Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ || Shirshendu Mukhopadhyay

ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ || Shirshendu Mukhopadhyay

রাসপুরের খালের ধারে

রাসপুরের খালের ধারে এসে থমকাল ফটিক। খালের ওপর একখানা জরাজীর্ণ বাঁশের সাঁকো। পেছনে নিতাই। ফটিক তার দিকে ফিরে বলল, “ও নিতাই, হয়ে গেল।”

“হলটা কী?”

“এই সাঁকো পেরোতে হলে হনুমান হতে হয়। অবস্থা দেখছিস!” বাস্তবিক সাঁকোর অবস্থা খুবই কাহিল। পেরনোর জন্য দু’খানা বাঁশ পাতা আছে। বাঁ পাশে একটা বাঁশের রেলিং। কিন্তু পেতে রাখা বাঁশের একখানা মাঝখানে মচাত হয়ে ঝুলছে। রেলিংয়ের বাঁশ কেতরে আছে। নীচে শেষ বর্ষার জলে খাল টইটম্বুর। বেশ স্রোতও আছে।

ফটিক দমে গেলেও নিতাই সবসময়েই আশাবাদী। বলল, “চল, পেরনোর চেষ্টা তো করি। জলে পড়ে গেলে সাঁতরে চলে যাব।”

‘কী বুদ্ধি তোর! আমি কি সাঁতার জানি নাকি? তার ওপর টিনের সুটকেস আর পোঁটলা রয়েছে সঙ্গে, জলে পড়লে সব নষ্ট।”

আশাবাদী নিতাই এবার চিন্তায় পড়ল। খালটা পেরনো শক্তই বটে। বেশি বড় নয়, হাত পনেরো চওড়া খাল। কিন্তু লাফ দিয়ে তো আর ডিঙোনো যায় না। রাসপুরের লোকজনের কাছে তারা পথের হদিস জানতে চেয়েছিল। তারা দোগেছে যাবে শুনে লোকগুলো প্রথমটায় এমন ভাব করল যেন নামটাই কখনও শোনেনি। একজন বলল, “দোগেছে। সেখানে কেউ যায়!” আর একজন বলল,

“দোগেছে যাওয়ার চেয়ে বরং বাড়ি ফিরে গেলেই তো হয়।”

যাই হোক অবশেষে একজন বলল, “বেলাবেলি পৌঁছতে হলে বটতলা দিয়ে রাসপুরের খাল পেরিয়ে যাওয়াই ভাল। তবে কাজটা কঠিন হবে।” কেন কঠিন হবে তা আর ভেঙে বলেনি।

ফটিক পা দিয়ে সাঁকোটা একটু নেড়ে দেখল। একটু নাড়া খেয়েই সাঁকোতে যেন ঢেউ খেলে গেল।

ফটিক পিছিয়ে এসে বলল, “অসম্ভব।”

নিতাই মৃদুস্বরে বলে, “একটু চেষ্টা করে দেখলে হয়। ব্যালান্সটা ঠিক রাখতে পারলে পেরোনো যায়।”

খালের ওপারে একটা বটগাছ। তার ছায়ায় একটা লোক উবু হয়ে বসে ছিল। এবার উঠে এগিয়ে এসে বলল, “কী খোকারা, খাল পেরোবে নাকি?”

নিতাই বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু কী করে পেরোব?”

“কেন, ওই তো সাঁকো। সবাই পেরোচ্ছে।”

“পেরোচ্ছে! পড়ে যায় না?”

“তা দু-চারটে পড়ে। আজ সকালে হর ডাক্তার আর বৃন্দাবন কর্মকার পড়ল। দুপুরে পড়ল নব মণ্ডল, সীতারাম কাহার আর ব্রজ দাস। বরাতজোর থাকলে পেরিয়েও যায় কেউ কেউ।”

“না মশাই, আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। সঙ্গে জিনিসপত্তর আছে। আচ্ছা, খালে জল কত?”

লোকটা মোলায়েম গলায় বলে, “বেশি না, বড়জোর ছ-সাত হাত হবে। সাঁতার দিয়েও আসতে পারো। তবে–” বলে লোকটা থেমে গেল।

নিতাই বলল, “তবে কী? জলে কুমিরটুমির আছে নাকি?” লোকটা অভয় দিয়ে বলল, “আরে না। এইটুকুন খালে কি আর কুমির থাকে? তবে দু-চারটে ঘড়িয়াল আর কামট আছে বটে। তা

তারা তো আর তোমাদের খেয়ে ফেলতে পারবে না। বড়জোর হাত বা পায়ের দু চারটে আঙুল কেটে নেবে, কিংবা ধরো পেট বা পায়ের ডিম থেকে এক খাবলা করে মাংস। অল্পের ওপর দিয়েই যাবে অবশ্য। আজ সকালেই হরবাবুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা গেল কিনা।”

ফটিক ফ্যাকাসে মুখে বলল, “বলে কী রে লোকটা!”

লোকটা বলল, “জোঁক আর সাপের কথা তো ধরছিই না হে বাপু। রাসপুরের খাল পেরোতে হলে অতসব হিসেব করলে কি চলে?”

নিতাই বলল, “অন্য কোনও উপায় নেই পেরোনোর?”

“তা থাকবে না কেন? আড়াই মাইল উত্তরে গেলে উদ্ধবপুরে খেয়াঘাটের ব্যবস্থা আছে। আরও এক মাইল উজিয়ে হরিমাধবপুরে পাকা পোল পাবে।”

“তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমরা অনেক দূর থেকে আসছি, বেলাবেলি এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। একটা উপায় হয় না?”

লোকটা খুব চিন্তিত মুখে বলল, “দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। উপায় ভাবতে তো একটু সময় দেবে! পরের ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমার সময় চলে যায়, নিজের ভাবনা আর ভাবার ফুরসতই হয় না।”

“একটু তাড়াতাড়ি ভাবলে ভাল হয়। আমাদের খিদেও পেয়েছে কিনা।”

লোকটা খ্যাঁক করে উঠল, “ওঃ, খিদে তেষ্টা যেন শুধু ওদেরই পায়! আমার পায় না নাকি? ওরে বাপু, খিদে-তেষ্টা পায় বলেই তো জগতের এত সমস্যা। তা তোমাদের কাছে কি গুটিপাঁচেক টাকা হবে।”

ফটিক আশায় আশায় বলল, “তা হবে।”

“বাঃ, বেশ! তা হলে বাঁ ধারে বিশ পা হেঁটে ওই যে ঝোঁপঝাড় দেখছ, ওখানে গিয়ে দাঁড়াও।”

ঝোঁপঝাড়ের দিকে চেয়ে ফটিক সন্দিহান গলায় বলল, “সাপটাপ নেই তো!”

লোকটা নিরুদ্বেগ গলায় বলল, “তা থাকবে না কেন? বর্ষার সময় এখনই তো তারা বেরোয়। আছেও নানারকম। গেছে সাপ, মেছো সাপ, কালকেউটে, গোখরো, চিতি, বোড়া। কত চাই?”

“ও বাবা।”

“আহা, অত ভাবলে কি চলে! সাপেদেরও নানা বিষয়কৰ্ম আছে। শুধু মানুষকে কামড়ে বেড়ালেই তো তাদের চলে না। পেটের ধান্দায় ঘুরে বেড়াতে হয়। একটু দেখেশুনে পা ফেলো, তা হলেই হবে।”

নিতাই বলল, “চল তো, অত ভয় পেলে কাজ হয় না।”

অগত্যা দু’জনে গুটিগুটি গিয়ে ঝোঁপঝাড়ে ঢুকল। কাঁটা গাছ, বিছুটি কোনওটারই অভাব নেই।

চেক লুঙ্গি আর সবুজ জামা পরা বেঁটে লোকটা জলের ধারে এসে খোঁটায় বাঁধা একটা দড়ি ধরে টান দিতেই দড়িটা জল থেকে উঠে এল আর দেখা গেল, দড়ির একটা প্রান্ত এপাশে একটা ছোট নৌকোর সঙ্গে বাঁধা। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর লুকোনো ছিল বলে নৌকোটা দেখা যাচ্ছিল না।

“নাও হে, উঠে পড়ো। পরের উপকার করতে করতে গতরে কালি পড়ে গেল।”

ফটিক আর নিতাই আর দেরি করল না। জলের ধারে নেমে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে পড়ল। লোকটা দড়িটা টেনে লহমায় তাদের খালের ওপারে নিয়ে ফেলল।

লোকটা একগাল হেসে বলল, “তায়েবগঞ্জের হাটে যাবে বুঝি? তা আর শক্ত কী? ওই ডান ধারের রাস্তা ধরে গুটিগুটি চলে যাও, মাইল দুই গেলেই খয়রা নদীর ধারে বিরাট হাট। জিনিসপত্র বেজায় শস্তা। আটাশপুরের বিখ্যাত বেগুন, গঙ্গারামপুরের নামকরা ঝিঙে, সাহাপুরের কুমড়ো, তার ওপর নয়ন ময়রার জিবেগজা তো আছেই।”

ফটিক বলল, “না মশাই, আমরা তায়েবগঞ্জের হাটে যাব না। অন্যদিকে যাব।”

লোকটা হঠাৎ তেরিয়া হয়ে বলল, “কেন, তায়েবগঞ্জের হাটটা কি কিছু খারাপ জায়গা নাকি? কত জজ ব্যারিস্টার ও হাট দেখতে আসে তত তোমরা তো কোথাকার পুঁচকে ছোঁকরা। এখন পাঁচটা টাকা ছাড়ো দেখি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

নিতাই ফস করে বলে উঠল, “খেয়াপারের জন্য পাঁচ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন! এ তো দিনে ডাকাতি। ওই পুঁচকে খাল পেয়োনোর ভাড়া মাথাপিছু পঁচিশ পয়সা হলেই অনেক।”

লোকটা অবাক হয়ে বলল, “খেয়াপারের ভাড়া চাইছি কে বলল? ছিঃ ছিঃ, ওইসব ছোটখাটো কাজ করে বেড়াই বলে ভাবলে নাকি? এই মহাদেব দাস ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না হে।”

“তবে পাঁচ টাকা নিলেন যে!”

“সেটা তো আমার মাথার দাম। এই যে তোমরা খাল পেরোতে পারছিলে না বলে আমাকে ধরে বসলে, আমাকে মাথা খাটাতে হল, বুদ্ধি বের করতে হল, এর দাম কি চার আনা আট আনা? মহাদেব দাসকে কি খেয়ার মাঝি পেয়েছ নাকি? এ-তল্লাটে সবাই আমাকে বুদ্ধিজীবী বলে জানে, বুঝলে! টাকাটা ছাড়ো।”

.

বিদেশ-বিভুই বলে কথা, তার ওপর লোকটাও বদমেজাজি দেখে আর কথা না বাড়িয়ে ফটিক পাঁচটা টাকা দিয়ে দিল।

মহাদেব দাস টাকাটা জামার পকেটে রেখে একটু নরম গলায় বলল, “না গেলে না যাবে, তবু বলছি তায়েবগঞ্জের হাটটাও কিন্তু কিছু খারাপ জায়গা ছিল না। নয়ন ময়রার জিবেগজা পছন্দ না হলে সাতকড়ির বেগুনি তো রয়েছে। খাঁটি সর্ষের তেলে ভাজা, ওপরে পোস্ত ছড়ানো, চটিজুতোর সাইজ। তা বলে বেশি খেলে চলবে না, পেটে জায়গা রেখে খেতে হবে। ধরো, দশখানা করে খেয়ে তারপর গিয়ে বসলে রায়মশাইয়ের মণ্ডার দোকানে। ইয়া বড় বড় মণ্ডা। বেগুনির পরই মণ্ডা খেতে যেন অমৃত। তাও যেতে ইচ্ছে করছে না?”

ফটিক কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “খুবই ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমাদের উপায় নেই। সন্ধের মধ্যে এক জায়গায় পৌঁছতেই হবে।”

মহাদেব একটু হতাশ হয়ে বলল, “তা যাবে কোথা? কুলতলি নাকি? সেও ভাল জায়গা। আজ সেখানে বোষ্টমদের মালসাভোগ আর দধিকর্দম হচ্ছে। এই তো সোজা নাক বরাবর হেঁটে গেলে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। তা কুলতলিতে কি তোমাদের মামাবাড়ি?”

ফটিক মাথা নেড়ে বলে, “কুলতলি নয়, আমরা যাব দোগেছে।”

মহাদেব দাস খানিকক্ষণ হাঁ করে অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল, “কী বললে?”

“গাঁয়ের নাম দোগেছে।”

মহাদেব ঘন ঘন ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, আমার কান দুটোই গেছে। বঁচির মাও সেদিন বলছিল বটে, ওগো কুঁচির বাপ, তুমি কিন্তু আজকাল কান শুনতে ধান শুনছ। একবার কান দুটো শশধর ডাক্তারকে না দেখালেই চলছে না।”

নিতাই আর ফটিক মুখ-তাকাতাকি করল। দোগেছের নামটা অবধি অনেকের সহ্য হচ্ছে না দেখে তাদের একটু ভয়-ভয়ই করতে লাগল।

এবার নিতাই এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা মহাদেবদাদা, দোগেছের নাম শুনলেই সবাই চমকাচ্ছে কেন বলতে পারেন?”

মহাদেব দাস একটু দম ধরে থেকে বিরস মুখে বলল, “চমকানোর আর দোষ কী বলোখোকারা! দোগেছে যাওয়া আর প্রাণটা যমের কাছে বন্ধক রাখা একই জিনিস। না হে বাপু, আমি বরং এইবেলা রওনা হয়ে পড়ি।”

নিতাই তাড়াতাড়ি পথ আটকে বলল, “না মহাদেবদাদা, তা হচ্ছে। না। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলতে হবে।”

মহাদেব দাস বটতলার খালের ওপর ধপ করে বসে পড়ল। তারপর বলল, “উরেব্বাস! সে বড় ভয়ঙ্কর জায়গা হে। না গেলেই নয়?”

ফটিক মাথা নেড়ে বলল, “না গিয়ে উপায় নেই। আমার এক পিসি সেখানে থাকে। জন্মে তাকে দেখিনি কখনও। সেই পিসি চিঠি লিখে যেতে বলেছে। খুব নাকি দরকার।”

চোখ বড় বড় করে মহাদেব বলল, “পিসি! দোগেছেতে কারও পিসি থাকে বলে শুনিনি। তা পিসেমশাইয়ের নামটি কী?”

“শ্রীনটবর রায়।”

নামটা শুনেই মহাদেবের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। ঘন ঘন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে সে বলল, “না, না, আমি কিছুই বলতে চাই না।”

ফটিক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন, তিনি কি খারাপ লোক?”

মহাদেব একটু খাপ্পা হয়ে বলল, “তাই বললুম বুঝি! নটবর রায়ের নাম তো জীবনে এই প্রথম শুনলাম রে!”

ফটিক আর নিতাই একটু চোখ-তাকাতাকি করে নিল। মহাদেব কিছু চেপে যাচ্ছে।

নিতাই নিরীহ গলায় বলল, “দেখ মহাদেবদাদা, আমরা ভিন গাঁয়ের লোক, এদিকে কখনও আসিনি। দোগেছে কেমন জায়গা একটু খোলসা করে বললে আমাদের সুবিধে হয়।”

মহাদেব উদাস গলায় বলল, “জায়গা খারাপ হবে কেন? পিসির বাড়ি বলে কথা। গেলেই হয়। তবে মাইলটাক গিয়ে হরিপুরের জঙ্গল পড়বে পথে। ওইটে পেরোতে পারলে গনা ডাইনির জলা। তারপর কাঁপালিকের অষ্টভুজা মন্দির। সেখানে এখনও নরবলি হয়। মন্দিরের পর মস্ত বাঁশবন। বাঁশবনের পর করালেশ্বরীর খাল। খাল পেরিয়ে দোগেছে। বাঁ দিকে নাক বরাবর রওনা হয়ে পড়ো। সাঁঝ বরাবর পৌঁছে যাবি, যদি না–”

বলে মহাদেব থেমে গেল।

ফটিক ঝুঁকে পড়ে বলল, “যদি না কী গো মহাদেবদাদা?”

মহাদেব মাথাটাথা চুলকে বলল, “আমার মুশকিল কী জানিস? পেটে কথা থাকে না। কথা চাপতে গেলে পেটে এমন বায়ু হয় যে, তখন সামনে এক হাঁড়ি রসগোল্লা রাখলেও সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না।”

নিতাই বলল, “বায়ু হওয়া মোটেই ভাল নয়। কথা চেপে রাখার দরকারটাই বা কী?”

“তা না হয় বলছি। আগে দুটো টাকা দে। কথারও তো একটা দাম আছে!”

নিতাই অবাক হয়ে বলে, “এই যে পাঁচটা টাকা নিলে!”

“সে তো মগজের দাম। কথার দাম আলাদা। ডাক্তারের যেমন ভিজিট, উকিলের যেমন ফি, তেমনই মহাদেব দাস বুদ্ধিজীবীর কথারও একটু দাম আছে রে।”

গেল আরও দুটো টাকা। মহাদেব টাকাটা পকেটে চালান করে বলল, “হরিপুরের জঙ্গলে গাছে গাছে মেলা হনুমান দেখতে পাবি। তা বলে হনুমান নয় কিন্তু। ও হচ্ছে কালু ডাকাতের আস্তানা। তার শাগরেদরা গাছে ঝুলে ওত পেতে থাকে। যেই জঙ্গলে সেঁধোবি অমনই ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে নেমে ঘিরে ফেলবে। হাতে দা, টাঙ্গি, বল্লম।”

“ওরে বাবা!”

“সর্বস্ব খুইয়ে জঙ্গল যেই পেরোবি অমনই গনা ডাইনি খানা গলায় ডাক দেবে, “কেঁ যাঁয় রে? আয় বাবা, ফলার খেয়ে যা।”

“বটে!”

“যদি বাঁ দিকে তাকাস তা হলেই হয়ে গেল। জলার মধ্যে টেনে নিয়ে পাঁকে পুঁতে মেরে ফেলবে। নয়তো গোরু ভেড়া বানিয়ে রেখে দেবে। চোখ কান বুজে মাঝখানের সরু পথটা পেরিয়ে গিয়ে পড়বি হারু কাঁপালিকের অষ্টভুজা মন্দিরের চত্বরে। নধরকান্তি ছেলেপুলে দেখলেই হারুর চেলারা ঝপাঝপ ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে পাতালঘরে ফেলে রাখবে। অমাবস্যার রাতে খুব ধুমধাম করে মায়ের সামনে বলি হয়ে যাবি।”

ফটিক বলল, “তা হলে কি ফিরে যাব?” মহাদেব মোলায়েম গলায় বলে, “আহা, ফিরে যাওয়ার কথা উঠছে কেন? এসব বিপদ আপদ পেরিয়েও তো কেউ কেউ দোগেছে যায়, না কি? তা মন্দির পেরিয়ে বাঁশবন। সে নিচ্ছিদ্র বাঁশবন, দিনে দুপুরেও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ওই বাঁশবনে বহুকাল যাবৎ দুটি কবন্ধ বাস করে আসছে। উটকো মানুষ ঢুকলে ভারী খুশি হয়। তারা তোক খারাপ নয়, তবে তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ হাডু-ডু খেলতে হবে। তা তাদের হাত থেকে ছাড়া পেলে থাকছে শুধু করালেশ্বরীর খাল। তা সে খাল পেরোনো শক্ত হবে। রাসপুরের খালে কুমির না থাকলেও করালেশ্বরীর খালে তারা গিজগিজ করছে। তাদের পেটে রাবণের খিদে। হাঁ করেই আছে। আর সে এমন বড় হাঁ যে, জাহাজ অবধি সেঁধিয়ে যায়।”

ফটিক উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “তা হলে পেরোব কী করে?”

“তা করালেশ্বরীর খালও পেরোনো যায়। কেউ কেউ তো পেরোয় রে বাপু। মানছি, সবাই পেরোতে পারে না, দু-দশজন কুমিরের পেটেও যায়। তা বলে তোরা পারবি না কেন?”

ফটিক বলে, “খেয়া নেই?”

“সেও ছিল একসময়ে। মোট সাতজন মাঝি নৌকোসমেত কুমিরের পেটে যাওয়ায় ও পাট উঠে গেছে। দোগেছের লোকেরা খালের দু’ধারে দুটো উঁচু গাছে আড়া করে দড়ি বেঁধে দিয়েছে। গাছে উঠে ওই দড়িতে ঝুল খেয়ে খেয়ে পেরোতে হয়। কেঁদো কয়েকটা হনুমান ওই সময়ে এসে যদি কাতুকুতু না দেয় বা মাথায় চাঁটি না মারে, আর নীচে উপোসী কুমিরের হাঁ দেখে ভয়ে যদি তোদের হাত পা হিম হয়ে না যায় তা হলে দিব্যি পেরিয়ে যাবি। পেরিয়ে গিয়ে অবশ্য–”

ফটিক সভয়ে জিজ্ঞেস করল, “অবশ্য?”

মহাদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বলে আর কী হবে? দোগেছে পৌঁছে তো তোরা নটবর রায়ের খপ্পরেই পড়ে যাচ্ছিস। তারপর যে কী হবে কে জানে!”

ফটিক শুকনো মুখে নিতাইয়ের দিকে ফিরে বলল, “কী করব রে নিতাই? এ যা শুনছি তাতে তো ফিরে যাওয়াই ভাল মনে হচ্ছে।”

মহাদেব বলল, “এসেই যখন পড়েছিস পিসির বাড়ি যাবি চলে তখন না হয়–“

ফটিক মাথা নেড়ে বলল, “না মহাদেবদাদা, দোগেছে গিয়ে আর কাজ নেই। আমরা বরং বেলাবেলি ফেরতপথে রওনা হয়ে পড়ি।”

মহাদেব উদাস গলায় বলল, “তা যাবি তো ফিরেই যা, পৈতৃক প্রাণটা তা হলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল। চ, তোদের খালটা পার করে দিই।”

নিতাই এবার বলে উঠল, “আমাদের কাছে কিন্তু আর পয়সা নেই।”

মহাদেব হেসে বলল, “পরের জন্য করি বলে আমার আর এ জন্মে পয়সা হল না রে। ঠিক আছে বাপু, বিনিমাগনাই পার করে দিচ্ছি, দুধের ছেলেরা ভালয় ভালয় ফিরে গেলেই হল। দেখি, চিঠিখানা দেখি!”

ফটিক অবাক হয়ে বলল, “কীসের চিঠি?”

মহাদেব বলল, “কেন, এই যে বললি পিসি তোকে চিঠি দিয়ে আসতে বলেছে!”

ফটিক পকেট থেকে পোস্টকার্ডটা বের করে দিতেই ভ্রু কুঁচকে মহাদেব বলল, “এ তো জাল জিনিস মনে হচ্ছে। কেউ তোদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। চিঠিটা আমার কাছে থাক, ব্যাপারটা বুঝে দেখতে হবে।”

এই বলে মহাদেব চিঠিটা পকেটে পুরে ফেলল। মহাদেব দাসের নৌকোয় উঠে দু’জনে ফের খালের এপারে চলে এল। ফটিক তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে বলল, “পা চালিয়ে চল নিতাই।”

নিতাই ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে একটু আড়াল হয়েই বলল, “দাঁড়া।”

“কী হল?”

নিতাই আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখল, মহাদেব দাস এদিকে একটু চেয়ে থেকে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বেশ খুশি-খুশি মুখ করে পিছু ফিরে ডান দিকের রাস্তা ধরে হনহন করে হাওয়া হয়ে গেল।

নিতাই ফটিকের হাত ধরে টেনে বলল, “আয়, আমরা দোগেছে যাব।”

“বলিস কী? শুনলি না কী সাঙ্ঘাতিক জায়গা!”

“তোর মাথা। লোকটাকে আমার একটুও বিশ্বাস হয়নি। আয় তো, একটা উটকো লোকের কথা শুনে এত ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে? এতই যদি খারাপ জায়গা তা হলে তোর পিসি কি তোকে সেখানে ডেকে পাঠাত?”

ফটিক ভিতু মানুষ। তবু নিতাইয়ের কথাটা একটু ভেবে দেখে বলল, “তা অবশ্য ঠিক, তবে-”

“তবে টবে নয়। আয় তো, যা হওয়ার হবে।”

দু’জনে ফের মহাদেবের নৌকোয় উঠে খাল পেরিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল।

ফটিক বলল, “মহাদেব লোকটা কোথায় গেল বল তো!”

নিতাই বলল, “শুনলি না তায়েবগঞ্জের হাটের কথা। এখন গিয়ে আমাদের পয়সায় সেখানে ভালমন্দ খাবে।”

সাত-সাতটা টাকার দুঃখে ফটিকের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সে বলল, “পিসির চিঠিটাও তো লোকটা নিয়ে গেল।”

নিতাই বলল, “তুই দিতে গেলি কেন?”

ফটিক মুখ চুন করে বলল, “লোকটা যে বলল জাল চিঠি! কেউ আমাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।”

“ওকে বিশ্বাস করাটা ঠিক হয়নি।”

“যাকগে, চিঠি তো আর তেমন কিছু নয়। আমিই তো যাচ্ছি।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress