সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 19
ওঁদের বাড়িটাও আমার পিছু নেয়। বিরাট বাড়ি, আগেকার, একশ বছর তো হবেই। শক্ত ভিত, মোটা দেওয়াল, বড় বড় ঘর, আসবাব, যাদের বয়স সত্তর-আশি পেরিয়ে গেছে। অব্যবহারে মলিন, কিন্তু কাঠামোটা ঠিক আছে। একজন অশক্ত বৃদ্ধা আরেকজন এখনও পর্যন্ত সক্ষম বৃদ্ধ। অথচ, এই বাড়িটাকে উনি নতুন করে সারাচ্ছেন। কী উৎসাহ! বাইরেটা পুরো আস্তরণ ছাড়িয়ে নতুন করা হচ্ছে। ভেতরের কাজ সে ভাবে দেখিনি, কিন্তু হচ্ছে, হবে। ওইসব আসবাবপত্র নতুন করে পালিশ হবে, গদি কুশন পাল্টানো হবে। নতুন নতুন ওয়াড়। আলোর ব্যবস্থায় কিছু নতুন, কিছু পুরনো তো থাকবেই। বৈঠকখানার ক্রিস্ট্যালের ঝাড়বাতিটা কি ওঁরা পাল্টাবেন? কখনওই না। বাড়ি সারানোর রকম দেখেই মনে হচ্ছে এটাকে ওঁরা রক্ষা করবেন— হেরিটেজ বিল্ডিং— কিন্তু সেইসঙ্গে নতুন করে বাসযোগ্য। নতুন জীবন, নতুন আশা, নতুন উৎসাহ। অথচ দু’জনেই ষাট পেরিয়েছেন। একজন এখন জড়পিণ্ড প্রায়, উদ্ধারের আশা আছে কিনা জানি না। ডাক্তার তো নই! তারপরে বাড়িটা তো একটা ঐতিহাসিক বাড়িও বটে। সামান্য অর্থে কত জন্ম মৃত্যু বিবাহ কত জেনারেশন ধরে এ বাড়িতে ঘটে গেছে। আর অসামান্য অর্থে এক কালে এক ব্রিলিয়ান্ট ছেলের সমাধিভূমি, প্রেতভূমি এই বাড়ি। এখানেই কে জানে কী অসম্বদ্ধ কারণে সে তার প্রেমিকাকে আক্রমণ করে। এবং সেই চোখ লাল মুখে-ফেনা-ওঠা পশ্চাৎপট জেনেও এই শক্ত বনেদের মহলে সানাই বেজে ওঠে।
ফাইলপত্তর সামনে নিয়ে আবছা ভাবে এ সবই ভাবছিলুম। একশ বছরের পুরনো বাড়িও লোকে শেষ জীবনে সারাই-ঝালাই করে বসবাস করবার কথা ভাবে? ভাবছিলুম একজন দুর্ধর্ষ মেধাবী মানুষ শুধু বুদ্ধিচর্চা করছিল বলে উন্মাদ হয়ে গেল? মানসিক আঘাত বা দুর্ঘটনার প্রশ্ন যতক্ষণ ছিল, একটা ব্যাখ্যা ছিল। এখন যে দেবকুমারের সবটাই অর্থহীন হয়ে গেল! প্রকৃতি কি তবে চায় না মানুষ বুদ্ধিচর্চা করুক! নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করুক! প্রকৃতি কি শুধু গতানুগতিকতাই পছন্দ করে! কতকাল ধরে, পৃথিবীর কত পরিবর্তন হয়ে গেল, পিঁপড়ে একভাবে সার বেঁধে চলেছে, খাদ্য-সংগ্রহ ও বণ্টন করছে, গরমে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। খাবারের টুকরো কিছু পড়ে থাকলে, যেন মাটি থেকে হাওয়া থেকে আবির্ভূত হচ্ছে। পিঁপড়েদের মধ্যে কোনও ফেইনম্যান, কি এনরিকো ফার্মি হবে না, দেবকুমার হবে না। আরশোলাদের মধ্যে আরশোলাদেরই মানদণ্ডে কোনও রবীন্দ্রনাথ হবে না। পরিবর্তন নেই। উদ্বর্তন নেই। টিকে আছে। কোনও মানে নেই কিন্তু যুগযুগান্ত ধরে টিকে আছে। অথচ যাদের টিকে থাকার মানে ছিল সেই রামানুজ শেষ। সেই দেবকুমার শেষ। দেবকুমার সাবান ঘষে ঘষে গেঞ্জি কাচছেন। নিজের বিছানা নিজেই ঝেড়ে নিতে শিখেছেন, এগুলো নিশ্চয়ই অ্যাসাইলামে তাঁকে অভ্যেস করিয়েছিল। আর হাইস্কুলের পাশকোর্স সায়েন্সের টেক্সট বই, অঙ্ক অনার্সের টেক্সট বই ঘাঁটছেন। এতদিন অনভ্যাসের পরেও যা তাঁর কাছে জলের মতো সোজা। নাকি সঞ্জীব সাহারায়ই একটা উপকথা বলে গেলেন? একজন কখন কী ভেবে অন্যের দিকে চলে যায় সে রহস্যই বা কে বুঝবে? স্থাবর বস্তু তো নয়!
—সমুদ্র!
মুখ তুলে তাকাই। সামনে মুকুলিকা, যাকে এখন আমরা সবাই-ই মুকুল বলে ডাকি।
—কী ব্যাপার? কিছু অসুবিধে হয়েছে? বসো না!
জয়ন্তী বা মুকুলের কোনও অসুবিধে হলে ওরা আমার কাছে আসে। ওদের অসুবিধে দূর করবার জায়গায় এখন আমি পৌঁছেছি।
মুকুল বসল। ও যেমন পরে একটা হালকা হলুদ শাড়ি। মুখ দেখলে মনে হয় না এ মেয়েটি এঞ্জিনিয়ার। যেমন কোনও জড়তা বা আড়ষ্টতা নেই, তেমন বিশেষ লক্ষণীয় কোনও স্মার্টনেসও নেই, যা দীপার ছিল, জয়ন্তীর আছে।
ফাইলটা ঠেলে সরিয়ে দিই।
—বলো, ব্যাঙ্গালোরে এবার যেতে অসুবিধে আছে?
কোনও জবাব দিল না মুকুল। একটু পরে দেখি ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছে, পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে, ও দু’একবার মোছবার চেষ্টা করল, তা-ও পড়তেই লাগল। মুখটা নিচু। আর জল মোছবার চেষ্টা ও করছে না, খালি শাড়ির ওপরাংশ ভিজে যাচ্ছে লোনা জলে।।
নির্বাক দু’জনে বসে আছি। আমি বুঝতে পেরেছি। কী যেন একটা উথলে উঠছে আমার বুকের মধ্যে। কী নিরুপায় ও! কত দীর্ঘদিন দুঃখ নিয়ে কাটিয়েছে, কতদিনের খরার পর এই বৃষ্টিপাত! কোনওদিন এ রকম অনুভূতি হয়নি আমার… এমন করুণা, যেন আমার শেকড় ধরে কে টান দিচ্ছে!
—মুকুল। তুমি কি আমায় বিয়ে করতে রাজি আছ?
অসহায় কান্নার মুখোমুখি এই কথাগুলোই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
কিছু ভাবিওনি।
ও চুপ।
—বলো কিছু বলো! এখনই কেউ এসে পড়তে পারে।
তাড়াতাড়ি রুমাল ঠেকাল চোখে।
—আমি আজই বাড়ি গিয়ে বলব। ধরো মাস দুই তিন! ঠিক আছে?
টেবিলে পড়ে থাকা মুকুলের হাতদুটো তুলে নিয়ে ওর মুখের দিকে গভীর ভাবে চাই। চোখে চোখ মেলে না। ওর নিচু মুখটা লালে লাল হয়ে আছে।
—তোমাকেও বাড়িতে বলতে হবে। আমি যাব। ঠিকানা, ফোননম্বরটা কি দেবে?
একটা কার্ড বার করে দেয় মুকুল। তারপর বলে— এগোবার আগে একটু কথা বলতে হবে। একটা সন্ধে দাও আমাকে। দেবে?
মনে মনে বলি… জীবনের সব সন্ধ্যা তোমাকে দেবার আয়োজনই তো করছি! আবার কেন সন্ধ্যা চাও মুকুল? তুমি কি দীপার কথা কিছু জিজ্ঞেস করবে? ও কথা জানলে তুমি বড় কষ্ট পাবে, আর যদি জেনে ফেলে থাকো…
—আমি জানি না কীভাবে… মুখে বললুম— ঠিক আছে। বলো কবে?
—যদি শনিবার হয়? এই শনিবার? কোথায় গিয়ে একটু কথা বলা যায়?
—আমি তো জানি না। যেখানেই যাই, বড় ভিড়। তুমি বলো। আমি চলে যাব।
আজ এসেছি। লিন্ডসে স্ট্রিটের ও প্রান্তে ছোট্ট লম্বা রেস্তরাঁ। সত্যিই খুব শুনশান। দু’একজন পান করছে, খাচ্ছে, নিচু গলায় কথা বলছে। উঠে চলে যাচ্ছে।
আমি পৌঁছবার দশ মিনিট পরে মুকুল পৌঁছলো।
আমার একটু সঙ্কোচ হচ্ছিল, কিন্তু ওকে ভাল করে দেখলুম। সাদার ওপর ছোট্ট ছোট্ট নীল নকশা, সাদা ব্লাউজ, সাদায় শ্যামবর্ণ কোনও যুবতীকে যে এত ভাল দেখাতে পারে আমার ধারণা ছিল না।
এতক্ষণ একটা নরম পানীয় নিয়ে বসেছিলুম। ও কী খাবে জিজ্ঞেস করি।
—যা হোক কিছু।
—যা হোক? কোনও বিশেষ পছন্দ নেই?
—এখন ও সব ভাবতে পারছি না। ও মুখ নিচু করেই রয়েছে।
—সমুদ্র!
—বলো!
—তুমি কোনও ভূমিকা ছাড়া হঠাৎ ও কথা বললে কেন?
ও কি শুনতে চায় আমি বহুদিন থেকে ওকে ভালবেসে এসেছি! কথাটা তো সত্যি নয়। যার সঙ্গে জীবন বাঁধতে যাচ্ছি তাকে এমন মন-ভোলানো কথা বলব! না বললেও তো ও কষ্ট পাবে! একটু ভেবে বলি—
—মুকুল আমি নিজের সম্পর্কে খুব নিশ্চিত নই। প্র্যাকটিক্যাল কাজগুলো আমার আসে, সহজে করে যাই। যাকে তোমরা এফিশিয়েন্সি বলো। কিন্তু হৃদয় বা আবেগের ব্যাপারে আমার ভেতর থেকে একটা বাধা আছে। জানি না কেন। তোমাকে বরাবরই আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু তুমি সেদিন ওইভাবে ভেঙে পড়তেই আমি বুঝতে পারি আমাদের দু’জনের দু’জনকে দরকার।
—সমুদ্র, তুমি জানো না এই রেস্তরাঁয় বসে আমরা মানে আমি, দীপা, জয়ন্তী তোমাকে নিয়ে কত আলোচনা করতাম। আমরা… তিনজনেই কিন্তু তোমাকে…। দীপার বিয়েটা স্থির ছিল। তাই হয়তো… জয়ন্তী এখনও… ও খুব দুঃখ পাবে।
—মুকুল কেউ দুঃখ পাবে বলে তো আমি নিজেকে সবাইকার মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি না। পারি?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল— জয়ন্তী তোমাকে আগে অ্যাপ্রোচ করলে কী করতে?
—ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটত নিশ্চয়। তখন জয়ন্তীর কাছে আমি ভাববার সময় চাইতুম। আর একটু সময়, আর একটু…। তাতেই জয়ন্তী বুঝে যেত। তা ছাড়া ওর সেন্স অব হিউমার আছে বেশ। তোমার মতো কান্নাকাটি করার পাত্র নয়।
একটু হাসল— তা হলে আমি ছিঁচকাঁদুনে বলেই…।
আমি হেসে ওর হাতটা ধরে বলি— অত বিশ্লেষণ করতে নেই। আবেগ হল আবেগ। অনুভূতি হল অনুভূতি। কী হতে পারত আর কী হবে এ সবে আমাদের দরকার কী?
ফিনকিকে দেখতে হয়। কী হাসি! কী লম্ফঝম্প।
—একটা কাজের মতো কাজ এতদিনে করলি ছোড়দা। এর পরে আমারও একটা ভাল দেখে বিয়ে দিবি তো?
—শিওর, আমি বলি, ওর গালে ঠোনা মারি। যদিও এসব আমার আসে না। বাবা খুশি।—ডেকে বললেন—তোমার সিদ্ধান্তে আমি নিশ্চিন্ত হলুম সমু। এটা আমাদের কর্তব্য ছিল, কিন্তু কখনও তোমাকে বলতে পারিনি। এমন একটা ডিসট্যান্ট ধরন তোমার! মেয়েটি সগোত্র নয় বলে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তোমাকে সংসারী দেখতে চাই। তারপরে ফিনির একটা…।
মা কিছু বললেন না। কিন্তু কয়েকদিন মায়ের ঘোরাফেরার একটা ছন্দ একটা প্রাণ এসেছে বুঝতে পারি।
আষাঢ় মাসে দিন ঠিক হল। প্রায় প্রায়ই দেখি ফিনকি মুকুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। দু’জনে সময় ঠিক করে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে যাচ্ছে। জেঠুও জানতে পারলেন। রাতে গুডনাইট করতে যাই প্রতিদিন। সেদিন বললেন— ‘সমু একটু বসো।’ একটু বসে ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া আমার অভ্যেস। একটু পরে বললেন— ‘সমু বড় ভাল ছেলে, বড় ভাল। ভাল হোক, সমুর ভাল হোক…’ ঘুম-জড়ানো গলায় বলতে বলতে কথাগুলো মিলিয়ে এল। আরও কিছুক্ষণ বসলুম। তারপর ওই কথাগুলোর রণন নিয়ে নিজের ঘরে আসি। একজন অসহায়, পরনির্ভরশীল, প্রায় আত্মবিস্মৃত মানুষ বলছেন, সমু বড় ভাল ছেলে। সাদা শাড়ি পরা প্রসাধনহীন একটি শ্যামা কেঁদে চলেছে। কেঁদে চলেছে, একটি প্রাণোচ্ছল মেয়ে বলছে, এবার আমার একটা ভাল দেখে বিয়ে দিবি তো? মায়ের মুখে হাসি-হাসি ভাব, বাবা আপাতত হম্বিতম্বি ভুলে গেছেন। আর জয়ন্তী একমুখ হেসে বলেছে— ব্যাড লাক।
—কার?
—আমার। আর কার?
দুজনেই হাসি।
আর দাদা এবার জরুরি ফোন করেছে— সমু। তোমাকে ভীষণ দরকার। খুব সঙ্কটে পড়েছি। আমার আপন লোক দরকার, পরামর্শ দেবার।
প্লেনের টিকিট কাটি। দাদাকে জানিয়ে দিই। দাদাই থাকবার ব্যবস্থা করতে চাইছিল। টেলিফোনেই সব স্থির হয়ে যায়। কিন্তু আমার একটা সুবিধে হবে। গুরগাঁওয়ে কিছু অফিস-সংক্রান্ত কাজ আছে। কাকে পাঠাব ভাবছিলুম। নিজেই মিটিয়ে আসতে পারব। মা বিয়ের চিঠিটা দিয়ে দিলেন,— এই প্রথম দাদার সম্পর্কে কোনও মন্তব্য শুনলুম মা’র কাছে।— ওর বিয়ের সঙ্গে তো আমাদের কোনও সম্পর্ক রাখতে দেয়নি। বোলো বউ নিয়ে যেন আসে।
একটু হাসি পেল আমার। দিল্লির চটি। দিল্লির চটি নিয়ে ছুটিতে আসার কথা দাদার। এখনও ফিনকি চটি পরছে।
প্লেন ছুটেছে আর আমি ভেবে চলেছি। কী এমন পরামর্শ দরকার হতে পারে দাদার? সে তো বাইরে চলে যাবে ঠিকই করে নিয়েছে। অরোরাদের আওতা থেকে বেরোবার আর কোনও রাস্তাও তো নেই! যেটা বুঝেছে সেটাই করুক। আমার পরামর্শ ছাড়াই তো এতখানি ভেবে ফেলতে, ব্যবস্থা করে ফেলতে পেরেছে। তা হলে? আমি কোন জাদু জানি যে আমার উপস্থিতিতে কিংবা পরামর্শে দাদার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? হঠাৎ মনে হয়, ও সব আসল কথা নয়। দাদা বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে খুব সুখে নেই। অন্যদের মুখোমুখি হবার সাহস ওর নেই। খালি আমাকে, একমাত্র আমাকেই ও সেইরকম আপন মনে করে যাকে নিজের ভুলচুক, সঙ্কট সব বলা যায়।
যাবার সময়ে প্লেন-এ। আসার টিকিট ট্রেনের। হেড অফিস থেকে ওরাই এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসে। ওরাই গেস্ট-হাউজে পৌঁছে দেয়। গুরগাঁওয়ের কাজ সারি। সরেজমিনে মার্কেট-কমপ্লেকসের সাইট দেখা, প্রারম্ভিক হিসেবপএ করা। আমার মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে কোটেশন দেওয়া হবে। তিন-চারদিন চলে যায়। তারপর দাদাকে ফোন করি। সাদা মারুতি চড়ে গেস্ট হাউজে চলে আসে দাদা।
এ কী চেহারা হয়েছে দাদার? এত থসথসে মোটা? বয়স কত। মাঝ-তিরিশ? ফ্যাটটা তো ভাল লাগছে না! ও কি ড্রিংকস ধরেছে নাকি?
কে রোগা হল, কে মোটা হল, এসব কথা আমি কখনওই কাউকে বলি না। কিন্তু আমার দৃষ্টিটা যে মুহূর্তে দাদার মুখের ওপর স্থির হয় ও বুঝতে পারে। মনের ভেতর একটা দংশন নিশ্চয়ই আছে ওর।
কৈফিয়ত দেবার ঢঙে বলে—কী জানিস, বসে বসে মাথার কাজ তো! গুচ্ছের খানেক আবার রিসার্চ করছে আমার কাছে। আমার তো মনে হয় যে কোনওদিন রক্তে চিনি কি হার্টব্লক ধরা পড়বে। নাও ইনসুলিন, করো অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি… যাক গে যাক গে। তোর চেহারাটা বলতে নেই চাবুকের মতো। ফর্মটা ধরে রেখেছিস। অনেকদিন বাঁচবি। আরাম সে।
আমি হাসি— একটু যোগ-ব্যায়াম কি ফ্রি-হ্যান্ড-ট্যান্ড করলেও তো পারো। কিছু না হোক হাঁটাহাঁটি? মাথার কাজ-টাজ অজুহাত।
—কী জানিস, তেমন উৎসাহ পাই না, কিছুতেই না।
কেন কী বৃত্তান্ত আমি কিছুই জিজ্ঞেস করি না। ওর যদি বলার তাড়া থাকে ও-ই বলুক।
—চল তোকে পরোটা গলিতে খাইয়ে আনি। আগের বার খেতে চেয়েছিলি, মনে আছে?
পরোটা গলিটা যে একটা অছিলা ছিল, কোনও সত্যিকারের আকাঙক্ষা ছিল না এসব কথা ওকে না বলাই ভাল। কেমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে আছে।
আমাদের বড়বাজারের মতো বিশৃঙ্খল ঘিঞ্জি জায়গাটা। একটা বিরাট গুরুদোয়ারা পেরোলুম। গাড়ি অনেক দূরে রেখে হেঁটে যাই। শীতকাল। কিন্তু দাদার একটু হাঁফ ধরছে। দু’চারটে দোকানে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করল।
—আমি কখনও আসিনি বুঝলি? দাদা একটু বোকার মতো হাসল,— সেই আজীবন কলকাতায় থেকেও লোকে ‘পরেশনাথ’ দেখে না, না? সেই রকম।
—এ হে-হে-হে, এ যে সবই ভেজ রে?
—তাতে কী হয়েছে? আমি বলি— আমার কোনও অসুবিধে নেই। তুমি কি একেবারেই….।
—আরে না না। ভেজ আমার ভালই লাগে, সেই মায়ের হাতের লাউ-মটরশুঁটি? অবশ্য যেদিন নুন-মিষ্টিটা ঠিক হত— দাদার সঙ্গে আমিও হাসি।
কাঠের বেঞ্চি, স্কুলের মতো হাইবেঞ্চ, লো বেঞ্চ। মাটির গর্তয় গনগনে উনুন তার ওপর পেল্লাই চাটু চাপানো। একজন ফর্সা লোক তাল তাল ময়দা ঠাসছে। কাঠের বারকোশের ওপর নানারকম পুর ভাগ করা করা রয়েছে। দাদা বলল— মেথি পরোটাটা আগে টেস্ট কর বুঝলি সমু? আলু পরোটা তো ওখানেও পাওয়া যায়।
আমার কোনও বক্তব্য নেই। ডাল, আলুর তরকারি, আর চাটনি আসে। মেথি পরোটা, গোবি পরোটা.. মটর পরোটা। এরা বলে পড়েঠা।
—বুঝলি সমু, আমার স্ত্রী যেতে চাইছে না।
—যেতে চাইছে না?—আমি অবাক—বস্টন কেম্ব্রিজ… যেতে চাইছে না?
—বলছে এখানে ওর অনেক দিনের চাকরি। ওখানে গিয়ে কী করবে?
—ওখানে গিয়ে ওয়র্ক পারমিট-টিট পেয়ে গেলে তো কাজ করতেই পারে?
—সে কথা ওকে কে বোঝায়? তারপর ছেলের এখন যে স্টেজ! ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। সেটাই…
—তাই বলে তোমার এত উন্নতি— সেটা ভাববে না? ছেলে তো স্কুল লেভল শেষ করে ওখানেই চলে যেতে পারে? বাবা-মা থাকলে তো ওর আরও সুবিধে হয়ে গেল! কত ছাত্র যাচ্ছে!
—তবে! দাদা হতাশ গলায় বলল— বলবীর আসলে ওর দাদু-দিদার চোখের মণি, ওঁরা ওকে ইন এনি কেস ছাড়বেন না।
—বড় হয়ে ও যদি নিজেই সে ডিসিশন নেয়?
—ওই তো বলে কে!
আমি দাদার দিকে তাকাই— এমন চান্স কিন্তু জীবনে বারবার আসবে না দাদা।
—তুই বলছিস? মিস করা ঠিক নয়, না? —দাদা খুব চনমন করে উঠল।
—নিশ্চয়ই।
—তা হলে আমি যে যাচ্ছিই সে কথা জানিয়ে দিই, না কী?
—ভেবে দ্যাখো।
—আবার ভেবে দ্যাখা-ট্যাখা কেন? সিদ্ধান্তটা যাতে নিতে পারি তাই তো তোর সাপোর্ট চাইছি!
—হ্যাঁ পরে বউদি নিশ্চয় বুঝবেন, মত পরিবর্তন হবে।
—সে গুড়ে বোধহয় বালি– দাদা খুব বিমর্ষ মুখে বলল— ও আদৌ যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। হয়তো… হয়তো বা ডিভোর্সই চাইবে।
—সে কী? আমি আপাদমস্তক অবাক হয়ে যাই।
দাদা করুণ মুখে মাথা চুলকোতে থাকে।
—এমনই কি সম্পর্ক তোমাদের যে যখন-তখন ডিভোর্স চাওয়া যায়।
—কী জানিস, যার একটা নিজের সন্তান হওয়ারই অধিকার নেই, তার সঙ্গে আর কী রকম সম্পর্ক হবে! তারপর ছেলেটাও তো বাবা বলে অ্যাকসেপ্ট করল না। অ্যাকসেপ্ট না করলে আমি কী করতে পারি, বল! চেষ্টার তো কসুর করিনি। উদ্ধত, বেয়াড়া ছেলে একটা, লাইফটা হেল করে দিলে।
বুঝতে পারি দাদার পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
—তুমি তোমার সিদ্ধান্তে স্থির থাকো, আপাতত তোমার কি খুব অসুবিধে হবে বউদি না গেলে? অত সহজে ডিভোর্স চাইতে পারে সে কেমন মানুষ?
অন্যের সম্পর্কে মতামত প্রকাশ আমি কখনও করি না। প্রত্যেককে তার ভাবনার স্বাধীনতা দিই। কোনও ভাবে নিজের ছায়া পড়তে দিই না। আজ কেন দিলুম? মনে হচ্ছিল— দাদা একেবারে কূল হারিয়েছে। তাই কী?
—ঠিক বলেছিস। আমি কী জানিস, একটা আইডেনটিটি কার্ড, একটা মলাট। সোনুর স্বামী, বলবীরের বাবা। এ ছাড়া আর কোনও দরকার ওদের আমাকে দিয়ে নেই।
—বউদিও কি এভাবেই ভাবে?
—কী জানি। বোধহয়! এদের মনের গড়নটা একটু অদ্ভুত। সেন্টিমেন্ট-টেন্ট ধার ধারে না।
—তা ছেলের জন্যে তো খুবই আছে। কত লোকে চান্স পেলে বাবা-মা’র কাছে ছোট বাচ্চা রেখে চলে যায়। পরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিয়ে যায়! আর এ তো একটা বড় ছেলে?
—ঠিক বলেছিস। সেন্টিমেন্ট আছে, আমার জন্যেই নেই।
—সে ক্ষেত্রে দাদা তোমার চলে যাওয়াই উচিত। ডিভোর্স-টিভোর্স এখুনি দিয়ো না। পরে তো পরিস্থিতি বদলাতেও পারে।
—ফাদার-ইন-ল’টা প্রবলেম করতে পারে। কিছুদিন হল রিটায়ার করেছে অবশ্য।
—পুরো জিনিসটা তুমি সিক্রেটলি হ্যান্ডল্ করো। যাবার আগে ক’দিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকো, চলে যাও, তারপর খবর দিয়ো।
—জানি না পারব কি না। তুই একটু হেল্প কর। আমি যদি ক’দিনের জন্যে কলকাতায় চলে যাই! …তোর কমপিউটার আছে? ফ্যাক্স?
—সবই আছে, অফিসে।
—কলকাতার বাড়ির ঠিকানা দেব বুঝলি। পাসপোর্ট, ভিসাও ওই আড্রেস। ইতিমধ্যে যা কিছু খুচরো খবর তোর ফ্যাক্স নম্বর-এ কি ই-মেলে করবে।
—রিলিজ?
—আরে ওদিকটা সম্পর্কে শিওর হয়ে গেলেই আমি রেজিগনেশন দিয়ে দেবো।
—নোটিস দিতে হয় তো?
—ধুর, কনট্রাক্ট সারভিস্ তো আর নয়। ফর্ম্যালিটি… জাস্ট ফর্ম্যালিটি…। আর পি. এফ-এর টাকা আমি বেশির ভাগটাই তুলে নিয়েছি। এই লোন, সেই লোন। সোনুকে একটা চিঠি লিখে রেখে যাব— তোমার জেদের জন্যে তো আর আমি আমার কেরিয়ার নষ্ট করতে পারি না! সুতরাং আমি চললুম। তুমি যখন ইচ্ছে চলে আসবে। ড্রাফটটা করে ফেলি বল!
আমি হেসে ফেলি— ড্রাফট করাটা আর এমন শক্ত কাজ কী! ও সব কারও চোখে-টোখে পড়ে গেলে…।
—ঠিক বলেছিস। কাগজপত্র কি আর তেমন সেফ? ড্রয়ারের একটা ডুপ্লিকেট চাবি করানোর এমন কী হাঙ্গামা?
বেশ জটিল অবস্থা দাদার। যা ভেবেছিলুম তার চেয়েও ঘোরালো।
যে আশ্রয়কে অনিরাপদ ভেবে দূরে সরে গিয়েছিল, সে আশ্রয়েই ফিরে আসতে চাইছে নিরাপত্তার জন্য। কী পরিহাস! দাদা কি কখনও নিরাপদ হতে পারবে?
ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষুনি স্পিড নেবে। দাদার ফুলো-ফুলো বিধ্বস্ত চেহারাটা কেমন ঢেউ ওঠা জলের তলার ছবির মতো বেঁকেচুরে যায়। কাচের লেভেলে কিছু দোষ থাকলে এ রকম হয়। দাদার চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। আরও আরও দূরে চলে যাচ্ছে দাদা। কে জানে হয়তো আর দেখা হবে না। দাদা কি সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত নিতে পারবে? দাদা কি কোনওদিন নিরাপদ হবে? আমি কেন মতামত দিলুম? কখনও তো দিই না! দাদার জীবনের সঙ্গে আমার মতামতের কী সম্পর্ক? তবে কি আবার কোনও জল-বসন্তের রাত এলো, যখন আমি ছাড়া দাদার কোনও শুশ্রূষা নেই!
আমার বার্থ নম্বর তেইশ। গুছিয়ে বসি, ওভারনাইট ব্যাগ একটা তলায় চালান করে দিই। চব্বিশ নম্বর অর্থাৎ ওপরের বাঙ্কের মালিক একটি মারোয়াড়ি ছেলে। নাম ভিনিত। অর্থাৎ আমাদের ‘বিনীত’। প্রচুর মোটা, তেমনি ফর্সা, সবই যেন ওর ফেটে পড়ছে। খুব হাসিখুশি মিশুক ছেলে। ‘দাদা দাদা’ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভাব জমিয়ে নিলে। আমাকে কিছু বলতে হয় না, ও-ই একনাগাড়ে বকে যায়। দিল্লিতে মৌসির কাছে থেকে চার্টার্ড পড়ে। বাবার বিজনেস কলকাতায়। কিন্তু ও কলকাতায় যোগ দেবে না। কলকাতার, কিছু মনে করবেন না দাদা, কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সুবিধে পেলেই ও অন্য কোথাও বিজনেস উঠিয়ে আনবে। দিল্লি ইউ.পি-র বর্ডার নয়ডা খুব ডেভেলপ করছে…ওইখানেই।
নিজেই নিজের ভুঁড়িতে টুসকি মেরে হাসতে থাকে— আমাকে আর কী মোটা দেখছেন দাদা, আমার মা ঔর ভি, পাপ্পার প্যান্ট বানাতে পুরা ছঁমিটার কাপড় লাগে। মোটা-মোটি কি ফ্যামিলি, দুবলি-দুবলা কোই নহি।
—খুব ঘি খাও তো?
—আরে কী বলেন দাদা, ঘিউসেই তো খানা পকতা হ্যায়, হোনাই তো চাহিয়ে। আপনি কী করে এমন চেহারাটি বানিয়েছেন। দাদা?
আমি হেসে বলি— এ আর এমন সিক্রেট কী? আমি তোমাকে বলতেই পারি। কিন্তু তুমি পারবে না।
—বোলিয়ে না দাদা! ওয়েট-লিফটিং, ইয়োগা? বোলিয়ে না, লড়কিলোগ পসন্দ করতি নহি।
—তবে তো বলতেই হয়, আমি মজা পেয়ে বলি, ওসব ইয়োগা টিয়োগা পরের কথা। আগে ঘি খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
—ও হি তো! উও মুঝসে নহি হোগা দাদা।
উল্টো দিকে হেঁটো ধুতি পরা এক ভদ্রলোক মনের সুখে খইনি ডলছেন, বলে উঠলেন— দুধ পিও ভাই, লোটাভর দুধ পিও। ভঁইস কা দুধ। লড়কিলোগ আপসে আ যায়েঙ্গি। ইৎনা গ্ল্যামার হোতা, ইৎনা গ্ল্যামার! তাকত! হিম্মৎ!
অন্য দুজন ভদ্রলোক ব্যবসায়ী মনে হল। নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় জোর গলায় আলোচনা করে চলেছেন। ফ্লাই অ্যাশ অ্যান্টি পলিউশন মেজার, গ্যাসকেট, সেরামিক ব্রিক…এ রকম নানা টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে। এরা বোধহয় অন্ধ্রের লোক। তেলুগুতে কথা বলছেন। খুব ভরাট গলা দুজনেরই। নিজেদের জগতে একেবারে মগ্ন, ডাইনে বাঁয়ে দৃষ্টি নেই।
সাইডের সিটে ওঁরা নিশ্চয়ই স্বামী-স্ত্রী, দুজনে মুখোমুখি পা ছড়িয়ে বসে আছেন, কখনও বাইরে চোখ রাখছেন, কখনও নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। কিন্তু শোনা যায় না। শব্দ নেই শব্দ নেই করেও ট্রেনের একটা কেমন অন্তর্নিহিত ধ্বনি থাকে যা সব কথাবার্তা, সব আওয়াজ দূরে পাঠিয়ে দেয়। একবার চকিতের জন্য মনে হল, অদূর ভবিষ্যতে এরকম একটা দৃশ্যে থাকতে পারে মুকুলিকা পালিত এবং এই মানুষটা যাকে ‘আমি’ বলে চিনি। কেমন অবাক লাগল কথাটা ভেবে। এতদিন এক ভাবে বেঁচে এসেছি, এখন এরপর কি অন্য ভাবে বাঁচব? সেই বাঁচাটা কেমন আমি আন্দাজ করতে পারছি না। আমি কি এই আমিই থাকব না অন্য কোনও আমি হয়ে যাব? টুপ করে একটা দুটো পেয়ারা পাতা খসে পড়ে, হাওয়া বয়, জলের মধ্যে ছবি ভেঙে ভেঙে যায়!
বাইরেটা যতক্ষণ দেখা যায় দেখি। তারপর কাচে শুধু এই কামরারই বিম্ব। এই আমি, ওই ভিনিত, খইনি, ব্যবসায়ীযুগল, দম্পতি। একটা সিনেমার দৃশ্য দেখছি, আমার একটা নগণ্য ভূমিকা আছে ছবিটাতে, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ তার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
মাঝখানের পর্দাটা টেনে দম্পতিদের আড়াল করে ব্যবসায়ীযুগল আবার একটু পানও করে নিলেন। ‘হোপ য়ু ডোন্ট মাইন্ড’ জাতীয় একটা নাম কা ওয়াস্তে অনুমতি নিয়ে। ভিনিত বলল—দাদা চলে? আমি প্রশ্নটা ওকে ফিরিয়ে দিই। মৌসি-মৌসা নাকি ওকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে ড্রিংক করলে। খৈনি দেখি হঠাৎ একটা কুঁড়োজালি মতো নিয়ে জপ করছেন। এতক্ষণে খেয়াল করি ওঁর গলায় কণ্ঠি। বিহারি বৈষ্ণব আমি এই প্রথম দেখলুম। উনি গ্ল্যামারেও আছেন, কুঁড়োজালিতেও আছেন।
আটটা পেরোতে না পেরোতে ওরা খাবার দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সেটা রেখে দিই, ঠায় বসে থাকা আর খাওয়া ছাড়া এ সব সুপার ফাস্টে তো আর কিছু করার থাকে না! কাজেই একটু পরে অ্যালুমিনিয়ম ফয়েলের খোসা ছাড়াই। সেই এক আধা-হলুদ পোলাও, আধা-কালো চিকেন, ডাল, একটা অখাদ্য তরকারি যাকে এরা বলে ‘সবজি’। একটু স্যালাড। মায়ের বা রাঁধুনির রান্না নুন-খরো মিষ্টি-বেশি আলুনি আতেলা সবই তো খেয়ে নিই। এই ট্রেন প্লেনের তথাকথিত সুখাদ্য কেন কে জানে গলা দিয়ে নামে না! এর পরে বোধহয় দই বা আইসক্রিম দেবে, সেটাই ভরসা।
ভিনিত তো খাবারটা নিলই না। স্বাভাবিক। সে যেখানেই যাক না কেন তার ঘিও সঙ্গে যাবেই। একটা ডিব্বা খুলল, ঘিয়ের গন্ধে ভরে গেল আমাদের কুঠুরি, মোটা মোটা পরোটাগুলো আচার দিয়ে খেয়ে নিল চটপট। খইনি দেখি জুলজুল করে দেখছেন।
একটু বকবক শুনি ভিনিতের, চুপচাপ চিন্তাহীন বসে থাকি কিছুক্ষণ। সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই ভিনিত ওপরে উঠে যায়, ঝাড়ছে সশব্দে বাঙ্কটা, বিস্তঁরা বানাবে। ব্যবসায়ী দুজন না উঠলে আমি বা খইনি কেউই শুতে পারছি না। শেষকালে খইনি এক আকাশ পাতাল জোড়া হাই তুললেন শব্দ করে।
—‘ওহ সরি, আপকো সোনা হ্যায়’…একজন সেরামিক ব্রিক খইনির ওপরের বাঙ্কে উঠে গেলেন, আরেকজন অন্য খুপরিতে চলে যান। নিভাঁজ বিছানা করি অতঃপর। বাড়তি চাদর মাথার দিকে ভাঁজ করে দিই। কম্বলের কুটকুটোনির থেকে সুরক্ষা-চাদরটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পাড়ি একটা চটি বই নিয়ে। ‘নিদ্ৰাযোগ’ বা ‘নিদ্রাইয়োগা’, নামটা এভাবেই লেখা। কিন্তু বইটা ইংরেজিতে। নিদ্রা ছাড়া কী-ই বা করবার আছে ট্রেনে? লেখক নিদ্রাকে নিদ্রাতেই আটকে রাখতে চাইছেন না। তাকে যোগ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, একটা সচেতন মানসিক ব্যায়াম। এভাবে যদি নিদ্রাকে ব্যবহার করা যায়, তা হলে নিদ্রা যে আরও কতগুণ বিশ্রাম ও এনার্জি দিতে পারে তার হিসেব অঙ্ক কষে দেওয়া আছে। মজা লাগে, আশ্চর্যও লাগে সেই সমীকরণ পড়তে। নিদ্ৰাযোগ, মোহনিদ্রা যোগনিদ্রা, ও মহানিদ্রা— এই রকম শ্রেণিবিভাগ করেছেন ভদ্রলোক। নিদ্রাযোগ থেকে যোগনিদ্রায় পৌঁছলে প্রাণশক্তিকে পর্যন্ত মুলতুবি রাখা যায়। আমরা যেসব সাধু-সন্ন্যাসীর কথা শুনি ক্বচিৎ কদাচিৎ যাঁরা মাটির তলায় দীর্ঘক্ষণ জীবন্ত সমাধির পরও বেঁচে থাকেন, তাঁরা এই যোগনিদ্রা ব্যবহার করেন। কিছুই না, খালি চর্চা। যোগনিদ্রার অভ্যাস পাকা হলে মহানিদ্রা অর্থাৎ চিরনিদ্রার ক্রান্তি খুব সহজ সুন্দর হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু কৌতুক বোধ করি। নিদ্রা মানেই তো চেতনাকে মুলতুবি রাখা, তার আবার সচেতন ব্যবহার কী জিনিস? শবাসনের মতো কী? ঘটনাহীন ট্রেন-যাত্রায় করার মতো কিছু পেয়ে আমি একটু হাঁফ ছাড়ি। মাথার কাছের সুইচটা অফ্ করে দিই। তারপর হাত পা সব শিথিল করে দিতে শুরু করি। পা থেকে ওপর দিকে উঠতে হয়। রিল্যাক্স, রিল্যাক্স…।
একদম গোড়ার দিকে কোথাও কারও নাসিকাগর্জন শোনা যাচ্ছিল। তারপর কামরায় খালি ঘুমের শান্তি, যার ভেতরে আমি তলিয়ে যেতে থাকি। চেতনার অতলেও কিন্তু ট্রেনের ঝড়ো গতি শরীরে জেগে থাকে, কামরা মৃদু মৃদু দোল দেয়, শিশুকে দোল দেওয়ার মতো। কত গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু, অ্যাস্টারয়েড, কত তারা, মহাজাগতিক বর্জ্য অকল্পনীয় গতিতে ঘুরছে মহাকাশে। আমরা পৃথিবীপৃষ্ঠে তার কিছুই তো বুঝি না। শুধু দিনরাত, শুধু ঋতুবদল দেখে বুঝতে শিখেছি আমরা চলেছি। হোক একই কক্ষপথে, তবু চলেছি। এখন ঘুমের মধ্যে হিমোগ্লোবিনে হিমোগ্লোবিনে, নিউরোনে নিউরোনে গতি বয়। সেই গতির সঙ্গে শরীরের ভেতরের সমস্ত উপাদান প্রতি মুহূর্তে সমঝোতা করে নিতে নিতে চলেছে। এই ক্ষীণ বোধ চেতনার অবতলে জেগে থাকে। হে আপাত ঘুমন্ত মানুষ তুমি থেমে নেই। বাহিত হয়ে যাচ্ছ স্থান থেকে স্থানান্তরে, গতি থেকে স্বস্তিতে, স্বস্তি থেকে শান্তি, শান্তি থেকে উপশম।
তবু, এখানেও নিদ্রা আমাকে পুরোপুরি অধিকার করতে পারে না, কেন না আমার সব পথ গ্রাস করে দাঁড়ায় এক বিশাল প্রত্ন অট্টালিকা। উঁচু উঁচু মোটা মোটা… ডরিক থাম, গুপ্তযুগীয় খিলান, পল্লেস্তারা খসে গেছে। যেখানে কোনওকালে দেয়াল চিত্র ছিল, এখন সে দেয়াল আঁকড়ে রয়েছে দানব-বিছের মতো বট-পাকুড়ের শেকড়ের মানচিত্র। ঘরের পরে ঘর পার হয়ে যাই। শূন্য। উঠোন, বারান্দা, দালান শূন্য। অথচ কোথা থেকে প্রতিধ্বনি আসে, কত রকম ডেসিবেল-এর, পায়ের আওয়াজ, ছুটে যাওয়া, হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠা, কলকল করে রুদ্ধ হাসি বয়ে যায়। বাচ্চা গলা ঘ্যানঘ্যানায়, বুড়ো মানুষের শ্লেষ্মাজড়িত কাশি, কথা কাটাকাটি, প্রেমিকের ফিসফিস, প্রেমিকার শীৎকার…পেছন ফিরে দেখি, পায়ের শব্দ থেমে যায়, হাসিতে হাসি মেলাতে যাই, হাসি থেমে যায়, কে কাঁদছ? বারান্দায় ধুলোর আস্তরণ, তার তলায় চাপা পড়ে গেছে কান্না, ঝুঁকে দেখি বাইরের একদা বাগানে স্তূপীকৃত পড়ে রয়েছে ভাঙা দেয়াল-ছাতের ইট কাঠ পলেস্তারার জঞ্জাল, ইঁদুর বেরিয়ে আসে, হুলো বেড়াল চাপা রাগে গজরায়। আর হঠাৎ সেই সমস্ত শূন্যতা, প্রতিধ্বনি, পতিত জমি, পরিত্যক্ত প্রাসাদ বেড়ে তার কুণ্ডলীকৃত শরীর পাকে পাকে খুলতে খুলতে উঠে দাঁড়াতে থাকে এক মহাসর্প। অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্যে, গরিমায়। তার রং গাঢ় বাদামি, চিকন, উজ্জ্বল, ভেতরের আলোয় জ্যোতিষ্মান, ফণায় ধবধবে সাদা নকশা। যেন কোনও মহানর্তক ধীরে ধীরে অপাবৃত করছেন তাঁর মুদ্রা মহিমা।
ধুন্ধুমার গর্জনে সেই প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। ভেতরে ভেতরে এত জীর্ণ এ যেন হওয়ারই ছিল। এই রহস্য কুঠির সব কোণ-কুলুঙ্গি দেখা হল না। খেদ নেই তেমন, কিন্তু ভেঙে পড়ার প্রতিঘাতে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। ভূকম্পের আওতা থেকে প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চাইছি, পারছি না। আমার নিদ্রাযোগ বা যোগনিদ্রা আমাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিয়েছে। আপার বাঙ্ক থেকে বিরাট আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ে ভিনিত। ওদিক থেকে অন্ধ্র- ব্যবসায়ী তাঁর বাঙ্কসুদ্ধু ভেঙে পড়েন ভিনিতের ওপর। উল্টো দিকের বার্থ থেকে খৈনিখাদক ছিটকে আসেন আমার বার্থের কিনারায়। আবার ছিটকে যান ওদিকে। এদিকে ওদিকে, এদিকে ওদিকে যতক্ষণ না তাঁর ওপর পর্দার ওপার থেকে ভীষণ শব্দে ভেঙে ছিটকে আসে তাদের বার্থসুদ্ধ দম্পতি এবং সবাই মিলে তালগোল পাকিয়ে যায়। জানলার শাটার কাচ ভেঙে পড়ছে চতুর্দিকে। আমার ওপরও, কিন্তু আমার অসাড় শরীর কিছুই অনুভব করছে না। গায়ে রক্ত, কিন্তু সে যেন সদ্যোজাত শিশুর গায়ে মায়ের রক্ত। গোঙানি চলতে থাকে, হাহাকার, আর্তনাদ। তারপর চুপ। খালি ভাঙা জানালাপথে তুমুল চিৎকার শুনতে পাই। ক্রেন.. ক্রেন, গ্যাসকাটার গ্যাসকাটার, দমকলের আওয়াজে রাত কাঁপতে থাকে। আমি শুধু শুয়ে থাকি তীক্ষ্ণ কাচের ফলা বুকে নিয়ে, তৃষ্ণার্ত, কখন কে মাটি ফুঁড়ে জল দেবে তার প্রতীক্ষায়।
চারদিকে অন্ধ দেয়াল। হাতড়াই। পেছল বেয়ে বেয়ে এগোতে চাই, অথচ কুয়োর ঢাকনি খোলা, দেখা যায় বর্তুল মুক্তি। কুয়োর কিনারা থেকে ঝুঁকে থাকে ছায়ামুখ, চিনি, চিনি, চিনতে পারি না। চারিদিকে জল খেলতে থাকে, মুখগুলো আপসাতে থাকে, ঝাপসা হয়ে যায়। কীরকম অন্তহীন জ্যোৎস্না ওপরে। পৌঁছতে চাই। পৌঁছতে চাই। কী করে? কীভাবে? মাথা খুঁড়ি। তারপর মনে পড়ে যায় আমার সেই একান্ত নিজস্ব গুপ্ত ক্ষমতার কথা।
নিরেট শূন্যে পায়ের একটু ধাক্কা, উড়ে যাই গিয়ার বদলে বদলে ওপরের আলোকিত অন্ধকারে। নির্বাধ উড়ে যাই। নীচে অজস্র বুদবুদের বর্ণালি রঙের হলকা ছুটিয়ে ফেটে যায়।