তীরের কাছে সমুদ্রের জল
তীরের কাছে সমুদ্রের জল খানিকটা ফিকে নীল আর সবুজে মেশানো, একটু দূরে গেলেই গাঢ় নীল। দূরে দূরে দু-একটা ছোট-ছোট দ্বীপ দেখা যায়। একটু পরেই মোটরবোটটা গভীর সমুদ্রে পড়ল।
মোটরবোটটা ছোট, কিন্তু খুব জোরে যায়। বিরাট-বিরাট ঢেউয়ের ওপর দিয়েও অনায়াসে চলে যাচ্ছে। শঙ্করনারায়ণ নামে একজন সেই বোটটা চালাচ্ছে, তার সঙ্গে রয়েছে আরও দুজন লোক।
সন্তু ভেবেছিল, সমুদ্রের ওপর দিয়ে মোটরবোটে চেপে যেতে তার দারুশ লাগবে। তার বন্ধুদের মধ্যে কারুর তো এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও। কিন্তু খানিকটা পরেই তার আর ভাল লাগল না। কী রকম মাথা ঘুরতে লাগল, পেটের মধ্যে মুচড়ে মুচড়ে উঠছে, তার ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। সন্তু নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল। বেড়াতে এসে এরকম তো কখনও হয় না। তার।
সমুদ্র দেখতে একঘেয়ে লাগছে, একসময় সে শুয়ে পড়ল কাঠের বেঞ্চের ওপর। কাকাবাবু সামনের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে বসে ছিলেন, একবার পিছন ফিরে সন্তুকে শুয়ে থাকতে দেখেই তিনি উঠে এলেন। কাছে এসে বললেন, কী সন্তু, শরীর খারাপ লাগছে?
সন্তু লজ্জিতভাবে বলল, না, না, এই এমনি একটু শুয়ে আছি।
তাড়াতাড়ি সে উঠে বসার চেষ্টা করল, তার ভয় হল, তার শরীর খারাপ দেখলে কাকাবাবু যদি তাকে ডাকবাংলোয় রেখে আসার কথা বলেন!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মাথা ঘুরছে? পেট ব্যথা করছে?
সন্তু উত্তর দেবার আগেই দাশগুপ্ত জিজ্ঞেস করল, ও বুঝি আগে কখনও সমুদ্রে আসেনি?
না।
তাহলে তো সী সিকনেস হবেই। এত বড় বড় ঢেউ–
দেখি, আমার কাছে বোধহয় ট্যাবলেট আছে।
কাকাবাবু তাঁর বড় চামড়ার ব্যাগ হাতড়ে দুটো ট্যাবলেট বার করলেন। ঐ ব্যাগটার মধ্যে অনেক কিছু থাকে। এমন-কী, কাঁচি, গুলিসূতো, আঠার শিশি পর্যন্ত সন্তু দেখেছে।
কাকাবাবু বললেন, এই ট্যাবলেট দুটো খেয়ে নাও সন্তু। তারপর শুয়ে থাকে। যদি বমি পায় বমি করে ফেলবে, লজ্জার কিছু নেই।
সন্তুর সত্যি একটু-একটু বমি পাচ্ছিল। কিন্তু অতি কষ্টে চেপে রইল। পেটের মধ্যেও যেন সমুদ্রের ঢেউ ওঠা-নমা করছে।
সন্তু এক সময় ঘুমিয়েই পড়েছিল, হঠাৎ দাশগুপ্তের চিৎকারে জেগে উঠল।
দাশগুপ্ত বলল, ঐ দেখুন, ঐ দেখুন!
সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসে বলল কী? কী?
দাশগুপ্ত সমুদ্রের মাঝখানে একদিকে আঙুল তুলে বলল, ঐ যে, দেখতে পাচ্ছ?
সন্তু দেখল, একটু দূরে জলের মধ্যে একটা খয়েরী তিনকোনা জিনিস উঁচু হয়ে আছে।
কী ওটা?
হাঙর। ঐ দাখো আর একটা।
হাঙর। ঐ রকম দেখতে?
ঐটুকু তো শুধু পাখনা। বাকি হাঙরটা জলের নীচে আছে।
ক্ৰমে দশ-বারোটা হাঙরের পিঠের পাখনা দেখা গেল। দাশগুপ্ত সন্তুকে ভয় দেখিয়ে বলল, দেখেছ, তো? এখানে একবার জলে পড়লে আর বাঁচবার উপায় নেই। হাঙরগুলো এক মিনিটে শেষ করে দেবে।
কাকাবাবু একটা দূরবীন চোখে লাগিয়ে বসে ছিলেন। খানিকটা দূরেই একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। তিনি দাশগুপ্তকে একটু ধমক দিয়ে বললেন, হঠাৎ ওরকম ভাবে চেঁচিয়ে উঠে না। আমি ভাবলাম, তুমি বুঝি কোনও মানুষজন দেখতে পেয়েছ?
দাশগুপ্ত আবার চুপ করে গেল।
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, এই যে দ্বীপগুলো দেখা যাচ্ছে, এগুলোতে নামা যায়?
দাশগুপ্ত বলল, না, স্যার, জেটি না থাকলে নামবেন কী করে? বেশি কাছে গেলে বোট তো বালিতে আটকে যাবে।
একেবারে কাছে না গিয়ে যদি খানিকটা দূরে বোট দাঁড় করিয়ে জলে নেমে পড়া যায়?
দাশগুপ্ত একেবারে আঁতকে উঠল। চোখ দুটো টলগুলির মতন গোল গোল করে বলল, না, না, তা কখনও হয়? এখানে যেখানে-সেখানে জলে নামতে যাবেন না। তাহলেই হাঙর এসে একেবারে ক্যাঁচ করে পা কেটে নিয়ে যাবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, স্যার, সত্যি কথা! একবার আমাদের চেনা একজনের পা কেটে নিয়েছিল।
কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, আমার তো একটা পা এমনিতেই অকেজো হয়ে আছে। হাঙর কি মানুষের দুটো পাই কেটে নিয়ে যায়? সব সময় তো শুনি ওরা মানুষের এক পা কাটে, আর এক পা রেখে যায়।
দাশগুপ্ত মজাটা বুঝল না। সে তখনও ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওসব চিন্তা ছাড়ুন। আপনি কি দুশোটা দ্বীপের প্রত্যেকটাতেই নেমে নেমে দেখতে চান? সে তো অসম্ভব ব্যাপার
এই দ্বীপে মানুষ থাকতে পারে?
কী করে পারবে? খাবার জল কোথায়? সমুদ্রের জল তো খাবার উপায় নেই। চারিদিকে এত জল, দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিকল। এই সব দ্বীপে কেউ দুদিন থাকলে জল তেষ্টাতেই শুকিয়ে মরবে!
তাহলে যে-সব দ্বীপে মানুষ থাকে, সেখানে কীভাবে জল পাওয়া যায়?
সে তো ঝরনার জল! যে-সব দ্বীপে বড় পাহাড় আছে, সেখানে ঝরনাও আছে। খুব মিষ্টি জল।
কাকাবাবু শুধু বললেন, হুঁ।
মোটরবোটটা এবার মূল সমুদ্র ছেড়ে খাঁড়িতে ঢুকল। খাঁড়ি মানে, দু-পাশে দ্বীপ, তার মাঝখান দিয়ে সমুদ্রের রাস্তা। দু-পাশের দ্বীপগুলো দারুণ ঘন জঙ্গলে ভরা, এক-একটা গাছ প্ৰকাণ্ড লম্বা-তার গায়ে লতাপাতায় ফুটে আছে। নানারকম ফুল। এ সব জায়গায় একটা গাছও চেনা গাছের মতন নয়।
দাশগুপ্ত ফিসফিস করে সন্তুকে বলল, তাকিয়ে থাকে, একটু পরেই কুমির দেখতে পাবে।
সন্তু বলল, কুমির? জলের মধ্যে ভেসে উঠবে?
না। দেখবে পাশের বালির চড়ায় রোদ পোহাচ্ছে। লঞ্চের আওয়াজ শুনেই ঝুপঝাপ করে জলে লাফিয়ে পড়বে।
সন্তু একেবারে বুকে পড়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
দাশগুপ্ত বলল, আজ যদি ভাগ্যে থাকে, তাহলে সাদা কুমিরও দেখতে পাবে।
কাকাবাবু আবার মুখ ফেরালেন। দাশগুপ্তকে বললেন, কী বাজে কথা বকছ? সাদা কুমির আবার হয় নাকি?
হ্যাঁ, স্যার, হয়। মাঝে মাঝে দেখা যায়! একবার একটা বিরাট তিমিমাছও এসে পড়েছিল নিকোবরের দিকে। তার কঙ্কালটা রাখা আছে পোর্ট ব্লেয়ারে। আর কুমির আর হাঙরের যা লড়াই বাধে না, স্যার, সে একটা দেখার মতন জিনিস।
কাকাবাবু হঠাৎ ডান দিকে ঘুরে বললেন, মানুষ! ঐ যে মানুষ দেখা যাচ্ছে!
সন্তু কুমির দেখলে যতটা উত্তেজিত হত, কাকাবাবু মানুষ দেখে তার থেকে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। সত্যি দেখা গেল বনের মধ্যে দুটি খাঁকি প্যান্ট পরা লোক ভেতর দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
দাশগুপ্ত কিন্তু বেশি উত্তেজিত হল না। বলল, হ্যাঁ, এদিকে বন বিভাগের কিছু লোক কাঠ কাঠতে আসে। কিন্তু ওদের শুধু বাঁ দিকেই দেখতে পাবেন। ডান দিকে পাবেন না?
কেন?
এই দিকের জঙ্গলে কারুর নামা নিষেধ। এই দিকের জঙ্গলেই জারোয়ারা থাকে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, জারোয়া কী?
এই রে, এর মধ্যে ভুলে গেলে? তখন বললাম যে! জারোয়া হচ্ছে খুব হিংস্র একটা জাত। তারা জামাকাপড় পরে না, তারা বিষাক্ত তীর মারে-আমাদের মতন লোক দেখলেই তারা খুন করতে চায়।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এই যে এখান দিয়ে মোটরবোট কিংবা স্টিমার যায়-এর ওপর তারা তীর মারে না? হঠাৎ যদি তীর ছুড়তে শুরু করে?
দাশগুপ্ত বলল, সেই জন্যই দেখবেন, একটু পরে-পরে পুলিশের ক্যাম্প বসানো আছে-পুলিশ ওদের সমুদ্রের ধারে আসতে দেয় না। ওদের দেখলেই গুলির আওয়াজ করে ভয় দেখায়। ওরা বন্দুককে খুব ভয় করে।
সন্তু বলল, ওদের বন্দুক নেই বুঝি?
বন্দুক কী বলছি, ওরা আগুন জ্বালাতেই জানে না! ওরা লোহার ছুরিও ব্যবহার করতে জানে না। ওদের যে তীর, তার ডগায় লোহা নেই, এমনিই সরু বাঁশের তীর-কিন্তু সেগুলোতে সাঙ্ঘাতিক বিষ মাখানো থাকে। অনেক সময় সমুদ্রতে শিশি বোতল ভেসে-ভেসে আসে তো, সেই বোতল ভেঙে ওরা কাচের ছুরি বানায়। কিংবা ঝিনুক বা পাথরের ছুরিও আছে। তবে শুনেছি, ওরা মাঝে মাঝে এদিকে এসে লোহা চুরি করারও চেষ্টা করে। সেই লোহা ঘষে ঘষে ধারালো অস্ত্ৰ বানাচ্ছে।
কাকাবাবু খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, জারোয়ারা যেখানে থাকে, সেখানে কোনও সভ্য মানুষ ঢোকেনি এ পর্যন্ত?
কার বুকের এত পাটা আছে বলুন? ওখানে ঢুকলে কেউ প্ৰাণ নিয়ে বেরুতে পারে না। চলুন না, একটু দূরে একটা জায়গা আপনাকে দেখাচ্ছি।
তাহলে একথা মনে করা যেতে পারে যে, যে-সব বৈজ্ঞানিক আগে নিরুদেশ হয়ে গেছে, তারা এ-জায়গাতেই যাবার চেষ্টা করেছিল?
তা হতে পারে এখানে যে সাহেবদের দেখেছিলাম, তারাও তো এখানে আসবার চেষ্টা করতে পারে। কারণ তাদের কাছে নিশ্চয়ই বন্দুক-পিস্তল আছে!
সেটা কিন্তু বলা শক্ত। মাত্র দু-তিনজন সাহেব বন্দুক পিস্তল নিয়েও এখানে এসে কী করবে? পাঁচ-ছাঁশো হিংস্ৰ জারোয়া যদি তাদের ঘিরে ধরে-
এই দ্বীপের উল্টো দিকেও তো সমুদ্র, সেখানে যাওয়া যায় না?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যায়। তবে সেদিকে পুলিশ-পাহারা নেই। জারোয়ারা একেবারে তীরের কাছে যখন-তখন চলে আসে-
আমি সেদিকে একবার যেতে চাই।
দাশগুপ্ত আবার অবাক হয়ে বলল, এখন?
কাকাবাবুজোর দিয়ে বললেন, কেন, এখন যাওয়া যায় না?
তাহলে স্যার বড দেরি হয়ে যাবে যে? আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে?
খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হবার কিছু নেই।
তা হলেও-মানে, এই বোটের শুধু এদিক দিয়ে যাওয়ারই পুলিশ-পারমিশান আছে। অন্য দিক দিয়ে যাবার জন্য আবার আলাদা করে অনুমতি নিতে হবে। চলুন না। দেখি যদি রঙ্গত্ব থেকে সেই অনুমতি জোগাড় করা যায়। ফেরার পথে না হয়-
দাশগুপ্ত আর একটু থেমে কাচুমাচুভাবে বলল, একটা কথা স্যার, ঐ জারোয়াদের মধ্যে যাবেন না! আপনি যে রহস্যের কথা বলছিলেন, তা কি শুধু ঐ জায়গাতেই আছে? তাহলে সে রহস্য যেমন আছে, থাক না! কেন শুধু শুধু প্ৰাণটা দিতে যাবেন।
কাকাবাবু বললেন, সব মানুষ তো এক রকম হয় না? কেউ কেউ ভাবে, সব যেমন চলছে তেমন চলুক। পুরনো জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করার কী দরকার? আর কোনও-কোনও লোক একটা জিনিস একবার ধরলে তার শেষ না দেখে ছাড়ে না। এই রহস্যটা যদি আমি বুঝতে না পারি, তাহলে কোনওদিন আমার রাত্তিরে ঘুম হবে না।
কিন্তু স্যার, ওখানে গেলে যে আমাদের প্রাণটাও যাবে।
তোমাদের কারুর যাবার দরকার নেই।
তা কখনও হয়? গভর্নমেন্ট থেকে আমার ওপর হুকুম হয়েছে, সব সময় আপনার সঙ্গে-সঙ্গে থাকতে। আপনাকে সব রকম সাহায্য করতে।
তাহলে গভর্নমেণ্ট তো তোমাকে খুব বিপদে ফেলেছে দেখছি?
না স্যার, আমি তো আপনাকে সাহায্য করতেই চাই। আপনি তো এদিককার ব্যাপার সব জানেন না।
আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
ঐ যে বললাম, রঙ্গত্। এদিককার বেশ বড় জায়গা। আমি ওয়ারলেসে আমাদের আসবার কথা জানিয়ে দিয়েছি। জেটিতে জিপগাড়ি রাখা থাকবে। ওখানে খুব সুন্দর ডাকবাংলো আছে, পাহাড়ের ওপরে—
সেখানে পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে?
তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাব। রঙ্গত্ থেকে আরও অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। আপনি যদি চান, আমরা মায়াবন্দরের দিকেও যেতে পারি। আমরা কী মনে হয় জানেন? ঐ সাহেবগুলো মায়াবন্দরে থাকতে পারে!
কেন?
মায়াবন্দর খুব সুন্দর জায়গা। সাহেব-মেমরা খুব পছন্দ করে।
সে তো যারা বেড়াতে আসে! এই সাহেবরা এখানে বেড়াতে এসেছে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। তাহলে তারা এত লুকোচুরি করত না।
একটুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। মোটরবোটের গুটিগুটি শব্দ শুধু শোনা যায়। খাঁড়ির সমুদ্রে ঢেউ বেশি নেই। দুপাশেই দেয়ালের মতন জঙ্গল।
সন্তু কুমির দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এক সময় সত্যিই দেখা পেল। দুটো কুমির বালির ওপর শুয়ে ছিল। ঠিক যেন দুটো পোড়া কাঠ। বোটের শব্দ শুনে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর খুব একটা ভয় না-পেয়ে আস্তে আস্তে জলে নামল।
সন্তু বলল, ঐ যে! ঐ যে কুমির!
দাশগুপ্ত একটু অবহেলার সঙ্গে বলল, এ দুটো তেমন বড় নয়! আরও বড় আছে। এইটাই কিন্তু সেই জায়গা
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কোন জায়গা?
সেই যে বলেছিলাম দেখাব! এ জায়গাটার বালির রঙ দেখছি কেমন সোনালী সোনালী? অরুণ্যদেবের গল্পে সোনা-বেলার কথা পড়েছ তো?
এই সেই সোনা-বেলা নাকি? তাহলে সেই জেড পাথরের ঘর কোথায়?
না, এটা সোনা-বেলা নয়। তবে এখানকার বালি খুব মিহি আর সোনালী রঙের। অনেকের ধারণা ওখানে বালির মধ্যে সোনা মিশে আছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি সোনা আছে?
না, না। গভর্নমেণ্ট থেকে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, সে রকম কিছু নেই। তবু লোকের লোভ হয়। ওদিকে তো যাওয়া নিষেধ-তাও একদিন রাত্তির বেলা তিনজন লোক ওদিকে বালি নেবার জন্য নেমেছিল। তিনটে বস্তায় বালি ভরেছে, এমন সময় পেছন থেকে জারোয়ারা আক্রমণ করে! দুটো ছেলেকে তক্ষুনি মেরে ফেলে–আর একটি ছেলে একজন জারোয়ার পেটে ছুরি মেরে নিজেকে কোনও রকমে ছাড়িয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জারোয়ারা সাঁতার জানে না-তাই জলে নামে না। সেই ছেলেটিও আহত হয়েছিল, সেই অবস্থায় সমুদ্রে ভাসতে থাকে। তার ভাগ্য ভাল, তাকে হাঙরে কুমিরে ধরেনি-বারো ঘণ্টা বাদে ছেলেটিকে একটা পুলিশের বোট উদ্ধার করে। তারপর তার পাগলের মতন অবস্থা। তারপর থেকে সে অনবরত চেঁচিয়ে বলে, জারোয়া! ঐ যে জারোয়া।
গল্প বলার সময় ঝোঁকের মাথায় দাঁড়িয়ে উঠে নিজেই সেই ছেলেটিকে নকল করে বলতে থাকে, জারোয়া! ঐ যে জারোয়া!
সন্তু হাঁ করে ঘটনাটা শুনছিল। কিন্তু কাকাবাবু হঠাৎ দাশগুপ্তকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেই ছেলেটিকে কখনও দেখেছি? নিজের চোখে?
দাশগুপ্ত থতমত খেয়ে বলল, তা দেখিনি। তবে সবাই এটা জানে!
কাকাবাবু বললেন, গল্প! এসব বানানো গল্প!
না স্যার, আপনি রঙ্গতে গিয়ে যাকে খুশি জিজ্ঞেস করবেন।
আমি লক্ষ করেছি তুমি বড় গল্প বানাও।
দাশগুপ্ত এর পর একেবারেই চুপ করে গেল।
তিনটের সময় বোট এসে ভিড়ল। রঙ্গতে। জেটি থেকে উঠে এসে বাইরের রাস্তায় দেখা গেল সত্যি একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। আরও আট-ন মাইল যেতে হবে।
সন্তু গিয়ে জিপে উঠে বসেছে। কাকাবাবুজিপে উঠতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললেন, আমার চশমাটা বোটে ফেলে এসেছি।
দাশগুপ্ত বলল, আমি নিয়ে আসছি।
না, আমিই আনছি।
কাকাবাবু ক্রাচ খট-খাট করে নিজেই এগিয়ে গেলেন জেটির দিকে।
তারপর একটু বাদে মোটরবোটটার ইঞ্জিনের ঘট্ঘট্ আওয়াজ শোনা গেল।
দাশগুপ্ত চেঁচিয়ে উঠল, আরো বোটটা ছেড়ে গেল যে! কাকাবাবু গেলেন কোথায়?
সন্তু তাড়াতাড়ি ছুটে এল জেটির কাছে। মোটরবোটটা সাঁ করে জল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দাশগুপ্ত তার পাশে এসে বলল, সর্বনাশের ব্যাপার! মোটরবোটটা আপনা-আপনি চলতে লাগল নাকি? তাহলে কি হবে? শঙ্করনারায়ণ, শঙ্করনারায়ণ?
বোটের চালক শঙ্করনারায়ণও বোটটার দিকে তাকিয়ে দেখছে। লোকটি খুব কম কথা বলে। এবার সে বলল, বোট কখনও আপনা-আপনি চলে। ওটা তো। উনি চালাচ্ছেন।
দাশগুপ্তর চোখ ট্যারা আর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সে ভয়-পাওয়া গলায় নললে, উনি নিজে বোট চালাচ্ছেন? তাহলে উনি নিশ্চয় একলা-একলা জাগোয়াদের কাছে যেতে চান। উঃ, কী গোঁয়ার লোক রে বাবা! জারোয়ারা dকে মেরে ফেলবেই। আমি গভর্নমেন্টকে কী জনাব?
মোটরবোটটা এখনও দেখা যাচ্ছে। সন্তু চিৎকার করে ডেকে উঠল, কাকাবাবু! কাকাবাবু!
দাশগুপ্তও চ্যাঁচাল, মিঃ রায়চৌধুরী।
শঙ্করনারায়ণ গম্ভীরভাবে বলল, উনি বেশি দূর যেতে পারবেন না। বোটে ডিজেল নেই। আমি এখান থেকে ডিজেল নেব ঠিক করেছিলাম।
দাশগুপ্ত বলল, অ্যাঁ? ডিজেল নেই? থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ শঙ্করনারায়ণ! ৩বে তো উনি আর জারোয়াদের জঙ্গলে যেতে পারবেন না?
মোটরবোটটা কিন্তু ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সন্তু ভাবল, মোটরবোটটার ডিজেল যদি ফুরিয়ে যায়, তাহলে কাকাবাবু মোঝ-সমুদ্রে এক-একা ভাসবেন? বোটে তো খাবার-দাবার কিছু নেই!
দাশগুপ্ত বলল, উঃ, কী ডানপিটে লোক বাবা! তাও তো একটা পা অচল। দুটো পা থাকলে আরও কী করতেন কে জানে। আচ্ছা, সন্তু, ওঁর একটা পা কাটল কী করে?
আফগানিস্তানে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।
ওরে বাবা, উনি আফগানিস্তানেও গিয়েছিলেন?
শঙ্করনারায়ণ জেটির সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গিয়ে বালির চড়া ধরে দৌড়তে লাগল। দুরে এক জায়গায় কয়েকটা মোটরবোট রয়েছে। ওর মধ্যে কোনওটা মাছ ধরার, কোনওটা মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার। একটু বাদেই শঙ্করনারায়ণ একটা বোট চালিয়ে নিয়ে এল জেটির পাশে। তারপর বলল, আপনারা একজন কেউ আসুন।
দাশগুপ্ত বলল, আমি যাচ্ছি। তুমি একটু থাকো, সন্তু।
সন্তু সে কথা শুনল না। সে লাফিয়ে গিয়ে মোটরবোটে উঠল।
শঙ্করনারায়ণ এত জোরে বোটটা চালিয়ে দিল যে, ওরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল আর-একটু হলে। সবাই শক্ত করে ধরে রাখল রেলিং।
একটু বাদেই আগের মোটরবোটটা দেখা গেল। সেটা এদিক-ওদিক এঁকে-বেঁকে যাচ্ছে। কাকাবাবু ভাল চালাতে পারছেন না। দাশগুপ্ত এদিক থেকে আবার চ্যাঁচাতে লাগল, মিঃ রায়চৌধুরী, মিঃ রায়চৌধুরী!
খানিকক্ষণ দুই বোটে পাল্লা চলল। কাকাবাবু থামতে চান না। তারপর হঠাৎ এক সময় কাকাবাবুর বোটটা থেমে গেল। মোটরবোট যখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলে, তখন তার একটা বেশ তেজী ভাব থাকে। থেমে গেলেই কী রকম যেন অসহায় দেখায়। ঠিক যেন একটা মোচার খোলা।
শঙ্করনারায়ণ প্ৰথমে এই বোটটা নিয়ে কাকাবাবুর বোটের চারপাশে বোঁ বো করে ঘুরুল কয়েকবার। তারপর একবার কাছাকাছি এসে একটা দড়ি নিয়ে ঐ বোটে লাফিয়ে পড়ল।
পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েও কাকাবাবুর কিন্তু লজ্জা নেই। বরং মুখে একটা রাগ-রাগ ভাব। কেউ কিছু বলার আগেই তিনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এই বোটটা হঠাৎ আপনা-আপনি থেমে গেল কেন?
শঙ্করনারায়ণ বলল, তেল নেই আর!
কাকাবাবু তাকে ধমক দিয়ে বললেন, কেন, তেল থাকে না কেন?
দাশগুপ্ত বলল, স্যার, আপনি এটা কী করছিলেন? এ-রকম পাগলামি করার কোনও মানে হয়? ওদিকে রঙ্গতে সবাই আমাদের জন্য খাবার-দাবার নিয়ে বসে আছে।
কাকাবাবু বললেন, আমি এখানে খেতে আসিনি। একটা কাজ করতে এসেছি।
কিন্তু কাজ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! কাজ মানে তো ঐ সাহেবগুলোকে খোঁজা? ওরা আর যাবে কোথায়?
আমি একটুও সময় নষ্ট করতে চাই না।
কিন্তু স্যার, আপনাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি। আপনি ঐ জারোয়া-ল্যাণ্ডে যেতে পারবেন না। অর্ডার ছাড়া আমি কিছুতেই আপনাকে ওখানে যেতে দিতে পারি না।
অর্ডারটা দেবে কে?
পুলিশের এস পি সাহেবের কাছ থেকে অর্ডার আনতে হবে। তাও তিনি পারমিশান দেবেন কিনা সন্দেহ। কয়েকজন সাহেব ছবি তোলবার জন্য এসেছিল, তাও দেওয়া হয়নি।
কাকাবাবু আর কোনও কথা না-বলে এই বোটে উঠে এলেন। ঐ বোটটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল, তারপর দুটোই চলল একসঙ্গে।
তারপর জেটিতে পৌঁছে ওরা বোট থেকে নেমে জিপে উঠলেন, বেশ চওড়া বাঁধানো রাস্তা, দুপাশে বড় বড় গাছ, কিন্তু মানুষজন বা বাড়িঘর বিশেষ দেখাই যায় না। এটাও একটা দ্বীপের মধ্যে, কিন্তু দু পাশের ঘন জঙ্গল দেখে সে-কথা আর মনে থাকে না।