর ক্লাসের বাইরে দেখা করবে না।

ডান। বাবি বলে উঠল। টিলাও মাথা নাড়ল।

টিলার বাবা ছিলেন না। ওর মা ব্যস্ত হলেন মেয়েকে দেখে, কী হয়েছে?

টিলা বলল, কিছু হয়নি। সুনেত্রা আন্টি!

সুনেত্রা বলল, যাও রেস্ট নাও। তারপর বলল, আজ সকালেই আপনার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হল, তখন ভাবিনি বিকেলে দেখা হবে। আসলে হয়েছে কি আপনার মেয়ে কলেজের অনুষ্ঠানে উলটোপালটা কিছু বোধহয় খেয়েছিল। আমার বাড়িতে এসে বমি করল। আমি ডাক্তারকে ফোন করে ওষুধ আনিয়ে খাইয়ে দিয়েছি। এখন ভালো আছে। বললাম একা ছাড়ব না, চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

খুব ভালো করেছেন। এত করে বলেছি বাইরের খাওয়ার খাবি না, কথা শোনে না।

ওকে এখন ঘুমোতে দিন, ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে। সুনেত্রা হাসল, আচ্ছা, চলি।

সেকি! আপনি প্রথম এলেন, একটু বসুন, চা খান।

না-না। ওসব আর একদিন হবে। জরুরি কাজ আছে। আচ্ছা নমস্কার। সুনেত্রা যেন পালিয়ে এল, এসে বাঁচল।

রাত্রে স্বামীকে ঘটনাটা বলতে গিয়েও পারল না সুনেত্রা। প্রতিক্রিয়া কি হবে কে জানে। কিন্তু ছেলের জন্যে এটুকু না করলে টিলার ক্ষতি হত, কথাটা ইন্দ্রজিৎ বুঝতে চাইবে না।

দিন সাতেক বাদে ইন্দ্রজিৎ বলল, সামনের সোমবার তোমার ছেলেকে চেন্নাই পাঠাব। হ্যাঁ, মেয়েটার খবর কি?

ঠিক আছে।

তার মানে?

মুক্তি পেয়ে গেছে।

সেকি? ওর মা-বাবা হেল্প করলেন?

না, নিজেরাই।

মাই গড। তোমার ছেলে এতবড় তালেবর হয়ে গেছে যে মেয়েটাকে নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে। ওই বয়সে আমি কল্পনাই করতে পারতাম না। ওকে ডাকো। এখনই। কথা বলব। ইন্দ্রজিৎকে হিংস্র দেখাল।

এসব ব্যাপারে কথা না বললে নয়?

এসব ব্যাপারে কথা বলতে আমার ঘেন্না করবে। ওকে চেন্নাই-এর কথা বলব। প্রসপেক্টাস আনিয়েছি, দেব।

সুনেত্রা অবাক হল। বাবি চেন্নাই-এর প্রস্তাব শুধু মেনেই নিল না, যাওয়ার জন্যে বেশ উৎসাহী হল। চেন্নাই-এর কলেজে কম্পিউটার নিয়ে পড়ার সুযোগ পেলে নাকি অনেক বেশি এক্সপোজার পাওয়া যাবে। সুনেত্রারও মনে হল, এই ভালো। প্রথম বয়সের ভুলটাকে ভুলে যেতে পারবে ওরা। নিত্য ওদের সমস্যায় জড়াতে হবে না তাকে।

কদিন থেকেই টেলিফোন ঘন-ঘন বাজছে। চেন্নাই চলে যাবে বলে বন্ধুরা ফোন করে যাচ্ছে। ছেলে চেঁচিয়ে কথা বলছ। কেউ আপত্তি জানালে উড়িয়ে দিচ্ছে। একটু আগে যে টেলিফোনটা এল সেটা ধরে ছেলে কথা বলছিল হইহই করে, হঠাৎ গলা নেমে এল। তারপর ছেলে এল সুনেত্রার কাছে, মা তোমার ফোন!

কে?

ছেলে গম্ভীর হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রিসিভার তুলল সুনেত্রা, হ্যালো।

আন্টি! আমি টিলা।

ও। কি খবর? কেমন আছ?

আন্টি, আজ আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে বলল ও এখান থেকে চলে যাচ্ছে চেন্নাই-তে।

কেন?

বেটার এক্সপোজার পাবে, তাই বোধহয়।

কথাটা ও তো আমাকে জানাতে পারত।

আমি তো তোমাদের নিষেধ করেছিলাম।

কেন?

আশ্চর্য? তোমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসোনা, মিছিমিছি কেন যোগাযোগ রাখবে? রাখলেই তো অতীতটা মনে পড়বে।

বাট আন্টি–!

তুমি কিছু বলবে?

আই হ্যাভ ডিসকভার্ড সামথিং।

কী সেটা?

আমি ওকে ভালোবাসি। রিয়েলি, বিশ্বাস করুন।

টিলা–।

হ্যাঁ আন্টি! ইটস লাইক এ আবিষ্কার!

তুমি কি বলছ?

আমি একদম ঠিক বলছি। কথাটা আমি ওকে বললাম। অদ্ভুত ব্যাপার, ও নাকি এটা ডিসকভার করেছে বলে চেন্নাই-এ যাওয়ার কথা আমাকে জানাতে পারেনি।

তুমি কি চাইছ ও চেন্নাই-তে না যাক? সুনেত্রা জিজ্ঞাসা করল।

নট দ্যাট। ভালো হলে ও যাক। কিন্তু অ্যান্টি, আমি যদি মাঝে-মাঝে আপনাকে ফোন করি, আপনার আপত্তি আছে?

না। নেই। তোমার ফোন পেলে খুশি হব।

রিসিভার নামিয়ে ছেলের দিকে তাকাল সুনেত্রা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, টিলা কী বলল তুই বুঝতে পেরেছিস?

মাথা নাড়ল ছেলে, ইটস নট আওয়ার ফল্ট, মা। হঠাৎ হয়ে গেল। আমি চেন্নাই চলে গেলে প্লিজ হেল্প হার। করবে তো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress