Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu » Page 16

শ্বেত পাথরের থালা || Bani Basu

পরদিন স্কুলে গেল না বন্দনা। একটু উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করলেন সোমনাথবাবু কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এখনও বন্দনার চোখ লাল, মুখ ফুলে আছে। নাই বা গেল একদিন। কিন্তু পরদিনও সে গেল না। তার পরদিনও না। তৃতীয়দিন সোমনাথবাবু বুঝতে পারলেন সে কোনদিনই আর স্কুলে যাবে না। সেদিন রাত্রে ঝোঁকের মাথায় অনেক কথা, প্রায় একটা বিরাট বক্তৃতাই দিয়ে ফেলেছেন বন্দনাকে। বিষয় খুবই স্পর্শকাতর। সেইজন্যেই কি সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল? কিন্তু তিনি তো নিরুৎসাহকর কোনও কথা তাকে বলেননি! বরং যাতে অপরাধবোধ, পাপবোধ থেকে মুক্ত হওয়া তার পক্ষে সহজ হয়, বাকি জীবনটা মোটের ওপর ভারমুক্ত হয়ে চলতে পারে এমন কথাই তাকে বলেছেন। বন্দনা কি রাগ-অভিমান করল? হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে সব সময় যুক্তি কাজ করে না। তিনি যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন, তত্ত্ব এবং উদাহরণের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাতে কি বন্দনা কোথাও আঘাত পেয়েছে? সে একবার বলেছিল বটে তাকে এত কঠিন কথা তিনি কেন বলছেন! তাহলে কি সে তাঁর ওপর রাগ করে স্কুলের কাজটা ছেড়ে দিল? স্কুলে কাজ নিতে তিনি তাকে কখনও বলেননি। বন্দনার নিজেরই ইচ্ছে সেটা। তিনি দেখে সুখী হয়েছিলেন যে বন্দনা কত স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে। প্রতিদিন এটা তিনি অনুভব করেছেন। তাহলে? তিনচারদিন কেটে গেলে সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলেন; বন্দনা বলল, ‘তুমি কি চাও যেখানে আমাকে সব সময় মিথ্যাচরণ করতে হয়, যেখানে আড়ালে আমাকে লক্ষ্য করে লোকে বক্রোক্তি করে সেখানে আমি যাই?’ কিছুই বুঝতে পারলেন না সোমনাথবাবু। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর আসল ঘটনাটা প্রকাশ পেল। বন্দনা বলল, ‘সামনাসামনি ওরা উদার, আড়ালে আরও কত কি বলে থাকে, কি মনোভাব পোষণ করে আমার সম্পর্কে এই ধরনের উক্তি থেকেই তো বোঝা যায়।’ সোমনাথ ব্যথিত হয়ে বললেন, ‘কি যে নিষ্ঠুর এই মায়ের জাত। নিজেদের হেয় করতে এদের সত্যিই জুড়ি নেই। কিন্তু বুড়ি এতো ভঙ্গুর হলে তো তোর চলবে না। তুই দুর্বল হলে আঘাত বারবার আসবে। আর এসব আঘাত মনকে শুধু ছোট করে, এ সব আঘাতের কোনও মর্যাদা নেই। তুই যে কোনও সংস্কার মানিস না সেটা লুকোলে চলবে না নিজের মধ্যে জোর না থাকলে লোকে বারবার আঘাত করবেই, অনেক সময়ে না বুঝেই করবে যে।’

বন্দনা চুপ করে রইল। একবারও বলল না জোরের সঙ্গে যে সে এবার থেকে আরও সবল হবে, এত সহজে ভেঙে পড়বে না। আসলে সে মনে মনে বলছিল, ‘আমি পারব না। পারছি না যে কাকা।’ কিন্তু এ কথা বললে কাকা পাছে তাকে আরও জোর করেন, তাই সে চুপ করে রইল।

চুপচাপ গুমোট দিনগুলো কাটে। একমাত্র রূপ বাড়ি ফিরলে তার হাঁকডাক, কলকাকলিতে সে গুমোট কাটে।

সে বাড়ি এসেই সেদিনের স্কুলের মুখ্য ঘটনাটা নাটকীয়ভাবে বলবে—‘ওঃ জানো মা আজকে স্কুলে ফাটাফাটি কাণ্ড।’

—‘কেন রে?’ বন্দনার প্রশ্ন খুব নিরুৎসুক।

—‘আরে দুটো নতুন ছেলে অন্য স্কুল থেকে এসেছে, কথা বলছিল, ব্যস মিস তাদের জামার পেছনে ডঙ্কি আর মঙ্কি লিখে দিয়েছে বড় বড় করে।’

—‘কোন মিস?’ সোমনাথবাবু জিজ্ঞেস করেন।

—‘মিসেস রডরিগ্‌স। সেই যে গো যার ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ে। স্যামুয়েল। ভীষণ বিচ্ছু!’

—‘তারপর?’

—‘টিফিনের সময়ে তো ছেলে দুটো বাইরে বেরিয়েছে, আর স্কুলশুদ্ধু ছেলে তাদের নিয়ে হেসেছে। তখন কি সাহস! ছেলে দুটো প্রিন্সিপ্যালের কাছে গিয়ে কমপ্লেন করেছে, কেঁদেছে।’

বন্দনা অন্যমনস্ক ছিল, বলল, ‘আচ্ছা! সত্যি খুব সাহসী ছেলে তো?’

রূপ উৎসাহ পেয়ে বলে, ‘তারপর শোনো না, প্রিন্সিপ্যাল মিসকে ডেকে কি বকুনি! চাইল্ড সাইকলজি, নেভার ইনসাল্ট দেম, য়ু আর নট ফিট টু বী আ টিচার, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই শুনেছি। কেন্‌ নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল একটু পরে এসে আমাদের সবাইকে তাড়িয়ে দিলে কি হবে, তার আগেই আমাদের শোনা হয়ে গেছে।’

সোমনাথবাবু বলেন, ‘যাক তবু বুদ্ধিশুদ্ধি আছে মিঃ স্মিথের।’

রূপ বলল, ‘মা তুমি কখনও তোমার স্কুলের মেয়েদের এরকম শাস্তি দাও, পেছনে লিখে!’

বন্দনা মুখে বলে, ‘পাগল হয়েছিস।’ মনে মনে বলে ‘আমি লিখব কি? আমার পেছনেই সবাই নানান কথা লিখে দিচ্ছে, এমন কালি দিয়ে যে সে আর কিছুতেই উঠতে চায় না।’

সোমনাথবাবু খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন। মানুষকে সাহায্য করা বড় কঠিন। কথায়, আচরণে, আদরে কোথাও তো চেষ্টার অন্ত নেই। তবু হয় না। তবু হল না। জীবনের ওপর মৃত্যু ক্রমাগত জয়ী হয়ে চলেছে। এতদিন পর তাঁর মনের মধ্যে গভীর আলস্য আসছে। অবসাদ, হতাশা। হতাশা থেকেই আলস্য। বন্দনার মায়ের মৃত্যুর পর, দাদার অবস্থা দেখে তাকে মানুষ করার ভার নিজেই তুলে নিয়েছিলেন যেচে। কোনদিন মনে হয়নি খারাপ করেছেন। একটি বালিকাকে আস্তে আস্তে গড়েপিটে তোলবার মধ্যে তিনি অসীম আনন্দ পেয়েছেন। সেই মেয়ে স্বামীকে হারালো। শ্বশুরবাড়িতে তার অবস্থা দেখে, নিজের মধ্যে সেই পুরনো জেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল আবার। অসীম স্নেহও ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এই হার-না-মানা জেদ। মুমূর্ষ মেয়েকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন তাঁর মনে হচ্ছে স্নেহের চেয়ে কি জেদটাই বেশি ছিল। বেশ তো এগোচ্ছিল। এখন যেন মেয়ে তাঁর সামনে একটা দেয়াল তুলে দিয়েছে। এই পর্যন্ত, আর এগিও না। কিছুদূর পর্যন্ত তোমার চেষ্টা আমি মেনে নেব। কিন্তু স্বপ্নেও ভেব না অনুশাসনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি আমি স্বীকার করে নেব। হঠাৎ সোমনাথের মনে হল তাঁর আর কোনও কাজ নেই। সত্যি সত্যি তিনি অবসর নিয়েছেন। বুড়ো হয়ে গেছেন। একেবারে বুড়ো। ইজিচেয়ারটায় আধশোয়া হয়ে ভেতরের বিমর্ষতায় কিরকম একটা চুলের মতো আসে। সেটা ঠিক ঘুম নয়। ঘোর। ঘোরের মধ্যে নিজেই নিজেকে বলেন, ‘চলো এবার ফেরো।’

‘কোথায়?’

—‘না, হিমালয় নয়। এবার আরও উঁচু অলটিচ্যুড, আরও উত্তরে। যেখানে সব প্রশ্নের শেষ উত্তর, সব তীর্থের সেরা তীর্থ।’

—‘ওদের কি হবে?’

—‘ওদের আর অত আগলে রাখতে হবে না। তুমি আড়াল করে আছ বলে বাড়তে পাচ্ছে না। সরিয়ে নাও তোমার পক্ষপুট। অভিজ্ঞতার মোকাবিলা নিজেদের করতে শিখতে দাও।’

‘কিন্তু বালকটি?’

—‘ওকে ওর মা দেখবে, মানুষ করবে, তুমি কে?’

ঘোরের মধ্যেই সোমনাথবাবু শুনতে পেলেন বন্দনা বলছে—‘ওমা, তুমি! হঠাৎ! এতকাল পরে!’

অপরিচিত নারী কণ্ঠ বলে উঠল, ‘বউমণি তুমি আবার কবে থেকে আমাকে তুমি বলতে আরম্ভ করলে গো?’

—‘কতদিন দেখা নেই! কিছু মনে করিসনি! সবাই ভালো আছেন?’

—‘ওমা মনে কি করব? কার ভালোর কথা জিজ্ঞাসা করছ?’

—‘সবার। মা, বাবা, কাকা, কাকিমা, মেজদা, ছোড়দা, মিলি।’

—‘সবাই ভালো। মেজদার তো বম্বেতেই বিয়ে হয়েছে। ভটচায্যি বাড়ির থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছে একেবারে, জানো তো? বিরাট পয়সা বউদিদের। মেজদা গিয়ে তাদের এক্সপোর্টের ব্যবসার হাল ধরেছে। মেজবৌদি বাঙালি হলে কি হবে? একেবারে বম্বেওয়ালী হয়ে গেছে। বাংলা বলে ভাঙা ভাঙা। মিলিটার বিয়েটা কিছুতেই লাগছে না। আসলে কাকা-কাকিমা বোধহয় স্বপ্নে-দেখা রাজপুত্তুরটি পাচ্ছেন না। যাই হোক, তোমাকে কিন্তু যেতেই হবে।’

সোমনাথবাবু আস্তে আস্তে চোখ মেললেন। একটি বউ, দেখলে মনে হয় বেশ বড়লোকের ঘরের। ঝলমল করছে চেহারাখানা। শাড়ি গয়নার জাঁকজমক ছাড়াই। ঝলমলানিটা কিসের? সোমনাথবাবু নিজেই জিজ্ঞেস করলেন নিজেকে, উত্তর দিলেন—বোধহয় সুখের। সমৃদ্ধিও আছে অন্তরালে। কিন্তু জানান দিচ্ছে না।

বন্দনা বলল, ‘আয় কলি, কাকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। কাকা, এই আমার ননদ কলি, তুমি বোধহয় ওকে চিনতে পারছ না, এত বদলে গেছে!’

কলি বলল, ‘আমি একটুও বদলাইনি বউমণি, বিশ্বাস করো। একটু মোটা হয়েছি শুধু। কোন বাঙালিনী বিয়ের পর মোটা হয় না গো? তুমিও হয়েছিলে!’ বলতে বলতে কলি কাকাকে প্রণাম করল; বলল, ‘কাকু, আমার মেজ দেওরের বিয়ে, বউমণি, আপনি, খোকা সবাই অবশ্যই যাবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার কর্তা অফিসের কাজে দিল্লি গেছেন। সেই বিয়ের দিন সকালে আসবেন। তাই আসতে পারলেন না।’

সোমনাথবাবু বললেন, ‘ও সব বলতে হবে না। আমি নিশ্চয় যাব মা।’

বন্দনা বলল, ‘কাকা রূপকে নিয়ে যাবেন কলি, আমাকে লক্ষ্মীটি বাদ দে।’

কলির মুখ কালো হয়ে গেল, বলল, ‘বউমণি, ছেলের অন্নপ্রাশনে কিচ্ছু করতে পারিনি। সে সময়ে এদের জেঠু মারা গেলেন। আমাদের এ বাড়িতে এই আমার নিজের হাতে আয়োজন করা প্রথম উৎসব, তুমি যাবে না, এ হতেই পারে না।’

—‘আমি গিয়ে কি করব কলি, আমি একটা মূর্তিমতী ছন্দপতন ছাড়া কি?’

কলি হারবার পাত্রী নয়। বলল, ‘বউমণি, একজনের ওপর রাগ করে আরেকজনকে শাস্তি দেওয়া কি ঠিক? মা, বাবা, কাকা, কাকিমা সবাই এখন তোমার জন্যে দুঃখ করেন, খোকামণির জন্যে ও বাড়ির আলো নিভে গেছে, জীবনে পাশাপাশি থাকতে গেলে কত কি ঘটে, খুবই খারাপ, ভোলা যায় না, তবু ভুলতে হয়। মাফ করাও যায় না তবু একটু মাফ করতেই হয়। আমি নিজে এসে যখন তোমাকে সাধাসাধি করছি, তখন তোমায় কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না নিশ্চিত জেনেই করছি তো!’

বন্দনা বলল, ‘ওসব কিছু নয় কলি। আমি সব ভুলে গেছি। মাফ করবারও প্রশ্ন নেই। ওসব ছাড়। আমার কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে, পাঁচজনের মজলিশে যেতে একেবারে ভালো লাগে না রে, জোর করিস না।’

কলি সোমনাথবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাকু আপনিই বলুন এটা কি বউমণি ঠিক করছে? এভাবে সরে থাকা, দূরে থাকা এটা কি সুস্থতার লক্ষণ?’

সোমনাথ বললেন, ‘তুমি ঠিকই ধরেছে মা। এইরকম দূরে সরে থাকা ঘোর মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু আমার কিছু করবার নেই। আমি বুড়ো মানুষ। কারো বাবা নই যে জোর করলেই জোর খাটবে। তোমাকে বিফল মনোরথ হয়েই ফিরতে হবে। যদি বলো তো নাতিকে নিয়ে আমি যাবো’খন।’

কলি বলল, ‘সে তো যাবেনই। তবে আমি হার মানছি না। বউমণিকে আমি ঘরের বার করবই। একটা মানুষ দিনের পর দিন নিজেকে এভাবে জ্যান্ত কবর দিয়ে রাখতে পারে তোমাকে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না। আমি আবার আসব। আজ যাই?’

—‘আবার এসো মা’, সোমনাথবাবু বললেন। কলি সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেল। বন্দনা পেছন পেছন। একটু পরেই গাড়ি ছাড়ার শব্দ হল।

সোমনাথবাবু চশমাটা খুলে রেখে আবার চোখ বুজলেন।

একটু পরে বন্দনার গলা শুনলেন, ‘তুমি ওভাবে বললে কেন?’ চোখ খুললেন সোমনাথ—‘কি ভাবে?’

—‘বললে তুমি বুড়ো, তুমি কারুর বাবা নয়। তোমার জোর নেই⋯।’

—‘কথাগুলো কি মিথ্যে? আমি বুড়ো হইনি? আমি কি কারুর বাবা?’

বন্দনা কাকার হাতের ওপর মাথা রেখে বলল, ‘কাকা তুমি বুড়ো নও। বুড়ি আসলে আমি। আমি বুড়ো, প্রাচীন, আবর্জনা হয়ে গেছি। আমার মনের মধ্যে শ্যাওলা ধরে আছে। চেষ্টা করছি, আমি কিছুতেই পরিষ্কার হতে পারছি না। তুমি আমার ওপর রাগ করো না। আমি তোমার রাগ-অভিমানের যোগ্য নই। এতো দীনহীন আমি!’

সোমনাথ উঠে বসলেন। বন্দনার চোখে জল থমকে আছে। বলল, ‘তুমি এভাবে নিজেকে সরিয়ে নিও না, তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।’

—‘কেন বুড়ি, তোর ছেলে রয়েছে। তার প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালোবাসা⋯··এ কি তোর যথেষ্ট নয়? স্নেহ নিম্নগামী জানিস তো!’

বন্দনা মাথাটাকে আরও জোর করে কাকার হাতের ওপর চেপে ধরে বলল, ‘রূপের আমি আছি। কিন্তু আমার কে আছে বলো?’

—‘কিন্তু আমি তো তোকে কষ্ট দিই বুড়ি। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতে জেদ করি। কোনও জিনিসই জোর-জুলুম করে হয় না, আমি ভুলে যাই মা।’

—‘ভোলো, ভুলে যাও কাকা। জোর করো। আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গড়ে উঠতে সাহায্য করো। আমার সত্যিকারের ইচ্ছে যে কি তা তো আমি জানি না। তোমার কথাগুলো আমি দিবারাত্র মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করি। বুঝতে পারি একটা শক্ত খোলসের মধ্যে বাস করছি। বিশ্বাসের, শিক্ষার, সংস্কারের অভ্যেসের শক্ত খোলা। সেটা ভেঙে বার হওয়া যে ভীষণ কঠিন কাকা, কত কঠিন, তুমি পুরুষ, তার ওপর বিয়ে করোনি, তুমি মুক্ত, তুমি জ্ঞানীও, তুমি বুঝবে না।’

সোমনাথ মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন—‘যদি কলিদের বিয়ে-বাড়িতে যেতে বলি, যাবি?’

—‘প্লীজ কাকা, অন্য একদিন আমি কলির বাড়ি নিশ্চয়ই যাব। ওইদিন যেতে বলো না। অনেক লোকের ভিড়, বিশেষ করে মেয়েদের ভিড় আমার সহ্য হয় না। আমি… আমার ভেতরটা কিরকম কুঁকড়ে যায়। ঘেন্না হয়। সত্যি বলছি কাকা। তাছাড়াও, ওখানে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হবে। ওঁরা যদি ফিরে যেতে বলেন, বলবেনই। তুমি কি চাও আমি চলে যাই?’

এমন করুণ মিনতির সুরে কথাগুলো বলল বন্দনা, যে সোমনাথ আর এ নিয়ে দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণ করতে পারলেন না। মনে মনে বুঝলেন বন্দনা ঠিক কথাই বলছে, এই উপলক্ষ করে কলি বোধহয় পঁয়তাল্লিশ নম্বরের সঙ্গে বন্দনাদের মিল-মিশ করিয়ে দিতে চাইছে। হয়ত তাতে এক ভাবে ওদের পায়ের তলার মাটি শক্ত হবে। কিন্তু বন্দনাকে খানিকটা পুনর্মূষিক হতেই হবে। তিনিই বা এই বয়সে আর কি নিয়ে থাকবেন? বন্দনা তাঁকে ছেড়ে যেতে চায় না। তাঁর ভেতরটা গভীর স্নেহে টলটল করছে। তিনি সেইরকম টলটলে গলাতেই বললেন—‘চল বুড়ি, খাবার বেলা বোধহয় পার হয়ে গেল।’

খেতে খেতে বন্দনা বলল—‘একটা কথা বলব? রাগ করবে না?’

—‘আমি কি তোর ওপর শুধু রাগই করি! বলই না কি কথা।’

—‘ওদের অফিসে অমলেন্দু ঘোষাল বলে এক ভদ্রলোকের কাছে একবার যাবে? তখন পার্সোনেল-এ ছিলেন, এখন কি হয়েছেন অবশ্য জানি না।’

—‘কেন রে?’

—‘আমার কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছে ওর স্ত্রী হিসেবে ওখানে একটা কাজের চেষ্টা করলে আমি পেয়ে যেতে পারি। ঘোষালের সম্পর্কে আমার খুব ভালো ধারণা। ওকে দাদার মতো ভালোবাসতেন।’

—‘কিন্তু তুই তো কাজ করতে গেলে দুঃখ পাস।’

—‘ওখানে পেয়েছি বলে এখানেও পাবো তার কি মানে আছে?’

সোমনাথ হাসলেন—‘বাইরে দুঃখ আছেই, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এখানে পেলে ওখানেও পাবি। তাছাড়া মেয়েদের পক্ষে টিচিং জবটা খুব নিরাপদ। চাকরিটা তোকে সুটও করেছিল ভালো। কত কাছে ছিল বাড়ির!’

বন্দনা থালার ওপর আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে বলল—‘আগের চেয়ে অনেক শক্ত হয়ে গেছি এখন, বিশ্বাস করো। স্কুলে আমি রেজিগনেশন পাঠিয়ে দিয়েছি। ওই পরিবেশটার সঙ্গে আমার কিরকম একটা মন-খারাপের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে। কিরকম একটা কমপ্লেক্স। আমি যে এতো দুর্বল আমি নিজেই জানতাম না। তুমি এবারটির মতো আমায় মাফ কর। আর কখনও আমি ওরকম করব না। দেখ!’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress