স্বর্গের বাহন : 03 – মার্ডার উইপন আবিষ্কার
নিজামতকেল্লার কবরখানায় কিছুক্ষণ খুব ভিড় হয়েছিল। পুলিশ ভিড় হটিয়ে না দিলেও মনে হচ্ছিল ওরা এমনিতে বড় নিস্পৃহ। একটু দেখেই কেটে পড়ল সবাই। পুলিসের মতে তাহের মিয়া দর্জি স্মাগলারদের হাতে খুন হয়েছেন।
সীমান্ত এলাকা। তাই এখানে স্মাগলারদের বড় ঘাঁটি। তাদের পিছনে রাজনৈতিক মদত থাকায় পুলিশ নাকি কিছু করতে পারছে না। ইদানীং তাহের দর্জির নামও পুলিশের খাতায় উঠেছিল। বিদেশী সিন্থেটিক কাপড়চোপড়, ঘড়ি আর ছোটখাট ইলেকট্রনিক যন্ত্র পদ্মা পেরিয়ে এ তল্লাটে আসে এবং জাহানাবাদ থেকে তা কলকাতা চালান যায়। তাহের মিয়া নিশ্চয় কিছু দামি মাল হজম করে ফেলেছিলেন। সেই নিয়ে গণ্ডগোল ঘটে থাকবে এবং রাগের বশে ওঁর মাথায় ইট-টিট মেরে পালিয়েছে কেউ।
সেই ইটটা অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি, যদিও কবরখানায় অজস্র ইট পড়ে আছে। বডি মর্গে চালান করে পুলিশ অফিসার রথীশ ভদ্র আমাদের সঙ্গে অনকক্ষণ গল্প করে গেলেন। যাবার সময় কর্নেলকে বলে গেলেন, “এ আপনার স্যার মশা মারতে কামান দাগা হবে। এস পি সায়েব গতকাল রেডিও মেসেজে আপনার কথা বলেছিলেন। তবে আমি আপনাকে বলছি, এমন খুনোখুনি, এ তল্লাটে স্মাগলার আর অ্যান্টিসোস্যালদের ভেতর আকছার লেগে আছে। আমরা বলি, “মর তোরা নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করে। যদুবংশ ধ্বংস হোক। বেঁচে যাই আমরা।”
অবশ্য কর্নেলের সাহায্যের প্রয়োজন হলে সাহায্য উনি যথাসাধ্য করবেন, সে প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেলেন।
বললাম, “কর্নেল, জর্জিস খাঁ সাহেবের বডি তো একইভাবে কবরখানায় পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশের সে-সম্পর্কে বক্তব্য কী? উনিও কি স্মাগলারদের সাথে জড়িত ছিলেন?”
রামবাবু তেতোমুখে বললেন, “আমাকে যে মুখ খুলতে দিলেন না। নইলে জিগ্যেস করতাম, স্মাগলারদের ঘাঁটিটা কি কবরের ভেতর?”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “জিগ্যেস করলে আপনার কী বিপদ হত জানেন রামবাবু? পুলিশ ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে না। উল্টে আপনাকে জেরার চোটে জেরবার হতে হত। যাই হোক, আপনাকে একটা বিষয়ে আবার মনে পড়িয়ে দিই। নিজামতকেল্লার ভেতর কোথাও কোনো পাগল দেখলে যেন তার ছায়া মাড়াবেন না।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ বলেছিলেন বটে!” রামবাবু নড়ে বসলেন। “কিন্তু সকালে অতক্ষণ তো ঘোরাঘুরি করলাম। ছবিও তুললাম অনেক। কোনো পাগল-টাগল তো দেখলাম না!”
কর্নেল বললেন, “এস জয়ন্ত, গঙ্গার ওদিকটায় ঘুরে আসি। রামবাবু, আপনি যাবেন, নাকি বিশ্রাম করবেন?”
রামবাবু উঠে দাঁড়ালেন। “পাগলের কথা মনে করিয়ে দিলেন।” হাসতে হাসতে বললেন, “একা থাকি আর কোন পাগল এসে আমাকে একা পেয়ে মেরে রেখে যাক! চলুন, আর আমি আপনাদের সঙ্গ ছাড়ছি না।”
আমরা নিজামতকেল্লার ধ্বংস্তূপের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। শীতের মিঠে রোদ্দুরে হাঁটতে আরাম পাচ্ছিলাম। কিন্তু জনহীন ধ্বংসপুরীর এখন দিনদুপুরেই কেমন ভয়-জাগানো রূপ। হয়তো খুনখারাপির প্রতিক্রিয়ায় আমারই মনের ভুল। যতবার পা ফেলছি, মনে হচ্ছে যেন ততবার একটু করে এগিয়ে আসছে আমারই অদৃশ্য এক আততায়ী। এই বিদঘুটে অনুভূতির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সহজ নয়। এদিকে রামবাবুর চাউনি দেখে মনে হচ্ছে, উনি পাগল খুঁজতে খুঁজতে হাঁটছেন। কিংবা সেই শুটকো জ্যান্ত মড়াটা পিছু নিয়েছে কি না দেখার জন্য বারবার পিছনেও ঘুরে দেখে নিচ্ছেন। কর্নেলের চোখে যথারীতি বাইনোকুলার। নিশ্চয় পাখিটাখির ডাক শুনে খোঁজাখুঁজি করছেন।
গম্বুজ ও মিনারওয়ালা বিশাল মসজিদের কাছে গিয়ে হঠাৎ লম্বা পা ফেলে কর্নেল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রামবাবু চমকানো স্বরে সর্বনাশ’ বলে দৌডুলেন সেদিকে। আমিও রামবাবুকে অনুসরণ কাম।
রামবাবু একটা খাড়া দেয়াল এবং মসজিদের মাঝখানে গলির ভেতর ঢুকে বলে উঠলেন, “ওই যে কর্নেল স্যার!” তারপর খাড়া দেয়ালের একটা ফোকর গলিয়ে ঢুকে গেলেন। উঁকি মেরে দেখি, ভেতরে একটা খোলা চত্বর। তার ওধারে গাছের ফাঁকে গঙ্গার জল ঝিকমিক করছে। রামবাবু গঙ্গা দেখেই হাসিমুখে ঘুরে হাত-ইশারায় আমাকে ডাকলেন। তারপর মনে হল উনি গঙ্গার ছবি তুলতেই যাচ্ছেন। চত্বরের শেষপ্রান্তে ধ্বংসপ আর গাছপালা। রামবাবু সেখানে উধাও হয়ে গেলে আমি ফোকর গলিয়ে ঢুকে গেলাম চত্বরে।
কিন্তু গঙ্গার ধারে পৌঁছে আর রামবাবু বা কর্নেল কাউকে দেখতে পেলাম না। নির্জনে একা কোনো ঐতিহাসিক জায়গায় গেলে এমনিতেই কেমন গা ছমছমকরা এক অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। তার ওপর খুনখারাপির টাটকা স্মৃতি মনে জ্বলজ্বল করছে। নিজেকে ভীষণ একা লাগল। ডাকলাম, “রামদা, রামদা!”
কোনো সাড়া পেলাম না। আরও কয়েকবার ডেকে একটা গাছের নিচে প্রকাণ্ড এক লাইমকংক্রিটের চাবড়ার ওপর হতাশভাবে বসে পড়লাম। ভাবলাম, রামবাবু যেখানেই থাকুন, আমার খোঁজে এদিকেই ফিরে আসবেন। কর্নেলের কথা অবশ্য আলাদা। হয়তো এবেলার মতো কোনো পাখির পেছনে ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেবেন। স্নানাহারের কথা মনেও থাকবে না।
সবে সিগারেট ধরিয়েছি, পেছনে পায়ের শব্দ হল। বুক ছাঁৎ করে উঠেছিল। কিন্তু ঘুরে দেখি, সেই যমজ বোন আসতে আসতে আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। একজনের ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি, অন্যজন গম্ভীর। চোখে চোখ পড়লে তারা কপালে হাত ঠেকিয়ে আদাব দিল।
আমিও আদাব দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “আসুন, আসুন! আলাপ করা যাক!”
হাস্যমতী সঙ্গিনীর কাধ ধরে ঠেলে নিয়ে এল। তারপর বলল, “আপনি সাংবাদিকতাই না?”
একটু অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ। আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরী।”
“জানি। আমরা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় আপনার নাম দেখেছি।”
আরও অবাক হয়ে বললাম, “বলেন কী! আপনারা বাংলা পড়তে পারেন?”
গম্ভীর বোনটি ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠল, “কেন পারব না? আমরা তো এখানকার বাংলা স্কুলে পড়েছি।”
হাস্যমতী বলল, “আমরা উর্দুও জানি। বাংলাও জানি। একটু-আধটু ইংরেজিও জানি।”
“আপনাদের কার কী নাম এখনও জানি না কিন্তু।”
হাস্যমতী বলল, “আমার নাম রুনা। আমার আপার নাম–সরি, দিদির নাম মুনা।”
“আপনাদের দেখে একবয়সী মনে হয়!
রুনা বলল, “হবেই তো! মুনা আমার চেয়ে আধঘণ্টার বড়।” বলে সে খিলখিল করে হেসে উঠল।
মুনা ভুরু কুঁচকে ইশারায় তার বেহায়া বোনটিকে ভৎর্সনা করল। কিন্তু সে গ্রাহ্য করল না। বললাম, “আপনারা বুঝি বেড়াতে বেরিয়েছেন?”
রুনা বলল, “আমাদের আপনি-আপনি করছেন কেন? তুমি বলুন। কর্নেলসায়েব তো সকালে দেখামাত্র তুমি বললেন! কর্নেলসায়েব কোথায় গেলেন?”
একটু হেসে বললাম, “হারিয়ে ফেলেছি ওঁকে।”
মুনা আস্তে বলল, “আপনি এখানে কতক্ষণ আছেন জয়ন্তবাবু?”
“বেশিক্ষণ নয়। কেন?”
“আমার ছোটমামাকে দেখেছেন এখানে?”
রুনা বলল, “উনি চিনতে পারবেন না দেখলেও।”
বললাম, “নিশ্চয় পারব। ছোটনবাব নাসির খাঁকে না দেখে থাকলেও চিনতে হয়তো অসুবিধে নেই। কারণ শুনেছি উনি পাগল হয়ে গেছেন।”
“মুনা বলল, “দেখেননি, তাই না?”
“না। আপনারা কি তার খোঁজেই এসেছেন?”
রুনা চাপা স্বরে বলল, “প্লিজ জয়ন্তবাবু যেন মায়ের কানে না ওঠে। মা যদি জানতে পারেন, আমরা ছোটমামাকে খুঁজে বেড়াই, মেরে ফেলবেন একেবারে।”
মুনা দুঃখিতভাবে বলল, “ছোটমামাকে মাঝেমাঝে দেখতে পাই দূর থেকে। কিন্তু সেখানে এসে আর খুঁজে পাই না। একটু আগে বাড়ির ছাদ থেকে দেখতে পেয়েছিলাম, ওই পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।”
পাঁচিলটার দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে বললাম, “কিন্তু উনি তো শুনেছি পাগল। তাছাড়া তোমাদের বাবাকে নাকি উনিই–
দুই বোন একসঙ্গে বলে উঠল, “না। আমরা বিশ্বাস করি না।”
“বেগমসায়েবা বিশ্বাস করেন?”
“মায়ের মাথায় বড়মামা ওটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন।” মুনা রাগের সঙ্গে বলল। “বড়মামা কলকাতায় বসে খালি কলকাঠি নাড়ছেন।”
“একটা কথা জিগ্যেস করি। কলকাতায় তোমাদের বড়মামার বাড়িতে বিড্ডু নামে একটা লোক থাকে।”
কথা কেড়ে রুনা বলল, “হ্যাঁ। বিড্ডু প্যালেসের বাবুর্চি ছিল। এখনও সে আছে নাকি?”
“আছে। তোমরা বড়মামার কাছে যাও না বুঝি”।
“দু বছর যাইনি। বাবা মরে যাওসার পর আর কোথাও যাওয়াই হয় না।” রুনা জিগ্যেস করল ফের, “বিড্ডুর কথা বলছিলেন। কী ব্যাপার?”
“বিড্ডু চুপিচুপি বলছিল, বড়নবাব ছোটনবাবকে একটা ছবির জন্য ওষুধ খাইয়ে পাগল করে দিয়েছেন।”
কথাটা বলে দুই বোনের মুখের দিকে নজর রাখলাম। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। রুনা একটু হাসল। “সকালে কর্নেলসায়েবও এই কথা বলছিলেন। শুনে গিয়ে মাকে জিগ্যেস করেছিলাম। মা খুব বকাবকি করে বললেন, বিড্ডু মিথ্যাবাদী, চোর, দাগাবাজ”।
“বিড্ডু বলছিল, একটা তসবিরের জন্যে কী গণ্ডগোল হয়েছিল। তো তোমরা তেমন কোনো ছবি ছবির কথা কি শুনেছ?”
মুনা বলল, “কর্নেলসায়েবও তাই জিগ্যেস করছিলেন। কিছু বুঝতে পারিনি তখন।” বলে সে বোনের দিকে ঘুরল। “আচ্ছা রুনা, আমার এখন মনে হচ্ছে, বিড্ডু সেই ছবিটার কথা বলেনি তো?”
রুনা বলল, “ও, হ্যাঁ, হা। বুঝেছি।”
মুনা আমার দিকে ঘুরে চাপা স্বরে বলল, “ওদিকে একটা বাড়ি ছিল, তার নাম ছিল খাজাঞ্চিখানা। ট্রেজারি। ছোটবেলায় শুনেছি, সেখানে ইটপাটকেল সরালে নাকি মোহর পাওয়া যেত আগের দিনে। বাবা এই কেল্লাবাড়ির কেয়ারটেকার হওয়ার পর সেখানে একটা পুরনো সিন্দুক খুঁজে পেয়েছিলেন।”
রুনা ঝটপট বলল, “আমরা দেখিনি। নানী–মানে আমার মায়ের মা গল্প করতেন, সিন্দুকে অনেক বাঁধানো ছবি ছিল। প্যালেস ভেঙে পড়ছিল, তখন ছবিগুলো আমার নানীর শ্বশুর…”
মুনা কথা কেড়ে বলল, “তাকে সবাই বলত গুনুনবাব। তিনিই ছবিগুলো সিন্দুকে ভরে খাজাঞ্চিখানায় রেখেছিলেন।”
রুনা বলল, “সব ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাবা রান্নাঘরে জ্বালানি করতে দিয়েছিলেন। একটা ছবি মোটামুটি আস্ত ছিল। সেখানা বাইরের ঘরে– আপনারার যে ঘরে আছেন, সেই ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন বাবা।”
জিগ্যেস করলাম, “কিসের ছবি?”
মুনা বলল, “বোররাখের।”
“বোররাখ কী?”
রুনা বলল, “আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ধর্মের প্রফেট সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন খোদার কাছে–জানেন তো? তখন ওঁকে এক দেবদূত–আমরা বলি ফেরেস্তা, ওই বোররাখে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বোররাখ হল একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া, কিন্তু তার মুখ সুন্দরী মেয়ের। মাথায় লম্বা চুল আর একটা তাজ পরানো। তাজ কী জানেন তো? আপনারা যাকে বলেন মুকুট।”
মুনা বলল, “বাবার কাছে শুনেছি, ছবিটা দিল্লির মোগল বাদশাহাদের হারেম ছিল। বাদশাহ আলমগীর–মানে ঔরঙ্গজিব তো খুব ধর্ম মানতেন। ইসলামে জীবজন্তুর ছবি আঁকা বারণ। তাই ছবিটা উনি ফেলে দিয়েছিলেন। আমার নানার বংশের এক নবাব সেটা কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এই নিজামতকেল্লার প্যালেসে টাঙিয়ে রেখেছিলেন।”
বললাম, “তাহলে খুব পুরনো ছবি! তা ছবিটার কী হল?”
“বলছি।” মুনা ঢোক গিলে বলল। “ছবিটা সেবার বড়মামা এসে দেখতে পেয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। মা বললেন, ছবি তো নিয়ে গিয়ে বেচে দেবেন আপনি। এ ছবির অনেক দাম পাওয়া যাবে। আমার মেয়েদের
সলজ্জভাবে মুনা থামলে রুনা বলল, “বলতে লজ্জা কী রে আপা? আমাদের বিয়ের জন্য টাকা লাগবে। তাই মা বললেন আমি তো সম্পত্তির কানাকড়ি পাইনি। সবই আপনারা দু ভাই মিলে বেচে টাকা নিয়েছেন। ছবিটা আমাকে দেবেন না? তাই শুনে বড়মামা বললেন, ঠিক আছে। তবে সাবধান, নাসির জানতে পারলে দাবি করবে।”
মুনা বলল, “বড়মামা চলে যাওয়ার কিছুদিন পরে–সঠিক মনে পড়ছে না, ছবিটা কীভাবে চুরি গিয়েছিল। তার কিছুদিন পরে”।
রুনা বলল, “তিন মাস পরে। মার্চে বড়মামা এসেছিলেন আমার মনে আছে। আমরা স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম না তখন?”
মুনা বলল, “হ্যাঁ–মে মাসে পরীক্ষা হল। সেই সময় ছবিটা চুরি গেল। পরের মাসে–”
“১৬ জুন।” রুনা ধরা গলায় বলল। “বাবা মার্ডার হয়েছিলেন ওইদিন ভোরে।”
হঠাৎ জিগ্যেস করলাম, “তোমরা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করো?”
দুই বোনই অবাক হয়ে তাকাল। তারপর একসঙ্গে বলল, “কেন?”
“এমনি জিগ্যেস করছি। কবরখানার কাছে তোমাদের বাড়িটা। তাই জানতে ইচ্ছে করছে, কখনও ওখানে ভূতপ্রেত দেখেছ নাকি?”
মুনা ও রুনা পরস্পর তাকাতাকি করছিল। তারপর মুনা গম্ভীর মুখে বলল “কবরখানায় একজন জিন থাকে শুনেছি। জিনেরা তো ভূতপ্রেত নয়। কোরান শরিফে আছে, খোদা মানুষকে মাটি থেকে আর জিনকে আগুন থেকে তৈরি করেছেন। জিনেরা থাকে আকাশে অন্য এক দেশে।”
রুনা বলল, “অন্য কোনো প্ল্যানেটে থাকে ওরা। পৃথিবীতে আসে মাঝেমাঝে তখন জায়গাটা আলো হয়ে যায়। মা বলছিলেন, যে জিনটা কবরখানায় থাকে, সে কোনো দোষ করে জিনমুল্লুক থেকে পালিয়ে এসে লুকিয়ে আছে। কোনো কোনো রাতে মা দেখেছেন, কবরখানায় আলোর ছটা ঝলমলিয়ে ওঠে।”
ওদের সরলতা দেখে অবাক হলাম না। বরং মুগ্ধ হওয়ার মতো অপাপবিদ্ধ সরলতা। একটু হেসে বললাম, “তোমরা কখনও দেখনি? নাকি দেখেছ?”
রুনা বলল, “পরশু রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ভীষণ শীত। তাই জানলা বন্ধ ছিল। বাথরুমে যাব বলে আপাকে ডাকলাম। আপা বলল, মাকে ওঠা– নয়তো মিনাকে ওঠা। মায়ের যা ঘুম! তাই মিনাকে ডেকে ওঠালাম। মিনা মেঝেয় শুয়ে থাকে। কিন্তু সুইচ টিপে দেখি, লোডশেডিং। জাহানাবাদে লোডশেডিং খুব কম হয়। তো মিনা মোম জ্বালবার জন্য দেশলাই হাতড়াচ্ছে। আমি দরজা খুলেছি। বাথরুম তো উঠোনের ওধারে। ঘরের বারান্দাটা বেশ উঁচু। হঠাৎ পাঁচিলের ওধারে কবরখানার দিকে আলোর ছটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মিনা মোম জ্বেলে বেরিয়ে সেও অবাক হল–দুজনেই বুঝলাম কবরখানায় জিনটা বেরিয়েছে।” রুনা খিলখিল করে হেসে উঠল। “ভয়ে আর বাথরুম যাওয়াই হল না।”
মুনা বলল, “ভোরে নানার কবরে ফুল দিতে গিয়ে দেখি একখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে শুকনো পাতা পুড়ে ছাই হয়ে আছে। জিনের ছটা লাগলে সব পুড়ে ছাই হয় যে!”
রুনা কী বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছে, এই সময় ধ্বংপের পেছন থেকে এবং ঝোঁপঝাড় ঠেলে বেরিয়ে এলেন রামবাবু। এসেই হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, “পালাও জয়ন্ত! পালাও! পাগল ইট নিয়ে দৌড়ে আসছে!” তারপর আর দৃকপাত না করে চত্বর দিয়ে দৌড়ে দেয়ালের সেই ফোকর গলিয়ে উধাও হলেন।
হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। মুনা ও রুনা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রামবাবুকে পালাতে দেখছিল। রামবাবু অদৃশ্য হলে দুজনে মুখ তাকাতাকি করে রামবাবু। যেদিক থেকে এসেছেন, সেইদিকে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল।
ডাকলাম, “মুনা! রুনা! তোমরা যেও না!” কিন্তু ওরা কথা কানে নিল না। তখন উদ্বেগে এবং সাবধানে সেদিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। পটা পেরিয়ে দেখি, দুই বোন হনহন করে এগিয়ে চলেছে। গঙ্গার একেবারে পাড়েই একটা প্রকাণ্ড দেয়াল খাড়া দাঁড়িয়ে আছে, তার বুকেও বিরাট ধ্বংসস্তূপ এবং আগাছা। একটা টিলার মতো দেখাচ্ছে জায়গাটি। সেই দেয়ালের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মূর্তি এসে দাঁড়াল। ধূসর আকাশের পটে ছেঁড়াখোঁড়া প্যান্ট আর তেমনি নোংরা ছেঁড়া একটা পাঞ্জাবি তার পরনে। মাথায় একরাশ চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি। পাগলই বটে। অর্থাৎ পাগলাদের ওই চেহারাটি পেটেন্ট বলা যায়। তবে এই পাগলের হাতে একটুকরো আধলা ইট দেখে আর পা বাড়াতে ভরসা হল না।
দুই বোন নিচে থেকে চিৎকার করে ডাকছিল, “মাম্মুজান! মান্নুজান!” তাদের কণ্ঠস্বরে কান্না ছিল। কিন্তু পাগল নাসির খাঁ ভাগ্নীদের দিকে ভুলেও তাকাতে যেন রাজি নন। সম্ভবত তিনি উঁচু জায়গায় উঠে রামবাবুকেই খুঁজছেন।
একটু পরে পূর্বদিকে ঘুরে কোথাও হয়তো পলাতক ফোটোগ্রাফার ভদ্রালোককেই দেখতে পেলেন। কারণ তখনই হুঙ্কার দিয়ে সেদিকে নামতে শুরু করলেন। আম উৎকণ্ঠায় আড়ষ্ট হয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম ঝোঁপের আড়ালে।
মুনা ও রুনা “মাম্মাজান” বলে ডাকতে ডাকতে অদৃশ্য হল। রামবাবু যদি ঘরে গিয়ে ঢুকতে পারেন, দরজা এঁটে দিলে পাগল নাসির খায়ের হাত থেকে বেঁচে যাবেন। এ মুহূর্তে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে, মুনারুনার বাবা জর্জিস খাঁ এবং তাহের দর্জি ইটের আঘাতেই মারা পড়েছেন! আর সেই ইট মেরেছে। এই নাসির খাই।
হ্যাঁ, জর্জিস সাহেবের মৃত্যুর সময় নাসির পাগল ছিলেন না, তা ঠিক। তবে রাগের বশে ইট ছুঁড়ে মারা সুস্থ মানুষের পক্ষেও তো সম্ভব। সুস্থ অবস্থায় যে ইট ছুঁড়ে মারে, পাগল হয়ে গেলে সে ইট আরও জোরে ছুঁড়েই মারবে।
যুক্তিটা আমার খুব মনঃপুত হল। গরিব হয়ে যাওয়া নবাব পরিবারে পূর্বপুরুষের সংগৃহীত কোনো প্রাচীন চিত্রকলার নিদর্শন নিয়ে ঝগড়াঝাটি এবং পরিণামে খুনোখুনি হয়ে যেতেই পারে কারণ সেই ছবিটার দাম নিশ্চয় বহু টাকা। বিশেষ করে আমেরিকার বাজারে পুরনো পেন্টিং বেচবার মওকা পেলে লক্ষপতি হবার চান্স আছে। কর্নেলকে এবার সূত্রগুলো ধরিয়ে দেওয়া দরকার। অথচ উনি খালি পাখি পাখি করেই আরেক পাগল।
কর্নেলের খোঁজে গঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে থাকলাম। সেই টিলার মতো ধ্বংস স্তূপ বুকে-নেওয়া বিশাল দেয়ালের পাশ দিয়ে এগিয়ে বাঁদিকে একটা গলিপথ পাওয়া গেল। দুধারে ভাঙাচোরা দুটো বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গলিটার একেবারে শেষে একপলকের জন্য কাউকে চোখে পড়ল, যার মাথায় টুপি আছে এবং মুখে দাড়িও। চেঁচিয়ে ডাকলাম, “কর্নেল! কর্নেল!” তারপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম গলিপথে।
একটা বিশাল খোলামেলা চত্বরে পৌঁছুলাম। দেখলাম কর্নেল হনহন করে হেঁটে চলেছেন। চত্বরের শেষে গিয়ে ওঁকে ডাকতেই উনি শুধু ইশারায় আমাকে অনুসরণ করতে বললেন। একটা ভাঙা ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকে ওদিকের আরেকটা দরজা পার হয়ে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমরা মুনা রুনাদের বাড়ির কাছে এসে পড়েছি। কিন্তু দৃশ্যটা সত্যি অবাক হবার মতো। পাগল নাসির খায়ের হাতে ইটটা এখনও আছে এবং রামবাবু তার সামনে হাঁটু মুড়ে ক্যামেরা তাক করে তাকে ইশারায় পোজ নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে যমজ বোন দুটি ছবি তোলা দেখছে।
কর্নেল ও আমি এগিয়ে গেলাম ঘটনাস্থলে। রামবাবু, নাসির খাঁ কেউই আমাদের গ্রাহ্য করলেন না। একটা কামান মাটির স্কুপ থেকে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। সেই কামানের কাছে নাসির খাঁকে দাঁড়াতে ইশারা করলেন রামবাবু। তখন নাসির খাঁ হাতের ইটটা পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে সেই নির্দেশ পালন করলেন। রামবাবু মুচকি হেসে বললেন, “ওক্কে! রেডি!”
উনি ক্যামেরার শাটার টিপেছেন, সেই সময় নাসির খাঁ ঘুরে কর্নেল ও আমাকে দেখলেন। দেখামাত্র ওঁর মুখে প্রচণ্ড ভয়ের ছাপ পড়ল। অস্ফুট স্বরে দুর্বোধ্য কিছু বলে উনি দৌড়ে গিয়ে কবরখানায় ঢুকলেন। তারপর কবরখানার দক্ষিণের নিচু পাঁচিল ডিঙিয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
রামবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন, “পাগল বশ করার পক্ষে ক্যামেরার চেয়ে মোক্ষম আর কিছু নেই। ঔঃ, ভাবা যায় না বুদ্ধিটা মাথায় না এলে কী ঘটে যেত। আমি দর্জি ভদ্রলোকের মতো এখানে–ঔঃ, ভাবা যায় না।”
বললাম, “র্যাপারটা খুলে বলুন তো রামদা!”
রামবাবু একগাল হেসে বললেন, “দৌড়তে গিয়ে গোলাকধাঁধায় পড়েছিলাম। এখানে এসেও চিনতে পারছিলাম না কোন্ পথে যাব। তারপর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ততক্ষণে সিধে নাকবরাবর এসে পড়েছে পাগলা নবাব। ইট তুলতেই ক্যামেরা তাক করে ধরলাম। অমনি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “তসবির খিচো।”
হঠাৎ চোখে পড়ল, কর্নেল নাসির খায়ের ফেলে যাওয়া ইটের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে কী দেখছেন। তারপরই আবিষ্কার করলাম আধলা ঝামা ইটটাতে জমাটবাঁধা রক্ত রয়েছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল।