Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বর্গের বাহন || Syed Mustafa Siraj » Page 6

স্বর্গের বাহন || Syed Mustafa Siraj

সকালে উঠে দেখলাম ঘন কুয়াশা চারদিকে। তাতে কর্নেলের প্রাতঃভ্রমণের ব্যাঘাত ঘটেনি। কখন বেরিয়ে গেছেন জানি না। আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে যখন রোদ ফুটল, তখন একা বেরিয়ে পড়লাম। একা চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগছিল না বলেই।

তাছাড়া একটু উদ্বেগও হচ্ছিল। ফেরারি দাগি আসামি জাভেদ পাঠানের পাল্লায় পড়েননি তো কর্নেল? অবশ্য কাল তার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, সে আমাদের সাধারণ ট্যুরিস্টই ভেবেছে। কিন্তু কর্নেল ওকে বলেছেন, আমরা স্টেশনমাস্টারের কোয়ার্টারে উঠেছি–অথচ আমরা আছি বেগমসায়েবার বাড়িতে। কবরখানা থেকে এটা তো সহজেই তার চোখ পড়তে পারে। কর্নেলের হেঁয়ালী এখনও অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। একথা ঠিক, কর্নেলের বুদ্ধিশুদ্ধিতে আমার আস্থা আছে। কিন্তু উনি তো মানুষ। হিসেবে ভুল করতেও পারেন। এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে নিজামতকেল্লার ধ্বংসস্থূপের ভেতর দিয়ে গঙ্গার দিকে হাঁটছিলাম।

গত কালকের চেনা শর্টকাট পথে কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল, মুনা ও রুনা একটা ভাঙা ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। তারা আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। তারপর রুনা, বলল, “বেড়াতে বেরিয়েছেন জয়ন্তবাবু?”

বললাম, “হ্যাঁ। তোমরা এখানে কী করছ?”

মুনা বলল, “মাম্মুজানকে খুঁজছি।”

অবাক হয়ে বললাম, “সে কী! উনি তত তোমাদের বাড়িতেই ছিলেন।”

রুনা বলল, “আমারই দোষ। মা দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন আমি তো কিছু জানি না। ভোরে উঠে দেখি, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তাই খুলে দিয়েছিলাম। কখন বেরিয়ে গেছেন ছোটমামা। মা খুব বকাবকি করছেন। তাই ওঁকে খুঁজতে বেরিয়েছি।”

কর্নেলের কথাটা মনে পড়ল। বলছিলেন যে নাসির খায়ের জন্য তার ভাবনা হচ্ছে। বললাম, “কাল রাত্তিরে ওঁর গান শুনে মনে হচ্ছিল পাগলামি সেরে গেছে।”

মুনা বলল, “আমরাও তাই ভেবেছিলাম। অনেক রাত্তির অব্দি কথা বললেন–”

রুনা ওর কথা কেড়ে বলল, “সে তো আবোল-তাবোল কথা?”

বললাম, “কী বলছিলেন ছোটনবাব?”

রুনা বলল, “কিছু কি বোঝা যায়? আমি একটুও বুঝতে পারিনি।”

মুনা বলল, “বোঝা যাবে না কেন? বললেন না বোররা আস্তাবলে বাঁধা আছে, দেখে আয় তোরা?”

রুনা চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ–বোররাখের কথাও বলছিলেন ছোটমামা।”

মুনা এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, “মাম্মুজান! মাম্মুজান!” তারপর বাঁদিকে খাড়া দেয়ালের একটা ফোকর গলিয়ে ঢুকে গেল। তাকে অনুসরণ করল রুনা।

আমিও ফোকর গলিয়ে ঢুকলাম। কিন্তু তারপর আর দুই বোনকে দেখতে পেলাম না। তবে যেখানে ঢুকলাম, সেখানকার অবস্থা দেখে শিউরে উঠলাম আতঙ্কে। ওপর থেকে প্রকাণ্ড সব লোহার বিম ঝুলে আছে এবং খানিকটা ছাদও কাত হয়ে আছে। যে-কোনো মুহূর্তে ধ্বসে পড়তে পারে।

প্রাণ নিয়ে পালানোর ভঙ্গিতে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু সর্বত্র একই অবস্থা। এটা একটা বিশাল বাড়ির ভগ্নাবশেষ। তার ভেতর যেখানেই ফোকর পাচ্ছি, সেই ফোকর গলিয়ে এই ভগ্নপুরী থেকে উদ্ধারের আশা করছি। কিন্তু এ যেন এক গোলোকধাঁধা। কিছুতেই বেরিয়ে যেতে পারছি না। তখন যেদিক থেকে এসেছি, সেদিকে ফিরে গেলাম। তাতে পড়লাম আরও বিপদে। সেই ফোকরটা খুঁজেই পেলাম না আর। এবার চেঁচিয়ে ডাকলাম, “মুনা! রুনা! তোমরা কোথায়?

আমার সামনে ছাদ ধ্বসে পড়া একটা স্কুপে জঙ্গল গজিয়েছে। দুই বোনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঝোঁপটার পাশে গেছি, কেউ চাপা স্বরে ধমক দিয়ে বলে উঠল, “অ্যাই বেঅকুফ! চিল্লাতা কহে?”

ঘুরে দেখি, পাগল নাসির খাঁ চোখ কটমটিয়ে বেরিয়ে আসছেন ঝোঁপের পেছন থেকে। আজ পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি আছে বটে, কিন্তু তাতে যথেষ্ট ধুলো-ময়লা লেগে আছে। কঁকড়া চুলে মাকড়সার জাল আর শুকনো পাতা আটকে আছে।

ঝটপট আদাব দিয়ে বললাম, “আদাব ছোটনবাবসায়েব!”

নাসির খাঁও গম্ভীর মুখে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, “আদাবরস! আদাবরস।”

আমার হিন্দি-উর্দুর জ্ঞান নাকি হাস্যকর। সেটা আবার প্রমাণিত হল। যেই বলেছি, “আপকা দো ভাগ্নী আপকো ঢুড়তা হ্যায়” নাসির খাঁ খিক খিক করে হেসে উঠলেন।

বললেন, “আরে ভাই, বাংলাতেই বলো না কেন? তুমি কি ভাবছ আমি বাংলা জানি না!”

অপ্রস্তুত হেসে বললাম, “আপনার ভাগ্নীরা আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

নাসির খাঁ বললেন, “বেড়াচ্ছে তা তো দেখছি। বেড়াক না। তাতে আমার কী, তোমারই বা কী?”

বলে দুর্বোধ্য কী সব কথা বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকলেন। এই গোলকধাঁধার ভেতর পাগলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। বললাম “চলুন ছোটনবাবসায়েব! বাড়ি ফিরে চলুন। আপনার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। আপনার দিদি”।

নাসির খাঁ বাঁকা মুখ করে বললেন, “শাট আপ! দিদি-টিদি চলবে না। আরও কিছু কথা থাকে তো বলো।”

“আমার মনে হয় আপনার একটু সাবধান হওয়া উচিত। কারণ জাভেদ পাঠানকে কাল সন্ধ্যায় কবরখানায় দেখেছি। তার হাতে একটা রাইফেল আছে।”

কথাগুলো বলে ওঁর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু নাসির খায়ের কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না। আমার চোখে চোখ রেখে নির্বিকার তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমাকে অবাক করে চাপা গলায় বললেন, “কত টাকা দেবে বলো?”

“টাকা?”

“হ্যাঁ, হা, টাকা। আস্তাবলে বোররাখ বেঁধে রেখেছি। টাকা দিয়ে নিয়ে যাও।”

উত্তেজনা চেপে বললাম, “ঠিক আছে। চলুন।”

“বিশ হাজার।”

“ঠিক আছে। তাই দেব।”

“মরদকা বাত, হাথিকা দাঁত।” নাসির খাঁ পা বাড়িয়ে বললেন। “মাল হাতে পেয়ে তখন এক কমাতে চাইবে, তা হবে না কিন্তু।”

“আমার এক কথা।” বলে ওকে অনুসরণ করলাম। উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছিল। কর্নেল যে এমন সময়ে কোথায় পাখি-প্রজাপতির পেছনে টো টো করে বেড়ান–কোনো মানে হয়?

সেই ফোকরটা এতক্ষণে চোখে পড়ল। ফোকর গলিয়ে গলিমতো রাস্তায় কিছুটা হেঁটে কঁকা চত্বরে পৌঁছুলাম। নাসির খা আগে হাঁটছিলেন। একটু পরে থমকে দাঁড়ালেন। বললাম, “কী হল?”

নাসির খাঁ কোনো জবাব না দিয়ে হঠাৎ এক দৌড়ে বাঁদিকে সেই বিশাল গম্বুজ ও মিনারওয়ালা মসজিদের পেছনে উধাও হয়ে গেলেন। হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম, মুনা ও রুনা দৌড়ে আসছে। তাহলে ভাগ্নীদের দেখতে পেয়েই আবার পালিয়ে গেলেন নাসির খা!

কিন্তু এবার আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে, নাসির খা হয় সেই হারানো এবং দুর্লভ ঐতিহাসিক ছবির খোঁজ রাখেন, নয় তো সেটা নিজেই লুকিয়ে রেখেছেন।

আস্তাবলে বোররা বেঁধে রেখেছেন–এর মানে অবশ্য নিজেই আস্তাবলের ওখানে লুকিয়ে রেখেছেন তাই বোঝায়। কিন্তু কিছু লুকিয়ে রাখার বুদ্ধি এই পাগল অবস্থায় কি ওঁর আছে? ধরা যাক, পাগল হওয়ার আগেই লুকিয়ে। রেখেছিলেন। পাগল হওয়ার পর যদি তা মনে পড়ে, তাহলে ছবিটা বের করে প্রকাশ্যে হাতে নিয়ে ঘোরাই তো উচিত ছিল! কারণ উনি গতরাতে ভাগ্নীদেরও এই কথা বলেছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, ছবিটার প্রতি তার একটা ফিক্সেশন’ সৃষ্টি হয়েছে অবচেতনায়।

এইসব জল্পনা-কল্পনা করতে করতে দেখলাম, দুই বোন মসজিদের দিকে ছুটে চলেছে। আমি সেদিকে যাব কি না ঠিক করতে পারলাম না। খিদেও পেয়েছে। বেগমসায়েবার বাড়ির দিকেই পা বাড়ালাম।

গিয়ে দেখি, আবু মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “নাশতা করবেন না সার? মাজী বললেন, সায়েবদের ডেকে নিয়ে আয়। তাই আপনাদের খুঁজতে বেরুচ্ছিলাম। বুড়োসায়েব কোথায় সার?”

“তুমি আমাকেই বরং খাইয়ে দাও।” হাসতে হাসতে বললাম। “বুড়োসায়েব যখন ফিরবেন, তখন খাবেন বরং। আমার খিদে পেয়ে গেছে।”

আবুর মুখে তবু হাসি ফুটল না। সে গম্ভীর মুখে চলে গেল ভেতরে। একটু পরে সে তেমনি গুম হয়ে দস্তরখান নিয়ে ফিরে এল। তখন জিগ্যেস করলাম, “কী আবু? শরীর খারাপ নাকি?”

আবু শুধু মাথা দোলাল। বুঝলাম, গতরাতে দস্তরখানের ব্যাপারে বেগমসায়েবা তাকে নিশ্চয় বকেছেন। মিনা ব্রেকফাস্টের প্লেট অর্থাৎ নাশতা নিয়ে এল। গরম গরম পরোটা, সুজির হালুয়া, কষা মুরগির মাংস, দুটো ডিমের পোচ। তার সঙ্গে এক প্লেট খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করে কাটা আপেল আর কমলালেবুর কোয়া। এরপর কফি। বেগমসায়েবার মতে এই নাকি গরিবের ঘরের নাশতা! উপরন্তু এ জিনিস নাকি তার প্রয়াত পিতার মতেও ছিল ছোটলোকের খাদ্য। বেগমসায়েবা তার পিতার যে খাদ্যতালিকা বর্ণনা করেছেন, তা উল্লেখ করতে গেলে মহাভারত হয়ে যায় এবং তা আমার নিজের কাছেই দুর্বোধ্য শব্দসমষ্টি মাত্র। সেইসব অদ্ভুত নাম মনে রাখাও দুঃসাধ্য।

মিনা কফি আনতে গেলে আবুকে জিগ্যেস করলাম, “আজ ভালভাবে মেঝে সাফ করেছ তো?”

আবু গোমড়া মুখে বলল, “আমার হাত থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে মাজী নিজেই–”

সে হঠাৎ থেমে গেল। শামিম-আরা বেগম পর্দা ফাঁক করে একটু হেসে বললেন, “কর্নেল সায়েবের মর্নিংওয়াক এখনও হয়নি?”

“এসে যাবেন এখনই। হয়তো পাখির পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন।”

বেগমসায়েবা বললেন, “আপনি বড্ড কম খান। নাকি আমাদের বাড়ির রান্না পছন্দ হচ্ছে না?”

দ্রুত বললাম, “না, না। কী যে বলেন! এমন সুস্বাদু রান্না আমি জীবনে খাইনি।”

“সত্যি বলতে কী, আমি রান্না জানি না। আগে তো বাবুর্চি ছিল। তাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর মিনাই রান্নাবান্না করে। আমি একটু তদারক করি শুধু।”

বেগমসায়েবা কথাটা বলে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হলেন। আবু প্লেট গুছিয়ে এবং দস্তরখান তুলে নিয়ে চলে গেল। মিনা কফির পট ও পেয়ালা রেখে গেল। কফি খেতে খেতে ব্যাপারটা ভাবতে থাকলাম। ভাজকরা কাগজটা খুঁজে পাওয়ার জন্য বেগমসায়েবাকে ঝাড়ু হাতে নিতে হয়েছিল। নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। কিন্তু এঁটো দস্তরখানের ভেতর রেখে দিয়েছিলেন কেন? অন্যমনস্কতার জন্য, নাকি দ্রুত গোপন করার ঝেকে? কারুর চোখে পড়ার ভয়েই কি ঝটপট লুকিয়ে ফেলেছিলেন হাতের কাছে যা পেয়েছিলেন তার ভেতরেই? বাড়িতে লোক বলতে আবু, মিনা আর তার দুই যমজ মেয়ে। কাল সন্ধ্যার পর অবশ্য নাসির খাঁও ছিলেন। কিন্তু তিনি তো পাগল মানুষ। আর আবু-মিনাকে ওঁর ভয় করার কারণই নেই। অতএব মুনারুনার চোখে পড়ার ভয়েই ঝটপট কাগজটা লুকিয়ে ফেলেছিলেন।…

কর্নেল ফিরে এলেন, তখন দশটা বাজে। বললাম, আমি তো ভাবছিলাম গুলি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে আছে কোথাও। আমি অবশ্য আপনার ডেডবডি উদ্ধারের চেষ্টা করতাম না। আজকের দিনটা কোনোরকমে কাটিয়ে কাল ভোরের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যেতাম।”

কর্নেল আমার কথার দিকে কান করলেন না। পোশাক বদলে আবুকে জানিয়ে দিলেন, বাইরে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছেন। আবুর কাছে জানা গেল, বেগমসায়েবা মিনাকে নিয়ে কোথায় বেরিয়েছেন রিকশো চেপে। মুনা-রুনা ছোটমামাকে খুঁজে না পেয়ে বাড়ি ফিরেছে।

আবু ভেতরে গেলে চাপা স্বরে বললাম, “নাসির খায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমাকে বিশ হাজার টাকায় আস্তাবলে বাঁধা স্বর্গের বাহনটিকে বেচতে চেয়েছেন।”

কর্নেল ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কথাটা শোনার পরও ওঁর কোনো ভাবান্তর ঘটল না। চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়ার ভেতর শুধু বললেন, “হুম!”

বিরক্ত হয়ে বললাম, “বড়বাবসায়েব আপনাকে তার ভগ্নীপতির হত্যা রহস্যের কিনারা করতে বলেছিলেন। আপনি এতসব সূত্র পাচ্ছেন। অথচ কিছু করছেন না। কাল জাভেদ পাঠানকে হাতের কাছে পেয়েও ধরিয়ে দিলেন না! তার হাতে রাইফেল থাক আর যাই থাক, আমরা দুজন ছিলাম এবং তার খুব কাছাকাছিও ছিলাম। রাইফেল ব্যবহারের সুযোগই পেত না সে। তাছাড়া আপনার কাছে রিভলভার আছে বলে জানি।”

এবার কর্নেল হাত বাড়িয়ে খাটের মশারি-স্ট্যান্ডের কোনায় ঝুলন্ত ওঁর জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা ভাঁজ-করা কাগজ বের করলেন। কাগজটা আমাকে নিঃশব্দে এগিয়ে দিলেন।

খুলে দেখে বললাম, “এ তো আপনার হাতের লেখা!”

“হ্যাঁ চিঠি।”

“ইংরিজিতে কাকে চিঠি লিখেছেন?”

“পড়ে দেখ আগে।”

চিঠিটাতে কোনো সম্বোধন নেই। তলায় কোনো নামও নেই। এ আবার কেমন চিঠি? কিন্তু পড়ার পর খুব অবাক হয়ে গেলাম। যা লেখা আছে, তা বাংলায় এরকম দাঁড়ায়–

“আমি আর দুটো দিন অপেক্ষা করে দেখব। তারপর বোম্বাই চলে যাবো। সেখান থেকে আবুধাবি। আমার পাসপোর্ট-ভিসা সব বোম্বাইয়ে রেডি আছে। তুমি গেলে তোমারও যে পাসপোর্ট-ভিসা করাতে অসুবিধে হবে না, তা আমি বরাবর বলে আসছি। কলকাতায় ভাইজান জিনিসটার খদ্দের ঠিক করে রেখেছে। ভাল দাম পাওয়া যাবে। কাজেই আমাদের ভাড়ার টাকার অভাব হবে না। তুমি ছোটকুকে কেন এত ভয় পাচ্ছ, বুঝি না। সে তো পাগল হয়ে গেছে। তবু যদি সে বাগড়া দেয় তাকে খতম করতে আমার হাত কাঁপবে না।…

“তুমি বুনোহাঁসের রোস্ট খেতে চেয়েছ। দুদিন ধরে রোশনিবাগ ঝিলে হাঁস মারার চেষ্টা করছি। কিন্তু মুশকিল হল, আমার এই রাইফেলের গুলিতে হাঁস মারলে এমন ছাতু হয়ে যায় যে শুধু খানকতক পালক ছাড়া কিছু থাকে না। তবু দেখছি চেষ্টা করে। বুঝতে পারছি আগের দিনগুলো তুমি ফিরে পেতে চাইছ, যখন ঝিলে আমি বন্দুকবাজি করে বেড়াতাম আর তুমি প্যালেসের ছাদ থেকে রুমাল নাড়তে!….

“এখানেই থাক। দেখি তুমি কী করো আর দুটো দিন–মনে রেখো।…অ্যাই হুসনু, তু পুছতি মেরা মঞ্জিল কিতনি দূর হ্যায় তেরি গুলবদনসে মেরা মহব্বতোকা দম যিতনা দূর হ্যায়…হে সুন্দরী, জানতে চাইছ আমি কতদূরে আছি? তোমার গোলাপ শরীর থেকে আমার প্রেমের নিঃশ্বাসের যতটা দূরত্ব, আমি তত দূরে।……।

পড়া শেষ হলে কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কিছু বুঝলে?”

বললাম, “হ্যাঁ। এটা একটা প্রেমপত্র। সম্ভবত জাভেদ লিখেছে। কিন্তু আপনার হাত দিয়ে ইংরিজিতে লিখল কেন?”

“এটা অনুবাদ। কাল রাতে দস্তরখানের ভাঁজ থেকে যে চিঠিটা পাওয়া গিয়েছিল, তার ফোটো তুলে নিয়েছিলাম।”

“হু, দেখেছি। ফোটো তুলে নিয়ে ওটা মেঝেয় ফেলে দিয়েছিলেন। আজ সকালে বেগমসায়েবা আবুর হাত থেকে ঝাড়ু কেড়ে নিয়ে নিজেই মেঝে সাফ করতে গেলেন কেন, তাও বুঝতে পেরেছি।”

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “জাহানাবাদে টুরিস্ট অল্পবিস্তর আসে। তাই এখানে স্টুডিও আছে। সকালে গিয়ে ভদ্রলোককে স্পেশাল চার্জ দিয়ে প্রিন্ট করালাম। তারপর এক উর্দুভাষী স্কুলশিক্ষককে খুঁজে বের করলাম। তিনি বাংলা ভাল বলতে পারেন না। তবু যা বললেন, তাতে প্রচুর ইংরেজি থাকায় আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললাম।”

“তাহলে এই ব্যাপার! জাভেদ পাঠানের সঙ্গে বেগম শামিম-আরার বাল্যপ্রণয়ের জের এখনো পুরোদমে চলেছে। অবশ্য বেগমসায়েবাকে এখন পরিণতযৌবনা বলা যায়। কিন্তু তাহলে তো বেগমসায়েবা জানেন জাভেদ কোথায় লুকিয়ে আছে। এমন কী জাভেদের দাদা ফরিদসায়েবও জানেন দেখছি!”

“বেগমসায়েবা তো অবশ্যই জানেন। কারণ তিনিই তাকে খাদ্য পাঠান নিয়মিত মিনার হাত দিয়ে। মিনা আস্তাবলের ওদিকটা ঘুরে কবরখানায় ঢোকে।” কর্নেল চুরুটের অনেকটা ধোঁয়া লম্বা করে ছেড়ে দিলেন। ফের বললেন, “আমার কাছে সবসময় বাইনোকুলার থাকার এই একটা সুবিধে জয়ন্ত! বহুদূর থেকেও অনেক দৃশ্য আমার দেখা হয়ে যায়।”

“মুনারুনা কি জানে এসব কথা?”

“না। তাদের মনে কবরখানার জিন সম্পর্কে ভয় ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“কিন্তু বেগমসায়েবা তাহলে তো দেখছি সাংঘাতিক মেয়ে!”

“প্রেম মানুষকে অন্ধ করে, ডার্লিং!”

“নিজের স্বামীকে খুন করিয়েছিলেন প্রেমিককে দিয়ে–এমন নিষ্ঠুরতা প্রেম শোভা পায় না,, কর্নেল! সে আপনি যাই বলুন। এ হল ব্যাভিচার।”

কর্নেল মাথা দুলিয়ে বললেন, “উঁহু। জর্জিস খাঁকে খুন করেছিল তাহের দর্জি।”

“কীভাবে জানলেন?”

“নবাবদের আস্তাবল বাড়িটা তুমি দেখনি। দেখার মতো জায়গাও নয়। কবরখানার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ওই যে দেখছ ভাঙাচোরা বাড়িটা, ওটাই আস্তাবল ছিল নবাবদের স্বর্ণযুগে। এখনও গোটাতিনেক ঘর আস্ত আছে। একটাতে থাকত তাহের মিয়া। বাকি দুটোর মধ্যে একটাতে থাকে এক বুড়ি। অন্যটাতে তার দূরসম্পর্কের নাতি মকবুল রিকশোওয়ালা আর তার বউ। বাজার থেকে ফেরার পথে মকবুলের রিকশোয় আসছিলাম। আমার স্বভাব তো জানো। মকবুলের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসছিলাম। কোথায় সে থাকে, জিজ্ঞেস করলে বলল, আস্তাবলে থাকে। নবাবী আস্তাবল দেখবার আগ্রহ একজন ট্যুরিস্টের থাকতেই পারে। কাজেই সে সেখানে নিয়ে যেতে আপত্তি করল না। তাহের দর্জির ঘরও দেখলাম। তারপর তাহের মিয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা শুরু হল। বুড়ি কান করে শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, তাহের মরবে না কেন? সে যে নেমকহারাম। ছিল। নবাবদের জামাইকে সেই তো খুন করেছিল। মকবুল আঁতকে উঠে বলল, চুপ, চুপ। বুড়ি খুব জেদী। বলল যে, চুপ করার কী আছে? সে নিজের চোখে দেখেছে, ভোরবেলায় কী নিয়ে দুজনে কবরখানার ভেতর কাড়াকাড়ি ধস্তাধস্তি চলছিল। তারপর তাহের দর্জি নবাবদের জামাইয়ের মাথায় ইট ছুঁড়ে মারল। বেগতিক দেখে মকবুল বলল, আমার নানী পাগল হয়ে গেছে। ওর কথায় কান দেবেন না। যাই হোক বুড়ির মিথ্যা কথা বলার কারণ নেই। তাছাড়া আমার সাজানো ছকটার সঙ্গে বুড়ির বিবৃতি চমৎকার খাপ খেয়ে যাচ্ছে।”

“ছকটা কী?”

কর্নেল সে-প্রশ্নে কান না করে বললেন, “ছকটার শুধু এক জায়গায় খুঁত ছিল সেটা তোমার একটা কথায় দূর হয়েছে। এখন ছকটি খাসা হয়েছে। তুমি একটি মূল্যবান সূত্র পেয়েছিলে জয়ন্ত!”

“আপনি কি নাসির খাঁর আস্তাবলে বোররাখ বেঁধে রাখার ব্যাপারটা মূল্যবান সূত্র বলছেন?”

“একজ্যাক্টলি!” কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। “আল-বিরুনির আঁকা ঐতিহাসিক ছবিটি যে আস্তাবলে কোথাও লুকোনো ছিল, তাতে আর আমার সন্দেহ নেই। আর তা ছিল তাহের দর্জির ঘরে। জর্জিসসায়েব আর তাহের মিয়াকে বুড়ি কবরখানায় মারামারি করতে দেখেছিল। কী একটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলেন ওঁরা। সেটা ওই ছবি। জর্জিসসায়েবকে মেরে তাহের ছবিটা নিয়ে পালিয়েছিল।”

“কবরখানায় জর্জিসসায়েব ছবি নিয়ে কী করছিলেন?”

“বড়বাবসায়েব যাতে ছবিটা জোর করে না নিয়ে যান, তাই উনি সেটা লুকিয়ে রাখতেই গিয়ে থাকবেন। তাহের দর্জি যে-কোনো উপায়ে জেনে থাকবে মূল্যবান ছবিটার কথা। সে যে ওঁত পেতে ছিল, এমন না হতেও পারে। কারণ তার ঘরের পশ্চিম-জানালা থেকে কবরখানা পরিষ্কার দেখা যায়। দূরত্বও মোটে মিটার দশেকের বেশি নয়।” কর্নেল চোখ বুজে থাকার পর হঠাৎ চোখ খুলে ফের বললেন, “বড়নবাবসায়েবও তাকে ছবিটার ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তাহেরের ঘরটা খোঁজা খুবই দরকার। আজই। মিঃ ভদ্রকে বলা আছে অবশ্য। কিন্তু তত গা করছেন না। দেখি, বিকেলের মধ্যে আসেন কি না। নইলে রাতেই চুপিচুপি হানা দেব।”

“নাসির খাঁ “।

আমার কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, “নাসির খাঁ পাগল হয়ে গিয়েই সমস্যা বেড়েছে। নইলে উনি অনেককিছু জানেন বলে আমার ধারণা। দিদির গোপন প্রণয় থেকে শুরু করে সবকিছুই সম্ভবত ওঁর জানা।”

“বিড্ডু বলেছিল, বড়নবাবসায়েব ওষুধ খাইয়ে ওঁকে পাগল করে দিয়েছেন!”

কর্নেল সে কথায় কান দিলেন না। চুরুট নিভে গিয়েছিল। আবার জ্বেলে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, “ছবিটা উদ্ধার করা গেলেও সেটা আর নবাব পরিবারের হবে না।”

“কেন?” “ওটা এখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। সরকার যে-মূহূর্তে নিজামতকেল্লা অধিগ্রহণ করেছেন, সেই মুহূর্তের তার যা কিছু ইট কাঠ পাথর পর্যন্ত, সবই সরকারের মালিকানায় চলে গেছে। বড়নবাবসায়েব কেন অত অস্থির হয়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন, এবার তা স্পষ্ট হয়েছে, জয়ন্ত! উনি আসলে ওঁর ভগ্নীপতির হত্যারহস্যের কিনারা করতে চাননি, ওটা নেহাত অছিলা। ওঁর আসল উদ্দেশ্য আমাকে দিয়ে ছবিটি উদ্ধার করানো। কিন্তু আমি যে দেশের আইন লঙ্ঘনের পক্ষপাতী নই, উনি সেটা অনুমান করেননি। ভেবেছেন আমি গোয়েন্দাগিরি করি টাকার লোভে। তাই প্রথমে টেলিফোনে গোযোগ করে টাকার কথাই তুলেছিলেন।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress