শর্মার বকলমে
সত্যি বলতে কি বংশীধর অধিকারীর জ্বালায় আমাকে মীর্জাপুরের অত ভালো মেসটা ছাড়তে হয়েছিল। যেই কাগজ কলম নিয়ে একটা গল্প লিখব বলে বসেছি, ভদ্রলোক এসে একগাল হেসে বলতেন, কী লিখলেন একটু পড়ুন না শুনি! এখন লেখা হয়নি বললেও রেহাই ছিল না। খুব আগ্রহ দেখিয়ে বলতেন, কী লিখবেন ভাবছেন, তাই বলুন না শুনি।
দিনের পর দিন এরকম জ্বালাতন। মনে-মনে যাচ্ছেতাই বিরক্ত হলেও চেপে থাকতুম ভদ্রতার খাতিরে। বংশীধরবাবু কিন্তু অতি অমায়িক মানুষ। মাথায় টাক ছিল। গোলগাল মুখ। হাসিটা ছিল ভারি মিঠে! নাদুসনুদুস বেঁটে শরীর নিয়ে ধুপধুপ শব্দ করে গেণবাড়ির এঘর থেকে ওঘরে ঘুরে বেড়াতেন। সবার সুখ-দুঃখের খোঁজ খবর নিতেন। গায়ে পড়ে উপকার করতে চাইতেন।
কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছিল না ওঁকে। তিনমাস লেগে যেত একটা ছোট গল্প লিখতে। আর আশ্চর্য ব্যাপার, কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতেন, আমি লিখতে বসেছি। অমনি চলে আসতেন আমার কাছে। পাশে বসে মুণ্ডু বাড়িয়ে বলতেন, কই একটু পড়ন না শুনি… ।
বর্ষানাগাদ নকুড় মল্লিক লেনে তিনতলা বাড়ির ছাদে একটা চিলেকোঠা গোছের ঘর খুঁজে বের করলুম। বাড়ির মালিক এক কথাতেই ভাড়া দিতে রাজি হয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, বললেন, ভাড়া যা দেওয়ার দেবেন খুশিমতো। ও নিয়ে দরাদরি করব না। আপনি মশাই লেখক মানুষ! আমি আপনার লেখার ভক্ত।
কলকাতা শহরে কোনও বাড়িওলা এমন কথা বললে কোন লেখকের না মন আনন্দে থইথই নেচে ওঠে! তবু ভাড়ার ব্যাপারটা ঠিক করাই ভালো। অনেক বলেকয়ে পঞ্চাশ টাকা দিতে চাইলুম। বাড়িওলা ভদ্রলোক তাও নেবেন না। বলেন, বরং তিরিশ দেবেন। ওরে বাবা। আপনি একজন লেখক বলে কথা!
মেস থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে যখন ও বাড়িতে চলে যাচ্ছি, বংশীধর খুব বাধা দিয়েছিলেন। প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। একটু কষ্ট হয়েছিল বইকী, অতকাল একসঙ্গে বাস করেছি।
নকুড় মল্লিক লেনের বাড়িতে গিয়ে মহানন্দে গল্প লেখা শুরু করলুম। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। নিরিবিলি তিনতলার ওপর ছোট ঘর। এতবড় ফাঁকা ছাদ। প্রাণভরে আকাশ দেখা যায়। আর আমায় পায় কে? আকাশ না দেখতে পেলে কি মাথায় কিছু বড়-বড় ভাব আসে?
প্রথম রাতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় কাগজ কলম নিয়ে বসলুম। বসামাত্র প্লট এসে গেল। প্লটটা এই?
এক শিকারি বনের মধ্যে পথ হারিয়ে অবশেষে একটা পুরোনো ভাঙাচোরা দুর্গে পৌঁছলেন। খুঁজে খুঁজে একটা অক্ষত ঘরে ঢুকে রাত কাটানোর কথা ভাবছেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন একটা অদ্ভুত চেহারার লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে– দরজা দিয়ে নয়, দেয়াল থেকে। তার মানে দেয়ালে টাঙানো একটা ছেঁড়া ছবি থেকে। শিকারির বন্দুকে আর গুলি নেই। এদিকে ছবির লোকটা তার গলা টিপতে আসছে।
শিকারিকে না বাঁচালে গল্প হবে না। কীভাবে বাঁচাব তখনও ভাবিনি। লেখাটাতে শুরু করা যাক।
সবে দুলাইন লিখেছি, আমার কাঁধের ওপর কার নিঃশ্বাস পড়ল। চমকে উঠে দেখি কী আশ্চর্য, কী অসম্ভব ব্যাপার, মীর্জাপুরের মেসের সেই বংশীধর অধিকারী পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। একগাল হেসে ঠিক তেমনি চাপাগলায় বলে উঠলেন, কী লিখলেন, পড়ুন না শুনি!
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। ঘরের দরজা কি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলুম? নিশ্চয় মীজাপুর থেকে ভদ্রলোক এই বৃষ্টির মধ্যে নকুর মল্লিক লেনে হাজির হয়েছেন।
কিন্তু আমার এ ঠিকানা তো ওখানে কাউকে জানিয়ে আসিনি! উনি টের পেলেন কেমন করে?
মনের কথা চেপে ভদ্রতা করে বললুম, আরে আসুন বংশীধরবাবু! বসুন।
বংশীধরবাবু বললেন,–কই একটু পড়ুন না শুনি।
পড়ছি, পড়ছি, সবে তো দুলাইন লিখেছি। কিন্তু আশ্চর্য আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে–বলতে-বলতে থেমে গেলুম। বংশীধরবাবু হঠাৎ আঁতকে উঠে পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ওরে বাবা! এ ব্যাটা আবার কে? বলেই আবছায়া হয়ে গেলেন। তারপর বেমালুম অদৃশ্য!
তারপর দেখি ঢ্যাঙা রোগা এক ফো ভদ্রলোক ঘরের কোণা থেকে এগিয়ে আসছেন। এঁকে দেখেই বুঝি বংশীধরবাবু ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলেন?
গুঁফো ভদ্রলোক চোখ কটমট করে বললেন,–কে হে ছোকরা? কী লিখলে পড়ে শোনাও তো।
খুব রাগ হল এবার। নিশ্চয় দরজা বন্ধ করতে ভুলেছি! দরজার দিকটা ছায়ার মধ্যে বলে বোঝা যাচ্ছে না। বললুম, আপনি তো মশাই বলা কওয়া নেই ঘরের মধ্যে হুট করে ঢুকে পড়লেন যে?
গুঁফো ভদ্রলোক হি-হি করে হাসলেন, ইস! বিষ নেই কুলোপনা চক্কর! ভারি দুলাইন ছাইপাঁশ লিখেই ধরাকে সরা জ্ঞান করা হচ্ছে। জানো আমি কে? আমি বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক হলধর শর্মা।
শুনেই বড় লজ্জায় পড়ে গেলুম। হেঁট হয়ে পা ছোঁওয়ার চেষ্টা করে বললুম, ক্ষমা করবেন। আপনার কত বই আমি ছেলেবেলায় পড়েছি। তা আপনি বুঝি এ বাড়িতেই থাকেন?
–এ বাড়িতে কী বলছ হে? তার আগে পড়ো কী লিখলে শুনি।
হলধর শর্মা দুপা এগিয়ে এলেন। অগত্যা পড়তেই হল। লাইনদুটো শোনার পর শর্মা মশাই বললেন, হুঁ, শুরুটা ভালোই। তবে শিকারিকে একটা ঘোড়া দাও। বন্দুকের বদলে দাও তীরধনুক। জমবে ভালো।
–গল্পটা যে একালের শর্মা মশাই।
–গল্পের আবার কাল? যা বললুম লেখো। এই আমি বসলুম। পুরো লিখে ফেল। শুনে তবে যাব।
বেগতিক দেখে বললুম,–বাইরের লোকের সামনে আমার লেখা আসে না শর্মা মশাই।
শর্মা চটে বললেন, বাইরের লোক মানে? আমি তো এ ঘরেই থাকি বললুম না?
–এঘরে আপনি থাকেন মানে? অবাক হয়ে বললুম। এঘর তো খালি পড়েছিল। আমি বাড়িওলার কাছে ভাড়া নিয়ে আজ বিকেলে এঘরে এসেছি।
–ট্রেসপাস করেছ বাপু! পরের ঘরে এসে থাকা কি ভালো? একসময় এই ঘরেই আমি থাকতুম। তবে নেহাত এসেই গেছ যখন আপত্তি করব না। বিশেষ করে তুমি নতুন লেখক। তোমায় উপদেশ দেওয়া এবং সাহায্য করাই আমার কর্তব্য। কই লিখতে শুরু করো। আটকালে বলবে। আমি বলে দেব।
কাঁচুমাচু মুখে বললুম,–সেটা কি ঠিক হবে?
হলধর শর্মা খাপ্পা হয়ে বললেন, আলবাতঠিক হবে। নাও–আমি ডিকটেশান দিচ্ছি, লিখে যাও।
প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিকের কথা অমান্য করি কোন মুখে? অগত্যা ডিকটেশান নিতে শুরু করলুম। গোড়ায় যে দুলাইন লিখেছিলুম, তা কেটে দিতেও হল ওঁর নির্দেশে। তারপর লিখতে লিখতে টের পেলুম, সত্যি, এই হল পাকা হাতের রচনা। কী জমাট এই গল্পটা! ছাপা হলে হইচই পড়ে যাবে এবার।
লেখা শেষ হওয়ার পর হলধর শর্মা বললেন, আর তোমায় কষ্ট দেব না। এবার আমার প্রাতঃভ্রমণের সময় হল। তুমি বিশ্রাম করো। আবার কাল রাতে যথাসময়ে দেখা হবে।
কাগজগুলো গোছাচ্ছিলুম। গোছান শেষ করে ঘুরে দেখি শৰ্মা মশাই নেই। বুঝলুম, তাহলে এই বাড়িতেই কোনও ফ্ল্যাটে থাকেন। আমার সঙ্গে রসিকতা করছিলেন। কিংবা হয়তো লেখার জন্য ঘরটাও ভাড়া নিয়েছিলেন।
কিন্তু তারপর বুকটা ধড়াস করে উঠল, যখন দরজার কাছে গেলুম। এ কী! দরজা তো ভেতর থেকেই বন্ধ রয়েছে। হ্যাঁ–আমিই বন্ধ করেছিলুম, মনে পড়েছে। তাহলে?
ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় শুয়ে পড়লুম। তখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।
ঘুম হওয়ার কথা নয়। একটু বেলা হলে বেরিয়ে দেখি ছাদের কোণায় দোতলার মধুবাবু ডন দিচ্ছেন। কাল বিকেলেই আলাপ হয়েছে। ডন শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার স্যার! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে?
বললাম,–মোটও না মধুবাবু! সারারাত…
মধুবাবু চাপা হেসে বললেন, শর্মামশাই জ্বালিয়েছেন বুঝি? আপনাকে খুলেই বলি স্যার, এঘরে কেউ একরাত্তিরের বেশি বাস করেন না। তাই অ্যাদ্দিন খালি পড়েছিল। আপনাকে কালই আভাস দেব ভাবছিলুম, রাগ করবেন বলে সাহস পাইনি।
ব্যাপারটা কী বলুন তো?
মধুবাবু অবাক হয়ে বললেন,–সে কী স্যার? নিজে লেখক হয়েও জানেন না? শিশুসাহিত্যিক হলধর শর্মা কবে গত হয়েছেন। সেকি আজকের কথা? বছর সাতেক তো হবেই। তখন আমি স্কুলের ছাত্র।
কী করে জানব? আমি গ্রাম থেকে কলকাতার এসেছি মাস কয়েক আগে। সাহিত্যিকদের মধ্যে কে জীবিত, কে মৃত, তা নিয়ে মাথা ঝামাইনি। গল্প লিখি আর কাগজে পাঠাই। কোনও-কোনও লেখা ছাপাও হয়।
চুপ করে আছি দেখে মধুবাবু বললেন, জ্বালাতন বলতে ওই এক ডিকটেশান নিতে হবে। তা নিজেও যখন লেখেন, তখন আর অসুবিধেটা কী? দেখবেন সয়ে যাবে ক্রমশ।
শর্মারহস্য তাহলে ফাঁস হল। কিন্তু বংশীধর অধিকারী? তার আবির্ভাব দরজা আঁটা ঘরে!
মেসে খোঁজ নিয়ে জানলাম যেদিন আমি মেস ছেড়ে আসি, সেদিনই সন্ধ্যায় হার্টফেল করে মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল ষাট।
তবে সুখের কথা হল শর্মার ভয়ে বংশীধর আর আমায় জ্বালাতে যাননি। এদিকে শর্মা রোজ রাতে ডিকটেশান দিতে দিতে বলেন, শিগগির এবার তুমি ভালো গল্প লিখতে পারবে। এটাই শেষপর্যন্ত আমার পক্ষে আশার কথা।