শিবরামের ছেরাদ্দ
দুঃখু করছিলাম হর্ষবর্ধন বাবুর কাছে। ‘একটা ভারি আফশোস রয়ে গেল মশাই…!’
‘কীসের আফশোস?’ তাঁর জিজ্ঞাসা।
‘দেখুন, পরের দৌলতে তো অনেক খেলাম। জীবনভরই খাচ্ছি। বলতে গেলে পরের বাড়ি খেয়েই মানুষ….’
‘পরের খেয়ে খেয়ে?’
‘না। পরিও আছে তার মধ্যে, পরিদেরও খেয়েছি এনতার।’
‘পরি পেলেন কোথায় আবার।’
‘কেন, আমার বোনরাই তো একেকটা পরি। পরির মতোই দেখতে সবাই, তাদের কি পর বলা যায়! আমার বোনদের কি আপনি পর বলতে চান?’
‘না না। তা কেন বলব?’ তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বলেন।
‘তাদের ঘাড় ভেঙেও খেয়েছি বিস্তর। ভাইফোঁটার দিনটি তো বটেই, তা ছাড়াও আরও কতদিন। কিন্তু সে-দুঃখ নয়—সেতো সুখের কথাই। দুঃখ এই যে নিজের সুবাদে একটা খাওয়াও এজন্মে আমার হল না।’
‘কীরকম?’
‘ধরুন আমার অন্নপ্রাশনের খাওয়াটা খুব ঘটা করে হয়েছিল শুনেছি…মাছ মাংস লুচি-পোলাও-মেঠাই-মন্ডা কিছুই নাকি বাদ যায়নি। কিন্তু যদ্দূর ধারণা, আমাকে খেতে দেয়নি একদম। খেয়ে থাকলেও আমার এখন মনে পড়ে না।…তারপর পইতের খাওয়াটাও ফসকে গেছে আমার। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছলাম বলে পইতের সময়টা উতরে গেল কোন ফাঁকে—টের পেতে না পেতেই! আর পইতে হল না বলে বিয়েও হল না শেষটায়। বিয়ের খাওয়াটাও হল না। আর বিয়ের পর বছর বছর জামাইষষ্ঠীর খাওয়াগুলোও বরবাদ! বর হতে পারিনি বলে বাদ পড়ে গেল বেবাক!’
‘কেন, বিয়ে হল না কেন! যাদের পইতে নেই তাদের কি আর বিয়ে হয় না? আমার তো হয়েছে।’
‘আহা, আপনার জাতকুলের পরিচয় আছে তো। আমার তো আর তা নেই। বাপ-মা অকালে মারা গেলেন। কে বিয়ে দেবে বলুন? যেখানেই বিয়ের কথা পাড়ি, জিজ্ঞেস করে তোমরা কী জাত হে? আমি বলি বামুন। তো বলে পইতে দেখাও, দেখাতে পারিনে! পইতে নেই, এদিকে চকরবরতি—বামুন-কায়স্থ-বদ্যি কেউই মেয়ে দিতে চাইল না, উলটে শ্লোক ছুড়ে ছুড়ে মার লাগাল আমায়।’
‘শেলেট ছুড়ে? বলেন কী মশাই?’
‘শেলেট নয়, শোলোক। বলল যে, অজ্ঞাতকুলশীলস্য বাস দেয়ো ন কস্যচিৎ! শ্লোকের ঘায় চিতপাত হয়ে পড়তে হল বলতে গেলে।’
‘দুঃখের কথাই বটে!’
‘তারপর ধরুন, নিজের ছেরাদ্দর খাওয়াটাও আমার বরাতে নেই, কিন্তু সেজন্যে দুঃখ করে লাভ কী! যদ্দূর জানি, কেউই নাকি ওটা খেতে পায় না। পরের ছেরাদ্দে খেয়ে খেয়েই সে-দুঃখ ভুলতে হয়—পুষিয়ে নিতে হয় সবাইকে।’
‘তাহলে আর সে-দুঃখুটা রাখবেন না,’ তিনি বললেন—‘নিজের ছেরাদ্দর খাওয়াটা আপনি খেয়ে নিতে পারেন। ইচ্ছে করলে এখুনিই!’
‘কী করে?’
‘নিজের ছেরাদ্দ নিজেই করে—আবার কী করে?’
‘কীরকম?’
‘শাস্তরে সেরকম বিধান দিয়েছে। যে অপুত্রক, যার পিন্ডজল দেবার কেউ নেই, সেনিজের পিন্ডি নিজে দিয়ে পরলোকের পথ পরিষ্কার করে যেতে পারে। ভাটপাড়ার থেকে পন্ডিতদের বিধান আনিয়েছি আমি। আমার তো কোনো ছেলেপুলে হল না, নিজের ছেরাদ্দ নিজেই করে যাব বলে ঠিক করে রেখেছি।’
‘তাই নাকি? তাহলে আমাকেও…মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থা করতে হয়।’
‘একী! আপনিও যে শেলেট ছুড়ে মার লাগাচ্ছেন মশাই!’
‘শেলেট নয় শোলোক।’ আমাকে শুধরে দিতে হয় আবার।
অবশেষে আমার ভাগনে গোপালকে হাঁক পাড়লাম একদিন—‘এই ছাপানো চিঠিগুলো এইসব ঠিকানায় বিলি করে আয় তো…’
বলে নাম-ঠিকানার একটা লিসটি দিলাম ওর হাতে।
‘এ যে তোমার ছেরাদ্দের চিঠি গো মামা!’ চিঠি পড়েই-না ভড়কে গেছে—চক্ষু ওর চড়কগাছ।
‘বেঁচে থাকতে থাকতেই করে যাচ্ছি… তোরা করবি কি না কে জানে! শেষটায় নরকে পচে মরতে হবে। আর তা ছাড়া সত্যি বলতে…’, আসল কথাটা ফাঁস করি তারপর—‘আমার ছেরাদ্দ, যদিই-বা হয়, সবাই মিলে সাঁটাবে আর আমিই কেবল ফাঁক যাব, এ-চিন্তা আমার কাছে অসহ্য, তাই কেবল শুধু ছেরাদ্দ করেই নয়, নিজের ছেরাদ্দে পেট ভরে খেয়ে যেতেও চাই আমি।’
‘মাসিদের কাউকে তো নেমন্তন্ন করনি…’। গোপাল তালিকা পাঠ করে বলে, ‘বিনিমাসি, ইতুমাসি, পুতুলমাসি, জবামাসি, কাউকেই তো ডাকনি দেখছি।’
‘আহা, ওরা কখনো আমার ছেরাদ্দ খেতে পারে?…প্রাণে লাগবে না ওদের? তা, মাসতুতো বোনদের না করলেও তোর মামাদের…মাসতুতো ভাইদের প্রায় সবাইকেই করেছি, আর ওইসঙ্গে আমার লেখক বন্ধুদেরও।’
গোপাল সুবোধ বালকের মতন গড়গড় করে পড়তে লাগল চিঠিটা—
সময়োচিত নিবেদনমিদং মহাশয়, অমুক তারিখে আমার মামা চন্দ্রবিন্দু শিব্রাম চকরবরতি-র শুভ শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে আপনার সবান্ধব আগমন প্রার্থনা করি। ইতি, নিবেদক, বিনীত শ্রীগোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়…চিঠিটা কিন্তু ঠিক লেখা হয়নি মামা। কোথায় যেন ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে। খটকা লাগছে আমার।
‘ভুলটা পেলি কোথায়?’
‘শুভ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান—এমন কথা শুনিনি কখনো। শুভবিবাহ হয়ে থাকে জানি, শুভ অন্নপ্রাশনও হয়, শুভ উপনয়নও হতে পারে, কিন্তু শুভ শ্রাদ্ধ…?’
‘কেন, শ্রাদ্ধ কাজটা কি খুব অশুভ নাকি?’ বাধা দিয়ে আমি বলি—‘একজনের পরকালের কল্যাণের পথ সাফ করা হচ্ছে, সেটা কি খুব অশুভ কাজ?’
‘কিন্তু ওই চন্দ্রবিন্দু শিব্রাম…চন্দ্রবিন্দু…চন্দ্রবিন্দু’, আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে সে।
ওর বিড়ম্বনায় আমি বললাম—‘আরে চন্দ্রবিন্দু কেন রে? ওটা হল গে ঈশ্বর শিব্রাম। মরে যাবার পর ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে। সবাই ঈশ্বর হয়ে যায় না? মুখ্যু কোথাকার! কিচ্ছু জানিসনে!’
কিন্তু আমার ঐশ্বর্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই সেবেরিয়ে গেল চিঠি বিলোতে।
ফিরে এল সন্ধ্যে বেলায়, এসে বলল, ‘তোমার লেখক বন্ধুদের কেউই কিন্তু আসতে রাজি হল না। বুঝলে মামা?’
‘কেন, কী বললে তারা?’
‘একজন বললে, মরেছে নাকি? আপদ গেছে। দাঁড়াও, তোমায় মিষ্টিমুখ করাই। খোশখবর এনেছ।…বলে চলে গেল বাড়ির ভেতর। আমি বসে আছি তো বসেই আছি, সন্দেশ রসগোল্লা কী খাওয়ায় কে জানে!…’
‘নরানাং মাতুলক্রম বলে যে, তা মিছে না।’ বলে মনে মনে ওর তারিফ করে একটা শ্লোক ছুড়ে মারি আমিও—‘তারপর?’
‘বসে আছি তো বসেই আছি। অনেকক্ষণ বাদে বেরিয়ে এসে বললে, ‘একী, তুমি এখনও বসে আছ যে?’
‘আজ্ঞে আপনি কী খাওয়াবেন বললেন-না,’ আমি ওঁর মনে করিয়ে দিই।
‘তা ভাই, এই বাজারে মিষ্টি এখন কোথায় পাই? সন্দেশ-টন্দেশ সব কন্ট্রোল হয়ে যায়নি? বলে একগাল হেসে ফের তিনি বাড়ির ভেতর সেঁধুলেন। আমি চলে এলুম তখন।’
‘তারপর?’
‘একজন বললে, সত্যি মরেছে? না, খবর কাগজে নাম ছাপানোর মতলব?…তুমি জান ঠিক? শিব্রামটা মরেছে, আমার কিন্তু পেত্যয় হয় না। সহজে মরবার ছেলে নয়। তেমন পাত্রই না, আমাদের মেরে তারপরে যদি সেমরে। বলি, রামায়ণ পড়েছ তো? সেই যে…কৃত্তিবাস পন্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ, লঙ্কাকান্ডে গাইলেন গীত রামায়ণ। তিনি কী বলে গেছেন জান? বলেছেন, কী ধাতুতে তৈরি? মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী?…দাঁড়াও, আমি রামায়ণটা নিয়ে এসে শোনাই তোমায়। বলে তিনি ইয়া মোটা একখানা বই নিয়ে এলেন, দেখেই-না আমার চক্ষুস্থির! তক্ষুনি আমি সটকে পড়েছি সেখান থেকে—তাই-না দেখেই।’
‘আর সেখানে যাসনে কক্ষনো।’ আমি উপদেশ দিই।
‘মরে গেলেও না।…মানে, তুমি সত্যি সত্যি মারা গেলেও যাব না। আরেকজন বললেন, দ্যাখো বাপু, ওর ছেরাদ্দে গিয়ে কী হবে? ও তো আর আমার ছেরাদ্দে আসতে পারবে না। আমার স্মৃতিসভাতেও ওকে দিয়ে কাজ হবে না কোনো। ওর তো হয়েই গেল। ওর ছেরাদ্দই বলো আর স্মৃতিসভাই বলো—সেখানে গিয়ে আমার লাভটা কী শুনি?’
‘আসতে হবে না ওর।’ শুনে আমার রাগ হয়ে যায় বেজায়।
তারপর যথাদিবসে যথাসাধ্য আয়োজনে শ্রাদ্ধের পাঠ চুকল। যথারীতি মন্ত্র আওড়ালুম। নিজের পিন্ডি চটকালুম দু-হাতে। তারপর নিজেকেই খেতে হল তাই আবার। আত্মার কল্যাণে যা যা করণীয় করতে হল সব।
শ্রাদ্ধশান্তি সকালে নির্বিঘ্নে চুকে যাবার পর, বিকেলে ব্রাহ্মণ আর কুটুম্ব ভোজনের পালা।
‘মামা, তুমি লুকিয়ে থাকো এখন—ঘাপটি মেরে থাকো কোথাও।’ বিকেল না হতেই গোপাল বলল আমায়, ‘আত্মীয়রা তো সব আসবে এইবার। তোমাকে দেখতে পেলে তারা ভড়কে যাবে না? নেমন্তন্ন না খেয়ে ভিরমি খাবে সবাই।’
‘বা রে! আমার ছেরাদ্দ, আর নিজেই আমি দেখতে পাব না? সেকী কথা!’
‘দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এই ঘরটার ভেতর থেকে ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে দ্যাখো-না কেন!’ গোপাল বাতলায়—‘তোমাকে কেউ দেখতে না পেলেই হল।’
তাই হল। আত্মগোপন করে আত্মীয়স্বজনদের আবির্ভাব দেখতে লাগলাম। শুনতে লাগলাম সবার আহা-উহু—কত-না সমবেদনা। সকর্ণে শুনতে হল সোচ্চার সব প্রশংসা। আমি যে সত্যিই এহেন ভালো, এমন আদর্শ লোক ছিলাম তা আদৌ আমার ধারণা ছিল না। নিজেকে এত নি:স্বার্থপর, সদাশয়, মহৎ, উদারচেতা, পরহিতচিকীর্ষু ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন সন্দেহ করিনি।
তারপর পাতায় পাতায় বসে গেল সব একে একে। সেই পাতাবাহারের ওপর সেদিনকার যত বাহারি আহার এসে পড়তে লাগল।
‘এটা কী হে?’ শুধালেন একজন।
‘আজ্ঞে পানতুয়া।’ জবাব দিল গোপাল।
‘একী চেহারা পানতুয়ার!’
‘কারিগর জানাল যে এ-জিনিসের পানতুয়া এর আগে সেকখনো বানায়নি তাই চেহারাটা ঠিক যুতসই করতে পারল না।’
‘তা গোড়াতেই মিষ্টি কেন হে? লুচি তরকারি আনো না-আগে।’
‘আজ্ঞে, আজ বেস্পতিবার কিনা। চাল-গমের খাবার বিকেলে ব্যবহার নিষিদ্ধ যে! সরকারি মানা রয়েছে।’ বালক গোপালই বৃহৎ কর্মকর্তা হয়ে দেখা দিয়েছে।
‘লোকটার আক্কেল দ্যাখো একবার! বেছে বেছে এমন দিনে মরেছে যে ছেরাদ্দের তারিখটি পড়েছে ঠিক বেস্পতিবারের বারবেলায়?’ বিক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি—‘বদমাইশের ধাড়ি! এক নম্বরের শয়তান যাকে বলে।’
‘তা লুচি-রুটি-ভাতটাত নাই-বা হল। মাংস তো করতে পারতে?’ চমকে ওঠেন একজন—‘তার ঢালাও ব্যবস্থা হলেও শুধু তাই-ই চালানো যেত নাহয়।’
‘আজ্ঞে আজ নন-মিট ডে না?’ গোপালের মনে করিয়ে দেওয়া।
‘বদমাইশিটা দেখেছ একবার? এমনিভাবে হিসেব করে খরচা বঁাচিয়ে মরাটা…’ আরেক জনের পরচর্চা শুনতে হয়।
‘চকরবরতিরা কঞ্জুস হয়ে থাকে।’ আরেক জনের উতোর গাওয়া তার ওপর—‘আর-আর চকরবরতিরা না হলেও উনি তো নির্ঘাত!’
‘পানতুয়ার পর আর কী আছে হে?’ একজন শুধান।
‘শুধু পান।’
‘শুধু পান—অ্যাঁ?’ এবার সবাই সত্যিই হকচকান।—‘এর পরেই পান?’
‘দেখুন—দেখুন সবাই! চকরবরতির কান্ডটা দেখুন একবার।’ চেঁচিয়ে মাত করেন একজন—‘জ্যান্ত থাকতেও যা বরাবর দেখে এসেছি সেই স্বভাবটা তার মারা যাবার পরেও যায়নি। মলে কি আর স্বভাব বদলাবে? জীবদ্দশায় আমাদের খাওয়াতে কখনো এক পয়সা খসায়নি, খালি আমাদের ঘাড় ভেঙে খেয়েছে। আর এই মারা যাবার পর কেমন ব্যবহারটা করে গেল দেখছেন তো?’
‘স্বভাব যায় না মলে একথা যে বলে, সেকি মিথ্যে? বেঁচে থাকতে সারাজীবন লোকটা pun করে গেল, মারা যাবার পরও সেই pun দোষ তার ঘুচল না। রসগোল্লা-সন্দেশ-রাবড়ি নাহয় কন্ট্রোল, মানলুম, কিন্তু খাজা-গজা, বেঁাদে-মতিচুর, গাঙ্গুরামের দই, চন্দ্রপুলি শোনপাপড়ি এসবও কি ছিল না বাজারে? তা না— সেই punতুয়া আর তার পরে এই pun! খান, যত খুশি খান!’
‘তাহলে একটা গল্প বলি শুনুন। মলেও যে মানুষের স্বভাব যায় না তার প্রমাণ পাবেন। আমাদের সুখচরে তারিণীখুড়ো ছিলেন এক নম্বরের বুড়ো বদমাইশ! গাঁয়ের নাম সুখচর হলে কী হবে কাউকে সেসুখে চরতে দিত না। তাকে নিয়ে স্বস্তি ছিল না কারও। হুজ্জুত হাঙ্গামা বঁাধিয়ে রাখত সব সময়—এর নামে মামলা, ওর নামে মিথ্যে সাক্ষী, এর জমি দখল, ওর খেতের ফসল রাতারাতি কেটে নেয়া—এই সবই ছিল নিত্যকর্ম।
একবার দারুণ অসুখে পড়ল সে, শেষটায় মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে এল লোকটার। যতই পাজি হোক-না, মরতে হবে একদিন সবাইকেই। মরবার আগে সেগাঁয়ের সকলকে ডাকিয়ে পাঠাল তার ভাগনেকে দিয়ে—তিনকুলে তার ওই ভাগনেটাই ছিল কেবল। ভাগনে গিয়ে বললে সবাইকে, মামা আমার মৃত্যুশয্যায়, আপনাদের শেষ দেখা দেখতে চান একবারটি। শুনে সবাই এল—বেশ খুশি হয়েই বলতে কী! তারিণীখুড়ো তাদের দেখে বললে, বাপু সকল, আমার সময় তো ঘনিয়ে এসেছে, সারা জীবন ধরে তোমাদের আমি জ্বালিয়েছি, তোমরা যেন রাগ পুষে রেখো না, তাহলে মরেও আমার আত্মা শান্তি পাবে না—আমাকে মাপ করো তোমরা সবাই। কিন্তু একটা অনুরোধ আছে, আমার একটি কাজ তোমাদের করতে হবে। না, শ্রাদ্ধ-শান্তির ব্যবস্থা করে খরচের দায়ে ফেলতে যাচ্ছি না তোমাদের। তোমরা কেবল এইটি করবে—আমি মারা যাবার পরে আমায় না পুড়িয়ে, গাঁয়ের মধ্যে বাজারের মাঝখানে আমার দেহ একটা বঁাশের ডগায় বসিয়ে রেখো—যদ্দিন-না আমি আপনার থেকেই পচে-খসে যাই, বুঝেছ? এইভাবে আমার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই আমি। বুড়ো বামুনের এই শেষ প্রার্থনাটা তোমরা রাখবে, এই-না বলে খুড়ো তো চোখ বুজলেন। তারা আর কী করে, তাঁর আত্মার সদগতির জন্যে, তাঁরই উপদেশমতো, বঁাশের ডগায়, শূলদন্ডদানের মতোই তাঁকে বাজারের মাঝখানে খাড়া করে রাখল। এদিকে খুড়ো করেছে কী, মরবার আগের দিনে, সদরের হাকিম সাহেবকে বেনামি এক চিঠি লিখে রেখেছিল…তাতে লেখা ছিল,
আমাদের গাঁয়ের তারিণী চাটুজ্যেকে কে বা কাহারা খুন করিয়ে বাজারের মধ্যস্থলে একটি বংশদন্ডে লটকাইয়া রাখিয়া গিয়াছে। কে বা কাহারাই-বা কেন বলি, এই সুখচরের তাবৎ অধিবাসী সবাই মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া এই কর্ম করিয়াছে বলিয়া আমার বিশ্বাস।
ইতি,
বিনীত নিবেদক।
ব্যাস, আর যায় কোথায়! পরদিন পুলিশ সাহেব এসে দেখলেন সত্যিই তাই! গাঁ-সুদ্ধ লোকের হাতে দড়ি পড়ল, সবাইকে টানতে টানতে নিয়ে জেল-হাজতে পুরে দিল পুলিশ। মরবার পরও স্বভাব গেল না, মরেও গাঁয়ের সবাইকে ফাঁসিয়ে গেল তারিণী।…’
‘ফাঁসি হয়ে গেল সবার?’ জানতে চায় গোপাল।
‘তনয়ে তারো তারিণী! এই কারণেই বলে থাকবে বোধ হয়।’ আপন মনে নেপথ্যে আমি আওড়াই।
‘হ্যাঁ যা বলছিলাম…’ গোপালের জবাব না দিয়ে বক্তা বলতে থাকেন…‘চিঠিটা লিখে রেখে খুড়ো তার ভাগনেকে বলে রেখে গেছল তার মারা যাবার পরেই যেন সেচিঠিখানা ডাকে ছাড়ে। আমাদের চকরবরতিও তার এই টিংটিঙে ভাগনেকে মরবার আগে বলে গেছে নিশ্চয়। আমার ছেরাদ্দে কাউকে কিচ্ছুটি খাইয়ো না। উপযুক্ত মামার উপযুক্ত ভাগনে তো!’ বলে উনি জাজ্বল্যমান উদাহরণের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন—‘দেখুন-না, কেমন মিটিমিটি হাসছে আবার!’
‘মিটমিটে শয়তান!’ আরেক জনের সার্টিফিকেট।
‘এক নম্বরের বিচ্ছু!’
‘আমার কী দোষ?’ গোপাল এবার বিচ্ছুরিত হয়—‘টাকাকড়ি না থাকলে আমি কী করব? মামার প্রকাশকদের কাছে গেলুম টাকা চাইতে, তা উনি মারা গেছেন শুনে কেউ আর একটি পয়সাও ঠেকালে না। বলল, ‘‘টাকা? টাকা কোথায়?’’ আকাশ থেকে পড়লেন সবাই—‘‘ওঁর তো কোনো পাওনা নেই আমাদের কাছে। বিস্তর টাকা আগাম নিয়ে রেখেছিলেন। তাই উশুল হতেই এখন সাত বছর লাগবে—বই বেচে আদায় করতে হবে আমাদের। তা, বই বিক্রি হলে হয় এখন! লেখক পটল তুললে তো তার বই আর কাটে না ভাই বাজারে।’’ এইসব বলে বিদেয় করে দিল সবাই। আমি কী করব?’
‘যাক গে, যেতে দাও। এই পানতুয়াই গিলব গন্ডা পাঁচেক। সকাল থেকে উপোস করে আছি এখনে এসে সাঁটাব বলে—ওই পানতুয়াই সই! আনো তোমার পানতুয়া যত আছে।’ বলে পাতের পানতুয়ায় কামড় বসাতেই তিনি হ্যাক থু: করে উঠেছেন—‘ছ্যা ছ্যা, এ কীসের পানতুয়া হে?’
‘কাঁচকলার।’
‘কাঁচকলার পানতুয়া! জন্মেও কখনো শুনিনি—পানতুয়া তো ছানারই হয় বলে জানতাম।’
‘ছানা যে কন্ট্রোল তা কি আপনার জানা নেই মশাই?’ গোপাল তখন না জানিয়ে পারে না।
এমন সময়ে এক বুড়ো ভদ্রলোক লাঠি ঠুকঠুক করে ঢুকলেন আসরে। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে চেহারাটা ঠিক ঠাহর হল না। এসেই তিনি বললেন—‘বা! হক্কলেই আছেন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যাঁর নাকি ছেরাদ্দ তাঁকে তো কই দ্যাখতেছি না?’
কথাটা শুনেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। বলে আমি নিজের রসের কথা বেচে খাই, আর আমার বাড়ি এসে ওপর চড়াও হয়ে এই রসিকতা? তাও আবার বস্তাপচা একখানা? আনকোরা হলেও নাহয় কথা ছিল। আমার আর সহ্য হয় না।
দ্বারভেদ করে বেরিয়ে আসি আমি—‘দ্যাখবেন না ক্যান? এই তো দ্যাখতেছ্যান। আপনাগোর হামনেই তো খাড়া আছি দ্যাহেন!’
দেখেই-না সবাই দুদ্দাড় করে পাতা ফেলে দে দৌড়! এমনকী সেই বুড়ো লোকটিও, লাঠি ফেলে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে একেবারে উধাও!
‘মাটি করলে তো ভোজটা?’ গোপাল বলে—‘বললাম না তোমায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে? সাত হাঁড়ি এই কাঁচকলার পানতুয়া খাবে কে এখন?’
‘আমিই খাব। আবার কে খাবে? এই এত এত মিষ্টি জিনিস ফেলা যাবে নাকি? আমিই খাব সাত দিন ধরে।’
‘প্রাণ ভরে খাও মামা,’ বলল গোপাল—‘এ জিনিস ভিখিরিতেও মুখে তুলবে না, কুকুর বেড়ালেও ছোঁবে কি না সন্দেহ!’
‘খাব তার কী হয়েছে? সকালে নিজের পিন্ডি গিলেছি—সাত দিন ধরে কাঁচকলাই খাই এখন। আমার ছেরাদ্দর আর বাকি কিছু রইল না। পরের পয়ে আমার পয়সা—পরের পয়সায় আমার আয়—চিরকাল ধরেই দেখে আসছি। আর আমার বরাতে চিরটাকালই এই কাঁচকলা ভাই!’
মনের দুঃখে ভাগনেকে ভ্রাতৃসম্বোধন করে বসলাম।