সাঁঝবেলা
দিবাকর বারান্দায় বসে মাধবীলতা গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে। গাছটা এ’বছর ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। বারান্দার একটা দেওয়ালে লতিয়ে লতিয়ে গাছটা বেশ তরতাজা হয়ে উঠেছে। মাধবী যেদিন গাছটা লাগিয়েছিল সেদিন ও বলেছিলে -‘আমি যেদিন থাকবো না সেদিন এই গাছটা তোমাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেবে।’ কথা’টা যে ও এইভাবে সত্যি করে দেবে দিবাকর তা স্বপ্নেও ভাবেনি। আজ বাড়িতে খুব আনন্দের দিন। কারণ, দিঠি’র আজ জন্মদিন। কিন্তু দিবাকরের মনে তো কোন আনন্দ নেই! এইতো সবে তিন বছর হয়েছে ওদের বিয়ে হয়েছে। এরইমধ্যে মাধবী ও’কে ছেড়ে চলে গেছে। দিবাকরের মনে আছে, মাধবী যেদিন জানতে পারলো ও ‘মা’ হতে চলেছে, তখন থেকেই ওর আনন্দের সীমা ছিল না। ওদের ভালোবাসার প্রথম প্রকাশ পৃথিবীতে আসতে চলেছে। মাধবী দিবাকরের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘যদি আমি না থাকি তবে ছেলে হলে নাম রেখো স্পন্দন; আর মেয়ে হলে নাম রেখো দিঠি।’ দিঠি’র জন্মের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বিনা নোটিশে মাধবী তার সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেল। সেই থেকে দিবাকর ভালো করে তাকায় না দিঠি’র দিকে। আজ ওই মেয়ের জন্মদিন। কিন্তু ছোট্ট মেয়ে দিঠি বাবার যন্ত্রণার কথা বুঝতে পারে না ! ও বাবার পা জড়িয়েধরে কোলে উঠতে চায়, কিন্তু দিবাকর মুখ ফিরিয়ে দিঠি’কে দূরে সরিয়ে দেয়। রোজ ছেলের এই ব্যবহার দেখে একদিন মা দিবাকর কে বললেন – ‘হ্যাঁ রে খোকা তুই বাচ্চাটাকে ওইভাবে দূরে ঠেলে দিস কেন?ওর কি দোষ বল দেখি? ওর মা চলে গেছে সেটা কি ওর দোষ। এটা ভাবিস না, ওই দুধের শিশুটাও মাতৃহারা হয়েছে!’ দিবাকরের সেদিন একটু দিঠি’র জন্য কষ্ট হয়েছিল; কিন্তু মাধবী’কে ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
মাধবীর সঙ্গে ওর বিয়েটা দু-বাড়ির দেখাশোনা করে হয়েছিল।আগে থেকে কেউই কাউকে চিনত না, কিন্তু বিয়ের দিন যখন শুভদৃষ্টি হলো, দিবাকরের মনে হলো মাধবী যেন ওর কতদিনের চেনা।মাধবীও ফুলশয্যার রাত্রে একই কথা বলেছিল- ‘জানোতো আমার মনে হয় আমাদের এই বন্ধন সাত জন্মের। তাই শুভদৃষ্টির সময়ে যখন তোমাকে দেখি আমার মনে হয়েছিল তোমাকে আমি বহু যুগধরে চিনি।’ দিবাকর মনে মনে ভাবে এই ভালোবাসা- ভালোলাগা এক নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে গেলো! এ কেমন সাত জন্মের অঙ্গিকার!শেষ যেদিন মাধবী ওর কাছথেকে বিদায় নিয়ে গেলো দিবাকরের মনটা হু..হু করে উঠেছিল। কিন্তু না, মাধবী দিবাকরের কোনো ডাকেই সাড়া দেয় নি। বারান্দায় বসে এই সব কথা ভাবতে ভাবতে দিবাকরের হঠাৎ মনে হলো, মাধবীলতা গাছটার নিচে কে দাঁড়িয়ে আছে! সেই হাসি, সেই টানাটানা চোখ, যেন ওর দিকে তাকিয়ে বলছে- ‘আমার দিঠি’কে দেখো।’ দিবাকর চমকে ওঠে! ওকি ঠিক দেখছে! মাধবী কি ভাবে আসবে! এক বছর আগে ও তো পার্থিব জগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে! তবে!
তবু মানুষের মন তো!সে বড়ই অবুঝ! দিবাকর ছুটে যায় মাধবীলতা গাছটার নিচে। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। দিবাকর ঘরে ফিরে এসে দিঠি’কে কোলে তুলে নেয়। মাধবীর শেষ চিহ্নের প্রতি অবহেলা দেখেই হয়তো ও বলে গেলো- ‘দিঠি আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ, ওকে যত্ন কোরো, না হলে আমি মুক্তি পাবো না।’
দিবাকরের কাছে দিঠি’র আজ নতুন জন্ম হলো। আজ থেকে দিঠি’র জন্যই ও বাঁচবে।সেদিন থেকে বাড়িটা আবার প্রাণ ফিরে পেলো। মাধবীলতা গাছ’টা’ও বেশ ডালপালা বিস্তার করে ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে। দিবাকরের বিশ্বাস তার মাধবী ওই মাধবীলতায় জড়িয়ে আছে। রোজ রাতে দিবাকর কিছুটা সময় এই গাছটার সাথে নিজের মনে কথা বলে; যে কথা শুনতে পায় একমাত্র মাধবীলতা।