Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) || Humayun Ahmed » Page 5

শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) || Humayun Ahmed

রুনু মারা যাবার পর

রুনু মারা যাবার পর আমার মনে হল মায়ের মৃত্যু আমি ঠিক অনুভব করতে পারি নি। মা যখন মারা যান। তখন অনেক রকম দুশ্চিন্তা ছিল, নিনুকে কে মানুষ করবে, ঘর-সংসার কী করে চলবে। কিন্তু এখন কোনো দুশ্চিন্তা নেই। রুনুর জন্যে কোনো কিছু আটকে থাকার কথা ওঠে না, কিন্তু সমস্তই যেন আটকে গেল। রুনুর কথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না। মনে হয় গভীর শূন্যতায় ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি। অসহ্য বোধ হওয়ায় লম্বা ছুটি নিয়েছি। দীর্ঘ অবসর সময়ও কাটে না কিছুতেই। একবার ভাবলাম বাইরে কোথাও যাই। কত দিন রুনুকে নিয়ে বাইরে যেতে চেয়েছি, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, কক্সবাজার, দিনাজপুরের পঞ্চগড়–কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আজ একা এক কি করে যাব?

কিছুই ভালো লাগে না। শুয়ে শুয়ে দীর্ঘ সময় কাটে। বাবা তাঁর ছোট ঘর থেকে কখনই বের হন না। তার হাঁপানি বড্ড বেড়েছে। মন্টু যে কখন আসে কখন যায়, বুঝতে পারি না। শুধু নিনুর দাপাদাপি শোনা যায়। সে খেলে আপন মনে। পাগলের মতো কথা বলে একা একা।

এক দিন রুনুর ছোট ট্রাঙ্কটা খুলে ফেললাম। কত কি সাজিয়ে রেখেছে সেখানে। প্রথম বেতন পেয়ে তাকে দশ টাকার নোট দিয়েছিলাম একটা। নোটের উপর লিখে দিয়েছিলাম, প্রিয় রুনুকে ইচ্ছে মতো খরচ করতে। রুনু সেটি খরচ করে নি। যত্ন করে রেখে দিয়েছে। একটি অতি চমৎকার মোমের পুতুল। আগে কখনো দেখি নি। কোথেকে এনেছিল কে জানে!, তার নিজের ফটো কয়েকটি, কিটকির ক্যামেরায় তোলা। স্কুলের ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় পাওয়া দুটি ছোট কাপ। একটি কবিতার বই, তাতে লেখা রাবেয়া আপাকে–রুনু। পাঁচ-ছটি সাদা রুমাল। প্রতিটির কোণায় ইংরেজি লেখা–তার নিজের নামের আদ্যক্ষর! পুরানো ডায়রি পেলাম একটা, পড়তে পড়তে চোখ ভিজে ওঠে।

১৭-১-৭১
আজ রাবেয়া আপা আমাকে বকেছে। মিটসেফ খোলা রেখেছিলাম, আর বিড়ালে দুধ খেয়ে গেছে। প্রথম খুব খারাপ লাগছিল। আপা সেটি বুঝতে পারল। বিকেলে আমাকে ডেকে এমন সব গল্প বলতে লাগল যে হেসে বাঁচি না। একটি গল্প এই রকম–এক মাতাল রাতের বেলা মদ খেয়ে উল্টে পড়েছে নৰ্দমায়। বিরক্ত হয়ে বলছে–ওরে ব্যাটা নৰ্দমা, তুই দিনের বেলা থাকিস রাস্তার পাশে আর রাত হলেই এসে যাস রাস্তার মাঝখানে? আপাটা কি হাসাতেই না পারে!

১৪-২-৭১
কিটকি আপা আমাকে এমন একটি কথা বলেছেন যে আমি অবাক। সবাইকে সে-কথাটি বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু বলা যাবে না। আপা আল্লার কসম দিয়ে দিয়েছেন।

৩০-৩-৭১
আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। দুপুরে আমি শুয়ে আছি, বাবা চুপি চুপি এসে ঘরে ঢুকে বলতে লাগলেন–রাবেয়া, রুনুটার কি হয়েছে? ও এমন মন-মরা থাকে কেন? আমি উঠে বললাম, আপা তো এখানে নেই বাবা। আর কই, আমার তো কিছুই হয় নি। বাবার মুখের অবস্থা যা হয়েছিল না!

২২-৫-৭১
আজ দুপুরে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। ও আল্লা, গিয়ে দেখি সিনেমা হলের লবিতে দাদা ঘুরছে। আমাকে দেখে বলল, কি রুনু মিয়া, সিনেমা দেখবে নাকি? তারপর নিজেই টিকেট কাটল। ছবিটা বড় ভালো।

৫-৬-৭১
মন্টুটা তলে তলে এত! আমাকে বলছে, তিন তিনটা ডি. সি-তে সিনেমা দেখাবে। যদি না দেখায় তাহলে সব ফাঁস করে দেব। তখন বুঝবে। মন্টুর একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাটি সে শুধু আমাকেই দেখিয়েছে, খুব অশ্লীল কিনা, তাই কাউকে দেখাতে সাহস হয় নি।

৯-৬-৭১
আজ সন্ধ্যাবেলা দেখি রাবেয়া আপা শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। খুব চাপা মেয়ে। কাউকে বলবে না তার কী হয়েছে। আমার যা খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

৯-৭-৭২
নিলুটার কাণ্ড দেখেশুনে অবাক হয়েছি। সেদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। আমি বললাম, কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?

সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, জান না তুমি, আজ ছেলেরা এক প্রফেসরকে মেরে ফেলেছে। আপামনি বলেছে ক্লাসে।

তাতে তোর কী হয়েছে?

দাদাকে যদি মেরে ফেলে, সেও তো প্রফেসর।

শুনে আমি হেসে বাঁচি না। ওর যত টান দাদার জন্যে।

হতাশা আর বিষন্নতায় যখন সম্পূর্ণ ড়ুবেছি, তখনি কিটকির চিঠি পেলাম। দেশে ফিরছি। কবে বলতে পারছি না। প্লেনের টিকিট পেলেই।

বদলে গেছিস কিটকি।

লম্বা হয়েছি, না?

হুঁ, আর রোগাও হয়েছিস।

আপনিও বদলেছেন, কি বিশ্ৰী গোঁফ রেখেছেন।

বিশ্ৰী?

হ্যাঁ, বিশ্ৰী আর জঘন্য, দেখলেই সুড়সুড়ি লাগে।

ম্যানিলার কথা বল।

সে তো চিঠিতেই বলেছি।

মুখে শুনি।

রাবেয়া ট্রেতে চা সাজিয়ে আনল। কিটকি হাসতে হাসতে বলল, রাবেয়া আপা আগের মতোই আছেন।

না রে, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, এই দেখ হাতে কত জোর।

উঁহু, উঁহু, আমার ঘাড় ভেঙে ফেলেছেন। বোন ফ্রাকচার হয়েছে নির্ঘাৎ।

বোন ফ্রাকচার হয় নি, হার্ট জখম হয়েছে কিনা বল।

রাবেয়া হাসতে হাসতে চলে গেল। কিটকি বলল, রুনুর কথা বলেন।

না, রুনুর কথা থাক।

মন্টুর নাকি একটা কবিতার বই বেরিয়েছে?

হ্যাঁ, কিছু কিংশুক নাম। তোমাকে নিশ্চয়ই দেবে এক কপি।

কেমন হয়েছে?

আমি কবিতার কী বুঝি, তবে সবাই ভালো বলেছে।

আপনার প্রফেসরির কী খবর?

খবর নেই কোনো। বেতন বেড়েছে। ব্যাঙ্কে কিছু জিমেছে। খরচ-পত্তর তো বিশেষ তেমন কিছু নেই।

রাবেয়া আপা শেষ পর্যন্ত বিয়ে করলেন না?

না।

কেন?

রাবেয়া করতে চাইল না, বাবা খুব চেষ্টা করেছিলেন।

কিটকি অনেকক্ষণ থাকল বাসায়। দুপুরে আমাদের সঙ্গে ভাত খেল। বিকেলে চা খেয়ে চলে গেল! কিটকিকে অন্যরকম লাগছিল। ছেলেমানুষী যা ছিল ধুয়ে মুছে গেছে। ভারি সুন্দর হয়েছে দেখতে। চোখ ফেরান যায় না, এমন।

সারা সন্ধ্যা কিটকির কথা ভাবলাম। ছোটবেলা কিটকি আমার জন্যে এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করত। এখনো করে কিনা কে জানে! তাকে সরাসরি কিছু বলার মতো সাহস আমার নেই, কিন্তু বড়ো জানতে ইচ্ছে করে। রাত দশটার দিকে রাবেয়া আমার ঘরে এল।

কি রে, জেগে আছিস?

রাবেয়া চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে খাটে বসল। চিরুনি কামড়ে ধরে বেণী পাকাতে লাগল।

খুব লম্বা চুল তো তোর!

হুই একটা বেণী কেটে নিয়ে যে কেউ ফাস নিতে পারবে।

প্রেমের ফাঁস, বল।

কিটকিকে দেখে খুব রস হয়েছে, না? মন পেয়েছিস কিটকির?

রমণীর মন সহস্র বৎসরেরও সখা সাধনার ধন।

তোর সাধনাই-বা কম কি? পাঁচ বছর অনেক লম্বা সময়।

রাবেয়া চুপচাপ বসে থাকল। কিছুক্ষণ। তার পর বলল, খোকা তোর কাছে একটা কাজে এসেছি।

কি কাজ?

আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দে, কিছু পড়াশোনা করি।

এত দিন পর হঠাৎ?

এমনি ইচ্ছে হল। শার এ কটা মাস্টার রেখে দিস, কিছু তো ছাই মনেও নেই!

আচ্ছা দেব। আবার ছেড়ে দিবি না তো?

না, ছাড়ব না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *