রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – অহীরাবণ বধ
রাম-গুণ গাইতে রে তনু পতন যদি রে হয়।
যায় অমর-ভুবনে, চাপিয়া বিমানে শমন চাহিয়ে রয়।।
অর্দ্ধ নাভিকূপে লয়েরে যখন ডুবায়।
শত শমন আসিয়ে তারে কি করিতে পারে,
পাতকী তরাতে শ্রীরামের নামটি
ওগো এসেছে সংসারে।।
মহীরাবণ মৈল দেখি যত নিশাচর।
ধাইয়া কহিল বার্ত্তা পুরীর ভিতর।।
পলায় সকল লোক কেহ নাহি রহে।
কপালে যা লেখা থাকে খণ্ডিবার নহে।।
আচম্বিতে রাজা লয়ে পড়িল প্রমাদ।
অন্তঃপুরে মহারাণী পাইল সংবাদ।।
রাজার মরণ শুনি রাণী জ্বলে কোপে।
আলুথালু বেশভূষা অধরোষ্ঠ কাঁপে।।
রাণী বলে এই ছিল যোগাদ্যার মনে।
এতকাল পূজা খেয়ে মারিল রাজনে।।
মহীরে দিলেক বলি দেবীর সাক্ষাতে।
মজিল রাজার রাজ্য মহামায়া হতে।।
দেবীর সহায় হয় কপি আর নর।
কি দোষেতে মহীরে ভাবিলা দেবী পর।।
আগে গিয়া প্রতিমা ডুবায়ে দিব জলে।
নর-বানরের প্রাণ লব শেষকালে।।
এতেক বলিয়া মহীরাবণের নারী।
ধনুক লইয়া উঠে মার মার করি।।
সঙ্গেতে সাজিল সেনা অসংখ্য গণন।
হনুর উপরে করে বাণ-বরিষণ।।
বড় বড় বৃক্ষ যত মারে হনুমান।
বাণেতে কাটিয়া রাণী করে খান খান।।
মনেতে ভাবিয়া কিছু না পায় মারুতি।
কোপ করি রাণীর উদরে মারে লাথি।।
দশমাস গর্ভ ছিল রাণীর উদরে।
প্রসবে সন্তান এক মহা ভয়ঙ্করে।।
অষ্টগোটা বাহু তার চারি গোটা মুণ্ড।
বিকট মূরতি তার দেখিতে প্রচণ্ড।।
ভূমিষ্ঠ হইল পুত্র অদ্ভুত বিক্রম।
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ যুগান্তের যম।।
মহাযুদ্ধ আরম্ভিল হনুমান সনে।
সাপটিয়া কীল লাথি মারে হনুমানে।।
গর্ভের রুধির পূঁজে ব্যাপিত শরীরে।
আচম্বিতে সংগ্রামেতে সিংহনাদ করে।।
উলঙ্গ উন্মত্ত যেন পাগল সমান।
তাহার বিক্রম দেখে হাসে হনুমান।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ হাসে দেখিয়া রাক্ষস।
হনুমান বলে বেটার বড়ই সাহস।।
এখনি জন্মিয়া পুত্র করে ঘোর রণ।
মহীরাবণের বেটা সে অহীরাবণ।।
আথালি পাথালি হানে মারুতির বুকে।
কিছু নাহি বলে হনু সম্বরিয়া থাকে।।
হনুমান বলে বেটার আম্বা দেখি অতি।
এখনি পাঠাব তোরে যমের বসতি।।
মারিবারে হনুমান ধায় উভরড়ে।
ধরিতে না পারে শিশু পিছলিয়া পড়ে।।
হেনকালে হনুমান চিন্তিল উপায়।
পবন স্মরণে রণে ঝড় বয়ে যায়।।
বিষম বাতাসে ধূলা লাগে তার গায়।
পাছরিয়া ধরে হনু আর কোথা যায়।।
দুই পদে ধরে তারে লয়ে ফেলে দূর।
পাথরে আছাড় মারি হাড় কৈল চূর।।
সংগ্রামে আইল আর যত যত জন।
লইল সবার প্রাণ পবন-নন্দন।।
পাতালবাসী মুনি ঋষি হৈল আনন্দিত।
ভয় দূরে গেল সবে মহা হরষিত।।
গেলেন দেবতাগণ আপনার স্থান।
হনুমানে সকলেতে করয়ে কল্যাণ।।
শত্রুরে মারিয়া যাত্রা কৈল তিন জন।
মহীর পূজিতা দেবী কহেন তখন।।
সাধিয়া রামের কার্য্য চলিলা সত্বর।
সেবা কে করিবে মম পাতাল ভিতর।।
এত শুনি হনুমান করি নমস্কার।
পাতাল হইতে করিল দেবীর উদ্ধার।।
হইয়ে হরিষযুক্ত চলে তিন জন।
আগে রাম পাছে হনু মধ্যেতে লক্ষ্মণ।।
সুড়ঙ্গের পথেতে উঠিলা তিন জন।
আপন কটকে গিয়া দিল দরশন।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে পেয়ে সুগ্রীব বিভীষণ।
জাম্ববানে দিল কোল এই তিন জন।।
হনুর প্রশংসা করে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
হনুমানে কোল দিল সুগ্রীব বিভীষণ।।
জাম্ববান কোল দিয়া কৈল আলিঙ্গন।
ধন্য হনুমান বলে যত কপিগণ।।
দুই প্রহর আকাশে যখন দিবাকর।
সিংহনাদ ছাড়ে তখন ভল্লুক বানর।।
চারি দ্বার চাপিয়া বানরের সিংহনাদ।
শুনিয়া রাবণ রাজা গণিল প্রমাদ।।
মহীরাবণ পড়িল শুনিয়া দশানন।
জীবনের আশা ছাড়ি করিছে ক্রন্দন।।
রামায়ণ গাহিল পণ্ডিত কৃত্তিবাস।
যেই জন শুনে তার পূবে অভিলাষ।।