কানফাটা মেঘের গর্জন
প্রথমে কানফাটা মেঘের গর্জন, তারপরেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। জানলা বন্ধ করতে করতে অর্জুন বাইরের বাগানটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল না। অন্ধকার ছড়িয়ে আছে গাছগুলোর ভিতরে, বৃষ্টি তাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
স্নান সেরে ঘরে ফিরে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, একী। এ যে প্রলয় শুরু হয়ে গেল। তা হলে লোকটা দেখছি ঠিকই বলেছিল।
কোন লোকটা? অর্জুন তাকাল।
ওই যে নদীর ধারের মন্দিরের কথা বললাম, তার চাতালে পদ্মাসনে বসে ছিল। দেখে মনে হল সাধু-সন্ন্যাসী গোছের কেউ হবে। তখনও নারকোলটা আমার দিকে নেমে আসেনি। পড়ল, আমি একটু বুঝতেই পারছ, নার্ভাস হয়েই ওটা কুড়িয়ে নিলাম। ঠিক তখনই সেই বৃদ্ধ ধমকে উঠল, যাঃ বেঁচে গেলি এই যাত্রায়। কেন এসেছিস এখানে? মরতে? যা পালা। পালালে বেঁচে যাবি।
এ কথা বলছেন কেন মহারাজ? জিজ্ঞাসা করলাম। প্রলয় আসছে। মহাপ্রলয়। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মা খেপে গেলে ধ্বংস অনিবার্য। পেরেছেন মহাদেব কেদারনাথ-বদ্রীনাথকে রক্ষা করতে? তাই তো মাকে শান্ত করতে তার পদানত হতে হয়। যা, পালা এখান থেকে। বিশ্বাস করো অর্জুন, লোকটার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে আমি কোনও প্রতিবাদ না করে পা চালিয়ে সরে এসেছিলাম। এখন তো পৃথিবী কালো করে বৃষ্টি এসে গেছে। দোলগোবিন্দবাবু চেয়ারে বসলেন।
তা হলে আপনি এখন আর নাস্তিক নন। অর্জুন হাসল।
না। স্বধর্মচ্যুত হওয়ার কোনও কারণ এখনও তীব্র হয়নি। তা দ্যাখো, নদীটা এখান থেকে পৌনে একমাইল দূরে। কালকের বৃষ্টিতে জলও বেড়ে গেছে খুব। শুনলাম খালের সঙ্গে নদীর জল একাকার হয়ে গিয়েছিল কাল রাতে। তা হলেও এত দুরে এসে ধ্বংস করার ক্ষমতা ওই নদীর হতে পারে না। কী বলো?
ধ্বংস করার আগেই আমরা স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরছি।
তুমি বলেছিলে সত্যসন্ধান করো। এখন তো কল্পনাবিলাসীর মতো কথা বলছ। খালের উপর যে ব্রিজ ছিল তা তো ভেঙে গেছে। এইরকম বৃষ্টি হলে আমরা খাল পার হতে পারব? অসম্ভব। তা ছাড়া ওপাশে ট্রেন লাইনের উপর যদি জল উঠে যায় তা হলে সোনায় সোহাগা।
কথাগুলো সত্যি। অর্জুন দরজার কাছে পৌঁছে দেখল দুটো ছাতি নিয়ে ভৃগু ছুটে আসছে। তার মাথার উপর ছাতিটা ভোলা। বারান্দায় উঠে সে বলল, ছাতি মানতে চাইছে না জল। আপনাদের একটু কষ্ট করতে হবে বাবু।
বুঝতে পারলাম না। অর্জুন বলল।
আপনাদের খাবার এতদূরে বৃষ্টির মধ্যে নিয়ে এসে খেতে পারবেন না। বড়বাবু বললেন, আপনারা কষ্ট করে ডাইনিংরুমে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করলে ভালভাবে খেতে পারবেন। উনিও আপনাদের সঙ্গে খাবেন। ভৃগু বলল।
দোলগোবিন্দবাবু বেরিয়ে এসেছিলেন ঘর থেকে, সেই ভাল। চলো অর্জুন।
.
মেহগিনি কাঠের লম্বা টেবিল, চেয়ারগুলোও সুদৃশ্য। মঙ্গলময়বাবু বললেন, এইরকম অবস্থা হবে তা আন্দাজ করতে পারিনি। আপনাদের অসুবিধা হচ্ছে বলে সত্যি দুঃখিত।
খাওয়া শুরু করেছিল অর্জুন। বলল, বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। জল পড়ছে ঠিকই কিন্তু আমরা তো জলে পড়ে নেই।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, নিশ্চয়ই এর আগে এখানে বন্যা হয়েছিল। আপনার এই বাড়ি পর্যন্ত নদীর জল এসেছিল?
না। কখনওই না। এবার প্রকৃতি বিচিত্র ব্যবহার করছে। মঙ্গলময়বাবু বললেন।
শুনলাম নদী আর খাল এক হয়ে গিয়েছে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।
সেটাই তো সমস্যা। আপনাদের ট্রেনের টিকিট কাটতে লোক পাঠিয়েছিলাম। খালের জল এত বেড়েছে আর সেইসঙ্গে স্রোতও, বেচারা পার হতে পারল না। যদি বিকেলের মধ্যে জল কমে যায়। কথা শেষ করলেন না ভদ্রলোক।
দোলগোবিন্দবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, অর্জুন, আমাদের কি আজই ফিরে যাওয়ার খুব দরকার আছে?
শুনেছেন তো, মহাপ্রলয় আসছে। কোন সাহসে থাকবেন? অর্জুন হাসল।
কী ব্যাপার? মঙ্গলময়বাবুর কপালে ভাঁজ পড়ল।
দোলগোবিন্দবাবু মন্দিরের সাধুর কথা শোনালেন।
এখানে তো এরকম কোনও সাধু থাকেন না। ভৃগু–!
আজ্ঞে–। ভৃগু এগিয়ে এল।
মন্দিরে নাকি একজন সাধুবাবা এসেছেন?
কাল অবধি কেউ ছিলেন না বাবু। হয়তো আজ এসেছেন। খবর নিতে কাউকে পাঠাব? ভৃগু জিজ্ঞাসা করল।
এই জলে কাউকে পাঠানোর দরকার নেই। আপনি বোধহয় খাবার পছন্দ করছেন না? দোলগোবিন্দবাবুকে বললেন মঙ্গলময়বাবু।
কী বলছেন? দারুণ খাবার। মুশকিল হল এত খেতে অভ্যস্ত নই। কী অর্জুন, রান্না কেমন? দোলগোবিন্দবাবু প্রশ্নটা করলেও অর্জুন জবাব দিল না। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
খাওয়া শেষ হলে বেসিন থেকে ঘুরে এসে অর্জুন মঙ্গলময়বাবুকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার এই বাড়িতে এসে খাওয়াদাওয়া করলাম। মিসেস বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করলে আপনার কি আপত্তি আছে?
দেখা করবেন? না না, আপত্তির কোনও কারণ নেই। তিনি কখন কথা বলবেন, কখন বলবেন না তা তার মর্জির উপর নির্ভর করে। পঁহ্যাঁড়ান। ভৃগু–!
ভৃগু বলল, আজ্ঞে–!
স্বর্ণলতাকে এখানে আসতে বলো।
ভৃগু চলে গেলে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, বাঃ, বেশ সুন্দর নাম।
যে মেয়েটি আমার স্ত্রীকে দেখাশোনা করে তার নাম স্বর্ণলতা। বেশ গম্ভীর গলায় জানালেন মঙ্গলময়বাবু।
দোলগোবিন্দবাবু মাথা নাড়লেন, আমি কেবলমাত্র নামটারই অ্যাপ্রিশিয়েট করেছি।
মঙ্গলময়বাবু বললেন, কাল থেকে টেলিফোনের লাইন ডেড হয়ে আছে। মোবাইলেও কোনও সাড়াশব্দ নেই। অদ্ভুত অবস্থা।
অর্জুন বলল, সেটাই দেখলাম। মাকে খবর দিতে পারলাম না। টাওয়ার কাজ করছে না।
ভৃগু ফিরে এল। পিছনে বছর চব্বিশের একটি যুবতী। পরনে মেখলা। গায়ের রং একটু মাজা হলেও শরীরের গঠন একেবারে নিখুঁত। মুখটিও সুন্দর।
মঙ্গলময়বাবু বললেন, স্বর্ণলতা, এঁরা আমার অতিথি। তোমার ম্যাডামের সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। তিনি কী করছেন?
ম্যাডাম এখন বৃষ্টি দেখছেন। মিষ্টি কণ্ঠস্বর মেয়েটির।
ওঁকে জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো–!
স্বর্ণলতা চলে গেল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, উনি স্বাভাবিক কথা বলেন?
একটা কি দুটো। তারপর সব গুলিয়ে যায়। মঙ্গলময়বাবু বললেন, আপনি হয়তো মানতে চাইবেন না কিন্তু আমার সন্ন্যাসীকাকা ভয়ংকর সর্বনাশ করে গেছেন।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, ব্যাপারটা আমার জানা নেই তাই কোনও মন্তব্য করতে চাই না। তবে সাধারণ কথা হল, অকাট্য প্রমাণ না পেলে মানুষ নিজের বিশ্বাস থেকে সরতে চায় না। আবার প্রমাণ পেলেও কিন্তু কিন্তু করে।
স্বর্ণলতা দরজায় এসে দাঁড়াল, আসুন। মঙ্গলময়বাবু ওদের নিয়ে প্রথম ঘর পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে ঢুকলেন। মূল্যবান আসবাব, বিশাল পালঙ্কের উপর মিসেস বড়ুয়া বসে ছিলেন। ওদের দেখে নেমে দাঁড়ালেন। এখনও সোনার মতো গায়ের রং, খাটো শরীর, মুখ বলছে একদা সুন্দরী ছিলেন। গা ভরতি গয়না।
মঙ্গলময়বাবু বললেন, এঁরা আমার অতিথি, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ইনি অর্জুনবাবু, উনি দোলগোবিন্দবাবু।
হাতদুটো এক করলেন মিসেস বড়ুয়া। তারপর দোলগোবিন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওমা! বাবা, তুমি এতদিন পরে এলে? বাবা…। থেমে গেল কণ্ঠস্বর। কিছু হাতড়াবার চেষ্টা করছেন মনে মনে।
অর্জুন বলল, আপনার বাবাকে দেখে ভাল লাগছে, তাই তো!
মাথা নাড়লেন মিসেস বড়ুয়া, বসো বসো।
দোলগোবিন্দবাবু হকচকিয়ে গিয়ে অর্জুনের দিকে তাকালেন।
অর্জুন বলল, চলুন, ওঁকে বিশ্রাম করতে দিন।
ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসামাত্র মিসেস বড়ুয়ার চিৎকার ভেসে এল, বাবা।
মঙ্গলময়বাবু চেঁচিয়ে বললেন, স্বর্ণলতা, ওকে শান্ত করো। স্বর্ণলতার গলা শোনার আগেই চুপ করে গেছেন মিসেস বড়ুয়া।
মঙ্গলময়বাবু বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার! এতটা সময় একটা কথা তো ও মনে রাখতে পারে না।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আমাকে উনি বাবা বলে ডাকলেন কেন?
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কি টাক ছিল?
হ্যাঁ। চকচকে টাক। হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোকের মুখের সঙ্গে তার কিছুটা মিল আছে। তবে কোনও সুস্থ মানুষ পাথর্ক্যটা বুঝতেই পারবেন না।
মঙ্গলময়বাবুর কথা শেষ হতেই প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ল কোথাও।
দোলগোবিন্দবাবুর মুখ থেকে ছিটকে বের হল, সর্বনাশ!
স্বর্ণলতা এসে দাঁড়াল দরজায়, উনি খুব কাঁদছেন।
কেন? মঙ্গলময়বাবু এগিয়ে গেলেন।
জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তর দিতে পারছেন না। স্বর্ণলতা ভিতরে চলে গেল।
অর্জুন বলল, আমরা গেস্টহাউসে যাচ্ছি। ও হ্যাঁ। এরকম কান্নাকাটি করতে তো ওকে কখনও দেখিনি অর্জুনবাবু। ওর আচরণ অদ্ভুত লাগছে। মঙ্গলময়বাবুকে চিন্তিত দেখাল।
হয়তো বাবার কথা মনে এসেছে। তিনি কি জীবিত? দোলগোবিন্দবাবু খুব ভেবেচিন্তে প্রশ্ন করলেন।
না। বিয়ের দু’বছর পরেই ও বাবাকে হারায়। কিন্তু অর্জুনবাবু, আপনার আজ ফিরে যাবেন কী করে? চিন্তার বিষয় হল। মঙ্গলময়বাবু বললেন।
তার চেয়ে অনেক জরুরি মিসেস বড়ুয়াকে শান্ত করা। আপনি যান। আর হ্যাঁ, আজ তো ফেরার উপায় নেই। কিন্তু আমি ভাবছি কয়েকদিন এখানে থেকে যাব। অর্জুন কথাগুলো বলে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল।
হাসি ফুটল মঙ্গলময়বাবুর মুখে, ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। ভৃগু, বাবুদের ছাতি দিয়ে গেস্টহাউসে পৌঁছে দাও।
.
গেস্টহাউসের চেয়ারে বসে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আজ যাওয়া যাবে না তা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি বললে এখানে কয়েকদিন থেকে যাবে। আমার তো এখানে থাকার কোনও মানে হয় না।
কেন?
কেন মানে? আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। ট্রেনে আলাপ হল, কিন্তু পরিচয় হল না। এখনও তুমি আমার নাম জানো না। পাকেচক্রে আমি এলাম তোমার সঙ্গে। এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে? একদিন থাকলাম, কাল জল কমলে চলে যাব। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।
সে কী? আমি ভেবেছিলাম আপনি আপনার কাজটা করবেন।
কোন কাজ?
মিথ্যে অনুসন্ধান। এখানে যেসব মিথ্যে চালু আছে সেগুলো খুঁজে বের করবেন। বাড়িতে তো চিন্তা করার মতো কাউকে রেখে আসেননি!
তা আসিনি।
তা হলে আর কিছু ভাববেন না। ভাল খাওয়া হয়েছে, একটু গড়িয়ে নিন। দুপুরটা দিবানিদ্রা দেওয়ার পক্ষে আদর্শ। বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘ ডাকছে, বাইরে অসময়ে অন্ধকার নেমেছে। দিনদুপুরেই রাতদুপুর। অর্জুন শুয়ে পড়ল।
.
দোলগোবিন্দবাবু পরমসুখে নাক ডাকছেন। মানুষটির বয়স হলেও এনার্জি লেভেল একটুও কমেনি। কিন্তু ভদ্রলোক বেশ রসিক। দোলগোবিন্দ নামটা মেনে নিয়েছেন, আসল নাম একবারও বলেননি।
অর্জুনের একটু তন্দ্রা এসেছিল। গতরাতের ক্লান্তি শরীরকে দখল করে থাকায় কখন চোখ জুড়ে গিয়েছিল যে টের পায়নি। প্রচণ্ড শব্দ সেই তন্দ্রা চুরমার করে দিতেই সে উঠে বসল। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। দ্বিতীয়বার আওয়াজটা হল। এবার খুব কাছে। মনে হল বাগানের কোনও গাছের উপর বাজ পড়ল। অর্জুন বিছানা থেকে নেমে ভেজানো দরজা খুলে বারান্দায় এল। চারধারে বৃষ্টির জল থইথই করছে। আলো কমে গিয়েছে আরও। বারান্দার থামের পাশে দাঁড়িয়ে মঙ্গলময়বাবুর প্রাসাদের মতো বাড়ির দিকে তাকাল সে। কোণের ঘরের বন্ধ জানলার কাছে এই অসময়েও আলোর প্রতিফলন। ওই ঘরে কে থাকেন?
মঙ্গলময়বাবুও বলেছিলেন, মিসেস বড়ুয়ার স্মৃতিতে কিছুই নেই। কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলে দুই-একটা শব্দ উচ্চারণ করে থেমে যান। মনে করতে পারেন না। কিন্তু আজ কী হল? বাবা শব্দটিকে মহিলা অনেকক্ষণ মনে রেখেছিলেন। তার আগে দোলগোবিন্দবাবুকে বাবা বলেই থেমে থাকেননি, বসো বসো বলেছিলেন খুব আন্তরিকতার সঙ্গে। বাবাকে যে অনেকদিন দ্যাখেননি তা তার মনে পড়েছিল বলেই অনুযোগ করেছিলেন, এতদিন পরে বলে। বলার সময় ভুলে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে তার বাবা গত হয়েছেন। কিন্তু স্মরণশক্তি হারিয়ে গেলেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তো দু একটা কথায় আটকে যায়নি। এই মহিলার রহস্য অর্জুনকে টানছিল। তার মনে হল আবার মিসেস বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করা দরকার।
বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকাল সে। কীরকম নুয়ে আছে ওরা। যেন উপর থেকে কেউ জল ঢালছে আর গাছগুলো বাচ্চা ছেলের মতো মাথা নিচু করে স্নান করছে। চোখ ফেরাতেই অর্জুন অবাক হল। বাগানের উলটোদিক থেকে কেউ এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দ্রুত গেটের দিকে চলে গেল। একে আলো কম, তার উপর গাছেরা আড়াল করে থাকায় লোকটাকে স্পষ্ট দেখা গেল না। কিন্তু অর্জুন ধন্দে পড়ল, এতদূর থেকে বোঝা গেল না যে গেল সে পুরুষ না স্ত্রীলোক। মাথা ঢাকা ছিল। ঘোমটা হতে পারে আবার বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে গামছা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু যেই যাক সে বৃষ্টিতে ভিজে যাবে কেন? ছাতা ব্যবহার করাই তো স্বাভাবিক। বাগানের ওই উলটোদিকে কী আছে তা অর্জুনের জানা নেই। যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ওদিকে কি কেউ থাকে? থাকলে সে অকারণে এভাবে ভিজবে কেন? অর্জুন ঘরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। মঙ্গলময়বাবুর বাড়ি থেকে ছাতা মাথায় ভৃগু এদিকে হেঁটে আসছে। সে দাঁড়াল।
কাছে এসে ভৃগু বলল, বড়বাবু বললেন, ওই বাবুর যদি খুব অসুবিধা না হয় তা হলে একবার উপরে যদি যান তা হলে ভাল হয়।
কেন? অর্জুন অবাক হল।
আপনারা চলে যাওয়ার পর থেকে মা কেবলই বাবা বাবা বলে ডাকছেন। কিছুতেই তাকে থামানো যাচ্ছে না। একটা কিছু মাথায় আটকে গেলে তিনি এইরকমই করে থাকেন। তাই বড়বাবু বললেন যদি মা আবার ওঁকে দেখতে পান তা হলে হয়তো শান্ত হতে পারেন। ভৃগু একটানা কথাগুলো বলল।
শুধু ওঁকেই যেতে বলেছেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ। বোধহয় ওঁকে একা দেখলে কাজ হতে পারে।
কিন্তু তিনি তো এখন ঘুমোচ্ছেন।
ঘুমোচ্ছেন?
হ্যাঁ। কঁচা ঘুম ভাঙালে ওঁর শরীর খারাপ হয়ে যায়।
ও। ভৃগু একটু ভাবল, তা হলে বড়বাবুকে এই কথা বলি।
দাঁড়াও। তুমি ভিতরে গিয়ে দ্যাখো, যদি ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকে–।
ভৃগু চট করে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মারল। তারপর ফিরে এসে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। খুব নাক ডাকছেন।
তুমি এক কাজ করো। সঙ্গে যে ছাতা এনেছ তা রেখে যাও। ওঁর ঘুম ভাঙলেই আমি বলব ওই বাড়িতে যেতে।
মাথা নেড়ে ছাতি মাথায় ফিরে গেল ভৃগু।
দরজা ভেজিয়ে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতেই দোলগোবিন্দবাবু উঠে বসলেন। লোকটা চলে গিয়েছে?
আরে! আপনি জেগে ছিলেন নাকি?
বিলক্ষণ!
তা হলে নাক ডাকছিলেন কী করে?
অভিনয়। অ্যাক্টিং। তুমি যেমন বললে কাঁচা ঘুম ভাঙালে আমার শরীর খারাপ হয়।
অর্জুন হেসে ফেলল, আপনি যাবেন কি না তা না জেনে অনুরোধ করতে চাইনি। দেখুন, মিসেস বড়ুয়া যদি আপনাকে দেখার পর শান্ত হন তা হলে ওঁর উপকারই হবে।
পাগল। হাত নাড়লেন দোলগোবিন্দবাবু, আমি বিয়ে করিনি, সারাজীবন অবিবাহিত হয়ে আছি, হঠ করে একজন বয়স্কা মহিলার বাবা হতে যাব কেন?
অর্জুন বলল, আপনি একটা ভুল করছেন। ভুল? কীরকম?
আপনি যেমন অবিবাহিত আছেন তেমনই থাকবেন, মিসেস বড়ুয়ার বাবা হিসাবে যাবেন দোলগোবিন্দবাবু।
অ্যাঁ? হা হয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
আপনি তো দোলগোবিন্দবাবু নন। ভেবে নিন দোলগোবিন্দবাবু যাচ্ছেন, আপনি যাচ্ছেন না। আপনাকে একা যেতে অনুরোধ করা হয়েছে। ওখানে যা যা কথা হবে তা মনে রেখে ফিরে এসে আমাকে বলবেন। অর্জুন হাসল, আপনি তো নিজেকে একজন মিথ্যেসন্ধানী বলে মনে করেন, কেউ আপনাকে বাবা বলে ভাবলে সেটা মিথ্যে ভাবনা। এই সুযোগে তার উৎসটা অনুসন্ধান করুন না।
ভাল বললে ব্রাদার। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আসলে এই যে পরিবেশ, বৃষ্টি, বাজের আওয়াজ, বিকেল না হতেই অন্ধকার, এই ব্যাকগ্রাউন্ডে মিথ্যেরা খুব শক্তিশালী হয়ে যায়। আর মিথ্যে শক্তিশালী হলেই তাকে সত্যি বলে মনে হয়। ধরো, তুমি সকালবেলার নরম রোদে শ্মশানের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ, কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু বৃষ্টির রাতে যখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ছে তখন ওই রাস্তায় হাঁটলেই মনে হবে কেউ তোমার পিছন পিছন আসছে। সকালে যা মিথ্যে ছিল রাতে তা সত্যি হয়ে যাবে। যাক গে, তোমার সঙ্গে এখানে এসে ভাল ভাল খাবার খাচ্ছি, কৃতজ্ঞতাবোধটা তো হারাতে পারি না। তুমি যখন বলছ তখন যাব। শ্বাস ফেললেন দোলগোবিন্দবাবু, তা আমি বলি কী, তুমি আমার সঙ্গে চলো। না না মিসেস বড়ুয়ার সঙ্গে দেখা করতে আমি একাই যাব। তুমি অন্য ঘরে অপেক্ষা করবে।
মিস্টার বড়ুয়া চাইছেন আপনি একাই ওখানে যান। সেইজন্যে একটা ছাতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। যান, আবহাওয়া আরও খারাপ হওয়ার আগে বাবার ভূমিকায় অভিনয় করে আসুন। অর্জুন বলল, ফেরার সময় চায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আসবেন।
অত্যন্ত অনিচ্ছা নিয়ে দোলগোবিন্দবাবু রওনা হলেন। ছাতি খুলে বারান্দার বাইরে পা বাড়িয়েও থমকে বললেন, এ তো বৃষ্টি নয়, বর্ষণ। তারপর প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে দূরত্বটা পেরিয়ে গেলেন। ঠিক তখনই অর্জুনের নজরে পড়ল, গেটের দিক থেকে একটি স্ত্রীলোক, যদিও আবছা দেখাচ্ছে, মাথায় কাপড়, বাগানের উলটোদিকে পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেল। ওর হাতে ছাতা নেই, বৃষ্টি আটকানোর কোনও চেষ্টাই করছে না। কিন্তু স্ত্রীলোকটি প্রচুর লম্বা। হাত বাড়াতেই গাছের নীচের ডালটা স্পর্শ করতে পারল। তারপর নিমেষেই ওদিকের বাগানে চলে গেল।
অর্জুনের মনে হল এই স্ত্রীলোকটিকে সে বাগানের বাইরে যেতে দেখেছে খানিক আগে। তখন অবশ্য ওকে স্ত্রীলোক বলে মনে হয়নি। অর্জুন মাথা নাড়ল। সমস্ত শরীর কাপড়ে মুড়ে কোনও পুরুষও তো এই জলে বের হতে পারে। কিন্তু কেন বের হবে? ছাতি না নিয়ে যেভাবে হেঁটে এল তাতে মনে হচ্ছিল চাঁদের আলোয় হাঁটছে। বৃষ্টিকে গ্রাহ্যই করছে না। বৃষ্টি থেমে গেলে ওদিকে গিয়ে দেখবে বলে ভাবল অর্জুন। সে ঘরে ঢুকল। আলো নেই। ভাগ্যিস বাইরেটা ঠান্ডা তাই পাখার প্রয়োজন হচ্ছে না। ভৃগুর উচিত এসে আলো জ্বেলে যাওয়া।
অর্জুন ভেবে দেখল এই বাড়িতে কিছুটা রহস্য রয়েছে। কিন্তু এই রহস্যগুলো পরস্পরের থেকে আলাদা। নারকোল পড়ার সঙ্গে মিসেস বড়ুয়ার স্মৃতিবন্দি হয়ে থাকার কোনো সংশ্রব নেই। আবার ওই রহস্যময় পুরুষ বা স্ত্রীলোকটির সঙ্গে মিসেস বড়ুয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আবার সেই ভদ্রলোক, যিনি মঙ্গলময়বাবুর সন্ন্যাসীকাকা, তার ভূমিকা তো আরও রহস্যময়। তার সঙ্গে মিসেস বড়ুয়ার সমস্যা জড়িয়ে থাকতে পারে কিন্তু কাঁচা বোঁটা ছিঁড়ে পড়া নারকোলের সঙ্গে থাকতে পারে না। একসময় মনে হয়েছিল তার এখানে। কিছুই করার নেই কিন্তু ক্রমশ অর্জুন বুঝতে পারছিল তার সত্যসন্ধানের জীবিকা শুরু করার পর এমন কঠিন সমস্যার মুখোমুখি সে কখনও হয়নি। এ যাত্রায় মেজর সঙ্গে নেই, অমল সোমও নেই, নেই বাইরের ঘটনার ঘনঘটা। কিন্তু মানুষের মনে বন্দি করে রাখা তথ্যকে উদ্ধার করার সঙ্গে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনাকে নস্যাৎ করার পথ খোঁজা অনেক কঠিন কাজ। তাকে এখন একাই সেই কাজটা করতে হবে।
.
দোলগোবিন্দবাবু ফিরে এলেন মিনিট কুড়ি পরে, পিছনে ভৃগু। ছাতা সামলেও সে ট্রে-তে টি-পট বাগিয়ে কাপপ্লেট এবং বিস্কুট নিয়ে এসেছে। ওগুলো টেবিলে রেখে সে হারিকেন জ্বেলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চা ঢেলে দিয়ে যাব বাবু?
না। আমরাই ঢেলে নেব। অর্জুন বলল।
রাত্রে কী খাবেন? ভাত না রুটি?
অর্জুন দোলগোবিন্দবাবুর দিকে তাকাল। তিনি কাঁধ নাচালেন, রুটি হলেই ভাল হয়। মাথা নেড়ে ভৃগুরাম চলে গেলে কাপে চা ঢালতে লাগল অর্জুন।
অভিজ্ঞতা। বুঝলে হে! বেঁচে থাকা মানে হল প্রতিটি দিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন। আমি চা খাব না। দোলগোবিন্দবাবু মাথা নাড়লেন।
কারণ আপনি ওখানে চা খেয়ে এসেছেন।
কী করে বুঝলে?
আপনার পেটের কাছে সবে চায়ের ছাপ লেগেছে।
ইয়েস। এমন করে বলল মেয়ে। হেসে বললেন দোলগোবিন্দবাবু।
মেয়ে? স্বর্ণলতাদেবীর কথা বলছেন? চায়ের কাপে চুমুক দিল অর্জুন।
না ভাই। মিসেস বড়ুয়ার কথা বলছি। আহা, কী ভাল মেয়ে। অথচ দ্যাখো, ভগবান নামক ভদ্রলোকটি কী অবিচার করেছেন ওঁর উপর। দুটো কি তিনটি কথা বলার পর খেই হারিয়ে ফেলছেন।
মিসেস বড়ুয়া আপনাকে চা খেতে বলেছেন?
হ্যাঁ।
এবার অনুগ্রহ করে বলুন ঠিক কী কী ঘটেছিল?
বলছি। একটা বিস্কুট নিচ্ছি। ওখানে বিস্কুট দেয়নি। একটা বিস্কুট নিয়ে মুখে পুরে চিবিয়ে দোলগোবিন্দবাবু ঘটনাটা শোনালেন।
ভৃগু অপেক্ষায় ছিল। তিনি পৌঁছোতেই ছাতা ফেরত নিয়ে উপরে নিয়ে গেল। মঙ্গলময়বাবু বসার ঘরে বসে বই পড়ছিলেন। দোলগোবিন্দবাবু লক্ষ করলেন, বইটার নাম তাভিলাষীর সাধুসঙ্গ।
তাকে খুব খাতির করে বসিয়ে মঙ্গলময়বাবু বললেন, আপনাকে দেখার পর আমার স্ত্রী এত আপসেট হয়ে পড়েছেন যে মাঝে মাঝেই বাবা বাবা বলে কাঁদছেন। আপনি যদি একবার সান্ত্বনা দিয়ে যান তা হলে ওর উপকার হবে।
দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করেন, কী বলে সান্ত্বনা দেব বলুন!
যেভাবে বাবারা মেয়েদের সান্ত্বনা দেয়। আমি সঙ্গে যাব না। স্বর্ণলতা আপনাকে নিয়ে যাবে ওর কাছে।
আপনি যাবেন না কেন?
আমি চাইছি এটা বাবা-মেয়ের ব্যাপার হোক। ওইজন্যেই অর্জুনবাবুকে আপনার সঙ্গে আসতে বলিনি।
ঠিক আছে, চেষ্টা করব সান্ত্বনা দিতে।
তার আগে একটা অনুরোধ করব। মঙ্গলময়বাবু টেবিলে রাখা একটা প্যাকেট থেকে সাদা গাঁধী টুপি বের করে বললেন, এটা পরে নিন।
এটা কেন?
আমার শ্বশুরমশাই গাঁধীবাদী ছিলেন। এটা ওঁর টুপি। শেষবার যখন এখানে এসেছিলেন ভুল করে ফেলে গিয়েছিলেন। তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে আমার স্ত্রী এটাকে তুলে রেখেছিলেন। আপনার মাথায় টুপিটা দেখলে খুব খুশি হবে। হাত বাড়িয়ে টুপিটা দিলেন মঙ্গলময়বাবু।
টুপি পরে একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলেন দোলগোবিন্দবাবু। তাঁকে দেখে মঙ্গলময়বাবু বললেন, এবার আমারই মনে হচ্ছে শ্বশুরমশাইয়ের কথা। স্বর্ণলতা, ওঁকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
স্বর্ণলতা যে ভিতরে যাওয়ার দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল তা লক্ষ করেননি দোলগোবিন্দবাবু। উঠে তাকে অনুসরণ করলেন।
বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন মিসেস বড়ুয়া। স্বর্ণলতা তার পাশে গিয়ে ডাকল, দেখুন, কে এসেছেন।
সেই অবস্থায় হাত নেড়ে মিসেস বড়ুয়া বোঝালেন তিনি দেখতে চান না।
দু’বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর স্বর্ণলতা ইশারা করল কিছু বলতে। অতএব দোলগোবিন্দবাবুকে এগিয়ে গিয়ে ডাকতে হল, মা।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলেন মিসেস বড়ুয়া। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন দোলগোবিন্দবাবুর মুখের দিকে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন,
কেঁদো না মা।
মাথা নাড়লেন ভদ্রমহিলা। কঁদব না। আমি, আমি—
কথা আটকে গেল। চোখ বড় হল।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
মিসেস বড়ুয়া বললেন, বসো বাবা।
পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন দোলগোবিন্দ। এই সময় তিনি কোনও সংলাপ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
মিসেস বড়ুয়া স্বর্ণলতার দিকে তাকালেন, বাবাকে চা-চা-চা–।
হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। সে দরজার কাছে গিয়ে গলা তুলে বলল, এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও, তাড়াতাড়ি।
এবার হাসি ফুটল মিসেস বড়ুয়ার মুখে। আঙুলে তুলে টুপিটা দেখালেন, বাবার টুপি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার টুপি। দোলগোবিন্দবাবু মাথা নাড়লেন।
ইস? ইস? ঘনঘন মাথা নেড়ে আচমকা চুপ করে গেলেন মিসেস বড়ুয়া।
কাজের লোক এসে চায়ের কাপ দিয়ে যেতেই মিসেস বড়ুয়া বেশ জোরে বললেন, চা চা!
চুমুক দিতে গিয়ে দোলগোবিন্দবাবু দেখলেন ওটা খুব গরম। তার অস্বস্তি হচ্ছিল ইস ইস’ শোনার পর। মনে হচ্ছিল বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকলে ধরা পড়ে যেতে পারেন। ভদ্রমহিলার মাথায় যে ক্ষীণ সুস্থতা আছে তাতেই ওই ইস শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। হাত একটু কেঁপে গেল। কয়েক ফোঁটা চা চলকে পেটের উপর পড়ল।
স্বর্ণলতা বলল, চা পড়ে গেল। ধুয়ে নেবেন?
না থাক। দোলগোবিন্দবাবু যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চা গিলে ফেলে বললেন এবার উঠি মা!
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন মিসেস বড়ুয়া তারপর শব্দ করে হেসে উঠলেন। দ্রুত বাইরে এলেন দোলগোবিন্দবাবু। পিছনে স্বর্ণলতা। সে উৎসুক মঙ্গলময়বাবুকে খবরটা দিল, এখন তিনি হাসছেন।
বাঃ। থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার ঘোষাল। আপনি আমাকে স্বস্তি দিলেন। ওটা দিন, আফটার অল ওর বাবার স্মৃতি। হাত বাড়ালেন ভদ্রলোক।
দোলগোবিন্দবাবু চটপট টুপি খুলে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে দিলেন। আমি চলি।
অবশ্যই। ভৃগু!
.
দোলগোবিন্দবাবু কাঁধ ঝাঁকালেন, এই হল ঘটনা। তবে আমি বলছি অর্জুন, মিসেস বড়ুয়ার ব্রেনের লক যদি আর একটু আলগা হত তা হলে আজ আমি নির্ঘাত ধরা পড়ে যেতাম, খুব বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন।
মিসেস বড়ুয়া এখনও জীবিত, ছিলেন বলছেন কেন?
আহা। এখন তো, বুঝতেই পারছ। দোলগোবিন্দবাবু উঠে দাঁড়ালেন। বাইরের কোনও খবরই পাওয়া যাচ্ছে না, চলো, একটু ঘুরে আসি, বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। ঘরে বসে হাঁফিয়ে উঠেছি হে।
অর্জুন বাইরে তাকাল। বৃষ্টি কমছে। সন্ধে হতে সামান্য দেরি আছে বলে বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে একটা নিস্তেজ আলো পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
অর্জুন বলল, বৃষ্টি একদম থেমে যাক, তারপর গিয়ে দেখে আসব খালের অবস্থা কীরকম।
বলতে না বলতেই বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশে মেঘ থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল এখনই বৃষ্টি পড়বে না। গত রাতের লোকদুটো টর্চ ফেরত নিয়ে গিয়েছিল। অর্জুন নিজের ব্যাগ থেকে টর্চ বের করল। তারপর পাজামা পালটে বারমুডা আর গেঞ্জিশার্ট পরে নিল। বলল, চলুন।
দোলগোবিন্দবাবু ওই বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ছাতা সঙ্গে নিলেন। মাটিতে পা-পাতা ভেজা জল জমে আছে। ওরা বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেটের কাছে এসে দেখল রাস্তায় জল জমে নেই। অর্জুন বাঁদিকে তাকাল। ওই পাশ দিয়ে রহস্যময় মূর্তি এদিকে আসা-যাওয়া করেছিল। অর্জুনের খুব ইচ্ছে করছিল বাগানের ওপাশটা দেখে আসতে। কিন্তু এই আধা অন্ধকারে ভেজা গাছের জঙ্গলে ঢুকে কতটা কী দেখা যাবে তাতে সন্দেহ হচ্ছিল। অর্জুন পা বাড়াল রাস্তায়।
একটি লোক বৃষ্টি না থাকা সত্ত্বেও ছাতা মাথায় আসছিল। তাকে দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, খালের অবস্থা কীরকম ভাই?
খাল এখন নদী হয়ে গেছে। ব্রিজ ভেসে গেছে, কবে খাল পার হওয়া যাবে ভগবান জানেন। লোকটি চলে গেল।
অর্জুন বলল, শুনলেন তো, আর ওদিকে গিয়ে কী হবে। চলুন, যে মন্দির দেখে এসেছেন সেদিকে ঘুরে আসি। ।
দোলগোবিন্দবাবু যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন।
রাস্তা এখন কাদায় ভরা। একটু পরেই মধ্যবিত্ত পাড়া শুরু হল। মধ্যবিত্ত পাড়া মনে হওয়ার কারণ, বাড়িগুলো গায়ে গায়ে, সামনে বাগান নেই। কিন্তু অর্জুন লক্ষ করল প্রায় প্রতিটি বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ। এই গ্রামটা এখন ভিজে চুপসে আছে, কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পরে নদী চোখে পড়ল। জলপাইগুড়ির তিস্তায় এখন জল নেই। বর্ষায় যেটুকু বাড়ে তা দেখে ভয় আসে না মনে। কিন্তু এই নদীর ঢেউগুলো যেভাবে ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটছে যে আতঙ্কিত হতেই হয়। জলের রং ঘোলা। অন্ধকার নেমে আসছে বলে তাতে কালচে রং মিশছে। প্রচুর জল নদীতে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, ওই যে মন্দির।
অর্জুন দেখল ঢিবির উপরে একঘরের পুরনো চেহারার মন্দির। সংস্কার হয় না বলে দেওয়ালে ফাটল ধরেছে।
কোন দেবতার মন্দির জানেন? সে জিজ্ঞাসা করল।
শ্মশানকালীর মন্দির। সকালে যে লোকটা সঙ্গে এসেছিল তার মুখে শুনেছিলাম। বছরে একবারই পুজো হয়। ভিতরে উঁকি মেরে দেখিনি। দোলগোবিন্দবাবু কথাগুলো বলেই গলার স্বর পালটালেন। নিচুস্বরে বললেন, ওই যে, দেখুন।
মন্দিরের ওপাশের চাতালে বাবু হয়ে বসে আছেন এক সন্ন্যাসী। সাদা দাড়ি, লম্বা জটা। শরীর শীর্ণ। অর্জুনরা ওঁর পিছনে বলে দেখতে পাননি। হঠাৎ সন্ন্যাসী চিৎকার করে উঠলেন, আয়, আয়, আরও নেচে আয়। ডুবিয়ে দে, ভাসিয়ে দে। তারপর আরও জোরে চিৎকার করলেন, জয় মা। ।
অর্জুন নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, মঙ্গলময়বাবুর লোক এই সাধু সম্পর্কে কিছু বলেছে?
না। সে নাকি আগে কখনও দ্যাখেনি। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।
ধীরে ধীরে অর্জুন এগিয়ে গেল সন্ন্যাসীর সামনে। দোলগোবিন্দবাবু একটু ইতস্তত করে কয়েক পা এগিয়েও থেমে গেলেন।
সন্ন্যাসী মুখ ঘুরিয়ে অর্জুনকে দেখলেন। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুই?
অর্জুন হাসল, আমি কে তা জানতে পারলে তো আপনাকে দর্শন করার কোনও প্রয়োজন হত না। দুটো হাত একত্রিত করে নমস্কারের ভঙ্গি করল অর্জুন।
সন্ন্যাসী কথা না বলে কিছুক্ষণ অর্জুনের মুখ থেকে চোখ সরালেন না। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, সেদিনের ছোকরা তুই, এইরকম কথা বলতে কে শেখাল?
আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আমার পিতৃপরিচয় জানি। আমার ঠিকানা, পড়াশোনা ইত্যাদির কথা জানা আছে। কিন্তু সেসব তো বাইরের আমার কথা, ভিতরের আমিটাকে তো জানতে পারিনি এখনও।
একটু ভাবলেন সন্ন্যাসী। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, এই গ্রামে থাকা হয়?
না। জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি।
কেন?
ভূত দেখতে। শুনেছি এই গ্রামে নাকি ভূতেরা গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। ভগবানকে তো কখনওই কেউ দ্যাখেনি কিন্তু কেউ কেউ নাকি ভূত দেখেছে। না দেখলেও অনুভব করেছে। দেখতে না পাই অনুভব করতে পারলেও খুশি হব। অর্জুন খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল।
কবে এসেছ?
গত রাতে। খাল সাঁতরে।
চমৎকার। কার বাড়িতে উঠেছ?
অর্জুন হাসল, তখন থেকে আপনি একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন আর আমি তার জবাব দিচ্ছি। এবার আমাকে চান্স দিন। আপনি নিশ্চয়ই গ্রামের এই মন্দিরে চিরকাল বাস করছেন না?
না।
কোথায় বাড়ি আপনার?
সন্ন্যাসীর কোনও বাড়ি থাকে না।
তা ঠিক। এখানে আসার আগে কোথায় ছিলেন?
দেবধামে। অলকানন্দার তীরে।
আপনি সত্যি ভাগ্যবান।
মানে?
চলে না এলে আপনাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। কত মানুষের শরীর ভেসে গেল, পাথরচাপা হয়ে রয়েছে তার হিসাব নেই। ঠিক সময়ে চলে এসেছেন বলে আমি আপনার দর্শন পেলাম। আমার সঙ্গে দোলগোবিন্দবাবু আছেন। আসুন, এসে দর্শন করুন। অর্জুন ইশারায় ডাকল দোলগোবিন্দবাবুকে।
এ কী! একে তো আজ আমি দেখেছি। সন্ন্যাসীর চোখ ছোট হল।
অর্জুন বলল, ঠিকই। ওঁর কাছেই আপনার কথা শুনে চলে এসেছি।
কী চাও বলো তো?
সত্যি কথা তো বললাম। ভূত দেখতে চাই।
দেখতে চাইলেই কি দেখা যায়? এখন এখান থেকে চলে যাও। রাত নামছে। হয়তো নদী আরও ভয়ংকর হবে।
আপনি মঙ্গলময় বড়ুয়াকে চেনেন?
কে সে? তাঁর কাকা সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছেন। সন্ন্যাসীরা কি সন্ন্যাসীদের চেনেন না?
সন্ন্যাসী হাসলেন, ছেলেমানুষ। তোমার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। একটা কথা শুনে রাখো, সংসার ত্যাগ করলেই সন্ন্যাসী হওয়া যায় না। যাও।
যাচ্ছি। কিন্তু ভুত-প্রেত নিয়ে উনি থাকেন। তারা ওঁর কথা শোনে। বিশ্বাস করুন, আমি কখনও ভূত দেখিনি। তাই দেখার ইচ্ছা নিয়ে এসেছি। ওই বাড়িতে নাকি তারা থাকে। দেখি কপালে থাকলে দেখব। অর্জুন বলল।
সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ালেন, শোনো বাবা, ভূত প্রেত বলো আর ভগবানই বলল, মানুষের মনই কল্পনা করে নেয়। মনের দরজা খোলো, সবাই বেরিয়ে যাবে। এই দরজা খোলাটা খুব কঠিন কাজ।
দরজা বন্ধ করাটা কি সহজ?
মানুষ তো নিজের মনের দরজা বন্ধ করে থাকতে ভালবাসে।
কিন্তু অন্য কেউ যদি, ধরুন, আপনার মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায় তা হলে সেটা খুলবেন কী করে? অর্জুন সতর্ক চোখে তাকাল।
ওটা আরও কঠিন কাজ। যে-সে পারে না। অনেক সাধনার পর সেই শক্তি কেউ কেউ অর্জন করতে পারে। এ কথা তুললে কেন?
শুনেছি মঙ্গময়বাবুর সন্ন্যাসী কাকার সেই শক্তি আছে।
বটে।
হ্যাঁ। আচ্ছা, নমস্কার। অর্জুন টর্চ জ্বেলে ফেরার পথ ধরে দোলগোবিন্দবাবুকে জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলেন?
বেশ উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী! দোলগোবিন্দ কাদা বাঁচিয়ে হাঁটছিলেন।
আজ সকালে ওঁকে ওই জায়গাতেই দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। না হয় উপরে একটা ছাদ ছিল তাই বৃষ্টিতে ভিজে যাননি, কিন্তু সারাদিন অভুক্ত আছেন?
সন্ন্যাসীরা তো সংসারী মানুষের মতো খাওয়া দাওয়া করেন না। হয়তো উনি চব্বিশ ঘণ্টায় একবার মাত্র খেয়ে থাকেন। কিন্তু এই সন্ন্যাসীর বেশ ইন্টারেস্টিং চরিত্র। কথা বলেন যখন, দু’রকম মানে হয়ে যায়। যে যেমন বোঝে। এই রে, আবার বৃষ্টি আসছে। উপরের কালো মেঘে বিদ্যুৎ চলকে উঠল, জল পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা।
টর্চের আলোয় চারপাশ দেখে অর্জুন বলল, তাড়াতাড়ি বাঁদিকে দৌড়োন। যেদিকে চাষের খেত শুরু। খেতের মুখেই চারটে বাঁশের উপর চাটাইয়ের ছাদ টাঙানো। চাষিরা বোধহয় প্রখর রোদে ওর তলায় এসে বিশ্রাম নেয়। বৃষ্টিতেও ওটা সাহায্য করে। তার নীচে পৌঁছে অর্জুন বলল, বাঃ। কপাল ভাল আমাদের। বসুন।
দু’পাশে দুটো খুঁটির উপর একটা তক্তা পাতা। যেটাকে স্বচ্ছন্দে বেঞ্চিও বলা যেতে পারে। সেখানে বসে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আমারই ভুল হয়েছিল। বেড়াবার কথা না তুললে গেস্ট হাউসেই আরামে থাকতে পারতাম। এই অন্ধকারে চাষের খেতে সাপের কামড় খেয়ে না মরতে হয়।
শীতকালে সাপ গর্ত থেকে বের হয় না। বর্ষায় বের হয় কি না জানি না। তবে পড়ে জেনেছি, বেশিরভাগ সাপের দাতে বিষ থাকে না অর্জুন বলল।
বৃষ্টি পড়ছে বেশ জোরে। চাটাইয়ের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি জলের কণা ওদের শরীরে নেমে আসছিল। এখন অন্ধকার এত ঘন যে বৃষ্টিও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালে মুহূর্তের জন্যে চারপাশ সাদা হয়ে গেলে তাকে। দেখা যাচ্ছিল।
বেঞ্চিতে বসার পর অর্জুন টর্চ জ্বালেনি।
হঠাৎ দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, সারাদিন কী সত্যসন্ধান করলে?
নাথিং। কিছুই না।
দিনটা নষ্ট হল তো? দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন, আমার আজকের দিনটা নষ্ট হয়নি। মিথ্যে অনুসন্ধানে আমি অনেকটা এগিয়ে গেছি।
কীরকম?
এই যেমন নদীর গায়ের মন্দিরের সন্ন্যাসী। সকালে দেখে মনে হয়েছিল, ওঁর রাগারাগি করা একটা মুখোশমাত্র, মিথ্যে। কিন্তু প্রমাণ ছিল না। এখন তো সব জলের মতো পরিষ্কার। ওঁর সম্পর্কে সেই মিথ্যেটা আর আমার মনে নেই।
এত চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?
তার মানে?
সূর্য পৃথিবীর চারপাশে চক্কর মারছে, এটা সত্যি না মিথ্যে।
মিথ্যে।
কিন্তু এই মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করত আপনার আমার পূর্বপুরুষ। কেউ এর প্রতিবাদ করলেই তাকে জেলে ঢোকানো হত। ওই মিথ্যেকে দূর করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক সময় লেগেছিল। আর আপনি এত তাড়াতাড়ি লোকটাকে বুঝে গেলেন?
অর্জুনের কথা শেষ হতেই কাছাকাছি কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল। প্রথমে একটা, তারপর অনেকগুলো।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আপদগুলো কোত্থেকে এল? টর্চটা জ্বালো তো। কামড়ে না দেয়। কুকুর কামড়ালে যত ইঞ্জেকশন দিতে হয় শিয়াল কামড়ালে তার ডবল দরকার হয়।
হোক। এইসব তথ্য কোথায় পেলেন জানি না কিন্তু টর্চ জ্বালব না। শেয়াল রাতে দেখতে পায়। আমাদেরও দেখেছে। কিন্তু অন্য কেউ আমাদের দেখুক তা আমি চাই না। অর্জুন নিচু গলায় বলল।
অন্য কেউ মানে? কে দেখবে? আমরা গেস্ট হাউসে আছি, খাবার খাচ্ছি মঙ্গলময়বাবুর সঙ্গে। সেই আমরা যখন বেরিয়ে এলাম তখন ওঁদের জানিয়ে আসিনি। কিন্তু ওঁরা যে লক্ষ রাখেননি তার গ্যারান্টি কোথায়? আমরা কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে কথা বলছি তা জানতে কেউ পিছন পিছন আসতেও পারে। বৃষ্টিতে অন্ধকারে সে নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে তাল রাখতে পারেনি, আলো জ্বেলে তাকে সাহায্য করার কী দরকার?
দোলগোবিন্দবাবু গোঁফে আঙুল বোলালেন, এটা আমার মাথায় আসেনি।
বৃষ্টির থামার লক্ষণ নেই। এর মধ্যে জলকণাগুলো ওদের মাথা ভিজিয়ে দিয়েছে একটু একটু করে। অর্জুন বলল, এভাবে সারারাত না বসে থেকে চলুন হাঁটা শুরু করি।
আর একটু দেখলে হত না? দোলগোবিন্দবাবু ইতস্তত করলেন। ঠিক তখনই পাশের রাস্তায় টর্চের আলো দেখা গেল। কেউ একজন নদীর দিক থেকে হেঁটে আসছে। বিদ্যুৎ চমকালে দেখা গেল লোকটির মাথা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত বর্ষাতিতে ঢাকা। কপালের সামনে টুপির হুড থাকায় চিবুকের আদলটুকুই বোঝা গেল, মুখ দেখা গেল না।
চাপা গলায় অর্জুন বলল, চলুন।
এই বৃষ্টিতে? দোলগোবিন্দবাবু ফিসফিস করে বললেন, নির্ঘাত নিমোনিয়া হয়ে যাবে। ছাতায় কোনও কাজ হবে না।
তা হলে আপনি এখানে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করুন। আমি এগোচ্ছি। লোকটি ততক্ষণে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে। অর্জুন দ্রুত রাস্তায় পৌঁছোতে গিয়ে বুঝল ধীরে পা না ফেললে আছাড় খেতে হবে। মাটি ভয়ংকর পিছল।
সতর্ক পায়ে হাঁটছিল অর্জুন। লোকটা মাঝে মাঝে টর্চ চালু করছিল বলে এই বৃষ্টিতেও তাকে অনুসরণ করতে অসুবিধে হচ্ছিল না। এই সময়ে এমন দুর্যোগে বিপদে না পড়লে কেউ বর্ষাতি চাপিয়ে বাইরে বের হবে না। কী বিপদে পড়েছে লোকটা?
জল বেশ ঠান্ডা। কাঁপুনি আসছিল। লোকটার সঙ্গে দূরত্ব বাড়লেও দৃষ্টির বাইরে যায়নি। ভয়ংকর শব্দে কোথাও বাজ পড়ল। তার আগে পৃথিবী ঝলসে উঠল কয়েক লহমার জন্যে। লোকটাকে দাঁড়াতে দেখল অর্জুন। ওই বাজ এখানে পড়লে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না।
খুব সন্দেহজনক বুঝলে?
পিছন থেকে দোলগোবিন্দবাবুর গলা ভেসে আসতে অর্জুন দেখল তিনি প্রায় পিঠের কাছে চলে এসেছেন।
কথা বলবেন না! আপনি ওখানে থেকে গেলেই তো পারতেন!
আমাকে কি পাগলা মশা কামড়েছে? থাকলে সকালে এসে মুখাগ্নি করতে হত তোমাকে। চলো, ও এগোচ্ছে।
দূরত্বটা অন্তত তিরিশ গজের। যখন টর্চের আলো জ্বলছে না তখন ওকে আন্দাজে ঠাওর করতে হচ্ছে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আমরা তো মঙ্গলময়বাবুর বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি। ও যেখানে যাচ্ছে যাক, খামোকা ফলো করার কী দরকার?
তখনই বিদ্যুৎ চমকাল। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল সামনের রাস্তায় কোনও মানুষ নেই, বর্ষাতি পরা লোকটা উধাও হয়ে গিয়েছে। এখানে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, লুকোবার কোনও জায়গা নেই। তা ছাড়া এতটা পথ আসার সময় লোকটার মনে নিশ্চয়ই সন্দেহ ঢোকেনি, ঢুকলে একবার অন্তত পিছন ফিরে তাকাত। তা হলে আচমকা উবে গেল কেন?
দোলগোবিন্দবাবু ফিসফিস করে বললেন, খুব বেঁচে গেছি ভাই। রাম রাম বলো। বলেই জপতে লাগলেন, রাম, রাম, রাম রাম।
একটু এগোতেই মঙ্গলময়বাবুর বাড়ির লোহার গেটের সামনে পৌঁছোল ওরা। গেট খোলাই থাকে। বেরোবার সময় দেখে গিয়েছিল। ভিতরে ঢুকে অর্জুন নিশ্চিন্ত হল। ওই লোকটা এই গেট দিয়েই ভিতরে ঢুকে গেছে।
বৃষ্টি এখন টিপটিপ করে পড়ছে। অর্জুন বাড়ির উলটোদিকের বাগানের দিকে তাকাল। ঘন জঙ্গলে অন্ধকার চাপ হয়ে রয়েছে। এখন ওদিকে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।
.
পোশাক বদলে পায়ের কাদা পরিষ্কার করে অর্জুন বলল, এখন এক কাপ চা পেলে চমৎকার হয়। কিন্তু শ্রীযুক্ত ভৃগুকে পাব কী করে? আমরা যখন বের হলাম তখন এই ঘর যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে।
ঠিক। বাইরের লোক ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে গেলে কেউ টের পেত না।
না বাবু। এখানে কেউ চুরি করতে সাহস করবে না। দু’হাতে চায়ের ট্রে ধরে ঘরে ঢুকল ভৃগু।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, শাবাস। কিন্তু বাবা, তুমি কী করে জানলে যে আমরা ফিরে এসেছি?
জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম। ভৃগু বলল, তবে কিনা, রাত বিরেতে আপনারা ঘরের বাইরে না গেলেই ভাল করতেন।
কেন? অর্জুন চায়ের কাপ তুলে নিল।
আপনারা বিশ্বাস করবেন না হয়তো, কিন্তু আমি জানি, তেনারা আছেন।
ছেলে না মেয়ে?
আপনি রসিকতা করছেন বাবু। মানুষের দুটো ভাগ থাকে, তেনাদের থাকে না। মানুন কি না মানুন। ভৃগু ফিসফিস করে বলল।
দোলগোবিন্দবাবু মাথাটা সামনে বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁদের দেখেছ?
জলে বাস করলে কুমির দেখব না?
সব জলে কুমির থাকে না। দোলগোবিন্দবাবু সোজা হলেন।
কিন্তু এখানে আছে। অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে এখানে। অমাবস্যার রাতে কত ছায়াছায়া মূর্তি বাগানে ঘুরে বেড়ায়। থাক গে, আপনাদের যা ইচ্ছে তাই করবেন, বড়বাবুর অতিথি আপনারা। ভৃগু চায়ের কাপ খালি হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
আমরা এখানে কেন এসেছি তা নিশ্চয়ই তুমি জানো? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
না বাবু। আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর জানব কী করে?
নদীর ধারে যে পোড়ো মন্দির রয়েছে, সেখানে একজন সন্ন্যাসী থাকেন। তাঁকে নিশ্চয়ই তুমি দেখেছ? খুব জাগ্রত সন্ন্যাসী। অর্জুন লোকটার মুখ লক্ষ করল।
সব ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার পরেও কারও মনে যদি সংসারের টান ফিরে আসে তা হলে কি আর তাকে সন্ন্যাসী বলা যায়? ট্রে তুলে নিল ভৃগু। তারপর মাথা নিচু করে টিপটিপ বৃষ্টিতে বাড়ির দিকে চলে গেল।
কী যে বলল তার কিছুই বুঝলাম না। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।
অর্জুন কোনও কথা বলল না। তার মনে হচ্ছিল ভৃগু একটা রহস্যের ইঙ্গিত দিয়ে গেল। কিন্তু যে ভূত বিশ্বাস করে তার রহস্য করার ক্ষমতা কি থাকে?
.
রাতের খাবার গেস্টহাউসের ঘরেই পৌঁছে দিয়েছিল ভৃগু। বলেছিল মঙ্গলময়বাবুর শরীর ভাল নেই বলে রাতে খাবেন না, তাই অর্জুনদের কষ্ট করে উপরে না যেতে বলেছেন। মুরগির মাংস, ঝিলা মাছের ঝাল আর ভাতা দোলগোবিন্দবাবু ঝিলা মাছ পেয়ে খুব খুশি। বলেছিলেন, ভাই অর্জুন, এখানে আসা সার্থক হল। কতদিন পরে খাচ্ছি মাছটা। লোয়ার অসম ছাড়া কোথাও এই মিষ্টি মাছ পাওয়া যায় না।
খেয়ে নিন। সব মাছ এখন সাগরে চলে গেছে বন্যায় ভেসে ভেসে।
ঘুম ভেঙেছিল যখন তখন বাইরে অন্ধকার। ঘড়িতে ভোর পাঁচটা। বাইরে বেরিয়ে অর্জুন দেখল, বৃষ্টি নেই কিন্তু আকাশজুড়ে মেঘ আর মেঘ। এই সময় সাধারণত আলো ফুটতে শুরু করে। অর্জুন পোশাক পালটে বেরিয়ে এল। দোলগোবিন্দবাবু বাচ্চা ছেলের মতো ঘুমোচ্ছেন। ওঁকে বিরক্ত করল না সে।
মঙ্গলময়বাবুর বিশাল বাড়ির কোথাও আলো নেই। মানুষগুলো সঙ্গে বাড়িটাও যেন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। অর্জুন গেটের কাছে এসে যেদিক দিয়ে সেই পুরুষ বা স্ত্রীলোকটিকে যাওয়া আসা করতে দেখেছিল সেদিকে হাঁটতে লাগল সতর্ক হয়ে। গাছগুলো ভিজে ঢোল হয়ে আছে। পাখিদের এখন চিৎকার করার কথা কিন্তু তারাও শব্দহীন। সরু ঘাসের পথ দিয়ে অনেকটা ঘোরাঘুরি করেও সন্দেহজনক কিছু দেখা দূরের কথা, কোনও মানুষ চোখে পড়ল না। অথচ বৃষ্টির মধ্যেও এখান থেকেই মানুষ বেরিয়েছে, এসেছে। অর্জুনের স্থির ধারণা, কাল রাতের ওই বর্ষাতি পরা লোকটাও গেট পেরিয়ে বাগানের এই দিকেই ঢুকেছিল। কিন্তু তাদের কোনও চিহ্ন এখন এখানে নেই। নিঃশব্দে বাগান পেরিয়ে এসে অর্জুন দেখল মানুষ সমান তারের বেড়ার ওপাশে চাষের খেত। তারপর নদী। নদীর জল এখন চাষের খেতের অনেকটা গ্রাস করেছে। জল যদি আরও বেড়ে যায় তা হলে নির্ঘাত মঙ্গলময়বাবুর বাড়িটা রক্ষা পাবে না। মঙ্গলময়বাবু তার জীবন বিপন্ন ভেবে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু বিপদ কোন দিক থেকে আসবে তা তিনি জানেন না। ওই নদীও তো তার বিপদের কারণ হতে পারে।
ফেরার সময় অর্জুন রাস্তা বদলাল। ঘাসের পথ দিয়ে না এসে সে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। জল চপচপে গাছের ডালের জন্যে চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। সে খুব সতর্ক হয়ে প্রায় নিঃশব্দে চলছিল।
খানিকটা এগোতেই ত্রিপলটা চোখে পড়ল। ঘন ঝোঁপের মাঝখানে ত্রিপল টাঙানো। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পাঁচ মিনিট। ওই সময় পাতার আওয়াজ হল। কেউ দৌড়ে আসছে। তারপরই লোকটাকে দেখা গেল। নেংটি ইঁদুরের মতো দেখতে। হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা। মুখ ভরতি দাড়ি গোঁফ। চার ফুটের বেশি লম্বা নয়। হাতে একটা থলি। ঘাসের পথ থেকে জঙ্গল সরিয়ে ত্রিপলের ছাউনির সামনে এসে নাকি গলায় বলল, বাবা এনেছি। আমি ঢুকব না আপনি আসবেন?
সব ঠিক আছে তো? ত্রিপলের ছাউনি থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ভেসে আসতেই লোকটা বলল, সব ঠিক আছে।
এবার যে লোকটি ছাউনির নীচ থেকে বেরিয়ে এল তাকে বৃদ্ধ বলা যায়। ছোটখাটো চেহারা, কাঁধ ছোঁয়া বাবরি চুলে রুপোর ঝিলিক। দাড়ি গোঁফও সাদা হয়ে গেছে কিন্তু শরীরের গঠন বলছে লোকটা বেশ শক্তিশালী। ওর পরনে লাল কাপড়, ঊর্ধ্বাঙ্গে লাল ফতুয়া, কপালে বিশাল লাল তিলক। বাজখাই গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গাঁজা খেয়ে পড়ে ছিলি? দেরি হল কেন?
বৃষ্টি না থামলে আসব কী করে? এই নিন। একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল প্রায় বামন লোকটা।
প্যাকেট খুলল বৃদ্ধ। একটা মাঝারি সাইজের দিশি মদের বোতল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। তারপর বলল, পাকে পড়ে এসব খেতে হচ্ছে। হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে। তবে আর বেশিদিন নেই। হুম।
অনেক কষ্ট করে জোগাড় করেছি বাবা। বাইরে থেকে সাপ্লাই আসছে না যে! তবে হ্যাঁ, নৌকা নিয়ে এসেছি। যেমন আপনি বলেছিলেন! বামন বলল।
খাদ্যদ্রব্য?
সব দোকান বন্ধ। শ্মশানের যে চণ্ডালের ঘর থেকে ওটা গেঁড়িয়েছি তার কাছে শুধু পান্তাভাত ছিল। ওটা কি আনা যায়?
ছাই হয়ে যাবি! নাকি বলব গলাটা টিপে দিতে?
সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করল বামন, আমার কী দোষ বলুন। আচ্ছা, দাঁড়ান। সে ঘুরে দাঁড়াতে বৃদ্ধ বলল, এখন থাক। কিছু মাংস রয়ে গেছে। তাই দিয়ে সকালবেলাটা চালিয়ে নেব। ওই ভৃগু ব্যাটার সঙ্গে তো ভাব করেছিস, বেলা হলে ওর কাছে কিছু চেয়ে নিস। তোর বউ কোথায়?
তাকে তো দেখছি না। আপনার এখানেই তো থাকার কথা।
ঘুমোনোর আগে আমার পা টিপে দিচ্ছিল। ঘুম ভাঙতে দেখি নেই। এই মেয়েছেলে তোর হাতছাড়া হল বলে। আমাকে বলছে ভৈরবী করে নিতে।
তাই নিন। আমি আর বোঝা বইতে পারছি না। বামন বলল।
তা পারবে কেন? বাপের বাড়ি থেকে যখন ভাগিয়ে এনেছিলে তখন কত লম্বা লম্বা বাক্যি ঝেড়েছিলে। হরিদ্বারে আশ্ৰম আছে, রুদ্রপ্রয়াগে ডেরা আছে। সব ভাঁওতা। ওপাশের ঘাসের রাস্তা থেকে একটি স্বাস্থ্যবতী মহিলা কথাগুলো বলতে বলতে হাতে থলে নিয়ে ত্রিপলের সামনে দাঁড়াল।
বৃদ্ধ বলল, ভাগ্যিস মিথ্যে বলেছিল। সত্যি হলে তো এখন তোকে খুঁজে পাওয়া যেত না। হাজার হাজার মানুষের মতো তোকেও খুঁজে কেউ পেত না। থলেতে কী আছে?
আমার পিন্ডি, তোমাকে গেলাতে হবে না? ত্রিপলের ছাউনির তলায় ঢুকে গেল মহিলা। বামন দাঁত বের করে বলল, যাক সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। মুখটা পোড়া কাঠ কিন্তু মনে মৌচাক।
বোতল থেকে খানিকটা মুখে ঢেলে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে থেকে ধীরে ধীরে গিলে ফেলল বৃদ্ধ। তারপর বলল, তোর সঙ্গে ভৃগুর কথা কবে হবে? মিছিমিছি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কী করে হবে? আপনি তো বলেই খালাস। ওই যে সোনার লতা নামের মেয়েমানুষটা দিনরাত বড়গিন্নির গা ঘেঁষে থাকে, সে থাকতে কিছু হবে না। বামন বলল।
সে যাতে না থাকে তার ব্যবস্থা কর।
কী করে?
ভেবে বলব। নৌকা নিয়ে চলে যা। একটা মুরগি আর বড় বোতল নিয়ে আয়। ফতুয়ার পকেট থেকে কয়েকটা একশো টাকার নোট বের করে ছুঁড়ে দিল বৃদ্ধ। এখন আমি সাধনায় বসব। তেনাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
বউকে বলব এখন ভিতরে না থাকতে? বামনের মুখে ভয় স্পষ্ট।
নিজের চরকায় তেল দে, যা! তাড়াতাড়ি আসিস। বামন দ্রুত মিলিয়ে গেলে বৃদ্ধ বোতল নিয়ে ছাউনির তলায় চলে গেল। বাইরে থেকে ভিতরটা দেখা যায় না। কিছুক্ষণ পরে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসতে লাগল। ওগুলো যে প্রেত ডাকার মন্ত্র তা বুঝতে পেরে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, চলুন কেটে পড়ি।
অর্জুনের মনে হল, আরও একটু অপেক্ষা করা উচিত। সে পা বাড়াল।
.
মঙ্গলময়বাবুর জ্বর এসেছে। বিছানা থেকে নামতে পারছেন না। ভৃগু গেস্টহাউসে ব্রেকফাস্ট পৌঁছে দিয়ে খবরটা জানাল।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েছ?
ডাক্তার তো থাকেন পাশের গ্রামে। আসার পথ তো এখন বন্ধ।
ক্যালপল বা ক্রোসিন বাড়িতে থাকলে খাইয়ে দাও।
বড়বাবু হোমিওপ্যাথি ওষুধ ছাড়া খান না।
হঠাৎ দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, মদ্যপান করেন না?
ওঁর কাকা খুব মদ খেতেন। বাবা অল্পস্বল্প। ওঁর মা ওঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন। তাই কখনও ছুঁয়েও দ্যাখেননি।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, যে রাতে এখানে এসেছিলাম তখন লোকদুটো বলেছিল এই বাড়িতে ভয়ংকর কুকুর আছে। একটা না, দুটো। কাল রাতে তাদের দেখিনি তো। আমরা তো অন্ধকারেই ফিরেছিলাম।
সত্যি কথা বলছি বাবু। দুটো কুকুর ছিল। বিশাল চেহারার কুকুর। মাস ছয়েক আগে ভোরবেলায় দেখা গেল দুটোই আমগাছের নীচে মরে পড়ে আছে। গলা টিপে খুন করা হয়েছে। ওদের মাটিতে পুঁতে দেওয়ার পর বড়বাবু বললেন, খবরটা যেন বাইরের লোক জানতে না পারে। সবাই ভেবে নেয় রাতে কুকুর বাগানে ছাড়া থাকে। তাই চোর ঢোকে না। কথাটা কাউকে বলবেন না। ভৃগু গোপন খবর দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল।
আর এই স্বর্ণলতা? ইনি মনে হয় এই গ্রামের মেয়ে নন। অর্জুন হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।
নয় তো। কোকড়াঝাড়ের মেয়ে। পেশায় নার্স। বড়বাবু পছন্দ করে নিয়ে এসেছে। এর বেশি জিজ্ঞাসা করবেন না বাবু। ভৃগু বলল।
.
ব্রেকফাস্ট খেয়ে দোলগোবিন্দবাবু জোর করলেন খালের অবস্থা দেখে আসার জন্যে। ভদ্রলোক যেন বন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হঠাৎ ভৃগুকে কুকুর দুটোর বিষয়ে কেন প্রশ্ন করলে?
দেখতে পাইনি বলে। অর্জুন জবাব দিল।
চেপে যাচ্ছ। রাতে কুকুর ছাড়া থাকলে বাগানের এক কোণে বুড়োটা জমিয়ে থাকতে পারত না। কুকুর ওর বারোটা বাজিয়ে দিত। তা দেয়নি মানে কোনও কুকুর বাড়িতে নেই। এটাই তো ভেবেছিলে? দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন।
অর্জুন মাথা নাড়ল, স্বীকার করছি, আপনি প্রকৃত মিথ্যেসন্ধানী।
থ্যাঙ্ক ইউ।
এখন বৃষ্টি নেই কিন্তু আকাশ থেকে মেঘ না সরায় সূর্যের দেখা নেই। রাস্তায় কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে খালের ধারে পৌঁছোতেই দোলগোবিন্দবাবুর চোখ বড় হয়ে গেল। সর্বনাশ! এ কী দেখছি।
অর্জুন দেখল খাল নদী হয়ে গিয়েছে। প্রবলবেগে স্রোত বইছে। এর মধ্যে একটি মৃতদেহ নিয়ে লোকজন এসেছিল। খাল পেরিয়ে শ্মশানে যেতে না পেরে খানিকটা দূরে, এপারেই দাহের ব্যবস্থা করছে। সাঁকোর চিহ্ন নেই। দোলগোবিন্দবাবু করুণ গলায় বললেন, কী করে ওপারে যাবে?
গিয়েও তো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। অর্জুন বলল।
কেন?
খালের ওপারে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে জল দেখছিল। ওই দিকটা একটু উঁচু। সে বলল, দেখুন তো, বাঁদিকের লোকটা স্টেশনমাস্টার কি না!
চোখের উপর হাত রেখে ঠাওর করার চেষ্টা করলেন দোলগোবিন্দবাবু। তারপর উত্তেজিত হলেন। হাত নেড়ে চিৎকার করলেন, মাস্টার। ও মাস্টার। মাস্টার।
খালের দূরত্ব অতিক্রম করে আওয়াজ পৌঁছোচ্ছিল না ওপারে। কিন্তু একটা লোককে লাফাতে দেখে স্টেশনমাস্টার হাত নাড়ল। অর্জুন বলল, আপনার কথা শুনতে পাবে না।
তখন অদ্ভুত কাণ্ড করলেন দোলগোবিন্দবাবু। হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝখানে ঠোঁট নিয়ে ট্রেনের মতো চলতে থাকলেন। ইঞ্জিনের শব্দটা শুধু অর্জুন শুনতে পেল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তা দেখে ওপার থেকে স্টেশনমাস্টার হাত নাড়তে লাগলেন। দুই হাত দিয়ে চিহ্ন আঁকল। তার মানে ট্রেন চলছে না।
দোলগোবিন্দবাবু বললেন, কী করবে ভাই!
আপনি তো জলে পড়ে নেই। খাওয়া দাওয়াও মন্দ হচ্ছে না। চলুন।
দোলগোবিন্দবাবু ফেরার পথ ধরে বললেন, আসলে কী জানো, কারও বাড়িতে অযথা পড়ে থাকতে একটুও ভাল লাগে না।
অযথা বলছেন কেন? মিথ্যের সন্ধান করুন। সময় কেটে যাবে।
বলছ?
অর্জুন জবাব দিল না। তার চোখ তখন ভোরে দ্যাখা সেই বামন লোকটির দিকে।
খালের তীব্র স্রোত সামলে ছোট্ট নৌকোয় চেপে এপারে আসছে লোকটা। নৌকো না বলে ডিঙি বলাই ভাল। লোকটার শরীরের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। এপারে এসে তীর ধরে ধরে সে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ডিঙিটাকে। অর্জুন হেসে বলল, আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ওকে রাজি করান ওপারে নিয়ে যেতে।
ঠিক বলেছ। দোলগোবিন্দবাবু ছুটলেন, ও ভাই ও ভাই বলতে বলতে।
লোকটা ডিঙি দাঁড় করিয়ে কুতুকুতু চোখে তাকাল, ডাকছেন কেন?
ততক্ষণে কাছে পৌঁছে গিয়েছেন দোলগোবিন্দবাবু। আমাদের ওপারে পৌঁছে দেবে? যা টাকা লাগবে তা দেব।
তিনজন চাপলে এটা ডুবে যাবে। পারব না। মাথা নাড়ল লোকটা।
এক এক করে পার করে দাও তা হলে–!
টাইম নেই।
একটু যদি কষ্ট করে ভাই–!
যাবেন কোথায়?
ট্রেন ধরব। বলেই গম্ভীর হলেন দোলগোবিন্দবাবু, ট্রেন বন্ধ তা খেয়াল ছিল না।
খিলখিল শব্দে হাসল লোকটা। ট্রেন এসে তো ধরবেন? ওপাশে নাকি রেললাইনের উপর দিয়ে জল বইছে। ব্রিজ ভেঙেছে। দাদু, ওপারে গিয়ে কোনও লাভ হবে না।
অ। তুমি যাচ্ছ কোথায়?
বাজার করে নিয়ে এলাম। নিয়ে গেলে রান্না হবে। যাই?
কাছে এসে অর্জুন কথাগুলো শুনছিল। ডিঙির খোপে চটের ব্যাগ রাখা আছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল, এত বৃষ্টিতেও দিশি মদের দোকান খোলা পেলে?
হাঁ হয়ে গেল লোকটা। তো তো করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী করে জানলেন?
দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন হেঁ হেঁ শব্দ করে। সবাই পায় না, আমার এই ভাইটি পেয়েছে। আশ্চর্য ক্ষমতা। তাকালেই বুঝতে পারে আড়ালে কী লুকোনো আছে।
শোনামাত্র লোকটা ডিঙি চালু করল। যতটা সম্ভব গতি বাড়িয়ে সে চেষ্টা করল দূরে চলে যেতে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, তুমি দেখছি ওকে বুঝতে পেরেছ!
আপনিও তো পেরেছেন।
মাথা নাড়লেন দোলগোবিন্দবাবু, দ্যাখো, আমি ভেবে দেখলাম ওই সত্যসন্ধান আর মিথ্যেসন্ধানের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই, সত্যের সন্ধান পেলে যেমন মিথ্যেটা ধরা পড়ে যায় তেমনি মিথ্যের সন্ধান পেলে সত্য বেরিয়ে আসে। তবে তুমি ভাই গ্র্যাজুয়েট আর আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্র, চলো।