ট্রাফিক জ্যামের জন্য
১০.
ট্রাফিক জ্যামের জন্য চিড়িয়ার মোড় পার হয়েই বাসটা দাঁড়িয়ে গেল। টালা ব্রিজের ওপরও যানবাহন জমে রয়েছে, হয়তো শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পর্যন্তও এই অবস্থা। এই জট কখন ছাড়বে, সেজন্য বসে থেকে সময় নষ্ট না করে শিবা বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল।
কিছুটা এগোতেই তার চোখে পড়ল উৎপল চট্টরাজকে, দুটো বাসের মাঝে এক হাত ফাঁক দিয়ে গলে রাস্তার ওপারে যাওয়ার জন্য দোনামনা করছে।
উৎপলবাবু, উৎপলবাবু। শিবা হাত তুলে চিৎকার করল। উৎপল মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
শিবা ছুটে এসে বলল, এভাবে কখনও পার হবেন না।
বড্ড তাড়া রয়েছে…তোমার খবর কী? তারপর তো আর দেখা হল না। উৎপলকে কিছুটা অপ্রতিভ দেখাল।
খবর তো আপনিই দেবেন। জোনাকির গোলমাল কি মিটেছে? দিদি, টুটু এরা কোথায়?
ধর্মঘটের ব্যাপারটা তার পরের দিনই, আমাকে আর জব্দ করতে না পেরে ওরা তুলে নেয়। ভাল কথা, সেদিন ওদের চারজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়, দুজন অ্যাডমিটেড হয়েছিল। ওরা রটায় আমি নাকি সাত-আটজন গুণ্ডা এনে ওদের পিটিয়েছি। উৎপল হো হো করে হেসে উঠল। শিবা হাসল না।
তা হলে আর গোলমাল নেই?
গোলমালের থেকেও বেশি, এখন সমস্যার পাহাড় জমে গেছে। রাস্তায় এভাবে দাঁড়িয়ে অত কথা তো বলা যায় না, সংক্ষেপে বললে, আসল যে ইউনিয়ন, তারা এখন ঠিক করেছে সমবায় ভিত্তিতে কারখানা তারাই চালাবে, এই নিয়ে এখন কথাবার্তা চলছে। মালিক গোরাচাঁদ সেন লেবারদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, ই এস আই-এর টাকা গায়েব করেছে, নানান দেনা চারধারে, টেলিফোনের টাকা দেয়নি, বিদ্যুতের সত্তর হাজার টাকা বাকি, ট্যাক্স বাকি; ম্যানেজমেন্টের মোট প্রায় ষাট লক্ষ টাকা দেনা। বলছে এসব শোধ দিয়ে তবেই সমবায় হবে। এদিকে লকআউট করার অজুহাত বানাতে নিজেদের লোক দিয়ে সাজানো ধর্মঘট বাধাতে চেয়েছিল আমাকে তাড়াবার ইস্যু তুলে। সেটা ভেস্তে গেছে, ঠিকমতো বললে, তোমারই জন্য।
শিবার মুখে রক্ত ছুটে এল। প্রশংসা অবশ্যই তার ভাল লাগে, অস্বস্তিও হয়।
আপনিই তা হলে ওদের পথের কাঁটা?
অন্যতম, একমাত্র কাঁটা নই। ব্যাপারটা কী জানো, এতগুলো পরিবারকে পথে বসিয়ে, রাজনীতি করা লোকেদের আর প্রোমোটারের সাপোর্টে কারখানা তুলে দিয়ে বাড়ি তৈরি করে বিক্রি করাটা—
আমি এসব রাজনীতি-টিতি একদম বুঝি না, বোঝার দরকারও নেই। নিরীহ, সৎ মানুষ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করা উচিত, শুধু এইটুকুই বুঝি। এখন যাচ্ছেন কোথায়?
কোয়ার্টারে। এখন আমি একাই ওখানে থাকি। আবার কবে কী ঝামেলা বাধে তার ঠিক নেই, তাই ওদের আর নিয়ে যাইনি।
আমার একটা উপকার করবেন? শিবার মুখে এবং স্বরে মিনতি ফুটে উঠল।
অবশ্যই করব, যদি সাধ্যের মধ্যে হয়। তুমি যা করেছ আমাদের জন্য তো। শিবা তাকে থামিয়ে দিল।
ওসব কথা থাক। আপনার কোয়ার্টারে একজনকে থাকতে দেবেন? আমার ট্রেনার, বয়স্ক লোক, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তিন কুলে কেউ নেই, একা মানুষ। ওঁকে যদি থাকতে দেন, তা হলে আমার খুব উপকার হয়। আমি আবার ন্যাশনালে নামব, গোসসারের কাছেই ট্রেনিং করছি। ওঁর খাওয়াদাওয়ার জন্য আপনাকে কিছু করতে হবে না, শুধু থাকতে দেওয়া। শিবা প্রায় এক নিশ্বাসে বলে গেল কম্বিনেশন পাঞ্চ করার মতো দ্রুতগতিতে।
আরে, এ আর এমনকী, সঙ্গে একজন থাকলে, তার ওপর আবার বক্সিং ট্রেনার, তো আমার বরং সুবিধাই হয়। আর খাওয়াদাওয়া তো আমার সঙ্গেই।
তিন-চার মিনিট পর শিবাকে দেখা গেল সে প্রায় ছুটে চলেছে লালবাগান জিম এর দিকে।
.
তিনদিন পর ফ্র্যাঙ্ক গোমস ননীর রিকশা থেকে নিতুর দোকানের সামনে নামল।
সাহেব আপনার লগে দেখা কইরতে চায়, তাই লইয়া আইলাম।
সাহেব শুনেই নিতু অস্বস্তিতে পড়ল। তবে রংটা ঘোর কালো, এটাই যা ভরসা। বাংলাটাংলা বলতে যদি নাও পারে নিশ্চয় বুঝতে ঠিকই পারবে। সে ফিসফিস করে ননীকে বলল, কে? আমার কাছে কেন?
গোমসসার! শিবারে ইনি তো বক্সিংয়ের অহিন্দি সব চিনাইছেন, শিকাইছেন। এনারে টেরনার করো, বক্সিংয়ের মাস্টারমশয়! টেরনার ছাড়া কেউ চ্যাম্পিয়ান হইতে পারে না।
তা আমার কাছে কেন?
গুড আফটারনুন। গোমস এগিয়ে এসে হাত বাড়াল। ওদের কথোপকথন সে শুনেছে। নিতু বিমূঢ়ভাবে গেমসের বাড়ানো হাতটা ধরতেই ঝাঁকুনি খেল। ফ্র্যাঙ্ক গোমস।…আপনিই শিবাজির দাদা নেতাজি?
হ, নিতুদা। ননী আগ বাড়িয়ে বলল।
আপনার নাম শুনেছি, তবে এই প্রথম চোখে দেখছি। নিতু সতর্ক ভঙ্গিতে বলল।
শিবাকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছুটি দেওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট নিয়ে আমি এসেছি।
নিতু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাহেব বাংলাটা এত ভাল বলে যে, বাঙালি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
কী জন্য ছুটি? নিতু এবার বিভ্রান্ত।
শিবা কামব্যাক করবে বক্সিংয়ে। আবার রিং-এ নামবে, আবার লড়বে। এজন্য ট্রেনিং করতে হবে, হার্ড ট্রেনিং।
শুনতে শুনতে নিতুর মুখ গম্ভীর হতে লাগল। ট্রেনিং করবে তাই দোকান দেখতে পারবে না, তাই তো?
গোমস কিঞ্চিৎ স্মার্টনেস হারাল নিতু সরাসরি এই প্রসঙ্গে আসায়। এ যেন রাউন্ড শুরুর বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে মুখে প্রতিপক্ষর একটা জ্যাব!
দোকান আর ট্রেনিং দুটো একসঙ্গে চালালে খুবই টায়ার্ড হয়ে যাবে। তাই বলছি, ডিসেম্বরে ন্যাশনা পর্যন্ত ওকে যদি আপনি ছেড়ে দেন।
হজ্ঞালে ডেচকি লইয়া আসার কামডা অবইশ্য শিবা চালাইয়া যাইব, ওডা তো ওর টেরনিংয়ের মদ্যেই পড়ত্যাসে।
তুই থাম। নিতু ধমক দিল। ননী গুটিয়ে গিয়ে পিছু হটে রিকশায় উঠল। আমি অহন যাই, বলেই প্যাডেল করতে শুরু করল।
কিছুদিন আগে শিবা পায়ে বড়রকমের চোট পেয়েছে, এখন আর ওকে বক্সিং করতে দেওয়ায় আমার মত নেই। তা ছাড়া এই বক্সিং থেকেই তো ওর জীবনে বিপদ এসেছিল। গুণ্ডারা ওকে যা মার মেরেছিল! তা তো আমি ভুলতে পারব না। থমথমে মুখে নিতু কথাগুলো বলে খদ্দেরে মনোযোগ দিল।
গোমস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, নিতুর হাত খালি হতে বলল, শিবার চোট এখন কমপ্লিটলি কিওরড। ডাক্তার ও. কে. করে দিয়েছে। আর গুণ্ডারা যে-জন্য মেরেছিল সেসব কারণ এখন আর নেই।…বক্সিং এমনই একটা খেলা, বেইটাররা এতে হেভি বেট করে। গোরাচাঁদের বক্সার ছিল শিবা। তখন আমার ট্রেনিংয়ে ছিল না। ও ইমম্যাচিওর ছিল তাই জানত না কত রকমের বদমাইশি করে হারিয়ে দেওয়া হয়। বহু টাকা হেরে রাগে গুণ্ডা দিয়ে গোরাচাঁদ ওকে পিটিয়েছিল। শিবার পেট্রন এখন শিবা নিজেই। গোমস দুই মুঠিতে তুলে নিল নিতুর দুই হাত। আমার রিকোয়েস্ট নিতুদা…তুমি রাখো, জাস্ট ওয়ান্স, একবার। এবার আমিই ওকে গাইড করব। এটা শুধু তোমার ভাইয়েরই নয়, আমারও কামব্যাক হবে।
আপনি থেকে তুমি, তার ওপর নিতুদা! কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল নিতুর মাথাটা। সে আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই গো বলল, ও যদি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হয়, মোস্ট প্রোবাবলি হবে, তা হলে সেটা একটা রিভেঞ্জ নেওয়া হবে। তা ছাড়া ওর সামনে অনেক ওপেনিং আসবে…চাকরি মিলবে, ইন্ডিয়া টিমে আসবে, নানান দেশ ঘুরবে…এশিয়ান গেমস, ওলিম্পিকস,..ফ্যামিলির মান বাড়বে।
নিতুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। পৃথিবীতে না হোক, এশিয়ার মধ্যেও যদি শিবা সেরা হতে পারে, তা হলে দেশের কোটি কোটি মানুষ ওর নাম জানবে। কলকাতার উত্তরে লাখ লাখ মানুষ গর্ব করে বলবে, চেনো না! এখানকারই ছেলে শিবাজি আইচ, পূর্বপল্লি কলোনিতে থাকে। জানো না, ওর বাবা দয়াল আইচ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী! স্বাধীনতার পরও তিনি সংগ্রাম থামাননি; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন।…তাঁর ছেলে লড়াইয়ে নামবে না তো কে নামবে?…শিবার দাদা নিতু, চা, রুটি, আলুর দম বেচে, সেও তো লড়াই করে…দারুণ। একটা ফ্যামিলি…।
শিবার বড় হওয়ার লড়াই আমার জন্য আটকাবে, তা কখনও হতে পারে!..বংশের মুখোজ্জ্বল করবে, সবাই বড় মুখ করে বলবে, শিবা আমাদের ছেলে, নিতুর ভাই…আমি দাদা হয়ে বাধা দেব! শুধু একটাই অনুরোধ, আপনি ওকে একটু দেখবেন। নিতু হাত বাড়িয়ে ফ্র্যাঙ্ক গোেমসের দুটো হাত ধরল।
সেদিন রাতে দুই ভাই পাশাপাশি শুয়ে। কারও ঘুম আসছে না। এক সময় নিতু বলল, সাহেবকে দিয়ে বলাবার কী দরকার ছিল, তুই নিজেই তো আমায় বলতে পারতিস। আমি আপত্তি করব, এই ধারণাটা তোর হল কী করে?
আমার অনেক অপরাধ জমা আছে। বালিশে মুখ চেপে শিবা বলল।
কী অপরাধ?
তোমাদের ফেলে আমি চলে গেছলুম সোনার বকলস পরতে।
নিতুর হাত শিবার গলায় ঠেকল। শান্ত গলায় নিতু বলল, বকলসটা নেই, কোনও দাগও নেই।…তোকে ট্রেনিং ছাড়া আর কিছু ভাবতে হবে না। দরকার হলে আমি লোক রেখে দোকান চালাব।
শিবার মনে হচ্ছে একটা ভারী পাথর তার বুক থেকে নেমে যাচ্ছে। হালকা হওয়ার আনন্দে তার চোখ থেকে জল গড়াল।
.
হলধর বর্ধন বক্সিং টুর্নামেন্ট শুরুর আগের রাতে শিবা ঘুমোতে পারল না। বিকট একটা স্বপ্নের মতো, চার বছর পেরিয়ে অতীত থেকে একটা চিৎকার আসছে। সেটা আবার ভারী পাথরটা তার বুকে তুলে দিচ্ছে। সেই রাতের প্রতিটি কথা, ঘটনা তার স্পষ্ট মনে আছে। এতদিন ভুলে থেকেছে কিন্তু এখন সেগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।
ঠিক চার বছর আগে এই হলধর টুর্নামেন্টেই, হেভি ব্যাগ ফাটানোর ভীতিকর খ্যাতি নিয়ে রিং-এ নেমে সে জীবনের প্রথম লড়াই হেরে গেছল, ই সি পি সি-র সুনীল বেরার কাছে, পয়েন্টে।
ইস্ট ক্যালকাটা ফিজিক্যাল কালচারের ছেলেরা লড়াইয়ের ফল ঘোষণার পর শিবার উদ্দেশে চিৎকার করছিল, বলো হরি হরি বোল..বলো হরি হরিবোল। আর শিবা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে মিশে যেতে যেতে ভেবেছিল এখন এখান থেকে পালাতে হবে।
প্রায় পালিয়েই শিবা ফিরে এসেছিল দুর্লভ চক্রবর্তীর গ্যারাজে। তখন সে গ্যারাজেই বাস করত। একটা মোটরের চালে চিত হয়ে শুয়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বক্সিং আর করবে না।
ননী তখনই গ্যারাজে ঢুকেছিল। শিবা তাকে বলেছিল বক্সিং ছেড়ে দেবে।
সেই ভাল। ফাইট করা তর দ্বারা অইব না। ফাইটার অন্য ধাতুতে গড়া হয়।
কী ধাতু?
কী ধাতু তা অবইশ্য জানি না, তয় ঘটিবাটি থালা গেলাসের ধাতু নয়। এডা হইতাছে মনের ধাতু। কোচিংঘরে স্বামীজির ছবিটা দ্যাখছস? চোক্ষু দিয়া যেন আগুন বাইরয়।
শোনামাত্র শিবার কানে বেজেছিল, নুইব না, আমি নুইব না।
এর পর মোটরের চাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে সে অন্ধকার গ্যারাজের কোণ থেকে বালিভর্তি চটের বস্তাটা, যেটাকে হেভিব্যাগ বানিয়ে সে প্র্যাকটিস করে, টেনে আনে। বস্তার মুখ বাঁধা দড়িটা, মোটরের এঞ্জিন তোলার কপিকলে লাগিয়ে টান দিয়ে সেটা জমি থেকে তুলল। কপিকলের লোহার চেনটা বাঁশের সঙ্গে জড়িয়ে দিল।
আয় ননী, হেল্প কর। বস্তাটা দুলিয়ে ছুড়ে দে আমার দিকে।
ননী বস্তাটাকে দুহাতে দোলাতে লাগল। সেটা শিবার বুকে, পেটে আঘাত করে ফিরে এলেই ননী আবার ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। মিনিট কয়েক পর শিবা বসে। পড়েছিল বুকে হাত দিয়ে। হাঁ করে শ্বাস টানছিল। বস্তার ধাক্কায় কলজে নিংড়ে বাতাস বেরিয়ে গেছে।
এ কী! এর মদ্যেই টেরনিং হইয়্যা গ্যাল? এতেই তুই ফাইটার হবি? ওঠ ওঠ… কথাটা বলেই ননী ডান পা দিয়ে শিবার পিঠে লাথি মেরেছিল। লজ্জা করে না তর? হাজার লোকের চোক্ষের সাইমনে মাইর খাইয়া আলি, লজ্জা করে না? আবার সে লাথি কষাল।
প্রথমটিতে শিবা চমকে উঠে শুধু তাকিয়ে থেকেছিল অবাক হয়ে। অন্ধকারে ননীর মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। ননী যে এমন দুঃসাহসিক কাণ্ড করতে পারে, এটা সে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না। দ্বিতীয় লাথিতে সে রাগে লাফিয়ে উঠে ননীর চুল ধরে ঝাঁকাতে থাকে।
তোর সাহস তো বড় কম নয়? পা-টা যদি এবার ভেঙে দি!
গায়ে জোর আছে, তা ভাঙতে পারস, কিন্তু আইজকার লজ্জাটা কি তাতে ভাঙব?
তখন শিবার মনে হয়েছিল, সে যেন সাধু, আর ননী যেন ভবানীসার। সাধুর মতোই তার মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে— পা-টা যদি এবার ভেঙে দি!
কাল অনেকেই জিগাইব, শিবা জিতছে তো?
মানুষমাত্রেই হারে। আমিও হেরেছি।
মানুষ জেতেও, তার জইন্য মনের জোর চাই।
এখন এই মধ্যরাত্রে চিত হয়ে জেগে থাকা শিবা দুঃস্বপ্ন থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে গোমসসারের সেদিনের কথাগুলোর প্রতিটি শব্দ স্মরণ করতে লাগল— জীবনের প্রথম ফাইট তুমি হেরেছ। ঠিক আছে। হার কাকে বলে না জানলে জিত কাকে বলে জানা যায় না। এটাই শিক্ষা, এটাই এডুকেশন। শিক্ষা নিতে পারলে বড় হবে।
শিবা এই কথাটা জেনে রাখ, চ্যাম্পিয়ান জিম-এ তৈরি হয় না, তৈরি হয় তাদের ভেতরের, একেবারে ভেতরের জিনিস থেকে। সেটা হল ইচ্ছা, একটা খোয়াব। মনের মধ্যে এটা না থাকলে কেউ বড় হয়ে উঠতে পারবে না।…আর চাই মনের জোর, উইল। স্কিলের থেকেও স্ট্রং হতে হবে ইচ্ছা, যাকে বলে উইল। তুমি দেখবে, অনেকে হারে তার থেকেও কমতি-স্কিলের অপোনেন্টের কাছে। কেন? মনের জোরের, উইলের কমতি থাকে বলে?
তুমি প্রথমেই একটা ঘুসি খেয়ে মাথা গরম করে ফেলেছিলে। তাতে তোমার বুদ্ধি গুলিয়ে গেছল। মাথার মধ্যে গোলমাল হতেই তোমার বুদ্ধি খারাপ পথে চলে গেল। তখন তুমি শর্টকাটে, নক আউট করে লড়াই জেতার কথা ভেবেছিলে। কিন্তু তুমি অপোনেন্টকে মেপে নাওনি, জানতে চেষ্টা করোনি তার ক্ষমতা কত, তার গলদ কোথায়। ফাইটারস আর ডিসকভারারস, তারা খুঁজে বার করে। তারা নিজেদেরও তখন ডিসকভার করে, নিজেদের ভালমন্দও তখন জানতে পারে।…একটা কথা মনে রেখো, রিং-এর মধ্যে কীভাবে ফাইট করবে এটা বাইরে থেকে তোমার ট্রেনার বলে দিতে পারে না। তোমাকে নিজে সেটা ঠিক করে নিতে হবে। এজন্য তোমার বুদ্ধি, মন তৈরি করতে হবে।…সবার আগে চাই জেতার ইচ্ছা, ডিজায়ার।
এক মাস পর স্টেট চ্যাম্পিয়ানশিপে প্রথম রাউন্ডেই শিবা নক আউট করেছিল সুনীল বেরাকে। রিং থেকে নেমে এসে বলেছিল, সার আমার ভেতরে ইচ্ছেটা হয়েছে কি?
.
হ্যাঁ সার, আবার আমার জেতার ইচ্ছে হয়েছে বলেই আমি ফিরে আসতে চাইছি।—শিবা নিজেকে কথাটা বলে অনেক হালকা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সে ফিরে-আসার প্রথম লড়াইটা পয়েন্টে জিতল। সাধারণ, মামুলি লড়াই। সারের চার বছর আগের কথাগুলো মাথায় রেখে সে লড়েছিল। বোম্বাইয়ে ন্যাশনালসের সাড়ে সাড়ে তিন বছর পর এই প্রথম রিংয়ে ওঠা। ভয় করেনি, কিন্তু অনিশ্চিত একটা বোধ তাকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। লড়তে হবে গোল্ডেন গ্লাভসের শওকত হক নামে একজনের সঙ্গে। অনেক বক্সারই প্রতিপক্ষ সম্পর্কে আগাম খোঁজখবর নিয়ে থাকে, গোমসসার বলে দিয়েছিলেন, এসবের দরকার নেই। এটা একটা মাইনর টুর্নামেন্ট, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ানশিপ নয়।
ড্রেসিংরুমেই সে হককে প্রথম দেখে। প্রথম তাকিয়েই শিবার মনে হয়েছিল, হক ভয় পেয়েছে। হয়তো শুনেছে শিবাজি আইচ নক আউটের মাস্টার, পাঞ্চের জোর দারুণ। হক দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে। শিবা স্বস্তি বোধ করল। সুনীল বেরার সঙ্গে লড়ার আগে সে-ও এইভাবে বসে ছিল। হক নিশ্চয় তাকে নক আউটের চেষ্টা করবে।
রিংয়ে ওঠার আগে গোসসার তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কোনও উপদেশও দেয়নি। ক্লাবেরই প্রাক্তন বক্সার অনিমেষ তার সেকেন্ডস। সাহায্য করেছে। কোমরে লাল রিবন আর গ্লাভস পরিয়ে লেস বেঁধে দিয়ে, মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে মাউথপিস। শিবার কর্নারে তোয়ালে, জলের বোতল আর বসার টুল নিয়ে অনিমেষ, তার পাশে গোমস। রিংয়ে উঠে মাল আলগা করার জন্য হালকাভাবে লাফাতে লাফাতে শিবা বাঁশের গ্যালারির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সাধুকে, তার পাশে দেবু।
চোখাচোখি হতেই সাধু শূন্যে ডান হাতে বাঁ হাতে দুটো ক্রস চালিয়ে, মাথাটা কাত করে চোখ বুজিয়ে জিভ বার করল। শিবা বুঝল, সাধু কী বলতে চায়নক আউট করো। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
রিংয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রেফারি হাত নেড়ে দুজনকে ডাকতেই হক এগিয়ে এসেছিল দম-দেওয়া পুতুলের মতো যান্ত্রিকভাবে। কোমরে সবুজ রিবন। শিবা ওর চোখ দেখে আন্দাজ করল, কীভাবে লড়বে হক সেটা ঠিক করেই রেখেছে, নড়চড় হবে না তার কৌশলের।
তোমরা দুজনেই নিশ্চয় রুলস জানো। রেফারি তাদের প্রথামাফিক বক্তৃতাটা দিয়েছিল। যখন বলব ব্রেক, দুজনেই তখন এক পা পিছিয়ে যাবে, তার মধ্যে ঘুসি। চালাবে না। পিছিয়ে গিয়ে তারপর আবার বক্স করবে।…ননা হিটিং বিলো দ্য বেল্ট। কিডনি পাঞ্চ…কোমরের পেছন দিকে কিংবা ব্যাবিট পাঞ্চ..ঘাড়ের পেছনে, একদম করবে না। যখন স্টপ বলব থেমে যাবে, যখন বক্স বলব লড়াই শুরু করবে। পরিচ্ছন্নভাবে লড়বে…গুড, ক্লিন স্পোর্টসম্যান ফাইট।
হকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ও কী ভাবছে, শিবা তা জানে। সেও প্রথমবার ভেবে রেখেছিল—মেরে শুইয়ে ফেলব। টাইমকিপারের ঘণ্টা বাজল। রেফারি দুহাত নেড়ে রিংয়ের মাঝে দুজনকে আসতে বলল।
বক্স।
হক গ্লাভসজোড়া মুখের সামনে রেখে তেড়ে এল। শিবা প্রথম জ্যাবটা থেকে মুখ পাশে সরিয়ে নিয়ে এক পা পিছিয়ে এসেই জ্যাব করল হকের কপালে।
শিবা ঘুরছে হককে ঘিরে। সারের কথাটা মনে রেখে, ডান্স, ডান্স, ডান্স…ঘুরে-ঘুরে নাচো। ও এগিয়ে আসবে তোমাকে রোপ-এ নিয়ে কর্নার করতে। তুমি জ্যাব করেই সরে যাও। লোকে বলবে পালাচ্ছে, তাতে কান দিয়ো না।…তুমি পয়েন্ট তুলে নাও…ওকে টায়ার্ড করে দাও ঘুসি মারতে দিয়ে। এক একটা পাঞ্চ-এ দম বেরিয়ে যাবে।…ভেতরে এসে কম্বিনেশন চালিয়েই আবার সরে যাও।
শিবা তাই করল প্রথম রাউন্ডে। নিজের কর্নারে টুলে বসে হক হাঁফাচ্ছে, বুক ওঠানামা করছে হাপরের মতো। গ্যালারিতে সাধু আর দেবু একই সঙ্গে লেফট-রাইট ক্রস চালিয়ে জানাচ্ছেনক আউট করো। গোমসসার তার দিকে তাকাচ্ছে না, কথা বলছে আশ্চয্যদার সঙ্গে। ননীকে সে আসতে বারণ করেছে, তাই আসেনি। আত্মীয়-বন্ধু কারও মুখই সে এখানে দেখতে চায়নি। অন্তত প্রথম দিনে নয়।
টুল নিয়ে অনিমেষ দড়ির ফাঁক দিয়ে গলে রিংয়ে ঢুকেছে। শিবা টুলে বসতেই সে হাঁটু ভেঙে চেয়ারের মতো হয়ে ওর দুটো পা নিজের উরুর ওপর তুলে নিল। চার বছর আগে শিবা লজ্জায় পা নামিয়ে নিয়েছিল। অনিমেষ ধমকে উঠে বলেছিল, রাখ। কিন্তু এখন সে পা দুটো রেখে দিল। মুখে জল ছিটিয়ে তোয়ালে দিয়ে শিবার হাত-মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে অনিমেষ বলল, ভাল লড়ছিস। এবার একটু কাছে যা, ইন ফাইটিংয়ে আয়…জ্যাব করার সময় ওর ব্যালান্স থাকছে না।
দেখেছি। নক আউট করে দিতে পারতুম।
করলি না কেন?
শিবা হাসল শুধু। দরকার কী, এটা তো একটা মাইনর টুর্নামেন্ট! সাড়া জাগিয়ে ফিরে আসার থেকে নিঃশব্দে এগোনোই ভাল।
ঘণ্টা বাজল। এক মিনিটের ইন্টারভ্যাল শেষ।
নক আউট শিবা, নক আউট। গ্যালারি থেকে দেবু বিকট স্বরে চিৎকার করে তাকে তাতিয়ে তুলতে চাইছে। শিবা ফিরেও তাকাল না। নক আউট শিবা ইমেজটা সাধুর দরকার তাকে নিয়ে ব্যবসার বা বেটিং করার জন্য। চেঁচাক ওরা, চেঁচাক।
দ্বিতীয় রাউন্ডে হুক একটামাত্র জবর পাঞ্চ শিবার পাঁজরে বসাতে পারল। বিনিময়ে তাকে বহু পয়েন্ট দিতে হল। তাকে পাক দিয়ে শিবার ঘুরে ঘুরে দূরে যাওয়া ও কাছে আসা, আচমকা লেফট রাইট কম্বিনেশন হককে শুধু দিশেহারাই নয়, ভয়ও পাইয়ে দিল। সে এই ধরনের স্ট্র্যাটেজির সামনে কখনও পড়েনি। এমন বিদ্যুৎগতির নড়াচড়াও সে কখনও দেখেনি।
তৃতীয় রাউন্ডে পুনরাবৃত্তি হল প্রথম দুটির। তবে তার একটা রাইট ক্রস হককে ক্যানভাসে ফেলে দেয়। রেফারি আট পর্যন্ত গুনতেই সে উঠে দাঁড়ায়। শিবা তখন হাঁফ ছেড়ে স্বস্তি বোধ করেছিল। বাকি সময়টুকু হক পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। ঘটনা বলতে শুধু এইটুকুই। দ্বিতীয় রাউন্ডেই শিবা বুঝে গিয়েছিল সে লড়াইটা জিতেই গেছে। হক এমন কেউ নয় যে, তার কাছে জিতে নাচানাচি করতে হবে।
রেফারি তার হাতটা তুলে বিজয়ী ঘোষণা করার এবং হককে জড়িয়ে ধরে তাকে সাবাশ জানাবার পর শিবা রিং থেকে নেমে এসে উদ্ভাসিত মুখে ফ্র্যাঙ্ক গোমসের সামনে দাঁড়ায়।
সার, কিছু কি বলবেন?
নিশ্চয় বলব। কাল সাড়ে ছটায় তোমার নেক্সট বাউট সাম টি. মিত্রার সঙ্গে। এখন সোজা ঘর যাও, অ্যান্ড রিলাক্স। কাল মর্নিং-এ রোড রানিং নয়, ওনলি ফ্রি হ্যান্ডস অ্যান্ড রেস্ট।…গুড নাইট।
লালবাগান জিম থেকে বেরিয়ে বাসস্টপের দিকে যাওয়ার সময় শিবা দেখল স্কুটারে বসে রয়েছে দেবু এবং সাধু। হাতছানি দিয়ে সাধু ডাকল।
তুই তো আমাকে ডোবাবি। এটা কি একটা লড়াই হল! তোর কাছ থেকে এমন মিনমিনে ব্যাপার আমি আশা করিনি।
কী আশা করেছিলেন? শিবা ছিলে বলতে গিয়ে ছিলেন বলল। সাধু বয়সে বড় এবং নিজের এলাকায় মান্যগণ্যও বটে।
নক আউট, নক আউট! আবার কী? সাধু চেঁচিয়ে উঠল।
জেতাটাই আমার লক্ষ্য, যেভাবেই হোক। শান্ত গলা শিবার।
শিবা ঠিকই বলেছে। পিলিয়নে বসা দেবু বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল। স্টেপ বাই স্টেপ ফর্মে ফিরতে হয়। এক লাফে মগডালে ওঠা যায় না।
তা হলে ন্যাশনালসের ফাইনালে তুই ফাস্ট রাউন্ডেই নক আউট করবি?..বল করবি? সাধু ব্যাকুলতা আর অনুরোধের মাঝামাঝি একটা স্বরে বলল। হঠাৎ ঝুঁকে ফিসফিস করল। বাজি ধরব…জিতলে তোর টেন পারসেন্ট, অনেক টাকা!
কয়েক সেকেন্ড সাধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে শিবা হাঁটতে শুরু করল। বাসস্টপ ছাড়িয়েও সে হেঁটে চলল। পাশ দিয়ে স্কুটারটা চলে যাওয়ার সময় দেবু বলে গেল, মনে রাখিস, টেন পারসেন্ট।
দেবদাস পাঠক রোডের মোড়ের স্ট্যান্ডে তিনটি রিকশা দাঁড়িয়ে। তৃতীয়ে ননী। শিবাকে দেখে সে বলল, আয়, বয়, পৌঁছায়ে দিমু।
শিবা রিকশায় উঠল। ননী প্যাডেল শুরু করে বলল, টায়ার্ড?
হ্যাঁ।
ননী পকেট থেকে একটা পেয়ারা বার করে হাতটা পেছনে বাড়িয়ে বলল, ধর।
পেয়ারাটা নিয়ে শিবা বলল, কোথায় পেলি?
এক প্যাসেঞ্জার রিশকা থাইক্যা লামবার সময় থলিডা একবার ধইরতে দিছিল। পিয়ারায় খুব ভিটামিন…কাল তর লড়াই আছে না?
হুঁ।
ভবানীসারের কোচিংঘরের দরজা বন্ধ। রিকশা থামিয়ে শিবা নামল। জানলায় উঁকি দিয়ে দেখল ভবানীসার হুমড়ি দিয়ে বসে একটা খাতায় অঙ্ক কষছেন। শিবা কথা বলে ব্যাঘাত করল না। তবে দেয়ালে একটা নতুন লেখা চোখে পড়ল। কিছুই বুঝতে পারল না, যেহেতু সেটা ইংরেজিতে।
সারের কোচিংয়ে আবার নাকি ভিড় হচ্ছে? শিবা জানতে চাইল।
হ। দশ-পনেরোজনরে ফিরাইয়া দ্যাছেন। মুখুজ্যেবাড়ির রঞ্জু আমারে ধরছিল তার ভাইপোডারে সারের কোচিংয়ে ভর্তি করাইবার জইন্য। গিয়া কইলাম সাররে। এককথায় লইয়া লইলেন।
তুই বলাতেই সার নিয়ে নিলেন!
ক্যান, রিশকা চালাই বইল্যা কি আমার মানসম্মান কম নাহি? সার রোজ আমারে ডাইক্যা তর কথা জিগায়, খবর লয়। তা আমি যদি এহন একডা রিকোয়েস্ট ওনারে করি, রাইখবেন না? রঞ্জুর দাদা কাঠের ফারনিচার কাইরখানা কইরচে ওনাদের বাগানের জমিতে, সেজ ভাইডারে ওহানে ফিট কইরা দিবার কথা ভাইবত্যাচি।
ননী কিন্তু সারাক্ষণে একবারও জিজ্ঞেস করল না, আজকের লড়াইয়ের ফল কী হল!
পরদিন শিবা কাঁকুড়গাছি ব্যায়াম সমিতির তুষার মিত্রকে নিয়ে তিন রাউন্ড ছেলেখেলা করল। ছেলেটি মাসতিনেক হল বক্সিং শুরু করেছে। বহু পয়েন্টের ব্যবধানে শিবা জিতল। তার পরের দিন ফাইনালে শিবা যাকে পেল, রাস্তায় মারামারি করায় তার নাম হয়েছে, একটা হবু সাধু, ই সি পি সি এ-র গৌতম নাগ। প্রথম রাউন্ডে নকআউটে জিতেছে। ওর লড়াইয়ের কায়দাটা হল, বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে তেড়ে যাওয়া, রাইট সুইং আর লেফট সুইং, বাটারফ্লাই সাঁতার কাটার মতো দুহাতে দুপাশ দিয়ে ঘুসি চালায়, তবে পাঞ্চে জোর আছে। নড়াচড়ায় অত্যন্ত মন্থর।
বিদ্যুৎগতিতে সরে সরে শিবা জ্যাব করে গেল বাঁ হাতে। এত দ্রুত সে ঘুরছিল যে, গৌতম বুঝে উঠতে পারছিল না কোনদিক থেকে লেফট হুক আর জ্যাবগুলো তার দিকে আসবে, মাথায় লাগবে রাইট ক্রস। অন্তত ছবার শিবা নিখুঁতভাবে নকআউট পাঞ্চ বসাতে গৌতমের চোয়াল পেয়েছিল। বসায়নি। শিবা বক্সিং লড়াই সম্পর্কে চমৎকার একটা শিক্ষা দিয়ে গৌতমকে বুঝিয়ে দিল রাস্তার মাস্তানি আর রিংয়ের মাস্তানি এক জিনিস নয়। ঘাম, রক্ত, পরিশ্রম, বুদ্ধি আর শৃঙ্খলাপরায়ণতা— এতগুলো জিনিস এবং সবার ওপরে ট্যালেন্ট, চ্যাম্পিয়ান হয়ে ওঠার জন্য দরকার হয়।
রিং থেকে নেমে আসতেই গো তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন লাগছে? খুশি?
শিবা মাথাটা দুপাশে নাড়িয়ে বলেছিল, বেঙ্গল বক্সিংয়ের খুবই শোচনীয় দশা সার। বেড়াল আর নেংটি ইঁদুরের সঙ্গে খেলে কি খুশি হওয়া যায়!
টাইগার আর লায়ন এ দেশে কোথায় পাবে, ইন্ডিয়ান বক্সিংয়েই নেই! তবে ন্যাশনালসে ডোবারমান কি আলসেশিয়ান তুমি পাবে।…রেডি থেকো।
.
১১.
জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে কলকাতার নেতাজি ইন্ডাের স্টেডিয়ামে হবে ন্যাশনাল বক্সিং চ্যাম্পিয়ানশিপ।
বাংলা দলে শিবা মিডলওয়েটে নির্বাচিত। আশ্চর্য ঘটক বলেছিলেন, ট্রেনিং করতে করতে শরীর ঝরবে। বাহাত্তর কে জি-র শরীরটা একাত্তর কিলোগ্রামের নীচে নেমে এসে তাকে ওয়েল্টার করে দেবে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক গোমস সেটা হতে দেয়নি। বরং গত এক মাসে বাহাত্তরকে নিয়ে গেলেন সাড়ে চুয়াত্তরে, অর্থাৎ মিডল বিভাগে।
পুষ্টিকর খাদ্য, ট্রেনিং আর বিশ্রাম ওজন বাড়াতে সাহায্য করেছে শিবাকে। দু-তিনজন অবশ্য আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, কম ওজন বিভাগে শিবাকে নামালে ফল ভাল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গোমস বলেছিল, ন্যাচারাল গ্রোথ যা হওয়ার হোক। তাকে জোর করে বন্ধ করলে শরীর উইক হয়ে পড়বে।
শিবা আবার লড়তে নামবে, এ কথা পূর্বপল্লির সবাই জেনে গেছে। কাজটা শারীরিক এবং পরিশ্রমের, সুতরাং তার শরীরের যত্ন নেওয়া দরকার, এই ধারণাটাই তাদের ব্যস্ত করে তুলল। যে যেমন পারে খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে দেয়; যার অধিকাংশই কোনও খেলোয়াড়ের খাওয়া উচিত নয়। শিবা সে-সবই ফিরিয়ে দিয়ে জানিয়েছিল, যদি চ্যাম্পিয়ান হতে পারি তা হলে সবার ঘরে একদিন করে গিয়ে খেয়ে আসব।
বিশেষ উৎসাহ শক্তি দাসের, রোজই একবার খোঁজ নিয়ে যায় শিবার। সুযোগ পেলেই চেনা পরিচিতদের সে জানিয়ে দেয়, শিবা তো আর বক্সিং করবে না বলেই প্রতিজ্ঞা করেছিল। রোজ ওর পেছনে লেগে লেগে তবে না চাগিয়ে তুললাম ইন্ডিয়া। চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সাধটা।
শচীনকাকু আবার দিয়ে যাচ্ছে সেদ্ধ ডিম। বটকেষ্টর দোকানের যাবতীয় রান্না সে করে চলেছে গত কুড়ি বছর ধরে। শিবা যখন চার বছর আগে লালবাগানে যাতায়াত শুরু করে বক্সার হওয়ার জন্য, তখন শচীন তাকে রোজ দুবেলা দুটো সেদ্ধ ডিম দিত, অবশ্যই বটকেষ্টর অগোচরে। ডিম দেওয়া সে বন্ধ করেছিল শিবা যখন গোরাবাবুর। বাড়িতে গিয়ে ওঠে। সাধুদের হাতে প্রবল মার খেয়ে শিবা হাসপাতালে যখন অর্ধমৃত অবস্থায়, অন্যদের সঙ্গে তাকে দেখতে গিয়ে শচীন একটা সেদ্ধ ডিম সঙ্গে নিয়ে গেছল। সাগরমামি তাকে ধমকে বলেছিল, খাবে কী, চিবিয়ে কিছু খাবার ক্ষমতা কি ওর আছে? শচীন এখন আবার শিবাকে সেদ্ধ ডিম দিতে শুরু করেছে, গায়ে জোর বাড়াবার জন্য।
লালবাগান জিম-এ শিবা চার থেকে ছঘণ্টা ট্রেনিং করে। গোমসসার সারাক্ষণই তার সঙ্গে। একটা মিনিটও তারা নষ্ট করে না। একদিন মিতা আর তার দিদি এসেছিল। তারা হলঘরের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল, আশ্চর্য ঘটক তাদের আটকান। এখানে মেয়েদের ঢোকা বারণ।…আপনারা কাকে চান? শিবার সঙ্গে দেখা করতে চায় শুনে আশ্চর্য ঘটক মাথা নেড়ে বলেছিলেন, দেখা হবে না। ওর ট্রেনারের কড়া হুকুম, ট্রেনিং চলার সময় কোনওরকম ডিস্ট্রাকশন যেন না হয়। আপনারা রাত আটটার পর আসবেন। দুটি মেয়ে দেখা করতে এসেছিল—এই খবর, বলা বাহুল্য, শিবার কানে আর পৌঁছয়নি।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে কান্তি প্রায়ই সন্ধ্যায় এসে আশ্চর্য ঘটক এবং অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে আর লক্ষ করে শিবার ট্রেনিং। ওয়েলেসলির পুরনো ফার্নিচারের দোকানের কাজ সেরে ফ্র্যাঙ্ক গোস জিম-এ আসে সন্ধ্যার পর। সে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কান্তি জিম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
একদিন হেভি ব্যাগে শিবার ঘুসিমারা দেখতে দেখতে কান্তি বলল, জীবনের প্রথম ঘুসিটা তুই আমার কাছে খেয়েছিলি, এই জায়গাতেই, মনে আছে?
খুব ভালভাবেই শিবার মনে আছে। কিন্তু সে কান্তির কথায় কান না দিয়ে পাঞ্চ করে যেতে লাগল।
এখন ভাবলে হাসি পায়। সেদিন তুই যদি পালটা এটা ঝাড়তিস তা হলে ভাঙা চোয়াল নিয়ে আমাকে জীবন কাটাতে হত।
শিবা ঘুসি চালানো বন্ধ করল। কান্তিদা, আপনার চোয়াল জোড়া যেত, সাধুর তো জোড়া লেগে গেছে!
সাধুকে তো আস্তে মেরেছিলি, আমাকে কি আর আস্তে মারতিস?
বোধহয়, না। কথাটা বলে শিবা হলঘরের দরজার দিকে এগোল, বাইরে খোলা বাতাসে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য।
এই দরজা দিয়ে হলঘরে প্রথমদিন ঢুকে সে কান্তির সামনেই পড়েছিল। কী রে, তোকে আগে কখনও তো দেখিনি?
আমাকে আসতে বলেছিল।
কে, গোমস নিশ্চয়?
শিবা মাথা কাত করে।
কখনও লড়েছিস?
না।
ঘুসি মেরেছিস কখনও?
না।
বক্সিং শিখতে এসেছিস, তাই তো?
হ্যাঁ।
শিখতে গেলে প্রথমেই কী করে ঘুসি হজম করতে হয় তার ট্রেনিং নিতে হয়। কান্তি দুহাতে গ্লাভস পরে হাত দুটো শিবার মুখের কাছে ধরে বলেছিল, কী বল তো?
ঘুসি।
বাহ, তুই তো জানিস দেখছি। এটা এবার তোকে হজম করতে হবে।
বলার সঙ্গে সঙ্গেই শিবার ডান পাঁজরে সে ঘুসি মারল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার চোখের সামনের যাবতীয় বস্তু কালো হয়ে যায়। শ্বাস নিতে গিয়ে বুকে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা বোধ করে। এর পর আবার ঘুসি বাম পাঁজরে। তারপর দুহাতে কান্তি চারটে ঘুসি মারল বুকে আর পেটে। শিবা উবু হয়ে বসে পড়ে বুক চেপে ধরে।
এবার তুই বাইরে গিয়ে বাঁ দিকে যাবি। ওখানে রিংয়ের পাশে একটা বুড়োকে দেখবি বেঞ্চিতে বসে আছে। নাম আশ্চয্যদা। এখানকার সেক্রেটারি। তাকে গিয়ে বলবি কান্তি সরকার আশীর্বাদ করে দিয়েছে, এবার আমি বক্সিং শিখব। এই বলে কান্তি খিকখিক করে হেসে যেতে থাকে।
অকারণে মানুষকে আঘাত করে, যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া মুখ দেখে কেউ যে আনন্দে হেসে উঠতে পারে এমন লোক সাধুর পর শিবা দ্বিতীয়বার দেখল কান্তি সরকারকে।
আমার ওপর তুই রেগে আছিস জানি।
শিবা বর্তমানে ফিরে এল কথাগুলো শুনে। কান্তি হলঘর থেকে বেরিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, কমলালেবুতে যে ওষুধ দেওয়া আছে তা আমি জানতাম না। সাধু বলল, শিবাকে দিয়ে বলবি গুড উইশ জানিয়ে গোমস পাঠিয়ে দিয়েছে, লড়াইয়ের আগে যেন খায়। তা হলে এনার্জি দেবে, স্ট্যামিনা দেবে।…খোসা ছাড়িয়ে টিফিন কৌটোয় ভরে আমিই তোকে দিয়ে এসেছি। কান্তির গলা ধরে এল। শিবার কাঁধে সে হাত রাখল।
এসব কথা এখন, এত বছর পর কেন? কান্তির হাতটা রূঢ়ভাবে শিবা কাঁধ থেকে ফেলে দিল।
তুই আমাকে সারাজীবন ভুল বুঝে থাকবি।…তোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সাধনা দেখে আমার বুকের মধ্যে কী যে হচ্ছে! শিবা তুই বড় হয়ে ওঠ, ভগবানের কাছে রোজ প্রার্থনা করি তুই বড় হ, আবার আগের মতো নক আউটের পর নক আউট করে রিং কাঁপিয়ে দে। দূর থেকে আমি দেখব আর চোখের জল মুছব।
নক আউট!
হ্যাঁ। তোর কাছে এটা খুব সামান্য চাওয়া। ট্রেনিংয়ে তোকে যেরকম দেখছি তাতে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি প্রত্যেকটা লড়াই তুই নক আউটে জিততে পারবি।
শিবা ওয়ার্ক আউট কি শেষ হয়ে গেছে? আশ্চর্য ঘটকের গলা ভেসে এল।
না, আশ্চয্যদা। শিবা একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে হল-এ ঢুকে গেল। রাজ্য চ্যাম্পিয়ানশিপটাই ছিল নির্বাচনী ট্রায়াল। হলধর টুর্নামেন্টে যাদের সঙ্গে লড়েছিল, ট্রায়ালে সে তাদেরই পেল; উপরন্তু নতুন একজন, হাওড়ার সমীর সাঁতরাকে। ওর সঙ্গে লড়াইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে শিবার নতুন একটা অভিজ্ঞতা হয়। সাঁতরার একটা রাইট ক্রস থেকে মুখ সরালেও গ্লাভসটা তার বাম ঘষে বেরিয়ে যায়। জ্বর ওপরের চামড়া ফেটে রক্ত চুইতে থাকে চোখের ওপর। সে দেখতে পাচ্ছিল না বাঁ চোখে।
একটা চোখে ঝাপসা, অন্যটায় পরিষ্কার দেখা জীবনে এই প্রথম। হয়তো বিস্মিত হয়েই সে পাঁচ-ছ সেকেন্ড বিহ্বল হয়ে থমকে গেছল।
শিবা।
রিংয়ের বাইরে থেকে ফ্র্যাঙ্ক গোমসের তীক্ষ্ণ চিৎকারে তার সংবিৎ ফিরে আসে। অস্বস্তিকর একচোখা দৃষ্টি নিয়ে সে সাঁতরার ঘুসির এলাকার বাইরে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে। সাঁতরা যতই এগোয়, ততই সে সরে সরে যায়। রাউন্ড শেষের ঘণ্টা না বাজা পর্যন্ত সে বাঁ চোখের পাতা বন্ধ করে রাখে। ডাক্তার রক্ত পড়া বন্ধ করে স্টিকিং প্লাস্টার লাগিয়ে দেন। তৃতীয় রাউন্ডে শিবা পরিষ্কার চোখে সাঁতরাকে মারতে শুরু করে। তবে মনের মধ্যে একটা খচখচানি শুরু হওয়ায় মুখটা বাঁ দিকে সামান্য ঘুরিয়ে রেখেছিল যাতে কাটা জায়গাটায় আঘাত না লাগে।
শিবা পয়েন্টেই জিতেছিল। ড্রেসিংরুমে যখন সে চুল আঁচড়াচ্ছে, কান্তি তখন তার পাশে এসে দাঁড়াল।
চোখ নিয়ে তোর খুব অসুবিধে হচ্ছিল।
কে বলল হচ্ছিল!
হাসি খেলে গেল কান্তির চোখে। আমি একটু আধটু বক্সিং করেছি যে, চোখে কিছু পড়লে তখন কী হয় আমি জানি। ইনজুরিটা তাড়াতাড়ি সারা, আর তো মাত্র হপ্তাতিনেক সময় আছে।
কান্তি সরে গেল গোমসকে আসতে দেখে।
ঘর যাবে তো, চলো। গোমস কথাটা বলে – তুলল। কান্তি তোমায় কী বলছিল?
চোখ নিয়ে…।
শিবা। গম্ভীর হয়ে গেল গোমস। আজ যদি একটু ভাল ফাইটারের সামনে পড়তে যার মগজ আছে, যে অপোনেন্টকে কিনলি অবজার্ভ করে, চোখের ওপর থেকে চোখ সরায় না, হু ইজ অ্যান অপারচুনিস্ট, সামান্য দু সেকেন্ডের সুযোগকেই যে কাজে লাগায় এমন কেউ আজ থাকলে তোমায় নক আউট করে দিত। ইউ আর ভেরি ভেরি লাকি।
শুনতে শুনতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছল শিবার মুখ। ক্ষীণ স্বরে বলল, কখন করত?
ফোর-ফাইভ সেকেন্ডস তুমি নিজেকে আনগার্ডেড রেখেছিলে। ইনাফ টাইম টু নক ইউ আউট: ইনাফ, ইনাফ…রিমেম্বার হোয়েন আই শাউটেড? রিমেম্বার রোজারিও?
শিবার মনে হল, তাকে অজ্ঞান করে অপারেশন টেবিলে তোলার জন্য ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। ফ্যালফ্যাল করে সে গোমসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অপলকে।
চলো ট্যাক্সি ধরব, ইঞ্জুরি নিয়ে বাসে ফেরা চলবে না।
ট্যাক্সিতে শিবা নিজেকে সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। সাড়ে তিন বছর…কিন্তু এখনও তার স্পষ্ট সব কথা, সব ঘটনা মনে আছে। সাড়ে তিন বছর আগে বোম্বাইয়ে, ন্যাশনালসের ওয়েল্টার ওয়েট ফাইনাল…রিমেম্বার রোজারিও। হ্যাঁ, সে কখনও ভুলবে না সেই হারের কথা…কিন্তু কেন সে হেরেছিল! নক আউট করেছিল তিনজনকে, ফাস্ট রাউন্ডেই, ফাইনালে সে ফেভারিট…ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে লোক ভেঙে পড়েছিল নক আউট দেখার জন্য।
শিবা কাতরে উঠল। চিবুক তুলে হাঁ করে ট্যাক্সির চালের দিকে তাকাল। পাশে বসা গো আলতোভাবে শিবার কপালে আঙুল ছুঁইয়ে কোমল গলায় বলল, পেইন হচ্ছে?
হ্যাঁ।
পেইন কিলার ক্যাপসুল খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
শিবা মনে মনে বলল, ঠিক হবে না। তাকে সাড়ে তিন বছর আগে ফিরে গিয়ে স্মৃতির মধ্যে ডুব দিতে হবে। প্রতিটি মানুষ, তাদের কথা চাহনি, চলাফেরা, হাসি, চিৎকার..সব তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে মনের মধ্যে।…রিমেম্বার, রিমেম্বার রোজারিও।
চোখ বন্ধ করল শিবা। তিন বছর আগে বোম্বাইয়ে, মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চৌপট্টিতে…সে আর সুনীল বেরা। মেলার মতো ভিড়। ভেলপুরি, আলু-মটর, আইসক্রিম, পাওভাজি, যা দেখছিল তাই কিনে খাচ্ছিল। বালি আর কাদা মাড়িয়ে সে সাগরের জলের স্বাদ কেমন জানার জন্য আরব সাগরের দিকে যাচ্ছিল। তখন দেখতে পায় সুনীল কথা বলছে রোজারিওর সঙ্গে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছয়-সাত বছরের একটি ছেলে আর স্কার্ট-ব্লাউজ পরা শ্যামবর্ণা এক মহিলা।
সুনীল তাকে হাতছানি দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল।
তারপর…
.
১২.
সে এগিয়ে যেতেই রোজারিও হাত বাড়িয়ে দিল। কুণ্ঠিতভাবে সে হাত মেলাল।
বেরা ওয়াজ জাস্ট টেলিং মি অ্যাবাউট ইউ। হাম তো রিটায়ার করনেওয়ালা বুঢ়া হ্যায়। বেরাসে শুনা তুমহারা পাঞ্চ বহত জবরদস্ত হ্যায়। তো দেখে বাবা, হামকো জারা আস্তে সে হিট করো! হাম মর যায়গা তো মেরা বিবি-বাচ্চাকো কউন দেখেগা। রোজারিও এই বলে হো-হো করে হেসে ওঠে।
লোকটাকে তার ভাল লেগে গেল। সে বলে ফেলল, হাম তো আপনার কাছ সে শিখে গা।
কেয়া শিখে গা?
সে ভেবে পাচ্ছিল না এবার কী বলবে! রোজারিওর মুখের হাসিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। ধীর শান্ত স্বরে বলল, তো শুনো, নেভার শেক হ্যান্ড উইথ অ্যান অপোনেন্ট আনটিল ইউ হ্যাভ হুইল্ড হিম। জিতনে কা আগে অপোনেন্ট কা সাথ কভি হ্যান্ডশেক না করো।
হ্যান্ডশেক আপ তো আভি কিয়া। শিবা তো আপকা অপোনেন্ট হ্যায়। সুনীল বলল।
দেখো, হাম অপোনেন্টকো হেট করতা। উই ফাইট, লেকিন ডিপ ইন আওয়ার মাইন্ড উই ডু নট রিয়্যালি হেট। হাম মনমে হেট বানাতা, মনমে অপোনেন্টকো খারাপি দুশমন বানাকে অ্যাটাক করতা।
তার পাশেই দাঁড়িয়ে রোজারিওর ছেলেটি। একদৃষ্টে বেলুনওলার হাতে ধরা বিশাল বিশাল বেলুনগুলোর দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে।
সে ঝুঁকে বলল, খোকা, বেলুন নেবে?
ছেলেটি লজ্জা পেয়ে মায়ের দিকে সরে গেল। হাত ধরে ছেলেটিকে সে বেলুনের দিকে টেনে নিয়ে দশ টাকায় দুটো বেলুন কিনে ওর হাতে দিতেই খুশিতে ঝকমক করে উঠল ওর মুখ। হাসিতে টোল পড়ল গালে।
কী নাম তোমার, নাম কেয়া?
নীল, নীল রোজারিও।
নীল! ধক করে উঠল বুকের মধ্যে। ছোট ভাই নিলু, অনেকটা এই বয়সেই মারা গেছে।
আচ্ছা শিবা, থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্যা বেলুনস। হামকো আভি তো কোলাবা যানে পড়ে গা, এক ফ্রেন্ড কা হাউস মো…ইয়ে মেরা লাস্ট অ্যান্ড ফিফটিথ ন্যাশনাল। পাপ্পা ক্যায়সা ফাইটার, নীল আপনা আঁখো সে দেখে গা। ইস লিয়েই হাম উনকো বোম্বাই লে আয়া, ইটস নীলস লাস্ট চান্স টু উইটনেস হিজ ফাদার ইন দ্য রিং।
যাওয়ার সময় নীল বলল, থ্যাঙ্ক য়ু আঙ্কল। যেতে যেতে মুখ ফেরাল, হাত নাড়ল। সেও হাত নাড়ল।
ছেলেটা বেশ। আমার এইরকম একটা ভাই ছিল। তার কথার কোনও জবাব সুনীল দিল না।
কী বলল বলো তো হ্যান্ডশেক করা নিয়ে? সে জিজ্ঞেস করেছিল সুনীলকে।
বলল, অপোনেন্টকে মারার জন্য আমরা মনের মধ্যে একটা ঘৃণা তৈরি করি, আসলে কিন্তু অন্তরে আমরা কাউকে ঘেন্না করি না।
মনের মধ্যে ঘেন্না বানিয়ে লড়তে হবে, জিততে হবে! কেন, ওটা ছাড়া এমনই কি জেতা যায় না?
সুনীল বলেছিল, সে জানে না।
প্রথম লড়াইয়ের আগে ড্রেসিংরুমে কাঁচাপাকা চুল ভরা মাথা, ঘাড়েগদানে, বেঁটে একটা লোক এসে বলল, আই অ্যাম বেহরাম মিস্ত্রি।
প্রিয় হালদারের কাছে নামটা সে শুনেছে। গোরাবাবুর সঙ্গে এই লোকটা আর এক পাঞ্জাবি মিলে নাকি অল ইন্ডিয়া টুর্নামেন্ট করবে। বেহরাম বলল, গোরাচাঁদ টেলেক্সমে ভেজা, তুম বহত ফাস্ট অউর হার্ড হিটার বক্সার! তুমহারা পর উইনকা দর আহমেদাবাদ অউর বোম্বাইমে তিন-এক, ক্যালকাটামে চার-এক, ফাস্ট রাউন্ড নক আউট কা দর আট-এক, কানপুরমে পাঁচ-এক। ফাস্ট রাউন্ড নক আউট করো, এক হাজার রুপৈয়া ইনাম মিলেগা।
রিং গেমে দু মিনিটের মধ্যে দিল্লির অরুণকুমারকে নক আউট করেছিল। স্টেডিয়ামের দর্শকদের উন্মত্ত চিৎকার তার ভাল লাগছিল। ওরা চায়, ঘুসি মেরে একটা লোকের লুটিয়ে পড়া দেখতে। যে দেখাতে পারে তাকে ওরা ভালবাসবে। সে ভালবাসা চায়। গোরাবাবুর আশ্রয়ে নিঃসঙ্গ জীবনটা ভরাবার জন্য এই চিৎকার তার দরকার। বেহরাম হাজার টাকা দিয়েছিল।
পরের লড়াই রেলওয়েজের মার্টিনের সঙ্গে। আবার বেহরাম বলল,ফাস্ট রাউন্ড নক আউট করো…হাজারই মিলেগা।
ফাস্ট রাউন্ডেই সে মার্টিনকে ফেলে দিয়ে কানের পরদা ফাটানো চিৎকার শুনেছিল। রিং থেকে নামতেই অনেকে ছুটে আসে পাগলের মতো, তাকে স্পর্শ করার জন্য। বেহরাম হাজার টাকা দিয়েছিল।
সেমিফাইনাল ছিল সার্ভিসেসের শ্যামবাহাদুরের সঙ্গে। ইতস্তত করে, বেহরাম বলেছিল, ফাস্ট রাউন্ড নক আউট হোগা? দুবার হয়েছে, তৃতীয়বারও কি তা সম্ভব?
চেষ্টা করেগা।
দো হাজার।
দুহাজার টাকাও সে জিতে নিল। রিং থেকে কারা যেন তাকে কাঁধে তুলে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গেছল। তখন যা কিছু দেখছিল, যা কিছু শুনছিল, সবই অবাস্তব, অলীক বলে তার কাছে মনে হচ্ছিল। চায়ের দোকানের শিবা ব্রেবোর্নকে কাঁপিয়ে শিবাজি…শিবাজি চিৎকারে যেন ছত্রপতি শিবাজিরই মর্যাদা পাচ্ছে। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
তার ফাইনালে ওঠার খবর পেয়ে কলকাতা থেকে প্লেনে উড়ে এল গোরাবাবু। তাকে হোটেলে ডেকে এনে বলল, এই ফাইনালে তোমাকে নিয়ে বেটিং হচ্ছে, হাজার হাজার টাকার বাজি! আমারও অনেক টাকা এতে রয়েছে। ফাস্ট রাউন্ড নক আউট, ফোর্থ টাইম..কী মনে হচ্ছে? লড়তে হবে রেলের রোজারিওর সঙ্গে, ওর লড়াই দেখে নিয়েছ?
রোজারিও বুড়ো হয়ে গেছে, আমার থেকে অনেক স্লো, পাঞ্চেও জোর নেই, দমও নেই।
লোকটা কিন্তু পাঁকাল মাছের মতো পিছল, শেয়ালের মতো ধূর্ত। গোরাবাবু হুঁশিয়ার গলায় বলল।
দেখা আছে সব। সে একটু তেতে উঠল তার সামর্থ্যের ওপর গোরাবাবুর দ্বিধা দেখে। সব জারিজুরি ভেঙে দেবে চোয়ালে একটা লেফট হুক বসিয়ে।
বেহরাম আমার পার্টনার হলেও ওকে আমি বিশ্বাস করি না। গোপনে হয়তো ও বাজি ধরবে রোজারিওর ওপর, তাই চাইবে ফেভারিটকে হারিয়ে আপসেট ঘটাতে। তোমাকে কিছু খেতে টেতে দিলে খাবে না, জলও নয়। নিজে সঙ্গে করে ফ্লাস্কে জল। নিয়ে যাবে। মনে রেখো, অনেক টাকা ধরেছি তোমার ওপর…ফাস্ট রাউন্ড।
কিন্তু সে জানত না রোজারিওর বউ ও ছেলে রিংয়ের ধারে বসবে। ছেলে একবার। অন্তত বাবাকে লড়তে দেখুক, এটাই রোজারিওর ইচ্ছে। রিংয়ে তার চোখে পড়ল নীল, তার দিকে তাকিয়ে। বড় বড় দুটি চোখে বিস্ময়, সারল্য, কৌতূহল। চোখাচোখি হতেই নীল হাত নাড়ল। সে পারল না। হাত তুলতে গিয়ে মনে হল বগলটা জং-ধরা। কবজার মতো।
তখন সে ভেবেছিল, হেট দরকার, হেট। রোজারিওকে ঘেন্না। নয়তো সে লড়তে পারবে না। মনের ভেতর একটা গনগনে আক্রোশ এখন চাই। এই জং-ধরা কবজাটায় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করছে, এটাকে হেট দিয়ে ঘষে ঘষে সচল করে তুলতে হবে।
কিন্তু রোজারিওকে খারাপ মানুষ ভাবার মতো ওর সম্পর্কে তো কিছুই সে জানে না। যতটুকু ওকে দেখেছে, বেশ ভালই লেগেছে। হাসিখুশি, ভদ্র, আমুদে। রিংয়ে শ্যাডো করতে করতে নজর আবার নীলের ওপর গিয়ে পড়ল। তখন সে নিজের ওপর রেগে উঠে ভাবল, কেন ওকে নীলু মনে হল! কেন ওকে বেলুন কিনে দিতে গেলুম!
রোজারিও রিংয়ে উঠতেই নীল দাঁড়িয়ে উঠল। এগিয়ে এল রিংয়ের ধারে। উবু হয়ে বসে রোজারিও রোপ-এর ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে নীলের কপালে চুমু দিল। গলা জড়িয়ে নীল বাবার দুই গালে চুমু দিল। দেখতে দেখতে তার বুকের মধ্যে একটা ধস নামল। একদম নির্জন ফাঁকা হয়ে গেল বুকের মধ্যে। তার কোনও আপনজন এখানে নেই। কলকাতা হলে ননী নিশ্চয়ই থাকত! ননী আর থাকবে না। কেউ তার চারপাশে আর নেই—মা, দাদা, ভবানীসার, সাগরমামি, শচীনকাকু, আশ্চয্যদা, গোমসসারও।
প্রথম রাউন্ড শুরুর ঘণ্টা বাজতেই রোজারিওর দিকে সে তেড়ে গেল। কয়েকটা জ্যাব আর স্ট্রেট লেফট দিয়েই তার মনে হল লোকটার ফুটওয়ার্ক অসম্ভব ভাল। শরীর থেকে ঘুসি ঝেড়ে ফেলার কায়দাটা জানে। জানুক। তার বাঁ হাতের চৌহদ্দি থেকে রোজারিওকে বেরোতে দেবে না। ফাস্ট রাউন্ডে ফেলে দিতে হলে ওকে টেনে আনতে হবে কিংবা এগোতে হবে।
শেয়ালের মতো ধূর্ত! চিন্তার হদিস পেয়ে গেছে নিশ্চয়। দূরে-দূরে ঘুরছে, ইনফাইটিংয়ে একেবারেই আসতে চাইছে না।
সে এগোল। রিংটাকে আড়াআড়ি কেটে এগোতে এগোতে সে রোজারিওকে কর্নারে যখন নিয়ে যাচ্ছে, প্রায় আট হাজার দর্শক তখন নক আউটের গন্ধ পেয়ে বীভৎস চিৎকার করল, কিল, কিল, কিল।
তার লেফট হুকটা তৈরি হয়ে ওঠার আগেই রোজারিও দ্রুত এগিয়ে এসে জড়াজড়ি করে ফেলল। তার গলা জড়িয়ে ধরেছে ওর ডান হাত, বাঁ হাতে কোমর। এই অবস্থায় ঘুসি মারা যায় পেটে বা বগলে, তাও খুব জোরে নয়। কয়েকটা বোবা ঘুসি সে চালাল, রোজারিওকে ঠেলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু ও ছাড়ছে না।
ব্রেক। রেফারি বিচ্ছিন্ন হয়ে দুজনকে সরে যেতে হুকুম দিল।
পিছোতে গিয়ে তার ডান পা অতি সামান্য পিছলে গেল। পলকের জন্য সে। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে ঠিক কানের ওপর রোজারিওর রাইট সুইংটা এসে পড়ল এবং সেটাকে অনুসরণ করে বাঁ হাতের সোজা একটা পাঞ্চ।
ক্যানভাসের ওপর তার পড়ার শব্দটা ব্রেবোর্নের নর্থ স্ট্যান্ডের চালে ধাক্কা খেয়ে। নেমে এল দর্শকদের ওপর। তারা হতবাক। দ্রুতই সে উঠে পড়ে, কিন্তু মনের জোর যেন কিছুটা তুলে নিয়ে গেল ওই দুটো পাঞ্চ। সেই জায়গায় ঢুকে এল ভয়। আর সেই ভয়ের তাড়সেই সে বুনো শুয়োরের মতো এগোল।
মুখে দুটো জ্যাব পড়ল, পাঁজরে সোজা একটা। রোজারিওর পাঞ্চে জোর নেই, সে কোনওরকম ব্যথা টের পেল না, তখন সে খুঁজছে বাঁ হাতের পাল্লার মধ্যে ওই বুড়োটাকে পেতে। পেয়েও গেল। লেফট হুকের সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতেও একটা।
পড়ে গেল রোজারিও। রক্ত বেরিয়ে আসছে নাক দিয়ে। কয়েক হাজার কণ্ঠের চিৎকার একসঙ্গে বেরিয়ে বোমার মতো ফাটল। ওরা যা চাইছিল তা পেয়েছে।
পাপ্পা…পাপ্পা!
একটা ভীত কচি কণ্ঠস্বর। ছোট্ট ফোঁপানি।
পাপপা…ওহহ।
ক্যানভাসে উপুড় হয়ে থাকা রোজারিও ধীরে ধীরে মুখ তুলল। দুহাতে ভর দিয়ে নিজেকে তুলে তাকাল যেদিক থেকে ডাকটা আসছে। তারপরই ওর দুচোখে ঠিকরে উঠল দুর্দমনীয় জেদ আর ইচ্ছা।
সে তাকিয়ে দেখছিল রোজারিওকে। লোকটা মানুষ না অন্য কিছু! ওই দুটো ঘুসি খাওয়ার পরও উঠে দাঁড়াচ্ছে!
ফাইভ…সিক্স…
পাপ্পা প্লিইজ গেট আপ।
রোজারিও ছেলের দিকে মুখটা ফেরাল। গালের পেশি দুমড়ে গেল। টপটপ রক্ত থুতনি বেয়ে সাদা গেঞ্জিতে ঝরছে। বিড় বিড় করে কিছু বলল।
এইট…নাইন…
শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে রোজারিও উঠে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসল। একবারও পা কাঁপল না। চোখ বন্ধ করল না, টলে উঠল না।
কর্নার থেকে সে এগোল আবার ওকে মারার জন্য। রোজারিও মুখের সামনে। দুহাতের গার্ড রেখে পিছিয়ে গেল। আর তখনই প্রথম রাউন্ড শেষের ঘণ্টা পড়ল।
বিভ্রান্ত চোখে সে রোজারিওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, এত জোর লোকটা পেল কোথা থেকে? তিনটে নক আউট এই পাঞ্চেই হয়েছে, অথচ উঠে দাঁড়াল! কীসের জোরে! গেঞ্জির বুকের কাছটা রক্তে লাল। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। নিজের কর্নারে গিয়ে রোজারিও টুলে বসল।
পাপ্পা ইউ আর আ ফাইটার…পাপ্পা ইউ আর আ ফাইটার…পাপ্পা…
রোজারিওর একটা চোখের চারপাশ ফুলে উঠেছে। অন্য চোখে অদ্ভুত একটা হাসি। ভীষণ মজাদার এই লড়াইটা, তাই না রে, এমন একটা ভাব করে সে ছেলের দিকে তাকিয়ে। ডান হাতে গ্লাভসটা তুলে নাড়ল। ওর জীবনের সবচেয়ে দামি স্বপ্নটা সার্থক হয়েছে।
ফাস্ট রাউন্ড নক আউট হল না। কীরকম একটা বিষণ্ণতা তার মধ্যে ছেয়ে আসছে। হাত, পা, মুখ, তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে সুনীল ঝড়ের মতো নির্দেশ, উপদেশ দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
অন্য কর্নারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে ভবানীসারকে দেখতে পেল। মাথাটা ঝোঁকানো, ঠোঁট দুটো সামান্য খোলা…আমি নুইব না, নুইব না! সে নিজেকে তখন জিজ্ঞেস করল, আমি কি তা হলে সাধু হয়ে গেছি? এখন শিবাকে চাই…কোথায় সে?
পাপ্পা কাম অন…ফাইট।
তার বুকটা কেঁপে উঠল। মনের গভীরে সে অসহায়ের মতো শিবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রোজারিওর মুখটা ভবানীসারের মতো কেন?…রোজারিও পয়েন্ট তুলে নিচ্ছে তাকে হিট করে করে।
শিবাজি, নক হিম আউট, কাম অন শিবাজি।
চিৎকারগুলো আর তার মধ্যে উত্তেজনা আনছে না। সে আর মারতে চায় না, মার খেতে চায়। দ্বিতীয় রাউন্ড শেষে সে টুলে বসে দুহাতে মুখ ঢাকল।
শিবাজি ইজ আ চিট…ফেক হ্যায়, নকলি হ্যায়।
বলুক, ওরা বলুক। তোয়ালে নেড়ে সুনীল বাতাস করছে। আর কোনও উপদেশ-নির্দেশ দিচ্ছে না। বোধহয় বুঝে গেছে লড়াই শেষ, তৃতীয় রাউন্ডও দ্বিতীয়টার মতো হবে।
গোমসসার বহুবার বলেছিল, চ্যাম্পিয়ান তৈরি হয় তাদের ভেতরের একেবারে ভেতরের জিনিস থেকে…সেটা হল ইচ্ছা, মনের জোর, যাকে বলে উইল। রোজারিওর ইচ্ছা ছেলের সামনে বীর হবে। বীরের ছবিটা চিরকাল নীলের মনে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকুক। এই ইচ্ছা নিয়েই রিংয়ে উঠেছে।
সে কারও জন্য ছবি আঁকতে চায় না। তার কোনও ইচ্ছা নেই, তার কোনও নিজের লোক নেই। ভবানীসার হারেনি। রোজারিও হারবে না বুঝে গিয়েই সে তৃতীয় রাউন্ডের জন্য উঠে দাঁড়ায়।
লড়াই শেষে রেফারি তার হাতটা তুলে ধরেনি।
.
আর ইউ অ্যাশ্লিপ …শিবা?
গোমসের আলতো নাড়ায় শিবা খাড়া হয়ে বসল। ট্যাক্সি দেবদাস পাঠক রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে!
পেইন হচ্ছে?
না। একদম সেরে গেছে। ট্যাক্সি থেকে নামার পর শিবা বলল, কালই আমি জিমে যাব সার। আসবেন?
ইয়েস, অফকোর্স যাব।
.
১৩.
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে জাতীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়ানশিপস শুরুর আগের দিন লালবাগান জিম থেকে একটু দূরে স্কুটারে বসে সাধু কথা বলছিল পাশে দাঁড়ানো কান্তির সঙ্গে।
বলছ কী কান্তি, ছ-ছটা লড়াই কোনওক্রমে যে জিতল তাকে বলছ কিনা দারুণ ফর্মে আছে? শিবা তো এখন পয়েন্টের বক্সার!
সবার তাই-ই মনে হবে, কিন্তু আমি তো ওর ট্রেনিং দেখছি, একটু-আধটু বক্সিং যা বুঝি, তাতে বলতে পারি ও এখন দারুণ শ্যেপ-এ আছে। কাদের সঙ্গে ওকে লড়তে হবে তা অবশ্য জানি না, ড্র-টাই বক্সিংয়ে খুব ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার, তবে ফাইনালে সার্ভিসেসের রঙ্গরাজন উঠছেই। সিওল কাপে ব্রোঞ্জ গতবছর, এবার ম্যানিলায় মেয়রস কাপে গোল্ড পেয়েছে।
জানি। শুনেছি দারুণ জোরে মারে, কিন্তু স্লো। ম্যানিলায় দুটো নক আউট করে ফাইনালে একটা মঙ্গোলিয়ানের কাছে জিতেছে, বাইশ-সাত পয়েন্টে, বোম্বাই থেকে খবর আমি আনিয়েছি। ওর এগেনস্টে শিবার কোনও চান্সই নেই। আমি ওর ওপর টাকা ফেলতে রাজি নই।
অত জোর দিয়ে বোলো না সাধু…শিবা ওর ফর্ম লুকিয়ে রেখেছে, ওই ব্যাটা গোমসের এটা চালাকি। যদি ওর ওপর বাজি নাই ধরো তবু, সাবধানের মার নেই পলিসি নাও। যদি শিবা ফাইনালে ওঠে, তা হলে ওকে নক আউটের ব্যবস্থা করে রাখো। ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে কান্তি বলল।
কীভাবে? সাধুও ঝুঁকে পড়ল।
ব্যবস্থা হয়ে যাবে…কী দেবে সেইটে বলো।
পাঁচশো।
উহুঁ।
এক হাজার।
তুমি কামাবে পঁচিশ-পঞ্চাশ, আর আমি মাত্র এক!
আরে, ওকে তো এমনিতেই রঙ্গরাজন নক আউট করবে, ব্যবস্থা করার কোনও দরকার নেই।
নেই তো নেই। পরে কিন্তু আমার কাছে ছুটে এসে বাঁচাও কান্তি, ডুবে গেলুম বলে হাত চেপে ধোরো না।
কান্তি হাঁটতে শুরু করল। স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে সাধু কান্তির পাশাপাশি চালাতে চালাতে বলল, তুমি ঠিক বলছ, শিবা ফর্ম লুকিয়ে রেখেছে?
একশোভাগ শিওর আমি।
ও ফাইনালে যাবে?
যাবেই।
ঠিক আছে, কত চাও?
পাঁচ।
অ্যা! সাধু অবাক হয়েই গম্ভীর হয়ে গেল। শুধু বলল, ঠিক আছে।
আমি লোকাল অফিশিয়াল হয়েছি, বাইরের টিমগুলোকে লড়াইয়ের সময় দেখভাল করার দায়িত্ব আমার। স্টেডিয়ামে তুমি আমার ধারেকাছে আসবে না কিন্তু।
.
শিবার প্রথম লড়াই হরিয়ানার সতীশ শর্মার সঙ্গে।
স্টেডিয়ামের ভি আই পি এনক্লোজারের সামনে এরেনা-র মাঝামাঝি, রিং তৈরি করা হয়েছে, গ্যালারিতে পাঁচশো দর্শকও হয়নি। বক্সিং বছর তিরিশ-পঁয়ত্রিশ আগেও কলকাতায় জনপ্রিয় ছিল, যেমন ছিল কুস্তি। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান ছেলেরাও বক্সিং লড়ত। ভারতের ওলিম্পিক দলে কলকাতার বক্সার বা কুস্তিগিররাও নির্বাচন পেত। কিন্তু বক্সিং রিং বা কুস্তির আখড়া পশ্চিমবাংলায় এখন আর দেখাই যায় না। কয়েকটি মাত্র টিমটিম করে জ্বলছে। ক্রিকেট আর ফুটবল নিয়েই এখন মাতামাতি। গায়ের জোরের খেলায় বা যে-খেলায় সংবাদ মাধ্যমগুলোর ঢাকে কাঠি পড়ে না, বাঙালি ছেলেরা সেই খেলায় আর মাতে না।
কলকাতায় জাতীয় বক্সিং প্রতিযোগিতার প্রথম দিনে দর্শক যৎসামান্য হওয়ায় কেউই আশ্চর্যবোধ করেনি। পঞ্চম লড়াইটি ছিল মিডল ওয়েটের। শিবার কর্নারম্যান ফ্র্যাঙ্ক গো আর আগেরবারের মতোই সুনীল বেরা এবং অনিমেষ। রিংয়ে ঢুকে দুহাতে দড়ি ধরে শিবা নিজেকে ঝাঁকাচ্ছিল, পেশিগুলো আলগা করার জন্য। গোমস বিপরীত কর্নারের দিকে তাকিয়ে শিবাকে বলল, টেক ইট ইজি…মাথায় রক্ত চড়িয়ে দেবে না..মনে রেখো ফাইটারস আর ডিসকভারারস, ওর ফল্টগুলো বার করো।
শিবা পাঁচ-ছটি ত্রুটি শর্মার মধ্যে বার করেছিল প্রথম রাউন্ডেই।
কী মনে হচ্ছে? শিবার মুখ থেকে মাউথপিসটা বার করে গোমস জিজ্ঞেস করল।
টার্নিং খুব স্লো..দুহাতে জ্যাব নেই,..ইনফাইটিংয়ে আসতে চায় না।
গো শুধু মুচকি হাসল। সুনীল বরফজলের স্পঞ্জ শিবার ঘাড়ে গলায় ঘষতে ঘষতে বলল, দে না শেষ করে। গোক্স ঠোঁটে আঙুল রেখে সুনীলকে চুপ থাকতে ইশারা করল।
দ্বিতীয় রাউন্ডে সে শর্মার খুব কাছে ওয়ান-টু-থ্রি কম্বিনেশন পাঞ্চ মুখে চালিয়েই পিছিয়ে এল। শৰ্মা পায়ে পায়ে এগোচ্ছে, শিবা দড়ির দিকে সরে এল। এবার বাগে। পেয়েছি ভেবে নিয়ে শর্মা বিশাল একটা ডান হাতে ক্রস শিবার মাথার দিকে চালাবার জন্য শরীরের সব ভার ডান পায়ের ওপর রেখে নিজেকে প্রায় ছুড়ে দিল। বিদ্যুৎগতিতে শিবা সরে গিয়ে শর্মাকে দড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে দিয়ে পয়েন্ট তুলে নিল দুটো জ্যাব করে। তৃতীয় পাঞ্চটি দিতে যাচ্ছিল একটা আপার কাট, যেটা হয়তো নক আউট পাঞ্চই হত।
নো ও ও ও।
শিবা সংবিৎ ফিরে পাওয়া চোখে নিজের কর্নারের দিকে একবার তাকাল। গোক্স হাত তুলে রয়েছে। তার কাছাকাছি দাঁড়ানো একটি ব্যাজপরা লোকের ঠোঁটে তখন হাসি খেলে গেল এবং তারপরই ঠোঁট কামড়ে ধরল। লোকটি কান্তি।
রেফারি তুলে ধরল শিবারই হাত। তেইশ-দুই পয়েন্টে সে জিতেছে। স্টেডিয়ামের পশ্চিমদিকের এনক্লোজার থেকে তখন একটি গলা সারা এরেনায় প্রতিধ্বনিত হল, ওস্তাই—দ।
শিবা তাকাল। হাত তুলে নাড়ল। ননীর পাশে সে উৎপল চট্টরাজকে দেখতে পেল। আশ্চর্য ঘটক বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ভাল লড়েছিস।
দ্বিতীয় লড়াই রেলওয়েজের মকরন্দ সুলেকরের সঙ্গে। ছিপছিপে লম্বা এই মারাঠির ঘুসি পৌঁছনোর দূরত্বটা শিবার থেকে বেশি এবং বুদ্ধিমান বক্সার। গতবারের রানার্স। ম্যানিলায়ও ভারতীয় দলে ছিল।
শিবা হুঁশিয়ার হয়েই প্রথম রাউন্ডটায় শুধু দূরে দূরে চক্কর দিল। দ্বিতীয় রাউন্ডে সুলেকর কৌশল বদলে আক্রমণে এগিয়ে এল। শিবার মনে হল, নিশ্চয় তার প্রথম দিনের লড়াইয়ের ধরন দেখেছে সুলেকরের কোচ। তাই কায়দাটা বদল করল। তাকেও এবার বদলাতে হবে, চমকে দিতে হবে। সেও পালটা তেড়ে গেল।
সুলেকরের মুখোমুখি হয়ে দুহাত বৃত্তের মধ্যে ঢুকে এসে পর পর জ্যাব এবং রাইট ও লেফট হুক করে শিবা ওকে বিস্ময়ে ফেলে দিয়েই পিছিয়ে এল। কিন্তু সে যে তারপরও আবার তেড়ে আসবে, সুলেকর সেটা বোধহয় ভাবতে পারেনি। ওকে ধাতস্থ হতে সময় না দিয়ে সে এক-দুই, এক-দুই-তিন কম্বিনেশন পাঞ্চ চালিয়ে গেল। সুলেকরের তখন আত্মরক্ষা ছাড়া আর কোনও চিন্তা ছিল না এই রাউন্ডে।
মানসিক ভারসাম্য এক মিনিটের বিরতিতেই সুলেকর গুছিয়ে নিয়ে তৃতীয় রাউন্ড শুরু করল। কেন সে নিজের বিভাগে ভারতের অন্যতম সেরা, এবার সে শিবাকে তা বুঝিয়ে দিতে শুরু করল। তবে মাথায়, পেটে, বুকে ঘুসি খেয়েও কিন্তু শিবা তার আগ্রাসী লড়াই থেকে হটল না। পঁচাত্তর ভাগ ঘুসি সে এড়িয়ে গেল শুধু তার দ্রুতগতিতে। নিজেকে ঘুসি থেকে সরিয়ে নেওয়ার এবং ঠিক জায়গায় ঘুসি পৌঁছে দেওয়ার পাল্লাদারিতে শিবা টেক্কা দিল।
শিবা জিতল আট-পাঁচ। তুমুল উল্লাসধ্বনি ছাপিয়ে শোনা গেল একটা গলা, চালাইয়া যাও ওস্তাদ…কাইল আম্মা ফ্রি রিশকা চালাইমু, পয়সা নিমু না।
উৎপল চট্টরাজ আজও হাজির। শিবা দেখল তার পাশে মিতা। সে গ্লাভস-পরা হাত দুটো জোরে জোরে নাড়ল মিতার হাতনাড়া দেখে। এই মিতাই বোম্বাইয়ে চৌপট্টিতে বলেছিল, বক্সিং বিশ্রী, খালি ঘুসি মারা, মুখ ফাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু ব্যাপারটা যে শুধুই তা নয়, সেটা হয়তো আজ সে বোঝাতে পেরেছে। স্কিল, গায়ের জোর, বুদ্ধি, মার নেওয়ার ক্ষমতা…সবই তো সে আজ দেখাল।
দেখল ফ্র্যাঙ্ক গোমসও, মিতাকে। রাত্রে জোনাকির কোয়ার্টারে সে উৎপলকে জিজ্ঞেস করল, আজ আপনার পাশে গ্রিন শালোয়ার-কামিজ-পরা একটা মেয়ে ছিল। চেনেন তাকে?
চিনব না কেন! ও তো আমার শ্যালি, মিতা, পারমিতা!
ফাইনালের দিন ও যেন শিবার বাউট দেখতে আসে, কাইন্ডলি আপনি কি সেটা দেখবেন?…আই উইল টেক নো চান্সেস। মিস্টার চট্টরাজ, অ্যাড্রিনালিন বলে একটা রস বডিতে তৈরি হয় যদি ইমোশনালি কেউ এক্সাইটেড হয়। এই রসটা এক্সট্রা পাওয়ার দেয়, রোখ বাড়ায়, পুশ করে অলআউট যাওয়ার জন্য। ফাইনালে ওটা আমার দরকার।…সেদিন নিতুকে আসতে হবে, একজন টিচারকে শিবা রেসপেক্ট করে, ননীকে বলে তাকেও আনাব। রিংয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত ওর মেন্টাল বিল্ট আপে কোনও গলদ আমি রাখতে চাই না। চার্জড হয়ে রিংয়ে উঠবে ইমোশনটা সঙ্গে নিয়ে। আর সেটাই…।
সেটাই বা কী?
শিবার ফিরে আসা…আমারও কামব্যাক, উইথা ব্যাং…আ নক আউট আই ওয়ান্ট ফর দ্য রেজারেকশন।
সব ওয়েট বিভাগের মধ্যে শুধু মিডল ওয়েটের ফাইনালেই বাংলার একজন। হঠাৎ যেন হুঁশ ফিরল কলকাতার। দর্শক পাঁচ হাজার ছাপিয়ে গেছে।
ড্রেসিংরুম থেকে শিবা বেরোতেই যে পারছে তার পিঠ চাপড়াচ্ছে। প্রত্যেকের মুখে একটাই কথা: জিততে হবে। বাংলার মান রাখতে হবে।
আশ্চর্য ঘটক শুধু বলল, তুই জিতলে বক্সিংয়ের দিকে বাঙালিরা তবু একটু তাকাবে।
ফ্র্যাঙ্ক গোমসই শুধু অনুত্তেজিত। মুখে সামান্য হাসিও লেগে আছে।
কান্তি সরকার খুবই ব্যস্ত। সার্ভিসেসের ড্রেসিংরুমে বারবার যাতায়াত করছে। তত্ত্বাবধানের কাজে। শিবাকে রিংয়ের দিকে যেতে দেখে সে ছুটে এল। ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, সাবধান, তোকে ফাস্ট রাউন্ডেই নক আউট পাঞ্চ মারার প্ল্যান করেছে, রঙ্গার কোচকে আমি বলতে শুনলাম!
গোমস শিবার সামনে হাঁটছিল। ঝটিতি সে ঘুরে রাগি চোখে কান্তির দিকে তাকাল। কান্তি দাঁড়িয়ে গেল এবং দুপা পিছোল।
ওর কথাগুলো মাথা থেকে বার করে দাও…খুব হার্মফুল এখন এসব কথা…কনসেনট্রেট! গোস কথাগুলো বলল যখন শিবা কাঠের সিড়ি দিয়ে রিংয়ে। উঠছিল।
প্রথমেই একটা বিশাল চিৎকারে তাকে অভ্যর্থনা জানাল দর্শকরা। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে বোম্বাইয়ে ব্রেবোর্নের মতোই লাগল শিবার কানে। হঠাৎ একটা নাড়া পড়ল তার মাথার মধ্যে। সেদিনও ছিল ফাইনাল!…রোজারিওর কাছে সে হেরেছিল…ছেলের সামনে বীর হওয়ার জন্য বুড়ো বক্সার লড়েছিল।
ওস্তাইদ, এধারে তাকা..আমরা আইসাচি।
শিবার গ্লাভসের ফিতেটা আর-একবার শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছিল সুনীল। মুখ ঘুরিয়ে শিবা তাকাল। দেখতে পেল ননীকে। তার পাশে শক্তি দাস আর তার বউ সাগরমামি,…টাক, চশমা ভবানীসার।…উৎপল…টকটকে শাড়িপরা মিতা! তার দিদি, কোলে টুটুও!..শচীনকাকু!..দুর্লভ চক্রবর্তী, গ্যারাজ তা হলে বন্ধ রেখেছে!..দাদা কই?…ওই তো, সবাই হাত নাড়ছে, দাদা নাড়ছে না।
শিবা হাসল। দাদার স্বভাবটা সে জানে। ধীর, ঠাণ্ডা, সহজে বিচলিত হয় না। এই মুহূর্তেও হচ্ছে না।
রঙ্গরাজন রিংয়ে উঠল। হাততালি পড়ল। দুহাত তুলে মাথা ঝুকিয়ে সে অভিবাদন জানাল। তার কর্নারে কয়েকজনের সঙ্গে কান্তিও রয়েছে।
রিংয়ের মাঝে দুজনকে ডেকে রেফারি যখন বাঁধা গত আউড়ে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল, রঙ্গা তখন ঠাণ্ডা চোখে শিবার মুখের দিকে তাকিয়ে। খুনির মতো চাহনি। শিবার বুকের মধ্যে সিরসির করে উঠল। এইটেই হচ্ছে পরস্পরের বুকের পাটা মেপে নেওয়ার, অন্যের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত। সার বলে দিয়েছে, খবরদার, চোখ সরাবে না, পালটা তুমিও চোখ রাঙাবে।…শিবার চোখ জ্বলে উঠল।
ঘণ্টা পড়ল।
দুজনে পরস্পরের দিকে দ্রুত এগিয়ে এসেই পাঁচ হাত ব্যবধান রেখে থমকে গেল। দুজনেই কয়েক পা পিছোল। তারপর শিবা আবার এগোল। রঙ্গাও এগিয়ে এল। এবার দুজনে চক্কর দিয়ে ঘুরতে লাগল। মুখের কাছে গ্লাভস, এগোব এগোব ভাব দেখিয়ে, শিবা কুঁজো হয়ে দুলছে। রঙ্গার একটা সোজা ঘুসি শিবার মুখে পৌঁছবার আগেই সে মাথা সরিয়ে পালটা একটা সোজা বিদ্যুৎগতিতে বসিয়ে দিল রঙ্গার কপালের মাঝখানে। চিৎকার উঠল দর্শকদের, শিবা প্রথম ঘুসিটা মেরেছে।
রঙ্গা নাড়া খেয়ে তেতে উঠল। শিবার কাছে পৌঁছে কম্বিনেশন মারতে গিয়ে হাত আটকে গেল শিবার হাতে। রঙ্গা বাঁ হাতে শিবার গলা জড়িয়ে চাপ দিয়ে মাথাটা হেঁট করিয়ে ডান হাতে ছোট দু-তিনটে আপার কাট মুখে কপালে মারল। রেফারি এসে ওদের ছাড়িয়ে দিল। তারপর আবার দূরত্ব রেখে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ এগিয়ে আসার ভান দুজনেই করতে লাগল। যেন দুজনের হাতেই বন্দুক, কে প্রথম গুলিটা ছুড়বে! ছুড়ে যদি ফসকায় তা হলে অন্যজন শেষ করে দেবে। যদি ঘুসি ছুড়ে না লাগাতে পারো আর অন্যজন যদি তৈরি থাকে, তা হলে ঘুসি খেতে হবেই।
এই সময়ই শিবার চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। বাঁ হাতের গ্লাভস দিয়ে সে চোখ রগড়াল।…কয়েক সেকেন্ড পর জ্বলুনিটা বাড়ল। আবার সে গ্লাভস দিয়ে চোখ রগড়াল। তার মনে হল চোখের পাতা ফুলে উঠে ঢেকে দিচ্ছে তার দৃষ্টি।
রঙ্গা এগিয়ে আসছে। পর পর দুটো জ্যাব শিবার মুখে পড়ল। বাহুর ওপর আর বুকে আরও দুটো। টলে গিয়ে শিবা পেছনে হটে গেল…তার চোখ জ্বলছে, পাতা দুটো ভারী লাগছে…তার হাত চলছে কিন্তু রঙ্গার শরীরে লাগছে না।
কী হল চোখে! শিবা ভারী হয়ে যাওয়া চোখ টানটান করে দেখতে পেল রঙ্গা যেন। অবাক হয়ে লক্ষ করল তার অবস্থাটা। তার চোখেও বিভ্রান্তি। সেটা কাটিয়ে উঠেই সে শিবার দিকে এগোল এবং এক-দুই কম্বিনেশনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড একটা লেফট হুকে শিবার মুখ ঘুরিয়ে দিল।
শিবা প্রথমে আছড়ে পড়ল দড়ির ওপর। দুহাতে দড়ি ধরা অবস্থাতেই ধীরে ধীরে ক্যানভাসের দিকে নামতে লাগল তার দেহ। সারা স্টেডিয়াম স্তব্ধ, বিমূঢ়। এখন তার কানে এল:
ওস্তাইদ…এ কী অইল!
ক্যানভাসের ওপর উপুড় হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেফারির গোনা শুরু হল, ওয়ান…টু…
শিবা রে… মেয়েগলায় একটা ফোঁপানি উঠল।
রোজারিও…তুমি উঠেছিলে, তা হলে আমিও পারব না কেন?
সিক্স…সেভেন…
বহু দূর থেকে ক্ষীণ কচি গলায় কে যেন বলছে পাপা, গেট…আপ। শিবা মুখ তুলে দেখল রঙ্গা তার কর্নারে দাঁড়িয়ে, তার পায়ের কাছে রিংয়ের বাইরে কয়েকটি মুখ, তার মধ্যে রয়েছে কান্তিও।
শিবা উঠে পড়।
দাদার গলা। রাগি, বিরক্ত স্বর। ভোরে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সে ধাক্কা দিয়ে বলে…
শিবা উঠে দাঁড়াল। ঘণ্টা পড়ল রাউন্ড শেষের।
দড়ি গলে রিংয়ে উঠে এল গোস, সুনীল অনিমেষ।
কী হয়েছে চোখে? শিবাকে টুলে বসিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন গোত্স জানতে চাইল।
জানি না সার। কীরকম জ্বালা করছে, চোখ মেলে তাকাতে পারছি না। অসহায় কাতর স্বরে শিবা বলল।
ওর দুটো চোখের পাতা তুলে গো তীক্ষ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করল। জলে ভরে গিয়ে লাল হয়ে উঠেছে চোখ দুটো। আঙুলটা বাঁ চোখের চারপাশে বুলিয়ে গোমস নিজের চোখে লাগাল। চোখ কোঁচকাল।
ইটস বার্নিং।…কোনও শয়তানি ব্যাপার আছে। বলেই আঙুলটার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। জ্বালা করছে। সুনীল, তুমি ওর চোখের ওপর আঙুল বোলাও তো।
সুনীল স্পঞ্জটা অনিমেষকে দিয়ে ডান তর্জনীটা শিবার দুই ভ্র আর চোখের পাতায় বোলাল। জ্বালা করে উঠতেই বলল, সার, এ বিছুটির রস!
বারবার জলের ঝাপটা দিল সুনীল। কয়েকবার তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিল চোখ আর কপাল।
এখনও কি জ্বালা করছে? গোমস উৎকণ্ঠিত।
করছে।
গো নাউ শিবা, ডান্স…রঙ্গার রিচ-এর বাইরে থেকে মুভ করো…স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম হিম। গোমস মাউথপিসটা শিবার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ওকে তুলে দিল।
দ্বিতীয় রাউন্ড এবং অবিশ্বাস্য হল শিবা। চোখে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। রঙ্গার ঘুসির পাল্লার বাইরে থাকার জন্য সে চক্কর দিচ্ছে, দুই পা তাকে ঘূর্ণির মতো ঘোরাচ্ছে রঙ্গাকে ঘিরে। কাছাকাছি হয়ে এলে বাঁ হাতে রঙ্গাকে ঘুসি পাঠিয়েই পিছিয়ে যাচ্ছে। সারা স্টেডিয়াম তাজ্জব। শ্বাসরোধ করে তারা অপূর্ব একটা মানুষের আত্মরক্ষার লড়াই দেখে যাচ্ছে।
সে এটুকু বুঝেছে, রঙ্গাকে কাছে আসতে দেওয়া মানেই লড়াই খতম। ওর একটা জ্যাব, একটা হুক যদি আবার মুখে কি মাথায় পড়ে তা হলে সে আর দাঁড়াতে পারবে। না।…ডান্স, ডান্স…স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম হিম…রঙ্গার রিচ-এর বাইরে থাকতে হবে…সবাই হাসছে, হাসুক। লড়াইয়ের ওরা কী বোঝে! ওরা জানে কি তার চোখের অবস্থা?
রঙ্গা এগিয়ে এসে শিবাকে দড়ির ধারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। চোখের পাতা টেনে তুলে রেখে শিবা শুধু একটা কালো আবছা আকাররূপে রঙ্গাকে দেখছে। জলে ভাসা চাহনির মধ্য দিয়ে সে দুজনের মধ্যের দূরত্বটা হিসেব করে জলপোকার মতো সরে সরে যাচ্ছে। রঙ্গার মন্থর স্টাইল কিছুতেই ওকে বাগে আনতে পারছে না, যদি বা সে কাছে পৌঁছচ্ছে, শিবার বাঁ হাতের জ্যাব তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার সময় আদায় করে নিচ্ছে।
এবার হতাশ আর বিরক্ত হয়ে উঠল রঙ্গা। সে শুনেছে শিবাজি একজন বিপজ্জনক ফাইটার। তাকে বলা হয়েছিল এবং স্বচক্ষে এখানে দেখেছেও—পাঞ্চ করে অসম্ভব ফাস্ট…দুর্দান্ত ওয়ান-টু কম্বিনেশন, জ্যাবের সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক স্ট্রেট লেফট…আর ওই ফুটওয়ার্ক, স্পিড…কিন্তু এরকম এক ফাইটার পালিয়ে পালিয়ে লড়বে, রঙ্গা তা ভাবেনি। ওর চোখ দেখে তার মনে হচ্ছে, কিছু একটা হয়েছে! চোখ পিটপিট করেই জোর করে পাতা খুলে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রঙ্গার মনে হল, শিবাজি যেন ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না।
তা হলে এখনই তো মার দেওয়ার সুযোগ। কিন্তু শিবা এমন ক্ষিপ্রতায় তার পাঞ্চগুলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে যে,তাকে সুযোগ দিতে দিচ্ছে না। রেগে উঠে রঙ্গা দর্শকদের দিকে তাকিয়ে ডান হাত তুলে শিবাকে দেখাল। ভাবখানা—দেখছেন তো, এর সঙ্গে কী লড়ব!
গ্যালারিতে দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল উঠল। রঙ্গা একবার ভ্যাংচাবার জন্য। শিবার ফুটওয়ার্ক নকল করে দেখাল এবং এগিয়ে গিয়ে একটা সুইং ডান হাতে, আর বাঁ হাতে সোজা একটা। দুটোই সে ফসকাল। আবার সে এগোল, তবে হতাশভাবে এবং দুটো হাত নামিয়ে। এই প্রথম সে কনসেনট্রেশন নষ্ট করল। হুঁশিয়ার থাকার চেষ্টা না করে, মুখের সামনে প্রহরীর মতো সজাগ দুই হাতের মুঠি তুলে না রেখে দেখাতে চাইল, সে শিবাকে ধর্তব্যের বাইরে গণ্য করছে। প্রতিপক্ষকে উপহাসের পাত্র বানাতে গিয়ে সে নিজেকে ঢিলে করে দিল।
চোখের পাতা টান করে তুলে শিবা শুধু দেখতে পেল রঙ্গা তার থেকে ফুটপাঁচেক দূরে এসে গেছে, মুখের গার্ড নামানো!
তখনই বুকের মধ্যে কে যেন বিশাল চিৎকার করে বলে উঠল, বহু পয়েন্টে হেরে তো গেছিসই…শিবা এই তোর শেষ সুযোগ-মার।
রঙ্গা পিছিয়ে যাওয়ার বা হাত দুটো মুখের সামনে তোলারও সময় পেল না। রেফারি পরে বলেছিলেন, তিনি ঠিকমতো দেখে উঠতে পারেননি শিবার লেফট হুকটাকে। এত সুইফট, এক পা এগিয়ে এসে, এত ফাস্ট পাঞ্চ তিনি কখনও দেখেননি।
মুখের থেকে সামান্য তাচ্ছিল্যের রেশটুকু মুছে নেওয়ার সময়ও রঙ্গা পায়নি। মার, এই নির্দেশটা মাথা থেকে শিবার হাতে পৌঁছনো এবং নির্দেশ অনুযায়ী কাজটা এমন গতিতে ঘটল, যেটা রকেটের গতি মাপার যন্ত্রে ছাড়া ধরা সম্ভব নয়। কথাটায় বাড়াবাড়ি রয়েছে, কিন্তু শিবার এই ঘুসিটাও তো তাই-ই। সে তার সারা দেহ নিংড়ে ক্ষমতার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত বার করে লেফট হুকটা চালিয়েছিল। আকাশে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল এবং তিন-চার সেকেন্ড পর রঙ্গা ক্যানভাসে পড়ল বজ্রাহতের মতো।
রেফারির দশ গোনার পরও সে ওঠেনি।
.
শিবাজি যখন ঘুসিটা মারলে তখন তুমি কী ভাবছিলে?
শিবাজি, এই মুহূর্তে তোমার কেমন লাগছে?
শিবাজি, কত বছর বয়স থেকে বক্সিং করছ? কেন তুমি বক্সিংয়ে এলে?
কার কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছ?
তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? তুমি কতদূর পড়াশোনা করেছ? এখনও কি লেখাপড়া করো?
ড্রেসিংরুমে হতভম্ব চোখে শিবা প্রশ্নকর্তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। ওরা সাংবাদিক। শিবার গলায় ঝুলছে তিনরঙা রিবনে বাঁধা একটা মেডেল।
অ্যাত কথা আর অহন জিগাইবেন না, অর অহন একা থাকন দরকার। উদ্বিগ্ন অভিভাবকের উৎকণ্ঠা ননীর গলায়। কীভাবে যেন ম্যানেজ করে সে ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়েছে। যা জিগাইবার আমারে জিগান, সব হিসটিরি আমি কইয়া দিমু…তয় আইজ নয়, সময় কইরা রিশকা স্ট্যান্ডে একদিন আসেন…শিবা উঠ উঠ, তরে লইয়া যাইবার জইন্য হলে গেটে খাড়ায়ে আচে।
.
তখন মাঝরাত্রি। ননীর রিকশাটা পূর্বপল্লিকে চতুর্থবার চক্কর দিয়ে দেবদাস পাঠক রোড, বি.টি. রোড দিয়ে মিলনপল্লিতে সাধুর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসছে। এই রিকশা চালাচ্ছে শিবা, পিছনের সিটে বসে ননী।
পাগলের মতো চোখ কইর্যা সাধু কইতাচিল, শিবা ঘুসিটা তো রঙ্গারে মারে নাই, আমারেই আর একবার মাইরলঅ।…অর বহু টাহা নাকি লোকসান অইচে।…জনে জনে খোঁজ লইত্যাচিল কান্তিরে দ্যাখচ? কান্তিরে দ্যাখচ?
মাথা নিচু করে ধীর গতিতে শিবা প্যাডেল করে যেতে লাগল। কোনও মন্তব্য করল না।
হ্যাঁ রে শিবা, কাগজের লোকগুলান আইব তো?
জানি না, আমি তো ফুটবল-ক্রিকেট খেলি না।
একটু পরে সে বলল, যদি আসে, তা হলে তুই কী বলবি?
পরথমে কইমু, আমার এই পা দুইডা দ্যাহেন, ভাল কইর্যা দ্যাহেন। এই দিয়া চাইর বচ্চর আগে একদিন শিবারে আমি লাথি মাইরছিলাম। পা দুইডারে শিবা ভাইঙা দিতে পারত…দেয় নাই। বলার সঙ্গে সঙ্গে ননী তার দুই পা শিবার কাঁধের ওপর তুলে দিল।
এবার যদি পা দুটো ভেঙে দিই!
ভাঙ, ভাঙ…আমার সারা শরিলের হারগোর তুই ভাইঙা দে। আমার মইদ্যে অহন কী যে হইত্যাচে তরে আমি বোঝাইতে পারুম না।
মধ্যরাত্রে, নির্জন পথে, রিকশায় বসে ননীর চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়তে লাগল। শিবা রিকশা চালানো বন্ধ করে পেছনে তাকাল।
শেষ কবে আমি কেঁদেছি জানিস? হাসপাতালে যখন তোদের সবাইকে আমার বেডের পাশে দেখলুম। মনে হল আমি যেন আবার জন্মাচ্ছি। তখন মনে মনে বলেছিলুম, আমি ফিরব, আবার রিংয়ে উঠব।
শিবার ঘাড় থেকে ননী পা নামাল। দুজনের যেন বলার মতো আর কথা নেই, তারা চুপ করে বসে থাকল। একসময় ননী বলল, তর নবজনম অইল।
হ্যাঁ।
তাইলে কানতাচস না ক্যান? মায়ের প্যাট থেকে পইড়াই তো বাচ্চারা—
হঠাৎ দুহাত তুলে শূন্যে ঘুসি ছুড়ে, বিশাল অট্টহাসিতে নিশুত রাতে শূন্য পথ, জনবসতি এবং অন্ধকার ভরিয়ে দিয়ে শিবা হেসে উঠল, তারপর রিকশা থেকে নেমে এসে ছুটতে শুরু করল।
সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল রিকশাটা তার পেছনে বনবনিয়ে ধাওয়া করল।