Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সবুজ দ্বীপের রাজা || Sunil Gangopadhyay » Page 10

সবুজ দ্বীপের রাজা || Sunil Gangopadhyay

এদিকে তখন বনের মধ্যে কী হচ্ছে?

হঠাৎ গুলির শব্দ। তারপরেই কাকাবাবু একটামাত্র ক্রাচ নিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে চলে এলেন সেই আগুনের কাছে। তাঁর রিভলভার সোজা সেই বুড়ো রাজার বুকের দিকে তাক করা।

জারোয়ারা প্ৰথমে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি। তারপর কাকাবাবুকে দেখে সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।

কাকাবাবু বুড়ো রাজাকে আবার ইংরেজিতে বললেন, আপনার লোকদের বলুন, কেউ যেন আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা না করে! কেউ আমার কাছে এলেই আমি তার আগে আপনাকে গুলি করে মেরে ফেলব।

বুড়ো রাজা কিন্তু একটুও ভয় পাননি। তার পাকা ভুরুর নীচে চোখ দুটি ঘোলাটে। একদৃষ্টি তিনি কাকাবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর দুটো হাত তুললেন মাথার ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে জারোয়ারা থেমে গেল।

বুড়ো রাজা কাকাবাবুকে স্পষ্ট ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? কাকাবাবু বললেন, তার আগে বলুন, আপনি কে? আপনি জারোয়া নন, তা বুঝতেই পারা যায়। আপনি সভ্য মানুষ। আপনি কেন সাহেবগুলোকে পুড়িয়ে মারছেন?

বুড়ো রাজা মাটিতে চিক করে থুতু ফেললেন। তারপর হাসলেন। সেই রকম একদৃষ্টিতে কাকাবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, তুমি আমাকে গুলি করলেও নিজে বাঁচতে পারবে না। তোমাকে এরা শেষ করে ফেলবে। তুমি এখানে কেন এসেছ?

কাকাবাবু ডান দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, এই আগুনটা দেখতে। এই সাহেবগুলোও সেইজন্যেই এসেছে।

বুড়ো রাজা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওদের সঙ্গে এসেছ?

কাকাবাবু বললেন, না। কিন্তু আপনি এই অসভ্যদের সঙ্গে থেকে কি অসভ্য হয়ে গেছেন? জ্যান্ত মানুষদের পুড়িয়ে মারছেন?

বুড়ো রাজা বললেন, তোমাকে কে বলেছে, এই জারোয়ারা অসভ্য? আর এই সাহেবরা কিংবা তোমরা সভ্য? তোমাদের আমি ঘৃণা করি!

এদের ছেড়ে দিন!

এবার বুড়ো রাজা বুকে ঝুঁকে এগিয়ে আসতে লাগলেন কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবুর হাত কাঁপছে। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, খবর্দার, আমার কাছে আসবেন না, আমি গুলি করব, ঠিক গুলি করব!

বুড়ো রাজা কোনও কথা না বলে হাসিমুখে তবু এগিয়ে আসতে লাগলেন।

কাকাবাবু বললেন, আমি গুলি করব কিন্তু! আমার রিভলভার কেড়ে নেবার চেষ্টা করবেন না, তার আগেই আমি গুলি করব।

বুড়ো রাজা একেবারে কাকাবাবুর মুখের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর কাকাবাবুর চোখের দিকে চেয়ে থেকে বাংলায় বললেন, তোমরা এই আগুনটা দেখতে এসেছ? এই আগুনটা বুঝি এত দামি? ঠিক আছে, তোমাদের সবাইকে আমি এই আগুনের মধ্যে পাঠিয়ে দেব।

দূরে, গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সন্তু শুনতে পেল, বুড়ো রাজা স্পষ্ট বাংলায় কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এই আগুনটা দেখতে এসেছ?

সন্তু তার নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না।

কাকাবাবু দারুণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বাঙালি?

বুড়ো রাজা সে-কথার উত্তর না দিয়ে কাকাবাবুর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিতে গেলেন।

কাকাবাবু বললেন, খবদার, আর এগোবেন না, আমি গুলি করব! ঠিক গুলি করব।

বুড়ো রাজা মাথার ওপর দুহাত তুলে বললেন, করো গুলি করো, দেখি তোমার কত সাহস?

কাকাবাবু গুলি করতে পারলেন না। তাঁর হাত কাঁপছে। তিনি বললেন, আমি আপনাকে মারতে চাই না। আমি জানতে চাই, আপনি কে?

বুড়ো রাজা কাকাবাবুর ডান হাতে জোরে একটা ধাক্কা মারতেই রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল একটু দূরে। কাকাবাবু আবার সেটা কুড়িয়ে নেবার জন্য কুঁকতেই পড়ে গেলেন হুমড়ি খেয়ে। কাকাবাবুর যে একটা পা নেই, সেটা তাঁর মনে থাকে না। সব সময়। কাকাবাবু পড়ে যেতেই বুড়ো রাজা তাঁর পিঠের ওপর একটা পা রেখে দাঁড়ালেন।

সমস্ত জারোয়ারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। তারা দেখল তাদের বুড়ো রাজা রিভলভারকেও ভয় পান না। কাকাবাবু জোর করে ওঠবার চেষ্টা করতে যেতেই দুজন জারোয়া ছুটে এসে তাঁকে চেপে ধরল।

হাত-পা বাঁধা সাহেবগুলোও ভয়ের শব্দ করে উঠল।

দূরে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে সন্তু সব দেখল। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এবার ওরা কাকাবাবুকে মেরে ফেলবে? সন্তু একা কী করে তাঁকে বাঁচাবে? এখনও সন্তুকে কেউ দেখতে পায়নি।

বুড়ো রাজা চিক করে মাটিতে থুতু ফেললেন। তারপর খুব কড়া গলায় কাকাবাবুকে বললেন, তোমাদের সবকটাকে আমি এক্ষুনি যমের বাড়ি পাঠাব! আমরা জারোয়ারা এখানে জঙ্গলের মধ্যে আপন মনে থাকি। আমরা কারুর কোনও ক্ষতি করি না। তোমরা কেন আমাদের বিরক্ত করতে আসো?

কাকাবাবু বললেন, আপনি জারোয়া নন। আপনি কে?

বুড়ো রাজা বললেন, আমি এক সময় বাঙালি ছিলাম। এখন আমি এদেরই একজন। আমি আর তোমাদের মতন পরাধীন নই। আমি স্বাধীন।

কাকাবাবু বললেন, আমার কষ্ট হচ্ছে, আমাকে উঠে দাঁড়াতে দিন।

বুড়ে রাজা বললেন, তোমার সব কষ্ট এক্ষুনি শেষ কবে দেব। তোমরা এই আগুনটা দেখতে এসেছিলে না? এই আগুনের মধ্যেই তোমরা যাবে। যত সব চোরের দল!

কাকাবাবু বললেন, আমি কিছু চুরি করতে আসিনি। আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম।

মিথ্যে কথা! যে-পাথরটা থেকে এই আগুন বেরুচ্ছে, তোমরা আসো সেই পাথরটা চুরি করতে। এর আগেও কয়েকটা সাহেব এসেছিল, সব কটাকে আমি যমের বাড়ি পাঠিয়েছি। তুমি বাঙালি হয়েও এই সাহেবদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছি। সাহেবের পা-চাটা! পরাধীন দেশের মানুষেরাই এরকম কাপুরুষ হয়ে যায়!

আমি ওদের সঙ্গে আসিনি। আমি ওদের পথ দেখিয়ে আনিনি।

চুপ। মিথ্যুক! কুকুর!

বুড়ো রাজা কাকাবাবুকে আর কোনও কথা বলতে দিলেন না। জারোয়াদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা কাকাবাবুকে টেনে তুলল। এবার বুঝি আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেবে!

সন্তু আর থাকতে পারল না। তার যা হয় হোক। কাকাবাবু যদি মরে যান, তাহলে সে-ও মরবে!

সে কাকাবাবু বলে চিৎকার করে তীরের মতন ছুটে এল। কোনও জারোয়া তাকে ধরতে পারল না, তার আগেই সে দৌড়ে কাকাবাবুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

সন্তুকে দেখে কাকাবাবুও খুব অবাক হয়ে গেছেন। আস্তে আস্তে বললেন, তুই চলে যাসনি? তোকে যে আমি বললাম।

বুড়ে রাজা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সন্তুর দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটি কে?

কাকাবাবু বললেন, এ আমার ভাইপো। আপনি আমাকে মারতে চান মারুন, কিন্তু ওকে ছেড়ে দিন।

এইটুকু ছেলেকেও সাহেবদের চাকরের কাজে লাগিয়েছ?

সন্তু বলল, বিশ্বাস করুন, আমরা ঐ সাহেবদের সঙ্গে আসিনি। আমরা আলাদা এসেছি। ঐ সাহেবরা আমাদেরও মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

বুড়ো রাজা সন্তুকে বললেন, আমার কাছে এসো!

বুড়ো রাজার চোখের দিকে তাকালেই ভয় করে। তবু সন্তু এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল। বুড়ো রাজা একটা হাত বাড়িয়ে সন্তুর গালটা ছুঁলেন।

রাজার গায়ের সব চামড়া কুঁচকে গেছে। লম্বা লম্বা শুকনো আঙুলের ছোঁয়ায় সন্তুর গাটা একবার শিরশির করে উঠল।

রাজা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। তাঁর মুখে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব ফুটে উঠল। তিনি আপনমনে বললেন, আমার ঠিক এই বয়েসী একটা ভাই ছিল। জানি না। সে এখনও বেঁচে আছে কি না।

তারপর তিনি মুখ নামিয়ে সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

সুনন্দ রায়চৌধুরী। আমার কাকাবাবু একজন খুব পণ্ডিত লোক। উনি মোটেই চোর নন।

অনেক পণ্ডিতও চোর হয়। টাকা-পয়সার লোভে তারাও সাহেবদের পা চাটে।

আমার কাকাবাবু মোটেই সেরকম লোক নন। তাহলে সাহেবদের বাঁচাবার জন্য ওর এত দরদ কেন?

এবার কাকাবাবু বললেন, কোনও মানুষকেই মেরে ফেলা আমি পছন্দ করি না। এই সাহেবদের অন্য শান্তি দেওয়া যেতে পারে, মেরে ফেলা উচিত নয়।

ওরা আমার অন্তত পনেরোজন জারোয়াকে মেরে ফেলেছে। কেন? জারোয়ারা ওদের কোনও ক্ষতি করেছিলা? জারোয়ারা এখানে শান্তভাবে থাকে-তারা তো অন্য কোনও জায়গায় গিয়ে অন্যদের মারতে যায় না।

সাহেবরা অন্যায় করেছে ঠিকই। সেজন্য তাদের বিচার করে শাস্তি দিতে হবে। আপনি সভ্যজগতের মানুষ।

চুপ! তোমাদের সভ্যতাকে আমি ঘৃণা করি!

কাকাবাবুকে তখনও দুজন জারোয়া চেপে ধরে আছে। আগুনটা এখান থেকে খুব কাছে। গায়ে আঁচ লাগছে। কিন্তু ঐ আগুনের কতরকম রঙ। দেখতে খুব সুন্দর লাগে।

হঠাৎ বিরবির করে বৃষ্টি নামল। এরকমভাবে যখন-তখনই বৃষ্টি নামে এখানে। সন্তু ভাবল, বৃষ্টিতে কি আগুনটা নিভে যাবে? কিন্তু সে একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখল। বৃষ্টির জল, সেই আগুনের মধ্যে পড়তেই পারছে না। ছাঁত ছাতি শব্দে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছোট ছোট আগুনের ফুলকি হয়ে যাচ্ছে। যেন সেই আগুনের শিখার ওপর অসংখ্য জোনাকি। এরকম দৃশ্য সন্তু কখনও দেখেনি।

কাকাবাবু বিড়বিড় করে বললেন, এটা পৃথিবীর আগুন হতেই পারে না। এই আগুন অন্য কোনও জায়গা থেকে এসেছে।

বুড়ো রাজা বললেন, এই আগুন জ্বলছে বহু বছর ধরে। কখনও নিভবে না।

বৃষ্টি আরও জোরে এল। বুড়ো রাজা জারোয়াদের কিছু একটা হুকুম করে পেছন ফিরে চলতে লাগলেন। জারোয়ারা সন্তু আর কাকাবাবুকে ধরে রেখে তাঁর সঙ্গে চলল। রাজা একটা কুঁড়েঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন, জারোয়ারা সন্তু আর কাকাবাবুকে তার মধ্যে ঠেলে দিল।

ঘরটার মধ্যে প্রায় কিছুই জিনিসপত্র নেই। মাটিতে ছড়ানো রয়েছে একগাদা শুকনো পাতা, তার ওপর দুটো হরিণের শুকনো চামড়া। একটা আস্ত গাছ উঠে গেছে। ঘরের এক কোণ দিয়ে। সেই গাছের ডালে একটা বাঁশের চোঙা ঝোলানো। তাতে জল ভর্তি। বুড়ে রাজা সেটা নিয়ে ঢাক ঢক করে জল খেলেন খানিকটা। তারপর কাকাবাবুদের বললেন, বসো।

বসবার পর আর দুটো জিনিসের দিকে চোখ পড়ল ওদের। ঘরের এক পাশে এক টুকরো লাল কাপড়ের ওপর রাখা আছে একটা বই। বইটার মলাটের ওপর লেখা আছে গীতা। আর তার পাশে একটা লোহার হাতকড়া। পুলিশরা চোর ডাকাতের হাতে যে-রকম হাতকড়া পরিয়ে দেয়।

ওরা দুজনেই সেই দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বুড়ো রাজা বললেন, ঐ দুটো আমার পুরনো কালের স্মৃতি। আর কিছুই নেই। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বয়েস কত? বুড়ো রাজা বললেন, হিসেব রাখি না। কী দরকার বয়েসের হিসেবে? আশি-নব্বই হতে পারে, একশোও হতে পারে। জানি না। কতদিন আগে এসেছি।

কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, আমি বোধহয় আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনার নাম কি গুণদা তালুকদার?

কী বললে?

আপনি নিশ্চয়ই গুণদা তালুকদার?

কে গুণদা তালুকদার? তুমি তার কথা কী করে জানলে?

আমি আন্দামানে আসবার আগে, এখানকার সম্পর্কে যত কিছু বইপত্র আছে, তা সব পড়ে ফেলেছি। বহু বছর আগে আন্দামান জেল থেকে গুণদা তালুকদার নামে একজন বিপ্লবী পালিয়েছিলেন। ঐ জেল থেকে মাত্র ঐ একজনই পালিয়েছেন। কিন্তু ধরা পড়েননি। সবাই তখন ভেবেছিল, গুণদা তালুকদার সমুদ্রে ড়ুবে মারা গেছেন। আজ এই হাতকড়াটা দেখেই হঠাৎ মনে হল…

বুড়ো রাজা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, এসব কথা বইতে লেখা আছে? গুণদা তালুকদারকে এখনও লোকে মনে রেখেছে?

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই! আপনার ছবি ছাপা হয়েছে কত বইতে। অবশ্য সে-ছবি দেখে এখন আপনাকে চেনা যায় না। আপনার জন্মদিনে উৎসব হয় অনেক জায়গায়। নেতাজীকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি, তেমনি আপনাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেশের লোক আপনাকে শ্রদ্ধা করে।

নেতাজী কে?

সে কী, আপনি নেতাজীর নাম শোনেননি? সুভাষচন্দ্ৰ বসু, আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে যিনি যুদ্ধ করেছিলেন ব্রিটিশের সঙ্গে?

সুভাষবাবু? তিনি যুদ্ধ করেছেন? কবে?

আপনি এসব কিছুই জানেন না? না। আমার নাম লোকে মনে রেখেছে? তার মানে পুলিশ এখনও আমার খোঁজ করে?

পুলিশ? আপনাকে খুঁজবে কেন? ও সেই জন্যই আপনি আমাদের পরাধীন দেশের মানুষ বলছিলেন? আমাদের দেশ তো বহুদিন আগে স্বাধীন হয়ে গেছে। এই যে সন্তু, ও তো স্বাধীন দেশে জন্মেছে। ভারত এখন পৃথিবীর একটি প্রধান দেশ।

স্বাধীন হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। আপনি দেশের জন্য কত লড়াই করেছেন, জেল খেটেছেন, আর সেই খবরটা রাখেন না?

আমি গত পঞ্চাশ-যাট বছর ধরে বাইরের কোনও লোকের সঙ্গে কথাই বলিনি।

আপনার কথা জানতে পারলে সবাই দারুণ খুশি হবে। সারা দেশ আপনাকে নিয়ে উৎসব করবে।

আমি আর কোথাও যাব না। আমি এইখানে খুব ভাল আছি।

আপনি এখানে এলেন কী করে? জারোয়ারা আপনাকে রাজা করে নিল?

আমি একটা ছোট ভেলা নিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়েছিলাম। ঝড়ে সেই ভেলা উল্টে গেল। আমি মরেই যেতম। অজ্ঞান অবস্থায় ভাসতে ভাসতে এই দ্বীপে এসে ঠেকেছিলাম। আমাকে এরা মারেনি কেন জানি না। তখনও আমার এক হাতে হাতকড়া ঝুলছিল। এরা মোটেই হিংস্র নয়। এদের যদি কেউ বিরক্ত না করে, এরা কখনও অন্য মানুষকে মারে না। এরা আমাকে খাইয়ে দাইয়ে সুস্থ করে তুলেছিল। সে কতকাল আগের কথা!

কিন্তু আপনি তো এদের সভ্য করে তুলতে পারতেন!

চুপ, ও কথা বলো না! সভ্য মানে কী? তোমরা সভ্য আর এরা অসভ্য? এখানে কেউ চুরি করে না, মিথ্যে কথা বলে না। এখানে সবাই খাবার একসঙ্গে ভাগ করে খায়। এখানে কোনও রোগ নেই। এর থেকে বেশি সুখ মানুষ আর কী চায়? আমিই এদের বারণ করেছি তোমাদের মতন সভ্য লোকদের সঙ্গে মিশতে তোমরা এদের নষ্ট করে দেবে।

আপনার মতন একজন মানুষ এখানে এইভাবে লুকিয়ে আছেন, একথা আমার কাছে শুনলেও কেউ বিশ্বাস করবে না।

তোমরা কেন এই জারোয়াদের ওপর অত্যাচার করতে আসো?

আমি বন্ধুত্ব করতে এসেছি।

তোমারও ঐ পাথরটার ওপর লোভ আছে নিশ্চয়ই?

কোন পাথরটা?

যেটা দিয়ে আগুন জ্বলে।

ওটার কথা আমি জানতামই না। তবে আন্দাজ করেছিলাম, এরকম একটা মহা-মূল্যবান জিনিস এখানে আছে। সাহেবরা আগেই টের পেয়েছে নিশ্চয়ই।

ওটা কী তুমি বুঝতে পেরেছ?

নিশ্চয়ই ওটা কোনও উল্কা। কিংবা অন্য কোনও গ্রহের ভাঙা টুকরো। পৃথিবীতে এরকম কিছু কিছু মাঝে-মাঝে এসে পড়ে। অনেকগুলো আসার পথেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু এটা বহু বছর ধরে জ্বলছে। এটার মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কোনও ধাতু আছে, যা আমাদের পৃথিবীতে নেই। সে রকম নতুন ধাতুর আবিষ্কার হলে তার সাঙ্ঘাতিক দাম হবে। পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে যাবে।

জারোয়ারা আগুন জ্বালাতে পারে না। এই আগুন থেকেই তারা সব কাজ চালায়। সেই আগুন চুরি করতে চায় কেন সভ্য মানুষ?

তা বলে একটা নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হবে না? এর বদলে ওদের আমরা হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ দেশলাই দিতে পারি।

না, এটা প্রকৃতির দান ওরা তাই নিয়েছে। ওরা সভ্য মানুষদের কাছ থেকে কিছুই চায় না। তোমাদের আমি ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে, তোমরা এই আগুনের কথা কখনও কারুকে বলতে পারবে না।

কিন্তু আমরা আপনাকেও নিয়ে যেতে চাই।

আমাকে?

দেশ স্বাধীন হয়েছে, আপনি একবার দেখতে আসবেন না? একবার দিল্লিতে আর কলকাতায় চলুন। দেখবেন, কত কী বদলে গেছে।

না, আমি যাব না।

এই সময় বাইরে হঠাৎ দারুশ একটা গোলমাল শোনা গেল। ডিসুম ডিসুম করে শব্দ হল বন্দুকের গুলির।

ওরা তিনজনই চমকে উঠল।

বুড়ো রাজা উঠে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়ালেন। তারপর বাইরে একবার তাকিয়েই কাকাবাবুর দিকে মুখ ফেরালেন। আস্তে আস্তে বললেন, তোমার জন্যই এবার আমাদের সর্বনাশ হল!

সন্তুও লাফিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দরজার পাশে। সে দেখল, সেই সাহেবগুলো হাতের বাঁধন খুলে ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। তিন-চারজনের হাতে বন্দুক, এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে চারদিকে।

বুড়ো রাজা বললেন, এবার ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে।

কাকাবাবু বললেন, আপনি ঘরের মধ্যে ঢুকে আসুন। বাইরে যাবেন না।

বুড়ো রাজা বললেন, ঘরের মধ্যে ঢুকলেও বাঁচা যাবে না। ওদের কাছে লাইট মেশিনগান আছে। ওরা আমার লোকজনকে মারছে।

সত্যিই তাই। কয়েকজন জারোয়া প্ৰাণের ভয় না করে সাহেবদের দিকে তাড়া করে আসছিল, সাহেবরা কটু কটু কটু কটু করে গুলি চালাল, সঙ্গে সঙ্গে তারা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। জারোয়াদের বিষাক্ত তীর দুজন সাহেবের গায়ে লাগল, কিন্তু তাতে তাদের কিছুই হল না। সাহেবরা আগেই বিষ প্ৰতিষেধক ইঞ্জেকশন নিয়ে নিয়েছে।

কাকাবাবুকে ঠেলে বুড়ো রাজা বেরিয়ে গেলেন ঘরের বাইরে। দুহাত উঁচু করে ইংরেজিতে চেঁচিয়ে বললেন, হোন্ড অন।

সঙ্গে সঙ্গে একজন সাহেব হিংস্রভাবে ঘুরে দাঁড়াল সেই দিকে। তার হাতে একটা বেঁটে আর মোটা ধরনের বন্দুক। সন্তু বুঝল, ওটারই নাম বোধহয় লাইট মেশিনগান।

সন্তুর মনে হল, সাহেবটি এক্ষুনি বুড়ো রাজাকে মেরে ফেলবে।

কিন্তু বুড়ো রাজার দারুণ সাহস। তবু তিনি লাঠি ঠুকতে ঠুকতে একপা একপা করে এগিয়ে গেলেন সাহেবদের দিকে। তারপর ইংরিজিতে বললেন, তোমরা আমার লোকদের শুধু শুধু মেরো না। তোমরা যা চাও, তাই নিয়ে যাও।

তিনি জারোয়াদের দিকে তাকিয়ে কী একটা অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করলেন। অমনি তারা সার বেঁধে পেছিয়ে যেতে লাগল। সেইসঙ্গে মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করতে লাগল। সেই শব্দটা ঠিক কান্নার মতন।

আর-একজন সাহেব এগিয়ে এসে খুব নিষ্ঠুরভাবে প্রচণ্ড এক চড় কষাল বুড়ো রাজার গালে। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন হুমড়ি খেয়ে। সাহেবটা বুড়ো রাজার বুকের ওপর পা তুলে বলল, একে এক্ষুনি মেরে ফেলব! এই বুড়োটাই যত নষ্টের মূল। এর হুকুমেই আমাদের একজন বন্ধুকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এতক্ষণে আমাদেরও মেরে ফেলত।

মেশিনগান-হাতে সাহেবটি বলল, ওকে এক্ষুনি মেরো না, একটু পরে। ওর কাছ থেকে আরও কিছু খবর জানা যেতে পারে।

যে লতা দিয়ে সাহেবদের বাঁধা হয়েছিল, সেই লতা দিয়েই ওরা বেঁধে ফেলল বুড়ো রাজাকে।

সেই অবস্থাতেও বুড়ে রাজা বললেন, আমাকে মারার চেষ্টা কোরো না। তাহলে তোমরা একজনও বেঁচে ফিরতে পারবে না। এখান থেকে তোমরা যা চুরি করতে এসেছ, তাই নিয়ে ফিরে যাও!

একজন সাহেব বুড়ো রাজার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল।

সন্তু আর কাকাবাবু সেই কুঁড়ে ঘরের দরজার কাছে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। মাটিতে শুয়ে থাকলে হঠাৎ গায়ে গুলি লাগে না। বুড়ো রাজার এই দুৰ্দশা দেখে ওরা শিউরে উঠল।

কাকাবাবু আফশেস করে বললেন, ইস, আমার রিভলভারটা যদি এখন কাছে থাকত

সন্তু দেখল, খানিকটা দূরে মাটির ওপরে কাকাবাবুর রিভলভারটা পড়ে আছে। একজন সাহেবের পায়ের কাছে।

কিন্তু চারজন সাহেবের হাতে বন্দুক একজনের হাতে লাইট মেশিনগান, কাকাবাবু শুধু একটা রিভলভার নিয়ে কী করতেন?

একজন সাহেবের কাঁধে ঝোলানো আছে একটা ব্যােগ। সে সেটা খুলে ফেলল। তার মধ্য থেকে বেরুল অনেক কিছু। নানারকমের যন্ত্রপাতি আর একটা খুব মোটা ফিতের মতন জিনিস গোল পাকানো। সেটা খুলে ফেলতেই দেখা গেল, সেটা আসলে একটা বিরাট লম্বা ক্যাম্বিসের জলের পাইপ। তার একটা মুখ ধরে দুজন সাহেব ছুটে গেল অন্ধকারের মধ্যে।

একটু বাদেই সেই পাইপটা ফুলে উঠল আর তার অন্য মুখ দিয়ে জল বেরুতে লাগল। আর দুজন সাহেব সেটা নিয়ে গেল আগুনটার দিকে। কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, ওরা ঝনা থেকে জল আনছে। সন্তুও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, ওরা আগুন নেভাতে চাইছে কেন?

কাকাবাবু বললেন, যে পাথরটা থেকে ঐ আগুন বেরুচ্ছে, সেটার সাংঘাতিক দাম। কোটি কোটি টাকা। ওরা সেটা চুরি করতে এসেছে। ওটা নিশ্চয়ই অন্য কোনও গ্রহের টুকরো কিংবা উল্কা। হয়তো ওর মধ্যে এমন অনেক নতুন ধাতু আছে, যা পৃথিবীর মানুষ কখনও দেখেনি। ওগুলো পেলে আমাদের বিজ্ঞানের অনেক নিয়ম উল্টে যেতে পারে।

সন্তু বলল, সাহেবগুলো ঐ পাথরটা যে এখানে আছে তা জানল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীতে কোথায় কখন উল্কাপাত হয়, অনেক বৈজ্ঞানিক তার খবর রাখেন। সবগুলোরই সন্ধান পাওয়া যায়, শুধু এটারই পাওয়া যায়নি। তবে এই লোকগুলো বৈজ্ঞানিক নয়। এরা যেমন হিংস্ৰ আর নিষ্ঠুর, তাতে মনে হয় এরা একটা ডাকাতের দল। কোনও বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে খবর পেয়ে এখানে চলে এসেছে।

সন্তু বলল, ওদের মধ্যে একজন পাঞ্জাবীও তো রয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, ঐ পাঞ্জাবীটি ওদের পথ দেখিয়ে এনেছে। নিশ্চয়ই অনেক টাকা দিয়ে হাত করেছে। ওকে।

তারপর আর ওরা কথা বলতে পারল না। অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল আগুনের দিকে।

সাহেবরা পাইপে করে আগুনের মধ্যে জল ছেটাতেই একটা আশ্চর্য সুন্দর জিনিস হল। আগুনের মধ্যে জল পড়তেই সেই জল লক্ষ লক্ষ রঙিন ফুলঝুরি হয়ে উঠে আসতে লাগল ওপরের দিকে। সমস্ত জায়গাটা লাল-নীল আলোয় শুয়ে গেল। আগুন নেভার কোনও চিহ্নই দেখা গেল না।

সাহেবরা তবু থামবে না। তারা জল ছিটিয়েই যেতে লাগল। আর সন্তু একদৃষ্টিতে দেখতে লাগল সেই ফুলঝুরি। এত সুন্দর রঙের খেলা সে কখনও দেখেনি। এখন আর ভয়ের কথা, বিপদের কথা তার মনে পড়ছে না।

কাকাবাবু বললেন, ও আগুন এই পৃথিবীর নয়। পৃথিবীর জল দিয়ে ঐ আগুন নেভানো যাবে না। ঐ আগুনেই পাথরটা পুড়ে পুড়ে একদিন শেষ হয়ে যাবে।

সাহেবরা এবার একটা কৌটো থেকে মুঠো মুঠো পাউডার ছড়াতে লাগল আগুনে। তাতেও কাজ হল না কিছুই। পাউডারগুলো পড়তেই দপ করে এক-একটা শিখা বেরিয়ে আসতে লাগল।

তাতেও নিরাশ হল না। সাহেবরা। এবার একটা সরু লম্বা গাছের গুড়ির কাছে গিয়ে মেশিনগানের গুলি চালাল পঁচিশ তিরিশটা। তারপর গাছটাকে ধরে কাৎ করতেই সেটা ভেঙে গেল মড়াত করে।

ওরা চারজনে মিলে সেই গাছটাকে বয়ে এনে আগুনের মধ্যে তার একদিকটা ঢুকিয়ে দিল অনেকখানি। গুম করে একটা শব্দ হল। পাথরটার গায়ে গাছটার ধাক্কা লেগেছে।

তখন সাহেবরা উৎসাহ পেয়ে গাছটাকে আবার বার করে এনে খানিকটা পিছিয়ে এল। তারপর জোরে দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মারল আবার। আবার গুম করে শব্দ হল, আগুনের শিখাগুলো যেন নড়ে-চড়ে উঠল খানিকটা।

সন্তুরা দম বন্ধ করে দেখছে। তারা বুঝতে পেরেছে সাহেবদের মতলবটা কী! তারা গাছ দিয়ে ধাক্কা মেরে মেরে আগুনের ভেতর থেকে পাথরটাকে বার করে আনতে চাইছে। কিংবা আগুনসুদ্ধই পাথরটাকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে ঝর্নার মধ্যে ফেলবে।

কিন্তু একটু পরেই আর একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হল। পাথরটা সহজে নড়ানো যায় না বলে ওরা খুব জোরে জোরে ধাক্কা মারছিল। এতবার ধাক্কা মারতে গিয়ে ঝোঁক সামলাতে না পেরে একজন সাহেব আগুনটার খুব কাছে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চুম্বকের মতন আগুন তাকে টেনে নিল ভেতরে। ঠিক যেন একটা হাতের মতন একটা আগুনের শিখা বেরিয়ে টেনে নিয়ে গেল লোকটিকে। সে একটা বীভৎস চিৎকার করে উঠল, তারপর আর তাকে দেখা গেল না।

শেষ মুহুর্তে সন্তু চোখ বুজে ফেলেছিল। আবার যখন চোখ মেলল, তখন দেখল, গাছটা ফেলে দিয়ে অন্য সাহেবরা ভয়ে পালিয়ে আসছে। কাকাবাবু কপালের ঘাম মুছছেন।

সাহেবটা আগুনে পুড়ে যাবার সময় দূরের জারোয়ারা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগান হাতে সাহেবটি সেদিকে এক ঝাঁক গুলি চালাল।

বুড়ো রাজা হাত পা বাঁধা অবস্থাতেই আবার হুকুমের সুরে চেঁচিয়ে বললেন, ওদের মেরো না! আমি হুকুম দিলে ওরা তোমাদের এখনও শেষ করে দিতে পারে!

সাহেবটা অসম্ভব রেগে গেল সেই কথা শুনে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বুড়ো বদমাশ, এবার তোকেই আগুনে পোড়াব। এই ল্যারি, এই বুড়োটাকে তুলে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দে তো!

অন্য সাহেবরা কাছাকাছি এক জায়গায় হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজন সঙ্গী তাদের চোখের সামনে আগুনে পুড়ে গেল! ব্যাপারটা ওরাও যেন সহ্য করতে পারছে না।

মেশিনগান-হাতে সাহেবটিই বোধহয় ওদের সদর। সে কিন্তু দামেনি। সে আবার চিৎকার করে বলল, ল্যারি, এদিকে এসো, এই বুড়োটাকে আগুনে ফেলে দাও!

ওপাশ থেকে ল্যারি উত্তর দিল, জ্যাক, পাথরটা পাবার কোনও আশা নেই। ওটা খুনে আগুন। চলো, আমরা এবার পালাবার চেষ্টা করি। নইলে আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব।

জ্যাক বলল, পালাবার আগে প্রতিশোধ নিতে হবে। এই বুড়োটাকে আমার চোখের সামনে আগুনে পোড়াতে চাই। আমি জারোয়াদের দিকে মেশিনগান তুলে রাখছি, তুমি একে আগুনে ফেলে দাও!

ল্যারি এগিয়ে এল।

কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, সন্তু, আমার রিভলভারটা…

সন্তু বুকে হেঁটে আস্তে আস্তে এগোল। রিভলভারটা যেখানে পড়ে আছে, সাহেবটা সেখান থেকে খানিকটা দূরে। সন্তু মাটির ওপর দিয়ে শুয়ে শুয়ে গেলে বোধহয় ওরা তাকে দেখতে পাবে না।

এই সময় তিনবার কাক ডেকে উঠল। অর্থাৎ ভোর হয়ে আসছে। আলো ফোঁটার আর বেশি দেরি নেই। আরও কয়েকটা পাখির ডাক, আরও কী যেন শব্দ হচ্ছে দূরে।

সন্তু রিভলভারটা নিয়ে ফিরে আসার সময় পেল না। ল্যারি এসে বুড়ো রাজাকে পাঁজাকালো করে তুলে নিতেই কাকাবাবু আর থাকতে পারলেন না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাঙ্গারুর মতন লাফাতে লাফাতে ছুটে গেলেন ওদের কাছে। চিৎকার করে বললেন, থামো, থামো! ওকে মেরো না!

জ্যাক চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখল কাকাবাবুকে। তারপর বলল, এই আর একটা শয়তান! ধর এটাকেও!

কাকাবাবুকে দেখে বুড়ো-রাজা শান্তভাবে বললেন, আমি কিছুতেই ইংরেজের হাতে মারব না প্ৰতিজ্ঞা করেছিলাম। তোমার জন্য সেই অপমানের মৃত্যুই আমাকে মরতে হচ্ছে। তুমিও মরবে!

কাকাবাবু ল্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে একজন জারোয়া আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় আমি এসে তোমাকে বাঁচিয়েছিলাম, ঠিক কি না? তুমি এই বুড়ো রাজাকে ছেড়ে দাও!

ল্যারি তাকাল জ্যাকের দিকে। জ্যাক বলল, এই দুটো বুড়োকেই আগুনের মধ্যে ফেলে দাও! নইলে আমরা পালাবার সময় এরা আমাদের পেছনে জারোয়াদের লেলিয়ে দেবে।

ল্যারি তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যাক ধমক দিয়ে বলল, দেরি করছ কী? দাও, ফেলে দাও। সঙ্গে সঙ্গে আকাশে একটা প্রচণ্ড ঘট ঘট শব্দ শোনা গেল। দূর থেকে শব্দটা এগিয়ে এল খুব কাছে। সবাই চমকে ওপরে তাকাল। একটা হেলিকপটার।

ল্যারি বলল, জ্যাক, শিগগির পালাও! হেলিকপটার নিয়ে পুলিশ এসেছে।

হেলিকপটার দেখে সন্তুরও মনে হল, নিশ্চয়ই তাদের উদ্ধার করার জন্যই ওটা এসেছে। আর কোনও চিন্তা নেই। সে উঠে সোজা হয়ে বসল।

জ্যাক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, একটা মোটে হেলিকপটার এসেছে, তাতে ভয় পাবার কী আছে? আমি এই মেশিনগান দিয়ে ওটাকে ফুড়ে দিচ্ছি। এক্ষুনি। তোমরা সরে দাঁড়াও, কিংবা মাটিতে শুয়ে পড়ো!

কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু–

সন্তু বুঝতে পারল না, কাকাবাবু তাকে কী করতে বলছেন। হেলিকপটারটা নীচের দিকে নেমে আসছে। আর একটু নীচে নামলেই জ্যাক গুলি চালাবে। তাদের সব আশা শেষ হয়ে যাবে।

সন্তুর খুব কাছেই পড়ে আছে কাকাবাবুর রিভলভারটা। সে সেটা চট করে তুলে নিল। কোনও চিন্তা না করেই সে দুটো গুলি চালিয়ে দিল জ্যাকের দিকে। গুলির শব্দে তার নিজেরই কানে তালা লেগে গেল, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল হাতে। সে চোখ বুজে ফেলল ভয়ে।

আবার চোখ খুলে দেখল, জ্যাক মাটিতে পড়ে গেছে, আর কাকাবাবু মেশিনগানটা তার হাত থেকে তুলে নিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে।

তারপর কাকাবাবু সেটা বাকি সাহেবদের দিকে ফিরিয়ে বললেন, তোমরা সব চুপ করে সারি বেঁধে দাঁড়াও। কেউ একটু নড়বার চেষ্টা করলেই গুলি চালিয়ে শেষ করে দেব-

ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাট শব্দ করে হেলিকপটারটা ঘুরতে লাগল ওদের মাথার ওপরে। একটু একটু করে নীচে নেমে আসছে। অনেকটা কাছে আসার পর সেটা থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরিয়ে এল। কে যেন মাইকে বলছে, আকিলা কিলকিল টুংকা টাকিলা! আকিলা কিলকিল টুংকা টাকিলা।

সন্তু অবাক হয়ে গেল। এ আবার কী? সেই আওয়াজ শুনে জারোয়ারা এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, টাকিলা। টাকিলা?

হেলিকপটার থেকে আবার আওয়াজ ভেসে এল, কাকিনা সুপি সুপি। কাকিনা সুপি সুপি!

এবার জারোয়ারা কোনও উত্তর দিল না। সবাই বুড়ো রাজার দিকে তাকিয়ে রইল।

কাকাবাবু বুড়ো রাজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কী বলছে?

বুড়ো রাজা বললেন, ঐ জিনিসটা থেকে কেউ একজন জারোয়া ভাষায় বলছে, মাঝখানে জায়গা ছেড়ে দিতে। ওটা এখানে নামবে।

কাকাবাবু বললেন, সবাইকে আপনি সরে যেতে বলুন! জায়গা করে দিতে বলুন!

এবার হেলিকপটার থেকে ইংরিজিতে কেউ জিজ্ঞেস করল, মিঃ রায়চৌধুরী, আর ইউ দেয়ার? মিঃ রায়চৌধুরী, আর ইউ দেয়ার?

কাকাবাবু চিৎকার করে বললেন, ইয়েস, আই অ্যাম হিয়ার। রায়চৌধুরী স্পিকিং-

কিন্তু হেলিকপটারের ঘাটঘ্যাট আওয়াজে তাঁর কথা বোধহয় ওপরে পৌঁছল। না, কারণ, ওরা সেই কথাই বারবার বলে যেতে লাগল।

কাকাবাবু সাহেবদের দিকে মেশিনগান তুলে রেখে, চোখ না সরিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, সন্তু, তোমার পকেটে রুমাল আছে?

রিভলভার থেকে গুলি চালাবার পর সন্তু আচ্ছন্নের মতন হয়ে মাটিতেই বসে ছিল। এবার সে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, হ্যাঁ আছে।

কাকাবাবু বললেন, সেই রুমালটা বার করে মাথার ওপরে ওড়াতে থাক।

সন্তু তার সাদা রুমালটা বার করে ডান হাতে প্ৰাণপণে ঘোরাতে লাগল।

কাকাবাবু সাহেবদের হুকুম করলেন, তোমরা সব মাটিতে বসে পড়ে। প্রত্যেকে হাত দুটো মাথার ওপরে তুলে রাখো।

একজন সাহেব মাটিতে পড়ে থাকা একটা বন্দুকের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল, কাকাবাবু বললেন, সাবধান, একটু নড়লেই খুলি উড়িয়ে দেব!

হেলিকপটারটা আস্তে-আস্তে ফাঁকা জায়গাটায় এসে নামল। প্রথমেই তার থেকে বেরিয়ে এল ধপধাপে সাদা দাড়িওয়ালা একজন শিখ। সে হাত তুলে বলল, টুংচা সংচু! টুংচা সংচু!

বুড়ো রাজা বললেন, টুংচা সংচু!

সঙ্গে-সঙ্গে সব জারোয়া সেই কথা বলে চেঁচিয়ে উঠল। বৃদ্ধ শিখটি তখন হেলিকপটারের দিকে হাত নাড়তেই তার থেকে বেরিয়ে এল আরও কয়েকজন।

প্ৰথমেই লম্বা চেহারার কৌশিক ভার্মা, তারপর বেঁটে গোলগাল পরেশ দাশগুপ্ত, তারপর বিশাল গোঁফওয়ালা পুলিশের এস পি মিঃ সিং আর চারজন সৈন্য, তাঁদের প্রত্যেকের হাতে মেশিনগান।

পরেশ দাশগুপ্ত ছুটে এসে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে লোফাতে-লাফাতে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি বেঁচে আছেন! আঃ, কী যে আনন্দ হচ্ছে! এই দেখুন, হোম সেক্রেটারি কৌশিক ভার্মা নিজে এসেছেন আপনাকে উদ্ধার করতে।

কাকাবাবুর আনন্দ হলেও মুখে তা প্রকাশ করেন না। কৌশিক ভার্মাকে দেখে তিনি বললেন, আপনার সোলজারদের বলুন, এই সাহেবগুলোকে ঘিরে ফেলতে। আমি আর এই ভারী মেশিনগানটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না!

কৌশিক ভার্মা বললেন, এরা কারা?

কাকাবাবু সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, এরা ডাকাত!

কৌশিক ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, জারোয়াদের মধ্যে ডাকাতি করতে এসেছে? কিসের লোভে? এদের কাছে কি সোনা আছে? হীরে আছে?

কাকাবাবু বললেন, না, সে সব কিছু নেই। কিন্তু এইটা আছে।

কাকাবাবু সেই রঙিন আগুনটার দিকে হাত দেখালেন। দিনের আলো ফুটে উঠেছে। এই সময় আগুনের রঙ বদলে যায়। এই আগুনটার রঙ কিন্তু একইরকম আছে।

কৌশিক ভার্মা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য! এরকম আগুন কখনও দেখিনি। সাহেবরা এটা চুরি করতে এসেছিল? এটা কী?

কাকাবাবু বললেন, সে সব পরে বলব। আপনি জারোয়াদের দ্বীপে এসেছেন, আগে এখানকার রাজাকে নমস্কার করুন! ইনিই জারোয়াদের রাজা?

হাত থেকে মেশিনগানটা ফেলে দিয়ে কাকাবাবু বুড়ো রাজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

কৌশিক ভার্মা আরও অবাক হয়ে বললেন, ইনি রাজা? মই গড! ইনি তো জারোয়া নন!

কৌশিক ভার্মা হাত জোড় করে নমস্কার করলেন বুড়ো রাজাকে। কাকাবাবু বললেন, না, ইনি জারোয়া নন। এর নাম গুণদা তালুকদার।

বুড়ো রাজা আস্তে আস্তে বললেন, সাহেবগুলোকে ভাল করে বেঁধে ফেলতে বলুন। এরা সাঙ্ঘাতিক লোক। আপনারা চলুন, আমার ঘরে বসে কথা বলা যাক।

কাকাবাবু পরেশ দাশগুপ্তর কাঁধে ভর দিয়ে বুড়ো রাজার কুঁড়েঘরের দিকে এগোলেন। বুড়ো রাজা যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর সন্তুকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন।

সন্তু কাছে যেতেই বুড়ো রাজা তার মাথায় খুব স্নেহের সঙ্গে হাত বোলাতে লাগলেন, তারপর কৌশিক ভার্মাকে বললেন, এই ছেলেটি না-থাকলে আজ আমরা কেউ বাঁচতুম না। আপনারাও বাঁচতেন না।

কৌশিক ভার্মা বললেন, তাই নাকি? কেন? এ কী করেছে?

বুড়ো রাজা বললেন, ঐ একজন সাহেবের হাতে মেশিনগান ছিল, সে গুলি চালিয়ে আপনাদের ঐ ফড়িঙের মতন যন্ত্রটায় আগুন ধরিয়ে দিতে পারত।

বুড়ো রাজা আগে কখনও হেলিকপটার দেখেননি, তাই নাম জানেন না।

কৌশিক ভার্মা বললেন, তা হয়তো পারত। সাহেবগুলো মেশিনগান নিয়ে ডাকাতি করতে এসেছে, এ ভারী আশ্চর্য ব্যাপার। এই জঙ্গলের মধ্যে ডাকাতি?

বুড়ে রাজা বললেন, সাহেবগুলো আমাকে আর ওর কাকাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল। ঠিক সময় এই ছেলেটি রিভলভারের গুলি চালিয়ে সাহেবটির হাত থেকে মেশিনগানটা ফেলে দেয়। তাই তো আমরা সবাই বেঁচে গেলাম।

কৌশিক ভার্মা প্ৰশংসার চোখে তাকালেন সন্তুর দিকে। তারপর তার কাঁধ। চাপড়ে দিয়ে বললেন, ব্রেভ বয়! এইটুকু ছেলে রিভলভার চালাতে জানে? টিপও নিশ্চয়ই খুব ভাল।

সন্তু লজ্জা-লজ্জা মুখ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে তো এমন কিছু করেনি। আনতাবড়ি একবার রিভলভার চালিয়ে দিয়েছে। সে যে এর আগে কখনও রিভলভার চালায়ইনি সে কথা আর বলল না।

কৌশিক ভার্মা বললেন, হি মাস্ট গেট আ রিওয়ার্ড। আমরা শুধু জারোয়াদেরই ভয় পেয়েছিলাম, সাহেব ডাকাতদের কথা ভাবিইনি। সত্যিই সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আপনি এখানে কী করে এলেন?

কথা বলতে বলতে ওঁরা ঢুকলেন কুঁড়েঘরের মধ্যে। সেখানে সেই গীতা বইটি আর বহুকালের পুরনো একজোড়া হাতকড়া দেখে কৌশিক ভার্মা আবার চমকে উঠলেন। তিনি বললেন, আমরা জানতাম, সভ্য জগতের সঙ্গে জারোয়াদের কোনও সম্পর্কই নেই, অথচ দেখছি, তাদের রাজা একজন লেখাপড়া-জানা মানুষ!

মাটির ওপরে বসে পড়েছেন। সেখান থেকে তিনি বললেন, এই গুণদা তালুকদার এক সময় ছিলেন একজন নামকরা বিপ্লবী। আন্দামান জেলা থেকে ইনি পালিয়ে যান। সে বহুবহু বছর আগেকার কথা। সকলের ধারণা ইনি মারা গেছেন। স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রত্যেক বইতে এর নাম আছে, ছবি আছে। এঁর জন্মদিনে উৎসব হয়।

কৌশিক ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, এখন আমারও মনে পড়েছে। এ যে দারুণ ব্যাপার। দিল্লিতে ফিরে গিয়ে এই খবর দিলে তো বিরাট হৈচৈ পড়ে যাবে! কিন্তু আপনি এখানে এলেন কী করে?

বুড়ো রাজা বললেন, এই হাতকড়ি বাঁধা অবস্থাতেই জেল থেকে পালিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে হাঙরে কুমিরে খেয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু খায়নি। ভাসতে-ভাসতে এসে ঠেকেছিলাম এই দ্বীপে।

জারোয়ারা আপনাকে মারেনি?

জারোয়ারা এমনি-এমনি কাউকে মারে না। এরা অত্যন্ত সভ্য। তোমরাই এদের হিংস্র বানিয়েছ।

তারপর থেকে আপনি এখানে থেকে গেলেন?

হ্যাঁ। আমি পরাধীন ভারতবর্ষে থাকব না ঠিক করেছিলাম, তাই এখানে শুনিয়ে স্বাধীন হয়ে থেকেছি। আমি আর বাইরের কোনও খবর রাখিনি।

এই আন্দামানে তো নেতাজী এসেছিলেন, কিছুদিনের জন্য স্বাধীন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন, তাও জানেন না।

এই দ্বীপের বাইরের কোনও খবরই আমি রাখি না। ইচ্ছে করেই রাখতে চাইনি। আমি যে এখানে আছি, তা জানতে পারলেই ইংরেজ সরকার আবার আমাকে বন্দী করত। সুভাষবাবু যে কবে নেতাজী হলেন, একটু আগে পর্যন্ত তাও জানতাম না!

কৌশিক ভার্মা বললেন, আশ্চর্য! সত্যি আশ্চর্য! কিন্তু গোটা ভারতবৰ্যই তো অনেক দিন স্বাধীন হয়ে গেছে! আপনি সে খবরও পাননি?

কাকাবাবু বললেন, উনি সে-কথাও বিশ্বাস করতে চাইছেন না। শুনুন, এই কৌশিক ভার্মা, ইনি গভর্নমেন্টের একজন বড় অফিসার। এঁকে জিজ্ঞেস করুন, আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে সেই সাতচল্লিশ সালে। আপনি জওহরলাল নেহরুর নাম শুনেছিলেন তো?

বুড়ো রাজা বললেন, হ্যাঁ। মতিলাল নেহরুর ছেলে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছিল।

সেই জওহরলাল হয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী। সে-ও তিরিশ বছর আগে।

গান্ধী কোথায়?

গান্ধীজী মারা গেছেন স্বাধীনতার এক বছর পরে। আপনাদের সময়কার প্ৰায় কেউ-ই বেঁচে নেই। চলুন, আপনি দিল্লি চলুন, সেখানে গিয়ে সব শুনবেন?

বুড়ো রাজা ভুরু তুলে বললেন, কোথায় যাব? দিল্লি? কেন? আমি কোথাও যাব না–

সে কী, আপনি এখনও এখানে থাকতে চান?

নিশ্চয়ই! আমি এখানে জারোয়াদের নিয়ে পরম শান্তিতে আছি।

আপনি স্বাধীন দেশে একবার ঘুরে আসতেও চান না? আপনার অনেক আত্মীয়-স্বজন হয়তো এখনও বেঁচে আছে, তাদেরও দেখতে চান না একবার?

না।

বুড়ো রাজা কিছুতেই তাঁর জারোয়া-রাজ্য ছেড়ে আর যেতে চান না। কোথাও। কাকাবাবু আর কৌশিক ভার্মা অনেক করে বোঝাতে লাগলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনবেন না। শেষে একবার রেগে উঠে বললেন, আপনারা যদি আমাকে জোর করে বন্দী করে নিয়ে যেতে চান, সেটা আলাদা কথা! তবুও সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে জোর করে নিতে গেলে সব জারোয়া একসঙ্গে মিলে বাধা দেবে। তারা প্ৰাণ দিয়েও আমাকে বাঁচাতে চাইবে।

কৌশিক ভার্মা বললেন, না, না, আপনাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাব কেন? আপনি আমাদের শ্রদ্ধেয়। আপনি দেশ স্বাধীন করার জন্য এত কষ্ট করেছেন। কিন্তু আমরা ফিরে গিয়ে যখন আপনার কথা বলব, কেউ বিশ্বাস করবে না?

সন্তু হঠাৎ বলে উঠল, ছবি তুলে নিয়ে গেলে সবাই বিশ্বাস করবে।

কাকাবাবু রাগ করে সন্তুর দিকে তাকালেন, সন্তু থতমত খেয়ে গেল। সে বুঝতে পারেনি, সে ভুল কথা বলে ফেলেছে।

সাদা দাড়িওয়ালা প্রীতম সিং এক পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। এবারে তিনি বললেন, কেয়া তাজব কি বাত্! আমি এতদিন জারোয়াদের সঙ্গে কথা বলেছি, কোনওদিন তারা জানতেও দেয়নি যে, তাদের একজন বাংগালী রাজা আছে। সেইজন্যই তারা বেশি ভেতরে ঢুকতে দিত না।

বুড়ো রাজা বললেন, সেটাই ছিল আমার হুকুম।

কাকাবাবু হতাশভাবে বললেন, তাহলে আপনি কিছুতেই যাবেন না?

বুড়ো রাজা বললেন, না।

সন্তু কিছু না বুঝে এগিয়ে গিয়ে বুড়ো রাজার হাত ধরে বলল, আপনি চলুন না। আমাদের সঙ্গে। একবারটি গিয়ে সব দেখে শুনে আবার এখানে ফিরে আসবেন। জানেন, হাওড়া স্টেশনে মাটির তলা দিয়ে রাস্তা হয়েছে, আপনি তো সেসব দেখেননি।

বুড়ো রাজা হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। সন্তুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওরে, তুই আমাকে একথা বললি কেন? তোর মতন আমার একটা ছোট ভাই ছিল, জেলে আসবার আগে তাকে ঠিক এই বয়েসী দেখে এসেছি। তোকে দেখেই তার কথা মনে পড়ছে।

কাকাবাবু বললেন, হয়তো আপনার সেই ভাই এখনও বেঁচে আছেন। আপনি গেলে তাকে দেখতে পাবেন।

বুড়ে রাজা একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন, তার দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তারপর চোখের জল মুছে বললেন, ঠিক আছে, আমি যাব! কিন্তু তার আগে তোমাদের কয়েকটা প্ৰতিজ্ঞা করতে হবে?

কাকাবাবু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী প্ৰতিজ্ঞা করতে হবে বলুন!

বুড়ো রাজা বললেন, তোমাদের কথা দিতে হবে, আমার এই জারোয়াদের কেউ কোনও ক্ষতি করবে না। এই দ্বীপে অন্য কেউ আসতে পারবে না। জারোয়াদের ঐ পবিত্র আগুন তোমরা নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে না। ওরা যে-রকমভাবে বাঁচতে চায়, সেইরকমভাবে থাকতে দেবে।

কাকাবাবু তাকালেন কৌশিক ভার্মার দিকে।

কৌশিক ভার্মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি, এগুলো সব মানা হবে। এগুলোই তো আমাদের নীতি।

বুড়ো রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে, তা হলে চলো, কিন্তু কয়েকদিন থেকেই আমি আবার ফিরে আসব কিন্তু!

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই। আমি নিজে সব ব্যবস্থা করে দেব।

বাইরে প্রত্যেকটি সাহেবের হাত পিঠের দিকে মুড়ে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। সন্তু যে সাহেবটিকে গুলি করেছিল, সেও মরেনি, দুটো গুলিই লেগেছে তার কাঁধে। হেলিকপটারে কিছু ওষুধপত্র ছিল, তাই দিয়ে তাকে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সৈন্যদের পাহারায় সাহেবদের পাঠিয়ে দেওয়া হল সমুদ্রের দিকে। ওখান থেকে লঞ্চে করে নিয়ে যাওয়া হবে ওদের।

বাকিরা সবাই হেলিকপটারে যাবে।

কিন্তু বুড়ো রাজাকে হেলিকপটারে তোলার সময় সে একটা দৃশ্য হল বটে। বুড়ো রাজা জারোয়াদের ভাষায় বুঝিয়ে বললেন ওঁর চলে যাবার কথা। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি জারোয়া মাটিতে মুখ গুঁজে একটা অদ্ভুত করুণ শব্দ করতে লাগল। এই ওদের কান্না। কান্নার সময় ওরা কারুকে মুখ দেখায় না। কয়েকটি জারোয়া মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বুড়ো রাজাকে। তারা কিছুতেই ওঁকে যেতে দেবে না। তিনি হাত-পা নেড়ে অনেক কষ্টে ওদের বোঝাতে লাগলেন, তাঁর চোখ দিয়েও জল পড়ছে। তিনি মাটিতে মুখ-গোঁজা প্ৰত্যেকটি জারোয়ার গায়ে হাত দিয়ে বলতে লাগলেন, আমি ফিরে আসব, কদিনের মধ্যেই ফিরে আসব।

কৌশিক ভার্মা কাকাবাবুকে বললেন, মানুষ মানুষকে যে এত ভালবাসতে পারে, আগে কখনও দেখিনি। এদের ভালবাসা কত আন্তরিক?

কাকাবাবু বললেন, হুঁ।

তারপর এক সময় হেলিকপটার আকাশে উড়ল। সমস্ত জারোয়া একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে চিৎকার করতে লাগল, বুড়ো রাজাও হাত নাড়তে লাগলেন তাদের দিকে। একটু বাদেই হেলিকপটার চলে এল সমুদ্রের ওপর।

পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে বেশি দেরি লাগল না। দূর থেকেই দেখা যায়। জেলখানাটা। ব্রিটিশ আমলের কুখ্যাত সেলুলার জেলা। পোর্ট ব্লেয়ারে এখনও সেটাই সবচেয়ে উঁচু বাড়ি। আকাশ থেকে সেদিকে এক দৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন্স বুড়ো রাজা। একদিন তিনি এই জেল থেকে পালিয়েছিলেন। আজ সত্যিই সেখানে রাজার মতন ফিরে আসছেন।

পোর্ট ব্লেয়ারে থাকা হল মাত্র একদিন। এর মধ্যে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেওয়া হল কলকাতা আর দিল্লিতে। ঠিক হল, কলকাতায় প্রথমে তিনি তিনদিন থাকবেন। তারপর যাবেন দিল্লিতে। সেখানে যে কদিন তাঁর থাকতে ইচ্ছে হয়। তিনি থাকবেন। তারপর যেদিন ফিরে আসতে চাইবেন, সেদিন আবায় কলকাতা হয়ে ফিরবেন।

পরদিন বিশেষ বিমান ওঁদের নিয়ে এল। কলকাতায় দমদম এয়ারপোর্টে কী সাঙ্ঘাতিক ভিড়। হাজার হাজার মানুষ এসেছে জারোয়াদের রাজাকে দেখতে। আরও কত খবরের কাগজের লোক, ফটোগ্রাফার। আলোর বিলিক দিয়ে ফটো উঠছে ঘন ঘন। সন্তুরও ছবি উঠে যাচ্ছে খুব, কারণ বুড়ে রাজা তারই কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিনা!

মাঝে মাঝেই ধ্বনি উঠছে, গুণদা তালুকদার জিন্দাবাদ!

এয়ারপোর্টে সন্তুর মা-বাবা, দুই দাদা, পাশের বাড়ির রিনি, বাবলু, পিংকুরাও এসেছে, কিন্তু সন্তু তো এক্ষুনি বাড়ি যাবে না। বুড়ো রাজার সঙ্গে এখন তাদেরও যেতে হবে রাজভবনে, সেখানে গভর্নর তাদের সম্বর্ধনা জানিয়ে মধ্যাহ্নভোজ খাওয়াবেন। লাটসাহেবের বাড়ি খাওয়া তো যে-সে কথা নয়।

লোকেরা এত ফুলের মালা দিচ্ছেন যে, তার ভারেই আরও বুকে পড়ছেন বুড়ো রাজা। এত ভিড়ের মধ্যে তাঁর কষ্ট হবে বলে কৌশিক ভার্মা তাড়াতাড়ি তাঁকে গাড়িতে তুললেন। কাকাবাবু আর সন্তুও সেই গাড়িতে।

গাড়ি এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। আবার কলকাতায় ফিরে সন্তুর খুব আনন্দ হচ্ছে। এবার যে বেঁচে ফিরে আসতে পারবে তাতেই খুব সন্দেহ ছিল।

সন্তু বুড়ে রাজাকে বলল, জানেন তো, এই রাস্তাটার নাম ভি আই পি রোড। আপনাদের সময় তো এটা ছিল না।

বুড়ো রাজা কোনও উত্তর দিলেন না।

কাকাবাবু বললেন, তখন এসব জায়গাতেও জঙ্গল ছিল।

গাড়ি চলতে লাগল, আর সন্তু নানান রকম খবর দিতে লাগল বুড়ো বাজাকে। এটা বিধান রায়ের মূর্তি, ঐ যে ঐখানে শিশু উদ্যান, এই জায়গাটার নাম কাঁকুরগাছি…

বুড়ো রাজা একটাও কথা বলছেন না।

গাড়ি মানিকতলা পেরিয়ে যখন বিবেকানন্দ রোড দিয়ে ছুটছে সেই সময় বুড়ো রাজা হঠাৎ উঃ শব্দ করে দুহাতে মুখ ঢাকলেন।

কৌশিক ভার্মা ও কাকাবাবু দুজনেই ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে বললেন, কী হল? কী হল?

বুড়ো রাজা উত্তর না দিয়ে আঃ আঃ শব্দ করে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

কৌশিক ভার্মা বললেন, এ কী! উনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, সামনেই আমার এক বন্ধুর ডাক্তারখানা। ঐ যে ল্যাম্পপেস্টের পাশে-ওখানে গাড়ি থামান!

কাকাবাবুর বন্ধু ডাক্তার, সামনেই তিনি বসে আছেন। সবাই মিলে ধরাধরি করে বুড়ো রাজাকে ভেতরের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল।

ডাক্তারের ওষুধে একটু পরেই জ্ঞান ফিরল। বুড়ো রাজার। ডাক্তারবাবু বললেন, ওঁকে এক্ষুনি কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। হার্টের অবস্থা ভালো নয়।

বুড়ো রাজা বললেন, না, না—

কাকাবাবু ঝুঁকে পড়ে বললেন, আপনার কষ্ট হচ্ছে? হাসপাতালে গেলেই ডাল হয়ে যাবেন। এখন কলকাতায় ভাল ভাল হাসপাতাল আছে।

বুড়ো রাজা বললেন, না, না, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো।

ফিরে যাবেন? হ্যাঁ, যাবেন, কয়েকদিন পরে—

বুড়ে রাজা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, না, এক্ষুনি। তোমাদের এখানে আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। এখানকার বাতাস এত খারাপ, এখানে এত শব্দ, এত মানুষ, এত বাড়ি-আমার সহ্য হচ্ছে না।রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে দেখলাম মানুষ ভিক্ষে করছে, রোগা রোগা ছেলে, না না, আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চলো…

কাকাবাবু কিছু বলতে গেলেন, তার আগেই দুবার হেঁচকি তুললেন বুড়ো রাজা। অতি কষ্টে ফিসফিস করে বললেন, আমি পারছি না। এখানে থাকতে পারছি না, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, এত ধুলো এখানকার বাতাসে, এত শব্দ-

বুড়ো রাজা জোর করে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই পড়ে গেলেন। সবাই ধরাধরি করে আবার শুইয়ে দিলেন তাকে। বুড়ো রাজার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। খুব আস্তে আস্তে আপন মনে বলতে লাগলেন, আমি কেন এলাম! কত ভাল জায়গায় ছিলাম। আমি-সেখানে বাতাস কত টাটকা-পাখির ডাক, গাছের পাতার শব্দ, আর ঝর্নার জলের শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই, সেখানে কেউ ভিক্ষে করে না, সেখানে কত শান্তি, সেই তো আমার স্বৰ্গ! কেন এলাম, আমাকে নিয়ে চলে। এক্ষুনি এক্ষুনি-আমি যাব-আঃ!

হঠাৎ বুড়ো রাজার কথা থেমে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সকলের মুখগুলোও কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, উনি কি—

কাকাবাবু কিছু উত্তর দিলেন না। মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। সন্তু জীবনে এই প্রথম দেখল, কাকাবাবুর চোখে জল।

সেও আর সামলাতে পারল না। শব্দ করে কেঁদে উঠল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 10 of 10 ): « পূর্ববর্তী1 ... 89 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress