রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – কুম্ভকর্ণের মৃত্যু শ্রবণে রাবণের রোদন
তবে রণভঙ্গে যত নিশাচরগণ।
রণস্তলী ছাড়ি কৈলা লঙ্কা প্রবেশন।।
যেথা কুম্ভকর্ণে পাঠাইয়া রাম-রণে।
দশানন চিন্তা করিতেছে মনে মনে।।
সমরে গিয়াছে আজি কুম্ভকর্ণ ভাই।
এখনি জিনিবে রণ কিছু শঙ্কা নাই।।
জয়বার্ত্তা দিবে দূত যে কালে আসিয়া।
তুষিব তাহারে আমি বহু ধন দিয়া।।
নগরে করিয়া নানা মঙ্গল-আচার।
ভ্রাতারে আনিতে নিজে হব আগুসার।।
না করিতে না করিতে প্রণাম আমারে।
অগ্রেই যে আমি কোলে করিব তাহারে।।
রণবেশ ঘুচাইয়া দিব্য বেশ করি।
দু’ভাই বসিব এক আসন উপরি।।
বন্ধুজন সকলে করিয়া আনয়ন।
নানামত উৎসব করিব আচরণ।।
এত ভাবি ক্ষণকাণ পরে দশানন।
উৎকন্ঠিত হয়ে পুনঃ করয়ে চিন্তন।।
ভ্রাতা মোর গিয়াছে হইল বহুক্ষণ।
এখনো না কৈল কেন দূত আগমন।।
বুঝিতে না পারি কিছু রণের বিষয়।
হইল কি না হইল শত্রু-পরাজয়।।
বুঝি শত্রুজয় নাহি হইয়া থাকিবে।
জয় হৈলে কেন মোর হৃদয় কাঁপিবে।।
এইরূপ করিতে করিতে মনোরথে।
শুনিতে পাইল কোলাহল ব্যোমপথে।।
তাহা শুনি হইয়া বিস্ময়যুক্ত মন।
উদ্বিগ্ন হইয়া করে বিবিধ চিন্তন।।
একি একি আজি দেব মুনি যক্ষগণ।
করিতেছে আকাশেতে জয় উচ্চারণ।।
বাঁচিয়া থাকিতে মোর কুম্ভকর্ণ ভাই।
উহাদের মুখে জয় শব্দ শুনি নাই।।
অতএব বড় শঙ্কা করে মোর চিতে।
না জানি হতেছে কিবা সংগ্রাম স্থলেতে।।
এইরূপ চিন্তা করে রাজা দশানন।
হেনকালে ভগ্নদূত কৈল আগমন।।
তারে দেখি জিজ্ঞাসে রাবণ সশঙ্কিত।
কহ রে কহ রে রণ-মঙ্গল ত্বরিত।।
ভীতমন হয়ে দূত কহিতে না পারে।
আরবার রাজা তারে কহে কহিবারে।।
তবে কান্দি কান্দি ভগ্নদূত কহে সভাস্থলে।
মহারাজ কি কহিব রণের কুশলে।।
তোমার অনুজ গিয়া সমর ভিতর।
বধিলেন বহুতর ভল্লুক বানর।।
পরে রাম-বাণেতে সে ত্যজিয়া পরাণ।
মহারাজ স্বর্গপুরে করিলা প্রস্থান।।
যেইমাত্র এই কথা চরেতে কহিল।
মূর্চ্ছা হয়ে দশানন ভূতলে পড়িল।।
তাহা দেখি মহাপার্শ্ব আর মহোদর।
উঠাইয়া বসাইল আসন উপর।।
কুম্ভকর্ণ-মৃত্যু-বার্ত্তা করিয়া শ্রবণ।
ক্রন্দন করয়ে যত লঙ্কাবাসী জন।।
মুহূর্ত্তেক পরে রাজা চেতন পাইয়া।
বিলাপ করয় শোকে কাতর হইয়া।।
ভাই নহি, আমি রে চণ্ডাল সহোদর।
কাঁচা ঘুমে জাগায়ে পাঠাই যমঘর।।
আজি হৈল শূন্যাকার নিদ্রার চউরি।
বীরশূন্য হইল কনক লঙ্কাপুরী।।
আজি হৈতে রাজ্য মোর হইল বিফল।
কুম্ভকর্ণ ভাই তুমি ছিলে মহাবল।।
চন্দ্র সূর্য্য বায়ু যম দেব পুরন্দর।
মহাসুখে নিদ্রা যাবে, ঘুচে গেল ডর।।
কোথা গেলে ভাই মোর আইস সত্বর।
দুই ভাই মিলি গিয়া করিব সমর।।
ডানি হস্ত গেল মোর এত দিন পরে।
লঙ্কাপুরে ক্রন্দন উঠিল ঘরে ঘরে।।
বিভীষণ ভাই মোরে দিয়া গেল শাপ।
ধার্ম্মিকের শাপে পাই এত মনস্তাপ।।
হায় হায় কি হইল, ক্রূর বিধি কি করিল,
প্রাণাধিক ভাই নিল হরি।
কি করিব কোথা যাব, কোথা গেলে তারে পাব,
তা বিনে কিরূপে প্রাণ ধরি।।
ওরে প্রাণাধিক ভ্রাতা, মোরে ছাড়ি গেলি কোথা,
দেখিতে না পাই আর তোরে।
ধিক্ ধিক্ প্রাণে মোর, শুনিয়া মরণ তোর,
এখনো না ছাড়ে এ শরীরে।।
কহি গেলে তুমি মোরে, মারি আসি রাঘবেরে,
আপনি বসিয়া থাক সুখে।
তাহা না করিতে পারি, নিজে গেলে যমপুরী,
ফেলিলে আমারে ঘোর দুঃখে।।
জিনিলে অসুর সুর, গন্ধর্ব্ব ভুজঙ্গপুর,
যক্ষ রক্ষ সিদ্ধ বিদ্যাধর।
জয় করি এ সংসারে, ক্ষুদ্র মনুষ্যের করে,
প্রাণ হারাইলে ভ্রাতৃবর।।
যে তোমারে শরীরেতে, নাহি পারি প্রবেশিতে,
বজ্র ভূমিতলে পড়েছিল।
সে তুমি রামে শরে, বিদ্ধ হৈলে কি প্রকারে,
আমার কপালে একি ছিল।।
আর আমি কি প্রকারে, জিনিব সে পুরন্দরে,
শমন বরুণ দৈত্যগণে।
উপস্থিত শত্রুজনে, কিরূপে বধিব রণে,
লঙ্কা রক্ষা করিব কেমনে।।
ওরে ওরে ভ্রাতৃবর, তোমা বিনা মোরে ডর,
না করিবে আর কোন জন।
অপর কি কব আর, যাবৎ বানর ছার,
তারা হৈল অশঙ্কিত মন।।
না মরিতে না মরিতে, আগে ঐ আকাশেতে,
কোলাহল করে দেবগণ।
বুঝি বা ইহার পরে, উপহাস করে মোরে,
করতালি দিয়া সর্ব্বজন।।
মারীচ কহিলা হিত, অতিশয় সমুচিত,
কহিলেক ভ্রাতা বিভীষণ।
তুমিহ কহিলে পথ্য, সব কথা অতিতথ্য,
কিছু নাহি করিনু শ্রবণ।।
ধার্ম্মিক বিশুদ্ধ মন, সেই ভ্রাতা বিভীষণ,
করিলাম তার অপমান।
সেই পাপে বুঝি মোরে, নর বানরের করে,
পাইতে হইল অপমান।।
তুমি ভ্রাতা যদি গেলে, কি ফল ঐশ্বর্য্যে বলে,
কি কার্য্য সীতায় আর প্রাণে।
কি ফল সমর জয়ে, কি ফল বান্ধবচয়ে,
প্রাণ দিব রঘুপতি বাণে।।