জল্পনা এবং জুতো
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে বনবাংলোর বারান্দায় বসে কফি পানের এই অভিজ্ঞতা তুলনাহীন। বৃদ্ধ প্রকৃতি প্রেমিক মুগ্ধভাবে কথাগুলি উচ্চারণ করলেন। তারপর চুরুট জ্বেলে আমার দিকে তাকালেন। তোমাকে বলেছিলাম জয়ন্ত, ভীমগড়ের বৃষ্টি ভীমের মতোই দুর্ধর্ষ।
আমার মনে বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বৃষ্টির দিকে মন যাচ্ছিল না। ভদ্রলোক একবার না হয় কোনও কারণে মিথ্যা বলেছেন, দ্বিতীয়বারও কি মিথ্যা বলবেন? বিশেষ করে নবকুমারবাবুর এক পাটি পামসু এবং রক্ত। আবিষ্কারের মতো সাংঘাতিক ধোঁকাবাজি করবেন
আমাকে চুপচাপ দেখে কর্নেল বললেন, তুমি দেখতে পাচ্ছ কেল্লাবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ঘাসে নবকুমারের চাপ-চাপ রক্ত বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। একপাটি পামসুও ভিজতে পারে, যদি না বটকৃষ্ণবাবু তা হাতিয়ে থাকেন। বলে বটকৃষ্ণবাবুর সেই কথা তিনটি আওড়ালেন। হুঁ, বুঝেছি। কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো।
ক্ষুব্ধভাবে বললাম, আপনার এই হেঁয়ালিপনা এক বিচ্ছিরি অভ্যাস কিন্তু। এক ভদ্রমহিলা এজন্যই আমাকে বলেছিলেন, আপনার ওই কর্নেল ভদ্রলোক বড্ড ন্যাকা।
হ্যাঁ, ন্যাকা। কর্নেল হাসলেন। আর তুমি হেঁয়ালিপনা বললে! সত্যিকার হেঁয়ালিতে নিজেই যখন হাবুডুবু খাই, তখন হেঁয়ালির লেজ ধরে টেনে তোমাকে দেখাই যদি তুমি এমন কোনও সূত্র দিতে পারো, যাতে উদ্ধার পাই। ডার্লিং। আমাকে বাধ্য হয়েই ন্যাকা সাজতে হয়। কেন জানোনা? যে ঘটনার কিছুটা জানি, বাকিটা জানি না, তখন ন্যাকামি আমাকে উদ্দীপ্ত রাখে। অর্থাৎ অন্যের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাই। তো দেখা যাচ্ছে, বটকৃষ্ণবাবুর সেই শেষ সংলাপ তোমার মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করতে পারেনি।
আপনার পেরেছে?
পেরেছে। সেটাই সমস্য। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, প্রথমত বটকৃষ্ণবাবুর আচরণের কথাই ধরো। কেন উনি নিজেকে ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার বলে পরিচয় দিলেন?
শুনলাম তো। এটা ওঁর স্বভাব। এই করে উনি লোককে ঠকান।
কিন্তু আমাদের কাছে কিসের আশায় উনি মিথ্যা পরিচয় দিলেন? এর একটাই জবাব হয়। উনি সাঁতরা পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটাতে চেয়েছিলেন। আমি রহস্যভেদী এবং তুমি আমার ছায়াসঙ্গী, তা উনি সত্যসেবক পত্রিকা পড়ে জেনেছেন। এদিকে দেখ, সত্যিই সাঁতরা পরিবারে একটা রহস্য আছে এবং দয়াময়ী দেবী আমাকে ওই অদ্ভুত শব্দছক আঁকা কাগজটা দিয়েছেন। বটকৃষ্ণবাবু কিন্তু আমাকে কাগজ দেওয়ার কথা জানেন না। তবু উনি নিজেকে অনিলবাবু বলে পরিচয় দিয়েছিলেন স্টেশনে। এবার চিন্তা করো, বটকৃষ্ণবাবুর উদ্দেশ্য কি ছিল।
বুঝলাম। আপনার কীর্তিকলাপ পড়ে ওর মাথাতেও রহস্যভেদের বাতিক চাড়া দিয়েছে।
ঠিক তা-ই। এবার দেখ, উনি ছিলেন পোস্টম্যান। প্রসন্ন রায়ের ঠিকানায় আসা একটি চিঠি–যার মধ্যে ওই স্বস্তিকা এবং শব্দছক আঁকা ছিল, সেটা উনি দয়াময়ী সাঁতরার লেটারবক্সে ফেলেছিলেন কেন?
বটকৃষ্ণবাবুর অন্যের চিঠি খুলে পড়ার অভ্যাস ছিল নিশ্চয়?
নাহ। খামে প্রেরকের নাম ছিল না। কিন্তু ডাকঘরের সিল ছিল। পোস্টম্যানরা অস্পষ্ট সিল পড়তে পারে। ওটা অভ্যাস! যেমন ছাপাখানার কম্পোজিটাররা খারাপ হাতের লেখাও কম্পোজ করতে পারেন। পোস্টিং অফিসের সিল আমিও আতসকাঁচে পড়েছি। ওটা পোস্ট করা হয়েছিল কেদারনাথ থেকে।
নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস্। তাহলে কি খামটা প্রসন্নবাবুর দাদা সেই সন্ন্যাসী–
আমার কথার উপর কর্নেল বললেন, বাহ। বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। সংসারত্যাগী প্রশান্ত রায়ই ওটা ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বটকৃষ্ণবাবুর ওই বদ অভ্যাসটাও সত্যি। শব্দছকটা টুকে নিয়ে কেল্লবাড়ির তলায় গুপ্ত কোন ভাস্কর্যের লোভ দেখিয়ে পাটোয়ারিজির কাছে অন্নের সংস্থান করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কারণ আজ সুন্দর সিং পাটোয়ারির বাড়িতে কিছু প্রত্নভাস্কর্যের নকল দেখেছি। তাছাড়া উনি বড় ব্যবসায়ী। একটা সত্যিকার প্রত্নভাস্কর্য হাতাতে পারলে বিদেশে বহু টাকায় পাচার করতেও পারবেন। ক্লিয়ার?
কিন্তু প্রত্নভাস্কর্য আসছে কোথা থেকে
স্বস্তিকা নাগমিথুনের প্রতীক, তা তোমাকে বলেছি। গুপ্তযুগের মন্দিরে ওই প্রতীক সর্বত্র ব্যবহার করা হত।
বুঝলাম। কেল্লাবাড়িতে কোথাও গুপ্তযুগের কোন প্রত্নভাস্কর্য গুপ্তধনের। মতো লুকোনো আছে। এই তো?
তাই তো মনে হচ্ছে। শব্দছকটা হয়তো তা খুঁজে বের করার সূত্র।
বটকৃষ্ণবাবু কেমন করে সেই রহস্য টের পেলেন?
এর উত্তর উনিই দিতে পারেন।
আরও প্রশ্ন আছে কর্নেল। উনি দয়াময়ী দেবীর লেটারবক্সেই বা কেন তা ফেলেছিলেন?
এর উত্তরও বটকৃষ্ণবাবু দিতে পারেন।
দয়াময়ী দেবীই বা প্রসন্নবাবুর ঠিকানা লেখা খাম খুলেছিলেন কেন?
কর্নেল হাসলেন। প্রসন্নবাবু ওঁর স্বামীর শত্রু। জমিজায়গা নিয়ে মামলা। কাজেই দয়াময়ী দেবীর কৌতূহল স্বাভাবিক ছিল। বিশেষ করে ওই হেঁয়ালি আঁকা ব্যাপারটা–হ্যাঁ, তোমাকে আগেই বলেছি, ভবিষ্যতে কোনও কাজে লাগতে পারে ভেবে গোপন রেখে দিয়েছিলেন।
দয়াময়ী আপনাকে মামলার কি অবস্থা এখন, তা বলেননি?
উনি জানেন না। কারণ ওঁর দেবর নবকুমারবাবু মামলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাছাড়া পারিবারিক কলহ বা শরিকি ঝামেলা তো থাকেই এসব ক্ষেত্রে।
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, বটকৃষ্ণবাবুর এই চিঠিটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আমার ভয় হচ্ছে, যদি সত্যি নবকুমারবাবু খুন হয়ে থাকেন
কর্নেল বললেন, ডিনার সেরে নেওয়া যাক। বেচারা কৃপানাথ ঢুলছে। কেউ কোথাও রক্ত এবং জুতো পড়ে থাকতে দেখে খবর দিলেও রাতের বৃষ্টির মধ্যে আমি দৌডুচ্ছি না।
বাংলোর ছোট্ট ডাইনিং রুমে আমরা খেতে গেলাম। কৃপানাথ উৎকৃষ্ট রাধে। কিন্তু খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। এক সময় বললাম, বটকৃষ্ণবাবুর শেষ সংলাপ নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?
কর্নেল মুরগির ঠ্যাং কামড়ে ধরে বললেন, উনি তোমাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তুমিও মিথ্যা খুন-খারাপির কথা বলেছিলে তাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মিথ্যাগুলোর আড়ালে একটা কঠিন সত্য আছে। উনি তোমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন। তাই না?
ভীষণ অবাক।
তার মানে, উনি জানতেন কাউকে খুনের চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু ওঁর ধারণা ছিল, তাকে খুন করা সম্ভব নয় এবং কোনও ভাবেই নয়। যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবুকে মুখোমুখি না পেলে কিছু জানা যাবে না।
খাওয়া শেষ করে আমরা ঘরে ফিরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। সেই সময় হঠাৎ পিছনের খোলা জানালার নিচে ভিজে কাগজের একটা মোড়ক দেখতে পেলাম। সেটা তুলে নিয়ে দেখি, একপাটি পামসু। চমকে ওঠে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! একপাটি জুতো। পামসু।
কর্নেল একবার দেখে নিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, রেখে দাও—